Saturday, June 28, 2014

সুসংবাদ নেই

নিয়ত দুঃসংবাদ
প্রতিদিন দুঃসংবাদ। ঘুম ভাঙ্গে দুঃসংবাদ শুনে। ঘুমোতে যাই দুঃসংবাদ শুনে। একদিন নিজেও হয়ে যাবো দুঃসংবাদের অংশ। আশংকা নয়, সম্ভাবনা নয়, অনিবার্য পরিণতি। কোন স্বজন বন্ধুর আটকানো নিঃশ্বাস হাসপাতালে জমা রেখেই আমরা বুক ভর্তি হাওয়া গিলে ঘুরে বেড়াই। কাজ করি, আড্ডা দেই, বিশ্বকাপ দেখি, খাই, ঘুমাই। একই সময়ে কেউ কেউ নির্ঘুম রাত পার করে। এক ফোঁটা বাতাসের জন্য কারো কান্না ভেসে বেড়ায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। অথচ আমার চোখ জুড়ে তখন জানোয়ারের মতো বিশুদ্ধ নিঃশ্বাসে নির্লজ্জ ঘুম ভেঙ্গে আসে।

শৃংখলবৃদ্ধি
দু হাতে শেকল পরানো ছিল বহুকাল। শেকল ছেঁড়ার শক্তি ছিল না। নিয়তির শৃংখল অথবা শৃংখলিত নিয়তি মেনে নিয়েও কাটছিল সময়। হাত বন্ধ থাকলেও হাঁটা বন্ধ হয়নি। হাঁটতে পারতাম যখন খুশী। চোখ মেলে তাকাতে পারি আকাশ অথবা সবুজে। একদিন সবুজের ঘ্রাণ পেয়েছিলাম। সজীব সময়। এরপর অবসর হতো সবুজের কাছে যাবার। সবুজের মুগ্ধতা ভুলিয়ে দিয়েছিল শৃংখলের যন্ত্রণা। অতঃপর নজরে পড়ে গেলাম অসময়ের। একদিন অসময় এসে শৃংখল পরিয়ে দিল দু'পায়েও। 

মগডাল
গাছটার একদম মগডালে ওঠার পর অবাক হয়ে ভাবছিল কিভাবে এত বিশাল একটা বৃক্ষের চুড়াশীর্ষ স্পর্শ করলো। সেই কবে গাছে উঠেছিল মনেই নেই। তাই এই শীর্ষারোহন তাকে বিশেষ তৃপ্তি দিল। শীর্ষে বসে সে অনুমান করার চেষ্টা করছে গাছটার উচ্চতা কত হতে পারে। একটা চারতলা দালানের চেয়েও বেশী হবে। কটা ডাল পার হয়ে আসলো? বিশটা তো হবেই। গাছের বাকলের রঙ কি, পাতাগুলো কতটা সবুজ। এই সবুজের আড়ালে বসে থাকতে কতটা ভালো লাগা। বাতাসে গা জুড়িয়ে যাচ্ছে। যত উপরে তত বেশী বাতাস। সে দুহাত মেলে বাতাস ছুঁয়ে দিতে চাইল। উঠে আসার আনন্দটা দ্বিগুন হয়ে ভর করলো যেন। ...........তারপর সর্বশেষ ডালের শীর্ষে দাঁড়িয়ে সে পাতার ফাঁক দিয়ে তাকাবার চেষ্টা করলো শেকড়ের দিকে....ঐ তো ওখান দিয়ে উঠে এসেছিলাম আমি। তাকানোই হলো ভুল, অপরিণামদর্শী এক ভুল। পা হড়কে ধপাস করে পড়ে গেল নীচে। ডালের সাথে বাড়ি খেতে খেতে, পাতার ফাঁক দিয়ে পড়তে পড়তে সে কিছুই ভাবতে পারছিল না, এমনকি ভুলে গেল একদিন সে সর্বোচ্চ চুড়াটা স্পর্শ করতে পেরেছিল।

রমজানে বঙ্গদেশ
আর একদিন পরেই রোজার শুরু। যদি সুযোগ থাকতো এই একটা মাস আমি বাংলাদেশ থেকে দূরে কোথাও থাকতাম। রমজান হলো সংযমের মাস। কিন্তু এই মাসটার মতো অসহনীয় অসংযমের মাস আমি একটিও দেখি না। চারদিকে শুধু খাই খাই হৈ হৈ রৈ রৈ তেলেভাজা পিয়াজু বেগুনি কি মরীচিকার খেলা। ধোঁয়া ধোঁয়া তেলতেলে রাজপথ গলিপথের বাতাস। মার্কেটে মার্কেটে গিলে ফেলা হা-গিলের দল হাহা রবে ছুটে বেড়ায়। রাস্তাঘাট যানজটে আটকা ঘন্টার পর ঘন্টা। গরমে রোদে বিকেলের ভাজাভুজিতে অসহ্য আচার। হঠাৎ মুসল্লীর দল ভিড় করে মসজিদে মসজিদে ইফতার পার্টিতে। ভণ্ড ধার্মিক পাঞ্জাবি পাতলুনে চিকচিকে চেকনাই, মুখে মুখে হাদিসের বাহার। ধর্ম নিয়ে ব্যবসাপাতি চাঙ্গা করার খায়েশ।

কোন মতে এই একমাস যদি নির্বাসনে যেতে পারতাম? এই একটা মাস, আমার পোড়াভাজা বাংলাদেশ, আমি তোমায় ভালোবাসি না।

Wednesday, June 25, 2014

উন্নয়ন, ইপিজেড ও বাংলাদেশ বিষয়ক ক্যাচাল

বাংলাদেশ সরকার বিশেষ সুবিধা দিয়ে একের পর এক ইপিজেড চালু করেছে ঢাকা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে। ইপিজেড একটি বণ্ডেড জোন। এই জোনগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেকটা আন্তর্জাতিক। এখানে কেউ পন্য বিক্রি করলে তা হবে বাংলাদেশের এক্সপোর্ট। এখান থেকে কেউ পন্য কিনলে তা হবে বাংলাদেশের ইমপোর্ট। ইপিজেডগুলো বণ্ড সুবিধার আওতায় ডিউটি ফ্রি আমদানী করে তা দিয়ে রপ্তানী পন্য তৈরী করে বিদেশে পাঠায় নির্ধারিত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। ইপিজেডের প্রত্যেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ১০ বছরের জন্য করমুক্ত সুবিধা পায়। কিন্তু ১০ বছর পার হবার পরও এদের খুব বেশী কর দিতে হয় না। কারণ এদের আয় অধিকাংশ সময়ই করমুক্ত সীমার ভিতরে থাকে অথবা অগ্রিম কর থেকে এই করের পরিমান খুব কম হয়। ফলে বাংলাদেশ সরকার এখান থেকে কিছুই পায় না বছর শেষে।

তাহলে ইপিজেড বাংলাদেশের উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখছে? কেউ বলবেন, কর্মসংস্থান। কেউ বলবেন, বৈদেশিক মুদ্রা আহরন।

দুটোই সত্যি। কর্মসংস্থানও হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রাও আহরন চলছে। কিন্তু কর্মসংস্থান কি স্থানীয় কারখানাগুলোতে হচ্ছে না? বৈদেশিক মুদ্রা কি স্থানীয় কোম্পানী গুলো আয় করছে না? ইপিজেডকে অধিক সুবিধা দেবার কারণটা কি তাহলে?

সেটা সরকার জানে। আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক অনুভূতির কথা বলি।

আমার ধারণা ইপিজেড বিদেশীদের জন্য যতটা লোভনীয়, বাংলাদেশের জন্য ততটা নয়। বিদেশীদের জন্য লোভনীয় কারণ এখানে আইনের আওতায় দুর্নীতি করার সুযোগ আছে। একটা উদাহরণ দেই।

ডাকসিল কোম্পানী ৪ মিলিয়ন ডলার খরচ করে একটা কারখানা খুলেছে। কর্ম সংস্থান করেছে ২০০০ মানুষের। কোম্পানীটি বছরে রপ্তানী করে ২০ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে আমদানী ব্যয় ১৬ মিলিয়ন ডলার। অন্যন্য খরচ ২ মিলিয়ন। নেট লাভ ২ মিলিয়ন ডলার। দশ বছরের করমুক্ত সুবিধায় কোম্পানীটি ২০ মিলিয়ন ডলার নেট লাভ করলো দশ বছরে। সেই লাভ থেকে তিন বছর পরপর আবারো বিনিয়োগ করলো ৪ মিলিয়ন ডলার করে দুইবার। এখন তাদের ৩ টি কারখানা। প্রতিটা কারখানায় ২০ মিলিয়ন করে মোট বার্ষিক রপ্তানী ৬০ মিলিয়ন ডলার দাড়ায়। ডাকসিল-১ যখন দশবছর পূর্ন করলো সেবছর তাদের আয় কমতে শুরু করলো। ১১তম বছরে ডাকসিল-১ এর মূনাফা ২ লাখ ডলারে নেমে আসে।  পরের বছর আরো কম। এভাবে দেখা যায় ডাকসিলকে তেমন কোন কর দিতে হচ্ছে না ১০ বছর পার হবার পরও।

ডাকসিল খুশী, কারখানার কর্মচারীগন খুশী, শুধু খুশী হতে পারে না বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ সরকার ভাবতে থাকে ডাকসিলকে এত সুবিধা দিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে আমার কি লাভ হলো?
লাভ নেই জেনেও ডাকসিলকে ব্যবসা করার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

ডাকসিলকে বন্ধ করে দিলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে কে কে?
১. ডাকসিলের মালিক (বছরে ২ মিলিয়ন ডলার আয়)
২. ডাকসিলের ২০০০ কর্মী (বছরে ১.৬ মিলিয়ন ডলার বেতন)
৩. ডাকসিলের সাথে কর্মরত বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানসমূহ (বছরে ১ মিলিয়ন ডলার আয়)
৪. বাংলাদেশ কর বিভাগ ( বছরে ২৫ হাজার ডলারের উৎস কর)

তেল কোম্পানীর সাথে সম্পাদিত পিএসসি চুক্তির মতো এই ইপিজেডগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে যতটা উপকার করছে, তারা নিজেরা উপকৃত হচ্ছে কয়েকগুন বেশী। কিন্তু আমাদের আর কোন উপায় নেই বলে আমরা বাধ্য হচ্ছি সেই অলাভজনক বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে। এ যেন সেই গরীব মানুষের বউ যে পরিবারের অভাব মেটাতে ব্যর্থ হয়ে স্বামীর অনুমোদন নিয়ে শরীর বেচে।

অথচ সেই বউটি যদি শিক্ষিত হতো, সে ভিন্ন একটা সম্মানজনক কর্মসংস্থান বেছে নিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা অবকাঠামো। বিদ্যুত আর যোগাযোগ খাতটা যদি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিনিয়োগ বান্ধব হতো, তাহলে বাংলাদেশকে ইপিজেডগুলোর মতো ক্ষুদে বিনিয়োগকারীদের উপর এতটা নির্ভর করতে হতো না।

মাঝে মাঝে শোনা যায় বাংলাদেশকে গার্মেন্টস সেক্টরের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। সেদিন এক মন্ত্রী বলছিলেন ২০২১ সালে বাংলাদেশ গার্মেন্টসএর চেয়ে অধিক পরিমান সফটওয়ার রপ্তানী করবে। আমি বলবো, এসব বাকোয়াজী বন্ধ করে অবকাঠামো উন্নয়ন করার জন্য কাজ করেন আগামী পাঁচ বছর। উন্নয়ন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আপনার বাড়িতে এসে ঢুকবে। সনি, স্যামসাং, এলজি, হুন্দাই, এসব কোম্পানীর বিনিয়োগ আশা করতে হলে আপনাকে বিদ্যুতখাতকে ১০০% নিশ্চিদ্র করতে হবে। ০.০০০১% বিচ্যুতিও সহ্য করবে না বিদ্যুতখাত। সুতরাং বক্তিমা কমান, কাম করেন!

লক্ষ্য যখন বস্তু নয়!

স্বাধীনতা ব্যাপারটি যে নিঃশব্দেও হরন হতে পারে সেটি জানা ছিল না ভুক্তভোগী হবার আগ পর্যন্ত। আমি বরাবরই অজাতশত্রু ভাবতাম নিজেকে। আমার কোন ব্যক্তিগত শত্রু নেই। এখনো নেই, আগেও ছিল না। তবু আমি আক্রান্ত হয়েছি তৃতীয় পক্ষের কারণে। আক্রান্ত হবার আগে কিছু অস্বস্তিকর মুহুর্ত থাকে। সেই মুহুর্তগুলোতে অনুভব করা যায় কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে। বিশেষভাবে লক্ষ্য করছে, বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু কেউ আমাকে লক্ষ্য করলেই আমি অভিযোগ দায়ের করতে পারি না। বিচারপ্রার্থী হওয়া যায় তখনই যখন আমি আক্রান্ত হয়ে যাবো। সুতরাং আক্রান্ত হবার আগ পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হয়।

আমার ব্যক্তিগত কোন শত্রু নেই, কিন্তু রাজনৈতিক শত্রুর সংখ্যা অজানা হলেও জানি, ওরা আছে। আমার ছাত্রজীবনের বিরাট একটা অংশ শত্রুশিবিরে কেটেছে। তখনো আমি জানতাম ওরা আছে। আমাকে লক্ষ্য করছে। লক্ষ্য করছে জেনেও আমি কখনো নিজেকে বিপন্ন মনে করিনি। আমি দুর্দান্ত কোন সাহসী মানুষ না, কিন্তু আমার রাজনৈতিক মতবাদের অবস্থানটা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট এবং প্রকাশ্য। শত্রুশিবিরেও আমি কখনো চুপ থাকিনি। এবং একবার সেই স্পষ্ট সরবতার খেসারতও দিতে যাচ্ছিলাম শত্রুপক্ষের ঘেরাওর কবলে পড়ে। আমার অপরিনামদর্শীতা বন্ধুদের এতই ভীত করে তুলেছিল ওরা একটু দূরত্বে অবস্থান নিয়েছিল। ওরা দূরে থাকলেও আমার বুকে ছিল সমগ্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুর্মর শক্তি। আমাকে আক্রান্ত করতে দেয়নি সেই বিশ্বাস। শত্রুর চোখে পোড়া চোখ দুটো জ্বালিয়ে রেখেই বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। বুঝলাম ২১ বছর বয়সটা আসলেই দুরন্ত বেপরোয়া।

সেই একুশেই আরো একবার বেপরোয়া হয়েছিলাম একই শত্রুর মুখোমুখি হয়ে। সামনে কী আছে জেনেই পা বাড়িয়েছিলাম। কোথা থেকে একটা উড়ো রাগ এসে ভর করেছিল। সবকিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার অদম্য জেদে হাঁটতে শুরু করেছিলাম মিছিলে। শুধু একটু ভুল করেছিলাম কাছের দুই বন্ধুকেও আমার সেই যুদ্ধে জোর করে টেনে নিয়ে। যখন আক্রান্ত হলাম, তখন কে কোন দিকে ছিটকে গেলাম মনে পড়ে না। সেই প্রথম আক্রান্ত হয়ে পালিয়েছিলাম সরাসরি গুলির মুখে। মরলে বাকী যুদ্ধ সমাপ্ত করবে কে? নাকি আগে নিজে বাঁচো, তারপর সহযাত্রী? নিজের এবং সহযাপাঠির রক্তমাখা শার্ট মনে করিয়ে দিচ্ছিল সেই একই শত্রু ১৯৭১ এবং ১৯৯০। একই শত্রু, ভিন্ন শিবিরে। অতঃপর পলায়নের চুড়ান্তে দুই বন্ধুকে অক্ষত পেয়ে বেঁচে থাকার বিজয়ের তৃপ্তি।

বহুদিন পর আবারো লক্ষ্যের শিকার। লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া এড়াতে নতুন একটা ক্যামোফ্লেজ জড়াতে হয়েছিল। বেশ কিছুকাল নিরাপত্তা চাদরে থাকার পর একদিন একটু একটু করে ছিদ্র হতে থাকে ক্যামোফ্লেজ। একদিন টের পেয়ে যাই আবারো লক্ষ্যের শিকার। চেনাপথগুলোতে চলাচল করছে পর্যবেক্ষকের চোখ। এবার আক্রান্ত হবার ধরন ভিন্ন হবার সম্ভাবনা জেনেও অস্বস্তি সরে না। চেনাপথগুলো দিয়ে হাঁটতে গিয়েও সতর্ক থাকতে হয়।

হাঁটতে হাঁটতে টের পাই চোখগুলো কিভাবে আমাকে অনুসরণ করছে। কাউকে না জানিয়ে আমি ক্যামোফ্লেজ পাল্টে ফেলবো কিনা ভাবতে থাকি। কিন্তু আমার পথে কেউ কাঁটা বিছিয়ে দেয়নি, শুধু কয়েকটি দৃষ্টিপাত মাত্র। সামান্য সেই দৃষ্টিপাতেই এত অস্বস্তি? আমি নতুন উপায় খুঁজতে শুরু করি।

ঠিকানা পাল্টানো? আমি ক্যামোফ্লেজ পাল্টে ফেললেও আমার ঠিকানা পাল্টাতে পারছি না বিবিধ কারণে। ঠিকানা পাল্টাতে না পারলে লক্ষ্যবস্তু হওয়া কিছুতেই ঠেকানো যাবে না। আমার স্বাধীনতাও ফিরবে না। এখন উপায়?

কোন উপায় নেই, আপাততঃ গোলাম হোসেন আপাতঃ পরাধীনতায় আক্রান্ত। যেখানে জ্বর গায়ে ঘাড়-মাথা ব্যথার মতো বস্তুর সাথে আটকে আছে লক্ষ্যের দৃষ্টি।

Tuesday, June 24, 2014

হা-গিলে

আমি ছোট একটা দেশে বাস করি। দেশ ছোট কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের হা তার শরীরের চেয়েও বড়। তারা চাইলে আস্ত মানুষ খপখপাখপ করে খেয়ে ফেলতে পারে। আমি সেই দেশের ছোট মুখের মানুষ। আমি একদিন রাজার কাছে আবেদন করলাম আমি জলপাই আচারের কারখানা বানাবো। রাজা অনেক চিন্তা ভাবনা করে বললো, তুমি উজিরের সাথে কথা বলো। আমি গেলাম উজিরের কাছে। উজির বললো, তুমি নাজিরের কাছে গিয়ে বলো। নাজিরের কাছে গেলাম। নাজির বললো, তুমি গোমস্তার সাথে কথা বলো। আমি গোমস্তার কাছে গেলাম।

গোমস্তা আমাকে আসতে দেখে দরোজা বন্ধ করে দিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু আমাকে তো কথা বলতেই হবে। দরোজার কড়া নাড়তে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর, দরোজার ফাঁক দিয়ে একটা রক্তচক্ষু বের হয়ে বললো, তোর এত সাহস আমার ঘরের দরোজা ঝাঁকাঝাকি করিস? দাড়া কোতোয়াল দিয়ে তোকে শায়েস্তা করি। আমি ভয়ে গোমস্তার কাছে মাফ চাইলাম হাত জোড় করে। জোড়হাতের নতজানুত্বে একটু যেন মন গলে গেল গোমস্তার। তারপর আসল কথা পাড়লাম।

গোমস্তা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বললো। বড় কঠিন আবদার। দেশে তো জলপাই সংকট আছে, আচার বানিয়ে শেষ করে ফেললে দেশের লোক খাবে কি। আচ্ছা, তবু তুই যখন আবদার করলি, ভেবে দেখি কি করা যায়। কালকে আসিস।

পরদিন গেলাম। গিয়ে দেখি দরজায় তালা। সে কোথাও গেছে। আমি সারাদিন অপেক্ষা করে ফিরে আসলাম। তারপরদিন আবারো গেলাম। তিনদিন ব্যর্থ হবার পর চতুর্থ দিনের সকালে অনেক কড়া নাড়ানাড়ির পর দরোজা খুলে বললো, কি রে কী চাস?

আমি অবাক হলাম আমাকে ভুলে গেছে দেখে। স্মরণ করিয়ে দিতেই বললো, ও সেই কথা? আচ্ছা কাল আসিস। আজ আরো একটু ভাবি। রাজার অনুমতি ছাড়া হবে না। বড্ড কঠিন কাজ। সরাসরি তো রাজার কাছে যাওয়া যায় না।

আমি ফিরে আসতে গেলে পেছন থেকে ডাক দিল। তুই যে জলপাই আচার বানাবি, টাকাপয়সা আছে তোর? বললাম, আছে। জিজ্ঞেস করলো কত আছে?  বললাম ২০০ টাকা আছে।

চোখ জ্বলজ্বল করে বললো, এত টাকা!! ঠিকাছে কালকে ২০ টাকা নিয়ে আসিস। দেখি রাজার কাছে পৌঁছানো যায় কিনা।

অনেক কষ্টে রাজার অনুমতি জোগার করে জলপাই আচার বানাবার কারখানা খুললাম। অনুমতি পত্রে লিখে দিয়েছিল- জলপাই বানাতে যা যা লাগবে সবকিছুর যেন পাই পাই হিসেব রাখি। রাজা চাহিবামাত্র প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। আমি জলপাই আচার বানাতে যা যা লাগে সবকিছুর হিসেব রাখি। জলপাই, তেল, সরিষা, আদা, রসুন, পেয়াজ, পাঁচফোড়ন, নুন, গরম মশলার গুড়া সবকিছু লিখে রাখি। আমার গুদামে নানান সাইজের বৈয়ামে থরে থরে সাজানো আচার।

একদিন গোমস্তা এলো কারখানা দেখতে। বললো, রাজার হুকুমে সব ঠিক আছে কিনা দেখতে এলাম। আমি খুশীমনে রাজার উপর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গোমস্তাকে সব হিসেব বুঝিয়ে দিতে লাগলাম। গোমস্তা গম্ভীর মুখে সবকিছু দেখেটেখে বললো, হিসেব তো রেখেছিস, কিন্তু কোন বৈয়ামে কতটা জলপাই তার হিসেব আছে তো?

আমি ওজন মেপে হিসেব রাখি। কিন্তু গুনে গুনে রাখতে হবে ভাবিনি। গোমস্তাকে বললাম, আজ্ঞে গুনে তো রাখিনি।

সাথে সাথে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো গোমস্তা। এত বড় সাহস তোর!! হুকুম করা সত্ত্বেও তুই সব হিসেব রাখিস নি? আমি এখন রাজাকে কী জবাব দেবো।

আমি তখন একটা বৈয়াম থেকে আচার ঢেলে জলপাই গুনে ফেললাম। বেশি সময় লাগলো না। পনের মিনিটে গুনে বের করলাম ৩৯টা জলপাই ধরেছে এই বৈয়ামে। হিসেব শুনে আরো গম্ভীর হয়ে গেল গোমস্তার চেহারা। মাথা নাড়তে লাগলো সে। বললো, এভাবে তো হবে না বাপু। শুধু কি জলপাই এখানে? বাকী মশলার হিসেব কি আমি বের করবো? শোনো হে বাপু। যদি আচারের কারখানা রাখতে চাও তাহলে কালকের মধ্যে আমাকে প্রতি বৈয়ামের হিসেব দিবা। কতটা জলপাই, কতফোটা তেল, কত দানা সরিষা, কতদানা পাঁচফোড়ন, সব হিসেব চাই।

এই হুকুম জারি করে সে চলে গেল। রাতে আমার ঘুমই এলো না। এই হিসেব কেমনে দেবে। এতকিছু গুনে রাখা কি সম্ভব? সে কি আচার বানাবে নাকি সরিষাদানা গুনবে বসে। তার চেয়ে ব্যবসা বন্ধ করে চলে যাবো। চিন্তায় আমার মাথার চুল যেন অর্ধেক পেকে গেল রাতে।

পরদিন গোমস্তা এলো, সাথে কোতোয়াল। কোতোয়ালের হাতে খাপখোলা চকচকে এক ছুরি। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।

কোতোয়াল এসে এক বৈয়াম আচার জব্দ করে বললো, এই আচার কতটা বিশুদ্ধ তা রাজার হুকুমে চেক করে দেখতে হবে। তারপর গোমস্তা এসে ফিসফিস করে বললো, তোর জন্য একটা উপায় বের করেছি। কোতোয়াল আর আমাকে দুই বৈয়াম আচার দিবি আর নগদে দিবি ৫০ টাকা। তোর যত খুশী সরিষা দে, যতখুশী জলপাই। কোন হিসেব লাগবে না। যাহ তোর জন্য এইটা করে দিলাম। এবার বিদায় কর আমাদের দুজনকে।

আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। জলপাই বিক্রি করেও ৫০ টাকা আয় করি না। এদেরকে ৫০ দিলে আমার উপায় কি। এ কথা বলতেই রক্তচক্ষু মেলে গোমস্তা বললো, তাহলে তোর কারখানা বন্ধ আজ থেকে।

আমি ছুটে গেলাম নাজিরের কাছে। ঘটনা খুলে বলতেই নাজির বললো, ১০০ টাকা রেখে যাও। দেখি কি করতে পারি। আমি পাগলের মতো ছুটলাম উজিরের কাছে। উজির বললো ২০০ টাকা দাও দেখি কোন উপায় করা যায় কিনা। আমি উপায় না দেখে রাজার কাছে ছুটে গেলাম। রাজা আমাকে দেখেই বললেন, তোমার কারখানার অবস্থা তো ভালো না হে। আচার খেয়ে লোকজন অসুস্থ হয়েছে বিস্তর। তোমার জরিমানা হবে ৫০০ টাকা। কারখানা বন্ধ করে তুমি গায়ে ফিরে গিয়ে ৫০০ টাকা কোষাগারে জমা দিয়ে যাও। নইলে তোমাকে শূলে চড়ানো হবে।

আমি গ্রামে গিয়ে জমিজোত বিক্রি করে ৫০০ টাকা জরিমানা শোধ করে শূলের হাত থেকে রক্ষা পেলাম।

গ্রামে ফিরে বুড়ো ওস্তাদের কাছে সবকিছু খুলে বলার পর তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে বললেন, আরো দেড় হাজার বছর পর গাঙ্গেয় অঞ্চলে বান্দেশ নামের যে দেশের জন্ম হবে, সেই দেশটাও আমাদের এই হা-গিলে দেশের মতো হবে। সেই দেশ শাসন করবে হা-গিলের বংশধরেরা।


আমি স্পষ্টতঃই বুঝলাম, এই বুড়োর মাথাটা একেবারে পচে গেছে!

Monday, June 23, 2014

লাক্সের সবচেয়ে পুরোনো বাংলা বিজ্ঞাপনটি

বৃষ্টির সাথে স্মৃতিচারণের একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। অনেক পুরোনো একটা টিভি বিজ্ঞাপন দেখে লাক্স স্মৃতি মাথাচাড়া দিল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত সাবান। তখন লাক্স সাবান বলতে একটু বিলাসী সাবান বোঝাতো। যাদের টাকা পয়সা একটু বেশী তারাই লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করতো। যাদের পয়সা কম আরা লাইফবয়। লিভার ব্রাদার্স এভাবেই দেশের ধনী দরিদ্র দুই ভাগের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমাদের যখন টাকাপয়সা কম ছিল তখন আমরা একটা লাইফবয় কিনে দুই ভাগে কেটে ব্যবহার করতাম। লাক্স সাবান কেনার কথা ভাবতাম না তখন। আবার যখন বাবার পকেটে টাকা আসে তখন শুধু লাক্স না, ডাভ, কেমি এসব সাবানও চলেছে। যাই হোক, আজকের বিষয় আর্থিক অবস্থার বিবর্তন নয়। আজকের বিষয় শুধুই লাক্স বিজ্ঞাপন।

[দুপুরে এক ঝলক রোদের আমেজ আসলেও এখন আকাশ সমস্তটাই কালো, এই দুপুরেই সন্ধ্যা নামিয়ে দিয়েছে। মুষলধারে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় দফার বর্ষণ।]

আমার স্মৃতিতে লাক্সের সবচেয়ে পুরোনো বিজ্ঞাপন নূতনের। এর আগেও কি আরেকটা বিজ্ঞাপন হয়েছিল অলিভিয়ার? মনে নেই, মনে পড়ছে না। যে বিজ্ঞাপনটি ইউটিউবে দেখছি সেটি রঙিন। আমার দেখা টিভি স্মৃতি সাদাকালো। তাহলে কি এটা সিনেমা হলের জন্য বানানো চিত্র? হতে পারে। এই বিজ্ঞাপন যখন দেখানো হতো তখনো টেলিভিশন একটি দুর্লভ বস্তু। দীর্ঘদিন এই বিজ্ঞাপন চলার পর লাক্স তারকা বদল করলো। আসলো সুবর্না। একই স্লোগান নিয়ে। বিশ্বজুড়ে চিত্রতারকাদের সৌন্দর্য সাবান। প্রথমটি যখন দেখায় তখন আমি স্কুলে। সুবর্নার বিজ্ঞাপনের সময় আমি কলেজে। তারপর একসময় কলেজ টপকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে যাই। লাক্স বিজ্ঞাপনে আবারো বদল আসে। এবারের তারকা বিপাশা হায়াত। বিপাশা হায়াতের যুগ শেষ হবার আগেই আমার জগত পাল্টে যায়, আমি টিভি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এখনো নিশ্চয়ই এই সৌন্দর্য সাবানের বিজ্ঞাপন তৈরী হয়। এখনকার তারকা কে? জানি না।

এবার দেখা যাক আমার দেখা প্রথম সেই বিজ্ঞাপনটি।
লাক্স বিশ্বজুড়ে চিত্রতারকাদের সৌন্দর্য সাবান

বৃষ্টির প্রথম ধাক্কাটা শেষ হয়ে এখন স্থির ঝরছে। আকাশের রং কালো নেই। ধপধপে সাদা হয়ে আছে কোটি কোটি জলকণার আলোয়।


Sunday, June 22, 2014

আনস্মার্টের গদ্য এবং বৃষ্টি দিনের কথকতা

১. স্মার্ট বনাম আনস্মার্ট

আমি জীবনভরই আনস্মার্ট। জীবনযাপন পোষাকআশাক শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুতেই। প্রযুক্তিতে এসেও সেই আনস্মার্ট জীবনযাপন। এখন আবার স্মার্ট আনস্মার্টের সংজ্ঞা অন্যরকম। মোবাইল দিয়ে মাপা হয় সেটা। সেই হিসেবে আমি বছরখানেক স্মার্ট ছিলাম। শখ করে একটা সনি এক্সপেরিয়া কিনে কাক হয়ে ময়ূর সেজেছিলাম এই এক বছর। সেদিন মানে গত বিষ্যুদবার আমার সংক্ষিপ্ত স্মার্টজীবনের অবসান ঘটতে শুরু করলো যখন আমি পুরোনো ধাচের একটা মোবাইল কিনলাম।

যে দোকান থেকে স্মার্ট কিনেছিলাম সানমার ওশান সিটির সেই একই দোকানে গিয়ে বললাম, ভাই এবার একটা আনস্মার্ট ফোন দেন, আমার স্মার্টনেসের চেয়েও বেশী দরকার চার্জ। দিনে তিনবার না, তিনদিনে একবার চার্জ দিতে হয় তেমন একটা সেট দেন। আর যদি সম্ভব হয় তাতে যেন গানটান শোনার একটু ব্যবস্থা থাকে। যে কোন ভ্রমণে আমার গান শোনার নেশাটা অনেক প্রিয়। ভ্রমণে বই সাথে থাকলেও চোখ বন্ধ করে গান শোনাই হয় বেশী।

দোকানী আমার জন্য একটা নকিয়া সাদামাটা(আসলে কালোমাটা) একটা সেট বের করে দিলেন। একদম আমার দাদার যুগের চেহারা। দাম মাত্র ২০০০ টাকা। কালোমাটা চেহারাটা পছন্দ হলে আর দেরী না করে জিনিসটা বগলদাবা করে নিয়ে এলাম।


আগের স্মার্টফোনের অভ্যেসগুলো আস্তে আস্তে বদলাতে হবে। প্রযুক্তির সাথে অতিমাত্রায় বন্ধুতার বিপদ অনেক। পদে পদে নাজেহাল করতে পারে সে। একটু কানেকশান বিঘ্ন ঘটলে মনে হয় দুনিয়ার তার ছিঁড়ে গেল। বি কানেক্টেড ব্যাপারটাই একটা মানসিক রোগ হয়ে যায়। পকেটে করে যেন সবসময় আস্ত একখানা অফিস বয়ে নিয়ে যাই। অফিসের মেইল, ফাইলপত্র, দরকারী তথ্য, ছবি, গান,এমনকি মুভিও।  সব বোঝা থেকে হালকা হয়ে ভাসতে ভাসতে বাসায় ফিরলাম।

আনস্মার্ট ফোন থেকে প্রথমে একটা সংক্ষিপ্ত ফোন করলাম এক বন্ধুকে। দেখলাম আগের ফোনের চেয়ে এই ফোনে কথা আরো পরিষ্কার। শুধু একটা সমস্যা। এটাতে ভাইবার নাই। স্মার্টের ভাইবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম বেশ কিছুকাল। ভাইবার সেট থেকে শেষবার যখন ফোন করি তখনো ভাবছিলাম মাঝে মাঝে ভাইবারের জন্য স্মার্টফোনের দরকার হবে। কিন্তু ফোনটা করার পর বুঝলাম, ভাইবারও বিগড়ে গেছে।


২. বৃষ্টির অনিষ্ট বনাম বৃষ্টির রোমান্টিকতা

গত তিনদিন ধরে শহরজুড়ে অঝোর ধারায় বর্ষণ। বঙ্গোপসাগরের সবগুলো মেঘ এখন গাঙ্গেয় মোহনায় অবস্থান করছে। নগরজীবন অচল প্রায়। তলিয়ে গেছে অনেক এলাকা। বর্ষণের গতি এত তীব্র যে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে ধোঁয়াশা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। ২০০৭ এর জুনে এরকম এক বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়েছিল আমাদের আগের বাড়িটা। ঘরের মধ্যেই এক কোমর জল হয়েছিল। আমরা পাশের দোতলা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সব জিনিসপত্রের মায়া ছেড়ে। ১৯৯১ ঘূর্নিঝড়ের মতো সেবারো প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তবু বইগুলো বেঁচে গিয়েছিল। ওই একতলা বাড়ির নিরাপত্তাহীনতা ছেড়ে আমরা পালিয়ে বেঁচেছিলাম শেষমেষ। কিন্তু কত মানুষ পালাবার সুযোগ পায় না। বছরের পর বছর আটকে থাকে চক্রবন্দী হয়ে। বৃষ্টি আমার বুকে ভালোলাগার আমেজ ঘটায়। শুধু কি আমার? এত দূর্যোগ বন্যা সত্ত্বেও বাঙালীর রক্তে বৃষ্টির প্রতি কেমন একটা সিক্ত রোমান্টিকতা কাজ করে না? বৃষ্টি নিয়ে বিশেষ কিছু স্মৃতি? আছে, তবে আজ নয়। আজ একটা কবিতা পড়া যাক। সচলের রোমেল ভাই কিছুদিন আগে লিখেছিলেন-

তোমাকেই লিখছি, তবু তোমাকে জানাতে নয়
হয়তো এ লিখা নয়—
স্মৃতির দোলচেয়ারে বসে
এলোমেলো ভাবনার আঙ্গিনায়
একটু আধটু ঢেউ তোলা...
অনিমেষ চেয়ে দেখা ভাঙনের বিদীর্ণ বুক।

হয়ত অন্ধের রাস্তা হাঁটবার মতো করে
হাতড়ে হাতড়ে চলা
তারপর কিছু কথা বলা ঘোরের ভেতর
তারপর বেলাবেলি হলে বুকের ভেতরের কবন্ধ হাহাকারগুলো
আলগোছে নেড়ে চেড়ে দেখা—
হাওয়ার ভেতরে খুঁজে ফেরা দীর্ঘশ্বাসের কিছু বিমূর্ত সংলাপ।

==========================

৩. এবং আংশিক সংলাপ

বৃষ্টির গান এখনো অবিরাম বেজে যাচ্ছে। আজ ভিজতে হবে। গাড়ি নেই। ছাতা ব্যবহারে অনভ্যস্ত। পকেট বাঁচিয়ে, রাস্তার জমা জল ঠেলে, জুতো মোজা একাকার করে, কতদূর যাবে তুমি, কত দূর।

যেতে যেতে বাংলা গান শুনি-

বন্ধু তোমার মন ভালো নেই

তারপর একখানা ইংলিশ-

And if you ever get lost on life's highway
Don't know where to go
There's just one thing that I want you to know
I am here for you, always here for you
When you're needin' someone to hold you
Remember I told you
I am here for you, I am here for you

[তুঁই যদি লাইপের মেইনরোডে পথ হারায় ফেলো, আঁই আছি, তোঁয়ারলাই আঁই ইয়ানে খাঁড়ায় আছি]

এর ফড়েও যদি তোঁয়ার মন ভালা না হয় তাইলে দেশী চ্যাং এর ক্যারিশমা দেখো






Thursday, June 19, 2014

অসমদুপুরসন্ধ্যারাত্রি

ডায়াল করতেই বহুবার শোনা বাক্যটি আবারো শোনা গেল - 'এই নাম্বারটি বর্তমানে খালি আছে, অনুগ্রহপূর্বক..........'। আমি জানি নাম্বারটা এখন খালি থাকারই কথা। ওই নাম্বারটি আর কেউ নেয়নি। মোবাইল কোম্পানীর এত কোটি নাম্বারের মধ্যে সামান্য একটা নাম্বার খালি থাকলে কারো কিছু এসে যায় না।

সংবাদটা আমাকে কে দিয়েছিল মনে পড়ছে না। দিনটা খুব গরম ছিল মনে আছে। আমি সংবাদটা পেয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে শুরু করেছিলাম। অতদূর অচেনাতে আগে কখনো যাইনি। তবু আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম ঠিকঠাক। পৌঁছে তোর অপেক্ষায় ছিলাম। সেই প্রথম আমি তোর প্রতীক্ষায় কোথাও দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুই এসেছিস সময়ের একটু পরে। অইটুকু সামান্য বিলম্বে কীই বা এসে যায়। আমি কিছু মনে করিনি।

অতদূর থেকে আরো দূর যাত্রার উদ্দেশ্যে তুই আসলি তবু তোর সাথে দেখা হলো না। কেন দেখা হলো না সেটা তুই ভালো করে জানিস। জানে আরো দশজনা।

বাঁশবাগানের মাথার উপর রূপোলী এক চাঁদ উঠেছিল সেদিন। তবু স্নিগ্ধতা ছিল না তাতে। দিনের মতো রাতটুকুও উষ্ণতা ছড়িয়ে যাচ্ছিল। বাঁশবনের ছায়া আমাকে আড়াল করে রাখলেও তোর উপর জ্বলজ্বলে নিটোল পূর্নিমা। অজর আঁধারের গালিচা সরিয়ে তুই কি দেখতে পেয়েছিলি তোর জন্য রাখা এক ফোঁটা জল? তোকে জিজ্ঞেস করা হবে না কোনদিন।

আজ সেই একটা বছর ছুঁয়ে দেবার দিন। তোকে আর কখনো দেখতে যাবো না আমি। আর কখনো তোর প্রতীক্ষায় থাকবো না। আমাদের সবার মধ্যে তুই প্রথম হয়ে গেলি বলে আমরা তোকে হিংসে করি? জানি না। তবে এটা জানি এবার তোর প্রতীক্ষার পালা। এরপর আমরাও আসতে থাকবো একে একে। কোন এক বর্ষণমূখর অথবা বর্ষণহীন রাতে। তখন হয়তো হবে দেখা। অন্য কোন ভূবনে।

১৯শে জুন ২০১৪

Tuesday, June 10, 2014

অচেনা স্বপ্নের বিহ্বলতা

অনেক বছর আগে দূর স্বপ্নের কুয়াশা মেখে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাম একবার। জেগে ওঠার পরও স্বপ্নটা পিছু ছাড়েনি সারাটা দিন। এমনকি কয়েকদিন। ঘোরের মধ্যে মাটিরাঙ্গা পথে ধুলো মেখে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গিয়েও দিগন্ত ছুঁতে পারিনি। আমি যত কাছে যাই দিগন্ত তত দূরে সরে যায়। আমার চোখের ঘোর একসময় ঢেকে যায় সন্ধ্যার অন্ধকারে। সন্ধ্যাকাশের জ্বলে ওঠা শুকতারাটি যখন গভীর উজ্জ্বলতা নিয়ে নিবিড় বনানীর পেছনে আশ্রয় নিল তখন যে লাইনগুলো বেজে উঠেছিল বুকের গহীনে-

কোনোদিন দেখিব না তারে আমি: হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে
কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান
সারারাত, — তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে — বেনুবনে তাহার সন্ধান
পাবো নাকে: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনীর সাথে,
সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না — আসিবে না কখনো প্রভাতে,
যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান,
যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান,
ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে; — এইখানে ধুন্দুল লতাতে
জোনাকি আসিবে শুধু: ঝিঁঝিঁ শুধু; সারারাত কথা কবে ঘাসে আর ঘাসে
বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে;
প্রতিটি নক্ষত্র তার স'ান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে
নীরব ধূসর কণা লেগে রবে তুচ্ছ অনূকণাটির শ্বাসে
অন্ধকারে — তুমি, সখি চলে গেলে দূরে তবু; — হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে
অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে; আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।

অতঃপর আমি যেন বিষন্ন পরাজিত নাবিক এক। আমাকে ক্লান্ত.... ক্লান্ত করে দিয়েছিল পৃথিবীর সকল অবশিষ্ট উপাদান। পথের বিছানো ইটের অমসৃন সমতলে পা ঘষতে ঘষতে, ঘষতে ঘষতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম অন্ধকার এক অনিশ্চয়তার পথে। আমাকে ফিরে ডাকার কেউ ছিল না তখন। মহাসড়কে উঠে অচেনা গন্তব্যের বাস ধরে আমি ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম বিম্বিসার ধূসর জগতের দিকে। যেখানে জীবনের সমুদ্র সফেন। তারপর দীর্ঘ পদযাত্রা, অফুরন্ত সেই পথ। কিন্তু আমাকে দুদণ্ড শান্তি দেবার মতো কোন অশ্বথ বট পথের ধারে অপেক্ষমান ছিল না। আমি এক অন্ধকার থেকে অন্য অন্ধকারে পথ হারিয়ে ঘুরে মরছিলাম। সবগুলো পথের দিশা আমার কাছে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘন সুপুরি বনের পাশে কলকল বয়ে যাও সরু জলধারা আমাকে কেবলই বিভ্রান্ত করে যাচ্ছিল। তখন আবারো বেজে উঠলো নতুন এক বেদনার্ত সুর-

খুঁজে তারে মরো মিছে — পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;
রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে — তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক
নাই আর; — অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক
দাঁড়কাক দেখা যেত দিন — রাত, — সে আমার ছেলেবেলাকার
কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার:
রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক, —
এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক
তার কথা ভাবি শুধু; এত দিনে কোথায় সে? কি যে হলো তার
কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস,
সেই দিন, সেই রাত্রি, সেই সব ম্নান চুল, ভিজে শাদা হাত
সেইসব নোনা গাছ, করমচা, শামুক গুগলি, কচি তালশাসঁ
সেইসব ভিজে ধুলো, বেলকুড়ি ছাওয়া পথ, ধোয়া ওঠা ভাত,
কোথায় গিয়েছে সব? — অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ
ভোর রাতে — নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!

রাত শেষ হয়, আমার পথ চলা শেষ হয় না, তখন আরো একটি নতুন ভোরের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পুবদিগন্ত। হারিয়ে যেতে থাকে রাতভর জ্বলতে থাকা নক্ষত্রমণ্ডলী। আমি হারিয়ে ফেলা অন্ধকারের জন্য কেঁদে উঠতেই ওরা আগে বলে উঠলো, ভেবো না, আমরা আছি দিনের আলোর গভীরেও। আবার ফিরবো সন্ধ্যা তারার ডাকে। তুমি থেকো, পথের দিশে হারিও না। আবার হবে দেখা।

তখন থেকে আমি অন্ধকারের প্রেমে পড়ে যাই। অন্ধকারের বুকেই আছে আমার প্রিয় নক্ষত্র নীহারিকার আলো। আকাশের বাতিঘর হয়ে আমাকে পথ দেখায় নিরন্তর।


[কবিতা কৃতজ্ঞতাঃ জীবনানন্দ দাশ, অরণ্যচিত্রঃ লাউয়াছড়া,সিলেট, রাতের আকাশঃ নামিবিয়া]

Monday, June 9, 2014

বিষাক্রান্ত বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ১০০% বিশুদ্ধ খাবার খেতে পারেন কত শতাংশ মানুষ? তাদের বিশুদ্ধ খাবারের উৎস কী? তারা কোথা থেকে বাজার করে? সেই বাজার রান্না হবার আগে এবং পরে বিশুদ্ধতা যাচাই করে কে? যাচাই করার পদ্ধতি কি?

হতে পারে কিছু শীর্ষ ক্ষমতাবান মানুষ, সংখ্যানুপাতে যারা ০.১% অথবা ০.০১% এর মতো ক্ষুদ্রাংশ, নিশ্চয়ই বিশুদ্ধ খাবার খায়। তাদের মধ্যে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রী আমলা শীর্ষ ধনকুবেরগন রয়েছেন। নিশ্চয়ই ভেজালমুক্ত রান্নাঘর তৈরীর ক্ষমতা তাদের আছে। সাধারণ মানুষের সে ক্ষমতা নেই, এমনকি ভেজালমুক্ত মানুষেরা কী পদ্ধতিতে ভেজাল থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখেন তাও জানার উপায় নেই।

ভেজাল দিয়ে যদি ভাগ করি, তাহলে দেশটা দুই ভাগে বিভক্ত। বিশাল অংশের ভাগটা ভেজাল খাবার খায়, আরেকটা ছোট্ট অংশ ভেজালমুক্ত খাবার খান।

যারা ভেজালমুক্ত আছেন, তারা কি ভেজালযুক্ত মানুষের কথা ভাবেন? মনে হয় না। দেশের ৯৯.৯% মানুষের বাজার, খাবার, রান্নাঘর ইত্যাদি পরীক্ষা করার কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা জানতেও পারি না প্রতিদিন আমরা কি পরিমান ফরমালিন খেলাম, কি পরিমান কার্বাইড গিললাম, কি পরিমান ক্রোমিয়াম পাকস্থলীতে জমা করলাম। যদি জানতাম তাহলে হয়তো আমরা আমাদের আয়ু সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারতাম। বুঝতে পারতাম, আমি মরবো কিডনী রোগে, তুমি মরবে যকৃতধ্বংস হয়ে অথবা সে মরবে পাকস্থলীর কোলন ক্যান্সারে।

একটা লঞ্চ ট্রেন কিংবা বাস দুর্ঘটনায় ৫০ জন মানুষ মারা গেলে সারাদেশ ব্যাপী তোলপাড় ঘটে যায়। কিন্তু ভেজাল খেয়ে বছরের পর পর হাজার হাজার মানুষ নীরবে মারা যাচ্ছে সেটা খুব বেশী গুরুত্ব পায় না। এই মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

এদেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনস্টিক সেন্টার, ডাক্তারের চেম্বার কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ছুটছে চিকিৎসা পেতে। বাজার খরচের টাকা না থাকলে আধপেটা থাকা যায়। কিন্তু চিকিৎসা খরচ না থাকলে ডাক্তার চোখ তুলেও দেখবে না, ডায়গনস্টিক সেন্টারও বলে তফাত যাও। তাই সর্বস্বান্ত হয়ে, ঋনগ্রস্থ হয়েও চিকিৎসার খরচ যোগাতে হয়। আমার চারপাশের চেনাজানা আত্মীয়বন্ধুর গড়পড়তা ৫০টি পরিবারের খোঁজ নিলে দেখবো, সম্পূর্ণ সুস্থ আছে তেমন পরিবার একটিও নেই। প্রতি পরিবারে একজন না একজন অসুস্থ রোগীর দেখা মিলবেই।

বিশ পচিশ বা পঞ্চাশ একশো বছর আগেও অসুস্থ হতো মানুষ। কিন্তু সেটার ধরণ ছিল ভিন্ন। ওটা ঘটতো বছরে দুয়েকবার মাত্র। জ্বরজারি সর্দি কাশি আমাশা ডায়রিয়া ছাড়া তেমন গুরুতর কোন সমস্যা থাকতো না। এখন তো প্রতিমাসে, কখনো কখনো প্রতি সপ্তাহেও আমাকে ডাক্তারের কাছে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে, হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে পরিবারের কোন না কোন সদস্য নিয়ে। একজন সুস্থ হতে না হতেই আরেকজন অসুস্থ হয়। গুরুতর সব রোগের নাম। কারো কিডনী চলে গেছে, কারো লিভার নষ্ট, কারো পাকস্থলী, কারো খাদ্যনালী। সামাজিক বা বন্ধুবান্ধবের যে কোন আড্ডায় বসলে অবধারিতভাবে চলে আসবে ডাক্তার হাসপাতাল রোগ বালাই ইত্যাদির কথা।

দেশব্যাপী এই বিরামহীন অসুস্থতার পেছনে প্রধান অবদান খাবারের। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যে খাবার সংগ্রহ করছে দিনরাত পরিশ্রম করে, সেই খাবার খেয়েই মানুষ মরতে বসছে। শরীরের যেসব অংশ দিয়ে খাবারদাবার আসা যাওয়া করে সেই পথগুলো ভয়াবহ সব সমস্যায় আক্রান্ত।
সামর্থ্য থাকলে আমি হয়তো ভালোমন্দ বাজার করে রান্নাঘর ভর্তি করে ফেলতে পারি কিন্তু বিষমুক্ত খাবারের ব্যবস্থা করা আমার জন্য অসম্ভব। ফলমূল, শাকসবজী, মাছ, মাংস, তেল মশলা কিসে নেই বিষ? আমার কাছে বিষাক্ততার মাত্রা যাচাই করার যন্ত্রপাতি নেই। তবু আমি জানি প্রতিদিন যা কিছু খাবার কিনছি তার বিরাট অংশেই ছড়িয়ে আছে নিঃশব্দ ঘাতক। আমি বাজারের থলেভর্তি করে বিষমুক্ত খাবার কিনে বাসায় যাই। পরিবারের পুষ্টি, আমিষ-প্রোটিন বাড়াতে গিয়ে রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেই বিষের ভিটামিন।

আমাদের কথা বাদ দিলাম। বলি যারা দেশ পরিচালনা করেন, যারা দেশের আইন কানুন, পরিবেশ, বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের সবার খাবার কি ১০০% বিষমুক্ত? তারা কি নিশ্চিত হয়ে প্রতিদিন বাজার করেন, রান্না করেন? যদি না হয় তাহলে তারাও কী ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে হাঁটছেন না? তাহলে সমগ্র জাতিই দীর্ঘমেয়াদী আত্মহননের পথে যাচ্ছে? কী ভয়াবহ ব্যাপার!!

এই জাতির ভবিষ্যত কী? নিকষ কালো আঁধার? নাকি একটু আলো আছে। শেষমেষ বাংলাদেশকে কেউ বিষমুক্ত করতে না পারলে আমরা কি এমন অসম্ভব কোন আশা করতে পারি বিষের সঙ্গে বসবাস করতে করতে মানুষের শরীর কোন একদিন এই সকল বিষ হজম করার মতো শক্তি অর্জন করে ফেলবে অভিযোজন প্রক্রিয়ায়? উটপাখির পাকস্থলী নাকি লোহা পাথর ইত্যাদি কঠিন জিনিস হজম করার মতো শক্তি রাখে। আমাদের পাকস্থলীও কি একদিন সেরকম শক্তিমান হয়ে উঠবে?


সবশেষে একটা সংবাদ পড়ে মনটা আরো দমে গেল। এতদিন ভাবতাম অন্য ফলে যাই ঘটুক, মোটা চামড়ার কাঁঠাল নিশ্চয়ই ফরমালিন মুক্ত। পছন্দের ফল না হলেও এতে একটু ভরসা রাখার জায়গা পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই কাঁঠালেও ফরমালিন। হারাধনের আর একটি ছেলেও অবশিষ্ট রইলো না।

Sunday, June 8, 2014

তুমার জন্য মর্তাম পারি!!!

দুনিয়া ভর্তি বিনোদন!!
ঘর অইতে দুই ফা পেলিয়া
দেখা হয় নাই চঞ্চু মেলিয়া
এ কোন হৃদয় খানের গান,
চনমন করে দিল প্রান
এই খাঁ খাঁ রোদের গরম দুপুরে।
অট্ট হাস্য করিলাম ঠা ঠা করে
সকল দুশ্চিন্তা বেদনাকে
নির্বিঘ্নে পাঠাইলাম নির্বাসনে।

হযরত আলি নিবেদিত ঠাঠা রোদ্দুর সঙ্গীত।
১০০% বিনোদন নিশ্চিত, বিফলে মূল্য ফেরত।

গানের পরে গান

এলোমেলো সময়ে গান কি কোন কাজ দেয়? তিন তিরিক্ষে নয় রকমের ঝামেলায় গান শোনার মুডও উবে গিয়েছিল। ভোরবেলা কর্মস্থলে আসার পথে ব্যাগের ভেতর থেকে না পড়া একটা বই বের করে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে পনেরো মিনিটের যাত্রা পয়তাল্লিশ মিনিটে শেষ করে কর্মস্থলে পৌঁছে যাই। গান শুনে শুনে কী বই পড়া যায়? যায়, আবার যায় না। আমি ছাত্রজীবনে গান শুনে শুনে অংক করতাম। ভার্সিটির পড়ালেখার সময় ওভাবেই গেছে। আর কিছু না হোক গোল্লা গোল্লা নাম্বার যোগাড় হয়েছে। থার্ড ইয়ারে এসে তবু রক্ষা।

কিছু গান আছে যা শুনতে শুনতে পড়াশোনা করা যায়। বহুবার শোনা গানগুলো। আবার একদম নতুন গান হলে পড়ায় মন বসে না। আবার গান শুনেও যুত লাগে না। তাই বই পড়ার সময় পুরোনো গান শুনি, আর নতুন গান শোনার সময় বই পড়ি না। এভাবেই গান শোনা আর বই পড়া একটা আপোষ করে নিয়েছে। কেউ কারো ক্ষতি না করেই সহাবস্থানে থাকতে পারছে।

বেশ কিছুদিন সুমনের গান শুনছিলাম। এই পর্বে আবারো নতুন কটা গান পেলাম। শুনে দেখার জন্য সংগ্রহ করলাম।


থেমে যেতে যেতে


সাড়া দাও



বিগড়ে যাওয়া সময়গুলো যখন অমসৃন পথ ঠেলে এগিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায় তখন কেউ আকাশ পথে হাতটি ধরে মাটি থেকে একটু করে ভাসিয়ে দিলে, ভেসে যেতাম আমি।

অসময়ে গুরুত্ব হারানো সংবাদটি

কেতাবী জ্ঞান না থাকলেও কাতেবুল ইসলামের কুতুবী বুদ্ধির কাছে মিরাজুল ইসলাম দুগ্ধপানরত বাছুর মাত্র। এক গাঁয়ের বাসিন্দা দুইজনই, দুই প্রান্তে বসবাস। শৈশব কৈশোরে একসাথে দুরন্তপনা করলেও দেশভাগের পর ভোল পাল্টে যায় কাতেবুল ইসলামের। দাঙ্গার সময় গ্রাম ছেড়ে পালানো এক হিন্দু পরিবারের সব সহায় সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব নেবার পর পুরো গাঁয়ের দায়িত্বও যেন তার উপর এসে পড়ে। সেই পরিবার আর ফেরেনি, সম্পদের দলিলে কাতেবুলের কারসাজির হাত পড়ে মালিকের ঠিকানা বদলে যায়। শুরুতে আপনি মোড়ল হলেও একসময় গাঁয়ের লোকেও তাকে মানতে শুরু করে। এক মিরাজুল ইসলাম ছাড়া।

মিরাজুল ইসলাম তাকে মোড়ল মানতে পারে না বন্ধুই মনে করে এখনো। বাল্যবন্ধু হলেও কাতেবুল ইসলাম ধনদৌলতের মালিক হবার পর থেকে মিরাজুলের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে থাকে। একসময় মিরাজুল বন্ধুকে হারিয়ে ফেলে চামুণ্ডাবেষ্টিত ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে।

কাতেবুলের বৈঠকখানায় লম্বা একটা টেবিলের এক পাশে দুটো চেয়ার বসানো আছে যেখানে সে বিশিষ্ট অতিথিকে বসিয়ে গল্পগুজব করে। টেবিলের দুপাশে আর ঘরের চারপাশে আরো আট দশখানা কাঠের টুল বসানো যেখানে গ্রামের সাধারণ লোক বসে মোড়লের কথা শোনে।

মিরাজুল প্রথম ভুলটি করে এক সালিশের দিনে। সেদিন সে কাতেবুলের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে কোন কথাবার্তা ছাড়াই। কাতেবুলের কাছে ব্যাপারটা বেয়াদবীর সামিল। ছেলেবেলায় নেংটা হয়ে এক পুকুরে গোসল করেছি বলে এখনো এক বিছানায় ঘুমাবো তা কখনো হয় না। গাঁয়ের লোক কিন্তু এতে কিছু মনে করে না, জানে দুজনেই বাল্য দোস্ত। কাতেবুল মনে মনে খুবই রুষ্ট হয় কিন্তু মুখফুটে কিছু বলতে পারে না। মনে মনে চেপে রাখে।

সেই থেকে শুরু। সুযোগ পেলেই কাতেবুল অপদস্থ করতে শুরু করে মিরাজুলকে। মিরাজুলের অর্থবিত্ত নেই, কিন্তু কিছু জোত জমি আছে তাতে ভালোই সংসার চলে। এই ভালোটা কাতেবুলের সহ্য হয় না। সে চায় বাকীদের মতো মিরাজুলও তার বাধ্য থাকবে, তার অধীন থাকবে, টাকাপয়সা লাগলে হাত পাতবে। ছেলেমেয়ের জন্য ভালো জামা লাগলে এসে বলবে। কাতেবুল জনসেবা করতে পছন্দ করে। সে সবাইকে সেবা করলেও মিরাজুলের জন্য কিছু করতে না পেরে মনে মনে অস্বস্তিতে ভোগে।

অস্বস্তিটা কয়েকগুন বেড়ে গেল যখন মেরাজুল বাড়ির পশ্চিম জমিতে বিরাট একটা পুকুর খনন করালো। পুকুরের চারপাশ ঘিরে নারকেল আম জাম কাঠাল গাছ লাগালো। খাবার জল আর মাছ চাষ দুটোর জন্যই দরকার ছিল পুকুরটার। গাঁয়ের লোকের মুখে পুকুরের প্রসংশা শুনে কাতেবুলের মেজাজটা দ্বিগুন চড়ে গেল।

মেজাজ ঠাণ্ডা করতেই বোধহয় কাতেবুল একদিন একটা মোটর সাইকেল কিনে ফেললো। নানান কাজে তাকে জেলা শহরে যাতায়াত করতে হয়। মোটরসাইকেলের দরকারটা ফেলনা নয়। জেলাশহর থেকে ফেরার সময় দুনিয়া কাঁপিয়ে ভটভট করে যখন তালতলার মেঠো পথে নামে তখন গাঁয়ের লোক কেন যেন একটু তটস্থ হয়ে পড়ে।

এরকম সময়ে মিরাজুল ইসলাম তৃতীয় বেয়াদবীটা করে বসলো। একদিন সে একটা রেডিও কিনে ফেললো। দেশ বিদেশের খবর শোনার জন্য। কাতেবুল ভাবলো এটা মিরাজুলের বাড়াবাড়ি। সে মোটর সাইকেল কিনেছে বলে পাল্টা রেডিও কিনে সে বাহাদুরি দেখালো। চাইলে কাতেবুল তিনটা রেডিও কিনে দেখাতে পারে। কিন্তু সেটা করলে মিরাজুলকে শিক্ষা দেয়া হবে না। তাই সে এক বৈঠকে ঘোষণা করলো, রেডিও হলো শয়তানের বাক্স। মানুষের ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে রেডিও শুনলে। চাটুকারেরা রব তুললো শয়তানের বাক্স, শয়তানের বাক্স, শয়তানের বাক্স।

একদিন কাতেবুলের বড় ছেলে জেলা শহর থেকে ফেরার পথে একটা রেডিও কিনে আনলো। কাতেবুল রাগে কিড়মিড় করেও জিব কামড়ে ফতোয়া বের করে ফেললো। ইহুদি নাসারার সাথে যুদ্ধ চলতেছে আরব দেশে। সেই যুদ্ধের খবর শোনা ঈমানী দায়িত্ব। সুতরাং রেডিও এখন হালাল। মোসাহেবরা বললো হালাল হালাল হালাল।

মিরাজুলের বড় ছেলে ঢাকায় পড়াশোনা করে। সে একটা মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেলেছে শহরেই। মিরাজুল সমাজে মুখ যতটুকু দেখাতে পারতো তাও বন্ধ হয়ে গেল কাতেবুলের এক ফতোয়ায়। যে ছেলে বাপের অমতে বিয়ে করে তাকে ত্যাজ্য করা ছাড়া কোন উপায় নাই। মাথা নীচু করে শুনলেও মিরাজুল ত্যাজ্য করতে পারলো না ছেলেকে। তবে কঠিনভাবে বলে দিল সে যেন গ্রামে না আসে আর। মেসাহেবরা বললো ত্যাজ্য ত্যাজ্য ত্যাজ্য।

বছর না ঘুরতেই কাতেবুলের বড় ছেলেটা একদিন পাশের গ্রামের এক কৃষকের মেয়েকে তুলে এনে জোর করে বিয়ে করলো। কাতেবুলের ফিট হওয়া মাথায় বরফ দেবার পর হুশ ফিরলে সে প্রথম যে বাক্যটা বলে তা হলো, 'বয়স হলে মুসলমানের ছেলেকে বিয়ে করানো বাপের দায়িত্ব। বাপ সে দায়িত্ব ভুলে গেলেও ছেলে যে ভোলেনি, সেজন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। সে নিজ দায়িত্বে বাপের অপ্রদত্ত নির্দেশ পালন করেছে বলে তাকে খোশ আমদেদ। মোসাহেবরা বললো, খোশ আমদেদ, খোশ আমদেদ, খোশ আমদেদ।

মিরাজুল সব বুঝেও মুখ বন্ধ করে থাকে। সে বুঝে ফেলে একই কাজ তার জন্য হারাম হলেও কাতেবুলের জন্য হালাল। এই নিয়মের মধ্যে সে ছোট মেয়ের বিয়েটা দিয়ে ফেলে নিজ হাতে। ব্যাপক আয়োজন না হলেও ঢাকঢোল কম বাজেনি।

মিরাজুলের মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি পৌঁছানোর আগেই কাতেবুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তার মেয়ের বিয়েটা এমন জাঁকজমক করবে তা  সাত গ্রামের লোকে দেখেনি। জেলা শহর থেকে বাবুর্চি, শহরের নামকরা ব্যাণ্ডের বাদক দল, মহাসড়ক থেকে গ্রামে ঢোকার রাস্তার পুরোটাই সাতদিন ধরে আলোকসজ্জা চলবে।

তিন মাসের মধ্যে পাত্র ঠিকঠাক করা হলো। মোড়ল জীবনের তেইশ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো কাতেবুল হাজির হলো সাবেক বন্ধুর বাড়ি। বিয়ের দাওয়াত নিয়ে। অনুষ্ঠানের তিনদিন আগেই যেন মিরাজুল পরিবার নিয়ে তার ঘরে চলে আসে ভাবীসাবকে সেই ওয়াদা করিয়ে তবে উঠলো কাতেবুল। মুগ্ধ হলো মিরাজুলের পরিবার।

বিবাহের আয়োজনের সাথে দুই বন্ধুর পুনর্মিলনে গ্রাম জুড়ে আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো।

গায়ে হলুদে রাতভর জমজমাট অনুষ্ঠান হলো বলে বিয়ের দিন সবাই দেরীতে জেগে উঠলো।

ঘুম থেকে জাগার পর দুইজন মানুষকে নিখোঁজ দেখা গেল। স্বয়ং বিয়ের কন্যা এবং মিরাজুলের কনিষ্ঠ পুত্র।

দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে কাতেবুল পাঁচ সেকেণ্ডে বুঝে ফেলে তার মেয়েকে নিয়ে মিরাজুলের পোলাটা ভাগছে। তাকে ধরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো আমি। মিরাইজ্যারে আমি এখন লাথি দিয়ে পুস্কুরনীতে ফেলে দেবো। খুন করে ফেলবো তোর গুষ্টিশুদ্ধা। শালা নেমক হারাম!

এরকম গালিগালাজ চলাকালীন কাতেবুলের শুভাকাংখী একজন পরামর্শ দিল খুনের কর্মসূচী আপাততঃ মুলতবী রেখে থানায় যাওয়া যাক। পুলিশকে কাজে লাগালে কাজ অনেক সহজ।

থানায় যাবার পথে পাশের জমিতে সাদা পাঞ্জাবীতে একজনকে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। কাছে গিয়ে দেখা গেল সেটি মিরাজের কনিষ্ঠপুত্রের লাশ।

ঘটনা এখানে এসে সম্পূর্ন উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে।

জানাজানি হতেই শত শত লোক ছুটে এলো। কাতেবুল ইসলামে পা থানার বিপরীত দিকেই টানতে শুরু করলো এবার। থানায় গিয়ে মামলা করার বদলে তাকে এখন বলতে হবে, আমি খুন করি নাই!

খুনের দায় থেকে রেহাই পেতে কাতেবুলকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হলো। মিরাজুলকে আবারো বুকে টেনে নিতে হয়েছিল তাকে।

কিন্তু মিরাজুল কোনদিন তাকে ক্ষমা করতে পারেনি। আবার এটাও বুঝতে পারেনি কেন তার ছেলেকে খুন হতে হলো। তার সাথে কি কাতেবুলের মেয়ের কোন সম্পর্ক ছিল? সেরকম কোন ইঙ্গিত পায়নি কোনদিন।

অনেক তদন্ত করেও এই ঘটনার ব্যাপারে আর কিছুই জানা যায় না। রহস্য থেকে যায়। একসময় সবাই ভুলে যায়।

শেষ সংবাদঃ
কোন ঘটনাই চাপা থাকে না চিরকাল। বহুবছর পর জানা যায় কাতেবুলের মেয়েটা যাকে ভালোবাসতো তার সাথে যখন পালাচ্ছিল তখন কাতেবুলের কনিষ্ঠ সন্তানের চোখে পড়ে যায়। ছেলেটা তাদের পিছু পিছু কিছুদূর যাবার পর তাকে ধরে খুন করে ফেলে রেখে যায় মেয়েটার প্রেমিকের বন্ধুরা। এই সংবাদটা এমন সময় জানা যায় যখন কাতেবুল আর মিরাজুল দুই বন্ধুই পরপারের ঠিকানায় পৌঁছে গেছে। এরকম চটকদার সংবাদেও কোন সাড়া পড়ে না। কারো কোন উপকার হয় না।

Friday, June 6, 2014

এই সব দুঃখবোধ

১.
একজন অচেনা মাহবুব শাহীন খিলগাঁও রেলক্রসিং এ নিজের শরীরকে চলন্ত ট্রেনের নীচে পাঠিয়ে দেবার আগমুহূর্তে ফেসবুক মারফত পৃথিবীকে যে বার্তাটা জানিয়ে গিয়েছে তার অন্তর্নিহিত সত্য কতটা বেদনাদায়ক তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু একজন অচেনা মাহবুব শাহীনের এরকম একটা প্রস্থান আমার সমস্ত অস্তিত্বকে নাড়া দিয়েছে। পৃথিবীর কেউ তাকে useless ভেবেছিল বলেই হয়তো সে নিজেকেই উপহাস করে বলেছে Leaving useless myself forever. আড়াই লক্ষ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটও তোমার কাছে অর্থহীন এখন!!

২.
এই ঘটনায় নিজস্ব ব্যক্তিগত দুঃখবেদনাজনিত হতাশ্বাসের জন্য খুব খুব লজ্জিত হলাম আজ।

৩.
কালকে আবারো নুতন কোন সমস্যায় ভারাক্রান্ত হয়েও ভাবতে থাকবো আমার চেয়ে ঢের বেশী সমস্যাক্রান্ত মানুষ আছে। আমাকে দুঃসময়ে হাত ধরার মানুষও আছে এখনো

৪.
পরশু হয়তো এই সব পরদুঃখ ভুলে আবারো আপনারে লয়েই বিব্রত রহিতে শুরু করিবো। জগতে এই মানবিক স্বার্থপরতা হাজার বছরের ইতিহাস।

Wednesday, June 4, 2014

হারিকেন

-একটা ঘান গাইবার কথা ছিল, ঘান
-ঘান নয় গাধা, গান
-না, ঘান
-ঘান কি করে হয়
-হয়, এরকম সময়ে ঘান হতে হয়, আমি গলা ছেড়ে ঘান গাইবো
-এতো দেখি পাড় মাতাল, শালা!
-ঐ গালি দিবি না, আমি তোর শালা কেমনে, তুই তো বিয়াই করিস নাই
-বিয়া করি নাই তো কি হইছে, করছি তো
-কি করছিস
-যা ইচ্ছে করছি,এবার ঘান গাইতে হবে
-ধুশশালা মাতোয়াল!
-ঐ আবারো গালি দেস?? আমি তোর গলাটা চেপে ধরবো, আয় হারামী.....কাছে আয়। আমি তোর গলা টিপে ধরে কাঁদি, আয় দুজনে কেঁদে কেঁদে ঘান গাই।

দোতলার বারান্দা থেকে দুই মাতালের গলাগলি আর গালাগালি শুনছিলাম মাঝরাতে। আমার ঘুম আসছে না। ঘরের ভেতর প্রচণ্ড গরম। কারেন্ট নেই। মশার ভ্যানভ্যান। সব মিলিয়ে ভীষণ অস্বস্তিকর একটা রাত। রাত দুটো বাজে এখনো ঘুমের দেখা নেই। প্রতিদিন এরকম হচ্ছে। মাঝরাতে উঠে বসি। আমার রুমমেট গ্রামের বাড়িতে গিয়ে অসুখে পড়েছে। গত কয়েকদিন একাকী রাত্রিযাপন।

সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরে হারিক্যানটা জ্বালিয়ে রাখি। যখন তখন কারেন্ট চলে যায় বলে নয়। আমার নিজস্ব শখে। আমার পড়াশোনার বাতিক আছে একটু, কিন্তু টাকাপয়সার অভাবে তেমন বইপত্র কেনা হয় না। ফুটপাত থেকে পুরোনো ঈদসংখ্যা কিনে জমিয়েছি কিছু। সময় পেলে ওগুলোই পড়ি। মোটা মোটা ম্যাগাজিনগুলো অনেক সস্তা। একেকটা সংখ্যায় দশ পনেরোটা উপন্যাস থাকে। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে অনেক পাওয়া।

আমি মেট্রিক পাশ করার পর গ্রাম থেকে চলে আসি সংসারের হাল ধরার জন্য। টাইপের কাজটা শিখেছিলাম বলে একটা কাজ পেয়ে যাই। সারাদিন খুটখাট টাইপ করে মাস শেষে যা পাই তাতে সংসারের হাল ধরা যেতো না। তাই ভাবি যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে।

দুর্ভাগাদের জন্য ধার্মিকেরা আশ্বাসবাণী ছড়ায়। আল্লায় যা করে ভালোর জন্যই করে। হ্যাঁ আমি জানি। খুব ভালো করে জানি এখন। সব ভালোর কারিগর সেই। এমনকি এক অসুখে আমার মা আর ছোটভাইটা এক সপ্তাহের মধ্যে দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েও খুব ভালো কাজ করেছে। সবই তাঁর ইশারায়।

সংসারের হাল ধরার জন্য এখন আর হিমশিম খেতে হয় না। চার হাজার টাকা বেতনে আমার খুব ভালো চলে যায়।

মেসের সবগুলো ঘরে কারেন্ট আছে। শুধু আমার ঘরে নাই। আমার ঘরে লাইন আছে। কিন্তু বাতি না জ্বালালে ভাড়া ১০০ টাকা কম। পঞ্চাশ টাকার কেরোসিনে আমার সারা মাস চলে যায়।  তাই বাতি লাগাই নাই। তাছাড়া বাতি ফিউজ হলে আমার কিনে লাগাতে হবে। একটা বাল্বের টাকায় দুই সপ্তার কেরোসিন হয়ে যায়। এটা কি যথেষ্ট জোরালো কারণ নয়?

হারিক্যানটা আমার কিনতে হয়নি। চিমনিও বহু পুরোনো। কালসিটে দাগ পড়েছে, তবু বদলাই না। আমি সন্ধ্যাবেলায় হারিক্যান জ্বালিয়ে পড়াশোনা করি। যেমন করতাম গ্রামের স্কুলে পড়ার সময়। তখন মা হারিক্যানটা ঝেড়ে মুছে জ্বালিয়ে দিতেন। চিমনিতে খাতার কাগজ ছিঁড়ে চারভাঁজ করে একটুকরো কাগজও লাগিয়ে দিতেন। চোখে আলো আসলে পড়তে অসুবিধা।

আমি সেই অভ্যেসটা এখনো চালু রেখেছি। পুরোনো ঈদসংখ্যার বিজ্ঞাপনের পাতা ছিড়ে চারভাঁজ করে হ্যারিকেনের চিমনিতে আটকে দেই। চোখে আরাম লাগে। পড়তে কষ্ট হয় না আর চোখের জলও আড়াল হয়।

আসল ব্যাপারটা সসংকোচে বলেই ফেলি।

আমি প্রত্যেক সন্ধ্যায় নিয়ম করে চোখের জল ফেলি। পুরুষ মানুষের চোখের জল লজ্জার বিষয়। কিন্তু এই হ্যারিকেনের সামনে বসলে আমার চোখে জল না এসে পারে না। এই উজ্জ্বল শহরে আমি পুরোনো চিমনির মধ্যে যে আমার মায়ের মুখ দেখি। এই হ্যারিকেন আমার আমরণের সঙ্গী!

