Tuesday, September 19, 2023

চট্টগ্রামের প্রাচীনতম মানচিত্র

চট্টগ্রামে মোগল স্থাপত্য খুব বেশি নেই কেন? প্রশ্নটা প্রায়ই মাথায় আসে। সাথে সাথে উত্তরটাও ভাবি। চট্টগ্রামে মোগল শাসন মাত্র ৯৫ বছরের। বৃটিশদের হাতে আসার আগে চট্টগ্রাম অঞ্চল কারো হাতেই বেশিদিন ছিল না। মোগল শাসনের আগে আরাকানী শাসনে ছিল ৮০ বছর। তার আগের কয়েকশো বছর বাংলা- আরাকান- ত্রিপুরার মধ্যে কাড়াকাড়িতে কেটেছে। শান্তিতে কেউ শাসন করতে পারেনি চট্টগ্রাম। একটা যুদ্ধ বিবাদের বাফার জোন হিসেবে চট্টগ্রামের অস্তিত্ব কোনমতে টিকে ছিল। হরিকেল রাজত্বেও সেই বিবাদ জারি ছিল।  ১৬৬৬ সালে মোগল অধিকারে যাবার পর থেকে চট্টগ্রাম স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছেছিল। মোগল শাসন কখন বৃটিশ শাসনে রূপান্তরিত হচ্ছিল তখন চট্টগ্রামবাসী টেরই পায়নি। কোন যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়া একেবারে শান্তিপূর্ণভাবে চট্টগ্রাম বৃটিশ শাসনে প্রবেশ করেছিল ১৭৬১ সালের জানুয়ারী মাসে। 


কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, চট্টগ্রাম বৃটিশ অধিকারে যাবার অনেক আগ থেকেই বৃটিশদের নজর ছিল এদিকে। ১৬৮৬-৮৮ সালে চট্টগ্রাম দখল করতে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালে কোন একটা সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বৃটিশরা চট্টগ্রামের উপকূল জরিপ করতে শুরু করেছিল মোগল শাসনামলেই। 


১৭৩০ দশকের পর থেকে মোগল সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারটা বৃটিশরা খুব ভাল করে বুঝতে পেরেছিল। মুর্শিদকুলী খানের আমল থেকে  দিল্লীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল বাংলা। নাদের শাহের দিল্লী আক্রমণ কিংবা মারাঠা আক্রমণের পর থেকে মোগল সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম তো মোগল শাসন কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। চট্টগ্রামের ওপর বাংলার নিয়ন্ত্রণ থাকলেও সেটাও অনেকটা শিথিল। 


সেই অবস্থাতে ইংরেজ জাহাজগুলো চট্টগ্রাম অঞ্চল জরিপ করতে শুরু করে। প্রথম দুটো প্রমাণ পাওয়া যায় ১৭৩৯-৪০ সালে তৈরি করা জেরেমিয়াহ আর র‍্যানসনের মানচিত্র থেকে। স্পেনের জাতীয় আর্কাইভ থেকে সম্প্রতি সেই মানচিত্র দুটো হাতে এসেছে।


আরো বিশ বছর পর যখন বৃটিশরা বাংলা দখল করে তখন  সেই মানচিত্রগুলো সাথে নিয়ে চট্টগ্রামে এসেছিলেন হ্যারি ভেরেলস্ট। এটা নিশ্চিত যতগুলো মানচিত্র তৈরি হয়েছিল তার অল্প কয়েকটি মাত্র টিকে আছে পৃথিবীর নানান জাদুঘরে। এখনো সবগুলো মানচিত্র আবিষ্কার করা হয়নি। এ পর্যন্ত সবচেয়ে পুরোনো মানচিত্রটি ১৭৩৯ সালে আঁকা।


Saturday, September 9, 2023

ঘটমান বর্তমান

ঠগবাজ

কেউ আপনাকে ঠকাচ্ছে জানলে আপনার খুব খারাপ লাগে। কিন্তু জানার পর যদি আপনি তাকে ঠকাবার সুযোগ দেন, তাহলে আপনি তাকে খেলাচ্ছেন। ঠগবাজকে খেলাতে পারলে আপনার ঠকার মূল্য কিছুটা উঠে যেতে পারে।


নির্ঘুম দিনলিপি

(৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ : রাত ২.৪৪ মিনিট) 

১. দিন তারিখের কোন রুটিন নেই। যখন যা ঘটার তখন সেটা ঘটেই যাবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না।

২. তেল চিনি পেঁয়াজ নুন আনাজ তরকারির পাশাপাশি বিল, ট্যাক্স, পাওনাদার, নির্বাচন, পরিবেশ দুষণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভেজাল, চোর ডাকাত বদমাশ দুর্ঘটনা সবকিছুর বেড়াজাল থেকে মুক্তি। স্বস্তি। 

৩. বাইরে হঠাৎ গোলাগুলি। নাকি বিয়ের বাজি। রাত পৌনে তিনটার সময় কিসের এত শব্দ?

......................................................


সময়-অসময়

অধিকাংশ মানুষ জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টাকে উপভোগ করতে পারে না। সময়টা যে সুন্দর ছিল তা বুঝতে পারে সেটা অতীতকাল হয়ে যাবার পর। অতীতকাল উপভোগ করা যায় না। কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলা যায়। মানুষ আসলে একদিনই বাঁচে। গতকালও না, আগামীকালও না। মানুষ বাঁচে শুধু আজকে।

ইলন মাস্কের সাথে গনি মিয়ার পার্থক্য কতটুকু? ইলন মাস্ক দুশো বিলিয়ন ডলারের মালিক। গনিমিয়া দুটো গরুর মালিক। আগে একটা গরু ছিল। কিছুদিন আগে জমানো ৪ হাজার টাকা দিয়ে একটা বাছুর কিনে আনলো পাশের গ্রামের কুদ্দুসের কাছ থেকে। আগামী বছর বাছুরটা একটু বড় হলে কমপক্ষে  ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারবে কল্পনা করে সে খুব আনন্দিত। বাড়ি ফিরে আলু ভর্তার সাথে একটা বাড়তি ডিম ভাজি খেয়ে ভরপেট ঘুম দিল।  

গনি মিয়া যেদিন ৪ হাজার টাকার বাছুরটা কিনলো, সেদিন ইলন মাস্ক ৪৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে টুইটার কিনলো। টুইটার কিনে ইলন মাস্কও খুব আনন্দিত। কয়েক মাসের মধ্যে টুইটারের শেয়ার আরো ১৪ বিলিয়ন ডলার বেড়ে যাবে সেই আনন্দে বান্ধবীকে নিয়ে নয় তারকা হোটেলে ডিনার সেরে ঘুমাতে গেল।

এখন গনি মিয়া এবং ইলন মাস্কের মধ্যে কার আনন্দ বেশি? ৪৪ বিলিয়ন বিনিয়োগ করে ইলন মাস্ক যে পরিমাণ আনন্দ পেয়েছে, ৪ হাজার টাকায় বাছুর কিনে গনি মিয়া তার চেয়ে কম আনন্দ পেয়েছে? 

মানুষের শরীরের যে রসায়ন তাতে জীবনকে উপভোগ করার জন্য কম টাকা এবং বেশি টাকার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। টাকার পরিমান অনেক কম হলেও মাঝে মাঝে গনি মিয়া ইলন মাস্কের চেয়ে বেশি সুখী হতে পারে। জীবনকে উপভোগ করার ক্ষেত্রে অর্থ সম্পদের ভূমিকা থাকলেও সেটাই একমাত্র অনুঘটক নয়।


দশ বছর পর

ঠিক এই সময় থেকে দশ বছর আগে এবং দশ বছর পরের অবস্থা তুলনা করতে গেলে যে কল্পনা এসে দাঁড়ায় সেটা সুখকর নয়। ২০১৩ সাল ছিল আমার জীবনের সমৃদ্ধ বছর। বেঁচে থাকলে ২০৩৩ সাল খুব সংকটময় বছর হতে পারে। কারণ তখন কোন আয়ের উৎস থাকবে না। সংসার চালাতে শেষ সম্বল বিক্রি করার অবস্থা দাঁড়াতে পারে। গত দশ বছরে তেমন কোন সংকট হয়নি। বয়স ছিল, শক্তি ছিল, আয় ছিল, সুস্থতা ছিল। আগামী দশ বছর পর এসবের কিছুই থাকবে না। যদি আমার পুত্র ততদিনে নিজের পায়ে দাঁড়াবার উপযুক্ত না হয়, তাহলে আমাদের সমূহ সংকট।

অতদিন টিকে থাকাটা সম্ভব নাও হতে পারে। আমার হয়তো জানাও হবে না পরিবার কেমন আছে। আমার কিশোর পুত্রটি তখন যুবকে পরিণত হয়ে কোন সংকটের মুখোমুখি দাঁড়াবে, সেটা ভেবে আমি খুব দুশ্চিন্তায় ভুগি। আমার বাবা যে বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সে বয়সেও আমি নিজের পায়ে দাঁড়াইনি। তবু আমার পুত্রের চেয়ে আমি অনেক সাহসী ছিলাম। পুরো পরিবারকে আকড়ে ধরে রাখতে পেরেছিলাম। আমার ছেলেটা কী পারবে?

Thursday, September 7, 2023

কর্ণফুলী নদীর ঐতিহাসিক বিবর্তন বনাম চট্টগ্রাম শহরের বন্যা


রাস্তা যখন খাল: 

চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাগুলো খাল হয়ে গেছে। কোন কোন এলাকা নদী হয়ে গেছে। মানুষের জন্য এটা ভয়ানক একটা দুর্গতি হলেও বন্যার পানির জন্য এটাই স্বাভাবিক। আমাদের শহরগুলো এমনভাবে গড়ে ওঠে যেখানে পানির জন্য কোন রাস্তা রাখা হয় না। আমরা ছোট ছোট নালা নর্দমাগুলো বানাই নিজেদের বাথরুমের পানি নিষ্কাষণের জন্য এবং আশা করি বৃষ্টির পানিও আমাদের নির্দেশ মেনে সেই নালাগুলো দিয়ে নিজেদের পথ বের করে নেবে। কিন্তু যখন ভারী বৃষ্টি হয় তখন পানির পক্ষে মানুষের তৈরি করা সেই নালাগুলো দিয়ে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে তখন মানুষের তৈরি করা রাস্তাগুলোকে খাল বানিয়ে তাকে নদীর দিকে ছুটতে হয়। সে কারণে রাস্তাগুলো খাল হয়ে যায় অতিবৃষ্টিতে।

চট্টগ্রাম শহর বন্যাপ্রবণ ছিল না সত্তর আশি দশকেও। ২০০০ সালের পর পর থেকে শহরে যে বন্যা দেখা দেয় তার প্রধান কারণ আবাসন প্রকল্পগুলো। শহরের নতুন নতুন জায়গাগুলো আবাসিক দালানে ভরপুর হতে শুরু করে। আবাসিক এলাকা মানে অনেকগুলো বাড়ি, আর বাড়ি মানেই অনেকগুলো সীমানা দেয়াল। পুরো শহর জুড়ে লক্ষ লক্ষ বাড়ির সীমানা দেয়াল পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে থামিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টি আগেও হতো, এখনো হয়। বরং আগের যুগের তুলনায় এখন অনেক কম বৃষ্টি হয়। তবু আমরা বন্যায় ভেসে যাচ্ছি আর দোষারোপ করছি গ্লোবাল ওয়ার্মিং, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বায়বীয় সব কারণকে। নিজেদের সৃষ্ট সমস্যাগুলোর দিকে আমরা মোটেও দোষ দিচ্ছি না।

এখন শহর জুড়ে সম্পন্ন লোকেরা যেসব বাড়ি তৈরি করে, সেগুলো একেকটা দুর্গ। সেরকম হাজার হাজার দুর্গ শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। আমরা আবাসিক এলাকা তৈরির সময় কখনো ভাবি না অতিবৃষ্টিতে কোন পথ দিয়ে পানিগুলো নদীতে যাবে। সিডিএ থেকে পাশ করানো প্ল্যানের মধ্যে প্রতিটা বাড়ির চার দিকে যে খালি জায়গা রাখার কথা বলা হয়েছে সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানা হয় না। আর মানা হলেও সীমানা দেয়ালের ব্যাপারে সিডিএর কোন নির্দেশনা না থাকাতে সবাই পাশের বাড়ির সাথে লাগিয়ে নিজের সীমানা দেয়াল তৈরি করেন। এটাই আমাদের স্বাভাবিক রীতি। কিন্তু এটা করতে গিয়ে আমরা শহর জুড়ে অনেকগুলো বিশাল বাঁধ তৈরি করে ফেলেছি।

আমি শুধু ছোট্ট একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। ১৯৮৭ সালে আমরা যখন ভবিষ্যত আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের পাশে ছোট্ট বাড়িটাতে উঠি, তখন চারপাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত ছাড়া আর কোন বাড়িঘর ছিল না। দক্ষিণ আর পুর্ব দিকে কয়েকশোগজ দূরে স্থানীয় ঘরবাড়িগুলো ছিল। পশ্চিম দিকে হালিশহর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। উত্তরদিকেও একই অবস্থা। এই পুরো এলাকা জুড়ে আমাদের মতো ছড়ানো ছিটানো কয়েকটি বাড়ি ছিল শুধু। দিনের পর দিন প্রবলবর্ষণ হলেও কোনদিন আমাদের উঠোনে এক ইঞ্চি পানি ওঠেনি। সেই বাড়িতে ২০০৭ সালে এসে যখন আমরা প্রথমবার বন্যায় ভাসি, তখন খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ৯১ সালের জলোচ্ছ্বাসেও আমাদের ঘরে এক ফুট পানি হয়নি, ২০০৭ সালে এক কোমরের চেয়ে বেশি পানি। কারণ পুরো এলাকায় গড়ে ওঠা শত শত বাড়ির কারণে পানিটা বাধা পেয়ে শান্তিবাগের পাশের খালে পৌঁছাতে পারছে না। যে খালটা মহেশখালের প্রধান শাখা। সেই থেকে ওই এলাকায় শুরু হওয়া বন্যার তাণ্ডব এখনো কমেনি, হাজার কোটি টাকা দিয়ে রাস্তা দশ ফুট উঁচু করার পরও কোন লাভ হয়নি।

নতুন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলেও এই সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হবে বলে মনে হয় না। যে রাস্তাগুলো উঁচু করা হয়েছে, তাতে পাশের আবাসিক এলাকাগুলো নীচু হয়ে আরো জলমগ্ন হচ্ছে। তার চেয়ে অনেকগুলো খাল কেটে শহরের পানি নদীতে যাবার পথ করে দিতে পারলে কিছুটা রক্ষা হতে পারে। নইলে প্রতি বছর বন্যার পানি রাস্তাগুলোকে খাল বানিয়ে নিজের পথ করে নেবে।

পুনশ্চ:১- দয়া করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কথা বলবেন না। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এ পাঁচ ইঞ্চি পানি বাড়লেও মালদ্বীপসহ পৃথিবীর অনেক দেশ নেই হয়ে যাবে। আগ্রাবাদ বাকলিয়া যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে ডুবে থাকতো তাহলে, আমাদের সেন্টমার্টিন এতদিনে পাঁচফুট পানির নীচে থাকার কথা। কিন্তু সেন্টমার্টিনে সমুদ্রের উচ্চতা এক ফুটও বাড়েনি।

পুনশ্চ:২- কর্নফুলী নদীর ঐতিহাসিক ভৌগলিক বিবর্তন নিয়ে এই শহরের কর্তারা যদি কাজ করতেন তাহলে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা সহজ হতো। কর্নফুলী নদীর বুক থেকে এই শহরের অধিকাংশ এলাকার জন্ম। সেই ইতিহাস পুরোপুরি না জেনে যে কোন প্রকল্প বাস্তবায়নে সফলতার সম্ভাবনা কম। স্পেনের জাতীয় আর্কাইভ থেকে সম্প্রতি আমি কর্নফুলী নদীর ১৭৬৪ সালের যে মানচিত্র খুঁজে পেয়েছি, সেটা রীতিমত চমকে ওঠার মতো। ওটা নিয়ে কিছু পড়াশোনা করছি, শেষ করার পর কিছু তথ্য প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে।
[ফেসবুক পোস্ট থেকে]

+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

আগ্রাবাদ এক্সেস রোড এবং মহেশখালের ইতিহাস

ফেসবুকে পোস্ট দেবার পর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ছোটখাট একটা পর্যবেক্ষণ দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিয়ে। ইতিহাসের তথ্য দিয়ে পুরো বিষয়টা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করলাম। সেই ব্যাখ্যা সবার কাছে গ্রহনযোগ্য নাও হতে পারে। তবু ব্যাপারটা যেহেতু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া, সেটার সাথে আরো অনেকের মতামত মিলতে পারে। বিশেষ করে যারা আগ্রাবাদের বাসিন্দা। যারা এই সমস্যার ভুক্তভোগী।

এই আলোচনার মধ্যে প্রধানত আগ্রাবাদ এক্সেস রোড ও মহেশখালের উদাহরণ দিয়ে পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আগ্রাবাদ এক্সেস রোড দিয়ে প্রচুর মানুষ যাতায়াত করলেও এর জন্মের আদি ইতিহাস প্রায় সবার অজানা। যারা ওই রাস্তার জন্ম থেকে জড়িত তাদের মধ্যে আমি একজন। তাই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়েই পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে আমার কোন সমস্যা হবে না।

রাস্তা উঁচু নাকি নীচু থাকবে

বৃষ্টির পানি যখন রাস্তাকে খাল বানিয়ে নদীর দিকে ছুটে যাবার চেষ্টা করে তখন বুঝতে হবে সে পথ হারিয়েছে অথবা পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। মানুষকে তখন বন্যার পানি হয়ে কল্পনা করতে হবে কেন আমি এই বেপথে ছোটাছুটি করছি। হ্যাঁ একটা উদ্ভট প্রস্তাবনা করছি এই পর্বে।

চট্টগ্রাম শহরটা সম্প্রাসারিত হওয়ার পূর্বে বৃষ্টির পানি কোন পথে চলাচল করতো সেটা বুঝতে হবে। যে এলাকাগুলোর মধ্যে রাস্তাকে খাল বানিয়ে পানি ছুটে যায় সেই এলাকাগুলোর ভৌগলিক ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। আমরা প্রথমে কয়েকটা নাম বেছে নেবো যেখানে এই ঘটনাটা বেশি ঘটে। এলাকাগুলো হলো চাক্তাই, বাকলিয়া, কাপাসগোলা, বহদ্দারহাট, চাঁন্দগাও, আগ্রাবাদ, হালিশহর। প্রতিটা এলাকার ভৌগলিক পরিবর্তনগুলো দেখতে হবে। বর্তমান চেহারার সাথে বিশ বছর আগের চেহারার পার্থক্যটা বুঝতে হবে। তাহলেই সমাধানের পথ খোঁজা সম্ভব হতে পারে।

আমরা এখন বন্যার পানি থেকে বাঁচার জন্য প্রথমেই রাস্তাটা উঁচু করার চেষ্টা করি। বাড়িগুলো উঁচু করে তৈরি করি। পানি যেন আমাদের নাগাল না পায় সেটার জন্য আমরা উপরের দিকে যাবার চেষ্টা করি। কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে চেষ্টাটা সফল হয় না। বন্যার পানিও সমানতালে উপরের দিকে উঠতে থাকে। আমরা রাস্তা দুই ফুট উঁচু করলে পানিও দুই ফুট উঁচু হয়। চারফুট উঁচু করলে পানিও চারফুট ওপরে উঠে যায়। এটা যেন একটা প্রতিযোগিতা। একজন পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছে, আরেকজন তাকে ছোঁবার জন্য মরিয়া। আগ্রাবাদ এক্সেস রোড আদি অবস্থা থেকে আট ফুট উঁচুতে ওঠার পরও সেটাকে প্লাবিত করেছে ২০২৩ সালের বন্যা। এটার কারণ কী?

আমাদের এক্সেস রোডের বাড়ি

আমরা যখন ১৯৮৭ সালে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের পাশে বাড়ি তৈরি করি তখন সেখানে রাস্তা ছিল না। চারপাশের ধূ ধূ ধানক্ষেতের মধ্যে আমাদের বাড়িটাই প্রথম পাকা স্থাপনা। আমরা বেপারিপাড়া মসজিদের পাশ থেকে পনেরো ফুট প্রস্থের কয়েকশো গজ দীর্ঘ একটা মাটির রাস্তা তৈরি করে নিয়েছিলাম বাড়ি পর্যন্ত যাবার জন্য। পরে আরো কয়েকজন প্রতিবেশি তাতে যুক্ত হয়ে রাস্তাটাকে আরো কয়েকশো গজ টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন পশ্চিম দিকে। তখনো এলাকাটি আবাসিক এলাকার মর্যাদা পায়নি। আমাদের বাড়িটাকে বলা হতো বিলের মধ্যে চিলের বাসা। আমরা শুনতাম কোন এক সুদূর ভবিষ্যতে এদিক দিয়ে একটা রাস্তা হবে। পাকিস্তান আমলের মাস্টার প্ল্যানে সেই রাস্তার নাম ছিল এশিয়ান হাইওয়ে। পরবর্তীতে সেটার নাম বদলে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড করা হয়। আসল কথায় ফিরি।

১৯৮৭ সালে বাড়ি তৈরি করার দু বছর আগে ধানক্ষেত ভরাট করা হয়। সেই জমি ভরাটের কাজটা করার জন্য একটা ছোট রাস্তা তৈরি করার দরকার হয় জমি পর্যন্ত বালির ট্রাক যাওয়ার জন্য। আমার বাবার উদ্যোগে রাস্তাটি তৈরি করা হয় নিজেদের টাকায়। বেপারি পাড়া পেছন দিকে মুহুরিপাড়া গলি থেকে সোজা পশ্চিমে ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে সেই মাটির রাস্তাটা তৈরি হয় ১৯৮৫ সালে। আমাদের জমি ভরাটের মাটি বয়ে নিতে নিতে রাস্তাটা পোক্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রায় আঠারো ফুট প্রশস্ত ছিল রাস্তাটা। রাস্তাটা ধানক্ষেত তিন চারফুট উঁচু ছিল। তখনকার জন্য সেটাই যথেষ্ট উঁচু বিবেচিত হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে আমাদের বাড়িটা তৈরি করা হয় সেই মাটির রাস্তা থেকে আরো চারফুট উঁচুতে। ধান ক্ষেত থেকে আমাদের বাড়ির মেঝে প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু ছিল। তখন বেপারি পাড়ার স্থানীয় লোকেরা বলেছিল এত উঁচু করে বাড়ি করার দরকার কী। এখানে কোনদিন বন্যায় বিলের মধ্যেও পানি ওঠেনি। বাবা বললো যদি ভবিষ্যতে রাস্তা হয় সেটা তো উঁচু হবে। তখন যেন আমরা নীচে পড়ে না যাই। এলাকাবাসীর কথা সত্যি ছিল। ওই রাস্তায় কোনদিন বন্যার পানি ওঠেনি। ১৯৯১ সালের জলোচ্ছ্বাসে আমাদের বাড়িতে প্রথম পানি উঠেছিল। সেটাও এক ফুটের কম ছিল। ১৯৯৭ সালে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের কাজ শুরু হয়। ওই রাস্তাটা আমাদের পুরোনো মাটির রাস্তাটির ওপর আরো তিন ফুট উঁচু করে তৈরি হয়েছিল। বাবার দূরদর্শিতার কারণে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড চালুর পরও আমাদের বাড়িটা নীচে পড়ে যায়নি। আমরা রাস্তা থেকে এক ফুট উঁচুতে ছিলাম। পরবর্তী দশ বছর আমরা কখনো বন্যা দেখিনি। প্রথম ধাক্কা খেলাম ২০০৭ সালে। ওই বছর জুন মাসের ১০ তারিখে হঠাৎ এক প্রবল বন্যায় চট্টগ্রাম ভেসে যায়। সবচেয়ে বেশি ভেসে গিয়েছিলাম আমরা। জীবনে এমন করুণ দশা আমাদের হয়নি। দুই ঘন্টার মধ্যে আমাদের বাড়িটা তিনফুট পানির নীচে তলিয়ে যায়। জিনিসপত্র সব ভেসে যায়। তার আগের বিশ বছরে আমরা যা দেখিনি সেই বছরে আমাদের সেটা দেখতে হলো।

কেন এমন হলো? ২০০৭ সালে কেন আমরা হঠাৎ করে ভেসে গেলাম? কী ঘটনা হয়েছিল সে বছর? আমি পরবর্তীতে নিজস্ব অনুসন্ধানে কারণটা খুঁজে পেয়েছিলাম। সেটাই বলবো এখন।

তার আগে একটা অংক করি।

আমরা যখন জমি ভরাট করে ভিটে বানাই তখন আমরা ৩ ফুট জমি ভরাট করেছিলাম। সেই তিন ফুট উচু ভূমির ওপর আমরা যে বাড়ি তৈরি করি, সেটার ভিত্তিভূমি ছিল ৪ ফুট উঁচু। অর্থাৎ আমরা ৭ ফুট উঁচুতে বাড়িটা তৈরি করেছিলাম। ২০০৭ এর আগে কখনো আমরা বন্যা দেখিনি। ২০০৭ এ এসে প্রায় ৩ ফুট পানির নীচে তলিয়ে গেছে বাড়িটা। অর্থাৎ আমাদের আদি জমির স্তর থেকে ১০ ফুট উঁচুতে উঠে গেছে পানি। সে বছর তিন বার আমরা বন্যায় ভেসেছিলাম পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে। তার পরের বছর আমরা ওই বাড়ি ছেড়ে নতুন এলাকায় চলে আসি। কিন্তু বন্যা ওই এলাকাকে ছাড়েনি। বছরের পর বছর ডুবতে থাকে।

বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ২০১০ সাল থেকে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড কয়েক দফা উঁচু করা হয়, উঁচু করতে করতে এমন অবস্থা হয় পুরোনো সবগুলো বাড়ির একতলা ভূগর্ভে চলে গিয়েছে।

এই রাস্তা কতটা উঁচু হয়েছে তার একটা তুলনা দেই। আমাদের সেই বাড়িটার যে গেট ছিল আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের প্রথম উচ্চতার চেয়ে সাত ফুট উঁচু ছিল। ২০২২ সালে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড যে উচ্চতায় উঠেছে সেটা আমাদের সেই গেটের চেয়ে উঁচু। তার মানে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড ৭ ফুট উঁচু হয়েছে প্রথম দফার তুলনায়। তবু ২০২৩ সালে এসে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের ওই অংশটা অন্তত ৩ ফুট পানিতে ডুবে গেছে। ভাবা যায়?

এখন প্রশ্ন হলো রাস্তা উঁচু করার পরও সমস্যার সমাধান কেন হচ্ছে না। পানিকে পাল্লা দিয়ে আরো উপরে উঠতে হচ্ছে কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলে, অনেক সমস্যার সমাধান করা যাবে। আমরা ওই এলাকার ভৌগলিক বিবর্তনের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। বিষয়টা বোঝার জন্য পুরো এলাকার ভৌগলিক ইতিহাস জানতে হবে। আমি এখানে আগ্রাবাদের উদাহরণ দিলাম, কিন্তু এই উদাহরণ পুরো চট্টগ্রামের বন্যাপ্রবণ সব এলাকার জন্য প্রযোজ্য। বাকলিয়া, চাক্তাই, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, কাপাসগোলা, হালিশহর, সিডিএ, সবগুলো এলাকার সমস্যার কারণ একই। সেটাই এখন ব্যাখ্যা করবো।

তার আগে কয়েকটি প্রাচীন মানচিত্র এবং আধুনিক স্যাটেলাইট চিত্রের দিকে তাকাতে হবে।






এই মানচিত্রটি আঁকা হয়েছিল মোগলদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম ইংরেজের হাতে আসার পর। এটাকেই চট্টগ্রাম শহরের আদি মানচিত্র বলা যায়। এর আগের কোন মানচিত্র এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি যে বর্তমান কর্নফুলী নদীর সাথে এটার কোন তুলনা হয় না। কর্নফুলী নদীর গড় প্রস্থ ছিল তখন ৫ মাইলের বেশি। মোহনার দিকে ১০ মাইল। বর্তমানে যেটা ১ মাইলেরও কম। এখানে নদীর যে অংশটা সরু হয়ে শহরের ভেতর ঢুকে গেছে সেটা পরবর্তীকালে চাক্তাই খাল নামে পরিচিত হবে। সেই অংশটি বহদ্দারহাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল চান্দগাও-বাকলিয়ার চর জেগে ওঠার আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ কর্নফুলী নদী সুলুকবহরের পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে এসে পাথারঘাটার কাছ দিয়ে বাঁক নিয়ে মোহনার দিকে বাঁক নিতো। মোহনাটা একসময় সদরঘাটের কাছাকাছি ছিল। এই নদীটা চর জাগতে জাগতে গত তিনশো বছরে ছোট হতে হতে বর্তমান অবস্থায় চলে এসেছে। এই মানচিত্রে যেসব এলাকা নদী হিসেবে চিহ্নিত, বর্তমানে সেগুলোর একাংশ আনোয়ারা পটিয়া বোয়ালখালীর অংশ, বাকীটা চট্টগ্রাম শহর। আমরা চট্টগ্রাম শহর নিয়ে আলোচনায় থাকবো। কর্নফুলীতে চর জেগে যখন চট্টগ্রাম শহর গড়ে উঠতে থাকে তখন নদীর প্রস্থ ছোট হয়ে যায়। কিন্তু লুসাই পাহাড় থেকে বয়ে আসা পানির ধারা একই থাকে প্রাকৃতিক কারণেই। প্রস্থ ছোট হলেও কর্নফুলী নদীর তলদেশ যথেষ্ট গভীর ছিল বলে বাড়তি পানিগুলো সমুদ্রে যাবার ক্ষেত্রে সমস্যা হতো না। বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের অতিরিক্ত পানি খোলা জমিজমার ওপর দিয়ে পার হয়ে নদীতে নেমে যেতো। এই ধারা অব্যাহত ছিল বিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত। বিশ শতকের শেষভাগ থেকে পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটতে থাকে। নতুন নতুন শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট তৈরি হয়। সেই সাথে আবাসন খাতে একটা বিপ্লব ঘটে যায়। নতুন নতুন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠতে থাকে কর্নফুলীর তীরবর্তী সমভূমিগুলোতে। আগ্রাবাদ হালিশহর বাকলিয়া চান্দগাও বহদ্দারহাটসহ যেসব এলাকা একসময় কর্নফুলীর চরাঞ্চল ছিল সেই এলাকাগুলো আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়। নতুন নতুন রাস্তা তৈরি হয় এসব এলাকায়। প্রথম দিকে যখন অল্প স্বল্প বাড়ি ছিল, বিশেষ করে নব্বই দশকে, তখন কোথাও ভয়ানক বন্যা হতো না শহর জুড়ে। কারণ শহরের বৃষ্টির পানি ফাঁকা ফাঁকা বিক্ষিপ্ত বাড়িগুলোর আশপাশ দিয়ে নিজের পথ খুঁজে নিয়ে কর্নফুলী নদীতে চলে যেতে পারতো। কিন্তু একুশ শতকের শুরু থেকে মানুষের বসতি এত বেড়ে যায় যে ওই ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ঠাসাঠাসি বাড়ির ফাঁক গলে বৃষ্টির পানিগুলো নামার সুযোগ পায় না। তখন বন্যার পানি রাস্তাগুলোকে খাল বানিয়ে নদীর দিকে যাবার চেষ্টা করে। তখনই শহর ডুবে যায়। পানিতে ভাসতে থাকে নগর জীবন। ভয়ানক দুর্যোগ নেমে আসে নগর জীবনে।




একটি উদাহরণ: ২০০০ সাল বনাম ২০২৩ সাল


এই যে দুর্যোগ, সেটার জন্য পানির দোষ কতখানি, মানুষের দোষ কতখানি? এই ব্যাপারটি বোঝার জন্য দুটি স্যাটেলাইট চিত্র দেখা যাক। আগ্রাবাদ-হালিশহর এলাকার দুটি চিত্র। একটি ২০০০ সালের, আরেকটি ২০২৩ সালের। এই দুটি চিত্রের পার্থক্যটা খালি চোখেই পরিষ্কার। এখন পার্থক্যের প্রভাবটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যাক।




উপরের দুই মানচিত্র একই এলাকার। দুটো দুই সময়কালে নেয়া হয়েছে স্যাটেলাইট ছবি থেকে।

২০০০ সালের চিত্রে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের আশেপাশে ফাঁকা ফাঁকা কিছু বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ১৯৮৭ সালে আমরা যখন ওই এলাকায় বাড়ি করি তখন পুরো এলাকাটাই ছিল ধান ক্ষেত। খোলা প্রান্তর। বর্ষাকালে এই খোলা প্রান্তর পেরিয়ে বৃষ্টির পানি অবাধে গিয়ে পড়তো মহেশখালে। মহেশখাল দিয়ে সমগ্র আগ্রাবাদ এবং ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের দক্ষিণাংশের সবগুলো এলাকার পানি কর্নফুলী নদীতে চলে যেতো কোন বাধা ছাড়াই। মহেশখালে যাবার জন্য কোন নালা নর্দমা লাগতো না। পানির স্রোত নিজস্ব গতিতে বিল পেরিয়ে খালের নাগাল পেয়ে যেতো। ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের দক্ষিণে যেসব পাড়া ছিল সেখানেও বাড়িঘর বেশি ছিল না। মুহুরী পাড়া এবং রঙ্গীপাড়ার পর থেকে তো খোলা প্রান্তর। বৃষ্টির পানি স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারলে বন্যার কোন আশঙ্কা থাকে না। বন্যার অর্থ হলো পানি কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। উত্তর আগ্রাবাদের সকল বৃষ্টির পানি বিনা বাধায় মহেশখালের সাথে যুক্ত হতো ছোটপুলের কাছে পুলিশ লাইনের আশপাশের এলাকায়। ওদিকে খালটা সবচেয়ে বেশি প্রশস্ত ছিল।

নব্বই দশকের পর থেকে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের ওই ধানক্ষেতগুলো বিলুপ্ত হয়ে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠতে থাকে। ২০০০ সাল পর্যন্ত যে চিত্র দেখা যাচ্ছে সেখানে বাড়িঘরগুলো তখনো সংখ্যায় বেশি নয়। তাই তখনো বন্যা হতো না। বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে যথেষ্ট জায়গা ছিল। সেই ফাকা জায়গা দিয়ে পানি চলে যেতে পারতো। কিন্তু পরবর্তী এক দশকের মধ্যে পুরো এলাকাটা ভর্তি হয়ে যায় বাড়িঘরে। পানি নামার আর কোন জায়গা থাকে না। তখন পানি আটকে পড়ে পুরো এক্সেস রোডের আশপাশের এলাকায় বন্যার সৃষ্টি করে। এক্সেস রোডের সাথে যে নালা করা হয়েছিল সেই নালার ধারণ ক্ষমতা খুব কম। এত বিপুল পরিমান পানি ওই নালা দিয়ে পার হওয়া কঠিন ব্যাপার। সব পানি নিষ্কাষণ হতে কয়েকদিন সময় লেগে যায়। সেই সময়টাতে এলাকার মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
এখন সেই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সরকার প্রথমে ঠিক করলো রাস্তা উঁচু করবে। কিন্তু রাস্তা যতই উচু করা হয়, পানিও তত উচ্চতায় উঠতে থাকে। কারণ রাস্তা উঁচু করার কাজটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত। মানুষের গাড়ি ঘোড়া চলার জন্য রাস্তাকে উঁচু করা হচ্ছে ঠিক। কিন্তু পানির জন্য ওই রাস্তা হলো একটা বাধ। সে বাধা পেয়ে আরো ফুলতে থাকে। ফলে মানুষ আরো নিমজ্জিত হতে থাকে। রাস্তা যত বেশি উঁচু করা হয় পানি তত বেশি ফুলে যায়। এটা প্রকৃতির সাথে একটা অসম যুদ্ধের মতো হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ২০২৩ সালে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড আগের তুলনায় ৭ ফুট উঁচু হবার পরও পানি উঠে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

তাহলে কী করা উচিত ছিল?

একটি উদ্ভট প্রস্তাব

এটা খুব জটিল একটা প্রশ্ন। কিন্তু আমার কাছে একটা প্রস্তাবনা আছে যেটা দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। আমি তাত্ত্বিকভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারি। শুনতে হাস্যকর লাগতে পারে। আমি বলবো রাস্তা উঁচু না করে বরং নীচু করে দেয়া হোক। যে রাস্তাগুলো উঁচু করা হয়েছে সেই রাস্তাগুলোই বন্যার জন্য দায়ী। আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, পোর্ট কানেকটিং রোড, আগ্রাবাদ সিডিএ সহ যতগুলো রাস্তা উঁচু করা হয়েছে সবগুলো ভুল পরিকল্পনা ছিল। যে ভুলের পরিণতিতে ওই এলাকার সবগুলো বাড়ির একতলাটা অকেজো হয়ে গেছে।

রাস্তাকে স্বাভাবিক উচ্চতায় রেখে সমাধান করার একটা উপায় ছিল। সেটা করার জন্য প্রতিটা রাস্তার পাশে বৃষ্টির পানি চলাচল করার মতো যথেষ্ট নালা নর্দমা আছে কিনা সেটা চেক করে, যেখানে নালা নেই সেগুলো খনন এবং পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করা। এক্সেস রোডের আশপাশে যেসব এলাকা একসময় খোলা প্রান্তর ছিল সেখানে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। সেই আবাসিক এলাকাগুলো তৈরির সময় সবাই শুধু নিজ নিজ বাড়ি নিয়ে ভেবেছে। সামগ্রিক কোন পরিকল্পনা করা হয়নি। রাস্তা, গলি, নর্দমা কোন কিছুই পরিকল্পিত নয়। যে যার মতো জোড়াতালি দিয়ে বাড়িঘর করে ফেলেছে। যারা আবাসিক এলাকার অনুমোদন দেয় সেই কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল বিষয়টা তদারকী করা। কিন্তু সেটা কখনোই করা হয় না। এখন প্রতিটা বাড়ির পাশে যেটুকু খালি জায়গা থাকার কথা সেই জায়গাটা শুধু বায়ু চলাচলের জন্য নয়। পানির জন্যও সেই জায়গাটা দরকার। কিন্তু প্রতিটা বাড়ির সীমানা দেয়াল সেই পথটা বদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে পুরো এলাকায় একটা বিশাল বাঁধ তৈরি হয়ে গেছে। বন্যার পানি সেই বাঁধ অতিক্রম করতে না পেরে যেদিকে সুবিধা পায় সেদিক ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এখন বাড়িঘরগুলো ভাঙ্গা সম্ভব না হলেও বাড়ির সীমানা দেয়ালগুলোর মধ্যে ফোকর তৈরি করে পানিগুলোকে যাবার পথ করে দিতে হবে। কোন বাছ বিচার না করে সবগুলো বাড়ির সীমানা দেয়াল কেটে ফাঁক করে দিতে হবে। বড়লোক ছোটলোক সবার জন্য এই আইনটা একইরকম থাকতে হবে। পানি বড়লোক ছোটলোক বোঝে না। সে তার চলার পথটা খালি পেতে চায়। ওকে যেতে না দিলে সবকিছু ভাসিয়ে নেবে।

মনে হতে পারে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড উঁচু করে খুব বড় একটা কাজ করা হয়েছে। আরো বড় কাজ হয়েছে পোর্ট কানেকটিং রোডটা উঁচু করে। বিশাল মহাসড়ক। দেখতে সুন্দর। দুপাশে ফুটপাত। গাড়িওয়ালাদের জন্য অবশ্যই একটা দারুণ ব্যাপার। কিন্তু পানিওয়ালাদের কী ব্যবস্থা আছে সেখানে? উপরের মানচিত্রটা আবার দেখুন। ওই মহাসড়ক দুটো পানির কাছে দুটো বিশাল বাঁধ ছাড়া আর কিছু নয়। সে আগে সহজে যে রাস্তা অতিক্রম করতে পারতো, এখন সেটা সম্ভব না। এখন তাকে দুটো বেড়িবাধের মধ্যে আটকে থেকে পুরো জনপদকে ভাসিয়ে নিতে হচ্ছে। রাস্তাটা তাকে পার হতে হবে নইলে সে মহেশখালে পৌঁছাতে পারবে না। তাই সে ফুলে ফেঁপে ৭ ফুট মহাসড়কের ওপর উঠে গেছে। তারপর অন্য পাড়ে গিয়ে মহেশখাল স্পর্শ করেছে। রাস্তাটা সাতফুট নীচে থাকলে তাকে এত কষ্ট করতে হতো না এত বাড়িঘর ডোবাতে হতো না। আগের লেভেলে যে বাড়িগুলো আছে সে বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে পানিকে যাবার পথ করে দিলে সে ওই এলাকা ডোবাতো না। আমাদের ডোবাচ্ছে নাগরিক উন্নয়ন। আমরা বোকার মতো উন্নয়নের খেসারত দিয়ে যাচ্ছি বছরের পর বছর।

মানচিত্রে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের উত্তরভাগ এবং পোর্ট কানেকটিং রোডের পূর্ব দিকের এলাকাটা দেখুন। এই পুরো এলাকার মানুষ একটা ফাঁদের মতো আটকে গেছে দুটো রাস্তা নামের বাঁধের ভেতর। ২০১০ এর আগেও প্লাবিত হতো না হালিশহর এলাকা। কারণ হালিশহরের সকল পানি অবাধে পুলিশ লাইনের পাশ দিয়ে মহেশখালে নেমে যেতো। কিন্তু ২০১০ সালের পর পুলিশ লাইন তাদের সীমানা দেয়াল নির্মান করে পুরো এলাকা জুড়ে। পুলিশলাইনের অবস্থানটা এমন জায়গায় যেটা মহেশখালের আগ্রাবাদ হালিশহরের কেন্দ্রভূমি। এটা একটা মোহনার মতো এলাকা। এদিক দিয়েই সমস্ত জল নিষ্কাশন হয় দুপাশ থেকে। পূর্বদিক থেকে আসতো দেওয়ানহাটের দক্ষিন পাশের সমগ্র এলাকার পানি। পশ্চিম দিক থেকে আসতো পুরো হালিশহর এলব্লক, কে ব্লকসহ ওদিকে যত আবাসিক এলাকা আছে তার সবগুলো পানি। পুলিশ লাইন যখন সীমানা দেয়াল তুলে দিল, সেই পানি আসার পথ বন্ধ হয়ে গেল। তখন থেকে হালিশহর এলাকাও প্লাবিত হতে শুরু করলো। হালিশহরের বন্যা প্লাবিত হবার একমাত্র কারণ ছোটপুল পুলিশ লাইনের সীমানা দেয়াল। বিশ্বাস না হলে ওই এলাকার বিশ বছর পুরোনো বাসিন্দাদের জিজ্ঞেস করতে পারেন।

আগ্রাবাদ সিডিএর জোয়ার-ভাটা এবং মহেশখালের সম্পর্ক

এবার আসি আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকার কথায়। আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকায় জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হতে শুরু করেছে একুশ শতকের শুরু থেকে। নব্বই দশকেও আগ্রাবাদ সিডিএতে পানি উঠতো না। হঠাৎ করে জোয়ার কেন বেড়ে গেল? চোখ বন্ধ করে সবাই গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে দোষ দিয়ে রাস্তা উঁচু করতে শুরু করলো। চিন্তা করলো না গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর অভিশাপ শুধু আগ্রাবাদ সিডিএ ওপর এসে পড়লো? সারা পৃথিবীর হাজার হাজার দ্বীপ এখনো টিকে আছে সমুদ্রের কয়েক ফুট ওপরে। তাদের কিছু হলো না। এমনকি আমাদের সেন্টমার্টিন দ্বীপও এক ফুট পানিতে তলিয়ে গেল না। শুধু সিডিএর ঘাড়েই এই বিপদটা এসে পড়লো। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত না? কিন্তু কারো ঘাড়ে যেহেতু দোষ চাপানো গেছে তাহলে ওটা নিয়ে আর কিছু চিন্তা করার নেই। আমরা বছর বছর রাস্তা উঁচু করতে থাকলাম। সিডিএ এলাকার রাস্তাগুলো অন্তত পাঁচফুট উঁচু হয়েছে নব্বই দশকের তুলনায়। তবু সমাধান হয়নি। সেই পাঁচফুট উঁচু রাস্তাও ডুবে যায়। ততদিনে তো মালদ্বীপের বারোশো দ্বীপ নেই হয়ে যাবার কথা ছিল। সব ঠিকমতোই আছে এখনো।


গোলমালটা কোথায়?

এখানে একটু দূর ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হবে। আরেকটি মানচিত্র দিচ্ছি।



স্পেনের জাতীয় আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত এই মানচিত্র দুটোর মধ্যে আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকার জলাবদ্ধতা রহস্যের উত্তর রয়েছে। যারা গ্লোবাল ওয়ার্মিং ইত্যাদির উপর সমস্যাটা ছেড়ে দেন আমি তাঁদের সাথে একমত নই। কর্নফুলী নদীর ইতিহাসের সাথেই এই সমস্যাটা ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। তিনশো বছর আগেও কর্নফুলী নদীর চেহারা এবং প্রশস্ততা কতটা ভিন্ন ছিল সেটা উপরের দুটো মানচিত্রে প্রকাশিত। ১৭৩৯ সালের মানচিত্রে দেখুন কর্নফুলী নদী থেকে একটা শাখা বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। শাখাটা নদীরই অংশ। ডানদিকে যে দ্বীপটা দেখা যাচ্ছে সেটা হলো হালিশহর পতেঙ্গা। তখনো ওটা দ্বীপের মতো ছিল। আরো দুশো বছর আগে ওই দ্বীপটা সমুদ্রের গর্ভে ছিল। কর্নফুলীর ওই শাখাটা ১৭৬১ সালের মানচিত্রেও দেখতে পাবেন। ওটা অনেকটা সরু দেখাচ্ছে। ওটা মানচিত্রের আয়তনের কারণেই সরু দেখাচ্ছে। কর্নফুলীর ওই শাখাটা বর্তমানে মহেশখাল। ওটা বঙ্গোপসাগরের অংশটা হলো কাট্টলী। আপনি উপরের মানচিত্রে একটা স্থানের নাম দেখতে পাচ্ছেন kautwallea, ওটা কাট্টলীর ভগ্ন উচ্চারণ। কর্নফুলীর ওই শাখাটা ভরাট হতে হতে খালে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সেই খালটাও হালিশহর আবাসিক এলাকার ভেতর হারিয়ে গেছে। এখন কর্নফুলী নদীতে যখন জোয়ার আসে তখন সেই জোয়ারের চাপটা মহেশখালের ওপর একটু বেশি পড়ে। লক্ষ্য করে দেখবেন অন্যন্য খালের তুলনায় মহেশখাল এবং চাক্তাই খালের উচ্চতা জোয়ারের সময় অনেক বেশি বেড়ে যায়। কারণ জোয়ারের পানির কাছে ওই দুটো নদীর অংশ। আমরা তাকে খাল বানিয়ে ফেললেও সে ওটাকে ভোলেনি।

এখন মহেশ খালের সাইজ ছোট হয়ে গেলেও তাতে পানির পরিমাণ আকৃতির তুলনায় বেশি। যখন খালের আশপাশে জলাভূমি ছিল তখন সে বাড়তি পানি ওই জলাভূমিতে ছড়িয়ে দিতো। সেই জলাভূমিগুলো দখল হতে শুরু করেছে নব্বই দশক থেকে। আপনি বর্তমান মানচিত্রে দেখবেন সিডিএ এলাকার পশ্চিম দিকের যে বিস্তীর্ণ প্রান্তর ছিল, সেখানে বিশাল আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। পোর্ট কানেকটিং রোড থেকে সিডিএ পর্যন্ত এলাকায় আগে ছিল মহেশখালের জলাভূমি। ছোটপুল থেকে শুরু করে ওই অঞ্চলের পুরোটাই ছিল মহেশ খালের জোয়ারের পানির আশ্রয়। সেই আশ্রয় নষ্ট হবার পর থেকে সে ফুলতে শুরু করে সিডিএর পাশের অংশে। সিডিএর মধ্য দিয়ে একটা নালা আগ্রাবাদ ব্যাংক কলোনী ঘুরে ফকির হাটের দিকে চলে গেছে। সেই নালাটিও একসময় মহেশখালের শাখা ছিল। ওই শাখাতে জোয়ার ভাটার পানি আসে। সেই নালাটি বেয়ে জোয়ারের পানি পুরো সিডিএ এলাকা প্লাবিত করে। ছোট ছোট নালা এত পানি ধারণ করতে পারে না। ফলে পানি রাস্তায় উঠে পড়ে। যদি সিডিএ আবাসিক এলাকার পশ্চিম দিকের বিলটা উন্মুক্ত থাকতো তাহলে ওই পানি সিডিএ এলাকায় ঢুকে পড়তো না।

এখনকার মানচিত্রে মহেশখালের আঁকাবাকা অংশগুলো খেয়াল করলে বুঝবেন। সিডিএ, ছোটপুল, বড়পুল এই পুরো এলাকাটা দিয়েই কর্নফুলীর ওই শাখাটা কাট্টলীর দিকে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়তো। সেই শাখা তো বন্ধ হলো। জোয়ারের পানি এসে যে বিলে ছড়িয়ে পড়তো সেটাও মানুষ দখল করে ফেললো। এখন জোয়ারের পানির উপায় কী? তাকে তো কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। সারাবছর তবু সে কোনমতে মেনে নেয়। কিন্তু বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির সাথে যখন একত্র হয় তখন দুজনে মিলে পুরো এলাকাকে গিলে ফেলে। রাস্তা যত উঁচু করা হোক না কেন ওই সমস্যার সমাধান হবে না। শুধু একটাই ব্যবস্থা করা যায়। সে যেখানে গিয়ে আশ্রয় নিত, সেই এলাকা দখলমুক্ত করে তার জন্য কোন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। অথবা মহেশখাল পুরোটাই ভরাট করে বৃষ্টির পানি নামার জন্য আলাদা পথ করে দেয়া। মহেশখালকে দখলমুক্ত করতে না পারলে তাকে কবর দিয়ে সমস্যাটা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করা যায়।

পুরোনো যুগে ফিরে যাওয়া

আপনি আবারো আগ্রাবাদ-হালিশহর এলাকার প্রথম মানচিত্রে ফিরে গিয়ে দেখতে পারেন। সেখানে দেখবেন সিডিএ এলাকার পশ্চিম দিকের যে বিস্তীর্ণ প্রান্তর ছিল, সেখানে বিশাল আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। ছোটপুল পুলিশ লাইনের পাশ দিয়ে যে খাল গেছে সেটার আশপাশেও প্রচুর খালি জায়গা ছিল। পোর্ট কানেকটিং রোড থেকে সিডিএ, শান্তিবাগ হয়ে পুরো এলাকাটা ছিল মহেশখালের জলাভূমি। এই জলাভূমিটা আসলে কর্নফুলী নদীর প্রাচীন একটা ধারা। যেটা তিনশো বছর আগের মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে। ছোটপুল থেকে শুরু করে ওই অঞ্চলের পুরোটাই ছিল মহেশ খালের জোয়ারের পানির আশ্রয়। একের পর এক আবাসিক এলাকা গড়ে উঠে জোয়ারের পানির সেই আশ্রয় নষ্ট হবার পর থেকে সেটা ফুলতে শুরু করে সিডিএর অংশে। আগ্রাবাদ এক্সেস রোড হবার পর সেই জোয়ারের পানি উত্তর দিকে বেশি ছড়াতে পারছিল না। তখন থেকেই সিডিএ আবাসিক এলাকার ওপর চাপ দিতে শুরু করে। সিডিএর মধ্য দিয়ে একটা নালা আগ্রাবাদ ব্যাংক কলোনী ঘুরে ফকির হাটের দিকে চলে গেছে। সেই নালাটিও একসময় মহেশখালের শাখা ছিল। ওই শাখাতে জোয়ার ভাটার পানি আসে। সেই নালাটির আশপাশের এলাকাও একসময় খালি ছিল। এখন সেদিকেও আবাসিক এলাকা তৈরি হয়ে গেছে। দুই দিকের চাপে জোয়ারের পানি ফুলে উঠে পুরো সিডিএ এলাকা প্লাবিত করতে শুরু করলো। যদি সিডিএ আবাসিক এলাকার পশ্চিম দিকের বিলটা উন্মুক্ত থাকতো তাহলে ওই পানি সিডিএ এলাকায় ঢুকে পড়তো না। এখনকার মানচিত্রে মহেশখালের আঁকাবাকা অংশগুলো খেয়াল করলে বুঝবেন। সিডিএ, ছোটপুল, বড়পুল এই পুরো এলাকাটা দিয়েই কর্নফুলীর ওই শাখাটা কাট্টলীর দিকে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়তো। সেই শাখা তো বন্ধ হলো। জোয়ারের পানি এসে যে বিলে ছড়িয়ে পড়তো সেটাও মানুষ দখল করে ফেললো। এখন জোয়ারের পানির উপায় কী? তাকে তো কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। সারাবছর তবু সে কোনমতে মেনে নেয়। কিন্তু বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির সাথে যখন জোয়ারের পানি যুক্ত হয় তখন দুজনে মিলে পুরো এলাকাকে গিলে ফেলে। সুতরাং রাস্তা যত উঁচু করা হোক না কেন, পানিও তত উঁচুতে উঠতে থাকবে। রাস্তা উচু করে ওই সমস্যার সমাধান হবে না। পানিগুলো নিষ্কাষণের মতো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। যদি মহেশখাল থেকে কাট্টলী পর্যন্ত একশো ফুট প্রশস্ত একটা খাল টেনে নেয়া যায় তাহলে হয়তো এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু এতগুলো স্থাপনা ভেঙ্গে সেটা করা সম্ভব কিনা জানি না। কিন্তু এটা জানি রাস্তা উঁচু করার জন্য যে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে সেই বাজেটে এই কাজটা হয়ে যেতো।

যদি সেটা করা না যায় তাহলে আরেকটি শেষ কাজ করা যায়। মহেশখালকে পুরোপুরি ভরাট করে সেটার ওপরও আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা যায়। তাতে অনেক মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা হবে এবং জোয়ারের পানি আসার রাস্তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। ওই খালটা যতদিন থাকবে আগ্রাবাদ হালিশহর এলাকা কোনদিন বন্যামুক্ত থাকবে না। ওই খাল না থাকলে বৃষ্টির পানি কোথায় যাবে? বৃষ্টি পানি এমনিতেও রাস্তাকে খাল বানিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নিজের পথ করে নেয়। মহেশখাল না থাকলেও সে তার পথ করে বেরিয়ে যাবে। শুধু রাস্তাগুলোকে কর্নফুলী নদীর দিকে ঢালু করে বানাবেন। যে রাস্তাগুলো উঁচু করা হয়েছে সেগুলোকে কেটে নীচে নামিয়ে দিতে হবে। আগ্রাবাদ এক্সেস রোড এবং পোর্ট কানেকটিং রোড এই দুটো রাস্তাই বৃষ্টির পানির প্রধান বাধা। ওই রাস্তাগুলোকে ২০০০ সালের উচ্চতা ফিরিয়ে দিন।

[আলোচনা চলমান.......]

** এখানে আগ্রাবাদ হালিশহরের যে উদাহরণটা দিলাম সেটা একদম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। আমার বিশ্বাস বাকী এলাকাগুলোর ক্ষেত্রেও এই বিষয়টা প্রযোজ্য।