Tuesday, February 17, 2009

একটি স্মৃতিকথা কিংবা উপন্যাসের সারাংশ

সংশপ্তকের মালুর কথা মনে আছে? আর তার রানুদি? তিরিশ বছর আগে মালুর বয়সে আমারও একটা রানুদি ছিল। রানুদি তখন গ্রাম্য তরুনী কিন্তু শহুরে স্মার্টনেস আর সৌন্দর্য দুই মিলিয়ে অতুলনীয়। সুন্দরের ঐশ্বর্য কখনো সম্পদ কখনো বোঝা। রানুদির ক্ষেত্রে সেটা হয়েছিল বোঝা। সৌন্দর্যের অরক্ষনীয়তা বিপদের সামিল। তাই সমস্যা শুরু হবার আগেই রানুদিকে এসএসসি পরীক্ষার পরপর শহরে পাঠিয়ে দেয়া হয় ছোটখালার বাসায় মানে আমাদের বাসায়। গ্রামীন শ্বাপদের উপদ্রপ থেকে রক্ষা পায় রানুদি। সেই বয়সে আমি ছিলাম রানুদির হাতের লাঠি কিংবা দেহরক্ষী। সার্বক্ষনিক সঙ্গী। ছেলেবেলা থেকেই রানুদি ছিল আমাদের পরিবারের খুব আপন। নিজের বোনের চেয়েও বেশী প্রিয় আমার। রানুদি ছিল একটা জীবন্ত গল্পের ঝুড়ি। ফলে তাঁর আগমন খুব কাংখিত ছিল আমাদের জন্য। ছোটরা সবাই আনন্দে হি হি মেতে উঠলাম তাঁকে দেখে। এখানে থেকেই কলেজে পড়াশোনা করবে রানুদি।

আলোকমান সৌন্দর্য যেখানে যায় সেখানেই আলো ছড়ায়। একদিন আমাদের বাসায় এক সুদর্শন যুবকের আগমন ঘটলো। নাম সাজু। নম্র ভদ্র অমায়িক যুবক অল্পদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ চুকিয়ে একটা কলেজে শিক্ষকতার কাজ নিয়েছে। অবসরে সঙ্গীতচর্চা করে, খন্ডকালীন সঙ্গীত শিক্ষক। মামাতো বোন শাহীন আপাকে গান শেখাতে এসে একদিন রানুদিকে দেখে মামার বাসায়। প্রথম দেখাতেই ভালোলাগা, অতঃপর ভালোবাসা। রানুদিও সমানে সমান। সেই থেকে সাজুভাই প্রায়ই আমাদের বাসায় চলে আসতো নানান ছুতোয়। রানুদির সাথে গল্প করতো ঘন্টার পর ঘন্টা। একদিন বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে ফেলে। আমার বাবা-মা প্রথমে সায় না দিলেও রানুদির বাবা মানে খালুর কাছে খবর গেলে খালু সানন্দে রাজী হয়ে যায়। এমন মার্জিত উচ্চশিক্ষিত যোগ্য পাত্র কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। তেমন কোন আয়োজন ছাড়া হুট করে বিয়েটা হয়ে যায় আমাদের বাসায়ই। কয়েকমাস পর আলাদা বাসা নেয় সাজুভাই। রানুদির এই সংসার যাত্রায় আমরা খুব আনন্দিত। বেড়ানোর একটা জায়গা হলো। বছর না ঘুরতেই রানুদির কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান। নাম রাখা হয় সেতু।

সেতুর বয়স যখন এক বছরের মতো, হঠাৎ একদিন রানুদি হাঁপাতে হাঁপাতে বাসায় এলো। সাজুভাই নাকি সেতুকে নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা বলে কোথাও চলে গেছে গতকাল। এখনো ফেরেনি। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা সবাই ছুটলাম। পরিচিত সব জায়গায় খোজ নিলাম। না, কোথাও পাওয়া গেল না। কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল বাসায়। রানুদি পাগলিনী হয়ে গেল। বহু খোজ খবর গোয়েন্দাগিরি করে মামা খালুরা সেতুর খোঁজ পায় কদমতলীর এঁদোগলির একটা বাসায়। তারপর অনেক থানা পুলিশ আদালত করে সেতুকে উদ্ধার করা হলো। জানা গেল সাজু পালানোর সময় এই বাসায় এক মহিলার কাছে সেতুকে রেখে যায়।

সাজুর পালানোর রহস্যটা কী। রানুদি আস্তে আস্তে সব বললো। বিয়ের পর থেকেই সাজুর অন্য একটা চেহারা দেখা যায়। রানুদি কাউকে বলেনি কারন রানুদি সাজুভাইকে খুব ভালোবাসতো, চায়নি তার অমর্যাদা করতে। সাজু ছিল মদ্যপ, অগনিত মেয়ের প্রতি আসক্ত, চরিত্রহীন, লম্পট। কোথাও বেশীদিন চাকরী করতো না। কলেজের চাকুরীটা ছেড়ে দেয় বিয়ের পরপর। তারপর আরেকটা ধরে। তারপর আরেকটা। এরপর বেকার। তারপর যৌতুক দাবী করে খালুর কাছে ব্যবসা অথবা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য টাকা চায়। খালুর অত টাকা দেবার সামর্থ্য ছিল না। চাকরী না করে খালুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংসার চালাতো। রাতে কখনো বাসায় ফিরতো কখনো ফিরতো না। কোথায় কী করতো রানুদি জানতো না। তখন থেকেই সাজু রানুদিকে ছেড়ে পালানোর চিন্তা করে। এই ব্যাপারগুলো পরে যখন জানলাম তখন ঘৃনায় রি রি করে উঠলো সবার শরীর। কিন্তু ততদিনে দেরী হয়ে গেছে।

ডিভোর্স ইত্যাদি শেষ হবার পর রানুদি নতুন জীবন শুরু করে। কলেজে ভর্তি হয় পাশ করে এনজিওতে কাজ নেয়, নিজের পায়ে দাঁড়ায়। রানুদির দ্বিতীয় বিয়ে হয় কয়েক বছর পর। তখন থেকে সেতুকে নানা-নানীর কাছে রেখে মানুষ করা হয়। সেতু বড় হতে থাকে, তবে বাবার পরিচয় অজ্ঞাত থাকে। সে শুধু জানে বাবা চলে গেছে মাকে ছেড়ে, কিন্তু পুরো ঘটনা গোপন রাখা হয় ওর বড় হবার অপেক্ষায়। স্কুলের উপরের দিকের ক্লাসে পড়ার সময় একদিন সেতুকে আমাদের বাসায় এনে আস্তে আস্তে ওর বাবার সব কাহিনী বলে শোনানো হয়। শুনে সেতু কাঁদেনি, কিছু বলেনি, কিন্তু পাথর হয়ে থাকে। শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। শোকে নাকি অপমানে জানি না।

আমাদের খুব কষ্ট হতো সেতুর কষ্টে। পরে আমরা আর কখনোই ওর বাবার প্রসঙ্গে কথা বলতাম না ওর সামনে। সেতু দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে, রানুদির চেয়েও সুন্দরী। এত সুন্দর অথচ এত শান্ত মেয়েটি। সেতুকে আমরা কেউ রাগতে দেখিনি। সবসময় হাসিখুশী উচ্ছ্বসিত। কিন্তু ওর হাসিখুশী চেহারার পেছনে কি একটা বিপুল বেদনা লুকিয়ে আছে কেউ কী ভাবতে পারবে? কোন কোন মানুষকে বোঝা খুব কঠিন। ভাবতে খারাপ লাগতো, মা-মেয়ে দুজনের জীবন কত সুন্দর হতো যদি সাজু এই প্রতারনাটা না করতো। আমি ওকে কখনোই ক্ষমা করবো না। এটা আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল। সাজু টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিল। বিটিভিতে গান গাইতো মাঝে মাঝে, নজরুল গীতির অনুষ্ঠানে দেখতাম। দেখে ঘৃনা আরো উপচে পড়তো। যদি সারা দেশের মানুষের কাছে এই প্রতারকের মুখোশ খুলে দিতে পারতাম? সাজুর খোঁজ খবর নেয়ার একটা সুত্র ছিল আমাদের, সেই সুত্রে খবর পেতাম সাজু আরো অন্তত ৪ টা মেয়ের সর্বনাশ করেছে রানুদির মতো। ৪র্থ বার পালাতে পারেনি। কারন ৪ নম্বর বউ কঠিন ছিল। সাজুকে বেঁধে ফেলেছে। ততদিনে সাজু ঢাকায় স্থায়ী হয়েছে, টিএন্ডটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নামকরা লোক। তবে ভয়ে চট্টগ্রাম আসতো না। চেষ্টা করতো কখনো যাতে চট্টগ্রাম বদলি না করে।

সেতু একদিন ঠিকানা যোগাড় করে চিঠি লেখে বাবাকে। আসলে রানুদিই ঠিকানা যোগাড় করে দিয়েছিল। রানুদি চাইতো সেতুর সাথে যেন বাবার সাথে যোগাযোগটা থাকে। হাজার হলেও আসল বাবা তো! আমরাও বারন করি না। সাজু সেতুকে একবার গোপনে দেখে যায়। তার বর্তমান স্ত্রী সন্তানগন জানেনা সে আগে কয়টা বিয়ে করেছে। সাজু ভয়ে থাকতো জানাজানি হবার। যোগাযোগ সৃষ্টি হবার পর আমরা ভেবেছিলাম সে অন্ততঃ সেতুর জন্য কিছু একটা করবে। কিন্তু না, সাজু চরম স্বার্থপর। কিছুই করেনি সে। অভিনয় পারদর্শীতায় সাজু যে কোন থিয়েটার কর্মীকে হার মানাতে পারবে। যোগাযোগ হবার পর চোখের জলে সেতুকে বুঝিয়েছে রানুদিই নাকি সাজুকে ছেড়ে পালিয়েছিল সেতুকে নিয়ে। সেতু সম্ভবতঃ আংশিক বিশ্বাস করেছে। বাবাকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসতো সে।

মাষ্টার্স শেষ করার পর একদিন সেতুরও বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর নিজের দোতলা বাড়ী আছে শহরে, ব্যবসা আছে। বছর ঘুরতে সেতুর একটা মেয়েও হয়। রানুদি তৃপ্ত হয়। আমরাও। কিন্তু সেতুর বাবাহীনতার সেই অতৃপ্তি রয়ে যায়। ঠিকানা পেয়েও সে কিছুতেই বাবার কাছে পৌঁছাতে পারে না। বাবা তার সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে ঠিকই। কিন্তু দুরত্ব রেখে। তাই বাবার শূন্যতা কিছুতেই পুরন হয় না তার। বাবার স্নেহ পাবার জন্য বুকের হাহাকার থামে না। বাবার সাথে যোগাযোগে এত নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এমনকি ঢাকায় গিয়ে স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বাবাকে। কিন্তু বাবা সু-অভিনেতা। সুবাক্যে তুষ্ট করে বিদায় করে কন্যা ও জামাতাকে।

