Monday, July 23, 2012

ঘুমের দেশে হুমায়ূন আহমেদ

১. হুমায়ূন আহমেদ আমার প্রিয় লেখক ছিলেন না। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কেটেছে আমার তারুণ্যের বেশ কিছু আনন্দময় সময়। বইয়ের পাতায়, টিভি নাটকে। আমার সেই আনন্দের আত্মিক মূল্য অনেক। তাই তাঁকে যারা সাহিত্যিকের মর্যাদা দিতে কুন্ঠিত তাদের সাথে আমি কঠোর দ্বিমত পোষণ করি। আমার ধারণা হুমায়ূন আহমেদ না লিখলে বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক পাঠক কাশেম-বিন-আবু-বক্কর জাতীয় লেখকের পাঠক হয়ে থাকতো। বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যার এই পাঠক উত্তরণে হুমায়ূন আহমেদের অবদান কেউ খাটো করে দেখলে সেটা তার সংকীর্ণতার সমস্যা।

২. ঢাকার শহীদ মিনারে আজ লক্ষ জনতার ঢল। সবাই হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে। এত মানুষের ভীড় আমি আর কোন মৃত্যুতে দেখিনি। সাধারণের পাশাপাশি এসেছে কূলীন সমাজও। সৈয়দ সামশুল হকের মতো মানুষেরা কফিন ধরে বসে আছে।  এমন সব মানুষকে দেখা যাচ্ছে শোকের মিছিলে যারা জীবিত হুমায়ূনকে পাত্তা দিত না। মৃত হুমায়ূনকে আমার জীবিত হুমায়ূনের চেয়ে শক্তিশালী মনে হচ্ছে।

৩. প্রিয় লেখক না হয়েও হুমায়ূন আহমেদের বেশ কিছু বই আমাকে আনন্দময় সময় কাটাবার অবকাশ দিয়েছে। বেশ কিছু বই মাথায় চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে, চোখের কোনা ভিজিয়েছে, হাসিতে তলপেট কাঁপিয়েছে। 'আনন্দবেদনার কাব্য' নামক ছোট গল্পের বইটা আমার প্রথম পড়া বই। যে বইটি বহুবার পড়ার পরও প্রায় সমান আনন্দ বেদনা যুগিয়েছে আমাকে। আশি নব্বই দশকের হুমায়ূন আহমেদকে যদিও একুশ শতকে আর খুঁজে পাইনি, তবু আমার তারুণ্যের কিছু উজ্জ্বল মুহূর্তের জন্য আমি হুমায়ূনের কাছে ঋনী।

৪. কলেজে পড়ার সময় বাংলা সাহিত্যে সরল গদ্যের জন্য আমার প্রথম পছন্দ ছিল জহির রায়হান। জহির রায়হানের পর আমি হুমায়ূন আহমেদকে পেয়েছিলাম সরল গদ্যে সরস বর্ননা দক্ষতায়। হুমায়ূন আহমেদের বই জনপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম একটা কারণ হলো সেই সেন্স অব হিউমার। যা তিনি নির্বিকার নৈপূন্যে তুলে ধরতে পারতেন। আমরা বলতাম হুমায়ূন আহমেদ হলো ইকোনো কলমের মতো। একবার পড়ে রেখে দিতে হয়, দুইবার পড়া হয় না। কিন্তু সেই একবারে পাঠক একদম খালি হাতে আসে না। বেশ কিছুটা সময় আনন্দ বেদনার রেশ থেকে যায় ভেতরে।

৫. দুজন মানুষকে আমাদের কূলীণ সমাজ গ্রহণ করেনি আন্তরিকভাবে। কাজী আনোয়ার হোসেন আর হুমায়ূন আহমেদ। এই দুজন কোন বিচারে তুলনীয় না হলেও, দুটো ব্যাপারে এদের মিল আছে। তাই এই মুহুর্তে এই দুজনের কথা মনে আসলো-
   - দুজনেই সুস্থ ধারার অসংখ্য পাঠক তৈরী করেছে।
   - দুজনকেই সুশীল সমাজ স্বীকৃতি দিতে দ্বিধান্বিত।


৬. হুমায়ূন আহমেদের লেখা আমার আরেকটি প্রিয় বই 'নির্বাসন'। এই বইটার মধ্যে কি যেন একটা ছিল যেটা আমার সদ্য তরুণ বয়সে একটা মিষ্টি স্মৃতির জন্ম দিয়েছিল। কোন কোন প্রিয় গান যেমন কিছু প্রিয় মুহুর্তকে স্মরণ করায়, তেমনি এই বইটিও। খুব সাধারণ কিছু বইও ব্যক্তিগত নস্টালজিক কারণে প্রিয় হয়ে যায়, যেমন হয়েছিল সুব্রত বড়ুয়ার  'জোনাকী শহর' বইটি। এই বইটিও বিশেষ কিছু দিনকে, বিশেষ কিছু মাসকে, বিশেষ একটা বছরকে যুগযুগ ধরে স্মৃতিপ্রকোষ্ঠে ধরে রাখবে।

৭. আমার মাইগ্রেন সমস্যা আছে। খুবই যন্ত্রনাদায়ক। অনেক বছর আগে কেউ একজন বলেছিল হুমায়ূন আহমেদের বই পড়লে নাকি মাথাধরা কমে। আমি তার কাছ থেকে একটি সরস হুমায়ূন আহমেদ পড়ে সত্যি সত্যি মাথাব্যথা ভালো করে ফেলেছিলাম। গতকালও আমার খুব মাথা ধরেছিল, কিছুতে সারছিল না। ভাবছিলাম হুমায়ূন আহমেদের বই দিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করা যায় নাকি।

৮. হুমায়ূন আহমেদের লাশ এখনো শহীদ মিনারে। সবগুলো টিভি চ্যানেল সরাসরি দেখাচ্ছে। এটাও নজীরবিহীন ঘটনা। বাংলাদেশে এত সম্মানিত মৃত্যু আর কোন লেখক পায়নি। কিছু কিছু বিষয়ে বিতর্কিত হুমায়ূন আজকের দিনটাতে অন্ততঃ বিতর্কের বাইরে আছেন। তাঁর পারিবারিক জটিলতাগুলো একটা দিনের জন্য হলেও ঢাকা পড়ে যাক। কফিনের পাশে দাঁড়ানো পরস্পরবিরোধী স্বজনেরা একটা দিন ভুলে থাকুক তাদের মনোবেদনা। এক বেদনা ঢেকে রাখুক আরো অনেক বেদনা, অন্ততঃ একটি দিনের জন্য। শান্তিতে ঘুমোন আপনি হুমায়ূন আহমেদ।

No comments: