Wednesday, September 16, 2020

জারিয়া ঝাঞ্জাইল পেরিয়ে

১.


জারিয়া ঝাঞ্জাইল নামে বাংলাদেশে কোন স্টেশন আছে জানা ছিল না মারুফের। প্ল্যাটফর্মে নামার পর স্টেশনের অদ্ভুত নামটা দেখলো সে। ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে ময়মনসিংহের ট্রেনে ওঠার সময় তাকে বলে দেয়া হয়েছিল ময়মনসিংহও তার জন্য নিরাপদ নয়। সে যেন ময়মনসিংহ নেমে শহরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা না করে জারিয়াগামী কোন একটা লোকাল ট্রেনে উঠে পড়ে। জারিয়া থেকে সড়কপথে দুর্গাপুর। দুর্গাপুর থেকে নদী পার হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করতে হবে। এই ছিল শওকতের বাতলে দেয়া পলায়নপথ। মারুফ জীবনে কোনদিন উত্তরবঙ্গে আসেনি। বাংলাদেশে তার গতিবিধি সীমাবদ্ধ ছিল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত।




এখন এই অদ্ভুত সময়ে, অদ্ভুত একটা স্টেশনে নেমে সমস্ত শরীরের ক্লান্তি যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো তার শরীরে। এরকম জঘন্য ট্রেনে সে জীবনেও চড়েনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার বগিতে, অচেনা অজানা বিচিত্রসব লোকজনের ভিড়ের মধ্যে বসে গরমে তার শরীর চ্যাটচ্যাটে হয়ে আছে। ট্রেনটা এক ঘন্টা দেরী করে সাড়ে আটটার জায়গায় রাত সাড়ে নটায় ছেড়ে জারিয়া পৌঁছেছে রাত বারোটার দশ মিনিট আগে। বাংলাদেশের মানচিত্র সম্পর্কে তার কিছু কিছু ধারণা থাকলেও এদিকটা সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকার। দুদিন আগেও সে কী জানতো এমন একটা ঘটনায় তাকে প্রাণ বাঁচাতে এমন করে পালিয়ে আসতে হবে চিরচেনা ঢাকা শহরের নিরাপদ জীবনকে পেছনে ফেলে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে গেল। এটা যেন অনিবার্য ছিল। আত্মীয় পরিবার বন্ধুবান্ধব কেউ তাকে আশ্রয় দেবার সাহস করেনি। একমাত্র শওকতই সাহস করে এগিয়ে এসে তাকে গোপনে ময়মনসিংহের ট্রেনে তুলে দিল।



শোষক বন্দনা

আমি শোষকের বংশধর, তাই চিরকালই শোষকের পক্ষে। জাতিসংঘের কোন অধিকার সনদ আমার জন্য প্রযোজ্য নয় কেননা আমি জন্মসুত্রে অধিকার প্রাপ্ত রক্তশোষক। আমার চৌদ্দ পুরুষ এমনকি চৌদ্দ লক্ষ কোটি পুরুষও রক্তশোষকই ছিল। আমাদের জাতিগত নিয়ম হলো - যেখানে জন্মাইবে সেখানকার সম্ভাব্য সকল প্রাণীর রক্ত শোষণ করিয়া মৃত্যুবরণ করিবে। জন্মের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমাদেরকে সংক্ষিপ্ত শিক্ষা সফরে নিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয় আমাদের অধিকারের সীমানা।


আমাদের বর্তমান সমাজটির বসবাস বিশাল এক প্রান্তর জুড়ে। ঘাসপাতা ছাড়া অন্য কোন গাছপালা নেই এদিকে।  এলাকাটা নিরাপদ বলে বিবেচিত। তবে এদিকে খাদ্য সংকটও প্রবল। মানুষের রক্ত আমাদের প্রধান খাদ্য এবং সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু এই এলাকায় কোন মানুষ আমাদের ধারে কাছে ঘেঁষে না। আমরা কেবল দূর থেকে মানুষের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমাদের বাসস্থানের খানিক দূর দিয়ে শক্ত পাথুরে মাঠের উপর দিয়ে বড় বড় দানবীয় কিছু পাখি গোঁ গোঁ করে আকাশে উড়ে কোথাও চলে যায়। সেই পাখিগুলোকে আমরা হিংসা করি। তাদের খাদ্য আস্ত জ্যান্ত মানুষ। একেকটা পাখি শত শত মানুষ গিলে উড়ে চলে যায় প্রতিদিন। পাখিগুলো প্রতিদিন এত মানুষ গিলে খায় তবু মানুষগুলো বোকার মতো আবারো লাইন ধরে পাখির পেটে ঢুকে পড়ে প্রতিদিন। ওই পাখি আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখলে আমরা পালিয়ে বাঁচি না, অথচ মানুষগুলো কোন যাদুর বলে নিজে নিজে ঢুকে পড়ে পাখির পেটের ভেতর। মানুষেরা কী করে এত বোকা হয় আমরা ভেবে পাই না।


নাথপাড়ার রক্তযজ্ঞ : ৩১শে মার্চ ১৯৭১

[সতর্কতা : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী ও তার দোসরগণ সারা দেশে যেসব নৃশংস বর্বরতা দেখিয়েছে তার অসংখ্য বিবরণী পড়েছি নানান জায়গায়। এই ঘটনাটি আমার পড়া সবচেয়ে নৃশংস ঘটনা, যেটিকে ভিত্তি করে এই গল্পটি লিখতে গিয়ে বহুবার আমার হাতের আঙুল অবশ হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ এক বছর বিরতি নেবার পর বাকী অংশ লিখতে পেরেছি দুর্বলতম গদ্যে। এমনভাবে লিখতে হয়েছে যেন এটা সত্যি ঘটনা নয়, যেন নেহায়েত বানোয়াট একটা গল্প লিখছি। তবু বলব দুর্বল হৃদয়ের মানুষদের এই গল্পটি পড়ার আগে সতর্ক হওয়া উচিত]


দেশকালসময় সবকিছুর উর্ধে চলে যাবার পরও ক্ষীরোদরঞ্জন নাথ কিছুতেই দৃশ্যটা ভুলতে পারছেন না। নিরবালা দেবী তাঁর স্ত্রী হলেও তার মাথার উপর নিজের কাটামুণ্ডুটি এভাবে হাজির হবে ব্যাপারটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তখনো  তার চক্ষু মুদে আসেনি। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন কয়েক সেকেণ্ডের সচেতন অচেতনের মাঝামাঝি ভাষাতীত এক মুহুর্ত ছিল সেটি। কাট্টলীর  নাথ পাড়ার সবগুলো প্রাচীন বৃক্ষ, সমুদ্রের হাওয়া, চৈতালী ঝড় ক্ষীরোদরঞ্জনের সাথে একমত। তাঁর কোন অভিযোগ নেই কারো কাছে। তবে সেই ঘটনার পর থেকে তিনি শুধু ঘুরে ঘুরে সেই খুঁটিটার কাছে ফিরে আসেন। যে খুঁটির নীচে ঠেস দিয়ে বসে ছিল নিরবালা দেবী। আসলে ঠেস দেয়নি, একটা পাটের দড়িতে বাঁধা ছিল নিরবালা দেবীর শরীরটা।


প্রতি বছর মধ্য চৈত্রের এই দিনে ক্ষীরোদরঞ্জন ফিরে আসেন নাথপাড়ার এই খুঁটির কাছে। তাঁর এই ফিরে আসাটা এতটাই আড়ালে ঘটে যে নাথপাড়ার কোন মানুষ টের পায় না তিনি এসেছেন। কিন্তু এ পাড়ার  প্রাচীন বৃক্ষ, সমুদ্রের হাওয়া, চৈতালী বাতাসের সাথে লোহার পাইপের মরচে ধরা খুঁটিটাও টের পায় ক্ষীরোদ রঞ্জনের উপস্থিতি। ফিরে না এসে উপায় কী? তাঁর নিজের স্ত্রীর সামনে এতটা অসম্মানিত হওয়া, একটা বিবর্ণ অপরাধবোধ নিরন্তর গ্লাণি তাঁকে গ্রাস করে রেখেছে কয়েক দশক ধরে।


দক্ষিণ কাট্টলীস্থ নাথপাড়ার ক্ষীরোদরঞ্জন নাথ বরাবরই নির্বিবাদী মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বৃদ্ধ পিতা হরিরঞ্জন নাথও কারো সাতেপাঁচে থাকতেন না। কিন্তু ক্ষীরোদরঞ্জনের স্ত্রী নিরবালা দেবীর সাহস একটু বেশী ছিল। উনিশশো একাত্তর সালে এমন কিছু অদ্ভুত দুঃসাহসী মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল গাঙ্গেয় মোহনার এই দেশটিতে। নিরবালা দেবীর এই সাহসিকতার প্রভাব পড়েছিল জ্যৈষ্ঠ সন্তানদ্বয় বাদল এবং দুলালের মধ্যেও। কলেজে উঠার পর থেকে বাদল আর দুলাল অনেক বেশী স্বাধীনচেতা হয়ে গেছে। নিজেদের স্বাধীনতা ছাপিয়ে তারা শেখ মুজিবের দলে ভিড়ে দেশের স্বাধীনতা নিয়ে মাতামাতি করে পাড়ার লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ক্ষীরোদরঞ্জন যে কোন রকম ঝুট ঝামেলা রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন, কিন্তু স্ত্রী নিরবালা হলো বিপরীত। তিনি তাঁর ছেলেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে গর্ব করেন।  


যদি কিছু আমারে শুধাও…..


১.

বৈশাখে জড়ো হওয়া বৃষ্টির মেঘগুলো এবার জ্যৈষ্ঠমাসে এসে উধাও হয়ে গেল কোথাও। অথচ এই দিনে খুব বৃষ্টি ছিল সেদিন। ঝড়ো হাওয়ার সিগন্যাল ছিল। ভিজতে ভিজতে সেই রেস্তোঁরায় ঢুকে পড়েছিলাম জুবুথুবু হয়ে। জিইসির কাছাকাছি সেই রেস্তোঁরা ভেঙ্গে মার্কেট উঠে গেছে এখন। ওখানে আমরা এই গরমে আইস কফি খেয়েছি কতদিন! স্মৃতিগুলো গল্পের মধ্যেই বেঁচে থাকবে। 


ছুটির দিন আজ। কোন কাজ নেই দুপুরে খাবার আগে। মেসের সবাই বাড়ি চলে গেছে সবাই। ইচ্ছে ছিল কোন বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিয়ে কাটাবো। কিন্তু বন্ধুরা সব এখন একেকটি সংসারের মালিক। ছুটির দিনের সকাল তাদের ব্যস্ততম সময়। আমার মতো গতস্য নিঃসঙ্গ মানুষকে সেখানে বেমানান লাগে। 


সকালে নাস্তা সেরে রেডিও টিউন করতে বসলাম। র‍্যাণ্ডম স্টেশনের র‍্যাণ্ডম মিউজিক। হঠাৎ ভেসে এলো বহু পুরোনো একটি গান। যে গানের কারণে জীবনের একটি অধ্যায়ের সমাপনী ঘটেছিল। অথচ ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ছিল না। কিন্তু না চাইলেও কিছু কিছু ভুল বোঝাবুঝি আপনাকে নাকাল করে দিতে পারে একেক সময়।