আমরা ভুলে থাকি ওদের বাবা মেয়ের আন্তঃসম্পর্কের ব্যাপারগুলো। কয়েকবছর কেটে গেছে তারপর। গত সপ্তাহে আমাদের বাসায় একটা ফোন আসে। সেতুকে দেবার জন্য একটা খবর। সেতুর বাবা মানে সাজু তিন মাস আগে ঢাকায় মারা গেছে। সেতু চাইলে বনানীতে গিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারে। খবরটা এতদিন দেয়া হয়নি কেন? কেউ জানে না। সাজুর বর্তমান ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে এখন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, তারা কোনভাবে সেতুর ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল। তারাই গোপন রেখেছে। সেতুর সাথে বাবার যোগাযোগ হয়নি মারা যাবার শেষ কয়েকমাসে। গত তিনমাসে সেতু অসংখ্যবার ফোন করেছে বাবার মোবাইলে, কিন্তু অজ্ঞাত কারনে লাইন কেটে দেয়া হতো বারবার। সৎভাইয়েরাই কেটে দিতো সেতুর নাম্বার দেখে।

রানুদি সেতুকে নিয়ে ঢাকায় গিয়ে বনানীতে কবর জিয়ারত করতে গেল। একবার ভাবলো বনানীর ফ্ল্যাটে সাজুর বর্তমান পরিবারের সাথে কুশল বিনিময় করে আসে। কিন্তু ফোন করলে ওরা অস্বীকার করলো সেতুর সম্পর্ককে। অস্বীকার করাটাই স্বাভাবিক। অপমানিত হবার ভয়, রানুদিকে বিরত রাখলো ওখানে যাওয়া থেকে। আর ওখানে গিয়েই বা কী হবে। সেতু তো বাবাকে হারিয়েছে ১ বছর বয়সে। নতুন করে হারানোর কী আছে?

কিন্তু সেতু? সেতুর অনুভূতি কী? সংসার জটিলতার এই পঙ্কিল ভূমিতে সেতুর খাঁ খাঁ অনুভূতি, বাবা থেকেও বাবাকে কোনদিন না পাবার শূন্যতার বেদনা বর্ননা করার কোন ভাষা আমার জানা নেই। বাবার মৃত্যু কি সেতুকে নতুন কোন শূন্যতায় ফেলেছে? আমার কখনো সাহস হবে না জানতে। সেতুর মুখোমুখি হতেও ভয় পাই আমরা। জীবন কারো কারো জন্য এমন বিদঘুটে হয়ে যায় কেন?

রানুদি আর সেতুর জীবনের ঘটনাগুলো বিস্তারিত লিখতে গেলে গোটা একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। পাঠকেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। কোন একদিন হয়তো উপন্যাসটা লিখতে পারবো। আজ শুধু দুই জীবনের এক উপখ্যানের সারাংশটুকুই দিলাম।

Monday, February 16, 2009

বাংলা স্কুল বনাম ইংরেজি স্কুল বনাম আরবি স্কুল

স্কুল পর্যায়ে বাংলাদেশে কত রকম শিক্ষাপদ্ধতি চালু আছে? আমার জানা মতে সাধারণ বাংলা স্কুল, সাধারণ মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা, সাধারণ কিন্ডারগার্টেন, গ্রামার স্কুল ইত্যাদি নানান রকম শিক্ষাপদ্ধতি বিদ্যমান। শিশুর প্রথম বিদ্যাপীঠ হিসেবে শ্রেণীভেদে এর মাঝ থেকে যে-কোনো একটাকে বেছে নিতে হয় অভিভাবককে।

স্কুল পছন্দ করতে গিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে আর্থিক কারণ ছাড়াও পছন্দ অপছন্দের বিভিন্ন কারণ কাজ করে থাকে। অনেকে ব্যাপক ভুল ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয়। ইংরেজি-স্কুল-পছন্দ অভিভাবক চায় বাচ্চাকে দ্রুত ইংরেজিবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে, যাতে সহজে তার লন্ডন-আমেরিকা গমন ঘটে। মাদ্রাসা-পছন্দ অভিভাবক চায় বাচ্চাকে বেহেশতের চাবি হিসেবে তৈরি করতে, যাতে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে সে বেহেশত দর্শনে যেতে পারে।

ইত্যাকার কারণে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় একটা তোগলকি অবস্থা বিরাজ করছে। একেক স্কুল একেক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করছে পূর্ণ গণতান্ত্রিক সুযোগ নিয়ে। কিন্তু একটা দেশের মূল শিক্ষাব্যবস্থায় এতটা ‘গনতন্ত্র’ কি সহনীয়?

ইংরেজি শিক্ষার নামে ৪ বছর বয়সি একটা বাচ্চার হাতে ৫ কেজি ওজনের বই তুলে দেবার যুক্তিটা কী? ৪ বছরের একটা বাচ্চাকে বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

মাদ্রাসা শিক্ষায় ধর্মের নামে একটা বাচ্চা ছেলেকে পৃথিবী যাবতীয় জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করার মানে কী?

শিক্ষাকেই জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। অথচ সেই মেরুদণ্ডের যত্নের জন্য যা যা করা দরকার তা কি করেছে আমাদের কোনো সরকার? এদেশে ইংরেজি বা আরবি স্কুলের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? বিদ্যমান সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়গুলোকে কতকাল অবহেলিত ফেলে রাখা হবে? যে-অঙ্কের টাকা ইংরেজি বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যয় করা হয় তা দিয়ে সাধারণ বাংলা স্কুলগুলোর মান উন্নয়ন করা যায় না কি? সাধারণ বাংলা স্কুলে পড়লে সন্তান মানুষ হবে না, এই কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার উপায়ই-বা কী?

বাংলাদেশের মানুষের জন্য আসলে কী রকম শিক্ষাপদ্ধিত প্রয়োজন?

টিভি চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপন বানিজ্য ও নাট্য প্রতারনা

টিভি তেমন দেখা হয় না। আন্দোলন, নির্বাচন, ঘটনা-দুর্ঘটনার গরম থাকলে টিভির সামনে বসি, নয়তো বসা হয় না। একই রকম খবর, একই রকম চিত্র, একই রকম সাক্ষাৎকার ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মুখ দিয়ে নির্গত হয় নানান নামে প্রতিটি চ্যানেলে। সবগুলো চ্যানেলকে জীবন্ত কপি-পেষ্ট মনে হয়, কপি-পেষ্টে আমার চির অরুচি। তবে হালকা বিনোদনের জন্য মাঝে মধ্যে দুটি সিরিজ দেখতাম একসময়। এনটিভির ‘হাউসফুল’ আর চ্যানেল আইয়ের ‘দৈনিক তোলপাড়’। এখন বিরক্ত হয়ে এগুলোও দেখি না। বিরক্ত হবার কারন নির্বিচার বিজ্ঞাপন অত্যাচার। আমি কোন সিরিয়াস দর্শক না। খুব সামান্য সুড়সুড়ি দিয়েই আমাকে আনন্দিত করা যায়। তোলপাড় বা হাউসফুলে যা দেখানো হয় তাতে সিরিয়াস কিছু থাকেও না। আমার দরকারও নাই। আমি সামান্যতেই তৃপ্ত ছিলাম। কিন্তু দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনের বাড়ন্ত উৎপাতে আমার নাটক দেখার রুচিই চলে গেছে। প্রথম প্রথম সহ্য করেছি, তারপর পালাতে হয়েছে টিভির সামনে থেকে।

এক সময় বিটিভি ছাড়া আর কোন চ্যানেল ছিল না বাংলাদেশে। একটা নাটক শুরু হবার আগে বিটিভি আমাদের কমপক্ষে পনেরো মিনিট বিজ্ঞাপন গিলিয়ে তারপর এক ঘন্টার নাটক দেখাতো। আটটার খবর শেষ হতো সাড়ে আটটায়। তারপর পনের মিনিটে বিজ্ঞাপন। পৌনে নটায় নাটক শুরু হতো - পৌনে দশটায় শেষ হতো। মাঝখানে একবার দুবার বিজ্ঞাপন থাকতো যদি স্পনসরড নাটক হতো। সেই বিজ্ঞাপনের দৈর্ঘ্য দুই মিনিটের মতো। তাতেই আমরা কত বিরক্ত ছিলাম। একুশে টিভি চালু হবার পর বিজ্ঞাপনের একটু মার্জিত ধারা দেখতে পেয়েছিলাম। একুশে যখন জোট সরকারের হাতে খুন হলো, তারপর বাংলাদেশে চ্যানেলের বন্যা বয়ে গেল। কিন্তু আর কেউ একুশকে ছুতে পারেনি। এখন আবার একুশে ফিরে এসেছে, খোলসটাই আছে কেবল, সেই একুশে আর নেই।

আজকাল অনেক চ্যানেল। অনেক বিজ্ঞাপন। অনেক নাটক। নাটকের বন্যা। নাট্যশিল্পীরা এখন পেশাজীবি। ভালো, খুব ভালো। কিন্তু সেই নাটকগুলো আমাদের কিভাবে গেলানো হয়। একটা নাটক কিভাবে গেলাতে হবে তার কোন নীতিমালা কি সরকারের আছে? নামী নাট্যকার নামী পরিচালক হলে ঠাসা ঠাসা বিজ্ঞাপন, কমদামী নাট্যকার হলে কম কম বিজ্ঞাপন। এরকম একটা অলিখিত নিজস্ব নিয়ম বোধহয় আছে চ্যানেলগুলোর। বিজ্ঞাপন ছাড়া ফ্রী কোন অনুষ্ঠান কী আছে? এমনকি সংবাদও তো বিজ্ঞাপন ছাড়া হয় না। তাও একজন নয়। কয়েকজন মিলে একটা সংবাদকে ভাগ করে নেয়। কোরবানীর ভাগা কিংবা সিগারেট-গাঁজা-বেশ্যা ভাগের মতো। কে আগা খাবে কে গোড়া খাবে এভাবে ভাগ হয়। কেউ প্রধান শিরোনাম, কেউ মাঝখানের অংশ, কেউবা নীচের হেড লাইন, কেউ শেষের শিরোনাম, কেউ বিরতি। আবার কোথাও কোথাও দুটো হেডলাইনও চালু থাকতে দেখেছি নীচের অংশে। ‘আমরা এখন একটা ইষ্টার্ন ব্যাংক বিরতি নিচ্ছি, তার আগে জানিয়ে দিচ্ছি প্রাইম ব্যাংক সংবাদ শিরোনাম’ এরকম ডায়লগ অহরহ। বিজ্ঞাপন বানিজ্য এমন পর্যায়ে পৌছেছে তাকে বেশ্যাবৃত্তি বলতে ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে। এত এত বিজ্ঞাপন তারপরও নাকি কর্মীদের বেতন বাকী থাকে, কী অবিশ্বাস্য!

বিজ্ঞাপনের যন্ত্রনায় টিভি দেখা ছেড়ে দিয়েছি, বাচ্চাদের ভাত খাওয়াতেই টিভিটা ব্যবহার হয়। তবু সেদিন এনটিভিতে ‘হাউসফুল’ শুরু হচ্ছে দেখে কৌতুহল বশত ছোট্ট একটা গবেষনা চালালাম নাটক ও বিজ্ঞাপনের উপর। আসলেই কী বিজ্ঞাপন অতিমাত্রায় অসহনীয় হয়েছে? নাকি আমিই অসহিষ্ণু হয়ে গেছি। দেখা যাক আমার পর্যবেক্ষনে কী দেখা গেল।

১২ মিনিট বিজ্ঞাপন (৮.২৩-৮.৩৪) শুরু
৬ মিনিট নাটক(৮.৩৫-৮.৪০)
১২ মিনিট বিজ্ঞাপন (৮.৪১-৮.৫২)
৬ মিনিট নাটক (৮.৫৩-৮.৫৯)
১২ মিনিট বিজ্ঞাপন (৯.০০-৯.১২)
৬ মিনিট নাটক (৯.১৩-৯.১৮) শেষ

