Monday, October 30, 2023

নতুন শিক্ষাপদ্ধতির তামাশা

 নতুন শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে যারা মতামত দিচ্ছে, তাদের অধিকাংশই এই বিষয়ে অনেকাংশে অজ্ঞ। অর্থাৎ পক্ষ বা বিপক্ষে যারা লিখছে তাদের কারোরই ব্যাপারটা নিয়ে পুরো ধারণা নেই। তাই ব্যাপারটা অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো হয়ে যাচ্ছে। এমনকি সরকারের মন্ত্রীদেরও বিষয়টা নিয়ে পুরো ধারণা নাই। থাকলে একপেশে কথাবার্তা বলতে পারতো না।

আমি বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় সেই কয়েকজন অভিভাবকদের একজন যারা গত বছর থেকে পাইলট প্রকল্প নিয়ে সরকারের এই নতুন শিক্ষাপদ্ধতির ভুক্তভোগী। আমার পুত্র গত বছর পাইলট প্রকল্পে গিনিপিগ ছিল।

তখন থেকে তার সমস্ত পড়াশোনা বদলে গেছে। সে এখন বই পড়ার সময় পায় না। অংক করার সময় পায় না। ইংরেজি শেখার সময় পায় না। তাকে সবগুলো বিষয় পড়তে হয় কাগজ কেটে কেটে। খাতা কলমের বদলে তাকে আমার কিনে দিতে হয় কাঁচি, আর্টপেপার, চার্টপেপার, গাম, রঙপেন্সিল ইত্যাদি। সে বীজগণিতের সূত্র লেখে কাগজ কেটে। তাকে কবিতার লাইন লিখতে হয় কাগজ কেটে বোর্ডে সাঁটিয়ে, তাকে বিজ্ঞান পড়তে হয় সেও কাগজ কেটে, গাম দিয়ে রঙিন বোর্ডে লাগিয়ে। এগুলো করতে যে পরিমান খরচ হয় সেটার কথা বাদই দিলাম, কিন্তু প্রতিদিন রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত সে ঘুমাতে যেতে পারে না এসব করতে গিয়ে। আমি অসহায় হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি সে গলদঘর্ম হয়ে এসব করছে। শুধু কী ছাত্র, ছাত্রের মা বাবা দাদা দাদী সবাইকে ব্যস্ত থাকতে হয় এসব সামলাতে গিয়ে। আমি সেদিন দেখলাম সে কান্না করে দেবার অবস্থা হয়েছে। তাকে হোমওয়ার্ক দেয়া হয়েছে একটা ফসিল তৈরি করতে। তাকে নরম কাদা যোগাড় করতে হবে, গাছের পাতা এনে সেই কাদায় চুবিয়ে রাখতে হবে কয়েকদিন, তারপর সেটা শুকিয়ে ভেতরে যে ছাপ পড়বে, সেটা একটা ফসিলের চেহারা নেবে। তারপর কাদা সহ সেই ফসিল স্কুলে নিতে হবে। আমি ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। বাড়ির কাজ এমন হতে পারে। তখন সে বই খুলে দেখালো বাড়ির কাজ। এখন একটা ফসিল কিভাবে তৈরি হয় সেটা শেখানোর জন্য ঘরে ঘরে যদি কয়েক কোটি ফসিল তৈরির কারখানা করা হয় সেটা কী একটা সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থা? এরকম অসংখ্য পাগলামি উদাহরণ আছে।

সে কারণে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি যার বাচ্চা এই শিক্ষাপদ্ধতির শিকার তারা কেউ এটার পক্ষে কথা বলবে না। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টা পুরোপুরি জানলে এটা এখনই বাতিল করবেন। বাংলাদেশে এত বড় পাগলামি শিক্ষা ব্যবস্থা আর কখনো আসেনি।


বলে রাখি, আমার পুত্র যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলটা একটা বিশেষায়িত স্কুল। সেখানে এসব নিয়ে শিক্ষা দেবার মতো যথেষ্ট অবকাঠামো আছে। তাদের বেশ কয়েকজন শিক্ষক গত বছর থেকে পাইলট প্রকল্পটির প্রশিক্ষক ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে সেই অবকাঠামো খুব কম স্কুলেই আছে। তাই এরকম পদ্ধতি অধিকাংশ স্কুলে জোড়াতালি দিয়ে চলবে। কিছুই দাড়াবে না শেষমেষ। আমার বাচ্চার স্কুলে অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও আমি এই পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধী। শুরুতে আমিও বইগুলো দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলাম। এত সুন্দর বই আগে দেখিনি এদেশে। কিন্তু যখন তার প্রয়োগ শুরু হলো তখন আমার মাথায় বাজ পড়লো। আমি নিশ্চিত যে কোন অভিভাবকেরই এই অবস্থা হবে।


আসলে সময় তো এদেশে সস্তা। সে কারণেই এত নিরীক্ষা চলছে বছরের পর বছর। সারা পৃথিবীতে হাইস্কুল লেভেলে পড়াশোনার যে চাপ যেখানে গণিত বিজ্ঞানের মতো বিষয় শিখতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা হিমশিম খায়, সেখানে আমাদের দেশে এসব খেলো নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। এই ধরণের শিক্ষাগুলো কিণ্ডারগার্টেন লেভেলের বাচ্চাদের জন্য দেয়া হয় উন্নত বিশ্বে। আমাদের দেশে সেগুলো নিয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে হাইস্কুলে।


নতুন শিক্ষাপদ্ধতির আরেকটা উদাহরণ দেই। কাগজ কিভাবে আবিষ্কার হয়েছে সেটা বোঝাতে গিয়ে বাচ্চাদের বলা হয়েছে ঘরে বসে পুরোনো বইপত্র ছিড়ে সেই কাগজ ভিজিয়ে মণ্ড তৈরি করে কাগজ বানিয়ে নিয়ে যেতে। সেই কাগজে আবার গাছের বীজও বুনে দিতে বলা হয়েছে। যেন কাগজ নষ্ট হয়ে গেলে সেটা ফেলে দিলে সেখান থেকে গাছ ওঠে। পৃথিবীটা নাকি এভাবে সবুজ হয়ে যাবে, পরিবেশ রক্ষা পাবে। পরিবেশ বাঁচানোর সেই হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে আমার বাসায় তিনদিন ধরে কত কী কাণ্ড হয়েছে সেটা বলতেও ক্লান্ত বোধ করছি। এরকম একটা নতুন পদ্ধতির বাচ্চা যে বাসায় আছে সে বাসার অর্ধেক সদস্য পাগল হয়ে যাবে।

Saturday, October 28, 2023

ডেটলাইন অক্টোবর ১৯৭৪

 আমাদের শহুরের জীবন তখনো শুরু হয়নি। ১ম শ্রেণীতে ভর্তি হতে আমার আরো দেড় মাস বাকী। সত্তর দশকের সংকটাপন্ন সময়ে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত জীবন। এই জীবনের আবছা স্মৃতি আছে আমার।

৫ অক্টোবর ১৯৭৪




২১ অক্টোবর ১৯৭৪




Friday, October 27, 2023

সংকট এবং কাজ

দুশ্চিন্তা- ১ : সারা পৃথিবী অস্থির হয়ে উঠছে। গাজা-ইসরায়েল সমস্যা মহাযুদ্ধে রূপ নিলে অবাক হবো না। পৃথিবীতে যুগ যুগ ধরে অসভ্য যুদ্ধগুলো সৃষ্টি করেছে সভ্যতম রাষ্ট্রগুলো। 

দুশ্চিন্তা-২ : এই বছরের শেষভাগ বাংলাদেশের জন্য আরেকটা অস্থির সময় নিয়ে আসছে। পৃথিবীর অস্থিরতায় বাংলাদেশও যুক্ত হতে পারে।

দুশ্চিন্তা-৩ :  সারা দেশের মধ্যবিত্ত মানুষগুলো নিঃশব্দে নিন্মবিত্তে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরাও তার বাইরে নই।  সীমিত আয়ের মানুষগুলোর কান্না কারো কানে পৌঁছায় না। 

দুশ্চিন্তা-৪ : ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক অসুস্থতা প্রতি মাসেই হাজির থাকে। অপ্রত্যাশিত আক্রমণে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা যে কোন সময়।


অনুসিন্ধান্ত

কাজই জীবন, জীবনই কাজ। ডানা ভেঙ্গে পড়ে যাবার আগ পর্যন্ত উড়ে যেতে হবে। 

Saturday, October 21, 2023

পিপীলিকার মানবাধিকার!

একটা পিঁপড়া আমাকে কামড় দিলে তার পুরো বাসাটা জুতো দিয়ে পিষে গোষ্ঠিসহ পরপারে পাঠানোর অধিকার আছে আমার। এটার নাম মানবাধিকার। আরো পিঁপড়া এসে কামড়াতে শুরু করলে আমার ভাই বেরাদর লাঠি নিয়ে আসবে, পিঁপড়ার বাসায় কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে পারে। এটাও মানবাধিকার। এ ধরণের মানবাধিকার পৃথিবীতে স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত। পিঁপড়াদের ঘরবাড়ি সংসার থাকার অধিকার নিয়ে কে কখন ভেবেছে?

Saturday, October 14, 2023

মানুষের পৃথিবী, প্রকৃতির পৃথিবী



পৃথিবী নামক গ্রহটা প্রথমে মানুষ নামের একটা প্রাণী দখল করেছে। তারপর সেটা থেকে অন্য প্রাণীদের অধিকার বাতিল করে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করেছে। তারপর নিজেদের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ন ইত্যাদি নানান দলাদলি সৃষ্টি করেছে। তারপর নিজেরা নিজেরা কোন্দল করে একেকটা এলাকা একেকটা জাতিগোষ্ঠির মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। তারপর থেকে এক জাতি অন্য জাতির কাছ থেকে ভূখন্ড দল করার প্রতিযোগিতা করেছে। যার যার শক্তি নিয়ে অন্য দলের ওপর হামলে পড়ে একেকটা অঞ্চল দখল করে দাবী করেছে এটা আমার সীমানা, ওটা তোমার সীমানা। সীমানা নির্ধারণ করার পরও একে অন্যের সীমানায় হানা দিতে থাকে। একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে যেদিন বিজয়ী হয়েছে সেদিন ঘোষণা করেছে আজ আমি স্বাধীন হলাম। সেই তারিখটা লিখে মানচিত্র বানিয়ে একটা পতাকা উঁচিয়ে ঘোষণা করে স্বাধীনতা দিবস। প্রত্যেক জাতির স্বাধীনতা দিবসের একটা শ্লোগান থাকে। গানও থাকে। গানের সাথে বন্দুকও থাকে। শক্তির লড়াইয়ে যে পরাজিত হয়েছে তার কোন স্বাধীনতা থাকে না। কখনো কখনো পরাজিতরা আবার লড়াই করে নিজেদের একটা ভূখন্ড দখল করে। তখন বলে আমরাও স্বাধীন হলাম। এভাবে পৃথিবী জুড়ে শত শত স্বাধীন দেশের জন্ম হয়ে গেল। তাদের সবার পতাকা, মানচিত্র, শ্লোগান, বন্দুক আছে। তার বাইরে শত শত দুর্বল মানবগোত্র রয়ে গেছে যারা এখনো সে সুযোগ পায়নি। যারা পরাজিত তাদের কোন স্বাধীনতা দিবস হয় না, তাদের কোন রাজ্য সীমানা থাকে না। শুধু ভাগ্যবানেরাই জাতিপুঞ্জের সভ্য। ভাগ্যবান বিজয়ীরাই স্বাধীন এবং স্বীকৃত। তাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নানা সংস্থা তৈরি আছে। সেই সংস্থার কাজ হলো বিজয়ী শক্তিমান জাতিগুলোর স্বার্থরক্ষা করা। পতাকা, সীমানা, মানচিত্র এবং বন্দুক চালাবার অধিকার সংরক্ষণ করা। সারা পৃথিবীর মানুষ এটাকেই সভ্যতা বলে মেনে নিয়েছে। স্কুল থেকে পই পই করে মুখস্থ করে শিখিয়ে দেয়া স্বাধীনতা ও গৌরবের সংজ্ঞা। তবু তাতেও সবার শান্তি হয়নি। এখনো দেশে দেশে সীমান্ত অধিকারের যুদ্ধ চলে। এখনো সুযোগ পেলে এক দেশ অন্য দেশের সীমান্তে হানা দেয়। যে দেশের সীমানায় একাধিক জাতি-ধর্ম-বর্নের বসবাস, সেখানে পরস্পরের মধ্যে হানাহানি চলে নিরন্তর। গুহাবাসী থাকার সময় পাথরের অস্ত্র নিয়ে যা করেছে, সভ্যতার শীর্ষে ওঠার পর আধুনিকতম প্রযুক্তি নিয়েও তাই করছে। প্রযুক্তি বদল হলেও চরিত্র কিছুই বদলায়নি। যার যত বেশি অস্ত্র সভ্যতার ওপর তার অধিকার তত বেশি। যার যত শক্তি, পৃথিবীতে তার তত বেশি যুক্তি। সে যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য দুর্বল জাতিগুলো। আবার দুর্বল জাতিগোষ্ঠির হাতে অস্ত্র-প্রযুক্তি আসার পর তার চরিত্র বিবর্তিত হয়। তখন সেও আগ্রাসী শক্তিতে দুর্বলের ওপর আঘাত করতে শুরু করে। অধিকাংশ শক্তিমান রাষ্ট্র ভয়ানক আগ্রাসী। পশুদের রাজ্য নেই বলে তাদের মধ্যে আগ্রাসন নেই, সন্ত্রাস নেই, দলগোত্রভেদ নিয়ে মানচিত্র ভাগাভাগি নেই। এটা শুধু মানবজাতিরই ধর্ম। আত্মগৌরবে অধিষ্ঠিত নিকৃষ্ট মানবধর্ম। গুহাবাসী মানুষের তুলনায় বহুগুন নিকৃষ্ট সভ্য মানুষ। সভ্যতার বিবর্তনেই মানুষ এই নীচতা অর্জন করেছে। সভ্যতার বিবর্তন একদিকে যেমন সুসভ্য জনগোষ্ঠী তৈরি করেছে, অন্যদিকে এরকম অসভ্য গোষ্ঠিও তৈরি করেছে। মানুষের এই পরিবর্তন প্রাকৃতিকভাবে পরিশোধিত হবে নিজেদের হাত ধরেই।

