Sunday, October 26, 2014

অর্থপূর্ণ কিংবা অর্থহীন কিছু দুঃস্বপ্ন

চেনা রাস্তায় কোন এক অচেনা কবরখানা। আমি একটি কবরের সামনে দাঁড়িয়ে। কবরটি কয়েকটি ইস্পাতের ঢাকনা দিয়ে ঢাকা দেয়া। আমি স্টীল পাইপের ফ্রেমগুলো তুলে ঢাকনা খুলে কবরটা উন্মুক্ত করলাম। কবরে সাদা কাফন পরে শুয়ে আছে যে লাশটা সে আমার খুব প্রিয়জন, তার চলে যাওয়া অনিবার্য হয়েছিল বলে সে চলে গিয়েছে, আমার কোন ভয় শোক তাপ কিছুই লাগছিল না। যেন খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। আমি লাশটির মাথার পাশে রাখা একটা পুটুলি দেখলাম। সে পুটুলিতে কি আছে মনে নেই। কিন্তু আমি দেখছিলাম পুটুলিটি ঠিকঠাক আছে কিনা। সদ্য কবর দিয়ে সবাই চলে যাবার পর আমি নিশ্চিত হতে এসেছিলাম জিনিসটা ওখানে দেয়া হয়েছিল কিনা। দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। এরপর লাশের শরীর স্পর্শ করে দেখলাম, তখনো শক্ত হয়ে যায়নি। আমি কবরের ঢাকনাগুলো আবার জায়গামতো বসিয়ে দিয়ে উঠে পড়লাম।

কিছুদুর হেঁটে গিয়ে আবারো কবরের পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় হঠাৎ চমকে দেখি লাশটা কবর থেকে উঠে কবরের পাশে একটা স্টিলের খাটিয়ায় শুয়ে আছে। মাথাটা একটু উঁচু করা। কাফনে ঢাকা শরীরের মাথার অংশটা খোলা। সেই খোলা অংশে দেখা যাচ্ছে ওর অনিন্দ্যসুন্দর মুখটি। আমি স্পষ্ট দেখলাম সে হাসছে আমার দিকে চেয়ে, সেই চিরপরিচিত হাসি। অশ্রু সরিয়েও যে মুখে হাসি ফোটে সেই ম্লানসুন্দর হাসি। সেই হাসির কোন অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না। বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। না কষ্ট না ভয় একটা অনুভুতি। আমার কিছু করার নেই। কিছু জানার উপায় নেই।

আমি ফিরে চলে আসলাম। কিছুদূর গিয়ে
বাদামতলী মোড়ে পৌঁছে আবার ফিরতে চাইলাম। কোথায় ফিরছি জানি না। আমি তখন আখতারুজ্জামান সেন্টারের উল্টোদিকে। আমি রাস্তা পেরিয়ে কেন যেন দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিলাম। যে রাস্তায় লাশটা দেখে এসেছি সেই দিকেই কী?

রাস্তা পেরোতে গিয়ে দেখলাম পূর্বদিকে আগ্রাবাদ হোটেলের দিক থেকে গোঁ গোঁ শব্দে একটা হেডলাইটবিহীন অন্ধ ট্রাক ছুটে আসছে, চারপাশ অন্ধকার, সড়কবাতি জ্বলছে না, আশপাশের কোন দালানেও নেই বাতির আভাস, যেন এক অন্তহীন ব্ল্যাকআউট, সেই ব্ল্যাকআউটের মধ্যে পূর্বদিক থেকে ছুটে আসা ট্রাকটা দেখে আমি রাস্তাটা দ্রুত পেরিয়ে যেতে চাইলাম, কিন্তু হঠাৎ আমার চোখের উপর একটা অন্ধকার পট্টি পড়ে চারপাশ নিকষ কালিতে ঢেকে দিল, তখন আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, চোখ থেকে পট্টিটা নামানোর প্রানান্তকর চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হলাম তখন দিগ্বিবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অন্ধের মতো ছুট লাগালাম মাথাটা নীচু করে, কিন্তু ছুটতে গিয়ে টের পেলাম আমি দিক হারিয়ে ফেলেছি, আমি চরকির মতো ঘুরতে শুরু করেছি, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সবকিছু আমার কাছে অর্থহীন হয়ে গেল, আমি যে কোন একটা দিকে ছুটে হেডলাইটবিহীন অন্ধ ট্রাকের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম, যদিও জানি ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে আমাকে পিষে দিয়ে ট্রাকটি শরীরের উপর দিয়ে পেরিয়ে যাবে যে কোন সময়।

ঠিক তখন গোঁ গোঁ শব্দ নিয়ে পার্শ্ববর্তিনীর ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। 
আমি বেঁচে আছি! ওটা নিতান্তই এক দুঃস্বপ্ন ছিল। স্বপ্নগুলোর হয়তো কোন মানে নেই, হয়তো আছে। সময়ের কাছে এর কোন ব্যাখ্যা থাকলে থাকতে পারে কিন্তু আমার নিজের কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে ইচ্ছে করছে না। আয়ুষ্কাল সমাপ্ত হবার পর কেউ হয়তো স্বপ্নগুলোর অর্থ খুঁজে পাবে। কে জানে? এক রাতে আধডজন স্বপ্ন হানা দিয়েছে যার প্রায় প্রতিটিই ভয়ংকর। কিন্তু বাকী স্বপ্নগুলো ভোর হবার আগেই মুছে গেছে স্মৃতি থেকে।

Monday, October 20, 2014

সময় অসময়ের কথকতা

এক. হেমন্ত হিম

অনেকদিন পর হেমন্তের ঘ্রাণ পেলাম। গতকাল সন্ধ্যায় রিকশা নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন লালখান বাজার থেকে চিটাগং ক্লাবের দিকে যাবার পথে হঠাৎ বাতাসে একটা হিমেল স্পর্শ। অক্টোবর মাসে এই আবেশ বহুবছর নির্বাসিত ছিল। এই আবহাওয়া বসন্তের চেয়েও আদৃত। বাংলা কত তারিখ আজ? পত্রিকা দেখে জানলাম কার্তিকের ৫। হ্যাঁ কার্তিকেই তো একটু হিমহাওয়া বইবার কথা, সাথে হালকা কুয়াশা।

এমন আবহাওয়ায় কোথাও বেড়াতে ইচ্ছে করে। না শীত না গরম। আজকাল বসন্তে সেই সুখ নেই। ফেব্রুয়ারী থেকেই কেমন তেতে ওঠে আবহাওয়া। সকালটা সহনীয় হলেও দুপুরটা অসহ্য। বছরে একবার কক্সবাজারে ছোটে বাঙালী। আমিও। যেতে না চাইলেও যেতে হয়। বাকীরা যাচ্ছে, আমরা একঘরে হয়ে থাকি কি করে? প্রতিবার যাই, একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফিরে আসি। অবশ্য বিরক্তি আমার একারই। বাকীদের আনন্দ। ওদের আনন্দের জন্যই আমার যেতে হয় বিরক্তি সহ্য করে।

কিন্তু একটা সময় ছিল আমি কক্সবাজার গিয়ে এরকম বিরক্ত হতাম না। তখন আমি অনেক বেশী স্বাধীন ছিলাম বলেই? মনে হয় না। তখন কক্সবাজারে এত ভিড় হতো না, হাজার হাজার মানুষ আর দালানকোঠার ভিড়ে সমুদ্রের নির্জনতা হারিয়ে যেতো না। এখন একা হবার জো নেই। থাকার হোটেল, খাবার হোটেল সবকিছুর শান শওকত বেড়েছে, কিন্তু সেবা ও আন্তরিকতার মানে চরম অধোগতি। প্রতিটা হোটেলে একই খাবার, কোন বৈচিত্র নেই। তবু মানুষ হৈ হৈ করে যায়, হৈ হৈ করে খায়, হৈ রৈ ফুর্তিতে কলাতলীর রাস্তা মাতিয়ে রাখে। কেন জানি কক্সবাজার গেলে আমার খুব ক্লান্তি লাগে, সামান্য হেঁটেও কাতর হয়ে পড়ি। আর কেবলই ঘুম পায়। আমি গতবার দুদিন ছিলাম। অধিকাংশ সময় আমার ঘুমে কেটেছে হোটেলে।



দুই. স্মার্টফোন কীর্তি:

১. মানুষ এখন দুই প্রকার। 'নেট মানুষ' এবং, 'বাস্তব মানুষ'। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবজাতিকে এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছে স্মার্টফোন।

২. আগের মানুষ বিবেক দ্বারা চালিত হতো, এখন চালিত হয় ফেসবুকের লাইক দিয়ে। স্মার্টফোনের দামে বিবেক কিনে নিয়েছে জুকারবার্গের ফেসবুক।

৩. অচেনা 'নেট মানুষ'কে যেমন আপন করে দিয়েছে স্মার্টফোন, তেমনি অতিচেনা বাস্তব মানুষকে ভুলে যেতে শিখিয়েছেও সেই স্মার্টফোন।

৪. পাশের বিছানায় তিনদিনের জ্বরে যে ভাই/বোন/বাবা/মা পুড়ে তামা হয়ে যাচ্ছে তার কপালে কখনো হাত ছোঁয়ায়নি। কিন্তু অতিদূর সমুদ্রের পাড়ে অদেখা আপন কেউ হাঁচি দিলেও আঁতকে উঠে বলছে, 'ম্যান তুমি তো ভীষণ সিক, যাও ডাক্তার দেখাও এখুনি। পাশে থাকলে আমি জলপট্টি দিতাম কপালে।' এও সেই স্মার্টফোন কীর্তি।

৫. একাকীত্ব ঘোচাতে আগের যুগে আত্মীয় বন্ধুর বাড়ি গিয়ে কড়া নেড়ে বলতো, অবনী বাড়ি আছো? এখন আত্মীয় বন্ধুর বাড়ি যাবার বদলে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে খোঁজে 'হু ইজ অনলাইন নাউ'!

৬. পথে যেতে শোনা একটি সংলাপ- 'ফেসবুক, স্কাইপে, ভাইবার, হোয়াটসআপ, ট্যাঙ্গো কিছুই নাই? তাহলে আমাকে খুঁজে পাবে কি করে?'

.....................মাত্র এই ৬টি নয়, আরো অগুণতি আছে!

স্মার্টফোন আমাদের অনেক উপকার করেও যে যান্ত্রিক মানবতা শিখিয়েছে, ভার্চুয়াল বাস্তবতার রাস্তা খুলে দিয়েছে, সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা মনুষ্যত্ব হারিয়ে বরণ করছি টেকনোলজির দাসত্ব!! আমি নিজেও এই দাসত্বের অনিবার্য শেকলে বন্দী হয়ে যাই মাঝে মাঝে।



৩. আত্মঘাতী বাঙালী

নীরদ চৌধুরীকে খুব অপছন্দ করতাম একসময়। বাঙাল বিদ্বেষী লোক বলে খ্যাত। কিন্তু তার আত্মঘাতী বাঙালীতে কিছু অজনপ্রিয় সত্যি কথা পড়ে ভিন্নভাবে ভাবতে হচ্ছে এখন। বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতি আসলেই একটা সংকটপ্রিয় মানবের একটা অংশ। বাঙালী হুমায়ূন আজাদের তিতা কথাগুলোতেও চরম সত্য কথার নজির ছিল। আমার কি দেশপ্রেম কমে যাচ্ছে?


Saturday, October 11, 2014

নাগরিক সন্ধ্যার অঙ্গনে

অপরূপা এক সন্ধ্যে নেমেছে নদীতীরে। শহরজুড়ে সড়কবাতির উৎসবেও কাটে না সম্পূর্ণ আঁধার।

ভাবতে চাই না, এই সন্ধ্যে আসন্ন মধ্য চল্লিশ পেরুনো অথর্ব জীবনের অনিবার্য অংশ। ভাবতে চাই না ফুরিয়ে গেছে কল কোলাহলের সকল বিকেল।

নদীর ঘাটে রাতের আকাশ, আলোড়িত জলে গোধূলির প্রতিবিম্ব এবং আধখাওয়া কৃষ্ণপক্ষ চাঁদের বিলম্বিত আবির্ভাব। তবু কী বিপুল আনন্দ এখনো অবশিষ্ট।

এক কাপ চায়ের সাথে দুটো ধূম্রশলা, হয়ে যাওয়া বৃষ্টির পরিচিত ঘ্রাণ নদীর বাতাসে, প্রলম্বিত আড্ডার একটু প্রহর। যেখানে শুধু আমরা দুজন।

[স্থান: অভয়মিত্র ঘাট]

শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০১৪​

Thursday, October 9, 2014

ফেলে আসা সময়ের ছায়া সবুজ বাড়িটা

প্রিয় অতীত,
তুমি জানো বাড়িটার কোন বিশেষ সৌন্দর্য ছিল না। না ছিল বিশেষ মুগ্ধ হবার মতো কোন বৈশিষ্ট। শুধু একটা ব্যাপার। কোলাহলময় শহরে ওই বাড়িটা ছিল ছোট্ট নিস্তব্ধ একটা গ্রাম। রাস্তা থেকে গেট পেরিয়ে সীমানা দেয়ালের মধ্যে প্রবেশ করলে আমাদের নিজস্ব জগত। আমাদের আনন্দ বাড়ি। তুমি জানো ওখানে একটা বাগানও ছিল। সেই বাড়িটার সামনে অগোছালো একটা বাগান বা উঠোন। বাগানে কিছু বিক্ষিপ্ত গাছপালা। মোট কটা গাছ ছিল বাগানে? কখনো গুনিনি। দাঁড়াও স্মৃতিতে গুনতে চেষ্টা করি। নারকেল গাছ ছিল দুটো। সুপুরি তিনটা। পেয়ারা গাছ পাঁচটা, সেই পাঁচটা গাছের পাঁচ রকমের পেয়ারা, আম গাছ চারটা প্রতিটা গাছের স্বাদ  আলাদা, দেশি আমের মতো পোকা নেই, টকও না। বরই গাছ ছিল দুটো, দেশি বরই, একটু কষা, আরেকটা টকমিষ্ট রসালো। কামরাঙ্গা একটামাত্র কিন্তু ধরেছিল অজস্র ফল। কাঠাল গাছ দুটো, একটা গাছ হাজারি কাঠাল। আগা থেকে গোড়া কাঠালে ভর্তি থাকতো। আরেকটি লেবু গাছ লাগিয়েছিলাম, অনেকদিন লেবু ধরবে ধরবে করে গাছটা বড় হয়ে একদিন যা ধরলো সেটা একটা জাম্বুরা।
সে কথা রাখেনি, তবু আমরা তাতেই কী আনন্দ করেছিলাম। আরো আছে, কলাগাছের কথা তো বলাই হয়নি। অনেকগুলো গাছ ছিল। কিন্তু কলাগাছগুলো ফলের চেয়ে পাতা বেশী উপহার দিয়েছে, কোরবানীর মাংস রাখার কাজে কাজে লাগতো, আর লাগতো পিঠা বানাতে। তবু বছর কয়েক ধরে নিয়মিত কাঁচকলা উপহার দিয়েছিল দুটো গাছ। আর দিয়েছিল কলার থোড়। কলা গাছ কেটে ফেললে সেটার কাণ্ডের মধ্যখানে যে সাদা শাস থাকে সেটা এক মজার তরকারী হতো। চাটগাইয়া ভাষায় তাকে বলা হয় বহলী। সবজি হিসেবে অতুলনীয়। 

বাগানে আরো কটা ফলের গাছ ছিল আতা, জলপাই, আমলকি হাবিজাবি। কিন্তু ওরা কেউ কথা রাখেনি। অথবা আমরা ওদের ঠিকমতো যত্ন নিতে পারিনি। ফুলের গাছের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ছিল মাধবীলতা, সবচেয়ে সুগন্ধী ছিল শিউলি আর হাসনাহেনা। ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাইরে পা রাখলে শিউলিতে সাদা হয়ে থাকতো পথের অনেকটা।  হাসনাহেনার গন্ধে নাকি সাপ আসে, আমার জানালার পাশেই ছিল হাসনাহেনার ঝাড়, কিন্তু আমি কখনো সাপ দেখিনি।  গোলাপ ছিল, কথা রাখেনি গোলাপও। যে রঙের ফুল দেবার কথা তা না দিয়ে অন্য রঙ দিয়েছিল। জবাগুলো অসাধারণ ছিল, সাদা, লাল, গোলাপী। গাঁদা, কসমস, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, এমনকি সূর্যমুখীও ফুটেছে একসময়। 

নিয়মিত ফুলফলের পাশাপাশি ছিল অসংখ্য অজানা অচেনা ঘাসলতাপাতার জঙ্গল। এই যে যাকে বাগান বলছি, তাকে সত্যি সত্যি বাগান বলা যায় কিনা সন্দেহ আছে। এখানে সবকিছু ছিল একদম অগোছালো। কিছু গাছ নিয়ম মেনে লাগানো হলেও অধিকাংশ উঠেছিল স্বেচ্ছাচারীর মতো। পাতাবাহারের ঝোপগুলো বেড়ে উঠতো ইচ্ছেমতো। আমাদের বাড়ির চেয়ে তিনগুন বড় ছিল বাগান, তাই বৃক্ষদের স্বাধীনতা ছিল অবারিত। ওরা ওদের মতো এখানে সেখানে বেড়ে উঠেছিল। একসময় বাগানের আড়ালে হারিয়ে গেল আমাদের আস্ত বাড়িটাই। 

পাশের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কেউ বাড়ি খুঁজে পেতো না, দেয়ালের দক্ষিণ পাশে যে রাস্তা সোজাসুজি চলে গেছে সেখানে দাড়ালে দেখা যাবে শুধুই সবুজ, শুধুই ছায়া। কোলাহলময় ব্যস্ত সড়ক থেকে আকাশী রঙের গেটটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই সুনসান এক সবুজ শান্তির জগত। সেই সবুজের ছায়ার আশ্রয়ে ছিল আমাদের বাড়িটা। আমরা দীর্ঘ ২২ বছর কাটিয়েছে সেই অখ্যাত স্মৃতিময় বাড়িটাতে।

এত বছর পর হঠাৎ খুঁজতে গিয়ে দেখি ওই বাড়িতে তোলা অধিকাংশ ছবি হারিয়ে গেছে। সেই সৌন্দর্যের একাংশও নেই বিদ্যমান ছবিগুলোতে। তবু কয়েকটি ছবি স্মৃতির অংশ হিসেবে যুক্ত করা হলো।


১. মহাসড়কের পাশে বাড়ির প্রবেশ পথে গেটের দুই পিলারের সাথে লাগানো কিছু গাছ ছিল। হাতের বায়ে শিউলি আর কামিনী। হাতের ডানে মাধবী লতার ঝোঁপ। মাধবী লতার ফুলগুলো বেলা বাড়ার সাথে সাথে নিজেদের রূপ বদলাতো। সকালে সাদা, দুপুরে লাল হয়ে যেতো। শিউলি তলাটা সাদা হয়ে যেতো সারারাতের ঝরে পড়া শিউলিতে। শিউলি গাছের পাশেই ছিল আমগাছ, কাঁঠাল গাছ, তার গা ঘেষেই আমাদের বসার ঘরের দক্ষিণের জানালাটা।

বাড়ির উঠোনে মা খালা ভগিনীত্রয়ীর অবসর বিকেল

গাছের কাণ্ড ধরে ঝাকুনি নিলে বরই ঝরে পড়তো
থালা ভর্তি কুড়িয়ে নেয়া বরই


গাছ থেকে সদ্য পাড়া ডাব

সকালের রোদ মেখে দ্বিতীয় প্রজন্মের দুইজন
ঘুম ভাঙা শীতের সকালে বাগানে চেয়ার পেতে রোদ পোহানো


দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে চতুর্থ প্রজন্ম
রাজকীয় জবা বাড়ির ছাদ ছুঁয়ে আম গাছের মগডালে পৌঁছেছে


নিবাসী কাকের ধারণা, এই বাড়ি তার, আমরা নেহাত ভাড়াটে


থোকা থোকা কামরাঙা

জানালার পাশে ঝুলছে কাঠাল, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়
সবুজের ছায়ায় নিঃসঙ্গ কাক

যে ফুলে সুগন্ধ নেই

সমস্ত বাগানে বিস্তৃত সবুজের ছাদ

অবসর বিশ্রামে মা

ঘরের দেয়াল ঘেঁষে বাহারী পাতার মিছিল

মানিপ্ল্যান্টের দেয়াল ভ্রমণ

রাত জাগা ফুল ফোটাবার প্রস্তুতি

দেয়াল বাইছেন ইনিও

ওখানে কে রে?

তৃতীয় প্রজন্মের উর্ধমূখী কৌতুহল

গাছ থেকে পড়ে থাকা পাকা আম


সাদা জবা

অতিথি শালিক

বাগানে দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন



দীর্ঘ বিশ বছরের ইতিহাস থেকে খুঁজে পাওয়া কয়েকখানা মাত্র ছবি দিয়ে এই বাড়ি নিয়ে কিছুই বোঝানো যাবে না। যতটা লেখার সাধ, ক্ষমতা তার চেয়ে অনেক কম।

ফেলে আসা বাড়িটা এখন কেবলই স্মৃতি। খুব প্রিয় একটা স্মৃতিময় অংশ। অথচ, অথচ এতসব স্মৃতির বোঝা ফেলে একদিন চলে যেতে হয়। তারপর.......

সেই সেদিন, অফিস থেকে ফেরার পথে আমাদের সাবেক সেই বাড়িটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি আস্ত বাড়িটা মাটির সাথে মিশে গেছে উন্নয়ন শাবলের আঘাতে, সেই সাথে মিশে গেছে ছায়া সবুজের সকল আশ্রয়। আর কদিন পরেই আকাশচুম্বি দালান খাড়া হয়ে যাবে সেখানে। তখন কেউ ভাবতেই পারবে না, এই জায়গার মাটি দীর্ঘ বিশ বছর সবুজ ছায়ায় নিমজ্জিত ছিল।

একদিন আমিও হয়তো বিস্মরণের পথে হাঁটতে শুরু করবো। তবু তার আগ পর্যন্ত আমাদের ছায়াবাড়িটা নিয়ে স্মৃতির বিলাস চালিয়ে যাবো। মানুষের জীবনটা খুবই ছোট্ট, অনিশ্চিত। অনেক প্রতিশ্রুতি সময়ের স্রোতে হাস্যকর হয়ে যায়। তাই 'আমি আরো লিখবো' এটা কোন প্রতিশ্রুতির দায় বহন করে না। এটা খুব সামান্য একটা ইচ্ছামাত্র।




[অসমাপ্ত]







Wednesday, October 8, 2014

ছুটিময় শহরে বিষাদময় অবসর অতঃপর খানিক আনন্দ ছোঁয়া মুহুর্ত

১.

ঈদের ছুটি শুরু হবার দিন ফেসবুকে লিখেছিলাম-

কিভাবে ছুটি কাটাতে চাই?

"সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শুয়ে শুয়ে একটু বিশ্রাম করি। তারপর হাতমুখ ধুয়ে চা-জলখাবার খেয়ে আবার শুয়ে পড়ি। দুপুরবেলা কষ্টেসৃষ্টে উঠে টানটান করে খাওয়া সারি। দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর ভাতঘুম তো বাঙালীর ন্যায্য পাওনা, দুপুরের পর তাই ভাতঘুমে থাকি। বিকেলে চা জলখাবার খাবার পর ভাবি কোথায়ই-বা যাবো, বরং শুয়েই থাকি। রাতের বেলা খাওয়া সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।"

সৌজন্যে: বিশ্রামগুরু শিবরাম চক্রবর্তী

দেখা গেল আক্ষরিক অর্থে ছুটিটা চুড়ান্ত অলসতায় গেল, যেটাকে খানিক অসুস্থতা বলেও চালানো গিয়েছে। এই অবসাদ, এই ক্লান্তি, কোথাও যেতে ইচ্ছে না করা, কিছু লিখতে না পারা, অথচ নির্ঘুম রাত এইসব কি অসুস্থতার লক্ষণ? আমি ঠিক জানি না, কিন্তু ভেতরের কলকব্জাগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না এটা নিশ্চিত। ৪৫ পার হওয়া মানে ৫০ এর পথে রওনা দেয়া। পঞ্চাশের দিকে সুস্থতার সম্ভাবনা কমে আসতে থাকে ক্রমেই। অগ্রজেরা যে পথে গেছে আমি সেই পথ থেকে ব্যতিক্রম হবো কি করে।

জুবায়ের ভাইয়ের 'সিকি আধুলি গদ্যগুলি' পড়ছিলাম। আগেও পড়েছি, কিছু লেখা বাকী ছিল সেগুলো পড়লাম রাত জেগে। একটা লেখা আরেকটা লেখাকে ডেকে আনে। বইটা আমাকে আরো তিনটা বই পড়তে বাধ্য করলো। আরো কয়েকটা জীবনকে আমার কাছে উন্মুক্ত করলো। চেনা মানুষের অজানা জীবন। আমি দুদিন বুঁদ হয়ে থাকলাম। এমন ঘোর অনেকদিন আসেনি আমার। আমি যখন ব্লগ জীবন শুরু করি, জুবায়ের ভাই তখন জীবনের মায়া ছেড়ে অন্য পৃথিবীর পথে রওনা দিয়েছে। মূলতঃ জুবায়ের ভাইয়ের সবগুলো লেখাই পড়েছি তাঁর অন্তর্ধানের পর। এই বইটা যতবার হাতে নেই, কেমন একটা চাপা কষ্টবোধ পেয়ে বসে। বর্তমান আনন্দময় দিনগুলো থেকে আমি ভাসতে ভাসতে ভবিষ্যতের না হওয়া কোন এক বিষন্ন দিনে ঘুরতে থাকি। তবু এই ছোট্ট বইটার ছোট ছোট বিষন্ন শব্দগাঁথা আমার পড়তে ইচ্ছে করে। অনেক লেখার বিষয়বস্তু চলে যাওয়া। অনেক মানুষের চলে যাওয়া নিয়ে লিখতে লিখতেই তিনি নিজেও একদিন চলে গেলেন। আমি জুবায়ের ভাইয়ের ব্লগস্পটে ঢুকে পুরোনো লেখাগুলো খুঁজে পড়তে থাকি। আমি কি কোথাও নিজেকে খুঁজে পাই ওখানে?

সিকি আধুলি গদ্যগুলির নতুন একটা লেখা পড়লাম পরশু রাতে। ২০০৬ সালে প্রয়াত কবি সুরাইয়া খানমের স্মরণে। একালের খুব বেশী মানুষ তাঁকে চেনে না। সত্তর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েছেন শিক্ষকতা করেছেন, ছিলেন তাদের কাছে ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক সুরাইয়া খানম এক আলোচিত কিংবদন্তী। যত না তাঁর প্রতিভা ও মেধার জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশী রূপের জন্য, সম্পর্কের জন্য। সবচেয়ে বেশী আলোচিত কবি আবুল হাসান এবং লেখক আহমদ ছফার সাথে বিশেষ সম্পর্কের জন্য। লেখাটি পড়ার পর আমাকে পড়তে হলো আহমদ ছফার আত্মজৈবনিক উপন্যাস- 'অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী'। বইটিতে চরিত্রের নামগুলো বদলে দেয়া হলেও অধিকাংশ চরিত্রই আমাদের চেনা। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক থেকে শামীম শিকদার, আহমদ ছফা থেকে আবুল হাসান সবাইকে খুঁজে পাই। ছফার জীবনীকার নুরুল আনোয়ারের মতে উপন্যাসে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা সত্য। এখানেই কিছু গোলমাল লাগে। কারণ ছফার দৃষ্টি দিয়ে বিচার করলে সবার প্রতি ঠিক সুবিচার করা হয় না। আবার তৃতীয় পক্ষের সাক্ষ্য পাওয়াও মুশকিল। আবুল হাসানের কোন সম্পূর্ন জীবনী পাইনি। সুরাইয়া খানমের জীবনির খোঁজও জানা নেই। তবে সুরাইয়া খানমের পরিচয় খুঁজে গিয়ে পেলাম তিনি ভোয়ার দিলারা হাশেমের ছোটবোন। তাঁর আরেক বোন দিলশাদ খানম সত্তর দশকে বিটিভিতে রক্ত করবী  নাটকের নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সেই নন্দিনী যাকে আমি কৈশোরে দেখে এত বছরেও ভুলিনি। জুবায়ের ভাইয়ের লেখাটা আমাকে আবুল হাসান, সুরাইয়া খানম আর আহমদ ছফা ত্রয়ীর সম্পর্কের আরো ইতিবৃত্ত জানার আগ্রহী করায় আমি 'ছফামৃত' পড়ে ফেললাম আরো একবার।

জুবায়ের ভাইয়ের শেষ লেখা ছিল - দুই মাস যখন দুইদিনে নেমে আসে। চলে যাবার এক মাস আগের লেখা অথবা প্রকাশ। লেখাটি অসম্ভব বিষন্ন করে দেয় মন। এই বিষন্নতা কাটাতে নতুন কিছু পড়া দরকার। এই অন্তহীন মন খারাপিয়া চক্র থেকে বের করার জন্য অন্য কোন বই পড়তে হবে। ছফা নয়, আবুল হাসান নয়, অন্য অন্য কোন বই।

২.

ঈদে কোথাও বেড়াতে না গেলেও বাচ্চাদের নিয়ে রাতের বেলা রিকশায় করে পূর্ণিমা দেখতে বেরোলাম গত রাতে। পাশাপাশি প্রবারণা পূর্ণিমার ফানুস উড়ানোর অপরূপ দৃশ্যও দেখা হলো। শত শত ফানুস  আকাশ ছেয়ে ফেলেছে, চাঁদের চারপাশে লালচে তারার মেলা। বাতাসে শীতলতা। অপূর্ব সুন্দর কিছু সময় কাটলো বাইরে। নিস্তব্ধ ছুটির শহরে এ এক পরম প্রাপ্তি।