‘বাল্যখেলা’ - মানে বাল্যকালের প্রিয় খেলা। দাবা, লুডু, তাস, কেরাম, ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনের মতো ভদ্রলোকের খেলার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার আগে যে খেলাগুলোর প্রতি প্রবল ভালোবাসা ছিল সেগুলোকে বাল্যখেলা বলে ডাকতে চাই আমি। বাল্যখেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ঘুড়ি, ডাংগুলি, মার্বেল, লাঠিম, সাতচাড়া, বোমবাইট ইত্যাদি। হাডুডু, দাড়িয়াবান্দাও খেলেছি কখনো কখনো। প্রতিটা খেলার অনেকগুলো প্রকার ছিল, সে লাঠিম হোক, কিংবা মার্বেল। সবগুলো আজ মনেও নেই। তবু ভালো লাগার অনুভুতিটা এখনো পুরোনো দিনের শিহরন জাগায়।
আমার খেলোয়াড় জীবন হলো ব্যর্থতার ইতিকথা। জিতেছি কদাচিত। তবু নেশা হলো নেশা। হেরে যাওয়াও নেশাকে ঠেকাতে পারেনি। আজ বলবো ঘুড়ি নিয়ে নেশার গল্প।
ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে বহু লাল নীল ঘুড়ি মহাশূন্যে হারিয়েছি। সুতো মান্জা দেয়ার অদক্ষতার কারনে কাটাকাটি খেলায় কখনোই জিততে পারতাম না। তবু ঘুড়ি ওড়ানোর আগ্রহ এতটুকুও কমেনি। কাটাকাটিতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। আমার একমাত্র নেশা ঘুড়িটাকে আকাশের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় পৌছানো। কাটাকাটিতে আমার আগ্রহ না থাকলেও আগ্রাসন থামানোর কোন উপায় ছিল না। প্রায়ই দেখতাম ঘুড়িটা আকাশে ওড়ার সাথে সাথে কোথা থেকে এক দস্যি ঘুড়ি এসে হাজির। শুরু হতো আকাশ সন্ত্রাস। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া শুরুর মতো গোত্তা খেতে খেতে এগিয়ে আসতো আমার নিরীহ ভাসমান ঘুড়িটার দিকে। পালানোর উপায় নেই। নামিয়ে আনার আগেই সন্ত্রাসী ঘুড়ি হুশশ করে নেমে আসতো আমার সুতোর উপরে। মুহুর্তে ঘ্যাচ করে কেটে দিয়ে সরে পড়তো অজানায়। আশে পাশে বেশ কয়েকটা কলোনী থাকাতে সব কলোনী থেকে ঘুড়ি উড়তো। অত উপরে কে গোত্তা দিয়েছে বলাও মুশকিল ছিল। এই অদৃশ্য আততায়ীর কাছে লাল-নীল-সবুজ কত ঘুড়ি যে হারিয়েছি আর বাবার কত বকা খেয়েছি তার ইয়ত্তা নাই।
ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্যে আরেক নেশা হলো সুতো কাটা ঘুড়ির পেছনে ছোটা। কতযে কাড়াকাড়ি জাপটাজাপটি হতো এই কাটা ঘুড়ি নিয়ে এখন অবাক হই ভেবে। কারো কারো নিজেদের বাগান ছিল কলোনীতে। প্রায়ই শুনতাম অমুকদের বাগানের আমগাছে একটা ঘুড়ি আপনাআপনি এসে আটকে গেছে, তমুকদের নারকেল পাতায় পাংকি ঘুড়ি দেখা যাচ্ছে। কী যে হিংসে হতো। আফসোস হতো ইশ্ আমাদেরও যদি একটা বাগান থাকতো!!
লম্বা সুতো নিয়ে কাটা ঘুড়ি খুজে পাওয়া একটা ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। বড়দের মুখে, মানে নাইন-টেনের বড় ভাইদের মুখে প্রায়ই ওসব গল্প শুনতাম। আমরা ফাইভ-সিক্সের পোলাপান ওদের সাথে দৌড়ে পেরে উঠতাম না বলে কখনো অত বড় সুযোগ পাইনি। তাছাড়া কোন ঘুড়ি অলক্ষ্যে কাটা পড়তো না বললেই চলে। একবার ব্যতিক্রম হলো। দুপুর বেলা মাকে ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি দরজা খুলে পেছনের মাঠে যাচ্ছিলাম। হটাৎ সামনের আকাশের দিকে নজর পড়লো। লাল রঙের একটা ঘুড়ি স্থির ভাসছে। একা। কে ওড়াচ্ছে সুন্দর ঘুড়িটা। সুতোর গোড়া খুঁজতে খুঁজতে শেষ মাথাটা যেখানে দেখলাম, সেটা একটা কাঁটাঝোপ। আমার বুকটা ধক ফক করে উঠলো। ঝোপের সাথে আটকে আছে কাটা মাথাটা। এটা একটা কাটা ঘুড়ি। দুর কোথাও থেকে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে পড়েছে। দুপুর বেলা বলে কেউ খেয়াল করেনি। এতবড় সুযোগ আর কখনো আসেনি আমার জীবনে। আমি তাই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বেশী দেরী না করে দৌড়ে গিয়ে সুতোটা ধরলাম। অনেক লম্বা। টেনে নামাতে সময় লাগবে। তবু প্রানপনে টানছি আর সুতোগুলো হাতে পেঁচিয়ে নিচ্ছি।
বেশিক্ষন পারলাম না। পাশের তিনতলা দালানের ছাদ থেকে হুংকার এলো। “ওওওই…ও…ই…ওওওওই…….ওটা ধরবি না, আমরা আগে দেখছি, ছাড় এখনি…., খবরদার ছাইড়া দে, নাইলে মাইর খাবি” ছাদের কিনারায় দাড়িয়ে এসব বকে যাচ্ছে কলোনীর দুই শক্তিমান বড় ভাই। একটা অলিখিত নিয়ম ছিল কাটা ঘুড়ি ধরার ক্ষেত্রে। যার চোখ আগে পড়বে সেই ওটার মালিক। কিন্তু প্রায়ই নিয়মটা লংঘিত হতো যখন ঘুড়িটা আমার মতো পিচ্চিদের চোখে আগে পড়তো। নিয়মের চেয়ে শক্তির জয়ই বেশী হতো। এবারও তাই ঘটতে যাচ্ছে বলে আমি পুরা হতাশ। আমি শিওর যে ওরা আগে দেখেনি এই ঘুড়িটা, আমিই আগে দেখেছি। কিন্তু গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিবে এখন। তবে ছাদ থেকে নামতে সময় লাগবে, ঘুরে আসতে হবে চান্দুদের। ছাদের সিঁড়ি বিল্ডিংয়ের ভেতর দিয়ে এবং পথ হলো সামনে দিয়ে। এটা পেছন দিক। আমি তাই নির্ভয়ে হাত চালিয়ে যাই। ওরা আসার আগেই যতটুকু পারা যায়। হঠাৎ দেখি ছাদের কার্নিশ থেকে যে দুইটা পাইপ নীচে নেমেছে, তাতে হাত পা লাগিয়ে বানর দুটো নেমে আসছে তর তর করে। অবিশ্বাস্য! এখুনি ধরে ফেলবে আমাকে। একেই বলে বাড়া ভাতে ছাই। ঘুড়ির বাকী অংশ ছিড়ে রেখে হাতের নগদ পেঁচানো সুতোগুলো নিয়েই দিলাম ভোঁ দৌড়। এক্কেবারে পগার পার। এই ব্যর্থতার জ্বালা অনেকদিন আমাকে তাড়িয়েছে। এখনও চোখে ভাসে লম্বা মান্জা সুতো নিয়ে দুর আকাশে ভেসে থাকা নিঃসঙ্গ সেই কাটা ঘুড়িটা।
No comments:
Post a Comment