মানুষ বাদে অন্য প্রাণীরা এই পরিবর্তনের কিছুই জানে না। তাদের কোন দুশ্চিন্তাও নেই এসব নিয়ে। কারণ তাদের পড়াশোনা নেই। তাদের কোন ধারণা নেই মানুষ সভ্যতার সংজ্ঞা লেখার সময় তাদের নাম কেটে বাদ দিয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস জানে। তাদের কাছে পুরো মানবজাতিই একটা মূর্তিমান আগ্রাসন। বাকী প্রাণীজগতের কাছে মানবসমাজ একটা জীবন্ত সন্ত্রাস। কিন্তু তাদের কাছে এই সন্ত্রাস নিবারণের কোন উপায় নেই। তারা এটাকে ভূমিকম্প, ঘুর্ণিঝড় কিংবা মহামারীর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে মেনে নিয়েছে। তাদের কোন ভাবনার কথা আমরা জানি না, কারণ তারা বই লিখতে শেখেনি। বক্তৃতা দিতে জানে না। অন্তত একটা ভাষা শিখলেও মানুষ তাদের ভাবনার কথা জানতে পারতো। কিন্তু তা হবার নয়। তারা জানে না মানুষ কিভাবে সীমান্ত সীমান্ত খেলা করে। মানুষ কিভাবে নিজেদের সংজ্ঞায় সভ্যতার মাত্রা ঠিক করে। তারা এটাও জানে না এত অসভ্যতা করেও মানুষ নিজেকে এই জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছে। তারা এটাও জানে না মানুষ নিজের তৈরি করা সভ্যতার সংজ্ঞার মধ্যে নিজেরাই নির্বিচারে মারা পড়ছে একে অন্যের হাতে। স্রেফ অকারণে। মানুষকে তারা হাস্যকর প্রাণী বলে ভাবে কিনা সেটাও আমাদের জানা নেই। এখনো মানুষের ভাষায় বলতে শেখেনি, লিখতে শেখেনি। অন্য প্রাণীদের বক্তব্য শোনার আগে মানুষ নিজেকে সভ্যতম প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করা স্রেফ হাস্যকর। কিন্তু অন্য প্রাণীদের হাসি আমরা দেখতে পাইনা। কারণ মানুষ বিশ্বাস করে অন্য প্রাণীরা হাসতে জানে না।

একদিন এই সভ্যতম প্রাণীটা নিজেদের অস্ত্রে নিজেদের সমূলে বিনাশ করবে। সেদিন মানবজাতির সব হাসি থেমে যাবে। প্রকৃতি শুধু মানবজাতির জন্য এই গ্রহটা আলাদা করে তৈরি করেছে, এই বিশ্বাস নিয়ে যারা বেঁচে আছে, তাদের কেউ সেদিন থাকবে না।

Thursday, October 12, 2023

সভ্যতার অসভ্যতা

মানব সভ্যতার একটা দুর্ভাগ্য যখন যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে, তখন তাদের অন্যায় করার সীমাহীন অধিকার থাকে। শক্তিমানদের হাতে অন্যায় করার যুক্তি মজুদ থাকে। 

ধর্ম এবং রাজনীতি আধুনিক মানুষের অসভ্যতার হাতিয়ার।

হামাস বাহিনী ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে শতশত নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে শতাধিক নারীপুরুষকে। তার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল বাহিনী পাল্টা হামলা চালিয়ে আরো শত শত নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে গাজা শহরে। আমেরিকাসহ পুরো পশ্চিমা শক্তি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে। আমেরিকা সর্বশক্তি নিয়ে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত  এবার পুরো প্যালেস্টাইনের মানচিত্র আরেকবার বদলে যাবে। একটা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আরো কয়েকগুন অন্যায় করা হচ্ছে। 

হামাস এমন একটা অপকীর্তি করেছে, যার মূল্য পরিশোধ করছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ।

