Wednesday, November 25, 2009

অমূল্য মাষ্টারের বিয়েটা আমাদের কখনোই খাওয়া হয়নি

অমূল্য মাষ্টারকে বহুদিন পর মনে পড়লো।

ব্যাপক সিনেমা পাগল অমূল্যচন্দ্র ম্যানোলা কোম্পানীর চাকরীর পাশাপাশি টিউশানিও করতো কয়টা। তার মধ্যে একটা আমাদের বাসা। তরুন অকৃতদার এই লোক 'অমূল্য মাষ্টার' হিসেবে পরিচিত ছিল এলাকায়। লজিং থাকতো আমাদেরই এক প্রতিবেশীর বাসায়। লোকটা বড়দের কাছে রসিক মানুষ হলেও ছোটদের যম ছিল।

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ুয়া বলে আমি পড়তাম না তার কাছে, ফলে তার বেত আমাকে ছুঁতে পারেনি কখনো। হম্বিতম্বি সব প্রাইমারী লেভেলের ভাইবোনদের উপর দিয়েই যেত। দৈনিক একবেলা এক ঘন্টা এসে পড়িয়ে যেতো আমাদের বাসায়। কিন্তু আড্ডা দিতো আরো দেড় দুইঘন্টা। আমার এক চাচা ছিলেন ওনার সমবয়সী, তাই একটা আড্ডার সম্পর্ক ছিল দুজনের। কিঞ্চিত বড় হবার সুবাদে অমূল্য মাষ্টারের সাথে আমার ঠিক বন্ধুত্ব না হলেও প্রায়ই ওদের গল্পে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা হবার চান্স নিতাম। বয়সটা ইঁচড়ে পাকা হয়ে ওঠার উপযুক্ত বলে ওদের গল্পের মধ্যে রসের আনাগোনা বুঝতেও খুব বেশী কষ্ট হতো না। কিন্তু চেহারায় "কলা ছিলে না দিলে খেতে পারিনা" ভাব নিয়ে পড়ে থাকতাম।

অমূল্য মাষ্টারের তিনটা ঘটনা এখনো ভুলতে পারিনি। সেটাই বলি।

১. তাকে সিনেমাপাগল বা সিনেমা উন্মাদ যাই বলা হোক, হলে গিয়ে একনাগাড়ে সর্বাধিক সময় সিনেমা দেখার রেকর্ড অমূল্য মাষ্টার বাদে আর কারো আছে কিনা জানা নেই। তখনও মানুষের যাতায়াত ছিল সিনেমা হলে, সেই ৮০-৮২ সালের দিকে। আমরাও যেতাম মাঝে মাঝে। কিন্তু অমূল্য মাষ্টারের সিনেমা দেখাটা ছিল বিশাল ব্যাপার। সেই সময় 'লাভ ইন সিঙ্গাপুর' ও 'সওদাগর' নামে দুটো সিনেমা বাংলাদেশে ব্যাপক হিট খায়। সেই সিনেমা দুটো অমূল্য মাষ্টার দেখেছিল প্রতিটা ১২ বার করে। শুধু কি তাই? একদিন এক নাগাড়ে দিনের ১২টা থেকে শুরু করে রাত ১২টা পর্যন্ত সবগুলো শো-র টিকেট কিনে বারোঘন্টা সিনেমা দেখেছিল নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে। ভাবা যায়?

২. ম্যানোলা তখন বাংলাদেশে নামকরা কসমেটিক কোম্পানী। অমূল্য মাষ্টার ম্যানোলা কোম্পানীর কোন পদে চাকরী করতো জানি না। কিন্তু বেশ বড় পদে নিশ্চয়ই। স্নো আর ক্রীম এত সুলভ ছিল তার কাছে যে সে মুখ মাথা এমনকি হাঁটু থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত ক্রীম মেজে আসতো কাজ থেকে ফেরার সময়। একদিন আমাকে বলেই ফেললো, আমাকে একটা ডানোর বড় টিন দাও তোমাদের জন্যও টিন ভর্তি করে ক্রীম নিয়ে আসবো। আমি হাঁটু আর পায়ের তালু পর্যন্ত ক্রীম মাজার উপকারিতা কি ভাবতে ভাবতে মার কাছে ডানোর টিন চাইতে গিয়ে রুটি সেঁকার খুন্তির তাড়া খেয়ে পালালাম।

৩. অমূল্যের সাথে তার গ্রামের একটা মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে ছিল। সেই সামনের বৈশাখে বিয়ে। মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়ে। অমূল্য মেয়েটাকে পড়াতো আগে থেকে। পড়াতে গিয়েই জীবন সঙ্গী নির্বাচন। আমাদের সাথে প্রায়ই গল্প করতো মেয়েটা কিরকম মেধাবী, কত সুন্দর, মেট্রিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পাবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। তার হবু বউয়ের গল্প শুনতে শুনতে অমূল্যের স্বপ্নটা আমাদেরও ছুয়ে যেত। কিন্তু বৈশাখ কাছাকাছি আসতেই অমূল্যের পরিবারে কে যেন একজন মুরব্বী মারা যান। ফলে বিয়ে স্থগিত হয়ে যায় এক বছরের জন্য। এক বছর কেন?

তখন শুনেছিলাম হিন্দুশাস্ত্র মতে পরিবারের বড় ছেলের বিয়ে নাকি বৈশাখেই হতে হয়। সত্যমিথ্যা জানি না। তবে আমরাও মেনে নিয়েছিলাম যেহেতু অমূল্যও মেনে নিয়েছিল। আমরা পরবর্তী বৈশাখের অপেক্ষায় থাকি। আমাদের অপেক্ষা বিয়েতে আমোদ ফূর্তি করা, ব্যাপক খাওয়াদাওয়ার উৎসবের জন্য। আগাম দাওয়াত পেয়ে গিয়েছিলাম। অমূল্য প্ল্যান করতে থাকে কিভাবে কি করবে।

কিন্তু পরবর্তী বছরে পরিবারের আবারো কার যেন দেহত্যাগ ঘটলো। বিয়ে আবারো স্থগিত। অমূল্য এসে বিষন্ন মুখে পড়ায়। আমরাও বিষন্ন থাকি। খাওয়াটা না জানি মার যায়। পরের বছর অমূল্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে হবু বউয়ের মেট্রিক পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার পুরো সময়টা দিনরাত খেটেখুটে পরীক্ষার হলে ডিউটি দিয়ে পার করে। পরীক্ষার তিনমাস পর রেজাল্ট দিল। বউ ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে!!! কি আনন্দ আমাদের! সব কৃতিত্ব অমূল্য মাষ্টারের। খুশীতে ব্যাপক মিষ্টিমুখ করানো হলো আমাদের। আমরা নিশ্চিত হই এবার বিয়েটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। সামনের বৈশাখেই বিয়েটা খাবো আমরা।

কিন্তু বিয়ের দিন ঘনাবার অনেক আগেই একটা দুঃসংবাদ আসলো। না, এবার কেউ মারা যায়নি। এবারের ঘটনা ভিন্ন। মেয়ের ভালো রেজাল্ট দেখে পাত্রীপক্ষ পিঠটান দিয়েছে। হবু শ্বশুর এখুনি মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। আরো উচ্চশিক্ষিত করে তারপর বিয়ে। আসল কথা ভালো রেজাল্টের কল্যানে পাত্রীর বাজার দর অনেক বেড়ে গেছে। ক্লাস নাইনে থাকতে বিয়েটা হয়ে গেলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু মেয়ে ফার্স্ট ডিভিশান পেয়ে যাওয়াতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ অমূল্যচন্দ্রকে এখন নিতান্ত বেমানান লাগছে মেয়েপক্ষের কাছে।

ফলতঃ অমূল্য মাষ্টারের বিয়েটা আমাদের কখনোই খাওয়া হয়নি।

ছয় টাকার চাকরী, চুয়ান্ন টাকার খেসারত

যেনতেন একটা চাকরী পেতেও কত যুদ্ধ, কতরকম নাকানিচুবানি খেতে হয় মানুষের। অথচ আমরা দুইবন্ধুতে মিলে সাড়ে তিনটাকা বাসভাড়া আর আড়াই টাকার কাগজ খামের খরচ দিয়ে চাকরী বাগিয়ে ফেলেছিলাম। শায়েস্তা খানের আমলে নয়, মাত্র সোয়াযুগ আগে নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে। তবে ছয়টাকা ব্যয় করে চাকরী পাওয়াও ব্যাপার ছিল না।

ব্যাপারটা হলো ওই চাকরীটা পেতে আমাদের আরো চুয়ান্ন টাকা খরচ করতে হয়েছিল। সেই বাড়তি চুয়ান্ন টাকা খরচের ঘটনাই বলি।

পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সাদা কাগজে দরখাস্ত লিখে অনেকটা মজা করার উদ্দেশ্যেই ইন্টারভিউ দিতে গেলাম আমি আর বিল্লাহ। জীবনের প্রথম দরখাস্ত একটা প্রায় ওয়াক ইন ইন্টারভিউর জন্য। দরখাস্ত জমা দিতে গিয়ে দেখি প্রচন্ড ভীড় অফিসের গেটে। শুনলাম পোষ্ট খালি আছে বারোটা, দরখাস্ত পড়েছে সাড়ে ছয়শো। ১০% চান্সও নেই। বিল্লাহ নিদারুন হতাশ। আমি বললাম, 'নো চিন্তা বন্ধু জীবনের প্রথম ইন্টারভ্যু, চাকরী না পেলেও ইন্টারভিউ চর্চা হয়ে যাবে প্র্যাকটিক্যালি।'

উপস্থিত প্রার্থীদের মধ্যে পোষাক আশাকে আমাদের দুজনের চেয়ে ক্ষ্যাত আর কেউ ছিল না। আমার কটন প্যান্টের উপর ছেড়ে দেয়া শার্টের সাথে ঘষে যাওয়া বাটা চপ্পল। এই বেশে চাকরী পাবার কোন সম্ভাবনা নাই। এখানে আজ সব টাই পরা বাঙালী। বিদেশী কোম্পানী স্মার্ট লোকই চাইবে। কত যত্ন করে প্লাষ্টিক ফোল্ডারে বায়োডাটা এনেছে একেকজন। আর আমাদের দরখাস্ত চন্দ্রঘোনার আদি বাঁশঝাড়ের মন্ডে তৈরী কেপিএমের লালচে হোয়াইট প্রিন্ট কাগজ। দরখাস্ত জমা দেবার ঘন্টাখানেক পরেই ডাক এল। ইন্টারভিউ বোর্ডে একজন বাঙালী দুজন বিদেশী। আমার ত্যানামার্কা হাতে লেখা দরখাস্তটা দুআঙুলের চিপায় নিয়ে মাঝ বয়সী বিদেশী ভদ্রলোক বললেন, এটাই তোমার? বললাম, জী। এটা তোমার হাতের লেখা? বললাম, জী।

সেই বড়কর্তার মুখে খানিক ব্যাঙ্গের হাসি লক্ষ্য করে আমি শিওর হয়ে গেলাম আমার চাকরী হবে না। না হলে না হোক। প্রথম ইন্টারভ্যুতেই লাগবে এমন সম্ভাবনা নাই। হবেই না যখন ডেসপারেট হয়ে বাকী সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। এক পর্যায়ে কর্তা বললেন, তোমার সাবজেক্ট তো অ্যাকাউন্টিং তোমাকে আমি অ্যাকাউন্টসের জন্য নিলাম, কি বলো? আমি চেয়ার থেকে আলগা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বললাম, ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু দুঃখিত আপনার চাকরী আমি করবো না। আমি গেলাম, গুডবাই (আমি যদিও অ্যাকাউন্টিং এ পড়েছি কিন্তু চাকরীতে ওটা নেবো না বলে কঠিন প্রতিজ্ঞা ছিল)।

ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বললেন, আরে করো কি। বসো বসো, ঠিক আছে, তোমার যা পছন্দ তাই দেয়া হবে তোমাকে। তবে একটা কথা। তোমার নাকের নীচের ওই কালো গোঁফ জোড়া তো বাদ দিতে হবে। শুনে চমকে উঠলেও মুখে বললাম 'প্রবলেম নাই'। বলা হলো লাঞ্চের পর রেজাল্ট দেবে। কিন্তু বেরিয়ে এসে ভাবলাম, ব্যাটারা বলে কি? আমার এত সাধের পাকানো গোঁফ ফেলে দেবো? গুষ্টি মারি তোর চাকরীর। আয় যাই গা। বিল্লাহকে নিয়ে রাস্তায় উঠে একটা বাসে চড়ে বসলাম। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে ফোঁটাফোঁটো।

বাসটা আগ্রাবাদের কাছাকাছি আসতেই বৃষ্টিটা কুকুর বিড়াল রূপ নিল। বৃষ্টির ধুন্ধুমার নাচনে রাস্তাঘাট, অফিস, দোকানপাট সব ঝাপসা দেখছি। বাস থেকে নেমে দাঁড়ানোর জায়গাও নাই। হঠাৎ মনে পড়লো নতুন চাকরী পাওয়া বন্ধু ডিউর অফিস তো এখানেই। বাসটাকে থামাতে বলে একদৌড়ে ওর অফিস বিল্ডিং-এ ঢুকে গেলাম। ইস্পাহানীর অফিস। চারতলায় উঠে ওর অফিসে উঁকি দিলাম। আমাদের দেখে বেরিয়ে এল সে। ওর নতুন চাকরীটা পাবার পর একটা খাওয়াদাওয়া হবার কথা ছিল। ধরলাম আজকেই পাওনাটা মিটিয়ে দে। রাজী হলে কাছাকাছি একটা রেষ্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম আধভেজা হয়ে।

খেতে খেতে চাকরীর ইন্টারভিউর কথাটা বললাম। গোঁফ বিসর্জন দিয়ে চাকরী করবো না বলেও জানালাম। কথা শুনে ডিউ ধমকে উঠলো, 'ব্যাটা মাগনা চাকরী পাবি নাকি। একটা কিছু ছাড় দিতেই হয়। এতো সামান্য গোঁফ। গোঁফ গেলে গোঁফ আসবে। আমার তো গোঁফই নাই। যা, খেয়েদেয়ে সোজা ফিরে যা আবার। রেজাল্ট জেনে ফিরবি।' এই জাতের হুকুম আশা করিনি ওর কাছে, কিন্তু আজকে ও খাওয়াচ্ছে। তাই বিশেষ কিছু না বলে গোমড়া মুখে বিল্লাহকে নিয়ে চাকরীর রেজাল্ট আনতে গেলাম। গিয়ে দেখি, দুজনেই পাশ!!! তবে এখন একটা দ্বিতীয় ইন্টারভিউ হবে। সেই বাছাইতে টিকলে তবেই ফাইনাল। অপেক্ষা করতে বলা হলো আবারো। দুশ্শালা! মনে মনে গালি দিলাম।

বেরিয়ে এসে পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে ধরালাম। ফুটপাতের সিমেন্টে পাছা ঠেকিয়ে বসলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ আগে। সিগারেট অর্ধেক শেষ করার পর খেয়াল করলাম সামনের চত্তরে ইন্টারভিউ বোর্ডের সেই বিদেশী ভদ্রলোক পায়চারী করছে আর আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে ধুমসে বিড়ি টানতে লাগলাম। দ্বিতীয় ইন্টারভিউতে ভদ্রলোককে দেখা গেল না বলে একটু স্বস্তি পেলাম। দেখা গেল, দুই নম্বর ইন্টারভিউতেও টিকে গেলাম দুইজনে। ধুত্তোরি। এত করেও ঠেকানো গেল না চাকরীটাকে। গোঁফজোড়া এবার ছাড়তেই হবে!! ঘোড়ার ডিমের চাকরী আমার। কিন্তু বাবার সংসার ভারাক্রান্ত চেহারা মনে হতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, চাকরীটা করবো। তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতেই বাসায় ফিরলাম।

ঘটনাটা এখানেই শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু হলো না।

পাড়ায় কিভাবে যেন গোঁফ ছাটার কথাটা রটে গিয়েছিল। সন্ধ্যার সময় পাড়াতো বন্ধুরা সব দলবেধে হাজির। চাকরীর শুভেচ্ছা জানাতে নয়, এসেছে গোঁফ ছাঁটা অভিযানে সঙ্গ দেবার বাসনায়। আমার শোক ওদের মচ্ছব! ঘোষনা করা হলো এই ঘটনা বিনা উৎসবে ছাড়া যাবে না। পাড়ার নাপিতকে দিয়ে বিশেষ কায়দায় ছাঁটানো হবে আমাদের গোঁফ। পরিষ্কার বুঝে গেলাম বেইজ্জতীর বিশেষ আয়োজন করা হলো। কোন অজুহাতে পালিয়ে দুরে কোন অচেনা নাপিতের সেলুনে গিয়ে কাটতে চাইলাম। কিন্তু আমাদের দুজনকে চোখে চোখে পাহারায় রাখা হলো। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখা গেল ছোটখাট একট মিছিল হয়ে গেছে দশবারো জনের। সবাই প্রথমে মোড়ের টং দোকানে গিয়ে একচোট চা বিস্কুট সিগারেট চালালো আমাদের উপর দিয়ে। চল্লিশ টাকা এক ধাক্কাতেই শেষ। তারপর আমাদের দুজকে সেলুনে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। আর সবাই চারপাশে ঘিরে দাড়ালো যেন চিড়িয়াখানার বাঁদরকে শেভ করানো হচ্ছে। হাসাহাসি চলছে খুব।

পাঁচমিনিটেই সাফা হয়ে গেল দশ বছরের শান দেয়া গোঁফ। আয়নায় নিজেরে চিনতে পারলাম না। যাত্রাপালার সং দেখছি যেন। এই চেহারার নিয়ে রাস্তায় বেরুবো কী করে? ভীষন বিব্রত অবস্থায়ও কাষ্ঠ হাসি দিতে হলো। সেলুনের ভেতর বাইরে থেকে প্রবল করতালি শুরু হলো। কাজ শেষে বিল দেবার সময় এলো নাপিতের আবদার। দুই জনের গোঁফছাটা দশটাকার ব্যাপার। কিন্তু নাপিত ব্যাটা বলে বসলো, 'দাদারা জীবনে প্রথম গোঁফ ছাঁটলেন। আমাদের বকশিশ না দিলে দাবী রেখে দেবো'। পুরোনো নাপিত, নতুন আবদার, কত বেতমিজ। কিন্তু কি আর করা। দুটাকা দুটাকা করে আরো চার টাকা গচ্ছা দিলাম।

সবাইকে বিদায় দিয়ে দুই বন্ধুতে আলাপ হচ্ছিল। অত্যন্ত হিসেবি ও মিতব্যয়ী বিল্লাহ বেজার মুখে বললো, "দোস্ত চাকরী পাইতে খরচ হইছে ছয়টাকা। কিন্তু গোঁফ ছাঁটার খেসারত তো গেল চুয়ান্ন টাকা। দুনিয়াতে বিচার নাই। এই ভাবেই সম্পদের অপচয় হয়!!"

চট্টগ্রামের লেইঙ্গা মাষ্টারঃ যাকে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম!

১৯১০ সালের দিকে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর এক মেধাবী ছাত্র যাদববাবুর পাটীগনিতের একটা অংক নিয়ে সমস্যায় পড়লো। স্কুলের কোন শিক্ষকই অংকটির সমাধান করতে পারলেন না। ছেলেটি থাকতো আগ্রাবাদের ছোটপুল এলাকায়। শেষ চেষ্টা হিসেবে সে প্রতিবেশী এক অংক পন্ডিতের কাছে গেল সমস্যাটি নিয়ে, তিনিও বহু চেষ্টা করে সমাধান করতে পারলেন না।

কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত দিলেন। বললেন যে যাদববাবুর ওই অংক প্রশ্নটিতে ভুল আছে। মারাত্মক অভিযোগ! যাদববাবুর অংকের বিরূদ্ধে এত বড় অভিযোগ তোলার সাহস উপমহাদেশে কারো ছিল না তখন। পরদিন মিউনিসিপ্যাল স্কুলের শিক্ষকগন কথাটি শুনে একচোট হাসলেন। বললেন, এত বড় পন্ডিত যাদববাবু, আর তার ভুল ধরে কোথাকার এক প্রাইমারী পাশ লেইঙ্গা মাষ্টার।

লেইঙ্গা মাষ্টারের আসল নাম আবদুস সোবহান। পড়াশোনায় প্রাইমারী পাশ হলেও মেধায় ছিলেন অতুলনীয়। ছেলেবেলায় গাছ থেকে পড়ে কোমরে আঘাত পেলে কোমরের নীচ থেকে পা পর্যন্ত অচল হয়ে যায়। চলাফেরা করতেন বিয়ারিং এর চাকায় তৈরী কাঠের পাটাতন দিয়ে বানানো গাড়ীতে বসে। চাটগাঁইয়া ভাষায় পঙ্গু বা চলৎশক্তি বিহীন লোককে বলা হয় লেইঙ্গা। প্রচন্ড শিক্ষানুরাগী এই মানুষটির শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। তিনি আগ্রাবাদের বেপারী পাড়া এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি প্রাইমারী স্কুল। নাম আগ্রাবাদ প্রাইমারী স্কুল। ওই এলাকার প্রথম স্কুল সেই বৃটিশ আমলে। কথিত ছিল লেইঙ্গা মাষ্টারের বেতের দৈর্ঘ্য নাকি তার স্কুলের চেয়েও বড়। এত কড়া শাসনে রাখতেন স্কুল।

তো লেইঙ্গা মাষ্টারের কানে এলো মিউনিসিপ্যাল স্কুলের শিক্ষকদের বিরূপ মন্তব্য। তিনি প্রত্যুত্তর না দিয়ে নীরবে ভাবতে লাগলেন। কয়েকদিন ভেবে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংক বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে। বিস্তারিত যুক্তি তুলে জানালেন কেন যাদববাবুর পাটিগনিতের ওই অংক প্রশ্নটি ভুল। তিনি ভুলটা শুদ্ধ করে একটা সমাধানও চিঠির সাথে পাঠিয়ে দিলেন।

চিঠি পেয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংক বিভাগের প্রধান প্রফেসর বোস সহকর্মী অন্যান্য অধ্যাপকদের নিয়ে একটা বোর্ড বসালেন। নানান আলোচনার পর বোর্ডের সবাই অবাক হয়ে একমত হলেন যে সেই অখ্যাত লেইঙ্গা মাষ্টারের কথাই ঠিক! অংকটি আসলেই ভুল ছিল। ফিরতি জবাবে তাঁরা আবদুস সোবহানকে পন্ডিত উপাধি দিয়ে একটা সার্টিফিকেট ও নগদ পাঁচশো টাকার একটা মানি অর্ডার সম্মানী পাঠালেন।

সেই লেইঙ্গা মাষ্টারের মৃত্যুর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর পর আগ্রাবাদ এলাকায় সরকারী কর্মকর্তাগনের চেষ্টায় স্কুলটিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয় আগ্রাবাদ প্রাইমারী স্কুল নামে। যেটি বর্তমানে "আগ্রাবাদ সরকারী কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়" নামে পরিচিত।

সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো আমি লেইঙ্গা মাষ্টারের এলাকায় দীর্ঘ বিশটি বছর বসবাস করেছি। সেই স্কুলে দশটি বছর পড়াশোনা করে মেট্রিক পাশ করেছি। কিন্তু কেউ কখনো ঘুনাক্ষরেও লেইঙ্গা মাষ্টারের কথা বলেনি আমাদের। কত তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের কীর্তিমান পূর্বপুরুষের কথা ভুলে যাই! মাত্র গতকাল রাতে শুনলাম আমি লেইঙ্গা মাষ্টার ইতিকথা।

একটু শান্ত্বনার সংবাদও পেলাম গতকাল। ২০১০ সালের জানুয়ারীতে স্কুলের ৫০ বছর পুর্তি উৎসবে লেইঙ্গা মাষ্টারকে মরনোত্তর সম্মান জানাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের খেদ যদি তাতে একটুও মেটে!

[তথ্যসুত্র কৃতজ্ঞতাঃ সাখাওয়াত হোসেন মজনু ভাই]

ঠিক গল্পও নয়

পরামানিকের কানাচোখে দৃশ্যটা দেখার কথা ছিল না। কিন্তু একটা পাথরে বেমক্কা হোঁচট খেয়ে যেখানে পড়ে গেল তার পাশেই রমিজ মন্ডলের গুদাম ঘরের দেয়ালের ফোকড়টা। ফোকরটা যেখানে ঠিক সেই বরাবর পরামানিকের বামচোখটা পড়লো এবং অনুচিত দৃশ্যটা দেখে ফেললো। দেখেই পালাতে চেয়েছিল।

কিন্তু রমিজ মন্ডলের বর্বর ছেলে মাখন মন্ডল তার আগেই ফোকড় দিয়ে পরামানিককে দেখে ফেললো। দেয়াল টপকে বাইরে এসে "হারামীর পো কাউকে বললে খুন করে ফেলবো" বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর।

পাঁচমিনিটের মাথায় পরামানিক দুই চোখেই সমান আঁধার দেখলো। দৃশ্যটা না দেখলেই কি বাঁচতো পরামানিকের বাকী চোখটা? অনুচিত দৃশ্য দেখতে হবে জানলে ফোকড়ে তাকাতোই না। কিন্তু দেখার আগে বুঝবে কি করে ভেতরে কি চলছে?

এ তার কর্মের ফল, নাকি কপালের দোষ? তাকানোটা আকাম হয়েছে, কিন্তু হোঁচটটা খেয়েছে কপাল দোষে।

কর্মের দোষ কপালের ঘাড়ে চাপিয়ে অঝোরে কাঁদতে বসলো পরামানিক।

মানীর মান জুতার বাড়িতেও যায় না, কথাটা ভুল

আমার এক প্রতিবেশী গিয়াস সাহেব। দুর সম্পর্কের আত্মীয়ও হন। সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন রাজস্ব বিভাগে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন মর্মে সার্টিফিকেটও আছে। আমি তাকে যথেষ্ট ভক্তিশ্রদ্ধা করতাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। এলাকায় সন্ধ্যার পর প্রায়ই বিদ্যুত চলে যায়। এটা একটা নিয়মিত চিত্র চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের। মজার ব্যাপার হলো গিয়াস সাহেব এই ঘটনার মধ্যে বিরাট ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতেন। ফিসফিস করে বলতেন, "বুঝলে ভাতিজা। এই সবই হিন্দুদের চক্রান্ত। হিন্দুর ছেলেরা দিনের বেলা পড়াশোনা করে রাখে, রাতে খেলাধুলা করে। তাই রাতে মুসলমানের ছেলেমেয়েরা যাতে পড়তে না পারে সেজন্য কারেন্ট বন্ধ করে দেয়। হিন্দুরা চায়না মুসলমান শিক্ষিত হোক। সব ইন্ডিয়ার চক্রান্ত"। আমি তাজ্জব শুনে।

আর একবার কোরবানীর সময় শেয়ারে গরু কোরবানী দিয়েছিলাম ওনার সাথে। গরু জবাই করার সময় কসাইদের সাথে আমিও ট্যাং ধরলাম একটা। কিন্তু গরুর লাথির চোটে আমি তিন লাফে গরু ছেড়ে পালিয়ে এলাম। এটা দেখে গিয়াস সাহেব রেগে গেলেন। আমার বাবাকে অভিযোগ করে - "কিসের এমএ পড়া ছেলে আপনার, গরুর ট্যাংটাও ঠিকমতো ধরতে পারে না। যতসব অপদার্থ।" এইটা শুনে বাবা লা জওয়াব, আর আমরা আড়ালে গিয়ে হাসি।

এই ভদ্রলোক সবকিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজতে ভালোবাসতেন। সহজ বিষয়কেও জটিল করে দেখতে ভালোবাসতেন। দেখতে সুশ্রী হ্যান্ডসাম এই ভদ্রলোক এত নরম স্বরে কথা বলবেন যেন ফেরেশতার বানী নির্গত হচ্ছে। প্রথম দৃষ্টিতে দেবদুত মনে হবার কথা। কিন্তু যেদিন গিয়াস সাহেবের মধ্যে ওই নোংরা সাম্প্রদায়িক মনোভাব দেখলাম, অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনলাম সেদিন থেকে শ্রদ্ধাটা যেন বাষ্পীভুত হয়ে গেল। গিয়াস সাহেবকে সালাম দিতেও কুন্ঠিত হই এখন।

শ্রদ্ধেয় মানুষদের শ্রদ্ধার আসন ধরে রাখার জন্য সতর্ক থাকা উচিত। মানীর মান জুতার বাড়িতেও যায় না, কথাটা ভুল।

[উৎসর্গ: ব্লগের বেইজ্জতাপন্ন মানীগুনীজন]

তোর বন্ধুতায় আমি যে বিব্রত এখন, হে বন্ধু আমার!

পাকাপাকিভাবে শহরবাসী হই প্রথম স্কুলে ভর্তি হবার সময়। ১৯৭৪ সালে 'পাঠশালা' শব্দের সহজ বানানটা হেডমাষ্টারের ভয়ের চোটে গুলিয়ে ফেলে ক্লাস টুর বদলে ক্লাস ওয়ানে যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম তার নাম আগ্রাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। তখনকার দিনে সরকারী প্রাইমারী স্কুলগুলোতে সর্বশ্রেনীর মানুষের সন্তানেরা পড়তো। ১৯৭৪ সাল ছিল দুর্ভিক্ষের সময়। কলোনীর সিড়িগুলোতে গ্রাম থেকে আসা শত শত দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সমাগম।

মনে পড়ে স্কুল থেকে আমরা জাতিসংঘ মার্কা নীল রঙের খাতা কলম রাবার পেয়েছিলাম। সেই সাথে সম্ভবতঃ বিস্কুট আর দুধপাউডারও দেয়া হয়েছিল। ক্লাসে প্রথমদিন যে ছেলেটির পাশে বসেছিলাম তার নাম মিলন। আমার প্রথম স্কুল বন্ধু। ওর রোল নাম্বার দশের ভেতরে হলেও আমার রোলনাম্বার ছিল ৬৯। এটি ক্লাসের সর্বশেষ রোলনাম্বার। এই সম্মানটা আমি পাবার কারন হলো আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র ১৬ দিন আগে। সুতরাং শিক্ষা জীবনটা শুরুই হয়েছিল লাষ্ট বয় হিসেবে।

মিলন আমার চেয়ে স্বাস্থ্যবান ও দেখতে বড়সড় ছিল। বাবা সেদিন মিলনকে বলেছিল আমাকে একটু দেখে রাখতে। কারন গ্রাম থেকে সদ্য এসেছি শহরে, শহুরে কেতা তেমন কিছুই বুঝি না। মিলন কথা রেখেছিল। আমাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল যতদিন পেরেছে। অদ্ভুত ভালোবাসা আর মমতায় ঢেকে রেখেছিল আমাকে। মিলনের বাবা ছিল কোন এক সরকারী দফতরের পিয়ন, আবার নিকটস্থ কাঁচাবাজারে তাঁর একটা সবজীর দোকানও ছিল। এখন অনেকে অবাক হবে সবজী বিক্রেতা শ্রেনীর ছেলের সাথে কিভাবে বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু তখনকার সময়ে কার বাবা কি সেটা নিয়ে বন্ধুত্বে কোন হেরফের হতো না। ভেদাভেদ শুরু হয়েছিল আরো অনেক পরে, আরো বড় হতে হতে, সচেতন হতে শুরু হবার পর। মিলন আমার বন্ধু ছিল ততদিন, যতদিন শ্রেনীসচেতন বন্ধুগন আমার চারপাশ ঘিরে ফেলেনি। সম্ভবতঃ ক্লাস থ্রী থেকে আমার নতুন বন্ধু যোগ হতে শুরু করে। মিলনের সাথে দুরত্বের সুত্রপাত তখন থেকে।

ক্লাস ফাইভে উঠতে উঠতে আমার বন্ধুমহলে বহুজাতের বাঁদরের আগমন ঘটে। সহজ সরল মিলন তাদের সাথে এঁটে উঠতে পারলো না। সেইসব উৎপাতে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ বৃদ্ধির কারনে মিলন আমার সাথে তেমন থাকে না। ফলে তার সাথে আমার দুরত্ব বাড়তেই থাকে। সম্ভবতঃ ক্লাস ফাইভের পর মিলন আর পড়াশোনা করেনি। আমাদের বন্ধুতার মৃত্যুঘন্টা বেজে গিয়েছিল তখনই। এরপরেও অবশ্য তাকে মাঝে মাঝে দেখতাম বাজারের তরকারির দোকানে বসতে। আমি ততদিনে মোটামুটি শ্রেনী সচেতন হয়ে উঠেছিলাম বলে মিলনকে বন্ধু স্বীকার করতে আমার ভেতর লজ্জাবোধের সৃষ্টি হয়। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর আমার মিলনপর্ব চুকে যায় স্থায়ীভাবে।

আরো পঁচিশ বছর পরের কথা।

একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তার পাশের দোকান থেকে ফলমূল কিনছিলাম। হঠাৎ কাঁধে একটা হাতের অস্তিত্ব অনুভব করি। ফিরে তাকিয়ে আমার মুখটা হা হয়ে যায়। এ কে? কত যুগ আগের মুখ এটি। এখনো অবিকল সেই মুখ, সেই মায়া, সেই হাসি। এ তো আমার ছেলেবেলার বন্ধু মিলন!! সে যখন আমার নাম ধরে যখন ডাক দিলে আমি অবাক, আমাকে চিনেছে ও? আমার হাতটা ধরে শক্ত একটা চাপ দিলে মনে পড়লো ওর গায়ে আগের মতোই আমার চেয়ে বেশী জোর। ওই চাপেই বুঝে গেলাম মিলন এখনো আগের আন্তরিকতা ধরে রেখেছে। কথায় কথায় জানতে পারলাম মিলন এখন সরকারী চাকরী করে। কোন একটা ডিপার্টমেন্টের মিস্ত্রী পদবীতে কাজ করে। তার পোষাক একটু গরীবি হলেও চেহারায় পুরো আত্মবিশ্বাস। আমাকে যেন এখনো ভরসা দিয়ে যাচ্ছে। আছি বন্ধু তোমার জন্য।

মিলনের কথাবার্তা কুশালাদি জিজ্ঞেসের ভঙ্গীমায় পুরোনো আন্তরিকতা বিদ্যমান থাকলেও, শ্রেনীসচেতন আমি কিন্তু খানিক বিব্রত। ওকে এড়াতে পারলে যেন বাঁচি। মিলন যতটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার পরিবারের খোঁজখবর করছে, আমি ততোধিক আলগা হয়ে জবাব দেবার চেষ্টা করছি। এমনকি মিলনের পরিবারের কে কোথায় আছে আমি তা একবারও জানতে চাই না। পালিয়ে যাবার অজুহাত হিসেবে মিলনকে বলি, আজ আমার খুব কাজ আছে, পরে দেখা হবে। কিন্তু মিলনের হাত ছাড়তে অনিচ্ছুক। সে জোর করে আমাকে তার নিকটবর্তী বাসায় নিয়ে যায়। উচ্চকন্ঠে তার পরিবারের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। এবং সবচেয়ে যেটা অবাক করেছে- আমার বাবা তাকে দুই যুগ আগে একটা বিদেশী বেল্ট উপহার দিয়েছিল সে এখনো রেখে দিয়েছে সেই স্মৃতি। আমি বিব্রত অবস্থায়ও মুগ্ধ হয়ে যাই ওর আন্তরিকতায়। বন্ধুত্ব কত বছর জিইয়ে থাকে? সেরকম কোন সীমারেখা কি আছে?

মিলনকে দেখে বুঝলাম সত্যিকার বন্ধুত্বের কোন শ্রেনীভাগ থাকে না। কিন্তু আমার ভেতরে যে বৈষম্যের বীজ অংকুরিত হয়েছিল শৈশবে এখন তা মহীরূহ। আমি সেটা উপেক্ষা করে মিলনকে কিছুতেই বন্ধুতার কাতারে আনতে পারলাম না আর। তাই বিদায় নেবার সময় মিলনকে মুখে বললাম, দেখা হবে। কিন্তু একবারও বললাম না- 'একদিন সময় করে বাসায় আসবি। একবেলা খাবি আমার সাথে।' এমনকি আমার নতুন বাসার ঠিকানাও বললাম না ওকে।

বাসায় ফেরার পথে একা একা ভাবতে লাগলাম মানুষের স্বার্থপর শ্রেনীসচেতনতার বীজ কত গভীর হয়!! দেশ উদ্ধার করা আড্ডাবাজিতে শ্রেনীবৈষম্যের বিরূদ্ধে এত বড় বড় গীত গাই, সামাজিক অবিচারের বিরূদ্ধে চায়ের কাপে ঝড় তুলি, সেই আমি কী এই আমি? আমার সবগুলো সুশীল আচার কি মুখোশ নয়? বই-খাতা-কলম-কীবোর্ডের বাইরে ব্যক্তিজীবনে আমরা কতটা ভন্ড, হায়!

একচোখা এক বিষন্ন চিল

একচোখা একটি বিষন্ন চিল একা একা উড়ছে বঙ্গোপসাগের অথই নীল জলরাশির ওপর। দুপাশে ছড়ানো পাখায় ভর দিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে নিঃসঙ্গ ধূসর চিলটি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে রানওয়ে হারিয়ে ফেলা একটা বিমানের মতো। বাতাসের লোনা জলের গন্ধে অনাগত শীতে ঝরা পাতার হাহাকার। সেই হাহাকারের মাঝে অবুঝ চিলটি হারানো কিছু খুঁজছে। খুজছে, কিন্তু ভুলে গেছে কি হারিয়েছে? কিছু একটা পড়ে গেছে তার পায়ের নখর গলে, আনন্দে মগ্ন একচোখা চিল দেখতে পায়নি কোথায় পড়েছে। তাই আদিম ভোর থেকে বাতাসের ভেলায় ভাসতে ভাসতে ভেবে চলেছে কি হারিয়েছে। কিছুতেই মনে করতে পারলো না কি হারিয়ে গেল। তবু সেই অজানা বস্তুর সন্ধানে একচোখা চিল আজ সারাদিন.......

তিনবিঘা করিডোরে কয়েকজন বাউন্ডুলে এলোমেলো হেঁটেছিল

সতর্কবানীঃ ঢাউস লেখা, অধৈর্য পাঠক প্রবেশ করিবেন না]

মানুষের জীবনে কত রকম সাধ অপূর্ণ রয়ে যায়! আমার সেরকম অপূর্ণ সাধের একটা বাউন্ডুলে জীবন। একটা বয়সে খুব ইচ্ছে করতো এলোমেলো হাঁটতে। সুযোগ পেলেই পালের হাওয়া যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকে পালিয়ে যাওয়া। নব্বই দশকের প্রথমভাগে ঢাকার বন্ধুদের সাথে আমার একটা আড্ডা ছিল নিয়মিত। কদিন পরপর নানা অজুহাতে ছুটে যেতাম ঢাকায়। সেই বাউন্ডুলে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিনরাত্রি। ১৯৯৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে ছুট লাগালাম ঢাকায়। বেকার জীবনের শেষ আড্ডা দিয়ে ফিরে আসার আগের রাতে সাব্বির বললো ওরা কাল সকালে উত্তরবঙ্গে যাবে একটা কাজে। কাজটা কি সেটা বললে আরেক বিশাল কাহিনী হয়ে যাবে বলে সেটা উল্লেখ করবো না আজ। কেবল ভ্রমনটাই বলি।

বাংলাদেশের ম্যাপের উত্তর কোনায় যে তিনটি সুচালো মাথা বেরিয়েছে তার মাঝখানের টিলার নাম বুড়ীমারী। ভারতে যাবার একটি অন্যতম স্থল বন্দর। হিমালয় পর্বতের খাড়াইগুলো যার কয়েক মাইল উত্তরে এসে থেমে গেছে দিগন্তের সেই শেষ প্রান্তে মেঘমুক্ত আকাশে মাঝে মাঝে কাঞ্চনজংঘার শ্বেতশূভ্র চুড়াটা উঁকি দেয়। সাব্বির বললো, চাইলে ওদের সাথে যেতে পারি আমি। কোথাও যাবার প্রস্তাব পেলে 'না' শব্দটা কখনোই উচ্চারন করতাম না। সুতরাং খপ করে লুফে নিলাম প্রস্তাবটা। কাঞ্চনজংঘার নাম শুনেই আমার মাথা থেকে বাসা বাড়ী, পরিবার, চট্টগ্রাম সব উবে গেল। মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো কাঞ্চনজংঘার সাদা সাদা বরফে ঢাকা চুড়া। মেঘের ফাঁক দিয়ে ওই উচুতে উঁকি দিচ্ছে। সেই কবে একটা বই পড়েছিলাম কাঞ্চনজংঘার উপর। টয়ট্রেনে চড়ে মেঘের ভেতর দিয়ে হিমালয়ের সেই যাত্রার বর্ননা ভুলতেই পারি না। চাইলে নাকি চুরি করে শিলিগুড়ি দিয়ে পালিয়ে একেবারে দার্জিলিংও চলে যাওয়া যায়। কিন্তু আমার পকেট তখন গড়ের মাঠ। বাড়ী ফেরার গাড়ী ভাড়া একশো বিশ টাকা বাদে আর কিছু নেই। কিন্তু থাকিতে বন্ধু ভয় কি রে তোর। সাব্বির বললো নো চিন্তা আমি আছি। কথা সত্য, সাব্বির থাকা মানে টাকার ভাবনা উসুল। ওর সাথে আমার অলিখিত চুক্তি হলো, আমার পকেট গড়ের মাঠ হলে সেটা পুর্ন করার দায়িত্ব ওর, আর ওরটা গড়ের মাঠ হলে দায়িত্ব আমার।

রাত দশটার মধ্যে টিকেট করে গাবতলী থেকে ফেরার পথে আমার পকেটে একটা পাঁচশত টাকার নোট গুঁজে দিয়ে সাব্বির বললো, এটা পথ খরচ, লাগলে খরচ করিস, না লাগলে ফেরত দিস। আমাকে আর পায় কে। জোশ একটা ভ্রমনের স্বপ্ন নিয়ে ওর বাসায় ফিরে ঘুম একচোট। ওর ব্যাচেলর ঘরে আমাদের সব বন্ধুদের আড্ডা ছিল। আমরা সবাই বেকার, ও একমাত্র চাকরীজীবি। বেডরুমটা পুরো কার্পেটে ঢাকা। ওখানে যে যার খুশী মতো বালিশ রেখে ঘুমোই আমরা। চাঁটগা থেকে যারা ঢাকা যাই সব বন্ধুর আশ্রয় ফকিরাপুলের ওই বাসাটা। এমনকি ঢাকার বন্ধুরাও বাসায় ভালো না লাগলে এখানে এসে ফ্রী থাকা খাওয়া চালিয়ে যায় দিনের পর দিন। সাব্বিরের বেতনের সিংহভাগ অংশ বন্ধুদের পেছনেই যেত। ওর উদারতা আমাদের সম্পদ। কি এক অবাক দিন গেছে তখন।

পরদিন বিকেলে বাস ছাড়লো গাবতলী থেকে। তখনো যমুনা সেতু হয়নি। লালমনিরহাটগামী যে বাসটিতে আমরা উঠলাম সেটি ছিল একটা লোকাল বাস। ঠাসাঠাসি ভিড়। দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। এটার নাকি বারো থেকে আঠারো ঘন্টা পর্যন্ত লাগাতে পারে পৌছাতে। ফেরীতেই লাগতে পারে তিনঘন্টা। দীর্ঘ ক্লান্তিকর একটা যাত্রা। কিন্তু দীর্ঘ যাত্রার কথা শুনে কারো চেহারায় এতটুকু বিরক্তি এলো না। বরং দীর্ঘ আড্ডার লোভে চিকচিক করছে সবকটি মুখ। পথে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে সবচেয়ে বিদঘুটে অভিজ্ঞতা হলো রংপুর পেরুনোর পর। একটা সেতু পেরুনোর পর পর। ওই সেতুটা (সম্ভবতঃ তিস্তা এতদিন পর সঠিক মনে নেই) পেরুনোর পর বাসটা থেমে গেল। রাত দুটো বাজে তখন। নিঝুম নীরবতা চারিদিকে। বিরান সেই অন্ধকারে আশেপাশে কোন লোকালয় ঠাহর করা গেল না। জানা গেল সামনের রাস্তাটা ভালো না। প্রায় দশ মাইলের মতো রাস্তায় নাকি ডাকাতের রাজত্ব। একা কোন গাড়ী পার হয় না রাতের বেলা। আরো গাড়ী আসলে সবাই লাইন ধরে একসাথে চলবে সাথে থাকবে একটা পুলিশের এসকর্ট ভ্যান। শুনে আমরা তাজ্জব মানলাম। বাংলাদেশে এরকম ভয়ংকর জায়গাও আছে যেখান দিয়ে একটা বাস একা পেরুবার সাহস পায় না। প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষা করার পর আরো কয়েকটা বাস এসে লাইনে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন পর কোত্থেকে একটা পুলিশের গাড়ীও চলে এলো। আমাদের বাসটার সামনে এসে পুলিশের গাড়ীটা দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর সবগুলো ড্রাইভারের সাথে কথা বলে প্রথমে পুলিশের গাড়ী তার পেছন পেছন আমাদের গাড়ীটা, তারপর অন্যগাড়ীগুলো এগোতে লাগলো। এতক্ষন ভয় লাগেনি, কিন্তু পুলিশ দেখে বিপদের গুরুত্বটা বেড়ে গিয়ে ভয়টা জেঁকে বসলো। দুপাশের অন্ধকারে সতর্ক চোখে দেখছি কোন নড়াচড়া আছে কিনা। এই রাস্তার দুপাশে অন্তত পাঁচ-সাত মাইল নাকি কোন জনবসতি নেই। বিশাল প্রান্তর চিরে বেরিয়ে গেছে রাস্তাটা। এলাকাটা একেবারে জনবিরল। আমি সামনে পুলিশের গাড়ীর দিকে তাকিয়ে জুবুথুবু বন্দুক জড়িয়ে থাকা পুলিশদের বসে থাকতে দেখলাম। মনে হলো হাতের বন্দুকগুলো ওদের বোঝা বাড়ানো ছাড়া তেমন উপকারে আসে না। হয়তো গুলিও নেই ভেতরে। সত্যি সত্যি সামনে ডাকাতদল পড়লে ওরাই হয়তো সবার আগে ছুটে পালাবে ওই অন্ধকারে। দীর্ঘসময় লাগিয়ে আমাদের কাফেলা একটা মোড়ে পৌছালো। ওখান থেকে একটা পথ কুড়িগ্রাম, আরেকটা লালমনিরহাটের দিকে চলে গেছে। এখান থেকে নিরাপদ যাত্রা। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লালমনিরহাটের পথ ধরলাম।

আরো বেশ কয়েকঘন্টা যাবার পর পাটগ্রামে এসে পৌছালাম। সকাল হয়ে গিয়েছিল ততক্ষনে। কেমন একটা পরিত্যক্ত শহরের মতো লাগলো দেখতে জায়গাটা। লোকজন তেমন নেই রাস্তায়। ভ্যানগাড়ী দেখা গেল দুয়েকটা। বুড়ীমারী সীমান্তের কাছেই ওদের অফিস। বাসটার শেষ যাত্রী আমরাই। যেই কোম্পানীর বাসে করে গিয়েছি সেই বাসের কন্ডাকটরের সাথে খাতির করে নিয়েছিলাম আমরা যাবার পথেই। একরাত এখানে কাটাবো। রাতে থাকার জন্য বাস কাউন্টারের পেছনে একটা ঘরের ব্যবস্থা হয়ে গেল এই খাতিরের সৌজন্যে। গাড়ী থেকে নেমে বাস কাউন্টারে ঢুকলাম সবাই। টিনশেড একটা বাড়ীর সামনের রুমটা অফিস, পেছনের ঘরে বাসের ষ্টাফদের থাকার জায়গা। ওটাই আমাদের জন্য ছেড়ে দেয়া হলো অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে। আমরা তখন যাহা পাই তাহাতেই আনন্দিত। বাসের লোকদের সহায়তায় সকালের চা নাস্তার ব্যবস্থা করা হলো। পরোটা ভাজি চা।

চা নাস্তা সেরে বেরুলাম সীমান্ত দেখতে। আমাদের থাকার আস্তানা থেকে সোজা নাক বরাবর একটা রাস্তা চলে গেছে। ওদিকে কয়েকশোগজ পরেই সীমান্তের গেট। এখানে রাস্তাগুলো ভীষন পরিষ্কার, সুন্দর। দুপাশে সারিবদ্ধ গাছ লাগানো। হেঁটে হেঁটে বুড়ীমারী সীমান্তের যেখানে বাংলাদেশের সীমানা চিহ্নটা আঁকা হয়েছে ওখানে দাঁড়ালাম। কে জানি নিষেধ করলো ওখানে দাঁড়াতে। নো ম্যানস ল্যান্ড। মানুষের জীবনে স্বেচ্ছায় নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়ানোর সুযোগ খুব বেশী আসে না। নিষেধ শুনে সরে আসতে হলো। বামপাশে কাষ্টমসের অফিসঘর। ডানদিকে সুন্দর একটা নদী। ওটার এপাশ বাংলাদেশ, অন্যপাশ ভারত। নদীটা এত সুন্দর পরিষ্কার টলমলে জল। স্রোত আছে বেশ। পাহাড়ী নদী, ভারতের হিমালয় থেকে কলকল করে বরফগলা জল বয়ে আনছে এই সমতল ভুমিতে।

ওখানে বেশ কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম আমাদের আবাসে। ওখানকার একজন বললো তিনবিঘা করিডোর নাকি খুব কাছেই। চাইলে যেতে পারি। গেটটা একঘন্টা পর পর আধঘন্টার জন্য খোলে দিনের বেলা। এক দৌড়ে ভ্যানগাড়ীতে বেড়িয়ে আসতে পারি। বাহ, তিনবিঘা করিডোর? কত লেখাজোকা পড়েছি ওটা নিয়ে। এরকম বিরল একটা সুযোগ পাবো এখানে এসে চিন্তাই করিনি। দেরী না করে একটা ভ্যান ভাড়া করে ছুটলাম। যেতে হবে পাটগ্রাম হয়ে। যেতে যেতে বিশাল প্রান্তর পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কাঁটাতার ঘেরা সীমান্তে। গেট বন্ধ এখন। ভ্যানওয়ালা জানালো আরো একঘন্টা পর খুলবে। এখানে একটা কেমন অস্তস্তিকর পরিবেশ। ভীষন কড়াকড়ি যেন। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের পোষ্ট দেখলাম করিডোরের মাঝখানে। ওদের মধ্যে রনসজ্জা, যেন এই মুহুর্তে যুদ্ধ বেধে যাবে। আমাদের বিডিআর পোষ্ট বেশ খানিকটা ভেতরে হওয়াতে অস্তিত্ব টের পাওয়া মুশকিল। ওপাশে বাংলাদেশ এপাশেও বাংলাদেশ। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ঝকঝকে ভারতীয় রাস্তা। ভারতের ওই অংশটার সাথে বাংলাদেশের পার্থক্যটা বেশ পরিষ্কার। বাংলাদেশ অংশটা ভীষন দরিদ্র মনে হলো।

আমরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম তিনবিঘা করিডোর। ওপাশে একটা বাংলাদেশ আছে যেটা আক্ষরিক অর্থে বন্দীশালা। কেউ ইচ্ছে করলেই ওখান থেকে যখন তখন চলে আসতে পারবে না এই অংশে। রাতে যদি কেউ মরেও যায় গেট খুলবে না। হাসপাতালে নেবার দরকার হলেও পরদিন ভোর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নিয়ম ভীষন কড়াকড়ি ভারতীয় তরফ থেকে। আমরা ভ্যানঅলার কাছ থেকে এসব তথ্য পাচ্ছিলাম, আর বিষন্ন হয়ে পড়ছিলাম।

এমন সময় একটা বিকট চিৎকার এলো কোথা থেকে জানি। তাকিয়ে দেখি বিএসএফ পোষ্ট থেকে বন্দুক উঁচিয়ে আমাদের দুরে সরে যেতে বলছে। ভ্যানঅলা বললো এখানে দাঁড়ানো নিষেধ। এই গেট ওদের। গেটের জায়গাটুকুও ওদের। আমরা গেটের একফুটের ভেতর চলে গেছি তাই গেট থেকে তফাত যেতে বলছে ওই সৈনিক। সরে গেলাম। কিন্তু এত রূদ্রমুর্তির কারন বুঝলাম না। গিয়ে পাশের প্রান্তরের ঘাসগুলো মাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম সবাই। ভারতীয় কাঁটাতার থেক দুই ফুট দুরত্ব বজায় রাখতে হলো। আমাদের তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করছে সৈন্যদল। দেখে মেজাজ এমন খারাপ হলো, হঠাৎ এক বন্ধু বললো, আমার পেশাব করতে হবে। দাড়া বাংলাদেশে দাড়িয়ে ইন্ডিয়ার কি করে বৃষ্টি ঝরাই দেখ।

বন্ধুর সাহস দেখে আমরা তাজ্জব। কিন্তু সাহস ব্যাপারটা যেন সংক্রামক। হুমকি আছে জেনেও জিপার খুলে বাকীরাও লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। আইন মেনে কাঁটাতার থেকে দুইফুট দুরে দাঁড়িয়ে ওইপারে জল ঝরাচ্ছে একদল বেপরোয়া তরুন। বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে ভারতে জলত্যাগ। একটা অহিংস প্রতিবাদ, ভারতীয় সহিংস হুংকারের প্রতিবাদে। যে কোন মুহুর্তে একটা হুংকার বা গুলি ছুটে আসতে পারে। কিন্তু আমরা তখন মরিয়া। শালার যা হবে হোক। এই কাজ দেখিয়ে যাবো তোদের। আশ্চর্য এবার কোন হুংকার এলো না। নির্বিঘ্নে কাজ সেরে সবাই বিজয়ী উল্লাস করে উঠলো। যাক ব্যাটাদের একটা শিক্ষা দেয়া হয়েছে আইন মেনেই।

গেট খোলার সময় হলে আমরা লাইন ধরে দাঁড়ালাম। করিডোরটা বোধহয় একশো গজের মতো হবে। করিডোরে প্রবেশ করে আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে পেরোচ্ছি ভারতীয় অংশটা। অদুরে বিএসএফ সৈনিকদের হেলমেট পরা মুখ আংশিক দেখা যাচ্ছে বালির বস্তার পেছনে সাব মেশিনগানের নলের পাশে। আবারো একটা চিৎকার। আরে মুশকিল, এখন সমস্যা কি তোর, চিল্লাস কা? কি বললো বুঝলাম না। কিন্তু চিৎকার চলছেই। একজন বুঝলো, বললো এত আস্তে হাঁটলে চলবে না। দৌঁড়ে জোর কদমে পেরিয়ে যেতে হবে জায়গাটা। হেলে দুলে হাঁটার কোন অবকাশ নেই। আজব! আমার আধঘন্টায় আমি যেমন খুশী তেমন করে পেরুবো। তাতে তোদের কি। কিন্তু না, আধঘন্টা আমাকে দেয়া হয়েছে জরুরী গতিতে পেরুবার জন্য। আয়েশ করে নয়। হেলেদুলে চলা এই জায়গায় নিষিদ্ধ। মেজাজ আবারো টং হলো সবার। এ কোন জাতের কথা? কি রকম চুক্তি হলো এটা? দুজনরে সমান সমান ব্যবহার করার কথা শুনেছি এতদিন। এখন এসব কি? পুরোটাই তো ওদের নিয়ন্ত্রনে। আমাদের কিছু করার নেই।

যাই হোক অবশেষে পা রাখলাম অন্য বাংলাদেশে। এটা একটা ভুমি দ্বীপ। আঙরপোতা দহগ্রাম নামে দুটি গ্রাম এখানে। দোকানপাট দেখে চা খাওয়ার উসিলায় স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলার সুযোগ নিলাম। চা দোকানের টুলে দুটো বাংলাদেশী পুলিশকে লাঠি হাতে বসে থাকতে দেখলাম। বললাম, সারাক্ষন এই হুমকির মধ্যে থাকেন কি করে আপনারা, ভয় করে না? উত্তরে যা বললো শুনে ভিরমি খেলাম রীতিমতো। বললো, ওদের ভয় বেশী তাই এত হুংকার করে। ওদের মেশিনগানের সাথে আমাদের এই লাঠিই যথেষ্ট। লোকটা রসিকতা করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম। যাই হোক, দেশপ্রেমের জোর আছে দেখে ভালো লাগলো। ওখানকার বেশীরভাগ মানুষের মধ্যে এটা দেখেছি। আমি ভাবতাম ওরা ভারতীয় বাহিনীর ভয়ে জুবুথুবু হয়ে থাকবে সারাক্ষন। কিন্তু সীমান্তের লোকজন নাকি একটু বেপরোয়া রকমের সাহসী হয়। হতেই হয় বোধহয়, নইলে টিকতে পারবে না। ওরা দেখলাম থোড়াই কেয়ার করে ওসব হুংকার হুমকি ধমকি। আরেকটা কথা মনে হলো সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের দেশপ্রেমের জোরও বোধহয় অন্যদের চেয়ে একটু বেশী।

গেটটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ততক্ষনে। আরো একঘন্টা ফেরা যাবে না। আঙরপোতার আরেকজন মানুষের সাথে কথা হলো। তিনি বললেন, বাংলাদেশ অংশে চাষের কাজ করেন তিনি। দুপুরে তার নয় বছরের মেয়েটি ভাত নিয়ে যায় ক্ষেতে। গেট বন্ধ হয় একটায়, মেয়েটা তার আগেই খাবার দিয়ে যায়। মেয়েটা যদি কখনো এক মিনিট দেরী করে, তাহলে তাকে একঘন্টা না খেয়ে বসে থাকতে হবে। বাপ এই পারে, মেয়ে ওই পারে। কতবার ঘটেছে ওরকম! এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে রাতে কোন বিপদ হলে সমস্যা। ভোর না হওয়া পর্যন্ত মরে গেলেও গেট খুলবে না।

হাবিজাবি নানা গল্পের পর গেট খোলার সময় হয়ে গেলে আমরা ফেরার জন্য উঠলাম। ওপাশে ভ্যান অপেক্ষা করছিল তখনো। জোর কদমে পেরিয়ে গেলাম তিনবিঘা করিডোর। ওপারে পৌঁছে ফিরে তাকালাম ভুমিদ্বীপ বাংলাদেশের দিকে। কী অদ্ভুত জীবন এখানকার মানুষের। স্বাধীনতা শব্দটার মানেটা সম্পূর্ন অন্যরকম ওখানে।

পাটগ্রামে এসে খেয়াল হলো দুপুরের খাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে খাবার দোকানপাট তেমন নেই। একটা হোটেল পেয়ে ঢুকে গেলাম। মুরগী অর্ডার দিতে গিয়ে দাম শুনে টাশকি খেলাম। এত সস্তা! সেই তুলনায় ডিমের দাম বরং বেশী। দশটা ডিমের দাম দিয়ে একটা আস্ত মুরগী পাওয়া যাবে। দেশী মুর্গীর ঝোল দিয়ে মোটা চালের ভাত দারুন লাগলো। দিনভর আরো ঘোরাঘুরি হলো অনেক। ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় তাসের আড্ডা চলার সময় একজন বাইরে থেকে খবর আনলো এখানে ভুটানী 'সরবত' পাওয়া যায়। সুখবর পেয়ে রাতের খাবার সেরে দুটো বোতল যোগাড় করা হলো। পনেরো মিনিটের মধ্যে খালাস বোতলের ‘সিরাপ’। তারপর সবাই রাস্তায় বেরুলাম হাঁটতে। বাহ, দারুন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। ভারতে যাবার রাস্তাটা একদম নির্জন এখন। দুয়েকটা কুকুর বাদে রাস্তায় আমরাই আছি কেবল। রাত বারোটা বাজে প্রায়। আমরা আধপাগল কয়জন তরুন এলোমেলো হাঁটছি। বেসুরো গলায় গান গাইছি। বিশেষ করে সাব্বিরের গান শুনলে রবীন্দ্রনাথ মাটির নীচ থেকে কঁকিয়ে উঠতো। ব্যাটার সারেগামা এত উচ্চমার্গের।

দুপাশের গাছের সারিগুলো ছায়ার মতো দাড়িয়ে আছে। আমাদের চোখে ঘুম নেই। রাস্তার ধারে কয়েকটা ভারতীয় ট্রাক দেখা গেল আমদানী পন্য নিয়ে এসেছে। ট্রাকের নীচে চুলা জ্বেলে রান্না চড়িয়েছে শিখ ড্রাইভার। আমাদের মধ্যে রুপু ছিল দুষ্টের শিরোমনি। সে এগিয়ে গিয়ে বাতচিত শুরু করলো তাদের একজনের সাথে। আধখেচড়া ভাষার জগাখিচুড়ীতে কিছুই বুঝলাম না। রুপু ফিরে এসে বললো, আরে ওদের সাথে কথা বলা তো সোজা। খালি বলবি "ইধার কা মাল কুধার যাতা হু।" তারপর খাতির হয়ে যাবে দেখবি। আমরা সেই শিখলাম। যতক্ষন ওই জায়গায় ছিলাম, ইধার কুধার বলতে বলতে হেসে খুন একেকজন।

পরদিন দুপুরে খাওয়ার পর পর আমাদের ফেরার পালা। আমার খুব মাথা ধরেছিল, বমি বমি লাগছিল। আমি একটা এভোমিন ট্যাবলেট খেয়ে বাসে উঠে চোখ বুঝে থাকলাম। রুপু সাব্বির সিদ্ধান্ত নিল বাসের মধ্যে একবোতল ভুটানী সিরাপ রাখবে, বাকী আঠারো ঘন্টার যাত্রায় এক চুমুক করে খেতে খেতে ঢাকায় পৌঁছাবে। ওরা ডানকানের একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতলে ভরে নিল সিরাপটা। আসলেই দেখতে লাগছে লাল গোলাপী রূহ আফজা সিরাপের মতো। মাথার উপরে মালামাল রাখা তাকে প্রকাশ্যেই রেখে দিল বোতলটা। বাস ছাড়তেই একটু পরপর গলা শুকিয়ে গেছে বলে, একেকজন একেক চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। আমি এভোমিনের নেশায় টাল হয়ে ঘুমোচ্ছি, ভুটানী সিরাপে আমি নেই। নগরবাড়ী ফেরীর আগ পর্যন্ত আমি প্রায় বেহুঁশ ছিলাম। ফেরীঘাটে পৌছে অন্য যাত্রীরা সবাই নেমে গেল আমরা কজন বাদে। একটুপর ড্রাইভার এলো আমাদের কাছে। চেহারা সুরত পরখ করে হো হো করে হেসে উঠলো সে। বললো, দাদারা যে লাইনের লোক, আগে বলবেন তো। আমিও তো লাইনের মানুষ। আসেন একসাথে খাই, আমারও আছে। নেমে গেল ওরা, আমি বাসে একা। পরে জেনেছি ড্রাইভার বেশী টানেনি গাড়ী চালাতে অসুবিধা হবে বলে। তবু এখন ভাবতে শিউরে উঠি, ওই সময়গুলোতে কিরকম বেপরোয়া ছিলাম আমরা।

আধমাতাল ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে যখন ঢাকায় প্রবেশ করছে আঁধার কেটে তখন ভোরের আলো ফুটছিল ঢাকার আকাশে। আমাদের চোখে, মুখে, শরীরে ক্লান্তিকর অবশ অনুভুতি। সীমান্ত ভ্রমনের স্মৃতি যেন মুছে গিয়ে বিছানার ডাকটা খুব মধুর শোনাচ্ছিল। পরবর্তী আটঘন্টা বেহুশের মতো ঘুমোলাম সবাই সাব্বিরের বাসার কার্পেটে।

আমাদের হারানো গল্পের বাগান

তুমি যাবার পর থেকে আমার গল্পগুলো থেমে গেছে। যদ্দিন তুমি ছিলে আমি ছিলাম এক নিটোল গল্পকার। একেকটা গল্পের একেকটা জীবন্ত চরিত্র নিয়ে তোমার আগ্রহ আমার গল্প বানাবার উৎসাহকে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত করতো। আমার সকল গল্পের একমাত্র পাঠিকা ছিলে তুমি। আমার কোন গল্প কখনো কোথাও পাঠাইনি। তুমি জানতে আমার গল্পে কখনো বানোয়াট চরিত্র থাকে না। চারপাশের মানুষগুলো নিয়েই আমার যত গল্প। তাই আমার গল্প নিয়ে তোমার বিপুল আগ্রহ। গল্পের মাঝে কখনো কখনো সংলাপ তৈরীতে মেকাপ দিতে হলেও চরিত্র চিত্রনে কোন আলগা প্রয়াস ছিল না। গল্পগুলো লিখতে লিখতে আমি কখন তোমাকেও গল্পের একটা চরিত্র ভাবতে শুরু করেছিলাম নিজেই জানি না। তোমার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তাই তোমাকেও গল্পে সম্পৃক্ত করলাম আজ। তুমি আমার গল্প মানুষ? তোমার আমার গল্পের সুচনা হয়েছিল কিভাবে? আমাদের গল্পের প্রথম সংলাপটি ছিল তোমার। তোমার প্রথম সংলাপটি যখন আমার প্রাঙ্গনে এসে পৌছল তখন আমি ভীষন একা। সেই একাকী সময়ে গল্প করার মতো কাউকে বড় প্রয়োজন ছিল। তোমারও হয়তো। তবে আমার দ্বিতীয় সংলাপ নিক্ষেপে খানিক বিলম্ব হওয়াকে তুমি হতাশার সাথে প্রকাশ না করলে আমাদের দুজনের গল্পকার হওয়া হতো না। তোমার সেই হতাশার মধ্যে একটা সুপ্ত আকুলতা ছিল যাতে আমি সবুজের প্রতিশ্রুতি দেখেছিলাম। তৃতীয় সংলাপের পর সেই সবুজের কুড়িটি পাতা মেলতে শুরু করলো। তারপর একদিন পত্রপল্লব বেড়ে গিয়ে আমাদের বিশাল গল্পের বাগান গড়ে উঠলো। নিয়মিত পরিচর্যায় আমাদের গল্প বাগানে হরেক রকমের ফুল ফুটলো, পাখপাখালীর আগমন ঘটলো, গান হলো, কবিতা হলো। ধীরে ধীরে গল্প যেন উপন্যাসে রূপ নিল। বিস্ময়ের ঘোর কেটে উপন্যাসের যাত্রাপথে একদিন তোমার ডাক এসে গেল আচমকা। নিরুপায় তুমি আমাকে ছেড়ে উড়াল দিলে নতুন গন্তব্যে........ চিরতরে। তোমাকে গল্প বলার, তোমার গল্প শোনার আর কোন সুযোগ রইল না আমার। আজ তোমার আকাশে নতুন ভোর, নতুন সূর্যোদয়, নিত্য নতুন প্রতিশ্রুতি। আমাদের সেই গল্প বাগান এখনো সেই খানেই আছে, তবে নিঝুম নিস্তব্ধতায় নিথর পড়ে আছে। বহুদিন কোন নতুন ফুল ফোটেনি, পাখপাখালি আসে না। সাপখোপ আর ইঁদুরের বসতি আগাছায় ভরা সেই বাগানে আমি আর হাঁটাহাঁটি করি না আজকাল। আমাদের গল্পগুলো কি আর কখনো প্রান ফিরে পাবে না? স্মৃতি কি প্রানহীন নিস্তরঙ্গ জলের আধার? তবু স্মৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে এত সুখ পাই কেন!

বিলম্ব পোষ্টঃ চট্টগ্রামে ইফতারাড্ডা (উৎসর্গ: পদ্মলোচন ও স্বপ্নবাজ)

সেদিন দুপুরে অফিসের ক্যান্টিনে লাঞ্চটা শেষ করে সিগারেটে আগুন দিতেই যে ফোনটা এলো সেটা এক প্রত্যাশিত সুখবর। আমাদের প্রিয় ব্লগার ও হবু ব্যারিষ্টার জাবীর জানালো ভিসাটা হয়ে গেছে। সুখবরটা সেলিব্রেট করার কোন উপায় নেই চাটগা থেকে। তবু জেনে ভালো লাগছে ঢাকার ব্লগারগন শুক্রবারে একটা অনুষ্ঠান করছেন। খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও থাকতে পারছি না বলে জাবীরের কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

গত কিছুদিন ধরে আক্ষরিক অর্থেই দৌড়ের উপরে ছিলাম, এখনো কিছুটা। তাই ব্লগেও আসা হয় না ঠিকমতো। লেখার সময় নেই, পড়ার সময় নেই, আড্ডা দেবার সময় তো নেই নেই হয়ে গেছেই। আসলে ঈদের বন্ধের পর থেকে আগের সব রুটিন বদলে গেছে যেন। খেই হারিয়ে ঘুরে মরছি এলোপাথাড়ি যেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত কখনো কখনো অফিসে কাটাই।

জাবীরের সাথে মাত্র একবারই আড্ডা দেবার সুযোগ পেয়েছিলাম। গতমাসে জাবীর চট্টগ্রাম এলো কাজে, ফোনে ঠিক করা হলো আমি অফিস শেষে ওকে নিয়ে ইফতার আড্ডায় বসবো। পাওয়া গেল আরেক চাটগাইয়া ব্লগার স্বপ্নবাজকে। আমার সাথে সেই প্রথম দেখা স্বপ্নবাজের সাথেও। যে ঠিকানায় জাবীরকে থাকতে বললাম সেটি ইস্পাহানী মোড়ে পিটস্টপ রেষ্টুরেন্ট। আমার অফিস থেকে ওখানে যেতে বড়জোর আধঘন্টা লাগে। কিন্তু ইফতারপূর্ব জ্যামের কারনে লেগে গেল দুইঘন্টা। যখন রেষ্টুরেন্টে পৌছালাম তখন মসজিদে ফু দেয়া শুরু হয়ে গেছে। আজান দেয় দেয় অবস্থা। আমি পুরো রেষ্টুরেন্টে হেটে বেরিয়ে কোথাও জাবীরকে পেলাম না। আজব।

পাঁচ মিনিট আগেও কথা হলো ওর সাথে গেল কই। বলেছিলাম ইফতারীর টেবিলের দখল নিয়ে বসে যেতে, নইলে পরে জায়গা পাওয়া যাবে না। সবগুলা মানুষের চেহারা দিয়ে ঘুরে এলাম, না জাবীর নয় একটাও। আমি ভুল করছি না তো দেখতে? আগে তো দেখিনি? ছবির সাথে আসল মানুষের মিল থাকে না। কি করি দিলাম ফোন আবার। তারপর নজর রাখলাম কার ফোন বাজে আর কার ঠোট নড়ে, গোয়েন্দা নজরে অনেকের ঠোট নড়তে দেখছি, কানে চোঙা লাগিয়ে অনেকেই কথা বলছে। জাবীরের সাথে আমিও বলছি। জিগাইলাম, কই তুমি। সে কয়, দাদা আমি তো এইখানে। আমি কই, আমিও তো এইখানে। কি মুশকিল। এত মানুষ মোবাইলে কথা বলে, কে কার কথা শোনে। ব্যাটারা ইফতারের আগে ইকটু চুপটি কর, আমি খুজে বের করি পদ্মলোচন জাবীরকে, ইফতারীর সময় যে পেরিয়ে যায়!!!

হঠাৎ নজরে পড়লো এক হুজুরের দিকে। জোব্বাজাব্বা পাগড়ী পড়া এক হুজুর মনে হলো আমার ফোনের তালে মাথা নেড়ে কথা বলছে, কি জানি সন্দেহ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি গিয়ে শুনি আমার ফোনে সেই শব্দ, এই হুজুরও সেই কথা বলে। খাইছে, এই হুজুরই তো জাবীর........ব্যাটা করছে কি? এই বেশভুষা লাগাইছে ক্যান? আমি দুইবার ওর পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি, ভেবেছি কোন মওলানা ইফতার খেতে এসেছে এখানে। জাবীর ততক্ষনে চিনে ফেলেছে আমাকে। উঠে এলে জড়িয়ে ধরলাম হেসে। ওর সাথে এক বন্ধুও আছে। যাক ইফতার করা যাবে তাহলে। হাপ ছাড়লাম। কিন্তু তখনো স্বপ্নবাজ আসেনি। রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে আজানের সাথে সাথে স্বপ্নবাজও হাজির। এরপর ইফতার, গপসপ, আড্ডা, চায়ের তেষ্টা। চায়ের অনুরোধ করতে দেরী হয়ে গেছে বলে সিরিয়ালে পেছনে পড়ে গেলাম। আমাদের ভাগ্যে চা জুটলো না, বলা হলো আরো বসতে হবে চা খেতে হলে। দুচ্ছাই অতক্ষন চা খেতে কে বসে থাকে, তারচে আমার বাসায় গিয়েই খাই চা। বাসায় গিয়ে চা খাওয়া হলো, আরেক দফা আড্ডা হলো।

তারপর ফেরার পালা এলো। জাবীর শরীর ঠিক রাখতে রাতে খায় না, এটা নিয়ে স্বপ্নবাজের সুন্দর কিছু মন্তব্য ছিল, দিলাম না এখানে। যাইহোক ডিনার বাদে ষ্টেশানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল ওরা। জাবীর কথা দিল লন্ডন যাবার আগে আরেকবার হবে আসা। আরো একটা আড্ডা সময়। কিন্তু হলো না আর। জাবীর তার আগেই চলে যাচ্ছে। এরপর আড্ডাটা হবে পরিপূর্ন ব্যারিষ্টারের সাথে। সেই দিনের প্রতি চোখ মেলে থাকলাম। জাবীরের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

ট্রান্সলেশান করো : ফাকি সব খরে রব রাতি ফোহাইল

ইন্টারে পড়ার সময় আমাদের দুই বন্ধু এক রাতে বাড়ী ফেরার পথে পাড়ার এক পরিচিত পাড় মাতালের মুখোমুখি হলো। পঞ্চাশোর্ধ মাতাল যে ইন্টারভিউ নিয়েছিল সেটা বহুবছর বন্ধুমহলে আনন্দ যুগিয়েছিল।

-এ্যাই খোথায় যাইচ্চ তুম্বরা?
-বাসায় যাইতেছি চাচা
-খোত্তেখে আসতেচ?
-পড়াশুনা করে আসতেছি (ডাহা মিছা কথা, দুজনেই গঞ্জিকার ভক্ত, সেই কাজ সেরে বাড়ী ফিরছিল)
-কিসে ফড়ো?
-কলেজে ফড়ি
-বহুত ফড়াশুনা কইরচ, দেকি দুটা ট্রান্সলেশন করো তো, তাইলে বুইজব তোমরা ফড়াশুনা করি আসতেছ,
-জী বলেন
-ফাকি সব খরে রব রাতি ফোহাইল, খাননে খুসুম খলি সবি ফুরাইল..বল ইংরেজীতে বল এইটা তইলে বুইজব তোমার শিক্কিত পোয়া

বন্ধু দুজন ঘাবড়ে গেল। তাছাড়া ওরাও তখন ঝিমানিতে আছে। বললো চাচা আমরা একটু পেশাব সেরে আসি। পেশাবের নাম করে একটু আঁধারে গিয়ে, সামনের দেয়ালটা টপকে ভোঁ দৌড়। পেছনে শুনতে পাচ্ছিল মাতাল তখনো ট্রান্সলেশানের অপেক্ষায় চেঁচাচ্ছে.....

"...ফাকি সব খরে রব রাতি ফোহাইল, খাননে খুসুম খলি সবি ফুরাইল। না ফারলে তোমাদের বাফেরে লাগাই দিবো। এই খোথায় তোমরা........"

অপ্রত্যাশিত বিদ্যুতের চমক

গল্পটির সুত্রপাত হয়েছিল এইখানে। লেখক চা খেতে গিয়ে ডিনারও সেরে ফেলেছিল। ফিরে এসে গল্পটি সমাপ্ত করতে পাঠকের ব্যাপক অনাগ্রহ লক্ষ্য করে নিজের হাতেই আবার কোদাল চালাতে শুরু করলো। ফলাফল নীচে দেয়া হলো।

*********************************************************
ট্রেনটা ভুজপুর জংশনে এসে থামলো। বগিতে মৃদু আলো। বেশীরভাগ যাত্রী নেমে গেছে। বগির এই অংশে মাত্র দুজন মানুষ। দুজনেই নীরব। মেয়েটি তখনো বিষন্নমুখে বাইরে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি যেদিকে বসেছে সেদিকে লোকালয় নেই, দেখার কিছু নেই, ষ্টেশানের বিপরীত দিক ওটা। তবু মেয়েটি বাইরের দিকে চেয়ে আছে অনির্দিষ্ট দৃষ্টিতে। তরুনটি বই থেকে মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকালো। প্ল্যাটফরমে কতগুলো ফেরীওয়ালা বসা, ভবঘুরে লোকজনও দেখা যাচ্ছে কিছু।

দুজনের মধ্যে দুরত্ব বড়জোর পাঁচফুট। এই দুরত্বে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে কিভাবে কথোপকথন শুরু করে তরুনের কোন ধারনা নেই। সে যে দেশে পড়াশোনা করে সেই দেশে অবশ্য অপরিচিত মানুষকেও হাই হ্যালো করা যায়। এদেশে সেখানে কেমন সংকোচ কাজ করে। নারী হলে তো কথাই নেই। তরুনটি মুগ্ধ হয়ে তরুনীর বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কয়েকসেকেন্ড। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিল। সরাসরি তাকানো অভদ্রতা হয়ে যায়। আবার আড়চোখে তাকানোও ভব্যতার মধ্যে পড়ে না। তবে মেয়েটির মধ্যে এমন কিছু আছে না তাকিয়ে বেশীক্ষন থাকা যাচ্ছে না। ভদ্রতা করে হাই বলাও যাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটার সাথে পরিচিত হবার সুপ্ত একটা বাসনা ধীরে ধীরে দানা বাধছে সেটা রূপম ভালোই টের পাচ্ছে।

ট্রেনটা কতক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। খিদে পেয়ে গেছে রূপমের। কিন্তু খাবার নেই সাথে। খাবার দোকান খুঁজতে ষ্টেশানে নামতে সাহস পাচ্ছে না। গ্রামের ষ্টেশানগুলোর আশেপাশে বিস্কুট চায়ের দোকান থাকে, কিন্তু অচেনা জায়গায় নামার ব্যাপারে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল রূপমের বহুবছর আগে একবার। সেকথা মনে পড়তেই সে চিন্তাটা বাদ দিল। কিচ্ছু করার নেই। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ফস করে ধরিয়ে ফেললো রূপম। খিদে পেটে সিগারেট যুত লাগে না, তবু নিঃসঙ্গতা কাটাতে সিগারেটের জুড়ি নেই। সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে ভাবনাগুলো কেমন খেলে যায়।

সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ নাকে যেতেই ভ্রু কুচকে জয়া জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে রূপমের দিকে তাকালো। এই প্রথম তার খেয়াল হলো বগির এই অংশে ওই তরুনটি ছাড়া আর কেউ নেই। সিগারেটের গন্ধ তার খুব বিশ্রী লাগে। গাড়ীতে যারা সিগারেট খায় তাদের প্রচন্ড ঘেন্নার চোখে দেখে সে। তরুনটি বাইরে তাকিয়ে আপনমনে সিগারেট টানছে। সিগারেটটা তরুনের ঠোঁটে কেমন বেমানান লাগলো। এত সুন্দর মানুষ সিগারেটের মত বিশ্রী জিনিস খায় কি করে। ঠোট কালো হয়ে যায় না? আশ্চর্য ব্যাপার যে সিগারেটের গন্ধে নাকে ওড়না দেবার বদলে জয়া ভাবতে বসে গেল অদ্ভুত একটা বিষয়ে- বেমানান ঠোঁটে সিগারেট। যেন এটি একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। ওটা নিয়ে কয়েক মিনিট এপার ওপার ভাবতে ভাবতে কাটালো।

সিগারেট টানার পুরোটা সময় রূপম বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল সচেতনভাবেই। সে নারী ও শিশুদের সামনে সিগারেট ধরায় না কখনো। আজ ব্যতিক্রম ঘটলো। অপরিচিত জায়গা বলেই কি? সিগারেট ধরালেও সংকোচে মেয়েটার দিকে তাকানো থেকে বিরত রাখলো নিজেকে। যেন ওই মেয়ের কোন অস্তিত্বই জানা নেই তার। ফলে তার জানা হলো না মেয়েটা তার দিকে কত মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিল পাক্কা দুমিনিট। সিগারেটের শেষাংশ বাইরে ছুড়ে দিয়ে বইটা খুলে বসলো আবার। এবার আর বইয়ে মন বসলো না। মেয়েটার দিকে ফিরে তাকাবার অবদমিত বাসনাটা জেগে উঠলো আবার। কিন্তু কিছুক্ষন আগের সিগারেট ধরানোর অপরাধবোধ তাকে সংকুচিত করে রাখলো। সংকোচ ধামাচাপা দিয়ে যখন সে চোখ তুললো, মেয়েটা তখন বাইরের অন্ধকারে ডুবে গেছে।

ট্রেনটা চলতে শুরু করলো আবারো। ট্রেন ও লাইনের ঝমঝম শব্দের ছন্দটা উপভোগ করছে রূপম। আরো এক ঘন্টার রাস্তা বাকী আছে হিসেবমতে। মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতে পকেট থেকে বের করে দেখলো আশিকের ফোন। কতক্ষন লাগবে জিজ্ঞেস করলো বন্ধু আশিক। পথের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে সাবধান করলো। বলো সে ষ্টেশানে থাকবে গাড়ী নিয়ে।

জয়া না তাকিয়েও কথাগুলো শুনছে মন দিয়ে। বুঝতে পারছে ছেলেটা একটু আনাড়ী আছে। এত বড় মরদকে কত জ্ঞান দিতে হয়, যেন বাংলাদেশে নতুন এসেছে। যত্তসব। এসব জিনিস মাম্মী ড্যাডির ছেলে হয়, এটা নিশ্চিত। আবার সিগ্রেটও খায়। বাপরে বাপ.... ফ্যাশান কত। কাঁধের ব্যাগ দেখলে মনে হয় বিদেশী টুরিষ্ট। মনে মনে ছেলেটার সাথে ঝগড়া শুরু করে কেন যেন। যখন কিছু করার থাকে না এরকম মনে মনে খেলা জয়ার ভীষন প্রিয়। এমনকি মনে মনে প্রেমও করে কখনো কখনো। নির্দিষ্ট কারো সাথে নয়। কল্পনার সৃষ্টি সব। তবে এই ছেলেকে তার কল্পনার মানুষের সাথে মেলানো যাচ্ছে না। বেখাপ্পা টাইপ। তবু সামনে আছে এর সাথে প্রেম না হোক ঝগড়া করা যাক। সময় কাটবে তার।

সময় যাচ্ছে। রাত বাড়ছে। আরো দুটো ষ্টেশান পেরোবার পর ট্রেনটা গতি ধীর করতে শুরু করলো হঠাৎ। একসময় ঝমঝম শব্দটা থেমেই গেলো। কি হলো? রূপম বই থেকে মুখ তুলে বাইরে তাকালো। জয়া জানালা থেকে একটু সরে আসলো। ট্রেন যখন অচেনা কোথাও থামে তখন বাইরে তাকানো নিরাপদ নয়। সে জানে, কিন্তু হাঁদারাম ছেলেটা জানে না বোধহয়। তাকে ওসব বিষয়ে ট্রেনিং দেয়নি মাম্মীডেডী? রূপম এবার পুরো মাথাটা বের করে দেখছে বাইরের অন্ধকারে।

জয়ার ভীষন রাগ হচ্ছে এবার ছেলেটার উপর। আরে বোকা করছো কি। বাইরে অত দেখার কি আছে। মাথা ঢোকাও ভেতরে। ধুর.......কিচ্ছু শুনছে না ছেলেটা। শুনবে কি করে, জয়াতো মনে মনেই চিৎকার করছে। যদি কেউ দায়ের কোপ মারে? জয়ার গাটা শিরশির করে উঠলো এবার। কিন্তু অপরিচিত মানুষ, তাকে কি করে বলবে। রাজ্যের সংকোচ এসে জড়ো হয় ।

ট্রেনটা চলতে শুরু করে আবার। রূপম মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে বইয়ে মন দেয়। জয়ার বুক থেকে একটা ভার নেমে যায়।

আরো প্রায় আধঘন্টার পথ। তারপর গন্তব্য। রূপমের একটু মন খারাপ হয়। আরো কিছুক্ষন যাওয়া যেতো যদি। মেয়েটার সাথে কথা বলার কোন ছুতো বের করা গেল না। গন্তব্যে পৌছে যাওয়া মানেই তো একটা আকাংখার অপমৃত্যু। সামনে আর কোন ষ্টেশান নেই। রূপম ছটফট করতে থাকে মনে মনে। কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকাতে পারে না সরাসরি। একবারও চোখাচোখি হয়নি ওদের।

জয়া কোথায় যাবে জানে না। মামার বাড়ী আর ফিরবে না বলে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছে। তার বাবা মা নেই। ঘনিষ্ট আত্মীয় বলতে এক খালা আছে, বিদেশে থাকে। দেশে এই মামা ছাড়া আর কেউ নেই। মামাই লালনপালন করেছে পনের বছর আগে দুর্ঘটনায় বাবা মা দুজনে মারা যাবার পর থেকে। ট্রেনটা তাকে যদি আজীবন বহন করে নিত। এই যাত্রা যদি কখনো শেষ না হতো, ট্রেনটাকে ঘরবাড়ী বানিয়ে যদি বিশ্বময় ঘোরা যেত। কত আবজাব ভাবে জয়া। মেয়েদের জন্য দেশটা মোটেও নিরাপদ নয়। তবু জয়া মরে গেলেও ফিরবে না ওই ঘরে। এত বড় অপমান সে সহ্য করবে না। সে এই ট্রেনেই আজকের রাতটা কাটাবে ঠিক করলো।

শেষ ষ্টেশান আসতেই রূপম তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। একবারো তাকালো না জয়ার দিকে। যেন তাকে খেয়ালই করেনি। মেয়েদের সাথে এরকম ভাব ধরা তার পুরোনো অভ্যেস। এতে করে দুর্বলতা এড়ানো যায়। রূপমের নেমে যাওয়া দেখে জয়ার একাকীত্বটা ভীষন চেপে বসলো। এতক্ষন সময়টা ভালোই কাটছিল, এখন কি করবে সে? একা এই বগিতে শুয়ে ঘুমোবে, শেয়াল কুকুরের খাবার হতে হবে না তার? রাতের বেলা একা একটা মেয়েকে পেলে মানুষগুলো কি পশু হয়ে যেতে পারে তা পত্রিকার পাতায় প্রায়ই পড়ে সে। আজ কি তার সেই দিন? হোক, আত্মহত্যাই হোক এভাবে।

কতক্ষন কেটেছে তার জানা নেই। ট্রেনের বাতিগুলো নিবে গেছে। সীটে হেলান দিয়ে তার ঘুমের মতো এসেছে। হটাৎ মোবাইল ফোনের শব্দে ঘোর কাটলো। আরে এ যে সেই ছেলেটার ফোনের রিংটোন। সেকি ফিরে এসেছে? কি করে সম্ভব। নাকি স্বপ্ন দেখছে। ফোন বাজছেই। খুব কাছে। অন্ধকারে দেখলো ছেলেটা যেখানে বসেছিল সেইখানে ফোনটা বাজছে অন্ধকারে নীলাভ আলো ছড়িয়ে। ছেলেটা ফোনটা ফেলে গেছে ভুলে।

ফোন তুলবে কি তুলবে না ভাবতে ভাবতে কেটে গেল লাইনটা। আবারো বাজলো ফোনটা। আবারো। তিনবার বাজার পর সংকোচে ফোনটা তুললো সে। রিসিভ করতেই ভেসে এলো সেই কন্ঠ। বহুল কাংখিত ছিল যেন এই ‘হ্যালো’ শব্দটা। কয়েকবার হ্যালো শোনা গেল ওপার থেকে। জয়া কয়েক সেকেন্ড পরে বললো হ্যালো। এই প্রথম কথা হলো ওদের।

-হ্যালো.....কথা বলছেন না কেন? (ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ বললো)
-হ্যালো...
-কে বলছেন?
-আমি..........
-আপনার হাতে ওটা আমার মোবাইল......
-জী আমি....মানে.....ফোনটা বাজছিল, ধরলাম
-ওটা আমার ফোন.... হারিয়ে গিয়েছিল, আপনি কোথায় পেয়েছেন
-আমি জানি না, আমি ঠিক..... (আমতা আমতা করে নারী কন্ঠ)
-দেখুন ফোনটা আমার দরকার, অনেকগুলো দরকারী নাম্বার ওখানে, আপনি কোথায় আছেন বলুন
-আসলে..... আমি জানি না আমি ঠিক কোন জায়গায়
-কি বলছেন? আপনি জানেন না আপনি কোথায়?
-আসলেই জানি না
-আপনি কি জোক করছেন? দেখুন ফোনটা দিতে না চাইলে না দিন, কিন্তু সিমটা আমার খুব দরকার, ওটা ফেরত চাই আমার।
-না না আপনি বুঝতে পারছেন না, আমি বোঝাতে পারছি না.....ফোনটা আপনি নিয়ে যেতে পারেন
-তাহলে আপনি কোথায় বলছেন না কেন এখনো? কোথায় আছেন বলুন.. টাকা পয়সা চাইলে দিতে পারি, কত লাগবে জানান
-ছি ছি আপনি কিসব বলছেন, আপনার ফোন আপনি নিয়ে যান, আমি আপনার ফোন নেব কেন?
-তাহলে ঠিক ঠিক বলেন আপনি এখন কোথায়
-আমি এখন ট্রেনে
-ট্রেনে মানে? কোন ট্রেনে?
-সেই ট্রেনে, যেই ট্রেনে আমি এসেছি,
-মানে?
-সেই ট্রেন....সেই শেষ ষ্টেশানে, যেখানে ট্রেন থেমেছিল, ষ্টেশানের নাম জানি না
-আশ্চর্য!! কি বলছেন? আপনি কে? আপনি কি ......
-আমি এই ট্রেনে এসেছিলাম
-আপনি সেই.......ট্রেন থেকে নামেননি আপনি এখনো??
-না
-কেন?
-কোথায় নামবো, আমার কোথাও যাবার নেই
-আশ্চর্য......আপনি....তবে কি বলি......ইয়ে আমি আসলে খুব সরি, অনেক আজেবাজে কথা বলেছি না চিনে......আমি ভেবেছি অন্য কেউ
-না ঠিক আছে, আমি তো চেনা কেউ না আপনার
-না না, ঠিক করিনি আমি.......আমি দুঃখিত
-আপনি এসে নিয়ে যান আপনার ফোন
-আসছি আমি এখুনি, আধঘন্টার মধ্যে, আপনি থাকুন
-আচ্ছা

ফোনটা আস্তে নামিয়ে রাখলো জয়া। ওটার নীলচে আলোটা নিভে গেল কয়েকসেকেন্ড পর। চারপাশে এখন নিকষ কালো অন্ধকার। অচেনা জায়গার অচেনা রাতের শব্দ। অন্ধকারে ওটার দিকে তাকিয়ে জয়া ভাবলো যে আলোটা এতক্ষন জ্বলেছিল একটু পর সেরকম একটা আলো আবারো জ্বলবে কয়েক মিনিটের জন্য। ফোনটা নিয়ে ছেলেটা চলে যাবার পর আবারো ফের সেই অন্ধকার। সেই একাকীত্ব। রাত ভোর হতে এখনো অনেক বাকী। সেই অজানা ভোরের প্রতীক্ষায় বসে থাকবে জয়া এই অচেনা ষ্টেশানে। ভোরটা কি দেখা হবে তার?



[পাদটীকাঃ গল্পটি আপাততঃ এখানে শেষ। তবে একটা গল্পের শেষ কখনো কখনো একটা উপন্যাসের সুত্রপাত করতে পারে। সেই সম্ভাবনা এখানে লুকিয়ে আছে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিছুটা নির্ভর করছে রূপমের উপর, কিছুটা জয়ার উপর। জয়ার জীবনটা কোন খাতে প্রবাহিত হবে সেটা কি রূপমের কোন হটকারী সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে? মানুষের জীবনের গতিপথগুলো অদ্ভুত, কখনো কখনো এক সেকেন্ডের একটা সিদ্ধান্ত আমূল পাল্টে দিতে পারে একেকটা জীবনের গতিপথ। কোন মানুষই এর বাইরে নয়। প্রতিটি মানুষের জীবনতো একেকটা ত্রিমাত্রিক উপন্যাস]

একটি গল্পের সুত্রপাত-

একটা গল্প লিখতে ইচ্ছে করছে। কি গল্প হবে এখনো জানি না। তবে গল্পের চটকদার একটা নাম ঠিক করা হয়েছে- "অপ্রত্যাশিত বিদ্যুতের চমক"। গল্পটা হতে হবে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু প্রানবন্ত। গল্পের মধ্যে সর্বোচ্চ দুজন চরিত্র থাকবে যার একজন পুরুষ আরেকজন নারী। অথবা দুজন পুরুষ কিংবা দুজন নারী। না, দুজন নারীকে নিয়ে ছোট গল্প লেখা যাবে না। কারন দুজন নারী একত্রিত হলে গল্প অনেক বড় হয়ে যাবে, সাধারনতঃ নারীগন স্বল্পভাষী হয় না। সুতরাং গল্পের আকার সংক্ষিপ্ত রাখতে দুজন পুরুষ কিংবা এক নারী এক পুরুষকে নিয়ে লেখাই শ্রেয়।

দুজন পুরুষকে নিয়ে গল্প দাঁড় করানো অবশ্য কঠিন। কারন পুরুষেরা পরস্পরের সাথে কথা বলে কম। অপরিচিত হলে তো মুখে রা টি নেই। তারচে বরং অচেনা নারী ও অচেনা পুরুষকে নিয়ে গল্প তৈরী করা যায়। দুই লিঙ্গের মধ্যে বিপরীত ও সহজাত আকর্ষনের কারনে গল্প হয়ে উঠতে পারে রোমান্টিক। কিন্তু না, রোমান্টিক গল্প লিখবো না। নারী ও পুরুষের দেখা হলেই কি রোমান্টিক গল্প হতে হবে? নারী পুরুষের মধ্যে অন্য সম্পর্ক হতে পারে না? আরো বেশী অর্থপূর্ন কোন সম্পর্ক? কি সেটা? প্রেম ছাড়া আর কি আছে? প্রেম কি পদ্যের মতো ছন্দময়? প্রেম ছাড়া অনুরাগের আর কোন প্রকাশ নেই? হয়তো আছে। সেটা পাঠকের মনে মনেও থাকতে পারে।

একটা কাজ করা যাক। গল্পটা না লিখে বরং পাঠককে গল্পের প্লট নিয়ে একটা ধারনা দেয়া যাক। পাঠকই ঠিক করুক প্রেমহীন একটা মধুর অর্থপূর্ন সম্পর্ক।

..........................................................................................................................
ধরা যাক একটি লোকাল ট্রেনের বগি। ধলঘাট ষ্টেশান থেকে ট্রেনে উঠেছে রূপম। কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর একগাদা বই। জানালার পাশে বসে রূপম নিবিষ্ট মনে বইয়ের ভেতরে ডুবে আছে। জানালা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে সবুজের অপূর্ব সমারোহ। সূর্য তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তের পানে। বিকেলের সোনালী রোদে গ্রামগুলো যেন ধুয়ে যাচ্ছে। হেমন্তকাল তখন। হালকা কুয়াশার আস্তরন ভেসে আছে ধানক্ষেতের উপর।

মিনিট পনের পর কদলপুর ষ্টেশান থেকে একই বগিতে ট্রেনে উঠলো এক তরুনী। নাম জয়া। রূপম যেখানে বসেছে তার চেয়ে একটু দুরের একটা সীটে বসে পড়লো সে। যদিও লক্করঝক্কর লোকাল ট্রেন, তবে ট্রেনে ভীড় একেবারেই নেই। কারন এই সময়ে শহরমুখী যাত্রী থাকে না বললেই চলে। শহর এখনো অনেক দুর। এভাবে চললে ঘন্টা দুয়েক লাগার কথা। পথে আরো আটটা ষ্টেশান ধরার কথা। আরেকটা বড় জংশনে আধা ঘন্টার মতো থামার কথা একটা এক্সপ্রেস ট্রেনকে পার করে দিতে। ততক্ষনে সন্ধ্যে পেরিয়ে যাবে।

তবে এই তথ্যগুলো তরুন তরুনী দুজনেরই অজানা। কারন তরুন বিদেশ থেকে এসে বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিল। কোন কিছুই চেনে না সে। সে জানে কেবল এই ট্রেন যেখানে থামবে সেখানে তাকে নেমে যেতে হবে। ওখানে তার জন্য দাড়ানো থাকবে একটা গাড়ী। আর তরুনী এই পথে কখনো ট্রেনে চড়েনি। সে মামার বাড়ীতে থেকে পড়াশোনা করে। মামীর সাথে রাগ করে বেরিয়ে পড়েছে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে। ট্রেনটা ছুটে যাচ্ছে ঝমঝম করে, দিগন্ত চিরে।
.............................................................................................................................

পাঠকের মনে ভাবনার সুত্র ধরিয়ে দিয়ে লেখক চা খেতে চলে যান। গল্পটির সাইজ মোটামুটি ১০০০ শব্দের ভেতর রাখার ইচ্ছে লেখকের। তার মধ্যে ২০০টি শব্দ লেখা হয়েছে। লেখকের ধারনা চা খেয়ে আসতে আসতে পাঠক গল্পটি শেষ করে ফেলতে পারে মনে মনে। পাঠকের দেয়া সমাপ্তি দিয়ে গল্পটি শেষ করলে কেমন হয়? কি আছে পাঠকের মনে....? বাকী ৮০০ শব্দে কি ঘটতে পারে?

সুশীল বেয়াদবী

সবাই সুশীল হতে পারে না। একবার না পারিলে শতবার চেষ্টা করেও কেউ কেউ পুরোপুরি সুশীল হয় না। সুশীল হতে হলে জীনের সাহায্য লাগে। মানে জেনেটিক্যালি হয়ে আসতে হয়। ট্রেনিং, শিক্ষাদীক্ষা ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি নিয়ে কেউ সুশীল হতে পারে না। আমি ভদ্রসমাজে সুশীল ভান করে থাকি ঠিকই। কিন্তু রাস্তায় মেজাজ খারাপ হলে মুখ দিয়ে যা বের হয় তার সাথে সুশীলতা মেলানো যায় না। বিপরীত দিকে বখে যাবার জন্যও যোগ্যতা লাগে। আমি বাল্যকালে অতীব বখা ছেলেদের সাথে বেশ কিছুকাল কাটিয়েছি। ভেবেছিলাম বখেই যাবো। কিন্তু সম্ভাবনায় গুড়ে বালি। বখাও হলো না আমার।

ওদিকে সুশীলদের সাথে বসবাস করেও ঠিক খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। মাঝে মাঝেই দড়ি ছেঁড়া হয়ে যেতাম। তারুন্যের শুরুতে আমার কয়েকজন সুশীল বন্ধুবান্ধবকে দেখে সুশীলতার দীক্ষা নিতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুকাল। সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে মেলামেশা হতো নিয়মিত। পাড়ায় কবি বন্ধু ছিল একজন। তার সাথে ঘুরে ঘুরে কবি সমাজে সমঝদারের খাতির পেতে লাগলাম। কবিতার ক-ও বুঝি না, কিন্তু না বুঝেও কা কা করলেও দেখি কবি সমাজ মারহাবা মারহাবা করে খুশী হয়। কোন কোন আড্ডায় কেউ কেউ আনকোড়া কবিতা পড়তে দিয়ে মতামতও চায়। আমি চোখ আধবোঝা করে উচ্চমার্গীয়তার ভান করি। কবি খুশী হয়। ভাগ্যিস 'কি বুঝিয়াছো বৎস' বলেনি, বললে রাম ধরা। আসলে সেই সময়টাতে প্রচুর বই পড়তাম ঠিকই কিন্তু উত্তরাধুনিক বা পরাবাস্তব কবিতা জিনিসটা আমার মাথার উপর দিয়েই যেতো। কিন্তু যাদের সাথে মিশতাম তারা সবাই উত্তরাধুনিক পরাবাস্তব কবিতাই লিখতো। তাই কষ্টের দিন যেতো যেদিন কয়েকজন কবি একসাথে নতুন কবিতা লিখে আনতো।

একদিন আমার এই সুশীল হবার খবর সংবাদ পৌছে গেল পাড়ার এক নবীন দার্শনিক কবির কানে। আমার ধারনাই ছিল না ছোকরা কবিতা লেখে। এক দুপুরে তার মোটা কবিতার খাতাটা আমার হাতে দিয়ে বললো, ভাইয়া আপনি একটু দেখে দেবেন পত্রিকায় পাঠানোর জন্য কোন কোন কবিতা দেয়া যায়। বুঝলাম উৎপাত শুরু হলো মাত্র। কারন ছেলেটা লাসা প্রকৃতির, বাজারে মাছঅলার সাথে কিংবা পথে রিকশাওয়ালার সাথে কি হয়েছে তা নিয়ে আধাঘন্টা বকবক করতে পারে। কী উৎপাতের কথা। এমনিতেই উত্তরাধুনিক কবিদের যন্ত্রনায় সুশীল আড্ডা ছাড়ি ছাড়ি অবস্থা। এদিকে ঘরেই কবিতা দিয়ে যাচ্ছে আরেকজন। সুশীল হবার যন্ত্রনা তো কম না?

তবু আমি কবিতার খাতাটা নিয়ে রেখে দিলাম গম্ভীর হয়ে। কবির নাম তৈয়ব। ভাগিয়ে দেবার কোন উপায় পাচ্ছিলাম না। কারন তৈয়ব আমার খুব ভক্ত। ভক্তকে নিরাশ করবো তেমন নিষ্ঠুর কি করে হই। তবু উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য কদিনের জন্য তাকে দুরে রাখতে হবে। আমার অন্য কাজে ব্যাঘাত হচ্ছিল। কয়েকজন কট্টর লেখকের দাঁতভাঙা কয়েকটা বই ছিল আমার কাছে। ফরহাদ মজহার, আবুল কাশেম ফজলুল হক ইত্যাদি লেখকের তাত্ত্বিক বই। ওই বইগুলো আমার বদহজম হচ্ছিল তখন। বইগুলো গছানোর একটা উপায় পেয়ে আলোকিত হয়ে উঠলো চেহারা।

একদিন বিকেলে তৈয়ব কবিতার মতামত নিতে আসলে তার হাতে বইগুলো তুলে দিয়ে বললাম- "পড়েছো এ বইগুলো? অসাধারন বই। এগুলো না পড়লে ভালো কবিতা আসবে না। তুমি ওগুলো পড়ে শহীদের কাছে গিয়ে মতামত দিও। আর তোমার কবিতার খাতা ওর কাছে দেয়া আছে, তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না কবিতা নিয়ে।"

শহীদ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কবি মহলের অন্যতম কবিবর। একদিন কথায় কথায় বলছিল পাড়ায় একটাও শিক্ষিত লোক নেই যে তার কবিতা বোঝে। ভাবলাম নবীন কবি তৈয়বকে আবিষ্কার করে নিশ্চয়ই আনন্দিত হবে সে। পরের সপ্তাহ থেকে কবি তৈয়বের গন্তব্য বদলে গেল শহীদের বাসার দিকে। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম সে যাত্রা।

কয়েকদিন পর শহীদ আমাকে রাস্তায় পাকড়াও করলো। "শালা কী একটা পাগল জুটিয়ে দিয়েছিস, দিনরাত ঘুমাতে পারি না, তার কবিতা নাকি ছাপাতে হবে আমার পত্রিকায়। কিন্তু খাতা খুলে দেখি নামধাম বদলে আস্ত কাজী নজরুল ইসলাম কাট করে মেরে দিয়েছে।"

আমি শিউরে উঠলাম ভেতরে ভেতরে। ভাগ্যিস পড়ি নাই। নইলে বলেই ফেলতাম, কবি আপনি তো মহান। কারন নজরুলের অনেক কবিতা তখনো পড়া হয়নি আমার।

মুখে বললাম, "দোস্ত আমারে মাফ কর। আমি কবিতা পড়া ছেড়ে দিয়েছি, তাই তোর কাছে পাঠিয়েছি। ঝামেলা মনে করলে বিদায় করে দে"

শহীদ ক্ষেপে গিয়ে বলে, "বিদায় করব কি করে, ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিদিন, বেয়াদপের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুকে। আগে আমাকে লুকিয়ে সিগারেট খেতো আর এখন আমাকেই কিনে দিতে চায়। আমি নাকি হারামজাদার কবি বন্ধু এখন। কিসব যন্ত্রনা লেলিয়ে দিয়েছিস তুই!!"

সর্বনাশ! তাই নাকি? আমার তখন মনে পড়লো একদিন নিউমার্কেটের সামনে দেখা হলে তৈয়ব আমাকে বারবার জোর করছিল, ভাইয়া আপনাকে সিগারেট কিনে দেই, একটা খান।

বলেছিলাম, "আমি ভর দুপুরে সিগারেট খাই না।" শুনে খুব বেজার হয়েছিল তৈয়ব।

তাহলে এই মতলব? ভাগ্যিস খাইনি। শালা বেয়াদবীর আর্ট জানে। কোনদিন আমাকে গলায় জড়িয়ে ধরে বলতো, আয় দোস গাঁজা টানি এক সাথে। এ যে সুশীল বেয়াদপ! এর পর থেকে আমি তৈয়বের ছায়াও মাড়াই না। বাসায় বলা আছে তৈয়বকে দেখামাত্র যেন বলা হয় - "বাড়ীতে নেই আমি, চলে গেছি মার্কেটে।"

ইসলামী ব্যাংকের হালাল হারাম ( যদি সুদ না বলে ভুষি বলি!!)

সুদ হারাম... সুদ হারাম.... সুদ হারাম।
লাভ হালাল.... লাভ হালাল... লাভ হালাল।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশী মুসলমানদের বিরাট অংশকে কাবু করে দিয়েছে এই বানীতে। ইসলাম বিষয়ে তরলপ্রান মানুষ তা বিশ্বাসও করেছে। বিশ্বাস করছে, ভালো করছে। ইসলামী ব্যাংকের ব্যাবসা রমরমা হইছে!! দেশে ইসলামী ব্যাংকের বিরাট জোয়ার বইতেছে। বিদেশী ব্যাংকগুলিও ইসলামী ট্যাগ লাগিয়ে ব্যাংকিং করতে আগ্রহী হচ্ছে। কারন বাজার বলে কথা। সুতরাং ইসলামের উপকার হোক বা না হোক। ব্যাংকিং ব্যবসায় প্রতিযোগীতা বাড়ছে।

আমার কিছু আলগা কথা আছে এই প্রসঙ্গে। যৎসামান্য ব্যাংকিং জ্ঞানের প্রভাবে এগুলো বেরিয়ে যায় মাঝে মাঝে।

আচ্ছা সুদ কি? সুদের সংজ্ঞা কি? সুদ শব্দটা কেন আসলো। interest শব্দটার বাংলা সুদ। তো.....এই অনুবাদ কি কোন হুজুর করে দিয়েছে? কোন সে মওলানা?

ইসলাম যখন কায়েম হয়, তখন কি ব্যাংক ছিল? ব্যাংক প্রথা চালু হয়েছে কোথা থেকে, কখন থেকে?

ইসলামী ব্যাংক সুদ আর লাভের মধ্যে হালাল হারামের মাজেজা দেখিয়ে ব্যাবসা চাঙ্গা করেছে বছরে পর বছর, আম জনতা বেহেশতের লোভে আকাম কুকামে টাকা কামিয়েও ইসলামী ব্যাংকে জমিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক হারাম বলে সুদ দেয় না লাভ দেয়, তো যারা ওই ব্যাংকে টাকা জমা রাখে তাদের কামাইগুলা কি হারাম না হালাল তা কি কখনো যাচাই করে রাখা হয়? নাকি হারাম টাকা ইসলামী ব্যাংকে রাখলে ইসলামী ফিল্টারে হালাল হয়ে বেরিয়ে আসে?

ইসলামী ব্যাংক বৈদেশিক বানিজ্যে আছে কি না। বিদেশে যখন কোন লেনদেন করে, তখন সুদ বাদে লেনদেন করে, নাকি ইসলামী ফিল্টার করে? সারা বিশ্বে ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংকিং সুদের হার নির্ধারন করে LIBOR কিংবা SIBOR নামে দুটো পথে। ইসলামী ব্যাংকের কী নিজস্ব কোন চ্যানেল আছে বৈদেশিক লেনদেনে? যদি না থাকে তাহলে দেশী টাকা জমা রাখার বেলায় হালাল শ্লোগান, আর বিদেশী লেনদেনে হারাম কারবার। একই ব্যাংকের এই দুইরকম লেনদেন কি মোনাফেকীর লক্ষন নয়?

যদি তথাকথিত সুদ আর লভ্যাংশ হাদিস মেনে ব্যাংকিং করতে হয়, ইসলামী ব্যাংকের কোন অধিকারই নেই ব্যবসা চালানোর। বান্দারে সাত-পাচ চৌদ্দ বুঝিয়ে পার পাওয়া যাবে, কিন্তু আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবে। তাইলে কি ইসলামী ব্যাংকওয়ালারা আল্লাহ খোদায় বিশ্বাস করে না? নইলে এখনো গলা ফুলিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে কি করে?

এখন একটু গিয়ানী কতা কই। ইসলাম যখন কায়েম হচ্ছিল তখন দুনিয়াতে ব্যাংকিং প্রথা ছিল না। প্রথম ব্যাংকিং ব্যবস্থার উদ্ভব হয় ইউরোপে। নাসারাদের দেশে। নাসারাদের অন্যতম ভাষা ইংরেজী। ভারতবর্ষে ওদের শাসন নাজিল হয় দুশো বছরের জন্য। সেই সুবাদে এই দেশেও আমদানী হয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় লেনদেনের হার নির্ধারিত হয় ইন্টারেষ্ট নামক উপাদন দিয়ে। ইংরেজী 'ইন্টারেষ্ট' শব্দটাকে কোন এক বঙ্গসন্তান অনুবাদ করেন 'সুদ' বলে। সেই থেকে চলে আসছে ব্যাংক ও সুদ। সেই আদম সন্তান যদি অনুবাদ করার সময় সুদ না বলে 'ভুষি' করতো তাহলে সেটা হারাম হতো না বলে মনে হয় না।

আপনার বলেন, ভুষি হারাম এই কথা কোন মুসলমান মওলানা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে?? সুতরাং সুদ ব্যাপারটা যতটা হালাল হারাম সমস্যা তার চেয়ে বেশী শব্দানুবাদের সমস্যা।

Sunday, August 30, 2009

জামাত শিবিরের সম্প্রসারন পদ্ধতি ও আমাদের হঠাৎ মুসলমানগন

'হঠাৎ মুসলমান' বলে একটা কথা ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদাকে বিতর্কিত করেছিল সংসদে। জামাত শিবির নিয়ে লিখতে গিয়ে এই শব্দটা মাথায় এলো। আমি কঠিনভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশে জামাতের প্রসারের অন্যতম কারন এই 'হঠাৎ মুসলমান'গন। নীচে দুটো সাধারন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উদাহরন দিলাম-

এক.
আমার প্রতিবেশী একটি পরিবার। জীবনে কোনদিন ধর্মের ধার দিয়েও ছিল না। আমোদ ফুর্তিতে দিনযাপন করতো। নারীপুরুষ নির্বিশেষে হৈ হুল্লোড়ে থৈ থৈ করতো যে কোন উৎসব পার্বনে। একদিন ওই বাসায় এক লজিং মাষ্টার প্রবেশ করলো। তার কদিন পর লজিং মাষ্টারের সুত্র ধরে এক বোরকাওয়ালীর প্রবেশ ঘটলো। এর কয়েকদিন পর ওই বাসা থেকে দুজন তিনজন করে বোরকাওয়ালী বের হতে লাগলো। একদিন পুরো বাসাটাই ঢেকে গেল বোরকায়। কারন কি? কারন ওই বাসায় যে লজিং মাস্টারের আগমন ঘটেছিল তিনি মওদুদীর ভাবশিষ্য। লজিং মাষ্টার ছাত্রছাত্রীদের মাথা খাবার পর বোরকাওয়ালীকে দিয়ে বাচ্চাদের মার মাথাও খেয়ে নিয়েছে অবলীলায়। ধর্মহীন ওই পরিবারে সেই মাষ্টারমশাই প্রথম ধর্মের বাতি জালিয়েছিলেন। এবং মওদুদীর জ্বালানীতেই সেই বাতি জ্বলেছিল। প্রতিবেশী পরিবার শীঘ্রই ইসলামের নামে মওদুদীবাদের ভক্ত হয়ে অতীত উচ্ছৃংখলতার পাপমোচনের চেষ্টা করে। কঠিন জামাতী পরিবারে পরিনত হয় শীঘ্রি। এই পরিবার থেকে জামাত শিবির বাদে অন্য কিছু বের হবার সম্ভাবনা কি আছে?

দুই.

আরেক ঘনিষ্ট এক বন্ধুর পরিবার। বন্ধু জামাত পছন্দ করে না। কিন্তু জিয়ার আদর্শের প্রতি দুর্বলতা আছে। তবে সরাসরি রাজনীতি করে না। পরিবারে রাজনীতির কোন ব্যাপার নেই। ভাইবোন সব আধুনিক। কিন্তু ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বন্ধুর বাসায় এক বোরকাওয়ালী প্রতিবেশিনীর আগমন ঘটে। বন্ধুকে আমি সাবধান করি। বোরকাওয়ালী জামাতী মহিলা। কিন্তু বন্ধু হাসে, বলে মহিলা রাজনীতি নিয়ে আলাপ করে না। মাকে ধর্ম নিয়ে পাঠ দেয়। কোরান শেখায়। আমি তবু আস্বস্ত হতে পারি না। কিছুদিন পর বন্ধুর আধুনিকা মাকে কালো বোরকায় চক্ষুকর্ন আচ্ছাদিত দেখে বুঝলাম রক্ষা হলো না। বন্ধু তরল কন্ঠে বললো 'বাসায় এখন ধর্মকর্ম ভালোই হয়। ওই খালাম্মা সবাইকে ট্রেনিং দিয়েছে। ভালো হয়ে যেতে পয়সা লাগে না। তোর বাসায়ও যাবে।'

আমি বন্ধুর কথা শুনে হিম হয়ে গেলাম। আমার বাসায়ও গিয়েছিল দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে। কিন্তু আমার বাসায় আগেই দ্বীনের বাপ বসা ছিল বলে সুবিধা করতে পারেনি। তবে আমার বাসায় না পারলে কি হবে। আর তিন বন্ধুর বাসায় সাফল্যের মুখ দেখলো জামাতি মহিলা। তবে ওই তিন বাসায় জামাতি মহিলা নিজে যায় নি। প্রথম বন্ধুর মাকে ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়ে কাজটা আরো সহজে করেছে। একটা লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো ওই তিন বন্ধুর পরিবারও জিয়ার আদর্শে দুর্বল ছিল। ভোট দেয় ধানের শীষে। তখন জোট সরকার ক্ষমতায় বলে ওরা জামাতকে বাইরের মনে করতো না। এভাবেই দাড়িপাল্লা ধানের শীষের জায়গায় বসে গেল।

এরকম আরো অনেক উদাহরন আছে। বাংলাদেশে জামাত শিবিরের সম্প্রসারন হবার বহুল প্রচলিত পদ্ধতির অন্যতম এগুলো। জামাত বাংলাদেশে নানা রূপে নানা কায়দায় ছড়াচ্ছে। রাজনীতির ময়দানে জামাতের উচ্চকন্ঠ তেমন শোনা না গেলেও ঘরে ঘরে এই কাজগুলো করে যাচ্ছে নিরুপদ্রপভাবে। ওই তথাকথিত ধর্মভীরু(আসলে অধার্মিক/বকধার্মিক) মানুষগুলোর প্রশ্রয়ে গোকুলে বেড়ে উঠেছে ভাইরাস জামায়াত ও শিবির।

বাংলাদেশে আইন করে জামাতের মতো দলগুলোর সম্প্রসারন রোধ করা যাবে না। কারন এরা পরজীবি ও সংক্রামক। এদের প্রবৃদ্ধি রোধ করতে হলে, এদের নির্মূল করতে হলে মানুষকেই সচেতন হতে হবে। আমাদের দেশের সাধারন পরিবারগুলো যদি সচেতন হতো এই ভাইরাসগুলোর স্পর্শ বাচিয়ে চলতে পারতো। যদি বুঝতো জামাত ও ধর্ম দুটো জিনিস ভিন্ন। তাহলে বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের শেকড় উপড়ে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া কোন ব্যাপার হতো না।

আমাদের লুকোনো সম্পদ, আমাদের সমৃদ্ধির আশ্বাস

বলিভিয়ার লবনভুমি সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি - এই শিরোনামে বিবিসির গতকালের একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল আজ। পুরোটা পড়ে কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলাম। বলিভিয়া পৃথিবীর অর্ধেক লিথিয়াম খনিজের মালিক। সারা বিশ্বে আগামীতে জ্বালানী শক্তির মস্ত সংকট ধেয়ে আসছে। তেল গ্যাস ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। বিকল্প জ্বালানীর সন্ধানে উন্নত বিশ্ব ব্যস্ত। সেই সংকটে লিথিয়াম হয়ে উঠতে পারে দারুন এক বিকল্প। সারা বিশ্বে ইতিমধ্যে লিথিয়াম ব্যাটারির জোয়ার চলছে। আগামীতে গাড়ীও চলতে পারে রিচার্জেবল ব্যাটারি দিয়ে। বিপুল পরিমান লিথিয়ামের মজুদে বলিভিয়া তখন হয়ে উঠতে পারে বিশ্বশক্তির আধার। কেউ কেউ এরই মধ্যে বলিভিয়াকে লিথিয়ামের সৌদি আরব বলা শুরু করেছে। যদিও বলিভিয়ার খনিজসম্পদ মন্ত্রী Luis Echazu-র তাতে দ্বিমত আছে। তিনি লিথিয়াম রপ্তানীর চেয়ে লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনে আগ্রহী বেশী।

গায়ানার পরেই বলিভিয়া দক্ষিন আমেরিকার দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ। বাংলাদেশের মতো এটিও হরেক সমস্যায় জর্জরিত। সম্পদের সুষম বন্টন নেই এখানেও। ধনী দরিদ্রের বিশাল ব্যবধান। সুনামের চেয়ে বদনাম বেশী। তবু বলিভিয়া মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়। মাথা তুলে দাঁড়াবার এই স্বপ্নটা বলিভিয়া দেখা শুরু করেছে যখন ২০০৬ সালে আদিবাসী বংশোদ্ভুত নেতা Evo Morales ক্ষমতায় আরোহন করলেন। সেই থেকে বদলে যেতে শুরু করে বলিভিয়ার দারিদ্রের পুরোনো চিত্র। নতুন স্বপ্ন দেখানো শুরু করেছে মোরালেস। দারিদ্রের ক্ষমতায়ন বিষয়টি কেবল কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহন করেছে তার নতুন সরকার। স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের মতো জাতীয়করন করা হচ্ছে তেল গ্যাস সহ দেশের গুরুত্বপূর্ন শিল্পগুলো। মূল্যবান খনিজগুলো যাতে দেশের জনগনের মঙ্গলের কাজে ব্যবহৃত হয় সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছে।

এবং সবচেয়ে চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে লিথিয়াম বিষয়ে। লিথিয়াম রপ্তানী করে তাৎক্ষনিক বড়লোক হবার চেয়ে লিথিয়ামের তৈরী ব্যাটারী রপ্তানী করতে তাদের আগ্রহ বেশী।বলিভিয়ার বর্তমান সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর করালগ্রাস থেকে শিল্প ও সম্পদকে রক্ষা করার আন্তরিক প্রয়াস। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে শিক্ষনীয় বিষয় হতে পারে এটি।

আমাদের কক্সবাজার মহেশখালী সেন্টমার্টিন হাতিয়া সহ উত্তরে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র বেসিনে লক্ষ লক্ষ টন তথাকথিত কালো সোনা স্তুপীকৃত হয়ে পড়ে আছে কয়েকযুগ ধরে। কালোসোনাগুলোর বাহারী নাম হলো ইলেমনাইট, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট ইত্যাদি। বিদেশী কোম্পানীগুলো মাঝে মধ্যে গন্ধ শুঁকে শুঁকে চলে আসে খোঁজ নিতে। তখন সরকার একটু নড়ে চড়ে বসে। তারপর আবার শীত ঘুম। এই করে করে চলছে দেড়যুগ। ও এইচ কবির নামে আধপাগল এক অবসরপ্রাপ্ত পর্যটন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন একা একা সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এই সম্পদের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করতে, এই সম্পদকে বিদেশী কব্জা থেকে রক্ষা করতে। তিনি নিজে গবেষনা করে চমকপ্রদ কিছু তথ্য আবিষ্কার করেছেন। সেই আবিষ্কারকে তিনি দেশের কাজে লাগানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলো তিনি ও তার আবিষ্কার নিদারুনভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। বারবার উপেক্ষিত হতে হতে এই মানুষটি প্রচন্ড অভিমানে তার গবেষনা ধ্বংস করে ফেলারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু শুভাকাংখীদের জন্য পারেননি। ২০০২ সালের দিকে সাপ্তাহিক ২০০০ এর রিপোর্টে এই কালো সোনার বৃত্তান্ত পড়ে আমি খুব আশাবাদী হয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলাম সরকারের ঘুম ভাঙানোর কাজে। কয়েক লক্ষ কোটির উপর মূল্য হতে পারে শুধু কক্সবাজার অঞ্চলের খনিজ আহরন করতে পারলে। দেশের বাকী অংশের কথা বাদই দিলাম।

আমাদের সমস্যা হলো সেই খনিজ পরিশোধনের প্রযুক্তি আমাদের নেই। যতটুকু আছে তাতে হয়তো ৮৫-৯০ভাগ পরিশুদ্ধ করা যায়। কিন্তু জানা গেছে ইলেমনাইট যদি ৯৯% পরিশোধন করা না যায় তার দাম আসলের ১ শতাংশও পাওয়া যাবে না। ৯৯% পরিশুদ্ধ হবার জন্য বিদেশী প্রযুক্তি অবশ্যই দরকার। টাকা দিয়ে প্রযুক্তি ভাড়া করে আনা যায়। দেশীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় কমিটি করা যায়। সম্ভাব্যতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।

কিন্তু সরকার সেই পথে না হেটে সোজা গোটা সম্পদের পাহাড়ই তুলে দেবার চেষ্টা করেছিল বিদেশী কোম্পানীর কাছে। অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানী ইন্টারন্যাশনাল টাইটানিয়াম কর্পোরেশান সেই সময় বেশ কিছুদিন কাজ করেছিল। ওখানেই আমাদের প্রবল আপত্তি ছিল।

তাই সাপ্তাহিক ২০০০-এ যিনি রিপোর্টটি লিখেছিলেন সেই সাংবাদিক আসাদুর রহমানকে নিয়ে আমার ঢাকাস্থ এক বন্ধুর সহায়তায় ঢাকায় একটা গোলটেবিল বৈঠকে একত্রিত করেছিলাম বুয়েটসহ বাংলাদেশে এই লাইনের সকল দেশীয় বিশেষজ্ঞকে। ও এইচ কবির সাহেবও উপস্থিত ছিলেন অন্যন্য বিশেষজ্ঞের সাথে। আরো আমন্ত্রন করেছিলাম তৎকালীন খনিজসম্পদ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ সাহেবকে। ভেবেছিলাম সরকারের ভেতর একটা জোর ধাক্কা দিয়ে জানানো যাবে আমাদের কী সম্পদ-সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে দেশের পেটের ভেতর। কিন্তু অন্য সবার বক্তব্যে আশাবাদী সুর আসলেও মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য শুনে আমি প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম এই রকম মন্ত্রী বাংলাদেশে যতদিন থাকবে ততদিন আমি আর কোন কাজে সরকারের ঘুম ভাঙাতে যাবো না।

গোলটেবিল বৈঠকে এরকম জনগুরুত্বপূর্ন বিষয়ে তিনি যা বলেছিলেন, তাতে তার জ্ঞানবুদ্ধি মন্ত্রী হবার যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা যায়। সেরকম প্রেসনোটধরনের বক্তৃতা যে কোন সরকারের আমলে রেডিও বা বিটিভির খবরে প্রতিদিন কয়েকবার বলা হয়। তাই সেই সাফল্যগাথার বয়ান দিতে রুচি হচ্ছে না এখানে। সরকারের ঘুম ভাঙাতে দারুনভাবে ব্যর্থ হলাম আমি ও আমার সঙ্গীরা। বিফল মনোরথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম সবাই।

কয়েকমাস আগে সেই নাছোড়বান্দা গবেষক ভদ্রলোক ও এইচ কবির সাহেব আরেকটা লেখা লিখেছেন নিউ নেশানে। এবার জানতে পারলাম এই সরকারও নাকি প্রিমিয়ার মিনারেল কোম্পানী নামে সিঙ্গাপুর-অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক আরেকটা বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করতে যাচ্ছে আমাদের কালো সোনা। সরকারের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টায় আমি হাল ছেড়ে দিলেও ছাড়েন নি ও এইচ কবির। তার নিউ নেশানে ছাপা লেখাটা তাই বলছে।

ভাবছি আবারো যোগাযোগ শুরু করবো কিনা, এই সরকারের ঘুম কি ভাঙাতে পারবো? সরকার কি আসলে ঘুমায়, নাকি জেগে ঘুমায় সেটাও বিরাট একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশকে নিজেদের সম্পদ নিজেদের কাজে ব্যবহার করার মতো শক্তি পেতে আর কতযুগ অপেক্ষা করতে হবে? বলিভিয়ার মতো একজন Evo Morales কবে আরোহন করবে বাংলাদেশের সিংহাসনে?

এটি কোন রূপকথা নয়, একটি জ্ঞানী পোষ্ট

ইহা একটি গিয়ানী পোষ্ট। একটি পরীক্ষামূলক রচনা। ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষার মান উন্নত করিবার মানসে প্রচলিত প্রশ্ননির্ভর পরীক্ষাপদ্ধতি ভাঙ্গিয়া উত্তর দিয়া প্রশ্ন রচনার প্রয়াস এটি। এতে প্রশ্নপত্রের বদলে উত্তর দেয়া থাকবে। ছাত্রছাত্রীগন পরীক্ষার হলে উত্তর অধ্যয়ন করে প্রশ্ন নির্ধারন করিবে। এতে একে তো বাঁচিবে সময়, অন্যদিকে রোধ হইবে মেধার অপচয়। [উত্তরে সাধু চলিত ভাষার মিশ্রন রহিয়াছে, বানানভুল রহিয়াছে। নিজ দায়িত্বে পড়িয়া নিতে হইবে। উত্তরের প্রতিটা ভুল ধরাইবার জন্য ১ নম্বর করিয়া বোনাস যুক্ত হইবে। ]

উত্তর শুরুঃ
এক বলদ মাঠে ঘাস খাইয়া দিনাতিপাত করিতেছিল। তাহার কোন সঙ্গীসাথী ছিল না। একা একা চরিত আর আর মনের আনন্দে হাম্বা হাম্বা করিত। মাঠের পাশে একটা জঙ্গলে একটা হরিনী বাস করতো। হরিনীটা প্রান্তরের ওপাশের জঙ্গলের এক হরিনকে ভালোবাসতো। কিন্তু অতদুরে একা যাবার সাহস তার নাই। প্রান্তরে ভুতের ভয় আছে। সে দুর থেকে হরিনকে ডাক দিত, হরিনও তাকে প্রত্যুত্তর করিত। কিন্তু হরিনেরও সাহস হয় না বিশাল প্রান্তর পেরিয়ে হরিনীর কাছে যেতে। তবে প্রেম কি এসব মানে?

হরিনী মরিয়া হয়ে একদিন জঙ্গলের প্রান্তে এসে গেল। দেখলো সেখানে চরছে একটা বলদ। মিস্টি সুরে ডাক দিল বলদকে। বলদ এত মিষ্টি সুরে জীবনে কখনো ডাক পায়নি। সুর শুনে গলে গিয়ে মাঠে শুয়ে পড়লো সে। কিন্তু কান খাড়া করে আবার শুনলো ডাক। এত মিষ্টি শুয়েই থাকতে ইচ্ছে হয়। চোখ বুঝে হরিনীর মিষ্টি ডাক উপভোগ করতে থাকে বলদ। দিন যায়। বলদের মুগ্ধতা বাড়ে। একদিন হঠাৎ চোখ মেলে দেখে ফেললো বনের ধারে দাঁড়ানো হরিনীকে। দেখামাত্র প্রেমে পড়ে গেল।

এই হরিনী মিষ্টি সুরে তাকে ডাকছে সেও নিশ্চয়ই তার প্রেমে পড়ে গেছে। আহা, কঠিন প্রেমের সুখে বুক ফেটে যায় যায় বলদের। সে মিষ্টি সুরে ডাকলো হরিনীকে। এভাবে দুজনের ভাব হয়ে গেল। বলদ নিজেকে বলদ সমাজ থেকে উন্নত ভাবতে শুরু করলো। সে চাইল হরিন সমাজে প্রবেশ করতে। হরিন সমাজে বলদের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু হরিনী তো আছে। সেই তাকে বলদ সমাজ থেকে হরিন সমাজে নিয়ে যাবে। সে তো বলদকে প্রান দিয়ে ভালবাসে। বলদ আশায় আশায় থাকে।

একদিন হরিনী প্রস্তাব দিল চল আমরা দুজনে একসাথে প্রান্তর পাড়ি দেই। এরকম অপ্রত্যাশিত ডেটিং অফার বলদকে এমন পুলকিত করলো যে সে আকাশের মরা চাঁদের পানে চেয়ে দুলাইন কবিতাই রচনা করে ফেললো তাৎক্ষনিক। ভাবলো মাঠে চরতে চরতে তার প্রিয়তমা হরিনীকে শোনাবে কবিতা খানা।

পরদিন দুজনে একসাথে মাঠে চরতে চরতে দুপুর নাগাদ মাঝমাঠ পেরিয়ে প্রান্তরের ওপাশে পৌছে গেছে। প্রান্তরে হাঁটতে হাঁটতে বলদ আরো ডজনখানেক গান গেয়ে শোনালো হরিনীকে। হরিনীও তার হরিনের জন্য সঞ্চিত কবিতা আর গানগুলো গেয়ে শোনালো। দুজনে সুখের সাগরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে বিকেলের মধ্যে প্রান্তরের শেষ মাথায় পৌছে গেছে। হরিনী ভাবলো ওইতো দেখা যায় তার প্রিয় হরিনের বাসস্থান। অধীর আগ্রহে যেখানে অপেক্ষায় আছে হরিন। বলদ ভাবলো আজকে আমার স্বপ্নপুরন হলো।

বলদ তার শেষ গানটা সূর্যাস্তের সময় শোনাবার জন্য রেখে দিয়েছে। আজ তার প্রেম পূর্ন হবে। কানায় কানায় পূর্ন হয়ে বলদ জীবন থেকে হরিন জীবনে প্রবেশ করবে। রীতিমতো রোমাঞ্চিত বলদ। ওদিকে প্রান্তরের এইদিকে আসার পর থেকে হরিনীর গান থেমে গেছে। কেমন উদাস হয়ে গেছে। বলদের কথা শুনতেই পাচ্ছে না যেন সে। বলদ ভাবছে অধিক আবেগের কারনে এমন চুপ হয়ে গেছে। বাকরূদ্ধ হওয়ার মতোই তো প্রেম। তার চোখ দিয়েও প্রেমাশ্রু টলটল করছে। আজ তার মহামিলন। আরেকটু মাত্র।

হরিনী প্রান্তরের শেষ প্রান্তে পৌছে বলদকে বললো, "অনেক হাঁটা হয়েছে তুমি একটু রেষ্ট নিয়ে নাও। আমি জঙ্গলের ভেতরটা দেখে আসি কোন শিয়াল টিয়াল আছে কিনা। তুমি দুশ্চিন্তা কোরো না। এখুনি ফিরবো।"

বলদ একটু অবাক হলেও বলার কিছু নাই। সে শুয়ে পড়লো ঘাসের উপর। ক্লান্তি লাগছে সারাদিনের হাঁটাহাঁটিতে। ঘুম ঘুমও লাগছে। একসময় ঘুমিয়েই পড়লো। ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেছে। বলদ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে এদিক সেদিক তাকিয়ে খুজলো হরিনীকে। চিৎকার করে ডাকলো। কোন সাড়া নেই। জঙ্গলের ভেতর অন্ধকার, সে ঢুকতে ভয় পেল।

সকালের সোনা রোদ এসে পড়লো তার গায়ে। একটা দোয়েল পাখি তিরিক্ষি সুরে ডেকে উঠলো। বলদের মনে হলো পাখিটা বলছে, বলদিয়া..বলদিয়া...বলদিয়া। মানে বলদ চিরকালই বলদ, বলদ কখনো হরিন হতে পারে না। তার দুচোখ বেয়ে দরদর করে পানি ঝরতে লাগলো। সে বুঝলো হরিনী তাকে ফাঁকি দিয়েছে, মহাফাঁকি। খুব দেরীতে বুঝলো বেচারা বলদ।

[উত্তর শেষ]

এবার সঠিক প্রশ্নে টিক চিহ্ন দিন। এটি নিন্মের কোন ভাব সম্প্রসারনের উত্তর ছিল?:
----------------------------------------------------------------------------------
১. ঘুমিয়ে আছে বলদ গরু সব পুরুষের অন্তরে

২. কোথায় বলদ, কোথায় প্রান্তর কে বলে তা বহুদুর
মানুষের মাঝেই আছে বলদ মানুষেতেই সুরাসুর।

আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে

বিবাহিত মানুষদের রোমান্টিকতা নিয়ে লেখা বিপদজনক। রবীন্দ্রনাথের মতো সাহসী পুরুষ বাংলাদেশে কজনকে পাওয়া যাবে? ৮০ বছর বয়সে লেখা কবিতা পড়ে বোঝার উপায় নেই এটি কোন বয়সে লেখা। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাগুলোর স্থান ও সময় লিখে রাখতেন। নইলে বয়স বোঝা মুশকিল হয়ে যেতো। আমি বহুদিন কবিতা পড়ি না। আবৃত্তি করিনা আরো অনেক বছর।

কম বয়সে দুজন কবি সবচেয়ে বেশী নাড়া দিত। জীবননান্দ ও রবীন্দ্রনাথ। বেশীরভাগ বাঙালীর কাছে এই দুজনের জনপ্রিয়তা পর্বতসম। যদিও জীবনান্দের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বেশী পড়া, তবু জীবনানন্দের নামটা আগে আসার কারন তাঁর কবিতার প্রাত্যাহিকতা। প্রতিদিন যেমন সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে, তেমনি জীবনানন্দের কবিতাও ছিল প্রতিদিন। জীবননান্দের কবিতা হাটে মাঠে যেভাবে জোরে আওড়েছি, রবিঠাকুরেরটা তেমন হয়নি শুধু অন্তরেই মাধুরী সঞ্চার করেছে।

আবার কারো কারো কবিতার একটি লাইনের কারনে জীবনের পুরো দর্শন বদলে যেতে পারে। সুধীনদত্ত যখন হাঁক দিয়ে বলেন "সে ভুলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে আমি ভুলিবনা, আমি কভু ভুলিবনা"। ভালবাসা তখন স্তব্ধ পুকুর বুকের ভেতর। তাকে না পেলেও আমার ভালবাসা নিস্ফল হয়ে যায় না।

ছেলেবেলা থেকে রোমান্টিক আবহাওয়ার পরশে থেকে স্বপ্ন ছিল প্রেম করে বিয়ে করবো। বাংলা সিনেমার প্রেমকাহিনীগুলো সেই বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করে তোলে। প্রেম ছাড়া জীবনই বৃথা। হেথায় হোথায় প্রেমের অনেক বাগান দেখি, আমার গোলাপ কই? কেউ তো আমার প্রেমে পড়ে না। আমি অনেকের প্রেমে পড়লেও প্রেম তাই আমার উপর এসে পড়েনি। বহুবছর পর প্রেম নিয়ে মনের মতো একটা গান শুনেছিলাম 'ব্যাচেলর' ছবিতে। "আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে।" ভাগ্য কাহাকে বলে। প্রথম শুনে মনে হয়েছিল আমার প্রেম ভাগ্যকে হিংসে করে লেখা।

৩৩ বছর কেটে গেল কেউ কথা রাখেনি। যে রাখতে পারতো সেও রাখে নি। কেন রাখেনি সে জানে। ২৮ বছর বয়সে পাড়ি জমালো অন্য ঘরে। আমার কেউ রইলো না। এক দিকে ভালোই হলো। প্রেমের জন্য গদ্য পদ্য লিখে সময় নষ্ট করার অবকাশ হয়নি। তারচেয়ে বিরহের কবিতা অনেক রোমান্টিক। হারানোর বেদনাও। পেয়ে গেলে এই বেদনা, এই না পাওয়া প্রেমের জন্য হাহুতাশ কোথায় থাকতো। বিরহকাতরতাই সৃজনশীলতার আতুড়ঘর।

৩৪ বছর বয়সে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করে নিরুপায় প্রেমহীন বিয়ে করতে হলো অনাঘ্রাত এক গোলাপের সাথে। সরাসরি বিয়ে নয়। বাগদানের পরবর্তী প্রবেশন পিরিয়ড ছিল তিন মাস। ভেবেছি সেই তিনমাস অপূর্ব সুযোগ। মোবাইল ফোনের যুগে রাত কেটে ভোর হয়ে যায় সাশ্রয়ী টকটাইমের বন্যায়। রাত প্রতি দুঘন্টা হলেও কম কি। কিন্তু গোলাপফুল তাতে নিতান্ত অনাগ্রহী। সামনে পরীক্ষা তার। জীবন গড়তে ভালোবাসার চেয়েও ভালো রেজাল্টের জন্য সাধনা করা জরুরী। প্রেমচিন্তা মাঠে মারা যায় যায়। প্রেম দুরে থাক ফোনাফুনির উপরও অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয় গোলাপের পক্ষ থেকে। বেকার মালী ঘোড়ার ঘাস কেটেই সময় পার করে।

হঠাৎ কোন এক শারদ সন্ধ্যায় পরীক্ষার এক ফাঁকে গোলাপের হঠাৎ সাধ হয় ফোন করে কথা বলার। গোলাপের ফোন মালীকে আগ্রহী করলেও প্রতিশোধমনষ্কতায় নিতান্ত রূঢ়ভাবে লাইনটা কেটে দেয়া হয়। একবার দুইবার তিনবার। এবার গোলাপের নাভিশ্বাস ওঠে। দুশ্চিন্তায় পরীক্ষা লাটে ওঠে। কথা বলতেই হবে। কী কথা? কিছু না। শুধু কথা। গোলাপের আবদার একটি মাত্র ঘন্টার।

নিরস গোলাপের এহেন আবদারে মালী দারুন অবাক। প্রেমহীন বাগানে ফুটলো কি অজানা ফুল? তিন পায়ে দৌড় দিয়ে হাজির হলো গোলাপের আবাসে। প্রথম একা থাকা সেই নিষিদ্ধ একটা ঘন্টা ঘটিয়ে দিল একটা ব্যাপার। জীবনে কোন বিপরীত মানুষের হাতে হাত রাখা হলো। নিরস হবু দম্পতির রোমান্টিকতার প্রথম পর্বের ফুল। সুযোগের অপেক্ষায় প্রেমহীন কেটেছিল যে দুটি মানবজীবনের। তবে প্রায় রেডিমেড প্রেমে না ছিল হারানোর ভয়, না ছিল ধরা পড়ার আতংক। সহজলভ্যতায় কী রোমান্টিকতা পরিপূর্নতা পায়? পায় না।

তবু একসময় ঘর হয়। ঘরোয়া আধো আধো রোমাঞ্চে দিন কাটে। ভালোবাসার খোঁজে অন্য কোথাও যাওয়া হয় না ঠিকই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রেরনা হয়ে যায় সময় সময়। কারো সাথে একটু দুরের দৃষ্টি বিনিময় নিষিদ্ধ অনুভুতির জোয়ার জাগায়। প্রিয় এক তরুন সহব্লগার বলে - পরকীয়া। দুঃসাহসী ব্যাপার। আমার এখন সেসব মানায়? দুচ্ছাই! তারপর?

অনেক বছর পরে আমি খোঁজ পেয়েছি নতুন প্রেমের। নতুন প্রেমের পরশ নিতে প্রতিটি দিন অফিস করে বাসায় ফিরি। ভালোবাসার ঢালি নিয়ে অপেক্ষাতে কান পেতে রয় কলিং বেলের। এতদিনে পুর্ন হলো বহুযুগের অনাহারী একটি জীবন। কন্যা আমার তিন বছরের। দরজা খুলেই বুকের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সদা সবাক মেয়ে আমার কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রয় ছোট্ট দুহাত গলার মালা। এত আদর এতযে প্রেম তিনশো বছর ভালোবেসে শেষ হবে না অশেষ এ টান। প্রতীক্ষাটা শেষ হলো আজ চার দশকের অবসানে। প্রেমে প্রেমে কানায় কানায় পূর্ন হলো আমার জীবন।

আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে! নাকি?

না পদ্য না গদ্য.........

একদিন সবকিছু গল্প হয়ে যায়............................

একদিন সবকিছু ফুরিয়ে যায় অনিবার্যভাবেই। সময়ের প্রয়োজনেই। এটা নিয়ে কোন দুঃখ করা সাজে না। কোন আক্ষেপ মানায় না। মানব জীবনেও ঋতুর তারতম্য ঘটে। সেই ঋতুর সুত্র ধরে ধরেই একেকটা বিবর্তন ঘটে যায়। কিছু বিবর্তনে মানুষ টিকে থাকে, কিছু বিবর্তনে হয় নিঃশেষ।

সময় বয়ে গেছে সেই বহুকাল আগে। তবু এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে বাকতৃষ্ণা। আমাদের আনন্দ আছে বুকের গভীরে, তৃপ্তি আছে সুখের সাগরে। আমরা সেই আনন্দ সাগরে স্নান করি যখন খুশী। যতদিন আমাদের সুখের আয়ু, ততদিন এই স্রোত বহমান। এক হাসিতে সাত দিন, অধরা মানুষ ঘটনাবিহীন।

সময়েরও আগের কথা। সুবর্ণ রথে চড়ে একদিন ভেসে এসেছিল সুদিনের সংবাদ। যার আসার কথা নয়, তার একটু কথার সুর ফিরে তাকিয়েছিল।
..................................................
যাহা বলো তাহা
তবু তুমি আহা
ফেরাতে পারিনা চোখ
তুমি আমার অনন্ত অসুখ
............................
কিছু কথা ছিল বাকী, কিছু ব্যথা দিল ফাঁকি
কিছু হাসি চুপ করে ছিল লুকিয়ে
সেই চোখ, সেই নাক, সেই ওষ্ঠাধার
চেনা চুলের ভাঁজ
এখনো এখনো ঢেউ তোলে বয়ে যাওয়া ধান খেতে
রাখাল বাজায় বাঁশী, গরুর পাল লয়ে যায় ফিরে
গোধুলী বেলায় এসে শুনতে কী পাও?
....................


বিকেলবেলার বারান্দাটির কথা মনে পড়ে। এক ফালি সেই বারান্দায় কয়েকটি ফুলের টব। সেই টবে সবুজ লতানো গাছগুলো বেড়ে উঠতো, ফুলেরা হেসে উঠতো, পাতাবাহারের ঝোঁপ থেকে ভেসে আসতো মাটির গন্ধ। সেখানে ছিল একটি চেয়ার। একজন আসলে সোজা বারান্দায় চলে যেতো। সেই চেয়ারে বসার কিছুক্ষণ পর আরেকজন এসে বারান্দার দরোজায় দাঁড়াতো। তারপর গাছেদের মাঝখানে রেখে কথা বলতো সেই প্রিয়ংবদা। গাছের কথা, পাতার কথা, ফুলের কথা, ফলের কথা, কথার কথা চলতে চলতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো। ঘরে বাতি জ্বলে উঠলে ওরাও উঠতো। চায়ের টেবিলে আবারো বসা হতো। চা খেতে খেতে আরো কথা। শুধু কথার কথা। ছিল না কোন অর্থ। তবু সেই অন্য কথার মধ্যে কোন বার্তা আসা যাওয়া করতো কিনা সেটা অন্তর্যামী ছাড়া কারো জানার কথা না। সেই কথার কথা দিনগুলো ফুরিয়ে গেল একদিন। বন্ধ হলো আসা যাওয়া। পথের ধারে ছিল না কোন প্রতীক্ষা। গন্তব্য হয়ে গেল আলাদা পথে। একদিন.....অনেকদিন পর একদিন মহাশূন্যে নীহারিকার কক্ষপথে দেখা হয়ে গেল আবার। তখন আর বারান্দা নেই, ফুলের গাছ নেই, গাছের পাতা নেই, আছে দুই নীহারিকার দুই নক্ষত্র। তখন সব ভয় দূরে সরে গেছে। সব দ্বিধা পিছু হটেছে। তখন ওরা মহাবিশ্বের সাক্ষ্যে নিজেদের উন্মোচিত করে। কথাগুলো এবার অর্থপূর্ণ হয়। স্মৃতির বাগানে ছড়ানো বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলো জোড়া লাগে। বাক্যগুলো সুসংহত হয়। তারপর.....তারপর খুব দেরীতে হলেও একটি অনুপম কবিতার জন্ম হয়।
....................................................................................................................................

   ওই হাসিটা কেবল প্রিয়তমার মুখেই মানায়: ওই একটি হাসিতে পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর প্রেম:  আর কিছু পাওয়া না হলেও কোন ক্ষতি নেই জেনো:  কেবল হাসিটি বেঁচে থাকুক অনন্ত স্মৃতিতে 

.............................

সবই কথার কথা, তবু কথারা বেঁচে আছে, একদিন যেমন দমবন্ধ ঘরে আটকে ছিল, এখন তা খোলা হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়।

[দিন বদলের সাথে শব্দ বাক্য তাল লয় সব বদলে যায়]

Wednesday, May 27, 2009

সুখ বড় অসময়ে চলে যায়

এইমাত্র একটা দুঃসংবাদ পেলাম। বন্ধু টুটুল ফোন করে জানালো তার স্ত্রী পরশু বিকেলে নিজের গাড়ী দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়েছে। হাত পায়ের হাড় ভেঙে গেছে ভয়াবহভাবে। চট্টগ্রামের হাসপাতাল থেকে ঢাকা স্কয়ারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মাত্র কয়েকমাস আগে শখ করে গাড়ী কিনেছে টুটুল। এই মাসে নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে। ওর বউ ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরী করে। সে আছে চাঁটগা চেম্বার অব কমার্সে। দুজনের সাজানো সুখের সংসার। এদেশে মানুষের সুখের কোন নিশ্চয়তা আছে? কি নিরাপত্তাহীন জীবন। দ্রুতগামী একটা ট্রাক এসে গাড়ীটাকে দুমড়ে মুচড়ে চলে গেছে। অবস্থা এত জটিল সুস্থ হলেও আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে কখনো কি ফিরে যেতে পারবে? আমি ভাবতে পারি না। কেন এভাবে মানুষের সাজানো বাগানগুলো নষ্ট হয়ে যায়। স্বপ্নবাজ মানুষ হয়েও এসব দেখে আমি স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই। সুখী ভাবতে ভয় পাই। সুখ বড় অসময়ে চলে যায়।

মোশাররফ রানার মুশকিল আসান ও কয়েকটা ভিয়েতনামী ডং

বোকাসোকা লোকগুলা কখনো মুশকিলে আসান হতে পারে, আবার কখনো আসানকে মুশকিলে ফেলতে পারে। মোশাররফ রানা তাদের একজন। নামে যেমন চেহারা সুরতেও টিভি নাটকের মোশাররফ করিমের কাছাকাছি। তার আচার আচরন যদিও একটু বোকাবোকা কিন্তু মজার লোক বলে খুব জনপ্রিয়। অ-ইংরেজ বিদেশীদের সাথে নিয়মিত কথোপকথনের কল্যানে তার ভাষাজ্ঞান বাংরেজী মেশানো শারীরিক অঙ্গভঙ্গির অনন্য মাত্রায় পৌছে গিয়েছিল। এই ভাষাজ্ঞান দিয়ে সে হোমো স্যাপিয়েন্স গোত্রের সকল প্রানীর কাছে তার বার্তা পৌছে দিতে সক্ষম বলে আমার ধারনা।

কয়েক বছর আগে অফিস থেকে একটা ট্যুরে যাচ্ছিলাম ভিয়েতনামে। সঙ্গে ছিল ১৯ জন সহকর্মী। হ্যানয়ের উপকন্ঠে আমাদের একটা প্রজেক্ট আছে যেখানে বেশ কজন বাঙালীও কাজ করে। ওই ট্যুরটা অন্যন্য বারের চেয়ে আলাদা। ট্রেনিং -মিটিং-সেমিনার এসব ফালতু বিষয় নাই। শুধুই ঘোরাঘুরি, দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন, নির্মল বিনোদন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হালং বে(Ha Long Bay)-তে নৌ বিহার ও বিখ ডং(Bich Dong)-লেকে ডিঙি নায়ে ভেসে বেড়ানো।

সহকর্মীদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ ভিয়েতনাম যায়নি আগে। আবার কয়েকজন ছিল যাদের এটাই প্রথম বিদেশ সফর, মোশাররফ রানা তাদের একজন। সে এমনিতেই আমাকে খুব পছন্দ করে তার উপর আমার পুর্বাভিজ্ঞতা থাকার কারনে ওখানে পৌছানোর পর থেকেই সারাক্ষন আঠার মতো আমার সাথে সাথে আছে। আমি যে দোকানে ঢুকি সেও ঢুকবে ওখানে। আমি যা কিনি, সেও তার একটা কিনবে। আমি যা ধরি সেও তা দরাদরি করবে। এরকম একটা ছায়াসঙ্গী বিরক্তিকর মনে হলেও ওর কান্ডগুলোর জন্য আমার মজাই লাগতো।

একদিন বেড়াতে গিয়ে পথে খিদে পেলে আমি শুকনো বিস্কুটের জন্য একটা মার্কেটের মতো জায়গায় গাড়ী থামালাম। রানাও নামলো আমার সাথে। আমি একটা বিস্কুট ধরলে - সে এগিয়ে দোকানী মহিলাকে বলে 'হাউ মাচ, ম্যাডাম গিভ মি এ প্যাক।' আমি অন্য বিস্কুট ধরি। সে আবারো এগিয়ে এসে বলে- 'হাউ মাচ, ম্যাডাম গিভ মি এ প্যাক।' ফলতঃ গাড়ীতে ফিরে আসার পর আমার হাতে দুজন খাবার মতো একটা বিস্কুটের প্যাকেট আর রানার হাতে বিশাল পলিব্যাগে নানান জাতের ভিয়েতনামী বিস্কুটের সমাহার।

আমাদের হোটেলটা ছিল শহর থেকে একটু দুরে। সাদামাঠা হোটেল কিন্তু প্রয়োজনীয় সব সুযোগ সুবিধা আছে। এসি, ফ্যান, টেলিফোন, টিভি, ভিসিডি থেকে শুরু করে বাথরুমে গরম ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা সব কিছু। সব থাকলেও রাত দশটার দিকে রানার খেয়াল হলো মশারি নেই। মাঝরাতে যদি মশা কামড়ায় তাহলে কি দশা হবে। তখন তো ডেকেও কাউকে পাওয়া যাবে না। বিদেশ বিভুঁই, যা করার এখনি করতে হবে। রানা আমার রুমে এসে বললো, "ভাইয়া একটা সমস্যা তো হয়ে গেছে। এই ব্যাটারা তো মশারি দেয় নাই।" আমি বললাম, "এখানে মশা নেই, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।" কিন্তু রানা নাছোড়বান্দা। মশারি ছাড়া তার নাকি ঘুম আসে না। তার ডেঙ্গুভীতি প্রবল।

পীড়াপীড়িতে অতিষ্ট হয়ে হোটেলের রুম সার্ভিসকে ডাক দিলাম। অল্পবয়সী ছেলেটা দুএক শব্দ ইংরেজী বোঝে। ইংরেজীতে বললাম কি চাই। সে মাথা নাড়লো। বুঝে নাই। ইশারায় বোঝালাম আবারো। কিন্তু ডানে বায়ে মাথা নাড়ছে। বুঝে নাই। ভুদাই একখান! নানা কায়দা করেও আমি ওকে বোঝাতে পারলাম না মশারি চাই একখান। আমাদের কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে উপর নীচের সব সহকর্মী রুম থেকে বের হয়ে এসেছে। ভিয়েতনামীরা ইংরেজীতে একদম গোল্লা। আমরা ছিলাম ইংরেজের কলোনী ওরা ছিল ফরাসী কলোনী। ফরাসীতে বললে হয়তো বুঝতো। ওই বিদ্যা আমার নেই। সাধারন ভিয়েতনামীদের ইয়েস নো বুঝাতেও কেয়ামত হয়ে যায়।

কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছে না রানা হঠাৎ লাফ দিয়ে টেবিলের উপর উঠে দাঁড়ালো। দুহাত উঁচু করে কল্পনায় মশা খুঁজলো, তারপর ঠাশ ঠাশ করে কয়েকটা কাল্পনিক মশা মেরে বিদঘুটে অঙ্গভঙ্গি করে দুহাতে চৌকোনা আকৃতি দেখিয়ে জোড়া হাত গালের পাশে রেখে ঘুমের ভঙ্গী করলো। এটুকু দেখেই বুদ্ধিমান রুম সার্ভিস 'ওহ ইয়েস ইয়েস কামিং' বলে ছুট দিল নীচে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রানার জন্য মশারি হাজির। ওদের ষ্টকে ছিল, কেউ চাইলে দেয়। তবে মশারিটা কেউ হাতে নিতে পারলো না। কারন রানার মশারি ক্যারিকেচারে মুগ্ধ দর্শককূল তখনো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল।

এক সপ্তাহের ভ্রমন শেষ। ফেরার দিন এয়ারপোর্টে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে প্লেনে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি সবাইকে নিয়ে। প্লেন ছাড়বে কিছুক্ষনের মধ্যেই। বোর্ডিং ব্রীজ লাগানো হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একজন পেছন থেকে এসে জানালো রানা বাইরে যাচ্ছে।

আমি ছুটে গিয়ে রানাকে ধরলাম। "কই যাও?"

রানা একগাল হেসে বললো, "এই তো পাঁচ মিনিটে চলে আসবো, একটু এয়ারপোর্টের গেটে যাচ্ছি একটা সিগারেট কিনতে"

আমি তাজ্জব হয়ে বলি,"একটা সিগারেট কিনতে গেটে যাচ্ছো?"

রানা সরলভাবে বললো, "মানে কয়েকটা খুচরা ভিয়েতনামী ডং রয়ে গেছে পকেটে, দেশে তো কোন কাজে আসবে না, তাই ভাবলাম একটা সিগারেট কিনে শেষ করে ফেলি। ভেতরে তো এক কার্টনের কম বেচে না। গেটের সামনে দোকান টোকান পাওয়া যাবে না?"

আমি আকাশ থেকে পড়লাম "তুমি জানো এটা কোন জায়গা? তুমি ইমিগ্রেশান, কাষ্টমস পেরিয়ে প্লেনের দরজায় দাড়িয়ে, এখান থেকে তুমি একটা সিগারেট কিনতে বাইরে যাবে? এটা কি গুলিস্তান সায়েদাবাদ পেয়েছ যে বাস ছাড়তে দেরী হচ্ছে একটা বিড়ি ফুঁকে আসি। যাও লাইনে দাঁড়াও গিয়ে, এখুনি প্লেন ছাড়বে"

বোর্ডিং ব্রীজে ঢোকার মুখে পেছনে তাকিয়ে দেখি মোশাররফ রানা বিরস মুখে লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে। ডান হাতটা তখনো পকেটের ভেতরে অবশিষ্ট খুচরো ভিয়েতনামী মুদ্রা গুলো ধরে রেখেছে।

শিক্ষা নিয়ে চিন্তাপোকার কচকচানি

আমার মেয়ের বয়স পৌনে তিন বছর। এর মধ্যেই ওকে কোন স্কুলে পড়ানো হবে, কিরকম শিক্ষা দেয়া হবে এ নিয়ে ওর মা-দাদী-ফুফু-খালারা চিন্তিত। সবাই নাকি এখন আড়াই বছর থেকে বাচ্চাকে স্কুলে দেয়া শুরু করে। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি, আমি যেরকম স্কুলে পড়েছি আমার মেয়েকেও সেরকম পড়াবো। আর এত তাড়াতাড়ি স্কুলে দেবার কোন ইচ্ছে নেই এবং ওকে এখনি সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার কোন দরকার নেই।

আমি এমন স্কুল চাই যেখানে বইপত্র সবচেয়ে কম এবং ফাঁকি দেয়ার সুযোগ সবচেয়ে বেশী। ফেল করলেও তুলে দেবে পরের ক্লাসে এরকম। সরকারী প্রাইমারী স্কুল এক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বেশী পছন্দ। আমার কথা শুনে সবাই তেড়ে আসে আমার দিকে। ওসব স্কুলে পরিবেশ নেই। বুয়ার ছেলেমেয়েরাও ওসব স্কুলে পড়ে না এখন।

কিন্তু মেয়েকে আমি এই বয়স থেকে বিদ্যার জাহাজ বানাতে চাই না। আমি চাই ওর শৈশবটা কৈশোরটা আনন্দময় হোক। বড় হবার পর সে নিজেই বেছে নিক তার পছন্দের রাস্তা।

ভাবি সরকারী স্কুলগুলোতে যদি পড়াতে না চায়, তাহলে সরকার এত টাকা-পয়সা বাজেটে খরচ করে ওই স্কুলগুলো কাদের জন্য রেখেছে? আমি কেন আমার সন্তানকে একটা সহজ শিক্ষাব্যবস্থায় বড় করতে পারবো না?

৩৫ বছর আগে আমি যখন একটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হতে যাই, স্কুলের দুটি জিনিসের স্মৃতি এখনো জেগে আছে। একটি বেত হাতে মাষ্টার, অন্যটা বিশাল খেলার মাঠ। একটা দেখে ভয়, অন্যটা দেখে আনন্দ পেয়েছিলাম। আমাদের বই ছিল সামান্য। পড়াশোনা সামান্য, মাঠটা বিশাল এবং খেলার সময় অফুরন্ত হওয়াতে স্কুল খুব আনন্দময় ছিল।

দৈনিক সর্বোচ্চ আট ঘন্টা পড়াশোনার জন্য ব্যয় করেছি শুধু মেট্রিক পরীক্ষার সময়। আমাদের শৈশব, কৈশোর, কী আনন্দময় ছিল ভাবলে এখনকার ছেলেমেয়েদের জন্য কষ্ট লাগে।

এখনকার ছেলেমেয়েরা কী করে? শরীরের অর্ধেক ওজনের একগাদা বই নিয়ে স্কুলে যায়। দমবন্ধকরা গাদাগাদি ক্লাসরুম। হোমওয়ার্ক, স্কুলওয়ার্ক, প্রাইভেট টিউটর, মওলানা হুজুর। জ্ঞানার্জনের নানা ক্যাচাল। সন্ধ্যে হলে টেবিলে বসা, ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পড়তে পড়তে নটা-দশটা বাজানো। তারপর হয়তো টিভি দেখা নয়তো খেয়েদেয়ে ঘুম। এখানে খেলার মাঠ কোথায়, খেলাধুলা কোথায়, আনন্দ করার অবকাশ কই?

স্কুলের মাঠ নেই, খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই, জনসংখ্যার চাপে জায়গা সংকুচিত হতে হতে স্কুল এখন সিড়িঘরে পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছে। ঘিঞ্জি বাড়ীর দুটি কক্ষ হলেই একটা স্কুল খুলে ফেলা যায় এখন। কি পড়াবে, কে পড়াবে এসব বিবেচনার কোন বালাই নেই। দরকারি-বেদরকারি ইংরেজী বইয়ের ছড়াছড়ি। বাচ্চা ছেলেদের আয়ারল্যান্ডের রাইমগুলো পিটিয়ে মুখস্ত করানো হয়। কেউ বলার নেই। কোন বয়সে কতটুকু শিক্ষা প্রয়োজন, তার কোন নিয়মনীতি নেই। বাচ্চাদেরকে খুব তাড়াতাড়ি বিদ্যার জাহাজ বানিয়ে ফেলতে হবে। ক্লাস টু থেকে নিউটন পড়াতে হবে, ইকুয়েশান শেখাতে হবে, তুমুল স্মার্ট করে তুলতে হবে, এজন্যই হুড়োহুড়ি সব।

জাতির মেরুদন্ড মজবুত করার জন্য রীতিমত জাঁতাকলে পিষ্ট করে হলেও শিক্ষার নামে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যা গিলিয়ে ছাড়বে আমাদের সেই ইংরেজী বিদ্যালয়গুলো। অভিভাবকদের তাড়াহুড়োও দেখার মতো। এমনিতে খেলাধুলার জায়গা নেই, তাদের যে অবসরটুকু থাকার কথা এই বয়সে, কিছু অতি সচেতন অভিভাবক তাও গ্রাস করে ফেলেছে।

একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার এক কাজিন তার দুই ছেলেকে বাংলা ইংরেজী আরবী সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞ করে তোলার স্বপ্ন দেখছেন। ভোর থেকে শুরু হয় তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন প্রকল্প। ঘুম থেকে উঠে কোনমতে নাস্তা গিলিয়ে স্কুলে চলে যায় দুই ভাই। একজনের বয়স ৬ বছর আরেকজন ৮ বছর। কিণ্ডারগার্টেনে ইংরেজী বাংলার পড়াশোনা শেষ করে দুপুরের আগে আগে চলে যায় ক্যাডেট মাদ্রাসায়। সেখানে আরবী অধ্যয়ন চলে। ফিরতে ফিরতে ৩ টা বাজে। খেয়ে উঠতে না উঠতে হুজুর আসবে প্রাইভেট পড়াতে। হুজুর যেতে যেতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর আসবে ইংরেজী অংকের মাষ্টারমশাই। মাষ্টারমশাই যেতে যেতে নটা বাজে। তারপর স্কুলের হোমওয়ার্ক তৈরী চলে রাত দশটা অবধি। এরপর খাওয়া সেরে ঘুমোতে ঘুমোতে রাত সাড়ে এগারটা পেরিয়ে যায়। পরদিন ভোরে উঠে আবার সেই একই রুটিন।

বাচ্চাদের এই ব্যস্ততার গল্প আমার সেই ভাই ও ভাবী তৃপ্তির সাথে খুব গর্বের সাথে বলে বেড়ায়-'পড়াশোনার এত চাপ, একদম সময় পায় না ওরা'। হায়, পড়াশোনাটাও ফ্যাশানের পর্যায়ে পৌছে গেছে।

আমি কাজিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এভাবে চললে ওদের খেলাধুলা করার সময় কোথায়? উনি বলেন - 'খেলাধুলা করলে তো দুষ্টু হয়ে যাবে, এখন সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আছে ভালো আছে। আর ওরা তো সময় পেলে ভিডিও গেম খেলে কম্পিউটারে। আরো বড় হলে খেলাধুলা করতে পারবে' আমার মাথাটা গরম হয়ে যায় শুনে। এই হলো আমাদের অভিভাবক সমাজের একাংশের মানসিকতা। যার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে স্কুলগুলো এবং দেশের জগাখিচুড়ি শিক্ষাব্যবস্থা।

শিক্ষার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। যে বইগুলো পড়ানো হয় আদৌ সেগুলোর দরকার আছে কি না কেউ ভাবে না। যদি দরকার না থাকে তাহলে কেন সেই অপ্রয়োজনীয় বইগুলো পড়িয়ে বাচ্চাদের মাথা খারাপ করে দেয়া হবে? অর্থ, সময়, মেধার অপচয় বন্ধ করার পদক্ষেপ কে নেবে? শিক্ষাকে বানিজ্যের লোলুপ গ্রাস থেকে রক্ষার দায়িত্ব কার?

আমার মাথা চলে না।

[সহব্লগার গৌতম আর দিগন্তের শিক্ষাবিষয়ক লেখাগুলোর কাছে আমার অনেক কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশের অপশিক্ষা নিয়ে একটা চিন্তাপোকা বহুদিন যন্ত্রনা দিচ্ছিল বলে যাচ্ছেতাই একটা তাৎক্ষনিকভাবে লিখে ফেললাম। এই বিষয়ে পরে আরো লেখার ইচ্ছে আছে।]

Monday, May 25, 2009

পত্রিকা পাঠের হোঁচটীয় ইতিহাস

একদম পোলাপান বেলায় বাসায় নিয়মিত কোন দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো না। বাবা যেদিন যা খুশী কিনতেন, কোনদিন কিনতেনও না। খবরাখবরের জন্য রেডিও ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। সকালে একবার রাতে দুবার বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকার খবর শোনা হতো। আজকে অবাক লাগলেও সত্তর দশকে দল বেঁধে, আয়োজন করে মানুষ রেডিও শুনতো। কাছাকাছি মানুষদের মধ্যে একমাত্র বড় মামা আর মেজ চাচার বাসায় দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত ছিল। বড়মামা সরকারী কর্মকর্তা। তার বাসায় সবসময় ইত্তেফাক রাখা হতো, মামা এত বেশী ইত্তেফাক ভক্ত ছিলেন যে আমি ভাবতাম ইত্তেফাক বোধহয় সরকারী পত্রিকা। এমনকি বড় হয়েও মামার বকা শুনতাম -তোরা কী ছাতামাতা পত্রিকা রাখিস, ইত্তেফাক রাখবি, ইত্তেফাক সবচেয়ে ভাল পত্রিকা (তখন আজকের কাগজ নতুন বেরিয়েছে আমি তাই রাখতাম)। আমার ইত্তেফাক পছন্দ ছিল না, ওটাকে আমার চিরকাল দালাল পত্রিকা মনে হতো। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মামা ইত্তেফাক ভক্ত ছিলেন।

মেজচাচা ব্যবসায়ী মানুষ, বাম রাজনীতি করতেন। তিনি রাখতেন 'সংবাদ'। এটাও আমার চোখে 'সুন্দর' লাগতো না। ছাপাগুলো কেমন ছেড়াবেড়া, ছবিগুলো ঝাপসা। সেদিক থেকে ইত্তেফাক অনেক পরিচ্ছন্ন ছিল। তবে ইত্তেফাকের সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল বিজ্ঞাপনের হিবিজিবি আর প্রথম পৃষ্টায় প্রত্যেক খবরের দুলাইনের পর '৮ম পৃষ্টায় দ্রষ্টব্য' লেখাটি।

নিজে প্রথম নিয়মিত পত্রিকার গ্রাহক হই ১৯৮৩ সালে, 'কিশোর বাংলা' নামের একটা ছোটদের পত্রিকা। ভীষন প্রিয় পত্রিকা ছিল আমার। তখন ঢাকার পত্রিকা চট্টগ্রামে পেতে পেতে বিকেল হয়ে যেত। ভোরে উঠে চায়ের কাপের সাথে দৈনিক পত্রিকা শুধু গল্প উপন্যাসের বিষয়। 'কিশোর বাংলা' পেতাম বিকেল চারটার পরে। আরো কিছুদিন পর চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী রাখা শুরু করি কিশোর বাংলার পাশাপাশি। তারও কিছুদিন পর সাপ্তাহিক বিচিত্রা। আজাদীর ছাপাটাও পুরোনো লাগতো বলে বন্ধ করে দেই একসময়। আমি তখন থেকেই দৃষ্টিনন্দন পত্রিকার পিয়াসী ছিলাম। কিন্তু মনমতো একটাও ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক পূর্বকোন যখন প্রথম প্রকাশিত হয় (সম্ভবতঃ ১৯৮৬ সালে) সেই প্রথমবারের মতো ঝকঝকে ছাপা একটা পত্রিকা হাতে পাই। ফটোকম্পোজ নামের আধুনিক প্রযুক্তির আমদানী ঘটেছিল তখন ছাপাখানায়। আমি পুর্বকোন রাখা শুরু করি।

কলেজে উঠে যায়যায়দিনের সাথে পরিচয়। ৩ টাকা দামের ভিন্ন আঙ্গিকের ৩২ পাতার পত্রিকাটি হারিয়ে দিলো বিচিত্রা-রোববারের মতো ৬৪ পৃষ্টার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাকে। আশির দশকের বিশাল অংশের আধুনিক তরুনের চিন্তাভাবনার ধারক বাহক হয়ে ওঠে যায়যায়দিন। আমরা যাযাদি বিপ্লবে সামিল হলাম। শফিক রেহমান তখন আমাদের আইডল (আজকের নষ্ট শফিক রেহমানকে যখন দেখি, নক্ষত্রপতনের কষ্ট পাই)। ত্রিশ সেট অলংকার কাহিনীতে যায়যায়দিন নিষিদ্ধ হলে আমার ম্যাগাজিন কেনা বন্ধ। তবু প্রতি সপ্তাহে পত্রিকার ষ্টলে গিয়ে খোঁজ নিতাম কোন সুখবর আছে কিনা। নিষেধাজ্ঞা উঠেছে কিনা। কিন্তু এরশাদের কোপানলে পড়েছে যাযাদি। ছাড়পত্র মেলে নি। সেই সময় বাজারে ৩২পৃষ্টার আরেকটি বিপ্লবী পত্রিকা চলছিল -মিনার মাহমুদের 'বিচিন্তা'। আপোষহীন রাগী তারুন্যের পত্রিকা। বিচিন্তার গ্রাহক হলাম। এটা নেয়া শুরু করতে না করতে কিছুদিন বাদে এটিও এরশাদের কোপানলে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো।

তারও কিছুদিন পর মোজাম্মেল বাবু সম্পাদিত 'পূর্বাভাস' নামের একটা ঝকঝকে সাপ্তাহিক পত্রিকা দেখা গেল হকারের থালায়। দাম পাঁচ টাকা, সেই বত্রিশ পাতাই, কিন্তু কাভারটা অফসেটের ঝকঝকে ছাপা। প্রথম সংখ্যা কিনেই বিমুগ্ধ ভক্ত। যাযাদির সমকক্ষ হতে পারে পত্রিকাটি। কিছুদিন পর এটিও এরশাদের চক্ষুশলে পরিনত হলো। শিশিরের অসাধারন কার্টুনের সাথে পরিচয় হয় এই পত্রিকা দিয়েই। প্রিয় পত্রিকাগুলো একের পর এক নিষিদ্ধ হওয়াতে নতুন পত্রিকার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতাম। সেই সাংবাদিককুলের কাছে আমি আজো কৃতজ্ঞ দিনের পর দিন নিষেধাজ্ঞার খাড়া মাথায় নিয়ে যারা একের পর এক পত্রিকা উপহার দিয়ে চলেছিল। পত্রিকা প্রকাশের সাথে বানিজ্য ব্যাপারটা তখনো তেমন করে যুক্ত হয়নি।

প্রতিদিন ঘুরঘুর করতাম পত্রিকার ষ্টলের আশেপাশে। যদি নতুন কিছু চোখে পড়ে। অদ্ভুত নামের একটা পত্রিকা চোখে পড়লো একদিন। দুর থেকে লেখা দেখলাম 'কাগজ'। সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খান। ছবি বিহীন, প্রায় বিজ্ঞাপন বিহীন অনেকটা ভাবগন্ভীর পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বিশ্বাস জন্মালো এটি আমার নতুন পত্রিকা হবে। আমি খবরের কাগজের পাঠক হয়ে গেলাম সেদিন থেকে। কিন্তু বেশীদিন নয়। কয়েকমাস পরেই সামান্য একটা প্রতিবাদী কবিতা ছাপানোর জন্য নিষিদ্ধ হয় খবরের কাগজ। এরশাদের পুরো সময়টা ছিল আতুরঘরে সংবাদপত্র হত্যার কাল। এরশাদের প্রতি আমাদের প্রজন্মের ঘৃনার হার সবচেয়ে বেশী এই কারনেও। তবে এখন ভাবি সেই নির্যাতনগুলো ভবিষ্যতের জন্য ভালো হয়েছিল। তরুন সাংবাদিকদের পত্রিকা প্রকাশের চেতনাকে জিদকে আরো অনেক বৃদ্ধি করেছিল। বিপরীত অর্থে সংবাদজগতের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছিল। মেরুদন্ডহীন সাংবাদিকতার যুগের অবসান ঘটিয়ে সংবাদপত্রের নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল এরশাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারনে। নিষেধের বেড়াজালে তারুন্য আরো বেশী শক্তিমান হয়।

এরশাদ পতনের পর যেদিন জানতে পারলাম 'খবরের কাগজ' সাপ্তাহিকটি আজকের কাগজ নাম নিয়ে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ পাবে, সেদিন আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল এই পত্রিকাটা আমার নিয়মিত পত্রিকা হবে। পত্রিকা হাতে পেয়ে আমার বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হলো। নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর, তথ্যসমৃদ্ধ, বিজ্ঞাপন উৎপাত বিহীন একমাত্র পত্রিকা ছিল আজকের কাগজ। আজকের কাগজকে আমি বলবো সংবাদপত্র জগতের 'একুশে টিভি'। আজকের সবগুলো টিভি চ্যানেলের আতুরঘর যেমন 'একুশে টিভি', তেমনি আজকের সবগুলো আধুনিক পত্রিকার আতুরঘর 'আজকের কাগজ'।

প্রিয় ম্যাগাজিন আর পত্রিকাগুলো ঘাটতে ঘাটতে আমি ততদিনে চিনে গেছি কে কোথায় লেখে, কোন কলামিষ্ট কোত্থেকে এসেছে। পত্রিকায় যারা লেখেন, কাজ করেন তাঁরা বোধহয় জানেন না, আমরা সাধারন পাঠকেরা দুর থেকে কিভাবে পত্রিকা কর্মীদের অনুসরন করি। পত্রিকা খুলে খবর পড়ার আগে প্রথমে কর্মীতালিকায় চোখ বুলানো আমার দুই যুগের অভ্যেস। এমনকি কম্পিউটার গ্রাফিকস এর দায়িত্বে কে আছেন সেটাও খেয়াল করতাম। কোন পত্রিকায় কে কোন বিভাগ দেখে সব মুখস্ত ছিল। ফলে কোন ছোটখাট নড়নচড়নও চোখ এড়াতো না। সাংবাদিক লেখকরা কোথাও ভুল করলে আমরা দুর থেকে বলে দিতে পারি। কিন্তু পাঠকের উপায় থাকে না সেই ভালোমন্দগুলো সেই লেখক সম্পাদক বা কলামিষ্টকে জানানোর। অনেকে পত্রিকায় লেখা পাঠাতো। আমি কখনো লিখতাম না। নিখাদ পাঠক ছিলাম আমি। পড়ার খিদে বরাবর বেশী। এখনো।

পত্রিকা কখনো ভাঙ্গতে পারে জানা ছিল না। প্রথম অভিজ্ঞতা হলো আজকের কাগজ দিয়ে। পত্রিকায় ভাঙ্গন পাঠকের মনে কিরকম আলোড়িত করে তা পত্রিকার মালিক বা কর্মীদের জানা নেই। আজকের কাগজের ভাঙ্গন আমাকে কষ্ট দিল। ভেঙ্গে একাংশ বেরিয়ে যাবার পর পত্রিকার মান ধপ করে নীচে নেমে গেল। এতে বোঝা যায় পত্রিকা মেশিনে ছাপা হলেও এর প্রধান কারিগর পেছনের মানুষগুলো। নতুন সম্পাদক আগের 'আজকের কাগজ' ফিরিয়ে আনতে পারলো না। আজকের কাগজ আমার নজর হারালো। পত্রিকা রাখা ক্ষান্ত দিলাম। কদিন পর ভোরের কাগজের খবর পেলাম। সম্পাদকীয় লাইন, ছাপা আর লেখা দেখে মনে হলো এটা আজকের কাগজের বিকল্প হতে যাচ্ছে। আমি ভোরের কাগজের গ্রাহক হলাম। একসময় ভোরের কাগজও ভেঙ্গে গেল। আবারও হতাশা। ভোরের কাগজের মান পড়ে গেছে। পত্রিকা নেয়া বন্ধ করলাম আবার।

খবর পেলাম প্রথম আলো আসছে। প্রথম সংখ্যাটা হাতে নিয়ে বেশ পছন্দ হলো। ভোরের কাগজের সাদাকালো নীতি বাদ দিয়ে রঙিন পত্রিকা। খোঁজ নিয়ে জানলাম এখানে সেই কারিগরেরা আছে যাদের আমি গত দশ পনের বছর ধরে অনুসরন করে আসছি নানান পত্রিকার মাধ্যমে। সেই অদেখা মানুষগুলো। প্রথম আলোর বিমুগ্ধ পাঠক ছিলাম অনেকদিন। তারপর আরো অনেক পত্রিকা এলো বাজারে। সমকাল ছাড়া অন্যগুলো তেমন টানতে পারেনি।

এক সময় আবিস্কার করলাম সবগুলো পত্রিকা কোন না কোন ব্যবসায়ীক গোষ্টীর প্রতিনিধিত্ব করছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রায় উঠে গেছে। আবারও আশাভঙ্গ। এবার পত্রিকার ভাঙ্গন নয়, কিন্তু পত্রিকার ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তি, বিশেষ গোষ্টীপ্রীতি, স্বার্থকলুষ সম্পাদকীয় নীতির কারনেই হতাশা হলাম। সাদাচোখে যতটুকু ধরা পড়ে আর কি। আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম পত্রিকার প্রতি। আর কোন পত্রিকা টানতে পারে না আমাকে। পত্রিকা পড়ার নিয়মিত অভ্যেস চলে যাওয়া শুরু করেছে। দৈনিক তিনটা পত্রিকা রাখা হলেও একটাও ভাল করে পড়া হয় না। শুধু অভ্যেসবশতঃ রাখা।

পত্রিকার জগত থেকে দুরে সরে এসে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে পড়ি। স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করি। পত্রিকাপাঠক আমি হয়ে যায় ইন্টারনেট পাঠক। দৈনিক অন্ততঃ আটঘন্টা ইন্টারনেটে থাকা হয়। পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশী পড়া হয় ব্লগ। পত্রিকার স্থান অনেকাংশে দখল করে নেয় ব্লগ। মাঝে মাঝে এখানেও ভাঙ্গন দেখি। কিন্তু এই ভাঙ্গন থেকে চোখ সরিয়ে রাখার সহজ উপায়ও আছে। অন্তর্জালে আছে শত কোটি বিকল্প তথ্যভান্ডার। এক জায়গা ভালো না লাগলে অন্য জায়গায় চলে যাই। একেকটি ওয়েবসাইট একেকটা জগত। ডুব দিয়ে পুরো দিন হারিয়ে যেতে পারি ওই জগতে। এই স্বাধীনতা আমি উপভোগ করি। এই স্বাধীনতা আমার অধিকার।

ন কবিতা

আমি তোমাকে প্রায় ভুলেই যাচ্ছি।
মাত্র কবছর
আমি কী বদলেই না গেছি!
বদলাইছি তো
লগ ইন করে প্রতিটা সকাল তোমাকে খুঁজতাম
অফলাইন মেসেজগুলো গোগ্রাসে গিলতাম
তোমার আইকনটা কখন বোল্ড হবে সেই আশায় ইয়াহু পর্দায় তাকিয়ে থাকতাম
তুমি লগ ইন না করা পর্যন্ত আমার অফিস মেইল বক্সের সবগুলো চিঠি অপঠিত থেকে যেতো।

তুমি আজ আসবে তো!

নাকি তোমার লাইনে ট্রাফিক গণ্ডগোল অথবা বিদ্যুত বিপর্যয়?
আমাকে খুব অধৈর্য করে দিত।

আমি হটমেইলে লগইন করে আবারো তোমাকে খুঁজতাম


যদিও জানি তুমি এখন হটমেইলে আসো না কারন ওখানে অফলাইন মেসেজ দেয়া যায় না।
তুমি আমি আমরা দুজনে হটমেইলকে কী ঘেন্নাই করতাম আমাদের অফলাইন ভালোবাসা বহন করতো না বলে।

এমনকি আমি মাইক্রোসফটের এর সবগুলো পন্যকে বর্জন করা শুরু করি
হটমেইলেই
অথচ হটমেইলেই আমাদের প্রথম শব্দ বিনিময়।
কী অকৃতজ্ঞ আর স্বার্থপর আমি তাই না?
তোমাকে পাবার জন্য জন্য সর্বশক্তিমানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতাম আমি।
তোমার আমার মাঝখানে দাঁড়ানো যে কোন বাধাকে আমি ঘৃনা করতাম,

সেই আমি কী বদলেই না গেছি!
মাত্র ক বছর
আমি তোমাকে প্রায় ভুলেই যাচ্ছি।
ভুলেই গেছি

Sunday, May 10, 2009

ন কবিতা

তোমাকে পাবার দুঃসাহস ছিল না বলে হাত বাড়াইনি। তুমি তো আমার হলে না, তবু আমি আর কারো হয়ে যাইনি।
.
সাঁঝ বিকেলে তুমি যেদিন উড়াল দিলে, বিদায় বেলায় অনুপস্থিত আমি। ভেবেছো ব্যস্ত আমি, কি যে বলো, এড়িয়ে গেছি সন্তর্পনে।
.
তুমি আমার কৈশোরের, তুমি আমার যৌবনেরও। তুমি আমার নাই বা হলে, না হয় এই প্রৌঢ়ত্বে ।
.
আমি তোমার প্রতীক্ষায়ও নেই, নেই অপেক্ষায়ও। তুমিতো আমার আগের মতোই আছো আমার অস্তিত্বে।

ন কবিতা

তুমি না এলে কী এমন ক্ষতি হতো?
.
এসেই জাগিয়ে দিলে অযুত নিযুত দিবারাত্রির হাহাকার। যে হাহাকার লুকিয়ে রেখেই বেঁচে ছিলাম। অন্য কোন সবুজ পৃথিবীর আশ্বাস ছিল না, তবু তোমাকে ছাড়াও চলতো আমার।
.
তুমি আসলে, পাশে বসলে, আমার দুচোখের ভেতরে তোমার দুচোখ ডোবালে। আমার অবাধ্য মন সাঁতার দিল অগম্য সাগরে। আজন্ম সাধ তোমাকে ছুঁয়ে দেখার, তবু সসংকোচ হাতটা বাড়িয়েও পিছিয়ে গেলাম।
.
গোটানো হাত পাখা মেলার আগেই তুমি উঠে গেলে। বললে, 'যাই।' নিরুপায় আমি বললাম, 'যাও'। অনুচ্চারিত থাকলো ''আরেকটু থাকো, আর কয়েকটা মিনিট, আমি তোমাকে একটু ছুঁতে চাই।"
.
তুমি চলে গেলে। এত অল্প সময়, পলকের আগেই ফুরোলো বেলা।
.
'তুমি এসেছিলে', এটা যেন নিছক একটা দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনা না ঘটলে কী এমন অতলান্তিক ক্ষতি হয়ে যেতো এই জগতের?

পঁচা কাদায় আটকে পড়া একজন

অফিসের গেট থেকে সিকিউরিটি ফোন করে জানালো জামান নামের একজন আমার সাথে দেখা করতে চায়।

জামান। আমি দুই সেকেন্ড চুপ থাকলাম নামটা শুনে। বিরক্ত হবো কিনা ভাবছি। দুই সেকেন্ডে আমার মস্তিস্কের কোষগুলো যেন কয়েকশতবার স্মৃতিভ্রমন করে এলো। ওকে অফিসে আসতে দেয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। বললাম- আমি আসছি।

জামান একটা জীবন্ত উপন্যাসের ট্র্যাজিক হিরো কিংবা ভিলেনের নাম। ঔপন্যাসিকের চোখে সে হিরো নিঃসন্দেহে, কিন্তু সমাজের চোখে সে ভিলেন অপয়া দুষ্টলোক। কোন কোন মানুষের জীবন চটকদার উপন্যাসের চেয়েও বিস্ময়কর, জামান তাদের একজন। জামানকে নিয়ে কখনো লিখতে হবে ভাবিনি। জামানের জীবনটা সুস্থ স্বাভাবিক থাকলে কখনো লিখতে হতো না। অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম ওকে নিয়ে লিখবো। এরকম একটা ঘটনাকে পাঠক আজগুবি চাপাবাজি বলে উড়িয়ে দেবে বলে সাহস করিনি। কিন্তু সেদিন জামানের সাথে আবারো কথা বলে ইচ্ছে হলো লিখেই ফেলি।

ক্লাস নাইনে পড়ার সময় জামানের সাথে পরিচয়। আমি একজন ঘোর আড্ডাবাজ। ক্লাস নাইন থেকেই শুরু। জামানের হাত ধরেই। আড্ডার মধ্যমনি বলে একটা বস্তু থাকলে জামান ছিল তার চেয়েও বেশী। জামানের সাথে আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের হলেও সে যেন নক্ষত্র, আমরা গ্রহ। অথবা সে যদি গ্রহ হয়, আমরা উপগ্রহ। জামানকে প্রদক্ষিন করেই আমাদের যত আড্ডা। সেই আড্ডা হতে পারে সকাল ছটায়, কিংবা রাত বারোটায়। জামান থাকলে আড্ডা জমবে। সে প্রচুর কথা বলতো, প্রচুর জানতো। আমরাও বলতাম, কিন্তু জামানের মতো কেউ পারতো না। ওর কথা শোনার জন্যই আমরা ওকে ঘিরে থাকতাম। জামানের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু কে সেটা নিয়ে একট গোপন ঈর্ষা ছিল বন্ধুদের মধ্যে। জামান আমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। যখনই হোটেলে খাওয়াদাওয়া হতো, জামান বিল দেবে এটা ধরে রাখা যায়। আমার খুব ইচ্ছে হতো জামানকে একবার খাওয়াই, কিন্তু সুযোগ পেতাম না। সমস্ত স্কুল কলেজ ভার্সিটি জীবনে মাত্র বার তিনেক বোধ হয় ওকে খাওয়াতে পেরেছি।

জামানের মনটা ছিল খোলা আকাশ। সেই আকাশে আমরা খেলতাম, হাসতাম গড়াগড়ি দিতাম। জামান যেভাবে চাইতো আমরা সেইভাবে করতাম। জামানের মন পাওয়া আমাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। এটাকে কী সম্মোহনী ক্ষমতা বলে? জামান যে গান গাইতো, আমরা সেই গান নকল করতাম। জামান যে সিনেমা দেখবে, সেই সিনেমা অবশ্যই আমাদের প্রিয় হবে। জামানের কতগুলি মজার দর্শন ছিল, আমরা সেগুলোকে ভালোবাসতাম। জামান কোন মেয়েকে পছন্দ করলে সেই মেয়েকে রাজী করাবার জন্য আমরা স্বর্গ পেড়ে দিতে চাইতাম। অদ্ভুত ভক্তি ছিল আমাদের।

জামানের পোষাক আশাক ছিল মার্জিত ও আধুনিকতার উত্তম সমন্বয়। আমরা কেউ জামানের সমকক্ষ হবার কথা ভাবতেও পারতাম না। জামানের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কোন শত্রু ছিল না। দুষ্টলোকেরা জামানকে ভয় পেত। অপ্রিয় সত্য বলতে জামান অকপট ছিল। জামানের বহুমুখী গুন ছিল। সে একাধারে সুপুরুষ সুগায়ক বাকপটু আবার অন্যদিকে শক্তিমান কৌশলী। খালি হাতে আত্মরক্ষা বিদ্যায় কালো বেল্টধারী। পুরো শহরে জামানের চেয়ে শক্তিমান লোক পাওয়া দুষ্কর ছিল। জামান চাইলে বাংলাদেশের সেরা একজন হতে পারতো।

কিন্তু জামান সেরকম হলো না কিংবা হতে চাইলো না। জামান চলতে শুরু করলো ভিন্ন পথে। ঠিক কখন ভিন্নপথে যাওয়া শুরু করেছে আমি জানতাম না। তবে আমি ও কয়েক বন্ধু শিক্ষাজীবনের শেষদিকে অন্য এলাকায় চলে যাই বাসা বদল করে। ফলে আড্ডায় যাওয়া হতো না নিয়মিত। আড্ডার মানুষগুলো বদলে যেতে থাকে। গ্রহ ঠিক থাকলেও উপগ্রহগুলো বদল হয়। সম্ভবতঃ এখান থেকেই সমস্যার সুত্রপাত।

আর চাকরীতে ঢোকার পর জামানের সাথে আমার দেখা সাক্ষাত প্রায় বন্ধ। বন্ধুদের মাধ্যমে মাঝে মাঝে খোঁজ পেতাম ওর। শুনতাম জামান এখন জুনিয়র ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয়। যে সব ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয় তারা জুনিয়র হলেও জগতে আমাদের সাথে অনেক অগ্রসর। আমাদের আড্ডার অন্যতম একটা উপাদান ছিল সিগারেট। কিন্তু নতুন আড্ডায় নাকি গাঁজা, ট্যাবলেট, ডাইলের আগমন ঘটেছে। নতুন উপগ্রহরা গ্রাস করে নিয়েছে গ্রহকে সেসব দিয়ে। এগুলো দেখে আমাদের অবশিষ্ট বন্ধুরা ওসব আড্ডা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল। জামান এখন শুধু নতুন উপগ্রহদের নিয়ে আছে।

বন্ধুরা আফসোস করতো দুর থেকে। জামান নষ্ট পথে চলে যাচ্ছে। ওকে ফেরানো দরকার। আমাকে মাঝে মাঝে বলা হয়। আমি বললে নাকি শুনবে, ওর বাবা-মারও তাই ধারনা। আমি ওর সাথে আড্ডা দেয়া শুরু করলে আবার ফেরানো যাবে ওকে। কিন্তু আমার তখন পেশাদারী ব্যস্ততা। একজন বন্ধুর মঙ্গলের জন্য নিজের সময় নষ্ট করতে চাইলাম না। তাছাড়া সে তো যথেষ্ট বুঝদার, নিজেই ফিরে আসবে এক সময়।

ফিরে আসেনি সে। নেশার জগতের পাশাপাশি বিচরন শুরু হলো অন্ধগলিতে। শুধু বিচরন করলেই হতো। একদিন কাদায় পা আটকে গেল তার। আর বেরুতে পারলো না। কানাগলির একটা মেয়ের ঘরে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। একদিন মেয়েটা বোমা ফাটালো। জানালো সে গর্ভবতী এবং তার সন্তানের বাবা হলো জামান। জামান পালিয়ে আসতে পারতো, কিন্তু আসেনি। কেন আসেনি সেটাই একটা বিরাট বিস্ময় এবং অন্য সকল মানুষ থেকে জামানকে আলাদা করে। অন্য যে কেউ হলে ঠিকই পালিয়ে আসতো। কিন্তু জামান আসেনি। সে বিয়ে করে ফেললো সেই কানাগলির কুৎসিত মেয়েটিকে। পরিবারের মুখে চুনকালি দিয়ে তার বিলাসী জীবন ছেড়ে বস্তিতে উঠলো।

জামানের এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা আমি খুজে পাই না। যে মানুষ এরকম নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, মাগীবাজী করে, সে কী করে এতটা মহৎ হয়। আমি জামানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন? জামান যে কথাটা বললো তাতে আমার হা আরো বড় হয়। বিয়ের পর সে জানতে পেরেছিল মেয়েটার সিফিলিস হয়েছে। তিনমাস হাসপাতালে সেবা করতে করতে সুস্থ করে তুলেছিল মেয়েটাকে। সন্তান প্রসব করার পর মেয়েটা তাকে নিয়ে মেয়ের গ্রামে চলে যায়। সেখানে মেয়েটার বাবা-মা থাকে।

গ্রামে গিয়ে আরেক জীবন তার। শ্বশুর লবনচাষী, সেও লবনচাষে যুক্ত হয়। বছরের পর বছর লবনচাষ করে জামান। লবনচাষেও একসময় ধরা খায়। ফিরে আসে শহরে। তখন তাদের দুটি সন্তান। এবার বউকে গার্মেন্টসে কাজ দেয়। নিজে চাকরীর চেষ্টা করে। অভাবে অনটনের জ্বালায় জামান একবার নিজের বাসায় গেলে তাকে প্রস্তাব দেয়া হয় সে যদি মেয়েটাকে ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে আমেরিকা কানাডা পাঠিয়ে দেবে। অনেক টাকা পয়সার লোভ দেখানো হয়। জামানের বাবার অগাধ টাকা পয়সা। কিন্তু জামান রাজী হয় না। সবকিছু করতে পারে, কিন্তু মেয়েটাকে সন্তানদের ত্যাগ করতে রাজী হয় না। আপোষ না করে ফিরে যায় অভাবের কুটিরে। আবারো যুদ্ধ শুরু। এই যুদ্ধের সময়ই সে একদিন আমার ঠিকানা নিয়ে অফিসে আসে। তখনই প্রথমবারের মতো তার কাহিনীগুলো জানতে পারি। প্রথমে আমি ওকে দেখে চিনতে পারিনা। মুখ ভর্তি দাড়িগোফ। বয়স যেন আমার চেয়ে দশ বছর বেড়ে গেছে।

সেদিনই আমার জানার শুরু তার নতুন অধ্যায়। খুব সংকোচে যতটা সম্ভব বলে আমাকে। তারপর বলে খুব অভাব। চাকরী দরকার। তার আগে দরকার কিছু নগদ। ঘরে চাল কেনার টাকাও নেই। বাচ্চারা অনাহারে। আমার এত কষ্ট লাগলো। চোখ জ্বালা করতে লাগলো। সেই জামানের এ কী দশা আজ। মানুষের জীবন এত বিচিত্র কেন? আমি পকেট থেকে হাজার খানেক টাকা বের করে দিলাম। সে বললো, টাকার জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু এ টাকা হয়তো ফেরত দিতে পারবো না। মাফ করে দিস। আমি বললাম, লাগবে না। পরে আরো লাগলে আসিস।

সেই শুরু। জামান আমার কাছে আসতে লাগলো মাঝে মাঝে। আমি একবার দুবার তিনবার যতটা সাধ্যে কুলায় দিতে থাকি। একসময় আমিও হাঁপিয়ে উঠি। বিরক্ত হতে থাকি। একবার স্পষ্টই বলে দেই- টাকা নেই। একশো টাকাও দিতে পারবো না। তবু সে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে বিদায় হয়। তারপর বহুদিন যোগাযোগ নেই আর। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।

তিন বছর পর আজকে আবার এলো। কি জন্য এসেছে? টাকার জন্য তো বটেই। নীচে নামতে নামতে ভাবলাম। নীচে নেমে বললাম, আয় গাড়ীতে ওঠ। অফিস থেকে কিছুদুর গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নামলাম। আমি কাটাকাটা সুরে বললাম-

-বল কি জন্য এসেছিস?
-তোকে দেখতে
-আসল কথা বল
-কিছু টাকা দে
-কত?
-হাজার দুই হলে চলবে
-এক হাজার আছে, নে
-এক হাজারে হবে না। পরে দিলেও চলবে, তবে দুই হাজার লাগবে।
-কী করবি?
-তোর কাছ থেকে শেষবার যাবার পর একটা চাকরীর দরখাস্ত করি। একটা কোম্পানীর সিকিউরিটি গার্ড। আমার যে বয়স অন্য চাকরী পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু গার্ডের চাকরীতে এসএসসি পাশ দরকার। একজন বললো বিএ এমএ বললে প্রাথমিক যাচাইতেই বাদ পড়বো। তাই মিথ্যে বলে মেট্রিক পাশ বলে চাকরীটা বাগালাম। বেতন খারাপ না, সব মিলিয়ে পাঁচ ছহাজার পাই। পার্মানেন্ট হয়েছে গত বছর। এবার একটা প্রমোশনের সুযোগ এসেছে। বিএ পাশ হলে প্রমোশন মেলে। ইন্সপেক্টর পদে। এখন সবাই জানে আমি বিএ পাশ। তবে অফিসে ফাইল নাড়ার জন্য কেরানীদের কিছু টাকা দিতে হয়, এ সপ্তাহেই দিতে হবে। আমার কাছে অত নাই। তাই তোর কাছে আসা।
-বাবার বাসায় যাস না?
-না, এখানে কেউ নেই এখন। বাবা রিটায়ার করার পর ঢাকা চলে গেছে। বাসা ছেড়ে দিয়েছে। আর কারো সাথে সম্পর্ক নেই।
-ও আচ্ছা
-তুই বিরক্ত হচ্ছিস জানি। কিন্তু আমার তো উপায় নেই। তুই ছাড়া আর কারো কাছে আমি যাই না।
-না, আসলে বিরক্ত না। আগে তুই নিজে কিছু করতি না বলে বিরক্ত হতাম। এখন একটা চাকরী করিস আমি এতেই খুশী। তোকে আমি টাকাটা কালকে দেবো।
-ঠিক আছে, আমি কাল আসবো।

জামান চলে গেল। আমি ভাবতে বসলাম মানুষের জীবনের অলিগলি নিয়ে। জামানের প্রতি আমার দায়িত্ববোধের অভাবটাও আমাকে পীড়া দেয়। আমি ওর জন্য কিছু করতে চাই। কিন্তু কী করবো বুঝতে পারছি না। কিছু করতে গেলে যদি উৎপাত বেড়ে যায়, সেজন্য বেশী কিছু করি না। যতটুকু করছি তা করাটা খুব সহজ হলেও ভান করতে হচ্ছে যেন আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। যাতে জামান আমাকে ঘন ঘন বিরক্ত না করে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমি এখনো বুঝতে পারছি ওকে এখনো কতটা ভালোবাসি। যদি ওকে আরেকটু ভালো জীবন উপহার দিতে পারতাম! কেউ কি পারে? হাতের সীমানার বাইরে চলে যায় কত কিছু!