Sunday, July 30, 2023

খোলা চোখে.....ক্রমশঃ

১.
খাঁচায় আবদ্ধ মানুষ পাখির ডানার ছটফট নিয়ে ঘুরে মরছে। একেকটা মানুষ একেকটা দুঃসময় অতিক্রম করছে। একটু নিঃশ্বাস নেবার জন্য বাতাস থেকে অক্সিজেন ধার করতে গিয়ে কত মানুষ হাঁসফাস করছে।

২.
প্রত্যেক মানুষের একটা নিজস্ব গুহা আছে। সেই গুহার মধ্যে মানুষ বাস করে। নিজের চিন্তাভাবনাগুলো জমা রাখে। সারাদিন বাইরে ঘুরে ফিরে আবার সেই গুহাতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কেউ কেউ গুহা থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর রূপরস গন্ধ দেখে। আবার কেউ আছে গুহা থেকে বের হবে না বলে বদ্ধ পরিকর হয়ে আছে।

৩.
শেষ বয়স নিয়ে ভেবে লাভ নেই, শেষ বয়স মানে ৭০+ নয়। যে কোন সময়ই শেষ বয়স নেমে আসতে পারে মাথার ওপর। যখন করার কিছু থাকে না, তখন কিছুই থাকবে না। যে মরে যায় সে আসলে বেঁচে যায়। তাকে নিয়ে আহাজারি করে কাজ নেই। যে বেঁচে থাকে সেই আসলে মরে যায়। প্রতিদিন মরে। মরতে মরতে চিরমৃত্যু হবার পরই সে বেঁচে যায়।

৪.
প্রায় ৩০ বছর আগে আমি একবার গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কল্পনা করেছিলাম আমার এমন কোন দূরারোগ্য অসুখ হবে যা পৃথিবীর কোন ডাক্তার ধরতে পারবে না। সেই রহস্যময় অসুখে আমার মৃত্যু হবে। সেই মৃত্যুটা আমার বয়স ৩০ হবার আগেই ঘটবে। আমার মাথায় আবুল হোসেন ভর করেছিল সেই বয়স থেকেই। অথচ তার পর আরো বিশ বছর কেটে গেছে। এখনো বেঁচে আছি। কিন্তু দূরারোগ্য ব্যাপারটা এখনো মুছে যায়নি।

৫.
সুবিধাবাদী মানুষদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুবিধা হলো সেখানে প্লট খুঁজতে দূরে যেতে হয় না। আমার অধিকাংশ গল্পের প্লট আমার নিজেকে নিয়ে। অন্যকে নিয়ে লিখতে গেলেও আমার লেখা ঘুরতে ঘুরতে আমাকেই খুঁজে নেয়। পৃথিবীর যাবতীয় নেতিবাচক ধারণা আমাকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। সৃষ্টিতে থাকে বেদনা, ধ্বংসে থাকে আনন্দ। আমি পৃথিবীর সকল দুর্যোগে আনন্দিত হই। অথচ আমার বিবৃতি পড়ে আমাকে শান্তিবাজ বলে আখ্যা দিতে থাকে বোদ্ধা সমাজ।

৬.
সত্য ঘটনা নিয়ে গল্প লেখার মধ্যে তেমন কোন শৈল্পিক কৃতিত্ব নেই যতটা আছে মিথ্যা ঘটনা নিয়ে সত্যের চেহারায় একটা গল্পকে উপস্থাপন করার মধ্যে। মিথ্যা গল্পগুলোই পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্প।

৭.
প্রতিদিন যে জীবন যাপন করি তার ভেতরেই অনেক গল্প জমে থাকে। চোখের সামনেই জন্ম হয় অনেক গল্প। এক পলকের গল্প নিয়েও মুগ্ধ হওয়া যায়। দেখার চোখ থাকতে হয়। খোঁজার মত মন, অনুভব করার মতো হৃদয় এবং উপলব্ধির সততা থাকতে হয়। আমার চোখের সামনে সেরকম অনেক গল্পের অক্ষর, শব্দ, দাঁড়ি, কমা ভেসে যায়। আমি দেখতে থাকি, কিন্তু ছুঁতে পারি না।

৮. প্রতিটি নতুন আবিষ্কার একটা নতুন আনন্দের জগত। ইতিহাসের পাতা উল্টে প্রতিনিয়ত সেই আনন্দ উন্মোচনের চেষ্টা করে যাওয়া আমার প্রতিদিনের প্রিয় একটি কাজ।


Saturday, July 29, 2023

সুরাইয়া খানমের একটি নিখোঁজ কবিতা

অনেক বছর পর হঠাৎ করেই আজ সুরাইয়া খানম সামনে এসে দাঁড়ালেন আবার। শেষবার দাঁড়িয়েছিলেন তিনি প্রয়াত হবার দুবছর পর ২০০৮ সালে। যখন তাঁকে প্রথম জেনেছিলাম সচলায়তনের লেখক মুহম্মদ জুবায়ের ভাইয়ের এক লেখায়। সুরাইয়া খানম জুবায়ের ভাইয়ের পরিচিত ছিলেন তাঁর বড় বোনের সূত্রে। জুবায়ের ভাইও চলে গেছেন এক যুগের বেশি সময় আগে। কিন্তু সেই পরিচয় পর্বটা রয়ে গেছে তাঁর লেখায়। সে কথায় যাবার আগে আজ কিভাবে সুরাইয়া খানম সামনে এসে গেলেন সে কথা বলে নিচ্ছি।  

আজ সকালে পহেলা বৈশাখ ১৪৩০ ছুটির অবকাশে বাসায় বসে পাঁচ দশকের পুরোনো পত্রিকার আর্কাইভ দেখছিলাম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, অবজার্ভার, বাংলাদেশ টাইমস ইত্যাদি পত্রিকা আলগোছে উল্টে পাল্টে তখনকার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবরগুলো পড়ছিলাম। হঠাৎ করেই চোখ গেল ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায়। সেখানে সুরাইয়া খানমের একটি কবিতা। তারিখটা ১৪ এপ্রিল  ১৯৭৬। কবিতাটা পড়ে জুবায়ের ভাইয়ের সেই লেখাটির কথা মনে পড়ে গেল। পনেরো বছর আগে সুরাইয়া খানম সম্পর্কে তিনি একটা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করেছিলেন।


আমি জানতাম সুরাইয়া খানমের একটিমাত্র কবিতার বই। নাচের শব্দ। সেও প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালেই। এই কবিতা প্রকাশের দুমাস পর। নাচের শব্দে কবিতাটি থাকার কথা। বুকশেলফ থেকে ‘নাচের শব্দ’ খুঁজে নিয়ে দেখলাম ইত্তেফাকে ছাপা সেই কবিতাটি ওখানে নেই। সুরাইয়া খানমের অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে একটা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। দেখলাম সেখানেও নেই। যারা সেই সংকলনটি প্রকাশ করেছিলেন কবিতাটি হয়তো তাঁদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। 


নীলপদ্ম মুখ তুলে থাকে

সুরাইয়া খানম

আমাদেরও ডাকঘর ছিলো, দরজায় বাঁধা থাকতো

রাশি রাশি পাগলা ঘোড়া

বস্তা বস্তা চিঠি নিয়ে ছুটে আসতো অন্ধ পিয়নেরা-

আমাদেরও অলৌকিক লোক মাধুরী এসে

নাচের শব্দে ঢেলে দিতো ঘড়াজল

দুয়ারের বাসি কড়া নেড়ে

আমাদেরও পুষ্প নিকেতনে সম্ভ্রান্ত রেশমকীট

ঘুরে ঘুরে জটলা পাকাতো-

দূরে কাছে পৌষমাস ক্রমাগত সর্বনাশ হয়ে উঠলো

চাবুকের মত তীব্র অসুখের ছোবলে ছোবলে

রক্তের প্রদীপ জ্বেলে ছুটে ছুটে চলে যায় সীমান্তের দিকে

বিষধর মোহনায় জল ডাকাতের মত দুলে গেলো

একবার উড়ুক্কু মাছেরা

ঘাই দিয়ে শুশুক কোম্পানী এসে সারেঙ্গী বাজায়

অথচ ফেরে না আজও অন্ধ পিয়নেরা- নীল পদ্ম মুখ তুলে থাকে

ওরা সব বসে থাকে বটতলার মৌচাকের ঝাঁকে

রোলড্  গোলডে্ চোখ ঢেকে পিতলের প্রবল জলসায়-

ডাকঘর / অঙ্ক পিয়ন/ পাগলা ঘোড়া

ওরা সব সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে আগুনের বৃক্ষের নিকটে

নীল পদ্ম মুখ তুলে থাকে-

…………………………………………………………………….

[দৈনিক ইত্তেফাক, পহেলা বৈশাখ, ১৪ এপ্রিল ১৯৭৬]


সুরাইয়া খানমের নিজের সৃষ্ট কবিতার সংখ্যা তেমন বেশি না হলেও আবুল হাসানের কারণে তিনি খুব পরিচিত ছিলেন সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে। আবুল হাসানের জীবনের ওপর লেখা কবি মোশতাক আহমেদের ডকু ফিকশন ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ প্রকাশের পর সে পরিচয় আরো বিস্তৃত হয়েছে। তাঁদের পরিবারের তিন বোনই বিখ্যাত ছিলেন। ভয়েস অব আমেরিকার দিলারা হাশেম, রক্তকরবীর নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাত দিলশাদ খানম এবং সুরাইয়া খানম -প্রত্যেকে ষাট দশকের এক একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। 

সুরাইয়া খানমের সাথে কবি আবুল হাসানের বন্ধুতার কথা সত্তর দশকে ঢাকা শহরে আলোচিত বিষয় ছিল। সেই সম্পর্কটা নিয়ে নানান রটনা ছিল। আহমদ ছফা সেইসব নিয়ে উপন্যাস পর্যন্ত লিখে ফেলেছিলেন। কিন্তু সুরাইয়া খানমের ওপর লেখা আমার প্রথম পঠিত স্মৃতিচারণটি ছিল একজন প্রত্যক্ষদর্শীর। তিনি আমার সহব্লগার অগ্রজ লেখক মুহাম্মদ জুবায়ের। ২০০৮ সালে সুরাইয়া খানমের ২য় মৃত্যুবার্ষিকীতে সচলায়তনে প্রকাশিত জুবাইয়ের ভাইয়ের সেই স্মৃতিচারণা তাই আজ আবারো সামনে এসে দাঁড়ালো। 

১৯৭৬ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আবুল হাসানের অন্তিমপর্বে সুরাইয়া খানমের একটি ঘটনার সাক্ষী ছিলেন জুবায়ের ভাই। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর স্মৃতিচারণের খানিকটা অংশ পড়া যাক:

১৯৭৩-এ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় সুরাইয়া আপা ছিলেন না, শিক্ষক হয়ে এলেন ওই বছরের শেষের দিকে অথবা ৭৪-এর শুরুতে। ক্যামব্রিজে পড়া বিদুষী এবং অসামান্য রূপসী সুরাইয়া খানম সাড়া জাগালেন অবিলম্বে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে মহিলা শিক্ষকদের আপা বলে সম্বোধন করার প্রচলন ছিলো না। ম্যাডাম বলা হতো, সম্ভবত এখনো হয়। সেই হিসেবে সুরাইয়া খানমকে আমারও ম্যাডাম সম্বোধন করার কথা। হয়নি, তার পেছনে আমার ছোটো বোন ঝর্ণার খানিকটা অপ্রত্যক্ষ ভুমিকা ছিলো। ঝর্ণা থাকতো শামসুননাহার হলে, সুরাইয়া খানম সেখানে হাউস টিউটর হয়ে এলেন। তাঁর জন্যে আলাদা আবাস বরাদ্দ হলো না। অথবা করতে পারলো না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তিনি তখন সংসারী নন, একা মানুষ। তাঁকে থাকতে দেওয়া হয়েছিলো ছাত্রীদের জন্যে নির্ধারিত একটি কক্ষে। নম্বর ২৪০। ঠিক পাশেই ২৩৯-এর বাসিন্দা ঝর্ণার সঙ্গে তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠতা হয়। ঝর্ণার জন্যে তাঁর বরাদ্দ স্নেহ-প্রশ্রয়ের কিছু আমার ভাগে এসে পড়ায় তিনি সুরাইয়া আপা হয়ে গিয়েছিলেন। ক্লাসে আমার নিয়মিত অনুপস্থিতির ফলে বেশি যোগাযোগ ছিলো না, ছাত্র হিসেবে আমার নিতান্ত অনুজ্জ্বলতাও হয়তো একটি কারণ।

১৯৭৫-এর ২৬ নভেম্বর। সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে খবর পাওয়া গেলো, তরুণ কবি আবুল হাসান প্রয়াত। তাঁর কবিতা আমার প্রিয়। আবুল হাসান দীর্ঘকাল অসুস্থ ছিলেন, সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসার জন্যে তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো বার্লিনে। যতোদূর জানি, একজন কবির চিকিৎসার জন্যে সরকারি তৎপরতা ও সহায়তার ঘটনা বাংলাদেশে সেই প্রথম। ফিরে আসার পর হাসান অল্প কিছুদিন ভালো ছিলেন, তারপর তাঁকে আবার পি জি হাসপাতালে (এখন শেখ মুজিব হাসপাতাল) ভর্তি করতে হয়। চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, সুরাইয়া আপা ছাড়েননি। আবুল হাসানের সঙ্গে সুরাইয়া আপার বন্ধুত্ব বা ততোধিক ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো, এই মর্মে কথাবার্তা শোনা যেতো। সেসব প্রসঙ্গ অবান্তর, কবির সেই শেষ সময়ে সুরাইয়া খানম অবতীর্ণ হয়েছিলেন মমতাময়ীর ভূমিকায়।


প্রিয় কবির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ক্লাস করতে যাওয়া যায় না। পি জি হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম উদভ্রান্ত সুরাইয়া আপাকে, প্রয়াত কবির বিছানার পাশে দাঁড়ানো। তাঁকে অমন করুণ ও অসহায় আগে কোনোদিন দেখিনি। কিছু কিছু ছবি চিরকালের মতো হৃদয়কন্দরে জেগে থাকে, তাঁরে সেই মুখ আজও ভোলা হয়নি। কবির বন্ধু-আত্মীয়-ভক্তরা তখন ধীরে ধীরে সমবেত হচ্ছেন পি জি হাসপাতালে কবির অন্তিম শয্যাটিকে ঘিরে। অতো মানুষের সংকুলান সেই ছোট্টো কক্ষে হওয়ার কথা নয়, আমরা কেউ কেউ বাইরে বারান্দায় দাঁড়ানো। সুরাইয়া আপা হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। কী ভেবে কে জানে, আমার হাত ধরে বললেন, ‘ওরা হাসানের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। তা কিছুতেই হতে পারে না, হাসানের খুব ইচ্ছে ছিলো তার কবর হবে রেসকোর্সের একপাশে। সে বলে গেছে। আমার কথা কেউ শুনছে না, তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে ওদের?’


জীবনে একেকটা অসহায় সময় আসে যখন মানুষ খুব অবুঝ ও যুক্তিহীন হয়ে যায়। তখন অতি সামান্য কিছুকেও শক্ত অবলম্বন ভাবতে ইচ্ছে করে। না হলে এতো মানুষ থাকতে সুরাইয়া আপা আমাকে এই অনুরোধটি কেন করবেন? আমার কী ক্ষমতা, আমি তো সত্যিই কেউ না, আমার কথা কে শুনবে? তাঁর তখন সেসব বিবেচনা করার অবস্থা নেই। বুঝতে পারি, অনেকের কাছে প্রত্যাখ্যাত ও উপেক্ষিত হয়ে সবাইকে তিনি একই অনুরোধ করে যাচ্ছেন, হাসানের কবর যেন ঢাকায় হয়। হঠাৎ রাহাত খানকে দেখতে পাই। আমি সুরাইয়া আপাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাই। বলি, ‘রাহাত ভাই কিছু একটা করতে পারবেন হয়তো।’


নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে সরে এসেছিলাম সেদিন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া আর কোনোদিন হয়নি। আমি পেরে উঠিনি। সুরাইয়া আপা একটিমাত্র অনুরোধ করেছিলেন, যা রক্ষা করার ক্ষমতা আমার ছিলো না।

[আমাদের সুরাইয়া খানম, মুহম্মদ জুবায়ের, সচলায়তন- ২৪ মে ২০০৮]

http://www.sachalayatan.com/zubair/15395


সুরাইয়া খানম ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব অ্যরিজোনাতে পিএইচডি করে সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। আমেরিকাতেই বাকী জীবন কাটিয়ে তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন ২০০৬ সালের ২৫শে মে।

—-------------------------

(১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১লা বৈশাখ ১৪৩০)


সেই সব রঙিন দিনগুলো

সব মানুষের জীবনে কিছু রঙিন দিন থাকে, কিছু থাকে ধূসর, কিছু কালো অন্ধকার। জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দেবার পর আমরা যখন ধূসরতার দিকে এগিয়ে যাই তখন রঙিন দিনগুলো বিস্মৃত হতে থাকি ধীরে ধীরে। এমনকি  অ্যালবামের রঙিন ছবিতেও শ্যাওলা ধরে যায়। সে কারণে কিছু স্মৃতির পোস্টার আলগা করে তুলে রাখা দরকার ভবিষ্যতের জন্য। যে শিশুরা একসময় অবোধ অবুঝ ছিল, তারা যখন বড় হবে তখন তাদের চোখে পড়বে সেইসব রঙিন দিন। আমাদের প্রিয় কয়েকটি ভ্রমণ স্মৃতি নিয়ে কয়েকটি প্রিয় পোস্টার। ২০১০ থেকে শুরু হবে শুধু কক্সবাজার ভ্রমণ নিয়ে। যখন থেকে ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলার যাত্রা হলো। আমাদের বিবর্তন এবং কক্সবাজারের বিবর্তনের ছবি।


কক্সবাজার: ২০১০










কক্সবাজার: ২০১১








কক্সবাজার: ২০১২









কক্সবাজার: ২০১৪









কক্সবাজার: ২০১৫








কক্সবাজার: ২০১৯








কক্সবাজার: ২০২৩




 


Wednesday, July 26, 2023

অনুবাদ বিতর্ক: মার্কেজের শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা

প্রায় সাত বছর আগে মার্কেজের Hundred Years of Solitude এর একটি অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল বিডিআর্টসের পাতায়। সেটা নিয়ে  পুরোনো একটা বাকযুদ্ধ চোখে পড়লো সেই অনুবাদ পাতায়। বাকযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বেশ কজন বোদ্ধা সমালোচক। উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং বর্তমান আনিসুজ্জামান এবং জিএইচ হাবীব, যিনি পূর্বে এই গ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন।  বাকযুদ্ধে অংশ না নিলেও দুই অনুবাদকই নিজ নিজ মতামত জানিয়েছেন খুব সংযতভাবেই।

বাকযুদ্ধে দুটো পক্ষ। এক পক্ষে লীনা দিলরুবা যুক্তি দিয়ে বলছেন এই গ্রন্থটির একটি সুখপাঠ্য বাংলা অনুবাদ(জিএইচ হাবীবের করা) থাকা সত্ত্বেও কেন আরেকটি অনুবাদ প্রয়োজন হলো। তার চেয়ে মার্কেজের অন্য উপন্যাসগুলো অনুবাদ করা যেতো। অন্যপক্ষ বলছে একটা বই বারবার অনুবাদ হলেও সমস্যা নাই। অতীতে এমন ঘটনার নজির বহু। অনুবাদক নিজে এসে বললেন, আগের অনুবাদটা ইংরেজি থেকে করা তাই কিছু ফাঁকফোকর আছে তিনি সেগুলো ভরাট করতে চেষ্টা করছেন। তিনি ইংরেজি থেকে না করে সরাসরি স্পেনিশ থেকে বাংলা করেছেন পাঠকের জন্য আরো সুখপাঠ্য করে।

===========

লীনা দিলরুবা:

“নিঃসঙ্গতার একশ বছর”-বাংলা অনুবাদে গ্রহণযোগ্য একটি সংস্করণ আমাদের দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। অনুবাদকের কাজটি শুধু গ্রহণযোগ্য নয়, খুবই উঁচুমানের হয়েছে বলে আমার ধারণা। জি এইচ হাবিব এর অনুবাদক। দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এটি প্রকাশ করেছে। কথা হচ্ছে নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর একটি সর্বজনগ্রাহ্য অনুবাদকর্ম থাকার পরও আবার কেন এর অনুবাদের প্রয়োজন পড়লো সেটি বোধগম্য হলো না। আপনাদের বক্তব্যনুযায়ী যদি ধরেই নিই যে- “বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কিংবদন্তিতুল্য এই উপন্যাসটি মূলভাষা থেকে অনূদিত হয়নি”- তবুও পূনঃঅনুবাদের জন্য কারণটি জোরালো নয়। যদি এমন হতো, আগের অনুবাদকর্মে মূলানুগ অনুসরণের সমস্যা হয়েছে, তবেই এর একাধিক এবং মূল ভাষা থেকে অনুবাদের প্রয়োজন পড়তো। ইংরেজি থেকে অনুবাদ হলেও জি এইচ হাবীবের অনুবাদকর্ম সাবলীল এবং সুখপাঠ্য ছিল।

পাঠক হিসেবে আমি মার্কেজের অন্য উপন্যাসগুলোর পুনরায় ভালো অনুবাদগ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি।

পরিশেষে বলি, অনুবাদক জনাব আনিসুজ্জামান যদি মার্কেজের “নিঃসঙ্গতার একশ বছর” অনুবাদে শ্রম ব্যয় না করে অন্য কোনো গ্রন্থ অনুবাদ করতেন সেটি পাঠক হিসেবে আমাকে আনন্দিত করতো।


লীনা দিলরুবার বিপক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে লিমা নামের আরেকজন আলোচক বলেছেন-

অনুবাদক আনিসুজ্জামানের ছন্দস্পন্দিত, সাবলীল ও মূলানুগ অনুবাদের প্রতিক্রিয়ায় লিনা দিলরুবা জি এইচ হাবীবের অনুবাদটির পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন, “কথা হচ্ছে নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর একটি সর্বজনগ্রাহ্য অনুবাদকর্ম থাকার পরও আবার কেন এর অনুবাদের প্রয়োজন পড়লো সেটি বোধগম্য হলো না।” প্রথম কথা হলো চিরায়ত যে কোন গ্রন্থের অনুবাদ একাধিকবার হতে পারে, হয়েছেও–এমন নজির ভুরিভুরি। বাংলা ভাষাতেই রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়ামের অনুবাদকদের দীর্ঘ তালিকার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো কাজী নজরুল ইসলাম (রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (রুবাইয়্যাত-ই-উমরখয়্যাম), হেমেন্দ্রকুমার রায় (ওমর খৈয়ামের রুবায়ত), কান্তিচন্দ্র ঘোষ (রোবাইয়াত্-ই-ওমরখৈয়াম), নরেন্দ্র দেব (রোবাইয়াত্-ই-ওমরখৈয়াম), হিতেন্দ্রনাথ বসু (রুবাইয়াত্-ই-ওমরখৈয়াম), শ্যামাপদ চক্রবর্তী (ওমরখৈয়ামের রুবাইয়াত), বিমলচন্দ্র ঘোষ (রুবাইয়াত্-ই-ওমরখৈয়াম), বীরেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য (ওমরখৈয়াম-রুবাইয়াত্), সুধীর গুপ্ত (ওমরখৈয়ামের রুবায়েত্), শক্তি চট্টোপাধায় (ওমরখৈয়ামের রুবাই), অশোক ভট্টাচার্য (রুবাইয়াত্), সুনীলচন্দ্র দত্ত (রুবাইয়াত্), বিজয়কৃষ্ণ ঘোষ (রোবাইয়াত্), সিকান্দার আবু জাফর (রুবাইয়াত্-ই-ওমরখৈয়াম)। এ তালিকায় আরো রয়েছেন অক্ষয় কুমার বড়াল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ।

এই অনুবাদকদের একজন, কান্তিচন্দ্র ঘোষ সম্পর্কে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছিলেন ‘প্রধানত অনুবাদক হিসেবে যাঁরা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড এবং কান্তিচন্দ্র ঘোষ একই সূত্রে স্মরণযোগ্য।’

কান্তিচন্দ্রেরও বহু পরে নজরুল ইসলাম মূল থেকে ওমর খৈয়াম অনুবাদ করেছিলেন । কিন্তু কোনো আহম্মকই এই প্রশ্ন তুলবেন না যে এত হাতে অনুবাদের পরও নজরুল কেন অনুবাদ করতে গেলেন, তাও আবার মূল থেকে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে হাবীবকৃত নিঃসঙ্গতার একশ বছর বইটি যে ‘সর্বজনগ্রাহ্য’– এই কথা তিনি কোন যুক্তি বা জরীপের ভিত্তিতে বলছেন? আমিও একজন পাঠক। আমাকে কি তিনি সর্বজনের মধ্যে ভাবছেন? যদি না ভেবে থাকেন তাহলে আমাকে ছাড়া সর্বজন হয় কী করে? আর যদি আমি সবর্জনের অংশ হই তাহলে আমার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এই যে হাবীবের অনুবাদটি আমার পছন্দ হয়নি, কিন্তু তারপরও আমি তাকে সাধুবাদ জানাই এই গ্রন্থটির প্রথম অনুবাদক হওয়ার গৌরব অর্জনের জন্য। এটাকেও আমি খাটো করে দেখতে নারাজ। এরকম একটি জটিল উপন্যাসের অনুবাদ সহজ নয়, তা সে মূল থেকেই করুন বা ইংরেজি অনুবাদের ভিত্তিতেই করুন না কেন। কিন্তু তাই বলে এর ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলা যাবে না– তাতো নয়। এই অনুবাদের অনেক ত্রুটি আছে এবং এই ত্রুটিও আসলে দুই ধরণের ক্রুটি। প্রথম ত্রুটি হচ্ছে তিনি কোথাও কোথাও ইংরেজির ভুল অনুবাদ করেছেন। দ্বিতীয় ত্রুটি হলো ভুল ইংরেজি অনুবাদের নির্ভুল অনুবাদ করেছেন। এই দ্বিতীয় ক্রুটি ঘটেছে মূলত মূল ভাষাটি সম্পর্কে তার অজ্ঞতার কারণে।

এটা ভাবা এক ঔপনিবেশিক আধি যে ইংরেজি অনুবাদ মানেই নির্ভুল। গ্রেগরী রাবাসার অনুবাদ অবশ্যই ভালো অনুবাদ, কিন্তু তা যে পুরোপুরি নির্ভুল এবং নিখুঁত এমন দাবী করাটাও হবে হাস্যকর ব্যাপার। মূল ভাষায় যারা এই বইটি পড়েছেন তারাই বলতে পারবেন কোথায় সেই ত্রুটি। আপনি, লীনা দিলরুবা, কোন যুক্তিতে এই দাবী করছেন যে, “যদি এমন হতো, আগের অনুবাদকর্মে মূলানুগ অনুসরণের সমস্যা হয়েছে, তবেই এর একাধিক এবং মূল ভাষা থেকে অনুবাদের প্রয়োজন পড়তো।”? অনুবাদের অনুবাদ মূলানুগ হবে– এ ধরণের দাবী কোনো উন্মাদও করবে বলে মনে হয় না। হাবীবের অনুবাদটি যদি মূলানুগই হতো তাহলে হাবীব আর আনিসুজ্জামানের অনুবাদে কোনো পার্থক্য থাকা উচিত নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে ঠিক উল্টোটাই।

হাবীবের অনুবাদটি যে ‘সর্বজনগ্রাহ্য’ হয়নি তার একটা উদাহরণ আপনার অবগতির জন্য এখানে হাজির করছি। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত অনুবাদক, প্রাবন্ধিক এবং স্প্যানিশ বিশেষজ্ঞ রবিন পালের প্রতিক্রিয়া আছে হাবীবের এই অনুবাদটি সম্পর্কে। তিনি হাবীবের অনুবাদের ত্রুটি, এমনকি ভাষাগত ত্রুটি সম্পর্কেও কথা বলেছিলেন:
“কিছু কিছু অনুবাদ অস্বস্তিদায়ক। যেমন- ‘ব্যাপারটা তাকে খানিকটা স্বস্তি দেবে মনে ক’রে একটা চারকোল নিয়ে এসে অগুনতি যেসব মিলনের পয়সা তখনো সে অরেলিয়ানোর কাছে পেতো সেগুলো মুছে দেয়… (পৃ ৩৬৪) Gregory Rabassa-র ইংরেজি হল এমন ‘Thinking that it would console him, she took a piece of charcol and erased the innumerable loves that he still owed her for, and (p.419) ‘চারকোল’ এবং ‘মিলনের পয়সা’ কানে লাগে যথেষ্ট। তেমনি অস্বস্তিকর ‘মাকোন্দো ততক্ষণে সেই ‘বাইবেলিয় যুগের হারিকেনের রুদ্ররোষের কবলে পড়ে ঘুরপাক খাওয়া ধুলোবালি আর ধ্বংস্তুপের একটা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে… ’ ইংরেজিটা ছিলো Macondo was already a fearful whirl Wind of dust and rubble being spun about by the wrath of the biblical hurricane… (p.422), পাঠক বুঝতে পারছেন বেশ কিছু প্রতিশব্দের গন্ডগোল আছে এখানে। বেশ আড়ষ্ট বাংলা– এ হচ্ছে স্রেফ একটা সামান্য ক্ষয়কারী অধঃক্ষেপ (পৃ.১৯) (this is just a little corrosive sublimate)

হিংগুলির নারকীয় গুণাগুণ (পৃ ১৯) (his Diabolical properties of cinnabar), rudimentary laboratory তো ‘সদ্য তৈরি গবেষণাগার’ (পৃ ১৯) নয়। রোদেলা বাগান, স্মৃতির অভ্রমিত অঞ্চল শুনতে অবশ্য খারাপ লাগে না। Squid সমুদ্র শামুক নয়, বরং এক জাতীয় সামুদ্রিক মাছ যা বঁড়শির টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। Pirate বললে যেমন ‘হার্মাদ’ বোঝায় না। ( রবিন পাল, যুগলবন্দী: স্পেনীয় ও ভারতীয় সাহিত্য, প্রকাশক: এবং মুশায়েরা, কলকাতা, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০০৭, পৃ: ২০৮-২০৯)
এই হচ্ছে আপনার ভাষায় ‘গ্রহণযোগ্য’, ‘উঁচুমানের’, এবং ‘সর্বজনগ্রাহ্য’ অনুবাদের নমুনা।

আপনি প্রতিক্রিয়ার এক জায়গায় স্ববিরোধী একটি কথা বলেছেন, “পাঠক হিসেবে আমি মার্কেজের অন্য উপন্যাসগুলোর পুনরায় ভালো অনুবাদগ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি।” প্রশ্ন হলো হাবীবকৃত এই ক্রুটিপূর্ণ অনুবাদটির পরিবর্তে যদি অন্য হাতে নতুন অনুবাদের বিরোধীই হন তাহলে অন্য অনুবাদগুলোর ক্ষেত্রে “পুনরায় ভালো’ অনুবাদগ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা” অনুভব করেন কোন যুক্তিতে?।

মানুষ দুধের স্বাদ পেলে কেন ঘোলে স্বাদ মেটাবে? কিন্তু আপনি ব্যতিক্রম। ঘোল খেতে খেতে আপনি রীতিমত ঘোলানুরাগীই নন, উপরন্তু দুধেরই বিরোধিতায় নেমেছেন।

বাংলাদেশে এমনিতেই মূল ভাষা থেকে অনুবাদ করার যোগ্য লোকের অভাব। আর এই কারণে ‘অনুবাদের অনুবাদ’ হ্ওয়ায় আমাদের অনুবাদ সাহিত্য এক ধরণের দীনতায় ভুগছে। কিন্তু কেউ এই অভাব পূরণের জন্য এগিয়ে এলে আমরা সেটা সহ্য করতে পারি না স্রেফ কায়েমি স্বার্থের কারণে। অরুচি, দুর্নীতি, কার্পণ্য, দীনতা, দুর্বৃত্তায়ন আমাদের মর্মে এতোই প্রোথিত যে ভালো জিনিস এবং ভালো উদ্যোগকে পর্যন্ত মেনে নিতে পারি না। আপনি তারই এক অপদৃষ্টান্ত হয়ে থাকলেন।

অনুবাদক আনিসুজ্জামান, আপনার অনুবাদের কাজ যেন দুষ্টজনের প্রতিরোধে থমকে না যায় এই অনুরোধ জানাই। আপনাকে অভিবাদন।


এই বিতর্কে অংশ নিয়ে স্পেনিশ থেকে সরাসরি অনুবাদক আনিসউজ্জামান মন্তব্য করেছেন:

আমার এবং জি এইচ হাবীবের অনুবাদ নিয়ে পাঠকবন্ধুদের বাদানুবাদে আমার অস্বস্তি এই জন্যে যে হাবীবের মতো একজন মশহুর অনুবাদকের সঙ্গে আমার মতো গৌণ এক অনুবাদকের তুলনা করা হচ্ছে। আমি নিজে হাবীবের অনুবাদের অনুরাগী পাঠক। আমি তাকে সাক্ষাতে একবার সে কথা জানিয়ে্ওছিলাম। আমি তার আলোচ্য অনুবাদটিও পড়েছি। পড়ে ভালো্ও লেগেছে। কিন্তু তারপরেও, মূলের সঙ্গে এর কোথাও কোথাও দূরত্ব আছে, ভাষাগত কিছু ভিন্নতা্ও আছে এবং সেটা থাকবেই। এই থাকার মূল কারণ তার অনুবাদটি মূলত ইংরেজি অনুবাদের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। এমনকি একই ইংরেজি অনুবাদের আশ্রয়ে গড়ে ওঠা দুজনের অনুবাদ্ও দুরকম হতে বাধ্য। এমন উদাহরণতো আছেই। আর আমি যেখানে মূল থেকে করার চেষ্টা করছি সেখানে তা আরও একটু ভিন্ন হ্ওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে ভিন্নতার অজুহাতে যাতে কোনো ভুল-পাঠ ঢুকে না পরে সেদিকে নিশ্চয়ই খেয়াল রাখা দরকার। আমি এই অনুবাদে সেটা খেয়াল রাখতে চাই, কিন্তু আমার অসতর্ক মুহূর্তে এবং বেখেয়ালে যে তেনমটা ঘটবে না–তার নিশ্চয়তা দেয়া খুব কঠিন। সেজন্যে বন্ধুদের কাছে আগেভাগেই অনুরোধ জানিয়ে রাখি: তেমন কিছু নজরে পড়লে আমার সমালোচনা করে (প্রয়োজনে তুলোধুনো্ও করতে পারেন) সংশোধন করে দিন। আপনারা নিন্দা এবং তারিফের মাধ্যমে আমাকে যারা অনুপ্রাণিত করছেন, তাদের সবার কাছেই আমার কৃতজ্ঞতা।


অতঃপর প্রথম অনুবাদক জিএইচ হাবীবও অংশ নিয়েছেন বিতর্কে। তিনি বলেছেন-

কথিত আছে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস রচিত ‘Cien años de soledad’ -এর “Gregory Rabassa” কৃত ইংরেজি অনুবাদ “One Hundred Years of Solitude”-কে স্বয়ং মার্কেস মূল রচনার চাইতে ভালো বলেছেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার সাহিত্যিক André Brink তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘Making and Unmaking. Gabriel García Márquez: One Hundred Years of Solitude’-এর শেষে টীকায় বলছেন “All the references to the English text are to the felicitous if flawed translation by Gregory Rabassa in the Picador edition (London, 1978).”

তার মানে, সেই বিশ্বনন্দিত অনুবাদেরও ভুল ধরা পড়েছে তাঁর কাছে, হয়ত আরো অনেকের কাছে। সম্ভবত তাতে অনুবাদটি সাহিত্যাঙ্গনে অপাংক্তেয় হয়ে যায়নি। কাজ করলেই ভুল হয়, না করলে হয় না। আর যিনি বা যাঁরা ভুল ধরেন তাঁরাও তা করতে গিয়ে ভুল করেন মাঝে মাঝে।

“One Hundred Years of Solitude” অনুবাদে আমার অতি ক্ষুদ্র, তুচ্ছ ও — আশংকা করি — বৃথা প্রয়াসে এরকম শত শত ভুল আছে নিশ্চয়ই। সেসব যাঁরা ধরিয়ে দিয়েছেন — রবিন পাল তাঁদের অন্যতম — তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। সেসব ত্রুটিনির্দেশ-এর মধ্যে যেগুলো যৌক্তিক মনে হয়েছে সেসব আমি পরবর্তী সংস্করণে শুধরে নেয়ার চেষ্টা করেছি, এবং সেচেষ্টা আমার অব্যাহত আছে। আর আমি এই কথাটি আগেও দুএক জায়গায় বলেছি যে, কেন যেন এই উপন্যাসের একটি বাক্যের অনুবাদেও আমি সন্তুষ্ট নই, মনে হয় যেন সেগুলো ভালো করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। যাই হোক, কিন্তু যতদূর মনে পড়ে রবিন পাল তাঁর লেখায় আমার ব্যবহার করা ‘পানি’, ‘খালা’, ‘পেশাব’ শব্দ নিয়েও আপত্তি তুলেছিলেন এই যুক্তিতে যে এগুলো বুঝতে কারো কারো অসুবিধে হতে পারে, এগুলো একটু অপ্রচলিত। আমি তাঁর এই বিজ্ঞ মত মানতে পারিনি। শব্দগুলো তাই বদলে দেয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করিনি।

আর আমাদের দেশের বাংলা অনুবাদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কিছু বক্তব্যের একটি হচ্ছে, আমার ধারণা, যেসব কাজের বাংলা অনুবাদের মান খুব খারাপ নয়, সেসব ফের অনুবাদ আমাদের অন্য বিলাসিতা। যে-বিলাসিতা ইংরেজি এবং আরো গুটিকতেক ভাষার লোকজন করতে পারেন। এখনো যে কত সহস্র কাজের বাংলা অনুবাদ দরকার তার যে ইয়ত্তা নেই! তবে, অনুবাদটি যদি মূল ভাষা থেকে না হয়ে থাকে অথবা কাজটি সম্পর্কে যদি অনুবাদকের বিশেষ দুর্বলতা থাকে সেক্ষেত্রে রচনাটি দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার অনুবাদে আমার অন্তত আপত্তি নাই। আর তাই আনিসুজ্জামানের অনুবাদ প্রচেষ্টাকে আমি সাধুবাদ জানাই, ও তাঁর সাফল্য কামনা করি। সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।


আনিসুজ্জামানের অনুবাদে আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ:

আমি প্রথমে দুপক্ষের যুক্তিময় বিতর্কটা পড়লাম, তারপর অনুবাদটা পড়তে শুরু করলাম। জিএইচ হাবীবের অনুবাদটা আমার আগেই পড়া ছিল। ইংরেজি অনুবাদও। ফলে সরাসরি স্পেনিশ থেকে অনুবাদ পেয়ে আশা করলাম এবার নিশ্চয়ই আরো ভালো কিছু পাওয়া যাবে। 

কিন্তু প্রথম অধ্যায়েই তিনবার হোঁচট খেলাম-

১. 
অনুবাদক লিখেছেন - কাকচক্ষু নদীর পাশে মাটি আর নল দিয়ে তৈরি বিশটি বাড়ির এক গ্রাম
ইংরেজিতে আছে-  a village of twenty adobe houses, built on the bank of a river of clear water
জি এইচ হাবীব অনুবাদ করেছেন- কাকচক্ষু জলের একটি নদীর তীরে রোদে শুকানো ইটের তৈরী কুড়িটি বাড়ির একটি গ্রাম

আনিসুজ্জামান সাহেবের কাছে আমার প্রশ্ন : মাটি আর নল দিয়ে তৈরী বাড়ি কোথায় পেলেন? ইংরেজিতে যেটা Adobe house সেটাই আপনার মাটি আর নলের তৈরী বাড়ি? অদ্ভুত অনুবাদ।