বিজ্ঞাপন এবং নাটক মিলিয়ে মোট সময় লেগেছে ৫৪ মিনিট। তার মধ্যে নাটক ১৮ মিনিট, বিজ্ঞাপন ৩৬ মিনিট। মানে কী দাড়ালো? আমরা কী নাটকের সৌজন্যে বিজ্ঞাপন দেখলাম, নাকি বিজ্ঞাপনের সৌজন্যে নাটক? এটাকে নাট্য প্রতারনা বললে খুব দোষের হবে? প্রতারনা কে করলো, নাট্যকার নাকি চ্যানেল? ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে দয়া করে ওনারা নাটক বানাচ্ছেন, দয়া করে চ্যানেলওয়ালারা দেখাচ্ছেন, তাতেই যেন আমরা ধন্য হয়ে যাই। আমাদের কোন রা নেই। তাই কী? এটা একটা মাত্র উদাহরন। জনপ্রিয় নাট্যকারদের দিয়েই এ ধরনের প্রতারনা করানো হয় বেশী। এক ঘন্টার একটা নাটককে টেনে ছয় পর্বের সিরিজ বানানো হয়। সংশপ্তকের কথা মনে আছে? ওটা এই যুগে তৈরী হলে নিশ্চয় ৫০০ পর্বের মেগা সিরিয়াল হতো। মেগা সিরিয়াল কী?

উপরে যে নাট্যদর্শনের পরিসংখ্যান দিয়েছি সেই নাটকে ৫৪ মিনিট বসে থেকে কী দেখেছি সেটা বলি। নাটকে একটা মেয়ের শরীর খারাপ, ডাক্তার টেষ্ট দিল, টেষ্টের রিপোর্ট নিল, তার মা তাকে ভাত খাইয়ে দিল, তার ভাইও এক লোকমা খেল, মেয়েটার মামা ফোন করে অসুখের খোঁজ নিল, তাদের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী দাড়ি শেভ করলো, একটা বাচ্চা তাকে পেছন থেকে ভেঙালো। ব্যস এক পর্ব শেষ। চুয়ান্ন মিনিট বসে যদি আপনি কোন নাটকের এইটুকু ঘটনা দেখেন, তখন সেই নাট্যকার বা নাট্যপ্রদর্শক সংস্থাকে সারমেয় কা বাচ্চা বলতে ইচ্ছে হবে না?

এই সব টিভি প্রতারনা/ নাট্য প্রতারনা/বিজ্ঞাপন প্রতারনা দমনের জন্য সরকারের কোন আইন আছে কি? আমি যদি এইসব প্রতারনার বিরূদ্ধে নাগরিক হিসেবে মামলা করতে চাই, আমার পক্ষে কোন উকিল পাওয়া যাবে কী? সদাশয় সরকারের কাছে প্রশ্ন, আপনার কী টিভি চ্যানেলগুলোকে ‘যেমন খুশী তেমন সাজো’র লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছেন নাকি নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে? যদি কোন নীতিমালা থাকে তাহলে নীতিমালাগুলো মানা হচ্ছে কী না সেটা দেখার টাইম কি আছে মন্ত্রনালয়ের? আপনাদের টাইম না থাকলে নীতিমালাগুলো আমাদেরকে দিন, আমরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সরকারকে রিপোর্ট দেবো এক মাসের মধ্যে।

টিভি চ্যানেলগুলোকে বলছি - আপনারা দয়া করে ডিজিটাল প্রতারনা থেকে বিরত থাকুন। অর্থলোভী কর্পোরেট বানিজ্যের মধ্যে ডুব দিয়ে আমাদের ভুলে যাবেন না। আমরা দর্শক, আমরা কিন্তু জেগে আছি।

কম বলুন, বেশী শুনুন, করুন সাধ্যমত

সদাশয় সরকারের মাননীয় উজির নাজির পারিষদ,

ক্ষমতায় আসীন হবার পর হইতে প্রতিদিন মিডিয়াতে, সভা-সমিতি-সাক্ষাৎকারে, আপনাদের বক্তৃতা বিবৃতি বাণীর প্রাচুর্য দেখা যাইতেছে। জনগন প্রথম প্রথম নতুন মুখ হিসেবে আপনাদের সুবচনগুলো শুনিতে কিছুটা আগ্রহী হইলেও দিন যতই যাইতেছে লক্ষ্য করিতেছি যে আপনাদের কথার ধার ও ভার কমিয়া যাইতাছে, পুনঃপুনঃ চর্বিত চর্বনে কথার মাধুর্য এবং ভারসাম্য নষ্ট হইয়া যাইতেছে। ফলে এই বক্তৃতা সমূহ জনগনের কাছে বিরক্তিকর ব্যাপারে পরিনত হইতেছে।

তবে জনগনের এই বিরক্তি আপনাদের দেখিবার অবকাশ আছে বলিয়া আমি মনে করি না। কারন প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি মোতাবেক সরকারের চেয়ারে বসিবার পর হইতে রাজনৈতিক নেতাদের দর্শনেন্দ্রিয় ও শ্রবনেন্দ্রিয়ের ব্যাপক অবনতি ঘটিয়া থাকে। আপনাদেরও তাই ঘটিবার আশংকা দেখা দিয়াছে। ফলে আপনারা শীঘ্রই জনগনের ভাষা বুঝিবার-শুনিবার-দেখিবার ক্ষমতা হারাইয়া ফেলিবেন। অসাধারন হইয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবেন সাধারন মানুষের স্পর্শ হইতে। তাই চুড়ান্ত অবনতি ঘটিবার পূর্বেই সতর্ক হইয়া যাইতে হইবে। চাটুকারের কচুরিপানায় ঢাকা পড়িবার আগেই আশপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করিয়া ফেলুন। তাহলে দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হইবে।

আপনারা অসীম ক্ষমতাবান নন এবং আপনাদের পূর্ববর্তীগনও কেহ অসীম ক্ষমতাবান ছিলেন না। তাহা আমরা যেমন জানি আপনারাও তেমনি জানেন। নির্বাচনপূর্ব সবগুলি প্রতিশ্রুতি আপনারা বাস্তবায়ন করিতে পারিবেন তেমন মনে করার কোন কারন নাই। কিন্তু আপনারা যদি সাধ্যমতো চেষ্টা না করিয়া জনগনকে বোকা বানাইবার চেষ্টায় থাকেন তাহা হইলে আখেরে কঠিন মূল্য পরিশোধে বাধ্য থাকিবেন। নির্বাচনপূর্ব মিথ্যা আশ্বাসে জনগন যতটা না ক্ষতিগ্রস্থ হইয়াছে তাহার চাইতে অনেক বেশী হইবে নির্বাচন পরবর্তী সামান্য মিথ্যায়ও। তাই মিথ্যা বলা এবং সত্য অস্বীকার করিবার অভ্যাস গ্রহন করিবেন না। যে কোন ব্যর্থতা বিনয়ের সহিত স্বীকার করিবার রাস্তা খোলা রাখুন। জনগন বিনয়ী শাসক পছন্দ করে।


আপনাদের চেহারা মিডিয়াতে কম দেখাইবার ব্যবস্থা করুন। একই কথা প্রতিদিন বলার অভ্যাস ত্যাগ করুন। হটকারী বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকুন। মিডিয়া সেল থেকে পত্রিকায় প্রকাশিত সমালোচনাগুলো সংগ্রহ করে নিয়মিত পাঠ করুন। হজম শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করুন (সমালোচনার ক্ষেত্রে)। চাটুকারদের দুরে সরাইয়া রাখুন। আপনারা বলিবেন কম, শুনিবেন বেশী, করিবেন সাধ্যমত। ইহাতেই আপনাদের মঙ্গল রচিত হইবে।


আপনাদের সুস্বাস্থ্য এবং সুশাসন কামনায়,

জনগনের একজন