Wednesday, July 25, 2012

গতকাল সন্ধ্যায়

ইফতারের সময়ে তিন বছরের পুচকা ছোকরাটা সরবতের গ্লাস হাতে চেয়ারে দাড়িয়ে এক নাগাড়ে চিৎকার করে যাচ্ছে।

"ওতা দাও,ওতা দাও ওতা দাও......."

কেউ বুঝতে পারছে না তার চাওয়াটা কি। দিশা পাশের চেয়ারে। ওর কান ঝালাপালা। সে অনেক চেষ্টা করেও কি বলছে কিছু বুঝতে পারছে না। আমি মনোযোগ দিয়ে দই চিড়া গিলে যাচ্ছি। এই সময়ে পিচ্চিপাচ্চিগুলাকে সচেতনভাবে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা। কিন্তু এই ব্যাটা থামছে না। শেষে ওর মা সংলাপে যোগ দিল।

-ওতা মানে কি?
-ওই ওতা
-পেয়াজু?
-না, ওতা
-জিলিপী?
-না, ওতাআআআ (ক্ষেপে যাচ্ছে আবার)
-ছোলাবুট?
-নাআআআ
-মুড়ি??
-নাআআআআ আমি ওতা কাবো, ওতা দাওওওওও
-এখানে আর কিছু তো নেই, ওতা মানে কি
-ওইদে ওকানে, ওত্তা
-কি মুশকিল, কি বলে বুঝো তোমরা?

আমি তখন চিড়া শেষ করে ছোলা মুড়ি মাখাচ্ছি সালাদ দিয়ে, পেঁয়াজুতে একটা কামড় দিয়ে পুচকাটার অসন্তুষ্ট চেহারার দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম, ওতা মানে কি?

-কিরে ব্যাটা, কি চাস, হালিম খাবি নাকি?
-হ্যাঁ, আলিমমমম। আমি আলিম খাবো, আলিম দাওওওওও!

সারছে! প্রতিদিন হালিম কিনি, আজ কেনা হয়নি। ব্যাটা আজই হালিমের দাবী তুললো? আমি চুপ গেলাম। ওর মা যোগ দিল আবার সংলাপে

-আজকে হালিম বানাই নাই (উত্তরটা ভুল দিল, ফাঁদে পা)
-একন আলিম বানাও (হুকুম দিল পুচকা)
-আজকে হালিম বানানো যাবে না
-তুমি আলিম বানাও!!!
-আমি পারবো না!!!
-আ-মি আ-লিম খা-বোওওওও........(চীৎকার)

যখন কোন কিছু জোর দিয়ে চায়, তখন বাক্য থেকে শব্দগুলো অক্ষরগুলো আলাদাভাবে উচ্চারণ করবে সে।

মা ছেলে মুখোমুখি সংঘর্ষের আশংকা দেখা দিল। বিপদেই না পড়লাম। এখন হালিম পাবো কই। দিশা এটা সেটা দেয়, কিছুতে ভোলাতে পারে না।

অগত্যা ওর মাকে এগ্রেসিভ হতে হলো। ডাইরেক্ট একশান। এগিয়ে গিয়ে কোলে করে 'আলিম' থেকে দূরে বারান্দায় নিয়ে যেতে হলো। সেখানে অপেক্ষমান দাড়কাক। কাক আসছে বললে, একটু থামে। কাকজাতি ওর দিকে কয়েকবার নজর দিয়েছে বারান্দার গ্রীলের ফাঁকে। সেই থেকে কাকদের পছন্দ করে না সে। অবশেষে এই করে পুচকা শিহানের ইফতার পর্ব সাঙ্গ হলো গতকাল।

Monday, July 23, 2012

ঘুমের দেশে হুমায়ূন আহমেদ

১. হুমায়ূন আহমেদ আমার প্রিয় লেখক ছিলেন না। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কেটেছে আমার তারুণ্যের বেশ কিছু আনন্দময় সময়। বইয়ের পাতায়, টিভি নাটকে। আমার সেই আনন্দের আত্মিক মূল্য অনেক। তাই তাঁকে যারা সাহিত্যিকের মর্যাদা দিতে কুন্ঠিত তাদের সাথে আমি কঠোর দ্বিমত পোষণ করি। আমার ধারণা হুমায়ূন আহমেদ না লিখলে বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক পাঠক কাশেম-বিন-আবু-বক্কর জাতীয় লেখকের পাঠক হয়ে থাকতো। বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যার এই পাঠক উত্তরণে হুমায়ূন আহমেদের অবদান কেউ খাটো করে দেখলে সেটা তার সংকীর্ণতার সমস্যা।

২. ঢাকার শহীদ মিনারে আজ লক্ষ জনতার ঢল। সবাই হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে। এত মানুষের ভীড় আমি আর কোন মৃত্যুতে দেখিনি। সাধারণের পাশাপাশি এসেছে কূলীন সমাজও। সৈয়দ সামশুল হকের মতো মানুষেরা কফিন ধরে বসে আছে।  এমন সব মানুষকে দেখা যাচ্ছে শোকের মিছিলে যারা জীবিত হুমায়ূনকে পাত্তা দিত না। মৃত হুমায়ূনকে আমার জীবিত হুমায়ূনের চেয়ে শক্তিশালী মনে হচ্ছে।

৩. প্রিয় লেখক না হয়েও হুমায়ূন আহমেদের বেশ কিছু বই আমাকে আনন্দময় সময় কাটাবার অবকাশ দিয়েছে। বেশ কিছু বই মাথায় চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে, চোখের কোনা ভিজিয়েছে, হাসিতে তলপেট কাঁপিয়েছে। 'আনন্দবেদনার কাব্য' নামক ছোট গল্পের বইটা আমার প্রথম পড়া বই। যে বইটি বহুবার পড়ার পরও প্রায় সমান আনন্দ বেদনা যুগিয়েছে আমাকে। আশি নব্বই দশকের হুমায়ূন আহমেদকে যদিও একুশ শতকে আর খুঁজে পাইনি, তবু আমার তারুণ্যের কিছু উজ্জ্বল মুহূর্তের জন্য আমি হুমায়ূনের কাছে ঋনী।

৪. কলেজে পড়ার সময় বাংলা সাহিত্যে সরল গদ্যের জন্য আমার প্রথম পছন্দ ছিল জহির রায়হান। জহির রায়হানের পর আমি হুমায়ূন আহমেদকে পেয়েছিলাম সরল গদ্যে সরস বর্ননা দক্ষতায়। হুমায়ূন আহমেদের বই জনপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম একটা কারণ হলো সেই সেন্স অব হিউমার। যা তিনি নির্বিকার নৈপূন্যে তুলে ধরতে পারতেন। আমরা বলতাম হুমায়ূন আহমেদ হলো ইকোনো কলমের মতো। একবার পড়ে রেখে দিতে হয়, দুইবার পড়া হয় না। কিন্তু সেই একবারে পাঠক একদম খালি হাতে আসে না। বেশ কিছুটা সময় আনন্দ বেদনার রেশ থেকে যায় ভেতরে।

৫. দুজন মানুষকে আমাদের কূলীণ সমাজ গ্রহণ করেনি আন্তরিকভাবে। কাজী আনোয়ার হোসেন আর হুমায়ূন আহমেদ। এই দুজন কোন বিচারে তুলনীয় না হলেও, দুটো ব্যাপারে এদের মিল আছে। তাই এই মুহুর্তে এই দুজনের কথা মনে আসলো-
   - দুজনেই সুস্থ ধারার অসংখ্য পাঠক তৈরী করেছে।
   - দুজনকেই সুশীল সমাজ স্বীকৃতি দিতে দ্বিধান্বিত।


৬. হুমায়ূন আহমেদের লেখা আমার আরেকটি প্রিয় বই 'নির্বাসন'। এই বইটার মধ্যে কি যেন একটা ছিল যেটা আমার সদ্য তরুণ বয়সে একটা মিষ্টি স্মৃতির জন্ম দিয়েছিল। কোন কোন প্রিয় গান যেমন কিছু প্রিয় মুহুর্তকে স্মরণ করায়, তেমনি এই বইটিও। খুব সাধারণ কিছু বইও ব্যক্তিগত নস্টালজিক কারণে প্রিয় হয়ে যায়, যেমন হয়েছিল সুব্রত বড়ুয়ার  'জোনাকী শহর' বইটি। এই বইটিও বিশেষ কিছু দিনকে, বিশেষ কিছু মাসকে, বিশেষ একটা বছরকে যুগযুগ ধরে স্মৃতিপ্রকোষ্ঠে ধরে রাখবে।

৭. আমার মাইগ্রেন সমস্যা আছে। খুবই যন্ত্রনাদায়ক। অনেক বছর আগে কেউ একজন বলেছিল হুমায়ূন আহমেদের বই পড়লে নাকি মাথাধরা কমে। আমি তার কাছ থেকে একটি সরস হুমায়ূন আহমেদ পড়ে সত্যি সত্যি মাথাব্যথা ভালো করে ফেলেছিলাম। গতকালও আমার খুব মাথা ধরেছিল, কিছুতে সারছিল না। ভাবছিলাম হুমায়ূন আহমেদের বই দিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করা যায় নাকি।

৮. হুমায়ূন আহমেদের লাশ এখনো শহীদ মিনারে। সবগুলো টিভি চ্যানেল সরাসরি দেখাচ্ছে। এটাও নজীরবিহীন ঘটনা। বাংলাদেশে এত সম্মানিত মৃত্যু আর কোন লেখক পায়নি। কিছু কিছু বিষয়ে বিতর্কিত হুমায়ূন আজকের দিনটাতে অন্ততঃ বিতর্কের বাইরে আছেন। তাঁর পারিবারিক জটিলতাগুলো একটা দিনের জন্য হলেও ঢাকা পড়ে যাক। কফিনের পাশে দাঁড়ানো পরস্পরবিরোধী স্বজনেরা একটা দিন ভুলে থাকুক তাদের মনোবেদনা। এক বেদনা ঢেকে রাখুক আরো অনেক বেদনা, অন্ততঃ একটি দিনের জন্য। শান্তিতে ঘুমোন আপনি হুমায়ূন আহমেদ।

Monday, July 16, 2012

হায় বর্ষা, তোমার চোখে

কোনো এক নামহীন কবির সর্বনাশ ঘটেছিল এক বরষায়। তাই বুঝি তিনি বলেছেন-

তোমার চোখে জলের ছায়া নদীর ধারে আমার বাস
মেঘের সাথে তোমার দেখা বর্ষা নামায় সর্বনাশ।

রবিঠাকুর যতই বলুক প্রহর শেষের চৈত্রমাসের কথা, বেশীরভাগ বাঙালীর হৃদয়ে সর্বনাশ ঘটে এই বর্ষার দিনেই। এই বাংলাদেশের বর্ষার কোন তুলনা আছে? থাকলে দুই হাত তোলেন। আমি বুক ফুলিয়ে বলি সারা বিশ্বে বাংলাদেশের বর্ষার রূপই সবচেয়ে অনন্য। এই রূপময়তার  যে নদী আমাদের সর্বনাশ করে, সেই নদীই আবার সবচেয়ে সৌন্দর্যের আধারও মেলে ধরে।

দুনিয়ার যেসব দেশে বন্ধুবান্ধব আত্মীয় আছে এবং যেসব  দেশে নিজে বর্ষা দেখেছি, সব মিলিয়ে বলতে পারি, উপমহাদেশ বাদে কোথাও উদার সৌন্দর্যের বর্ষা নাই। পশ্চিমা দেশে তো বর্ষা বলে কোনো ঋতু নেই। সামারেই বৃষ্টি বাদল সব সারিয়ে দেয়। তাই বোধহয় বৃষ্টি পড়ে ভীষণ রকমের দীনতা নিয়ে। একটুও ভালো লাগার না। আমার লাগেনি অন্ততঃ। ওসব দেখে বরং দেশের উদার- অকপট বৃষ্টিধারা তুমুল মিস করেছি! মেজাজ খারাপ করে বিচিত্র ভাবনা ভাবি, ওদেশের বৃষ্টির গরিবী দেখে। বড়লোক হলে কি হবে! বাংলাদেশের মতো ওদের আকাশ উদার হয়ে ঢালতে জানেনা- কাঁদতে শিখেনি তেমন করে। আরো ভাবি, ওখানকার বাচ্চাগুলোর কথা। গুটুর গুটুর করে খালি কম্পু গুতানো কিংবা হাইফাই কোনো খেলনা নিয়েই ব্যস্ত থাকলো বেচারাগুলো। বৃষ্টিতে কিভাবে ভিজতে হয়, আদুর গায়ে বৃষ্টিধারা কেমন করে মাখতে হয়, সে আনন্দের খোঁজ হতভাগার দল পেলো না ভেবেও মনটা উদাস হয়!

মনে পড়ে যায় নিজের ছেলেবেলার কথা। কোনো কোনো বৃষ্টির দিন মনটা কিছুতেই মায়ের শাসন, বড়দের বকুনির ধার ধারতো না। পাড়ার আর দু-দশজনকে জুটিয়ে হা রে রে রে করে নেমে যেতাম বৃষ্টিতে ভিজবো বলে। সে কি হৈ হু্ল্লোড়! আনন্দ স্বয়ং আমাদের বন্ধু তখন। সব ভুলে অপার আনন্দের হাত ধরে আমরা তখন দিশেহারা- বাঁধনছাড়া, পাগলপারার দল!

কোনো কোনো বৃষ্টির দিন ছুটতে ছুটতে চলে যেতাম নতুন কোনো পথের বাঁকে। যেদিকে হয়ত যাওয়া হয়নি কখনোই। লুকোচুরি খেলার অংশ হিসেবে তেমন জায়গা ছিলো খুব পছন্দের। এভাবে একদিন পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। ঘোরবৃষ্টির মাঝে একদম অচেনা এক পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলাম কেমন বোকার মতো! এখন ভাবলে হাসি পায়। আবার হারিয়ে যাওয়া সেই আমি'টার জন্য মনটা কেমন কেমন করে! এদিক ওদিক পথ খুঁজতে গিয়ে বন্ধুদের দেখা মিলে গিয়েছিলো তাতেই বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। সেবার বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি খেতে হয়নি। বরং আমি ফিরতেই, মা আমাকে ঝাপটে ধরে রেখেছিলেন অনেকটা সময়। আমার ভিজে কাপড় মায়ের শাড়িই শুধু ভিজিয়ে দেয়নি- তাঁর টুকটুকে মুখ জুড়ে জল ছোপছোপ খেলা দেখে আমি কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেবার ধুম জ্বর এসে যায় আমার। বৃষ্টি আমার ধাতে সয় না। ভিজলেই শর্দিতে ভুগতে হতো- যেকারণে বাড়ির বড় কেউ বৃষ্টিতে ভিজতে দেখলেই চোখ রাঙাতেন।

আর সব ব্যাপারে আমি শান্ত সুবোধ থাকলেও বৃষ্টি হলেই কেমন বেপরোয়া হয়ে যেতাম। তখন আমি পাগলা জগাই, তখন আমি কাউকে না ডরাই। ঠান্ডা জ্বরের তোয়াক্কা না করে কতো যে ভিজেছি তুমুল বৃষ্টির কোলাহলে! এখন এই বয়সে এসে বৃষ্টির দিনের সেসব কথা মনে পড়ে ভীষণ। খুব ইচ্ছে করে একদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ুক। ধুম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আমি ভিজবো- আমূল ভিজে যাবো আমি। ছুটতে ছুটতে আবার পথ হারিয়ে ফেলবো…..কিন্তু তেমন বৃষ্টি আসে না যেন এখন। এলেও আমি আর আগের মতো ছুটে গিয়ে ভিজতে পারি না।  ধুম বৃষ্টির দিনে হুডখোলা রিক্সায় প্রিয় একজন মানুষের সাথে ভিজতে পারার সুখস্মৃতি আমার হয়ত নেই। কিন্তু যা আছে সেই বা কম কি! বৃষ্টিদিন আমাকে তাই উদাস করে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবের সেইসব আনন্দমেলায়। মায়ের সেই সোঁদা গন্ধমাখা শাড়ির ছায়ায়…আমি তাই বৃষ্টি ভালোবাসি; আমি তাই হামুখো কাঙ্গালের মতো বৃষ্টি চাই।

==============================================

লেখাটা শেষ করার পর নিমাইচন্দ্র আমার দিকে মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, চ্রম বাজে একটা রচনা হইছে। 

আমি বললাম, তা তো বটেই। কিন্তু কবিতাটা নিয়ে চাপাটা না মারলেই হতো।

নিমাই বললো, এটা ঠিক চাপা না, কিন্তু আমি কবিতা লিখছি শুনলে ছাগলেও হাসবে। দেখোনি, আগেকার দিনে নোটবইয়ের লেখকের নাম থাকতো, 'জনৈক অভিজ্ঞ হেডমাষ্টার'। আমাকে স্কুলে কুইজ প্রতিযোগিতায় প্রিয় লেখকের নাম জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলাম, 'জনৈক অভিজ্ঞ হেডমাষ্টার'। আসলে তখন 'জনৈক' মানে ভাবতাম সৈয়দ জাতীয় বংশ টাইটেল, 'অভিজ্ঞ' মানে ভাবতাম মূল নাম, আর হেডমাষ্টারতো চিনিই, মাথায় পাকাচুল কেউ হবে।

আমি নিমাইচন্দ্রকে অভয় দিয়ে বললাম, তোমার লেখাটা দৈনিক বিলাতী আলুতে পাঠিয়ে দিতে পারো নিশ্চিন্তে।

Thursday, July 12, 2012

নির্বিষ পদ্য

আবারো সরে যাবার কাল চলে এসেছে
আবারো নেবো নিবিড় আড়াল।
আবারো বিব্রত সময়ের সকাল বিকাল
আবারো নতচোখে দ্বন্দ্বের আভাস।

চলে যাবার সময় হলে দ্বিধার অবকাশে যাওয়াই ভালো
স্মৃতির পিছুটান যে দুঃসময় আগলে রেখেছিল তাতে জল ঢালা হয়ে গেছে
এবার সে বাঁচবে বহুকাল, আগুন পেরিয়ে
তবু তুষের আগুন যেখানে নীরবে জ্বলে সেখানে কোথাও আলো নেই।
দ্বিধার অবকাশে অবিশ্বাস করে নেয় ঠাঁই

,+++++++++++++++
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়

Thursday, July 5, 2012

ওয়াসফিয়া নাজরীনের সাথে একটি সান্ধ্যকালীন আড্ডা

যাচ্ছিলাম আম কিনতে। খবর পেয়েছি ফরমালিন মুক্ত আম এসেছে এক জায়গায়। যেতে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম এতদিন বিষযুক্ত আম খেয়েছি, এখন বিষমুক্ত আম খেলে বদ হজম হবে কিনা। কিন্তু গিয়ে আমের দাম শুনে মস্তিষ্কে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হলো। বিবেকের কাছ থেকে সমাধান এলো ওই দামের বিষমুক্ত আম খাওয়ার চেয়ে খানিকটা বিষ সয়ে নেয়া ভালো। শরীরের নাম মহাশয়, যতটুকু সওয়ানো যায়, ততটাই .....।

আম কিনতে ব্যর্থ হয়ে মনে পড়লো বিশদ বাঙলার আলম খোরশেদ জানিয়েছিলেন ওয়াসফিয়া আসছে বুধবার সন্ধ্যার পর। আড্ডা হবে। ওদিকেই চাকা ঘোরালাম। নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘন্টা পরে গিয়ে বিশদ বাঙলার ছোট্ট আড্ডা ঘরে জায়গা পাবো কিনা সন্দেহ আছে। তবু ঘোর প্রতিবেশী মেয়েটাকে এক পলক দেখে আসার সুযোগ হারাই কেন। ঘোর প্রতিবেশী বলাতে অবাক হচ্ছেন? একই শহরের বাসিন্দারা সবাই প্রতিবেশীই তো। তাছাড়া ওয়াসফিয়া যে পাহাড়ে শৈশব কৈশোর কাটিয়েছে তার একটা পাহাড় পরেই আমার বাসা। তার চেয়ে বড় সত্য হলো নিজের শহরের কেউ বিখ্যাত হলে তাকে প্রতিবেশী পরিচয় দিতেই গর্ব হয়।

নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা পর সাড়ে সাতটার দিকে বিশদ বাঙলায় ঢুকতেই কর্ণধার আলম ভাই জানালেন আর দশ মিনিটের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হবে, যানজটের জন্য প্রধান অতিথি শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফি আসতে দেরী করছেন, তিনি ওয়াসফিয়াকে সংবর্ধিত করবেন সবার পক্ষ থেকে। তিনি এসে পৌঁছালেই শুরু হবে। ভেতরে তখনো একটু জায়গা খালি আছে দেখলাম। আর কি, স্যান্ডেল খুলে ভেতরে বসে পড়লাম। সম্পূর্ন ঘরোয়া আয়োজন। বিশদ বাঙলার পনের বাই পঁচিশ ফুটের ছোট্ট আড্ডাঘরটি ততক্ষণে নানা বয়সী মানুষে জমজমাট হয়ে গেছে। পুরো ঘর জুড়ে কার্পেট বসিয়ে আড্ডার বন্দোবস্ত। দেয়ালের একপাশে মুরব্বীদের জন্য একসারি চেয়ার আছে। বাদ বাকী ঘরে সবাই পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে আছে কার্পেট জুড়ে।

অভিযাত্রী কই? মেয়েদের মধ্যে কোনজন হবে? পত্রিকার ছবির সাথে মিল আছে কিনা বাস্তবে? গতকালকের পত্রিকায় শেখ হাসিনার চেয়েও লম্বা লাগছিল। সামনের দিকে দেখলাম গাঢ় নীল সুতী শাড়ি পরা একটা মেয়ে লাজুক মুখে মাথা নীচু করে বসে আছে। আমার জায়গা থেকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। তবে মাথা তুলতেই বুঝলাম ওই মেয়েটিই ওয়াসফিয়া নাজরীন।

যানজট পেরিয়ে মুশতারী আপা আসতে প্রায় আটটা। ইতিমধ্যে ওয়াসফিয়ার মাও এসে গেছেন। যানজট আজকে আমার উপকারই করলো।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। এটাকে অনুষ্ঠান বললে যুত হয় না। পুরো ব্যাপারটাই ঘরোয়া। মাইক স্পীকারের বালাই নাই। গোল হয়ে মুখোমুখি বসে গল্প করতে করতে প্রজেক্টরে স্লাইড শো দেখা। বিশদ বাঙলার পক্ষ থেকে ওয়াসফিয়াকে একটা লাল সবুজ পতাকা চাদর পরিয়ে দিয়ে মুশতারী শফি সংবর্ধনা শেষ করলেন।

এবার মূল পর্ব। ওয়াসফিয়া তাঁর ছোট্ট জীবনের বিশাল অভিজ্ঞতা ঝুলি থেকে একটু একটু ছাড়তে লাগলেন মুগ্ধ শ্রোতাদের সামনে। বিশ্বাসই হতে চায় না, এই ছিপছিপে সাদামাটা দেখতে মেয়েটি বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম স্থানে পা রেখেছে।

সহজ, স্বচ্ছ, সরল বর্ননা। গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলতে জানে সে। সাত মহাদেশের সাতটি চুড়ায় উঠবে ওয়াসফিয়া। তিন মহাদেশ শেষ। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া। ইউরোপের শীর্ষচুড়ার ৩০০ মিটার নীচ থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল ঝড়ের কারণে। আবার যেতে হবে ওটায়। এই ৪টি চুড়ায় উঠতে পারলে মিশন শেষ। খোলামেলা আড্ডার মধ্যে প্রচুর গল্প হলো দেড় ঘন্টা ব্যাপী। ছেলেবেলার গল্প থেকে বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত গল্পের একাংশে যোগ দিলেন ওয়াসফিয়া জননী। প্রশ্নের মুখোমুখি হলো সেও।

প্রশ্নঃ আপনি কি গর্ব বোধ করছেন আপনার মেয়ের এভারেষ্ট জয়ে?
জবাবঃ আমার মেয়ে মোট ৭ টা চুড়ায় ওঠার জন্য নেমেছে, মাত্র তো ৩টায় উঠেছে। ও এভারেষ্টে যখন গেছে আমি ভয়ে থাকতাম প্রতিটা মুহুর্ত, ঘুমাতে পারতাম না। বাকী চারটায় কিভাবে উঠবে ভাবলে আমার বুক আতংকে হিম হয়ে যায়। গর্ব নয় আমি আতংকে আছি।

প্রশ্নঃ মা হিসেবে ওর এত বড় অর্জনের কোন লক্ষণ দেখা গিয়েছিল শৈশবে?
জবাবঃ ও বরাবরই শান্তশিষ্ট লাজুক। কিন্তু শৈশব থেকেই অসম্ভব জেদী ছিল সে। শৈশবেই জেদের চোটে বিছানায় শুয়ে শুয়েও খাট পালংক কাঁপিয়ে ফেলতো।

আড্ডার সুরে অনেক কথা বলেছেন ওয়াসফিয়া। তাঁর কয়েকটা নীচে দিলাম। তবে যেহেতু মগজের মেমোরি থেকে লেখা, আক্ষরিকভাবে হুবহু শব্দ ব্যবহার করা যায়নি।

১) আমাকে ২০০৭ এ চীনারা এভারেষ্টে উঠতে দেয়নি আমার ব্যাগে দালাইলামার ছবিসম্বলিত বই ছিল বলে। কঠোর ভাবে বলেছিল, তুমি জীবনে আর কখনোই তিব্বতে পা রাখতে পারবে না। এবার এভারেষ্টে উঠে নেপাল অংশ থেকে তিব্বতের দিকে ৫০ ফুট নেমে গিয়ে দালাইলামার একটি ছবি বরফে পুতে ছবি তুলে এসেছি। অনেক দিনের জেদ ছিল আমার। পা রাখতে দেবে না আবার!

২) আমাদের গ্রামের কিছু রক্ষণশীল মানুষের কাছে আমি প্রায় অচ্ছ্যুত ছিলাম আমার ধর্মকর্মহীন জীবন যাপনের জন্য। দেশ বিদেশ একা ঘুরে বেড়াই। কিন্তু এবার এভারেষ্ট থেকে ফেরার পর সেই রক্ষণশীল মুরব্বীরাই এসে জড়িয়ে ধরে জানাচ্ছে আমার জন্য প্রতিদিন দুহাত তুলে দোয়া করেছে।

৩) এভারেষ্টকে শেরপারা দেবতা মান্য করে। কিন্তু এভারেষ্টের চুড়ায় উঠতে হয় জুতা পায়ে। দেবতার মাথায় পা দেয়া একটা বেয়াদবী। বেয়াদবীর জন্য আগাম মাফ চাইতে একটা পুজার আয়োজন করা হয়। পুজার বেদীতে নানান জিনিসপত্রের পাশে অভিযাত্রীদের জুতোগুলো রেখে দেবতার পুজো করা হয় যাতে ওই জুতো পরে এভারেষ্টে উঠলেও দেবতা রাগ না করেন। কুসংস্কার আছে যদি কোন কারণে পুজার বেদীটা ভেঙ্গে পড়ে তাহলে সেটাকে অমঙ্গলের সূচক বলে ধরে নেয়া হয়। পথে একটা মেয়ের মৃত্যু ঘটলে শেরপারা স্মরণ করছিল মেয়েটার বেদীটা ভেঙ্গে গিয়েছিল পুজা করার সময়।

৪) কিলিমাঞ্জারো কিংবা একোংকাগুয়ার চেয়ে এভারেষ্ট অনেক কঠিন। তবু এভারেষ্ট আমার ভেতরে নেশা জাগিয়েছে। আমার ইচ্ছে ভবিষ্যতে আমার আমার যতগুলি সন্তান হবে প্রত্যেকটিকে নিয়ে এভারেষ্টে চড়বো।

৫) আমাকে এভারেষ্ট বিজয়ী বলা উচিত নয়। শুনতে ভালো লাগে না। বারণ করেছি তবু মিডিয়া এতেই অভ্যস্ত। এভারেষ্ট অনেক বিশাল ব্যাপার, একে কেউ বিজয় করতে পারে না, আমরা কেবল এভারেষ্ট ছুঁয়ে আসতে পারি।

৬) মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর আমাকে বিশাল একটা পতাকা দিয়েছিল এভারেষ্টের চুড়ায় ওড়ানোর জন্য। অতবড় পতাকা কেউ নেয় না অভিযানে। বেস ক্যাম্পে আমি যখন পতাকাটা ওড়াই, সবগুলো ক্যাম্পের মধ্যে ওটাই ছিল বৃহত্তম পতাকা। সারা পৃথিবী থেকে আসা অভিযাত্রীরা মনে করে বাংলাদেশ এভারেষ্টে বিশাল এক টীম পাঠিয়েছে।

৭) এভারেষ্ট থেকে ফিরে আসার পর বহুবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে একটি মন্তব্য - "যখন শুনলা নিশাত আগে উঠে গেছে, তোমার কিরকম লাগলো। মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে ইচ্ছে করেনি? নিশাত যখন উঠে গেছে তখন তোমার লাভ কি?" কেউ কেউ বোঝে না, এভারেষ্টে ওঠা কোন প্রতিযোগিতার বিষয় নয়। ওঠাটাই যোগ্যতা। নিশাত আপা আর আমি কখনোই প্রতিযোগিতা করিনি।

ওয়াসফিয়ার শৈশব কৈশোরের উল্লেখযোগ্য অংশ কেটেছে চট্টগ্রামে। বাবার চাকরীসুত্রে থাকতেন জেমস ফিনলের পাহাড়ে। পড়তেন বাওয়া স্কুলে। তারপর ঢাকা চলে যান। অতঃপর উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য আমেরিকা, স্কটল্যাণ্ড, তিব্বত। তিব্বতে গবেষণা কালীন সময়ে শেরপাদের সাথে বন্ধুতা গড়ে ওঠে। হিমালয়ের সাথে জানাশোনাও তখন। তাদের কাছ থেকেই ট্রেনিং নিয়েই অভিযাত্রার শুরু।

কথার শেষ নেই। ঘড়ির কাটা দেখে আড্ডা সংকুচিত হলো। দশটা বেজে গেছে ততক্ষণে। আনুষ্ঠানিকভাবে আড্ডা শেষ করা হলো। প্রশ্নোত্তর পর্বও শেষ। আড্ডা শেষে ওয়াসফিয়াকে বললাম আমার ছ বছরের জেদী মেয়েটার জন্য কিছু একটা লিখে দিতে। সে লিখলো, "ডিয়ার ওশিন, লিভ ইয়োর লাইফ, লাইফ ইজ হোয়াট ইউ মেক ইট। লাভ ফ্রিডম"।

বাসায় গিয়ে ওশিনকে বইটা দিয়ে অটোগ্রাফের কথা বলাতে সে বললো, "মানেটা বুঝিয়ে দাও বাবা!"।
মুশকিলে পড়লাম। হুবহু অনুবাদ করে দিলে তো আগামীকাল থেকে আর পড়ার টেবিলের কাছ দিয়েও যাবে না, ডাইনিং টেবিলের আশপাশ মাড়াবে না, স্বাধীনতা ঘোষণা করে ধেই ধেই করে সারা ঘর নেচে তোলপাড় করে ফেলবে। তাই বললাম, "তোমাকে ওয়াসফিয়া বলেছে বেশী বেশী করে লেখাপড়া করে বড় হতে, তাইলে তুমিও হিমালয়ের চুড়ায় উঠে এই বরফের আইসক্রিমে ঘুরে বেড়াতে পারবে।"

এত সুন্দর মিথ্যা আমি জীবনে খুব কমই বলতে পেরেছি।