২.
পঞ্চম বাক্যে গিয়ে আনিসুজ্জামান অনুবাদ করেছেন -বাবুইপাখির পায়ের মতো সরু লিকলিকে হাতওয়ালা দশাসই চেহারার আর বেয়াড়া রকমের দাড়ি-গোফওয়ালা জিপসি
ইংরেজিতে আছে - A heavy gypsy with an untamed beard and sparrow hands
জিএইচ হাবীব অনুবাদ করেছিলেন - বেয়াড়া রকমের দাঁড়িগোফ আর সরু লিকলিকে হাতের এক দশাসই বেদে

আনিসুজ্জামান সাহেবের কাছে আমার প্রশ্ন: স্পেনিশে বাবুই পাখির পা কথাটা লেখা আছে? আমরা জানি ইংরেজিতে Sparrow hands কথাটা একটা ফ্রেইজ। যেটার যথার্থ অনুবাদ জিএইচ হাবীব করেছেন।

৩.
কয়েক প্যারা যাওয়ার পর হঠাৎ অসংলগ্ন, অসম্পূর্ণ একটি বাক্য। এটা পড়ে পাঠক কী বুঝবে? কার কথা বলা হয়েছে এখানে? 
"পাহাড় ডিঙিয়ে জলাভূমিতে পথ ভুলে, পায়ে হেটে খরস্রোতা নদী পেরিয়ে প্লেগ, হতাশা আর বন্য জন্তুর উৎপাতে প্রায় খরচের খাতায় চলে যেতে যেতে বেঁচে যায় ডাক-বওয়া খচ্চরগুলোর পথের দিশা পেয়ে, রাজধানী পর্যন্ত যাওয়া সে সময় প্রায় অসম্ভব ছিল।"
ইংরেজি অনুবাদে আছে: He sent it to the government, accompanied by numerous descriptions of his experiments and several pages of explanatory sketches, by a messenger who crossed the mountains, got lost in measureless swamps, forded stormy rivers, and was on the point of perishing under the lash of despair, plague, and wild beasts until he found a route that joined the one used by the mules that carried the mail.
জিএইচ হাবীব লিখেছেন- "তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার বেশুমার বর্ণনা আর ব্যাখ্যামূলক অগুনতি নকশাসহ সেটা সে পাঠিয়ে দেয় সরকারের কাছে, এক বাহকের হাতে, সে লোকটা পাহাড় ডিঙোয়, জলাভূমিতে বেপথু হয়, পায়ে হেঁটে পেরোয় খরস্রোতা নদী, তারপর হতাশা, প্লেগ আর বুনো জন্তু-জানোয়ারের উৎপাতে চলেই যেতে বসে খরচের খাতায়, যদিও শেষতক বেঁচে যায় ডাক-বওয়া খচ্চরগুলোর পথের সঙ্গে গিয়ে মেশা পথটা পেয়ে।"



[চলমান........]

Sunday, July 2, 2023

দেশের খনিজ সম্পদের অর্থমূল্য ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার

 




প্রথমে চোখের মাথা খেয়ে সংবাদ শিরোনামটা দেখে ভেবেছি বাংলাদেশ রাতারাতি ইংল্যান্ডের মতো বড়লোক হয়ে গেছে। কারণ শিরোনামের সংখ্যাটা ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার! বাংলাদেশের মাটির তলায় পড়ে থাকা খনিজ সম্পদের মূল্য। এই অংক ইংল্যাণ্ডের জিডিপির সমান।
তাও এই হিসাবে আমাদের গ্যাস সম্পদের মূল্য যোগ করা হয়নি। গ্যাসের মূল্য যুক্ত হলে সম্পদের আকার আরো কয়েক ট্রিলিয়ন বাড়বে। চারপাশের এত দুঃসংবাদের ভেতর একটা বিশাল সুসংবাদ।
কিন্তু সংবাদের পরের অংশটা পড়ে আনন্দটা বিষাদে পরিণত হলো। বলা হয়েছে ওই খনিজগুলো উত্তোলন ও ব্যবহার করার ব্যাপারে উৎসাহ নেই কর্তাদের। বরং অনেক বেশি টাকা দিয়ে পরের সম্পদ আমদানী করতে বেশি আগ্রহী। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুসারে রিপোর্টে বলা হয়েছে ওই খনিজ উত্তোলনের জন্য বিনিয়োগ খুব বেশি নয়। সেই সামর্থ্য আমাদের আছে। তবু কর্তারা এটায় আগ্রহ পাচ্ছেন না। কেন আগ্রহ পাচ্ছেন না এটা তারাই জানেন, আমরা শুধু অনুমান করতে পারি।
আসলে এরকম ঘটনা আমাদের জন্য নতুন কিছু না। বাংলাদেশে এটা সবসময় হয়ে এসেছে।
২০০১ সালের একটা ঘটনা মনে পড়লো। তখন কক্সবাজার সৈকতের খনিজ সম্পদ নিয়ে এরকম একটা রিপোর্ট পড়েছিলাম 'সাপ্তাহিক ২০০০' ম্যাগাজিনে। রিপোর্টার ছিলেন সম্ভবত আসাদুজ্জামান। তিনি একটা বিস্তারিত তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট করেছিলেন। ওটা নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনী হয়েছিল। রিপোর্টটা হয়েছিল কক্সবাজারের সৈকতে থাকা কিছু মূল্যবান খনিজ সম্পদের মজুদ নিয়ে যার মূল্য দিয়ে পুরো বাংলাদেশ কয়েকবার কিনে ফেলা যাবে। এখন যেখানে কলাতলী হোটেল মোটেল জোন ওই পুরো এলাকাটা ছিল সেই সৈকতের বালি ওই খনিজে ভরপুর। ওই খনিজের কারণে সেই এলাকায় কোন হোটেল করা যাবে না এই মর্মে আইনও হয়েছিল। শুরুতে স্থানীয় প্রযুক্তি দিয়ে বালি থেকে সেই খনিজ পরিশোধনের বেশ তোড়জোর করা হয়েছিল। মোটেল উপলের পাশে একটা ছোটখাট গবেষণাগারও খোলা হয়েছিল। কক্সবাজারের লোকেরা তামাশা করে বলতো বালির অফিস। কারণ গবেষণাগারের বিশাল চত্ত্বরে বড় বড় বেশ কিছু বালির স্তুপ ছিল।
সেই বালিতে প্রাপ্ত খনিজগুলোর মধ্যে বড় অংশ ছিল টাইটানিয়াম, জিরকনিয়াম, বেরিলিয়াম ইত্যাদি। এ বিষয়ে অভিজ্ঞজনের জানেন সারা বিশ্বে এই খনিজগুলো সোনার চেয়েও দামী। আকাশযান এবং মহাকাশযানের ইঞ্জিন এবং গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ তৈরিতে এই পদার্থগুলো ব্যবহার হয়। এগুলো ইস্পাতের চেয়ে বহুগুন শক্ত, উচ্চতাপ সহনশীল কিন্তু বেশ হালকা। দুর্লভ পদার্থ হওয়াতে চাহিদা অনেক বেশি।
কিছুদিন পর হঠাৎ শোনা গেল কক্সবাজারের সৈকতের সেই অংশটা লিজ দেয়া হচ্ছে বিদেশী একটা কোম্পানিকে। ওরা আমাদের সামান্য কিছু পয়সা দিয়ে খনিজগুলো উত্তোলন করে নিজেদের দেশে নিয়ে যাবে। সেখানে পরিশোধন করে বহুগুন বেশি দাম দিয়ে বিক্রি করবে। বুদ্ধিটা কার মাথা থেকে এসেছিল জানি না। কিন্তু দেশ বিক্রি করে দেয়া হয় এভাবেই। অথচ চেষ্টা করলে আমরা নিজেরাই একটা প্রকল্প তৈরি করে সেখানে বিদেশী বিশেষজ্ঞ আনিয়ে বিদেশী মেশিনপত্র বসিয়ে পরিশোধন করে খনিজগুলো আমরা নিজেরাই উচ্চমূল্যে রপ্তানী করতে পারি। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা সেরকমই মতামত দিয়েছিলেন।
কথাটা শোনার পর আমরা কয়েকজন মিলে এই লিজিং তৎপরতা বন্ধ করার জন্য একটা মিডিয়া প্রচারণার উদ্যোগ নেই। আমি কক্সবাজার গিয়ে কলাতলীর সেই গবেষণাগারের অফিসারদের সাথে কথা বলে ঘটনার সত্যতা যাচাই করি। তারপর আমরা ঢাকায় একটা গোলটেবিলের আয়োজন করার জন্য সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর সাথে আলাপ করি। তাঁর পত্রিকাতেই সেই রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। তিনি সানন্দে রাজী হলেন। সেই গোলটেবিল আয়োজনে সরকারের খনিজসম্পদ মন্ত্রীসহ বেশ কজন বিশেষজ্ঞকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল যাদের অধিকাংশ ছিলেন বুয়েটের। তাঁদের সাথে অন্যতম বক্তা ছিলেন কক্সবাজারের সেই প্রকল্প প্রধান। ভদ্রলোক বলেছিলেন ওই খনিজটা ৯৫% পরিশোধন করার মতো প্রযুক্তি তাঁর কাছে আছে। সেই আসরে উপস্থিত সবাই একমত হয়েছিলেন যে লিজটা যে কোন উপায়ে বাতিল করা উচিত। তারপর নিজেদের উদ্যোগে একটা প্রকল্প নেয়া হবে। খনিজসম্পদ মন্ত্রীও তাতে সায় দিয়েছিলেন। শুনেছিলাম তিনি প্রধানমন্ত্রীকেও জানিয়েছিলেন।
অতঃপর আমরা আনন্দের সাথে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। বিদেশী কোম্পানীকে লিজ দেয়ার প্রস্তাবটা বাতিল হয়েছিল। আমরা অল্প চেষ্টাতে এত বড় বিজয়ে ঢাকার একটা রেস্তোঁরায় পানাহারও করেছিলাম।
কিন্তু বছরখানেক পর দেখা গেল ওই জায়গাটা বিভিন্ন প্লটে বিভক্ত করে সীমানা দেয়াল তোলা হচ্ছে। আরো কিছুদিন পর দেখা গেল ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে একটা দুটো হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর উঠছে। প্রথমে কলাতলী রোডের দিকে উঠেছিল সেই হোটেলগুলো। কয়েক বছর পর দেখা গেল সৈকতের সবটুকু এলাকা হোটেলে ছেয়ে গেছে। জায়গাটা কোন অদৃশ্য যাদুর ছোঁয়ায় হোটেল মোটেল জোনের পরিবর্ধিত এলাকায় পরিণত হয়েছে। অথচ সুগন্ধা পয়েন্টের দক্ষিণের পুরো এলাকায় কোন হোটেল হবার কথা ছিল না।
বড় বড় হোটেল গড়ে ওঠার পর খনিজ বালি প্রকল্প পরিত্যক্ত ঘোষিত হলো। সরকারও বদলে গেল। তারপর ধীরে ধীরে কক্সবাজারের মানুষ বালির অফিসের কথাও ভুলে গেল। ওই হোটেল-মোটেল জোন হবার আগে আমি সৈকত থেকে সেই কালো বালির খনিজের নমুনা তুলে এনে বোতলে ভরে বাসায় সাজিয়ে রেখেছিলাম। বেশ কিছুদিন ওই বালির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম।
অবশ্য কর্তাদের দোষ দেবার উপায় নেই। তাঁরা তো কথা রেখেছিলেন ঠিকই। বিদেশিদের না দিয়ে দেশের সম্পদ দেশে রেখে দিয়েছিলেন। একদম স্থায়ীভাবে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখন কেউ কলাতলী এলাকায় গেলে টেরই পাবে না ওই এলাকায় কী বিপুল সম্পদ মাটির তলায় হারিয়ে গেছে।


পুরো সংবাদ:
https://bonikbarta.net/home/news_description/345607/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%96%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%9C-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%AE%E0%A7%82%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A7%A8.%E0%A7%A8%E0%A7%AC-%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%A8-%E0%A6%A1%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-

ভিয়েতনাম ভ্রমণ: ২০০৪ সংস্করণ


অ্যানালগ যুগের এই ছবিটা হঠাৎ করে খুঁজে পেলাম। বহুকাল আগের এই ছবিটা আমার খুব প্রিয়। জায়গাটা ভিয়েতনামের Halong Bay, পেছনে তার বিখ্যাত ল্যাণ্ডমার্ক টুইন স্টোন। ২০০৪ সালে একটা অফিশিয়াল ট্যুরে গিয়ে হালং বে এলাকায় নৌবিহার করেছিলাম, তখনকার ছবি। এতদিন পর ছবিটা খুঁজে পেয়ে সেই ভ্রমণে ঢাকা এয়ারপোর্টের একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল।
সেই ট্যুরে আমরা ১৯ জনের একটা দল যাচ্ছিলাম। নামে অফিশিয়াল ট্যুর হলেও এটা ছিল মূলত একটা আন্তর্জাতিক পিকনিক। হ্যানয়ের উপকন্ঠে আমাদের একটা বড়সড় কারখানা নির্মিত হয়েছিল। সেটা পরিদর্শনের উসিলায় ভিয়েতনামের বিখ্যাত কিছু পর্যটনস্থল ঘুরে আসাই মূল উদ্দেশ্য।
ঢাকা থেকে বেলা দুটোর সময় থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইট। সবাই ঘন্টা তিনেক আগে এয়ারপোর্টে গিয়ে হাজির হলাম। যেহেতু আনন্দ ভ্রমণ, সবাই টেনশান ফ্রী। পিকনিক মুডে সবাই থাই এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে মালামাল বুঝিয়ে দিয়ে ভেতরে গিয়ে ইমিগ্রেশনে লাইনে দাঁড়িয়েছে।
আমি কী একটা কাজে একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। আধঘন্টা পর ভেতরে গিয়ে দেখি ইমিগ্রেশন লাইনের পাশে ছোটখাট একটা ভিড় জমে গেছে, একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি আমাদের লোকদের সাথে ইমিগ্রেশন অফিসার এবং অন্যন্য সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে একটা তর্কবিতর্ক চলছে। কাউকে ইমিগ্রেশন পার হতে দেয়া হয়নি।
অফিসারদের আপত্তি এতগুলো লোক একসাথে ভিয়েতনাম কেন যাবে? ওটা তো ট্যুরিস্ট কান্ট্রি না। বেড়ানোর নামে অন্য কোন মতলবে যাচ্ছে কিনা। ইমিগ্রেশন অফিসারদের শতবার বোঝানোর পরও বিশ্বাস করছে না আমরা কোন বদ মতলবে যাচ্ছি না। নেহায়েত প্রমোদ ভ্রমণ। আমাদের এ ধরণের ট্যুরগুলোর নাম ছিল ‘বিজনেস ট্রিপ’ এবং নানান দেশে বছরে কয়েকটা সত্যিকারের বিজনেস ট্রিপ হতো। এবারের ট্রিপটাই ছিল একটু ব্যতিক্রম।
তখন ভিয়েতনামে যেতে ভিসা লাগতো না। অন এরাইভাল ভিসাতে যাওয়া যেতো।
ইমিগ্রেশন অফিসারদের দৃঢ় বিশ্বাস এটা আদম পাচার কেস। এই সন্দেহের কারণ দলের প্রায় সবাই কম বয়সী তরুণ। দুয়েক জন বাদে বাকী সবার নতুন পাসপোর্ট। নতুন পাসপোর্টে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। সুতরাং এটা আদম পাচার না হয়ে যায় না। আমাদের দলের মধ্যে যিনি সবচেয়ে সিনিয়র তাঁকে আদমপাচারের হোতা ভেবে গ্রেফতার করে ফেলবে এমন অবস্থায় চলে গেছে।
ওদিকে ফ্লাইট কলিং শুরু হয়ে গেছে। আধ ঘন্টার মধ্যে ফ্লাইট ছেড়ে যাবে। মহামুশকিল। পুরো আনন্দ ভ্রমণটাই একটা কেলেঙ্কারিতে পরিণত হয়ে ভেস্তে যাবার যোগাড়।
শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি একটু দুঃসাহসী হবার সিদ্ধান্ত নিলাম। দলের মধ্যে একমাত্র আমিই ওই দেশে আগে গিয়েছিলাম এবং পূর্ব এশিয়ার আরো দুয়েকটা দেশ ভ্রমণের সুবাদে আমার ইমিগ্রেশন ভীতি একটু কম ছিল। সেই সাহসের ভিত্তিতে আমি অফিসারদের বললাম, আমি আপনাদের প্রধান কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে চাই।
কিন্তু অফিসাররা আমাকে সেটাও করতে দেবেন না। সোজা বলে দিলেন, কথা বলার কোনো দরকার নাই। আপনারা যেতে পারবেন না। আমরা এয়ারপোর্টে এসব কেস হরদম দেখে আসছি। আর কিছু করার নেই।
ঠিক সেই সময় কোথা থেকে যেন দেবদুতের মতো উদয় হলেন চিফ ইমিগ্রেশন অফিসার। তিনি কাছে এসে জানতে চাইলেন, এখানে দলনেতা কে?
এই প্রশ্ন শুনে আমরা পরস্পরের মুখ দেখাদেখি করলাম। কারণ আমরা দলনেতা জাতীয় কিছু ঠিক করে আসিনি। আমাদের সবচেয়ে সিনিয়র যে কলিগ ছিলেন, অফিসিয়াল পদবীর হিসেবে তাঁকে দলনেতা বলা যায়। মুশকিল হলো ভদ্রলোককে আদম পাচারের নেতা বলে অপদস্থ করার কারণে তিনি পুরোপুরি নার্ভাস। বাকীদের মধ্যেও এই পরিস্থিতিতে চাপাবাজি করতে পারবে সেরকম কাউকে দেখছি না। অতঃপর নিজ দায়িত্বে এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমার সাথে কথা বলতে পারেন।
তখন সেই চিফ ভদ্রলোক আমাকে তাঁর অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে পুরো বিষয়টা শুনতে চাইলেন। কথা শুরুর আগে বললাম, ‘অফিসার, তার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। ওই যে ফ্লাইট কলিং হচ্ছে সেটা বন্ধ করতে হবে। নইলে আর পনের মিনিটের মধ্যে প্লেনটা আমাদের রেখেই ছেড়ে চলে যাবে। আপনি দয়া করে থাই এয়ারকে বলে দিন প্লেনটা আমাদের ইমিগ্রেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন উড়াল না দেয়। নইলে পুরো ব্যাপারটা ভেস্তে যাবে। ’
আমার কথা শুনে তিনি একটু চোখ বড় বড় করে তাকালেন। বুঝতে পারছি আমার মতো সাধারণ কোন যাত্রীর কাছ থেকে এ ধরণের কথা শুনতে তিনি অভ্যস্ত নন। তবু আমার কথাকে উপেক্ষা না করে তিনি ফোনটা তুলে কাউকে অনুরোধ করলেন ফ্লাইটটা যেন এক ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হয়। ভদ্রলোক সত্যি খুব অমায়িক ছিলেন। আমি তাঁকে ফ্লাইট পেছানোর কথা বললেও তিনি যে আমার কথাটা রাখবেন সে ভরসা করিনি। এয়ারপোর্ট কেন্দ্রিক যেসব সরকারী কর্তাদের দুর্নাম শুনি, ইনি নিশ্চিতভাবে তাদের মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
আমি অল্প সময়ে ওনাকে গোটা পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম। তারপর আমার পাসপোর্ট দেখালাম। আমাদের কোম্পানির ব্যবসার ধরণ এবং বিনিয়োগ ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা দিলাম। তখন তিনি বললেন, ‘সব মেনে নিলাম। তবু আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। দলের পক্ষ থেকে গ্যারান্টি দিতে হবে আপনি ফেরার পথে পুরো দলটা নিয়ে ফিরে আসবেন। আপনার পাসপোর্টের কপি আমরা রেখে দেবো’।
আমি গ্যারান্টি দিয়ে স্বাক্ষর করলাম একটা কাগজে। তিনি আমার পাসপোর্টের কপি রেখে ইমিগ্রেশনে বলে দিলেন আমাদের দ্রুত পার করে দেবার জন্য।
অতঃপর স্বস্তি ফিরে এলো দলে। হৈ হৈ করে পিকনিক মুডে আবারো সবাই গিয়ে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালো। এক ঘন্টার মধ্যে আমাদের ফ্লাইট আকাশে উড়লো। তেত্রিশ হাজার ফুট উপরে ওঠার পর পাশে বসা দলনেতা মুরব্বী বললেন, ‘কী একটা ক্ষমতা দেখাইলেন, একটা ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট এক ঘন্টা পিছায়ে দিলেন!’
ক্ষমতা আমি দেখাইনি। নেহাত কপালজোরে পার হয়েছিলাম। কিন্তু আক্ষেপের ব্যাপার হলো ফেরার পথে অফিসারকে দেয়া কথাটা পুরোপুরি রাখতে পারিনি। সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলাম ঠিক। কিন্তু ঢাকা এয়ারপোর্টে নামতে পারিনি আমরা। থাই এয়ারওয়েজের ফিরতি ফ্লাইটটা কী একটা কারণে যেন রুট বদলে ব্যাংককের বদলে চিয়াংমাই-তে যাত্রাবিরতি করেছিল এবং সেখান থেকে সোজা চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে। আমরা চট্টগ্রামেই নেমে গিয়েছিলাম। আমাদের নামিয়ে ফ্লাইটটা ঢাকা চলে গেল।
জানি না ঢাকা এয়ারপোর্টের সেই অফিসার পরবর্তীতে আমার খোঁজ করেছিলেন কিনা। খোঁজ করে না পেলে হয়তো ভাববেন আমি সত্যি সত্যি ১৮ জন আদম পাচার করে হাওয়া হয়ে গিয়েছি।
[ফটোক্রেডিট: ১৮ জনের কেউ একজন। সম্ভবত প্রিয় সহকর্মী মনজুর-এ-ইলাহী]

ডাক্তারের ওপর মাস্টারী



সপ্তাহখানেক আগের কথা। আমার এক ছোটভাই প্রচণ্ড পেট ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। একের পর এক ডাক্তার সার্জন এসে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন। রোগ নির্ণয় হয়েছে কিন্তু ব্যথার উপশম ঘটছে না। অপারেশনও করা যাচ্ছে না ডাক্তারদের মতানৈক্যের কারণে। জটিল হয়ে যাচ্ছিল পরিস্থিতি। আমি নিজেও বছরখানেক আগে ভুক্তভোগী ছিলাম, সে কারণে বিষয়টা সম্পর্কে একটু ধারণা ছিল। আমার কাছে ব্যথাটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল, তাই আমি হাসপাতালের ডাক্তারদের অনুরোধ করছিলাম আরো দুয়েকটা বিশেষ পরীক্ষা করার জন্য। একাধিকবার অনুরোধ করার পর ডাক্তার খুব বিরক্ত হয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে আমাকে বললেন, “আপনি কী ডাক্তার? আপনি ডাক্তারের চেয়ে বেশী বুঝেন? এসব গ্যাসের ব্যথা। ওষুধ চলছে। সেরে যাবে”।
কিন্তু এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পরও সমস্যার সমাধান না হওয়াতে অবশেষে বাইরের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে ডাকা হলো। তিনি আমার কথিত সেই টেস্টটা দিলেন এবং দেখা গেল গুরুতর একটা সমস্যা পাওয়া গেছে। টেস্টের রেজাল্ট পাওয়ার পর ডাক্তাররা বললেন সমস্যাটা খুব গুরুতর, তাঁর হাতে সমাধান নাই। চট্টগ্রামে কেউ অপারেশন করবে না।
তারপর দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে রোগীকে অনেক কষ্ট করে ঢাকা এভারকেয়ারে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে পরদিনই অপারেশন করা হলো। ভয়ংকর একটা অবস্থা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়া গেল।
এখন আমার একবার ইচ্ছে হয় ওই ডাক্তারকে গিয়ে বলি আমি আপনার চেয়ে বেশি বুঝেছিলাম।
আসলে সব ডাক্তার এক নয়। পরিস্থিতি আর মানসিকতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। ওই একই হাসপাতাল আমার মায়ের জটিল অসুস্থতার সময় সারিয়ে তুলেছিল দুবছর আগে। সে কারণে তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
ডাক্তারের চেয়ে আমরা সাধারণ মানুষেরা বেশি বুঝবো না, এটা ঠিক। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যদি আমরা যদি একটু বেশি বুঝি সেটাকে একদম ফেলনা মনে করা উচিত না।
প্রায় ১৮/১৯ বছর আগের একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলি।
ডাঃ শামসের উদ্দিন(ছদ্মনাম) তখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের একটা বিভাগের প্রধান এবং অধ্যাপক। প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন সন্ধ্যা ছটা থেকে। এক সন্ধ্যায় সিরিয়াল নিয়ে তাঁর চেম্বারে গেলাম ঘনিষ্ট একজনের বিরল একটা রোগ নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য। রোগটি খুব বেশী পরিচিত নয় বলে আমি নিজে ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছু তথ্য যোগাড় করেছিলাম। সেটা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করার জন্যই যাই। উনি জানালেন এখানে ওই রোগ সম্পর্কে খুব বেশী ডাক্তার পড়াশোনা করেনি। তবু পরদিন মেডিক্যাল কলেজে যেতে বললেন অন্য সব সিনিয়র ডাক্তারের সাথে আলাপ করে যতটা সম্ভব সাহায্য করবেন।
অধ্যাপক শামসেরের এই মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ। পরদিন মেডিকেল কলেজে গেলে তিনি আমার সংগৃহিত তথ্যগুলো দেখতে লাগলেন মনোযোগ দিয়ে। সেই ফাঁকে আমি ওই রোগ সম্পর্কে এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে ইন্টারনেট ঘেঁটে যা জেনেছি তা নিয়ে ছোটখাট একটা লেকচার দিলাম। নিতান্ত সাধারণ জ্ঞানই বলা যায়। কিন্তু তিনি আমার সেই সাধারণ জ্ঞানকে অসাধারণ গুরুত্বের সাথে নিয়ে বললেন, 'আপনি একটু বসুন আমি অন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরও ডাকছি। সবার জানা দরকার বিষয়টা'।
খানিক পরেই আধডজনের মতো সহকারী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এসে হাজির হলেন।
সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে প্রফেসর শামসেরউদ্দিন আমাকে বললেন, 'একটু আগে আমাকে যা বলেছেন, সেগুলো আবার বলেন তো ওনাদের'।
উপস্থিত ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে বললেন, 'উনি যা বলবেন আপনারা একটু নোট করে নেন কষ্ট করে। সবার জানা দরকার ব্যাপারটা।'
বলে কী? আমি লেকচার দেবো এতগুলো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের উদ্দেশ্যে? উইকি আর গুগল গুঁতিয়ে যে ক'পাতা পড়েছি তা নিয়ে এই সুখ্যাত মেডিক্যালের বাঘা প্রফেসরদের উদ্দেশ্যে আমি একটা রোগ নিয়ে বক্তৃতা দেবো? ধরনীকে দ্বিধা হতে বলতে পারতাম। কিন্তু অধ্যাপক সাহেবের তাগাদায় লেকচারটা আবারো দিতে হলো।
লেকচার শেষে উপস্থিত এক ডাক্তার পাশের বইয়ের আলমারী থেকে মোটা একটা চিকিৎসা পুস্তক নামিয়ে আমার সামনে এনে পাতা খুলে দেখালেন সেই রোগ সম্পর্কে যা যা লেখা আছে। দেখলাম ওই রোগ সম্পর্কে বিশ বছর আগে প্রকাশিত সেই বইটিতে মাত্র দশ লাইনের একটা প্যারা আছে। বললেন, ওনারা ওইটুকুই পড়েছেন শুধু। এখন বুঝলাম এর বাইরে আর কিছু পড়া হয়নি এদের, তাই আমার সংগ্রহ করা বাইশ পাতার সাধারণ জ্ঞান ওনাদের কাছে মহাভারত মনে হচ্ছে।
লেকচার পর্ব শেষ হবার পর আমাকে চা নাস্তা খাইয়ে প্রফেসর সাহেব বিদায় দিলেন। বের হবার পর মনে পড়লো আমার নিজের কাজটাই তো হলো না। আমি এসেছিলাম একটা রোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ নিতে। কিন্তু পরামর্শ তো পেলাম না, উল্টো ডাক্তারদের জ্ঞান দিয়ে গেলাম সেই রোগ সম্পর্কে। ব্যাপারটা হাস্যকর এবং অবিশ্বাস্য।
অতএব মাঝে মাঝে এটাও মানতে হবে যে বিশেষ কোন পরিস্থিতিতে রোগীও ডাক্তারের চেয়ে বেশি বুঝতে পারে। সেটাকে সম্মান করলে দুপক্ষেরই লাভ হতে পারে।

আমার প্রিয় ডাক্তার



গতকাল ডাক্তারের ওপর মাস্টারী পোস্ট দেবার কারণে আমার এক ঘনিষ্টজন কিঞ্চিত মনক্ষুন্ন হয়েছেন। তিনি বলেছেন, খারাপ অভিজ্ঞতাটা লিখলাম কিন্তু অধিকাংশ ডাক্তারের কাছ থেকে আমি যে ভালো ব্যবহার এবং সেবা পেয়ে আসছি সেটা নিয়ে কোনদিন লিখিনি।
তিনি সত্য কথাই বলেছেন। মানুষ, বিশেষ করে বাঙালী মাত্রেই অকৃতজ্ঞ। কেউ আমার ৫০০ টাকার ক্ষতি করলে সেটা আমাদের বুকে দাগ রেখে যায়, কিন্তু কেউ ৫০,০০০ টাকার উপকার করলে সেটা ভুলে যেতে দেরি করি না। এখানেও তাই ঘটেছে।
সত্যি কথা বলতে গেলে, দুয়েকটি ঘটনা বাদে আমার সাথে এ যাবত পরিচয় হওয়া প্রায় সব ডাক্তারই খুব চমৎকার। আমার বাবার যুগে আমাদের একজন পারিবারিক ডাক্তার ছিলেন। তিনি সাধারণ এমবিবিএস ছিলেন, কিন্তু তাঁর মতো অসাধারণ ডাক্তার আমি খুব কমই দেখেছি। একটা ওষুধের দোকানের পেছনে ছোট একটা কক্ষে তাঁর গোছানো চেম্বারটি ছিল। তাঁর সাথে পরিচয় ঘটেছিল এক মধ্যরাতে যখন পরিবারের একজন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোথাও ডাক্তার না পেয়ে দিশেহারা হয়ে এলাকার এক ওষুধের দোকানে খোঁজ করতে তারা এলাকায় নতুন আসা এক ডাক্তারের বাসার ঠিকানা দিলেন।
আমরা একেবারে অচেনা হলেও তিনি সেই মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ নিয়ে আমাদের বাসায় এসে চিকিৎসা দিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি ধীরে ধীরে আমাদের পরিবারের ছোটবড় সবার ডাক্তার হয়ে ওঠেন। শুধু ডাক্তার নন, তিনি আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো আপন হয়ে ওঠেন। তিনি অতি মানবিক ডাক্তার ছিলেন। আমার এখনো মনে পড়ে তিনি ১০০ টাকা ভিজিট নেবার পর সেখান থেকে ৫০ টাকা আলাদা করে রাখতেন। সে টাকা তিনি গরীব মানুষদের সাহায্যে ব্যয় করতেন। তিনি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে বিসিক মার্কেটের চেম্বারে রোগীর ভিড় দেখার মতো ছিল। বয়স হবার পর তিনি অবসরে গিয়ে শুধু জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। সেই সময় আমরাও আগ্রাবাদ ছেড়ে নতুন এলাকায় চলে আসি।
নতুন এলাকায় আসার পর পাঁচলাইশ এলাকায় আরেকজন মানবিক ডাক্তারের সন্ধান পেয়ে যাই। তিনি একজন অধ্যাপক শ্রেনীর বিলেতের ডিগ্রীধারী ডাক্তার। নিরিবিলি আবাসিক এলাকায় নিজের বাড়ির একতলায় তিনি রোগী দেখতেন। প্রথমবার গিয়েই ডাক্তারের ব্যবহারে খুব মুগ্ধ হয়ে গেলাম। দেখলাম এই ডাক্তারের রোগীর ভিড় বেশি নেই। যেখানে ভিড় বেশি, আমি সে ডাক্তার এড়িয়ে চলি। তিনি সময় নিয়ে, মন দিয়ে রোগীর সাথে আলাপ করেন। ধীরে ধীরে ওই ডাক্তারের সাথেও সুসম্পর্ক হয়ে গেল। তিনিও আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক হয়ে ওঠেন। যে কোন সমস্যার জন্য প্রথমে তাঁর কাছে গিয়ে প্রাথমিক পরামর্শ নেই কোন পথে গেলে ভাল হবে। তিনি সবসময় সৎ পরামর্শ দিয়ে এসেছেন।
একসময় তিনি পেশাগত প্রয়োজনে ঢাকায় চলে গেলে আমাকে আরেকজন চিকিৎসা পরামর্শকের খোঁজ করতে হয়। ভাগ্যক্রমে সেটাও পেয়ে যাই। তেমন পরিচিত বা বিখ্যাত নন কিন্তু যত্ন করে রোগীর কথা শোনেন, রোগীকে কথা বলতে দেন। অনেক ডাক্তার রোগীকে ঠিকমত কথা বলতে দেন না, কথা বলার আগেই টেস্ট লিখতে শুরু করেন, এই ডাক্তার সেরকম নন। ফলে অল্পদিনে তিনি আমাদের পরিবারের ডাক্তার হয়ে ওঠেন। সময়ের হিসেব করতে গেলে গত চল্লিশ বছরে আমাদের পরিবার বিশেষ প্রয়োজন বাদে অধিকাংশ সময় মাত্র তিনজন ডাক্তারের ছায়ায় কাটিয়েছে।
সেই পারিবারিক ডাক্তারগুলোর বাইরেও আমার বেশ কয়েকজন শুভাকাঙ্খী ডাক্তার আছেন যাদেরকে আমি সময় অসময়ে বিরক্ত করি, পরামর্শ নেই যে কোন বিপদে পড়ে। করোনার সময় সেই ডাক্তারগুলো আমার পরিবারকে টেলিফোনে যত্ন করে এমন পরামর্শ দিয়েছেন আমাকে অনেক বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে। বিপদের বন্ধু নামে ডাকি আমি তাঁদের। এখনো তাঁরা প্রতিনিয়ত আমাকে যে কোন বিপদে ভরসা এবং পরামর্শ দুটোই দিয়ে যাচ্ছেন।
তাঁরা আমার ফেসবুকে আছেন তাই আমি আলাদা করে কারো নাম বলে বিব্রত করতে চাই না। সেইসব ডাক্তারের ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই, যাদেরকে কোনদিন এক টাকার ভিজিটও দেইনি। এক কাপ চা খাওয়ানোরও সুযোগ হয়নি। শুধু বাতিঘর সংলগ্ন এলাকায় আড্ডা দিয়েছি দুয়েকবার। তাদের প্রতি প্রকাশ্যে কোনদিন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিনি। আজ এই পোস্টের মাধ্যমে করলাম।

ক্যারিয়ার শুরুর একটি ছোট গল্প



এটি আমার ক্যারিয়ার সম্পর্কিত একটি গল্প। আরো বাইশ বছর আগের কথা। তখন আমার প্রথম চাকরীর বয়স মাত্র ৬ বছর। কিন্তু সেই অল্প সময়ে আমি অভাবিতভাবে কয়েকটি পদোন্নতি পেয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কিত একটি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমাদের হেড অফিস ছিল দক্ষিণ কোরিয়া। মাঝে মাঝে সেখানে যেতে হতো মিটিং কনফারেন্সে।
একবার হেড অফিস থেকে চেয়ারম্যান ডেকে পাঠালেন। যাওয়ার পর তিনি এক সুদর্শন তরুণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার পুত্র ব্রায়ান। আমেরিকা থেকে আইন পাশ করে এসেছে। সে ব্যবসাপাতিতে আগ্রহী নয়। তার ইচ্ছা ল প্র্যাকটিস করবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা সে ব্যবসাটা একটু শিখবে। তুমি তাকে গাইড করবা।’
শুনে আমি প্রথমে খানিক বিব্রতবোধ করেছি সত্যি। আমার দেশের অভিজ্ঞতায় বড়লোকের ছেলেদের মতিগতি ভালো হয় না বলে জানি।
কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে ব্রায়ানের সাথে আমার চমৎকার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। এত বিশাল কোম্পানির উত্তরাধিকারী সে, তবু বিন্দুমাত্র অহংবোধ নেই। আমাকে ওস্তাদের মতোই মান্য করে। এতটা বিনয় আমি কল্পনাও করিনি।
কয়েকদিন পর বললাম, বাংলাদেশে আসো। তোমাকে হাতে কলমে শেখাবো আরো। কোম্পানির আরো কয়েকটি দেশে ব্যবসা ছিল। সে বলতো বাংলাদেশকেই তার বেশি ভাল লাগে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম। কয়েক মাস পর সে চট্টগ্রামে এলো। প্রথমদিন তার সাথে গল্পগুজব খাওয়াদাওয়া হলো। বললো, আমার সাথে কাজ শুরু করবে পরদিন থেকে।
কিন্তু পরদিন থেকে তাকে আর অফিসে আসতে দেখি না। আমি ভাবলাম বড়লোকের খেয়ালী পুত্র। হয়তো খুলশীর বাসায় আরাম করছে নয়তো কোথাও আমোদ প্রমোদে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দুদিন পর তার সাথে দেখা হলো লাঞ্চের সময়। ঘর্মাক্ত শরীরে কাছে এসে একগাল হাসি দিল।
বললাম, 'একি দশা তোমার ব্রায়ান? কোথায় ছিলে?'
সে যা বললো তা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম। তার বাবা বলেছে, অফিসের কাজ শেখার আগে নীচের ফ্লোরে নেমে শ্রমিকেরা কিভাবে কাজ করছে সেটা দেখতে হবে। সেখানে শ্রমিকরা যে পরিস্থিতিতে কাজ করছে তাদের সাথে থাকতে হবে। শুধু পর্যবেক্ষক হিসেবে না- সত্যিকার একজন প্যাকিংম্যান হিসেবে একতলার প্যাকিং এণ্ড শিপমেন্ট ফ্লোরে তাকে তিন মাস কাজ করতে বলা হয়েছে। ওখানকার কষ্টকর অবস্থা পার হয়ে তারপর অফিসে বসার সুযোগ পাবে। তার আগে নয়।
বেচারার দুর্দশার কথা শুনে আমার মায়া লেগেছিল। আমেরিকার ডিগ্রী নিয়েও বাপের কয়েকশো মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে অশান্তিতে পড়ে গেছে। কিন্তু কিছু করার নাই। তার বাপ ঘাড়ত্যাড়া। এক কথার লোক।
তবে সে এক মাসের মধ্যেই এত ভাল কাজ শিখে ফেলেছে যে তাকে দুমাস মওকুফ করে অফিসে প্রমোশন দেয়া হলো। কিন্তু অফিসে পদোন্নতি পেলেও ম্যানেজার বা কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। সাধারণ অফিসার হিসেবে আমার কাছে বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যাংকিং, শিপিং ইত্যাদির দীক্ষা নেয় চুপচাপ পাশে বসে। কয়েক মাস পর হেড অফিসে বদলি করা হলে অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিল।
আমি ওই কোম্পানি ছেড়ে এসেছি আট বছর আগে। তখন পর্যন্ত ব্রায়ানকে শীর্ষস্থানীয় কোন পদ বা ডিরেক্টরশীপ দেয়া হয়নি। কোম্পানির সকল উঁচু পদে ছিল আমাদের মতো বাইরের লোকেরাই।
এই বিষয়ে তার কোন আক্ষেপ আছে কিনা আমি জানতে চেয়েছিলাম। জবাবটা খুব পছন্দ হয়েছিল।
সে যা বলেছিল তার সারমর্ম ছিল: উত্তরাধিকার সূত্রে কোম্পানির শীর্ষপদে বসে যাওয়া সম্মানজনক ব্যাপার নয়। বাবার মতো সেও পৃথিবীকে নিজের যোগ্যতায় জয় করতে চায়।
আজকের পত্রিকায় দেখলাম অনুর্ধ ত্রিশ এক পুত্র তার পিতার কল্যানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে গেছেন।
বুঝলাম, বাঙালীরা জগতের অন্য সকল জাতির তুলনায় কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে।