অনেক বছর আগে দূর স্বপ্নের কুয়াশা মেখে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাম একবার। জেগে ওঠার পরও স্বপ্নটা পিছু ছাড়েনি সারাটা দিন। এমনকি কয়েকদিন। ঘোরের মধ্যে মাটিরাঙ্গা পথে ধুলো মেখে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গিয়েও দিগন্ত ছুঁতে পারিনি। আমি যত কাছে যাই দিগন্ত তত দূরে সরে যায়। আমার চোখের ঘোর একসময় ঢেকে যায় সন্ধ্যার অন্ধকারে। সন্ধ্যাকাশের জ্বলে ওঠা শুকতারাটি যখন গভীর উজ্জ্বলতা নিয়ে নিবিড় বনানীর পেছনে আশ্রয় নিল তখন যে লাইনগুলো বেজে উঠেছিল বুকের গহীনে-
কোনোদিন দেখিব না তারে আমি: হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে
কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান
সারারাত, — তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে — বেনুবনে তাহার সন্ধান
পাবো নাকে: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনীর সাথে,
সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না — আসিবে না কখনো প্রভাতে,
যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান,
যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান,
ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে; — এইখানে ধুন্দুল লতাতে
জোনাকি আসিবে শুধু: ঝিঁঝিঁ শুধু; সারারাত কথা কবে ঘাসে আর ঘাসে
বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে;
প্রতিটি নক্ষত্র তার স'ান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে
নীরব ধূসর কণা লেগে রবে তুচ্ছ অনূকণাটির শ্বাসে
অন্ধকারে — তুমি, সখি চলে গেলে দূরে তবু; — হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে
অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে; আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।
অতঃপর আমি যেন বিষন্ন পরাজিত নাবিক এক। আমাকে ক্লান্ত.... ক্লান্ত করে দিয়েছিল পৃথিবীর সকল অবশিষ্ট উপাদান। পথের বিছানো ইটের অমসৃন সমতলে পা ঘষতে ঘষতে, ঘষতে ঘষতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম অন্ধকার এক অনিশ্চয়তার পথে। আমাকে ফিরে ডাকার কেউ ছিল না তখন। মহাসড়কে উঠে অচেনা গন্তব্যের বাস ধরে আমি ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম বিম্বিসার ধূসর জগতের দিকে। যেখানে জীবনের সমুদ্র সফেন। তারপর দীর্ঘ পদযাত্রা, অফুরন্ত সেই পথ। কিন্তু আমাকে দুদণ্ড শান্তি দেবার মতো কোন অশ্বথ বট পথের ধারে অপেক্ষমান ছিল না। আমি এক অন্ধকার থেকে অন্য অন্ধকারে পথ হারিয়ে ঘুরে মরছিলাম। সবগুলো পথের দিশা আমার কাছে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘন সুপুরি বনের পাশে কলকল বয়ে যাও সরু জলধারা আমাকে কেবলই বিভ্রান্ত করে যাচ্ছিল। তখন আবারো বেজে উঠলো নতুন এক বেদনার্ত সুর-
খুঁজে তারে মরো মিছে — পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;
রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে — তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক
নাই আর; — অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক
দাঁড়কাক দেখা যেত দিন — রাত, — সে আমার ছেলেবেলাকার
কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার:
রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক, —
এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক
তার কথা ভাবি শুধু; এত দিনে কোথায় সে? কি যে হলো তার
কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস,
সেই দিন, সেই রাত্রি, সেই সব ম্নান চুল, ভিজে শাদা হাত
সেইসব নোনা গাছ, করমচা, শামুক গুগলি, কচি তালশাসঁ
সেইসব ভিজে ধুলো, বেলকুড়ি ছাওয়া পথ, ধোয়া ওঠা ভাত,
কোথায় গিয়েছে সব? — অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ
ভোর রাতে — নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!
রাত শেষ হয়, আমার পথ চলা শেষ হয় না, তখন আরো একটি নতুন ভোরের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পুবদিগন্ত। হারিয়ে যেতে থাকে রাতভর জ্বলতে থাকা নক্ষত্রমণ্ডলী। আমি হারিয়ে ফেলা অন্ধকারের জন্য কেঁদে উঠতেই ওরা আগে বলে উঠলো, ভেবো না, আমরা আছি দিনের আলোর গভীরেও। আবার ফিরবো সন্ধ্যা তারার ডাকে। তুমি থেকো, পথের দিশে হারিও না। আবার হবে দেখা।
No comments:
Post a Comment