আজ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইসরায়েলে গিয়ে সংহতি জানিয়েছে ইসরায়েলের সাথে। হামাসকে ধ্বংস করে দেবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। সেটা করুক। কিন্তু একবার একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না হামাসের হামলার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পুরো গাজা শহরকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে, হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে যাচ্ছে নির্বিচারে। মানুষকে পালাবার সুযোগও দিচ্ছে না। বিদ্যুত পানি খাদ্য ওষুধ সবকিছুর সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। সীমান্ত বন্ধ করে ইঁদুরের মতো হত্যা করছে। কয়েক হাজার হামাস যোদ্ধার উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য বাইশ লাখ মানুষকে ধ্বংসের মুখোমুখি ঠেলে দিয়েছে। সে ব্যাপারে আমেরিকা একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। এতে মনে হয় শুধু ক্ষমতাবানদের প্রাণের মূল্য আছে, দুর্বলের প্রাণ পিপড়ারও অধম। 

বাকী পৃথিবী এখনো বুঝতে পারছে না কার নিন্দা করবে, কার পক্ষ নেবে। 

আমরা অপেক্ষায় থাকবো আরেকটি পরিবর্তনের জন্য।



Wednesday, October 11, 2023

যাদের ভুলে গেছি: রেলওয়ে কর্মকর্তা শহীদ শফি আহমেদ

 রায়হানা শফিকে আপনারা চেনেন না হয়তো। চেনার কথাও না। তিনি বিখ্যাত কেউ নন। সাধারণ একটি চাকরী করে সংসার চালান। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন একা একাই। প্রবল মানসিক জোর না থাকলে তিনি টিকতে পারতেন না। তাঁর মানসিক শক্তির যোগান দেয় ছোট্ট একটি জুয়েলারী বাক্স। যুগের পর যুগ পার হয়ে গেলেও তিনি বাক্সটি আগলে রেখেছেন। জুয়েলারী বক্সে কী আছে বাইরের কেউ জানে না। মাঝে মাঝে দেখা যায় আলমারি থেকে তিনি সেই বাক্সটি বের করেন এবং ডালা খুলে আলতো হাতে ছুঁয়ে কিছু একটা স্পর্শ করেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে রাখার চেষ্টা করেন। তাঁর কাছে সেই দিনটি এখনো গতকালের ছবির মতো পরিষ্কার।


চট্টগ্রামের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য নিয়ে সিআরবি পাহাড়ের উপর ছোট ছোট বাংলোগুলো দাঁড়ানো তার একটিতে ছিল তাঁর বসবাস। তিনি এখন যেখানে থাকেন তার কয়েকশো গজ দূরেই ছিল তাঁর সেই বাংলোটির অবস্থান। তাঁর স্বামী রেলওয়ের চীফ প্ল্যানিং অফিসার। তার পাশেই ছিল ডেপুটি সুপার মকবুল আহমেদের বাংলো। দুজনেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন লালন করতেন। স্বামীদের পাশাপাশি স্ত্রীরাও রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান। রায়হানা শফি নিজে আওয়ামী লীগের রেলওয়ে শাখার সভানেত্রী। 

৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পর থেকে সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। তখন এই দুই বাড়িতে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাদের গোপন বৈঠকগুলো বসতো পাহাড়ের অন্তরালে। মাঝে মাঝে খুব গোপনে এখানে যোগ দিতেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের বাঙালী সামরিক অফিসারগণও। পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকলে ঘন ঘন বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে থাকে নেতাদের মধ্যে।

রায়হানা শফি তখন ৩/৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ২৪শে মার্চ হঠাৎ একটা টেলিফোন আসে শফি আহমেদের বাড়িতে। টেলিফোনে কারো সাথে কথা বলে দ্রুত তৈরী হয়ে একা বেরিয়ে পড়েন তিনি তাঁর ৯২৯২ নম্বরের টয়োটা করোলা গাড়িটি নিয়ে। মিসেস শফি কিছু বুঝতে না পেরে কিছু একটা অমঙ্গল আশংকায় পাশের বাংলোতে মিসেস মকবুলের কাছে খোঁজ নিতে গেলেন। মিসেস মকবুল জানালেন চিন্তার কিছু নেই, শফি ভাই খানিক পরেই চলে আসবেন আরো কয়েকজনকে নিয়ে। আমার কাছে ঢাকা থেকে গোপন মেসেজ এসেছে তাদের জন্য। কিছুক্ষণ পর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে শফি সাহেবের গাড়িটাকে আসতে দেখা গেল। তিনি নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন।

গাড়িটা কাছে আসলে কয়েকজন বাঙালী সামরিক অফিসার নামলো গাড়ি থেকে। লে.কর্নেল এম আর চৌধুরী, মেজর জিয়া এবং ক্যাপ্টেন রফিক। লে.কর্নেল চৌধুরী ছিলেন শফি আহমেদের আপন খালাতো ভাই। তিনি মিসেস মকবুলকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাবী কোন মেসেজ আছে? মিসেস মকবুল জানালেন, হ্যাঁ ভাই আছে। ক্যাপ্টেন আমিন ফোনে আপনাদের বলতে বলেছেন, কোন অবস্থাতেই যেন 'লাল ফিতা' না ছাড়েন।

কথা শুনেই এম.আর. চৌধুরীর মুখ লাল হয়ে গেল উত্তেজনায়।এরপর ওরা চারজন চলে গেলেন লুৎফুল করিমের বাংলোর পেছনে বড় গাছে ঢাকা জঙ্গলাবৃত জায়গায়।

পরে রায়হানা শফি জানতে পারেন সোয়াত জাহাজের অস্ত্র নামানোর জন্য মেজর জিয়াকে যে হুকুম দেয়া হয়েছে সেটা অমান্য করে বিদ্রোহ করার জন্য মেজর জিয়াকে ডেকে এনেছেন ক্যাপ্টেন রফিক যিনি প্রায় নিশ্চিত পাকিস্তানীরা বড় ধরনের গনহত্যার আয়োজন করছে। 'লাল ফিতা'র কোডের অর্থ হলো অস্ত্র। সেই সময় পাকিস্তানীরা কৌশলে বাঙালী সৈন্যদের অস্ত্রগুলোকে হস্তগত করার পরিকল্পনা করেছিল। ঢাকা থেকে বলা হয়েছে কোন অবস্থাতেই যেন বাঙালী সৈন্যরা অস্ত্র সমর্পন না করে।

কিন্তু ২৪ মার্চ তারিখ ক্যাপ্টেন রফিকের বিদ্রোহ পরিকল্পনায় সায় দিতে পারেননি বাকী সেনাকর্তারা। তাঁরা আশাবাদী ছিল হয়তো আলোচনা সফল হবে। কিন্তু তার ২৪ ঘন্টা পরেই ইয়াহিয়া বাঙালীদের উপর চরম আঘাত হানার হুকুম দিয়ে ঢাকা এয়ারপোর্ট ত্যাগ করেছিল।

[খসড়া লেখা]



===============================

লেফটেনেন্ট কর্নেল এম.আর. চৌধুরীর কথা মনে আছে? ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে যাকে হত্যা করেছিল? তাহলে নিশ্চয়ই মনে আছে  মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের লেখা 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' বইটিতে উল্লেখিত সেই ঘটনাটি। লে.কর্নেল. এম.আর. চৌধুরী ২৪শে মার্চ সন্ধ্যার পর মেজর জিয়াউর রহমানকে নিয়ে সিআরবি পাহাড়ে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে মিলিত হয়ে পাকিস্তানীদের আসন্ন আক্রমন নিয়ে আলাপ সেরে পাশেই তাঁর এক আত্মীয়ের বাংলোর দিকে চলে গিয়েছিলেন। বইটিতে অবশ্য সেই আত্মীয় সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া ছিল না।

আরেকটু সুত্র থেকে তথ্য মারফত জানা যায় সেই আত্মীয়টির নাম শফি আহমেদ, যিনি রেলওয়ের চীফ প্ল্যানিং অফিসার যিনি লে.কর্নেল এম.আর. চৌধুরীর ঘনিষ্ট আত্মীয়, তাঁর আপন খালাতো ভাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে যে কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা চট্টগ্রামে সরাসরি যুক্ত ছিলেন শফি আহমেদ তাদের একজন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব নিবেদিত প্রাণ মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা ইতিহাস থেকে মুছে যাবার উপক্রম তিনি তাঁদেরও একজন।

অন্তর্হিত মানবতা

 

১.
একদল হিংস্র পশু এবং একদল হিংস্র মানুষের মধ্যে সভ্য আচরণের তুলনামূলক বিচার করলে পশু সমাজ যে এগিয়ে থাকবে তা আমরা এখন আর কেউ অস্বীকার করতে পারি না। পশুর হিংস্রতা কোন একটি মৌলিক চাহিদা পূরণ ঘটিত সমস্যা থেকে উদ্ভুত হয় এবং সেই হিংস্রতা প্রয়োগের একটা মাত্রা থাকে একটা যুক্তি থাকে। কিন্তু মানুষ কোন রকম যৌক্তিক কারণ ছাড়াই স্বজাতির উপর চড়াও হয়ে চরম নির্মমতার পরিচয় দিতে পারে খুব অনায়াসে।

বাঘ সিংহ গণ্ডার কয়োট হায়েনা বেড়াল কুকুর যেই হোক, সবাই নিজ নিজ সীমানাটা মেনে চলে। সিংহ কখনো বেড়ালকে কামড়ে দিয়ে বলে না তোর কেন কেশর হয় না, কিংবা হাতি কখনো কুকুরকে লাথি দিয়ে বলে না তুই কেন শুড় দিয়ে মাংস খাস না। আন্তঃপশু সংঘর্ষের কোন সংবাদ আমরা তেমন দেখি না। পশুরা কী করে যেন একটা সুশৃংখল সভ্যতা গড়ে তুলেছে সেটা খুব আশ্চর্যের। অথচ তাদের কোন রাষ্ট্রনায়ক নেই, মহামানব নেই, অবতার নেই, দেবতা নেই, পথ নির্দেশক নেই। তাদের নেই কোন রাষ্ট্র, ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন, বিদ্যালয়, উপাসনালয়। এসব কিছু না থেকেও ওরা আদি থেকে এই সভ্যতা ধরে রেখেছে।

প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের রাষ্ট্র, নেতা, ধর্ম, মহামানব, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবকিছু আছে। এই সব কিছুর যোগফল নিয়ে মানবকূল পৃথিবীটা দখল করে শাসন করছে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাকী প্রাণীসমাজ অবশ্য জানে না ‘মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব’, জানার মতো শিক্ষাদীক্ষাও তাদের নেই। জানলে এই শ্রেষ্ঠত্ব বিনাতর্কে মেনে নিতো কিনা সন্দেহ আছে।

কিন্তু মানব সমাজের বাইরে একটা তৃতীয় অবস্থান নিয়ে যদি আমি মানুষ এবং অন্য প্রাণীদের তুলনামূলক অবস্থানটা দেখি, তাহলে দেখবো, প্রযুক্তি, জ্ঞানবিজ্ঞান এবং ক্ষমতার দিক থেকে মানুষ বর্তমানে শ্রেষ্ঠ অবস্থানে আছে (৫০ হাজার বছর আগে হলে এটা বলতে পারতাম না) এটা সত্যি হলেও যাকে আমরা গড়পড়তা ‘মানবতা’ বলি, সেই হিসেবে মানুষ পশুদের চেয়ে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে।

মানুষকে বাই ডিফল্ট শ্রেষ্ঠ ধরে ভালো গুন সমৃদ্ধ অর্থে ‘মানবতা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মানবতা বলতে মায়া দয়া স্নেহ মমতা সমৃদ্ধ একটি উদার একটি চরিত্রের নিদর্শনকে বুঝি। অথচ মানুষের ভেতরে যে চরম স্বার্থপর হিংস্রতম নির্দয় চরিত্রের অন্ধকার বিষয় লুকিয়ে আছে তাকে প্রকাশ করতে গেলে আমরা পশুর নামানুসারে আখ্যায়িত করি ‘পশুত্ব’ বলে। যদিও যুক্তিহীন নির্দয় হিংস্রতার ব্যাপারে পশু সমাজ একদমই নিষ্পাপ। মানুষের মতো অযৌক্তিক হিংস্র হওয়া কোন পশুর পক্ষে সম্ভব না। তাই মানুষের অমানবিক আচরণের প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পশুত্ব’ শব্দটি বাদ দিয়ে আমাদের উচিত মানব উপযোগী নতুন একটি শব্দের উদ্ভাবন করা। মানুষের কুৎসিত আচরণের দায় নির্দোষ পশু সমাজের উপর চাপানো নিতান্তই অপমানের সামিল।

২.
খুব সাদামাটাভাবে তাকালেও দেখি মানুষের প্রাণীত্ব স্বভাবের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত শুভবুদ্ধিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। যেটাকে অবক্ষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তো অবক্ষয়টা চরম বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। ব্যক্তি মানুষের হিসেব করতে গেলে প্রতিটা মানুষের ভেতর শুভ অশুভ চেতনার মিশ্রন আছে। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে এই বোধগুলোর প্রভাব বিস্তারের মাত্রা ওঠানামা করে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা যায় অশুভ বোধ প্রবলভাবে আক্রান্ত আমাদের জনগোষ্ঠির বিশাল একটা অংশ।

গত শতকের শেষ দিকেও আমরা মাঝে মাঝে শুনতাম এই অবক্ষয়ের কথা, কিন্তু তখনো সেটা একটু দূরে ছিল, শোনা কথা, পত্রিকার পাতা ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ থাকতো। এই শতকের দ্বিতীয় দশকেই এসে তা এতই ভয়াবহ রূপে আক্রমণ করবে তা গত শতকে আমরা কল্পনাও করিনি। আমাদের প্রচুর দুর্বলতা আছে চরিত্রের, প্রচণ্ড সীমাবদ্ধতা আছে চিন্তা জগতের, আত্মকেন্দ্রিকতার অন্ধকার প্রচণ্ড। ভার্চুয়াল মননশীলতার বিচার করার জন্য বাঙালীর ফেসবুক ভুগোলে পরিভ্রমণ করেও অনেকটা অন্ততঃ আঁচ করা যায়। যদিও এই বাঙালী মধ্য এবং উচ্চবিত্ত বাঙালী। অনুমান করি শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ এর অন্তর্ভুক্ত নয়। শ্রমজীবি কিংবা প্রান্তিক মানুষেরা এই জগতে নেই। কিন্তু একটা দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটাকে দিয়ে বিচার করা হয় সেই সমাজের মানবিক অবস্থান। এই অবস্থানটা অতিমাত্রায় সংকীর্ণ মানসিকতায় ভরপুর। এখানে শিক্ষা রুচি আর্থিক অবস্থা কোনটাই এই সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করতে পারেনি মানুষকে। যে যেই মতবাদে বিশ্বাসী তার বাইরের কাউকে মানুষের মর্যাদা দিতেও রাজী না। ন্যুনতম শ্রদ্ধাবোধ দূরে থাকুক, তার জীবনেরই কোন দাম নেই প্রতিপক্ষের কাছে। সেটা ধর্মীয় হোক বা রাজনৈতিক হোক কিংবা সামাজিক মতবাদ হোক।

তবু একটা সময় ছিল যখন কেবল পক্ষ বিপক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল এই বিরোধীতা। হিংসা হানাহানি যাই হতো তা নিজ নিজ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই হতো। তার বাইরের কেউ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে এটা আমরা দশ বছর আগেও কল্পনা করিনি। এই বাংলাদেশে এখন তাই হচ্ছে। কে কখন কার লক্ষবস্তুতে পরিণত হবে কেউ জানে না। কে কখন কার হাতে খুন হবে কেউ জানে না। চোখের সামনে দেখতে দেখতেই একটি আত্মহত্যাপ্রবণ অপরিণামদর্শী সমাজে বিবর্তিত হয়ে গেছি আমরা। সমস্ত জাতির রক্তে অজানা কোন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ শিরা উপশিরা বেয়ে শুভবুদ্ধির প্রধান আশ্রয়কেন্দ্র মগজকে আক্রান্ত করেছে। মগজে মগজে অমানুষ। কত হাজার কত লক্ষ কত কোটি, এখনো ঠিক জানি না। শুধু জানি আমরা ‘ভালো নেই’। আমরা ‘ভালো নই’।

কেন ভালো নই? কেননা এইসবের জন্য আমিও দায়ী, আপনিও দায়ী, আমরা সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে কোনভাবে অবশ্যই দায়ী। আমরা নিজ নিজ স্বার্থের বাছবিচার করে অশুভকে শুভ বলেছি, শুভকে অশুভ করেছি। আমাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়েই বেড়ে উঠেছে বিষবৃক্ষ। সময়ে সময়ে আমরা বপন করেছি বীজ, রোপন করেছি চারা, সার দিয়েছি, জলপানি দিয়েছি। সময়ে সময়ে আগাছাকে বাড়তে দিয়েছি অন্যের বাগান গ্রাস করবে বলে। অন্যের বাগান আক্রান্ত হলে আমরা পুলকিত হই। কিছু কিছু ধ্বংস আনন্দ দিয়েছে আমাদের কাউকে কাউকে। আর এখন সেই আগাছা, সেই বিষবৃক্ষ অন্যের বাগান খেয়ে আমার নিজের বাগানেও হানা দিয়েছে।

এখন আমরা নিজেদের তৈরী ফ্রাংকেনস্টাইনে নিজেরাই আক্রান্ত। তবু কি আমরা কিছু না করে বসে থাকবো? নিজের অবস্থানে ঠায় বসে থাকবো নাকি একটু সরে এসে দানবের শক্তিকে রুখে দেবার জন্য সমাজকে তৈরী করবো?

[দিনলিপি: ২০১৮]


Sunday, October 1, 2023

সেই সব অদ্ভুত দিন: সিগারেটের জন্য হাহাকার

 


দৈনিক বাংলা, ৩ আগষ্ট ১৯৭২

পৃথিবীতে এক সময় এরকম দিনও ছিল যখন সিগারেট জিনিসটা ভাত কাপড়ের মতো জরুরী ছিল। তার জন্য হাহাকার ছিল। এখন যে কেউ আঁতকে উঠবে কিংবা হেসে দেবে। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগে ওটাই ছিল  বাস্তবতা।