Tuesday, June 3, 2014

বছর কুড়ি আগে

ওদের দুজনের কথা আমার খুব মনে পড়ে।

আরো মনে পড়ে তখন বিটিভিতে অ্যালেক্স হ্যালীর রুটস দেখাচ্ছিল আর আমি তখন ভার্সিটির নবীন ছাত্রের গন্ধ কাটিয়ে উঠছিলাম মাত্র। সংসারে তখন তীব্র অভাব, পড়াশোনা করাটা বিলাসীতারই নামান্তর। তবু কিভাবে যে চলছিল! চলছিল কারণ বাবা নামের বটগাছটি ছিল। যে বটগাছটি কয়েক বছর আগেও সুখের পায়রাদের নিয়ে বিত্তবান সমাজে আনন্দ উল্লাসে সময় কাটাতো সেই বটগাছ এখন পত্র পল্লব হারিয়ে ঘরের কোনে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছিল। সেই ঘরটিতে বাবার নিত্য সঙ্গী ছিল ১৪ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশনটা যা বিকেল পাঁচটায় জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জেগে উঠতো, ঘুমাতো রাত বারোটায় জাতীয় পতাকা দেখাবার পরে। সেই সময়ের অধিকাংশ বাবা খুব মন দিয়ে টেলিভিশনে ডুবে থাকতো। মা বিরক্ত হতো, আমরাও কখনো কখনো। বাবা টিভি রুমে থাকলে রুটস ম্যাকগাইভার বা বিশ্বকাপের খেলাটেলা দেখা হলেও মুভিটুভিগুলো দেখতে সাহস পেতাম না। টিভির জাতীয় পতাকা দেখানোর অনেক পরেও বাবা জেগে থাকতেন। ঘুম আসতো না হয়তো। কেন আসতো না আমাদের বোঝার বয়স হয়তো হয়নি, অথবা আমরা সেদিকে দেখতে চাইতাম না।

ঠিক সেরকম একটা সময়ে কুনতা কিনতে আমাদের ঘরে আসে। একদিন বাবা বাজারে  গিয়ে গোশতের বদলে দুটো ফুটফুটে খরগোশ ছানা নিয়ে ফিরেছিল। মায়ের তিরস্কারের মুখেও আমরা ভাইবোন চুপি চুপি বাবার পাশে গিয়ে খরগোশ দুটোকে দেখছিলাম এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই আদর করে ওদের নামকরণ করা হলো কুনতা কিনতে। রুটসের সেই বিখ্যাত দাস চরিত্র। ঘরে বাজার করার টাকা নেই কিন্তু খরগোশের জন্য তারের জালির সুন্দর ঘর তৈরী হয়ে যায়। ওদের জন্য আসতে থাকে খাবার দাবার সবজি।

আমরা অভাবের কথা ভুলে খরগোশ নিয়ে মেতে থাকি কদিন। আমাদের সামনের সবুজ বাগানে খরগোশ দুটো ছোটাছুটি করতো, খেলা করতো নিজেদের সাথে আর আমাদের সাথে। আমাদের সবচেয়ে কনিষ্ঠ বোনটার খুব প্রিয় হয়ে যায় কুনতা কিনতে। ওর প্রিয় সবকিছু আমারও প্রিয়, আমার প্রিয় সবকিছু ওরও প্রিয়। ফলে আমিও কুনতা কিনতের ভক্ত হয়ে যাই। আমাদের আনন্দ দেখে বাবাও কিছুসময় ভুলে থাকেন সংসার যন্ত্রণা।


আমাদের বাড়িটার চারপাশ ঘিরে অনেকগুলো নারিকেল গাছ লাগানো হয়েছিল। গাছগুলো তখনো মাটির কাছাকাছি। আম জাম লেবু আতা জলপাই পেয়ারা বরইসহ অনেক ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। তখনো গাছগুলো ছায়া দেবার মতো খুব বড় হয়নি। কিন্তু ঘাসগুলো বেড়ে উঠতো তরতর করে। দশ কাঠা জায়গার মাঠটা জঙ্গল হয়ে যেতো ঘাস লতাপাতার ছাউনিতে। সেই ক্ষুদ্র আমাজনে হারিয়ে যেতো কুনতা কিনতে। আবার ডাক দিলে হুড়মুড় করে ছুটে বেরিয়ে আসতো জঙ্গল ছেড়ে।

মাঝে মাঝে সীমানা ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তায় উঁকি দিত। তখনো পাকা রাস্তা হয়নি ওদিকে। চারদিকে ধানক্ষেত। পূর্ব পশ্চিমের রাস্তাটা মাটির তৈরী। বর্ষাকালে ডুবুডুবু হয়ে উঠতো বিল উপচে পড়লে। রাস্তার দিকে উঁকি দিলেও বের হবার সাহস করতো না, কুকুরের ভয়ে।

দিন যাচ্ছিল এভাবেই। ঢিমে তালে, তালে ঢিমে। আমি সকালে ভার্সিটিতে যাই, দুপুরে ফিরে খেয়ে ঘুম, ঘুম থেকে উঠে বিকেলে কলোনীতের নাটকের রিহার্সাল, রিহার্সাল শেষে কিছুক্ষণ আড্ডা, তারপর বাড়িফেরা। এই একঘেঁয়ে রুটিনে বৈচিত্র আসার মতো ঘটনা বিরল। তবু একদিন ঘুম ভেঙ্গে গেল হৈ চৈ শব্দে। ছুটে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম জুটির সাদাকালো খরগোশটি তার ঘরের ভেতরে বসে থাকলেও ফকফকা সাদা খরগোশটি খাঁচার বাইরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। খরগোশের ঘরটির তারের জালির নীচে একটা গর্ত।

কিভাবে কি ঘটলো কিছুই বোঝা গেল না। আপাতঃ দৃষ্টিতে বেড়াল বা কুকুরের আক্রমণে মারা গেছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু কোন শব্দ শুনলাম না কেন?

খরগোশের মৃত্যুটা আমাদের ঘরে প্রিয়জন হারাবার বেদনা হয়ে রইল বেশ কদিন। সবচেয়ে কনিষ্ট বোনটি এত আঘাত পেল যে কদিন ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করলো না। বাকী খরগোশটি কুনতা যার নাম, সে আর তার ঘরের বাইরে আসে না। চুপচাপ বসে থাকে উদাস চাউনি দিয়ে। বেদনার্ত চোখ দুটো কেমন জ্বলজ্বল করতো। ওখানে ক'ফোটা জল জমা ছিল আমাদের কারো জানা নেই। ওই ছোট্ট বুকে সঙ্গী হারাবার বেদনা কত তীব্র হয়ে বেজেছিল তাও আমাদের বোঝা হয়নি। তবে ওর সঙ্গীহীন জীবন আমাদের মধ্যেও বিষন্নতার জন্ম দিয়েছিল। আমাদের সহ্য হচ্ছিল না এরকম একটা দৃশ্য। কুনতা আমাদেরকে অপরাধী ভেবেছিল কি?

দায়মুক্তির জন্যই বোধহয় একদিন তাই বাবা ওকে খাঁচায় পুরে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চিড়িয়াখানায় দান করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। অশ্রুসজল চোখে কুনতাকে বিদায় জানালাম আমরা। ভরসা এটুকু যে আমাদের আদর থেকে বঞ্চিত হলেও অন্ততঃ বাকী জীবন সঙ্গীহীন থাকবে না চিড়িয়াখানায়। সঙ্গীহীন জীবন যে কোন প্রাণীর জন্যই সমান দুঃসহ।

বহুকাল কেটে গেছে, ওদের দুজনকে আমি আজো ভুলতে পারি না। পৃথিবী থেকে চলে গিয়েও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল এখনো। পৃথিবীর বয়েস ২০ বা ২৫ বছর বেড়ে গেছে ইতিমধ্যে?

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা যদি হয়
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-
তখন হলুদ নদী নরম নরম  হয়
শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে !
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাই আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড় ছড়াতেছে;
মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল !
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের ঝাউয়ের-আমের,
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে !
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!
তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে-
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাঁকে কোথায় লুকায় আপনাকে !
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-
সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !

[ কবিতা এবং শিরোনাম কৃতজ্ঞতাঃ জীবনানন্দ দাশ]

Sunday, June 1, 2014

একটি কবিতার সারমর্ম প্রচেষ্টা


জীবনানন্দ দাশের অন্যন্য কবিতার মতো 'দুজন' কবিতাটি পড়েও দৃষ্টিভঙ্গির ফেরে পাঠকের অর্থবাচক প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন হতে পারে। আমি বিশ বছর আগে যখন কবিতাটি পড়ি তখন একরকম অর্থ ভেবেছি, আজ ভাবছি অন্য রকম। প্রতি ছত্রের নিজস্ব একটা সারমর্ম তৈরী করে ব্র্যাকেটে জুড়ে দিলাম কবিতার সাথে। এহেন অপকর্মে বোদ্ধা লোকের তিরস্কার অতি প্রত্যাশিত পুরস্কার হতে পারে।


আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু - একই আলো পৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?- বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;
আজ এই মাঠ সূর্য সহমর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে
প্রাণ তার ভরে গেছে।


[একই নক্ষত্রের নীচে বসবাস করেও দুজন দুজনকে ভুলে পৃথিবীর নিঃশ্বাসে বেঁচেছিল বহুকাল। নক্ষত্রের ঢের আগে মরে যায় নিবিড় প্রেমও..............]

দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবী ও আকাশের পাশে
আবার প্রথম এল- মনে হয়-যেন কিছু চেয়ে -কিছু একান্ত বিশ্বাসে।
লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বথের শাখার ভিতরে
অন্ধকারে নড়ে-চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে;
তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল।

[বিশ্ববটতলে মাত্র দুটো ঝরাপাতা................]

যেখানে আকাশে খুব নীরবতা, শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে-ক্রমে যেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছেঃ
সেই ব্যপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে
হেমন্ত আসিয়া গেছে;-চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরী;
ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে-শালিকের নেই আর দেরি,
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উচুঁ করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে;
ঝরিছে মরিছে সব এইখানে-বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।


[হেমন্তদিন পার হলে সোনালী ডানার চিলও হারায় আভা, এই তো জগতের ব্যাপ্ত নিয়ম.........]

নারী তার সঙ্গীকেঃ'পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
জানি আমি;-তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়
কী নিয়ে থাকিবে বল;-একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা,
তারপর ঝ'রে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না।
হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের-প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা
ফুরোত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে-'


[প্রতিটি প্রেমের হৃদয়ই দুস্থ, প্রতিটি হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ, যদি ভুলগুলো না হতো কিছু ক্ষরণ বেঁচে যেতো আহা.........]

এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে
উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রইল হাঁটুভর।
হলুদ রঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছে, এলোমেলো অঘ্রাণের খড়
চারি দিকে শূণ্য হতে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;
চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;-
প্রেমিকের মনে হলঃ'এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে
যেখানে রব না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা,
কুয়াশা রবে না আর-জনিত বাসনা নিজে-বাসনার মতো ভালোবাসা
খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।'

[অতঃপর কবি ভাবে.... এই নারী আমাকে না পেলেও খুঁজে পাবে তার ইপ্সিত আশ্রয়, অঘ্রাণের শুষ্কতা পেরিয়ে সে পৌছে যাবে তার অবিরল ঠিকানায়.......]