Wednesday, November 17, 2021

একটি মহাজাগতিক জীবাণু ভাবনা!

প্রাকৃতিক নির্বাচন বিষয়টা কী পরিকল্পিত হতে পারে? নাকি কেবলই একটি দুর্ঘটনাক্রম। এই যে মহাবিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন নির্জীব নিষ্প্রাণ বস্তুকণা সমৃদ্ধ নক্ষত্রমণ্ডলীর আমাদের পৃথিবীর এই প্রাণচাঞ্চল্য, এটি কী একটি নেহায়েত দুর্ঘটনা, দৈবাৎ ঘটে যাওয়া ব্যাপার? এরকম দুর্ঘটনা আর কতটি ঘটেছে মহাবিশ্বে?

কয়েকশো কোটি বছরের মধ্যে এমন ঘটনা দ্বিতীয়টি আর কোথাও ঘটেছে কিনা আমরা জানি না। আর কোথাও ঘটেছে কিনা সেটা জানার জন্য যে মাপের অনুসন্ধানী যন্ত্র দরকার তা আমাদের এখনো নেই। ধরা যাক সেরকম একটি যন্ত্র আবিষ্কার হয়ে গেল যা দিয়ে এক কোটি আলোক বর্ষ দূরে বার্তা পাঠানো সম্ভব। সেই যন্ত্র পঞ্চাশ লাখ আলোকবর্ষ পরিধির মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর দুটো জগতের সন্ধান পেল। সেই তথ্য পাওয়ার পর এই পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারবে পঞ্চাশ লাখ বছর আগে ওখানে আরেকটি প্রাণময় জগতের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সেই জগতটি এখনো বহাল আছে কিনা সেটা নিশ্চিত হবার উপায় নেই। বর্তমান অবস্থা জানতে চেয়ে কোন বার্তা পাঠানো হলে তার জবাব আসবে পঞ্চাশ লাখ বছর পরে। ততদিনে আমাদের এই মানবসভ্যতার কোন অস্তিত্ব পাওয়া যাবে? এক লক্ষ বছর পরে এই পৃথিবীর প্রাণীজগতের কোন অস্তিত্ব থাকবে? এক হাজার বছর পরের অবস্থা কল্পনা করাও কষ্টসাধ্য এখন। মহা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অতি নগণ্য এই মানবজাতি তবু প্রতিনিয়ত যেসব বিপুল বৈপ্লবিক চিন্তা চেতনার বিষয় নিয়ে হানাহানি করে সেটা মহাজাগতিক অর্থে নিতান্ত হাস্যকর একটা ব্যাপার। মানুষ দূরে থাক, পৃথিবীর কথাও বাদ দেই, আমাদের যে বিপুল আয়তনের নক্ষত্র সৌরমণ্ডল, সেটাই মহাজগতের প্রেক্ষাপটে একটা জীবাণুরও অধম। 

একটি মহাজাগতিক জীবাণু ভাবনা!

'উপনিবেশ চট্টগ্রাম' : চট্টগ্রামের ইতিহাসের উজ্জ্বল উদ্ধার



চট্টগ্রাম ভূখণ্ডের ইতিহাস নানা দিক থেকে তুমুল রোমাঞ্চকর ও প্রশ্নাতীতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার বাণিজ্যিক ইতিহাস নিয়ে লিখতে গেলে যেমন চট্টগ্রামের কথা উঠে আসবে, তেমনি বাঙালির বিদ্রোহী চেতনার প্রসঙ্গ উঠলেও এই সমুদ্রপাড়ের জনপদের উল্লেখ অনিবার্য―তা লেখক যে ভাষারই হোন না কেন। চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে লিখতে যাওয়াটা তাই যুগপৎ ‘চ্যালেঞ্জ’ এবং পরিশ্রমের। চট্টগ্রাম ভূখণ্ডের ইতিহাসের জটিলতা উপরোক্ত ‘চ্যালেঞ্জ’-এর নেপথ্যে অনেকটা দায়ী, এমনটি বলা যায়।

মাসখানেক আগে প্রকাশিত বৃহদাকার গবেষণাগ্রন্থ উপনিবেশ চট্টগ্রাম-এ লেখক হারুন রশীদ এই জটিলতা মোকাবেলা করেছেন দক্ষ হাতে এবং এক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যের মাত্রা আকাশচুম্বী। বাংলা মুলুকের বাকি অংশের তুলনায় যে চট্টগ্রামের ইতিহাস অনেকটা ‘আলাদা ও গোলমেলে’―সে সম্পর্কে তিনি পুরোদস্তুর ওয়াকিফহাল। বইটির বিস্তৃতি বোঝা যায় এর উপশিরোনাম দেখলে : ‘৫০০ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস’। কেউ কেউ অবশ্য বলতে পারেন, ৫০০ বছর আবার খুব বেশি সময় নাকি ? কিন্তু যে পাঁচ শতাব্দীর চট্টগ্রামের কথা এ বইতে বিবৃত হয়েছে, সেই সময়পর্ব ইতিহাসের নিরিখে এতটাই জটিল যে তার জট ছাড়ানো দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে অনেক সময়। হারুন রশীদ সেই জট ছাড়ানোর কঠিন কাজটি তাঁর অনুসন্ধানী গবেষণার মাধ্যমে করেছেন। প্রায় অচেনা-অজানা দুর্লভ দলিল এবং নির্ভরযোগ্য বইপত্র ঘেঁটে ইতিহাসের বহু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। ইতিহাসের প্রচলিত বয়ানে বিরাজমান ‘লুপহোল’গুলোও পূরণ করতে চেয়েছেন প্রাপ্ত তথ্য ও পোক্ত যুক্তি দিয়ে। লেখকের এই সবিশেষ প্রচেষ্টা সম্পর্কে বইয়ের মুখবন্ধে বহুমাত্রিক লেখক-অনুবাদক আলম খোরশেদ যা লিখেছেন, তা যথার্থ: ‘গবেষণালব্ধ নতুন তথ্য, উপাত্ত, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তসমূহের একত্র সন্নিবেশ ঘটিয়ে তিনি রচনা করেছেন চট্টগ্রামের ইতিহাসবিষয়ক এই নতুনতম গ্রন্থখানি।’

বইয়ের শুরু ‘প্রাককথন’ দিয়ে। এখানে সরাসরি চট্টগ্রামের ইতিহাসের প্রসঙ্গ নেই, কিন্তু যা আছে তা বইটির তাত্ত্বিক কাঠামো ও লক্ষ্য বুঝে নেবার জন্য জরুরি। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ, বিশ^জুড়ে উপনিবেশের বেশে পরিচালিত তাদের শোষণযজ্ঞ ও ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে ইউরোপবাসীদের বাণিজ্যযাত্রার উদ্দেশ্য-বিধেয় লেখক এই অংশে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এরপর সরাসরি প্রবেশ চট্টগ্রামের ইতিহাসে। প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম : ‘ইতিহাসের পেন্টাপলিস, গাঙ্গে, চাটিগাম কিংবা সিটি অব বেঙ্গালা’। এর শুরুতে একটি বিস্ময় জাগানিয়া অথচ যুক্তিপূর্ণ একটি অভিনব সিদ্ধান্তের দেখা মেলে। তা হলো, আনুমানিক ৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন নৌ বন্দরের বিবরণ নিয়ে মিশরবাসী এক অজ্ঞাতনামা গ্রিক নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থে যে ‘গাঙ্গে’ শহর ও খ্রিস্টপূর্বকালে গ্রিক ভূগোলবিদ ক্লডিয়াস টলেমির মানচিত্রে ‘পেন্টাপলিস’ নামের যে পাঁচ নগরের বাণিজ্যকেন্দ্রের কথা পাওয়া যায়, কখনও খুব সম্ভবত তা আজকের চট্টগ্রামেরই আদিপিতা। প্রাচীন সেই নগর সমুদ্রে বিলুপ্ত হয়েছে বা মাটিগর্ভে চাপা পড়েছে তা জানা না গেলেও এটা বোঝা যায় : আধুনিক পৃথিবীর চট্টগ্রাম তারই উত্তরাধিকার। এরপর তুলে ধরা হয়েছে ষোড়শ শতকের চারজন ইউরোপীয় অভিযাত্রীর চোখে দেখা চট্টগ্রাম সংক্রান্ত বয়ান। এই বিবরণগুলো যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনি ইতিহাসের নানা আদিসূত্রের আকরও।

দ্বিতীয় অধ্যায় ‘ষোড়শ শতকের অস্থিরতায় চট্টগ্রাম’ একটি বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণের চালচিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে। ষোড়শ শতকের আগ পর্যন্ত বাংলার শাসকদের নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম থাকলেও ওই শতকের প্রথমার্ধ থেকে তাকে ঘিরে ভিনদেশের ও ভিন রাজ্যের শাসকগোষ্ঠীর নানামুখী তৎপরতা দৃশ্যমান হয়ে উঠতে থাকে। এই তৎপরতার প্রথম বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ১৫১৩ সালে যুদ্ধ করে ত্রিপুরার রাজা ধনমাণিক্যের চট্টগ্রাম অধিকারে নেবার ঘটনায়। তখন বাংলার শাসক আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। তাঁর বাহিনী অবশ্য পরে চট্টগ্রাম পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়। তাতে অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। কেননা, তারপর আসে পর্তুগীজ বণিকের দল। খোদ ভাস্কো দা গামাও নাকি কখনও চট্টগ্রামে না এলেও চট্টগ্রামের কথা জানতেন ও বন্দরটির বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল―এই কৌতুহলোদ্দীপক তথ্যটিও লেখক তুলে ধরেছেন। চট্টগ্রামকে ঘিরে পর্তুগিজদের তৎপরতা ও গিয়াসউদ্দিন হোসেন শাহর পতন পরবর্তী পরিস্থিতিতে সেখানে জলদুস্যতার বিস্তার ঘটার প্রসঙ্গে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি।

‘চট্টগ্রামের ইতিহাসের বিভ্রান্তিকর সময়’ অধ্যায়টি নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ১৫৪০ থেকে ১৫৮৬ সাল অবধি চট্টগ্রাম কোন শাসকগোষ্ঠীর দখলে ছিল তা নিয়ে নানারকম বিতর্ক ও বিভ্রান্তি রয়েছে। আরাকান, পাঠান ও ত্রিপুরার রাজশক্তির মধ্যে বারবার যুদ্ধ-সংঘাত হতে হতে ওই ৪৬ বছরে আক্ষরিক অর্থেই চট্টগ্রামের ক্ষমতাবলয় বারবার ‘হাতবদল’ করেছে। একাধিক মান্য নথি ও ইতিহাসগ্রন্থ ঘেঁটে ওই সময়ের চট্টগ্রামের ক্ষমতাবলয়ের মুর্হুমুর্হু পরিবর্তনের আখ্যান যতটা পারা যায় স্পষ্ট করে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন লেখক। এতে ইতিহাসের আবছা সময়টা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে বৈকি।

চট্টগ্রামে আরাকানি উপনিবেশের পর্ব চূড়ান্ত অস্থির এক সময়খণ্ডই যেন। ‘চট্টগ্রামে আরাকানি উপনিবেশের শেষ ৮০ বছর’ অধ্যায়ে পর্তুগীজ-আরাকানি জলদস্যুদের ঐক্য, আরাকানরাজের বিরুদ্ধে মোগলশাহির যুদ্ধ-তৎপরতা, তার মধ্যেও দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের মৃদু প্রচেষ্টা ও স্থানীয়দের ওপর আরকানিদের দুর্বৃত্তপনা―এমন বহু প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। আরাকানিদের শায়েস্তা করতে শায়েস্তা খানের যুদ্ধ অভিযান ‘মগ ধাওনী’-র ইতিবৃত্ত নিয়ে রচিত এর ঠিক পরের অধ্যায়, ‘চট্টগ্রামে মোগল অভিযান ১৬৬৬’। আরাকান-বিরোধী চট্টগ্রাম অভিযানে শায়েস্তা খানের যুদ্ধকৌশলের পাশাপাশি তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও কূটনীতিক সত্তার পরিচয়ও উঠে এসেছে এখানে। আরাকানিদের শায়েস্তা করতে তিনি যেভাবে চট্টগ্রাম জুড়ে বাণিজ্যিক ও সামরিক ক্ষেত্রে তৎপর থাকা পর্তুগিজ ও ওলন্দাজ গোষ্ঠীকে নিজের দলে টেনে নিয়েছিলেন, সেই আখ্যান অনেকের কাছেই অশ্রুতপূর্ব বলে মনে হতে পারে। আরাকানি সাম্রাজ্যের পতন হবার পরও শান্তি মেলেনি। তার ঠিক পরেই মোগল অধিকারে আসা চট্টগ্রামের দিকে নজর পড়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চট্টগ্রাম অভিযান ১৬৮৬-১৬৮৮’ অধ্যায় তারই ইতিবৃত্ত। ১৭ শতকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুটি নৌ অভিযান পরিচালনা করেছিল চট্টগ্রামকে লক্ষ্যে রেখে। প্রথম অভিযান হয়েছিল অ্যাডমিরাল নিকলসনের নেতৃত্বে ১২টি জাহাজ নিয়ে, ১৬৮৬ সালে। দ্বিতীয়টি ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হিথের অধীনে, ১৬৮৮ সালে। ক্যাপ্টেন হিথের অভিযান কীভাবে ব্যর্থ হলো, তার রসঘন বর্ণনা পাঠকদের মোহিত করবে।

সতের শতকে ব্যর্থ হলেও আঠারো শতকে পলাশির যুদ্ধের নির্মম ফলাফলহেতু ইংরেজ কোম্পানি এক সময় চট্টগ্রাম শেষমেশ দখলে নিতে সক্ষম হয়। মোগল শাসন থেকে কীভাবে কোম্পানির হস্তগত হলো চট্টগ্রাম, সেই বিবরণ লভ্য ‘মোগল শাসন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৬৮-১৭৬০’ অংশভাগে। ১৭৬০ সালে হেনরি ভ্যানসিটার্ট কোম্পানির গভর্নর হয়ে বাংলায় আসার পর কোম্পানির কাছে ঋণগ্রস্ত ‘হঠাৎ নবাব’ মির জাফরকে পাওনা মেটানোর বদলে চট্টগ্রামের দেওয়ানিত্ব লাভের প্রস্তাব দিয়ে প্রথমে ব্যর্থ হলেও পরে মির কাশিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে চট্টগ্রাম-লাভের গোপন চুক্তি করেন―সেই কাহিনি কোনও গোয়েন্দা গল্পের চেয়ে কম উত্তেজনাকর নয়। বাংলা-বিহার- উড়িষ্যার পরবর্তী ‘পরাধীন’ নবাব মির কাশিম ও দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের দেওয়া ফরমানকে ভিত্তি ধরে কোম্পানির চট্টগ্রাম দখল ও শাসনের পূর্বাপর মেলে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে চট্টগ্রাম ১৭৬০-১৮৫৭’ অধ্যায়ে। এই অধ্যায়ের সমাপ্তিতে সিপাহী বিদ্রোহের কালে চট্টগ্রামের এক হাবিলদারের প্রায় অজানা বিদ্রোহী তৎপরতার খবর পাওয়া যায়। রজব আলি নামের সেই হাবিলদারের নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর একদল সেনা বিদ্রোহ করে। পরে তাঁদের পরিণতি অবশ্য খুব সুখকর হয়নি। তাঁরা ত্রিপুরা রাজার সহায়তা পাবার আশায় সেখানে গিয়ে বিফল হন। পরে রেঙ্গুনের এক জঙ্গলে অনাহারে তাঁদের মৃত্যু ঘটে।

সিপাহী বিদ্রোহের পর চট্টগ্রামের শাসনভার সরাসরি ইংরেজ ‘রাজ’ সরকারের ওপর এসে পড়ায় ঠিক কেমন পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তা ‘সরাসরি ইংরেজি শাসন ১৮৫৮-১৯৪৭’ অধ্যায়ের উপজীব্য। ১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির প্রতিষ্ঠা তরানি¦ত হবার নেপথ্যে যে এই শহরের জলাবদ্ধতা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার বাজে পরিস্থিতি বড় ভূমিকা পালন করেছিল, এ তথ্য জেনে চমকে যেতে হয়। এমনকি এই পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে গিয়ে ১৮৭৫ সালে চট্টগ্রামের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টি এম কির্কউড আন্দোলনের মুখে পড়ে কেমন নাজেহাল হয়েছিলেন, তা-ও বাদ থাকেনি। লেখকের মতে, ওই আন্দোলনটিই ‘চট্টগ্রামের প্রথম ইংরেজ বিরোধী গণ আন্দোলন’। আধুনিক চট্টগ্রাম বন্দর ও রেলওয়ে ব্যবস্থাও গড়ে ওঠে রাজ আমলে। আবার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সলতে পাকানোর শুরুতেও চট্টগ্রামের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। স্বদেশি আন্দোলন সংশ্লিষ্ট তৎপরতা, শহরে গান্ধী-রবীন্দ্রনাথের আগমন, বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের কারণে চট্টগ্রামের আসাম রাজ্যে চলে যাবার শঙ্কা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের প্রভাব―দীর্ঘ অধ্যায়টিতে কোনও জরুরি প্রসঙ্গই বাদ থাকেনি। ১৯৩০-১৯৩৪ কালপর্বে চট্টগ্রামের আগুনঝরা যুববিদ্রোহ নিয়ে রয়েছে আরেকটি আলাদা অধ্যায়, ‘চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ’।

‘দেশভাগ এবং পাকিস্তানি উপনিবেশের যাত্রারম্ভ’ অধ্যায়ের বিষয় পাকিস্তানি উপনিবেশ পর্ব। ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসানের মুহূর্তে বেদনামথিত দেশভাগ। দুই ভাগে বিভক্ত ‘অসম্ভব’ নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলো চট্টগ্রাম। কিন্তু কিছুদিন পর দেশটির দুই খণ্ডের মধ্যেকার বৈষম্য বুঝিয়ে দিলো, কার্যত নতুন মোড়কে আরেক ঔপনিবেশিক শাসন ফের হাজির হয়েছে। বইয়ের অন্য অধ্যায়গুলোর তুলনায় সংক্ষিপ্ত এই অংশে মুখ্যত ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবির পক্ষে ১৯৬৬ সালে শহরের লালদিঘি ময়দানে হওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি জনসভার ইতিবৃত্ত তুলে ধরা হয়েছে। অধ্যায়টি আরেকটু বিস্তৃত হলে ভালো লাগত। তবে লেখককে অন্য একটি কারণে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। বাংলাদেশের তীব্র ডানপন্থী ও বামপন্থী একচক্ষু ইতিহাস লেখকগণ এবং এমনকি অধিকাংশ মধ্যপন্থী জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদও তো পাকিস্তানি জামানাকে ঔপনিবেশিক আমল বলে স্বীকারই করতে চান না! উল্টো তারা ১৯৪৭-কে উপনিবেশ থেকে ‘মুক্তির স্বাদ’ পাবার সময় বলে দেখাতেই অধিক তৎপর। এমন পরিস্থিতিতে হারুন রশীদ তীক্ষè যুক্তি দিয়ে পাকিস্তানি আমলকে শোষণকামী ইংরেজ উপনিবেশের জাতভাই (অথবা তার আরেক রূপ) বলে চিহ্নিত করতে পিছপা হননি। স্বাভাবিকভাবেই বইটির ইতি টানা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চট্টগ্রামের প্রসঙ্গ দিয়ে। অন্তিম অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম ১৯৭১’ অধ্যায়ের আরম্ভ চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা প্রাথমিক প্রতিরোধের ঘটনাপ্রবাহে, আর সমাপ্তি একদিন বিলম্বে ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রামের মুক্ত হওয়ার দিনটির কথায়। বস্তুত, ওই দিনটিতেই ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড় থেকে চট্টগ্রাম চূড়ান্তভাবে মুক্তি পেয়েছিল।

এই গ্রন্থের আরেক মূল্যবান সম্পদ এর সমৃদ্ধ ‘পরিশিষ্ট’। এই অংশে অন্তর্ভুক্ত ‘চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাণশিল্প ও ফিগ্রেট ডয়েচল্যান্ড’ প্রবন্ধটি এক না-জানা ইতিহাসের উজ্জ্বল উদ্ধার। আরও রয়েছে চট্টগ্রাম শহরের প্রাচীন দুর্লভ মানচিত্র নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। বিশেষভাবে বলতে হয় লেখকের উদ্ধার করা ১৮১৮ সালে ইংরেজ প্রকৌশলী জন চিপের আঁকা একটি দুর্লভ মানচিত্রের কথা।

হারুন রশীদ পেশাদার ইতিহাসবিদ নন। ধারণা করি, প্রথাবদ্ধ ইতিহাস লেখকদের বাগাড়ম্বর ও রীতিসর্বস্বতা তাঁর মধ্যে নেই বলেই এমন একটি যুগপৎ নতুন তথ্যে ও বিশ্লেষণে পরিপূর্ণ সুখপাঠ্য ইতিহাসগ্রন্থ আমরা হাতে পেলাম। বিশেষত, এই সময়ে বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধকে জোড়া দিয়ে একক ইতিহাসগ্রন্থ বলে চালিয়ে দেবার একটি আপত্তিকর প্রবণতা যখন ক্রমেই ডানা মেলছে―তখন উপনিবেশ চট্টগ্রাম নিপুণভাবে সুসম্বন্ধ সুলিখিত ধারাবাহিক ইতিহাস উপস্থাপন করেছে। সেজন্য বাংলাদেশ থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ইতিহাস বিষয়ক জরুরি গ্রন্থের তালিকা করতে বসলে একে বাদ দেওয়া অসম্ভব হবে বলেই মনে করি। হারুন রশীদের ভাষা গতিশীল, সরল-সহজ; তবে বিন্দুমাত্র তরল নয়। তাঁর গদ্যে মার্জিত রসবোধেরও দেখা পাই। তিনি স্বদেশে লভ্য পুরোনো গ্রন্থ কি নথির সহায় যেমন নিয়েছেন, তেমনি প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদেশের গ্রন্থাগার বা মহাফেজখানায় থাকা চট্টগ্রাম সংক্রান্ত অজানা-অচেনা দলিল আর তথ্য সংগ্রহের বেলাতেও ছিলেন পারঙ্গম। তথ্য আহরণের ক্ষেত্রে ঐতিহ্য ও প্রযুক্তির সমন্বয় করতে পারাটা বইটি লেখার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই বাড়তি শক্তি জুগিয়েছে।

বইটি ছাপতে গিয়ে চট্টগ্রামের নতুন প্রকাশনা সংস্থা পূর্বস্বর বিরল পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রচুর প্রাসঙ্গিক ছবি নিপুণভাবে বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নান্দনিকতা বজায় রেখে স্থাপিত। এতে চোখের আরাম, মনেরও। বইয়ের বাঁধাই, বিন্যাস কি পৃষ্ঠাসজ্জা―সবই অত্যন্ত নিষ্ঠা ও যত্নের সঙ্গে করা হয়েছে, একনজর দেখলেই তা বোঝা যায়।


আলোচক: মুহিত হাসান
লেখক, প্রাবন্ধিক

[শব্দঘর জুলাই-আগষ্ট ২০২১, সেরা বই বিশেষ সংখ্যা থেকে সংকলিত]

Thursday, June 17, 2021

মধ্য পঞ্চাশের দুই প্রজন্মের দুই পিতা

মধ্য বয়সে এসে আমি জীবনকে পরিপূর্ণভাবে দেখতে পাচ্ছি। পুরোনো অনেক উপলব্ধির রূপান্তর ঘটেছে। একটা বয়সে না পৌঁছালে মানুষ নিজেকে পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারে না।

বাবা হিসেবে আমি সন্তানদের বেড়ে ওঠা দেখতে দেখতে একটা নতুন আনন্দের সন্ধান পেয়েছি। জানি না সব বাবা এই আনন্দকে উদযাপন করে কিনা। সেই সাথে একটা দুঃখবোধও কাজ করে। আমার আশঙ্কা এই সুখের মেয়াদ বেশিদিন থাকবে না। আমার চেনাজানা অনেক পরিবারে দেখেছি জ্বলে ওঠার পর দপ করে নিভে গেছে কোন না কোন একটা ঘটনায়। আমার ছেলেটা যখন অসুস্থ হলো করোনার সময়, আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমি জীবনের সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি সারারাত জেগে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার বাবাও আমার ছেলেবেলায় এরকম ঘাবড়ে গিয়ে ডাক্তারকে ধরে মার দিয়েছিল শুনেছিলাম। আমি প্রায় মরে গিয়েছিলাম। একদম শেষ প্রান্ত থেকে ফিরে এসেছিলাম। আমরা চার ভাই হবার কথা ছিল। টিকেছি শুধু আমি একা। 

আজকাল আমার ভাবতে ভালো লাগে এই বয়সে বাবা কী করেছিলেন, কেমন ছিলেন ইত্যাদি। এরকম বয়সে বাবা বিদেশ থেকে ফিরে আসেন। আমি তখন কলেজে পড়ি। পঞ্চাশ পার হবার পর থেকে বাবা খুব বেশি স্বচ্ছল ছিলেন না। ৫৫ বছরে পৌঁছে বাবা প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলাম। অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছি। 

সেদিক থেকে তুলনা করলে আমার মধ্য পঞ্চাশে আমি এখনো স্বচ্ছল আছি। কিন্তু আমার সন্তানেরা এখনো স্কুলে পড়ছে। আমি দেরিতে বিয়ে করেছি, দেরিতে বাবা হয়েছি, তাই আমার বাবার তুলনায় পিছিয়ে আছি অন্তত ৮ বছর। এই ঘাটতি কখনো পুরণ হবে না। আমাকে যদি এই মাঝপথে চলে যেতে হয়, তাহলে আমার সন্তানেরা অসহায় হয়ে পড়বে। তাদের বেড়ে ওঠার পর্বটা অনিশ্চয়তায় ডুবে যাবে। এই ভাবনটা আমাকে মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে।

তবু একটা তৃপ্তি আছে আমার। আমার বাবার চেয়ে আমি সন্তানদের বেশি কাছে পেয়েছি। আমার যখন বেড়ে ওঠার বয়স বাবা তখন বিদেশে। দীর্ঘ ৮ বছর বিদেশে থাকার কারণে বাবাকে আমি অনেকটা সময় কাছে পাইনি। যখন দেশে ফিরে এসেছে, তখন আমি বড় হয়ে গেছি, ওই বয়সে কেউ বাবার ন্যাওটা হয়ে থাকে না। প্রেস্টিজজ্ঞান বেড়ে যায়। আমি বাবার কাছ থেকে সযত্ন দূরত্ব বজায় রাখতাম। কিছুদিন পর আমার ছেলেও হয়তো প্রেস্টিজজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে পড়বে তখন সেও আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে। তবু এখনো আনন্দ যে আমি দীর্ঘ সময় ওদের কাছে পেয়েছি। আমার কর্মক্ষেত্র বাসার মধ্যে আছে বলে। স্কুলের সময় বাদ দিলে সারাক্ষণই আমরা একসাথে কাটাই। আমার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে আমার দুই সন্তান। ওদের ছাড়া আমার এক দিনও চলে না। 

ছেলেবেলার কথা ধরলে আমার তুলনায় আমার সন্তানেরা একটা জায়গায় পিছিয়ে আছে। ওদের বয়সে আমি অনেক বেশি বহির্মুখী ছিলাম। বাইরের খেলাধুলার একটা জগত ছিল। আমাদের কলোনীতে সেই সুযোগটা বেশি ছিল। এখন ওরা পুরোপুরি গৃহবন্দী জীবনযাপন করে। শহরের কেন্দ্রস্থলে থাকি, ঘর থেকে বের হলেই সদর রাস্তা গাড়িঘোড়া হৈ হুল্লোড়। আমাদের সেই নিরিবিলি জীবন ওরা পায়নি।

ওরা এগিয়ে আছে অন্য জায়গায়। আমার ছেলেবেলায় আমরা অতি সাধারণ নিন্মবিত্ত জীবনযাপন করতাম। ছোট একটা বাসায় আমরা এতগুলো ভাইবোন মিলে থাকতাম। অভাব অনটন না থাকলেও তেমন একটা উন্নত জীবন কাটাতাম বলা যায় না। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত এক রুমের বাসাতেই থাকতাম আমরা। এখন ভাবলে অবাক হই। ওদেরকে সেই গল্পগুলো করলে ওরা অবিশ্বাসীর চোখে তাকায়। ওরা জন্ম থেকেই শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা আধুনিক ফ্ল্যাটে বাস করছে ওরা। যেখানে বিদ্যুত পানির অবাধ সরবরাহ আছে। লিফট, জেনারেটর, সিকিউরিটি সার্ভিস সবকিছু প্রথম শ্রেণীর। আমরা এখনো মধ্যবিত্ত, কিন্তু জীবনযাত্রার মান অনেকটা উচ্চবিত্তদের মতো। ঘরে আধুনিক সব গ্যাজেট মজুদ আছে। শৈশব থেকে বাসায় দু চারটা ল্যাপটপ দেখে বড় হয়েছে, স্মার্ট টিভি, স্মার্ট ফোন, ডিএসএলআর ক্যামেরা থেকে শুরু করে সবকিছুই বাসায় আছে। কোনদিন অভাব দেখেনি। বাসায় আইপিএস, জেনারেটর সব আছে, আজকাল বেশি লোডশেডিং মাঝে মাঝে জেনারেটর থাকে না। তাই কখনো কারেন্ট চলে গেলে ওরা অবাক হয়। আমি বলি, দেশের বেশিভাগ মানুষ এভাবেই আছে। তোমাদেরও সেরকম অবস্থায় থাকার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। বলি ঠিকই, কিন্তু জানি কখনো এই সুবিধাগুলো চলে গেলে ওদের খুব কষ্ট হবে। আমার ছেলেবেলায় এসবের কানাকড়িও দেখিনি। তাই আমাদের অসুবিধা হয়নি। আমরা ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। ওরা জন্মের সাথে সাথে সবকিছু পেয়ে গেছে। যদি আমার আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায় তখন ওদের খুব কষ্ট হবে। এটা ভেবে আমার খারাপ লাগে। কিন্তু জীবন তো চিরকাল একরকম থাকে না। আমরা গত ২৮ বছর এক নাগাড়ে যে স্বচ্ছলতার জীবন কাটাচ্ছি, সেটা খুব দুর্লভ একটা বিষয়। আমার বাবা দাদা কেউ এতদিন সুখ করেনি।

আমার কন্যাকে নিয়ে খানিক দুশ্চিন্তা আছে। সে পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী না। নিজের ভাল বোঝে না। সুযোগ পেলেই ফাঁকি দেয়। শুধু পড়ায় নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সে ফাঁকি দেবার সুযোগ খোঁজে। এই প্রবণতা খুব খারাপ। এটা ওর ভবিষ্যতকে অনেক জটিল করে ফেলবে। আমি অনেক চেষ্টা করেও কাজ না করার বদভ্যাসটা দূর করতে পারিনি। ফাঁকির হাতে সে বন্দী হয়ে আছে। কিছুদিন পর কলেজে পড়তে শুরু করবে। তখন জীবনটা নিজের হাতে চলে যাবে। সেই জীবনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে যদি চলতে না পারে, তাহলে পুরো ভবিষ্যত হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। নিজেকে ফাঁকি দিলে জীবন ক্ষমা করে না। আমার অনেক বন্ধুর জীবন থেকে আমি এই শিক্ষাই নিয়েছি। সেই হিসেবে ছেলেটা এখনো ভালো আছে। তার মধ্যে ফাঁকিবাজির চেষ্টা নেই। সে নিজে নিজে অনেক কিছু শেখার চেষ্টা করে। সেই চেষ্টাগুলো আমাকে অবাকও করেছে। যদি ওর সুযোগ থাকে তাহলে সে উন্নতি করতে পারবে। টেকনোলজিতে ওর বেশ আগ্রহ। টেকি জিনিসপত্র নিয়ে একদম ছেলেবেলা থেকেই নাড়াচাড়া করে। আমি তেমন কিছু শেখাইনি, তবু সে কম্পিউটারে আমার চেয়ে ভালো। আমি যেসব পারি না, সে ওসব পারে। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর সে আমাকে কম্পিউটার বিদ্যা শেখানোর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এটা ভালো লেগেছে আমার। আমি প্রোগ্রামিং এর পও জানি না। সে আমাকে ল্যাঙ্গুয়েজ শেখায়। বেসিক ওয়েব পেজ ডিজাইন, ওয়েব টুলস তৈরি করা, জাভা, এইসটিএমল, সিএসএস এসব আমি বুঝি না। সে আমাকে ওসব নিয়ে জ্ঞান দেয়। শেখার এই আগ্রহটা জরুরী। ভাইবোন দুজনই যদি একরকম করে কাজ শিখতো। দুজনেরই ভাল হতো। কিন্তু দুজন খোঁচাখুঁচি করে বেশি। এটাই মুশকিল। আমি তাই দুজনকে দুপাশে নিয়ে মিলেমিশে গল্প করতে ভালোবাসি। তখন ওরা ভাল থাকে পোষা বেড়ালের মতো। মধ্য পঞ্চাশ বয়সে আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ওদের সাথে সময় কাটাতে। বন্ধুদের আড্ডার চেয়েও আমি ওদের আড্ডা উপভোগ করি। কারণ এখন ওরা পড়াশোনা বিষয়ক কথাবার্তাগুলো বোঝে। আমি যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করি সেগুলোর গল্প করতে পারি ওদের সাথে। আগে দিশার সাথে করতাম, এখন ওদের সাথে করি।





সাহিত্যিক দলাদলি: পাষণ্ড পীড়ন ১৮৪৬

সাহিত্যিক দলাদলির এই বেরসিক ঘটনাটি ঘটেছিল বাংলা পত্রিকা প্রকাশনার আদিযুগে- উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত শিক্ষিত সমাজের বিনোদনের জন্য একটা পত্রিকা চালাতেন। সাথে ছিলেন সাহিত্যিক বন্ধু গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ।
১৮৪৬ সালে প্রকাশিত ‘পাষণ্ড পীড়ন’ নামের মাসিক পত্রিকাটি সমাজের পাষণ্ডদের কতটা পীড়া দিতে পেরেছিল তা জানা না গেলেও কারো কারো বুদ্ধিতে আগুন ধরাতে পেরেছিল নিঃসন্দেহে। সেই আগুনের তাপে দুই বন্ধুর মধ্যে দড়ি টানাটানি শুরু হয়। দুজনে কুৎসাপূর্ণ কবিতার মাধ্যমে পরস্পরকে আক্রমণ শুরু করেন। দেশের লোক সেই লড়াই দেখে আমোদিত হতো।
.
প্রকাশক সীতানাথ ঘোষ তখন একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। এক রাতে সম্পাদককে কিছু না জানিয়ে ছাপাখানার মূল যন্ত্রটা নিয়ে ভেগে গেলেন তিনি। পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি ভেগে গিয়ে হারিয়ে যাননি। তিনি মূলত দলত্যাগ করেছিলেন। পত্রিকা প্রকাশের সেই যন্ত্রটা তাঁর প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
.
সুরসিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কয়েক বছর পর 'পাষণ্ডপীড়ন' বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে মনের দুঃখে লিখেছিলেন-
"১২৫৩ সালের আষাঢ় মাসের সপ্তম দিবসে প্রভাকর যন্ত্রে পাষণ্ডপীড়নের জন্ম হইল। ইহাতে পূর্ব্বে কেবল সর্ব্বজন-মনোরঞ্জন প্রকৃষ্ট প্রবন্ধপুঞ্জ প্রকটিত হইত। পরে ৫৪ সালে কোন বিশেষ হেতুতে পাষণ্ডপীড়ন, পাষণ্ডপীড়ন করিয়া, আপনিই পাষণ্ড হস্তে পীড়িত হইলেন। অর্থাৎ সীতানাথ ঘোষ নামক জনেক কৃতঘ্ন ব্যক্তি যাহার নামে এই পত্র প্রচারিত হয়, সেই অধার্মিক ঘোষ বিপক্ষের সহিত যোগ দান করতঃ ঐ সালের ভাদ্র মাসে পাষণ্ডপীড়নের হেড চুরি করিয়া পলায়ন করিল। সুতরাং আমাদিগের বন্ধুগন তৎপ্রকাশে বঞ্চিত হইলেন। উক্ত ঘোষ পত্র ভাস্করের করে দিয়া পাতরে আছড়াইয়া নষ্ট করিল।"**
.
আদিযুগের এই বাংলা বুঝতে অনেকের অসুবিধা হলেও এ যুগের সাহিত্যিক দলাদলির সাথে ঐতিহাসিক মিল খুঁজে পেতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
.
[**সূত্র: সংবাদ প্রভাকর, ১ বৈশাখ ১২৫৯]

Wednesday, June 16, 2021

তোমাকে....

তোমাকে এখনো ভালোবাসতে পারি। প্রতিদিন তোমার সাথেই থাকি আমি। যেদিন তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না সেদিন আমার আয়ুষ্কাল শেষ। তুমি আছো বলেই সবুজকে সবুজ দেখি, নীলকে নীল। তুমি বিদ্যমান বলেই হলুদ বেগুনী লাল কমলা সবগুলো রঙ নিজ নিজ উজ্জ্বলতায় সমুন্নত আমার চোখের রেখায়।

জানতে পারিনি তুমি কখনো আমাকে বেসেছো কিনা। আমাকে আদৌ চেনো কিনা, তাও জানা হয়নি। প্রতিদিন তোমার হাতে হাত রেখে কাটাই, অথচ কেমন নির্জীব অক্ষরে তুমি আমাকে দেখো। তুমি জড়, তুমি কাগজ, তুমি বিট বাইটের সংখ্যারহস্য। তোমার প্রাণ নেই, অথচ আমার প্রাণ তোমার হাতে বন্দী।

তুমি প্রেম নও, স্মৃতি নও, প্রেয়সী নও, বাংলা ভাষার কোন অলংকার নও, মাত্র দুই শব্দের তৈরী নাম বই!



Tuesday, June 15, 2021

ধরাশায়ী

ধরা কাহিনী সবারই আছে। জীবন মাত্রেই মরণশীল, মানুষ মাত্রেই ধরাশীল। ধরা খাওয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নাই, কোলেষ্টেরোলও নাই। তবে ধরা কাহিনী নগদের চেয়ে বাসীই মজাদার। তাই গতকাল যে ধরাটা খেয়েছি সেটা এখন না বলে পুরোনো গুলিই বলছি।

মোবাইল 'ধরা': একটেল

দশ-বারো বছর আগেও ভোররাত থেকে লাইন ধরে হুড়োহুড়ি ধাক্কাধাক্কি করে ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা খরচ করে মিনিটে ৭ টাকায় কথা বলার সুবর্ণ সুযোগ পাবার জন্য যে কোম্পানীর কানেকশান কিনতো মানুষ, তার নাম গ্রামীণ ফোন। ক্রেতা সামলানোর জন্য পুলিশ ডাকতে হয়েছে সেরকম কোম্পানী পৃথিবীতে খুব বেশী নেই। গ্রামীণের ক্রেতাভাগ্য ঈর্ষনীয় ছিল।

আমি গ্রামীনের লাইনে দাঁড়াইনি কখনো। মোবাইল ফোন বড়লোকের জিনিস, বাসার ল্যান্ডফোনই যথেষ্ট, এই ধারনাটা এক বন্ধু এসে নাড়িয়ে দেয় যখন সে বিদেশ যাবার আগে তার একেটেল মোবাইলটা আমাকে বন্ধুসুলভ দামে 'উপহার' দিয়ে যেতে চাইল।

'উপহারে' আমার আপত্তি নেই জেনে 'মাত্র' আট হাজার টাকায় দূর্লভ একটেল পোষ্টপেইড সিম আর সাথে বোনাস হিসেবে সাড়ে তিন হাজার টাকার দুমাসের বকেয়া বিল বুঝিয়ে দিয়ে সে বিদেশে চলে গেল। একটেলের ওই সিমটা তখন মহার্ঘ ছিল 'ইনকামিং ফ্রি' ছিল বলে।

মেঘ পাহাড় বৃষ্টি বনাম ঘটমান অতীতের গল্প

১.
দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। জানালা দিয়ে অনেক দূরের কিছু পাহাড় সারির ধোঁয়াশা। ধোঁয়াশাটা বৃষ্টির পর্দা। পাহাড়গুলো নদীর ওপারে। মাঝে মাঝে দেহবহির্ভূত হয়ে মনটা ওই পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নেয়। একদিন নদীটা পার হয়ে সোজা ওই পাহাড়গুলোর দিকে চলে যাবো। অফিসে আসার পথে প্রতিদিন নদী পারাপারের খেয়াঘাট পেরিয়ে আসি। কখনো সখনো দেখি সারিবদ্ধ মানুষ নৌকা থেকে নেমে শহরের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। যেখানে ঘাট, সেখানেই বাসস্টপ। সন্ধ্যের আগে কাজ সেরে সবাই ফিরে যাবে ওই পাড়ে।

নদীর এই ঘাটলাটা বড় সুন্দর। আধুনিক খেয়াঘাট। কাঠের সুন্দর পাটাতন মহাসড়ক থেকে ধাপে ধাপে নেমে গেছে নৌকার কাছে। শহরের মধ্যখানে এমন সুন্দর একটা ঘাট আছে ভাবতে ভালো লাগে। ঘাট থেকে মূল নদী কয়েকশো গজ দূরে। নদী ছেড়ে একটা সরু খাল শহরের পেট চিরে এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে, সেই খালের মধ্যেই এই ঘাট। এই দূরত্বটাই এই ঘাটের সৌন্দর্য। খালটি নদীতে প্রবেশের আগে কয়েকশো গজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পেরিয়ে আসে। ঘাটের ছাউনি বরাবর বিশাল একটা অশ্বথ গাছ ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। গ্রামের হাটবাজারে কিংবা নদীর ঘাটেও এই গাছগুলিই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু মহানগরের এই দালানকোঠার ভিড়ে কেউ খেয়াল করে ওকে? এরকম গাছগুলো কেউ লাগায় কিনা জানি না, মনে হয় এরা পাখির ঠোঁট থেকে পতিত বীজ থেকে জন্মায়, তারপর অযত্নে বেড়ে ওঠে একসময় মহীরূহ হয়ে যায়। এই গাছের ছায়ায় বসে মানুষ যাত্রার ক্লান্তি দূর করে, আয়েশ আড্ডাবাজি করে, আর বৃষ্টির সময় এই গাছগুলো হয়ে ওঠে নিদারুন আশ্রয়। আহ্ আমারো তেমন একটা আশ্রয় বৃক্ষ ছিল গ্রামের বাঁশবনটায়।

বই আছে, সময় নেই

কত কত বই জমে আছে! এত বই পড়ার সময় কই? সীমিত আয়ুষ্কালে এতসব বই কী পড়া শেষ করা যাবে? পড়তে পড়তে প্রায়ই এই দুশ্চিন্তাটা মাথাচাড়া দেয় পড়ুয়াদের। বিশেষ করে সেই পড়ুয়া যারা 'বেঁচে থাকার জন্য পড়ে' কিংবা 'পড়ার জন্য বেঁচে আছে'। পড়াশোনা ব্যাপারটা তাদের কাছে বেঁচে থাকার অক্সিজেনের মতো। বইয়ের কাছে না থাকলে এরা রীতিমত হাঁসফাস করে। 


সময় কম, বই বেশী। কম সময়ে বেশী বই পড়ে এগিয়ে থাকার যুদ্ধে চাপটা এসে পড়ে দৃষ্টিশক্তির উপর।  লক্ষ্য যদি হয় বেশীদিন পড়া, তাহলে চোখকে বাঁচাতে হবে। অন্য যেসব কাজে আমাদের চোখ ব্যবহার করতে হয় সেসব কাজ কমিয়ে বইয়ের খাতে বেশী বরাদ্দ রাখতে হবে। সেটা কী আদৌ সম্ভব?  ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমাদের চোখ গড়ে ৮ ঘন্টা বন্ধ থাকে ঘুমের জন্য। কমপক্ষে ৮ ঘন্টা জীবিকার কাজে লাগে। বাকী থাকে ৮ ঘন্টা। এই ৮ ঘন্টার মধ্যে স্নাহাহার, যাতায়াত এসবে ৪ ঘন্টা (ঢাকা শহরে যাতায়াত বাবদ আরো বেশী খরচ হয়)। বাকী থাকলো ৪ ঘন্টা। এই চারঘন্টা ভাগাভাগি করতে হবে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, অতিথি, আড্ডা, ফেসবুকসহ নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদির মধ্যে। সবাইকে সময় দিতে গেলে বই পড়ার জন্য দৈনিক আধঘন্টা সময়ও কি মিলবে? গাণিতিক হিসেবে বই পড়ার জন্য কোন সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। 

Thursday, March 25, 2021

এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপুর্ণ জীবন

আমাকে
তুমি দেখিয়েছিলে একদিন;
মস্ত বড় ময়দান — দেবদারু পামের নিবিড় মাথা — মাইলের পর মাইল;
দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়;
জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;

জানালায় জানালায় অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলে:
পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।
তারপর
দূরে
অনেক দূরে
খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মাতা ধান ভানে — গান গায় — গান গায়
এই দুপুরের বাতাস।

এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপুর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন
বিকেলে নরম মুহুর্ত;
নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা যাওয়া;
একটা ধবর চিতল-হরিণীর ছায়া
আতার ধূসর ক্ষীরে গড়া মুর্তির মতো
নদীর জলে
সমস্ত বিকেলবেলা ধরে
স্থির!

মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ
আগুণের — ঘিয়ের ঘ্রাণ;
বিকেলে
অসম্ভব বিষন্নতা।
ঝাউ হরিতকী শাল, নিভস্ত সূর্যে
পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু–
বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;

শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াওড়ি জোছনায়–ছায়ায়,
রাত্রি;
নক্ষত্র ও নক্ষত্রের
অতীত নিস্তব্ধতা!

মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার
এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।

[আমাকে তুমি - জীবনানন্দ দাশ]


মাত্র কয়েকটি শব্দের বিনিময়ে কোন কোন দিনের কাছে, কোন কোন মুহুর্তের কাছে ঋণী থেকে যায় মানুষ। 
চৈত্র মাসের বিশেষত্বহীন একটা দুপুরও ফাগুনের শীতল হাওয়া বয়ে আনতে পারে। 
২৫.৩.২০২১  (২.০৬)