Saturday, October 30, 2010

প্রিয় কন্যা এবং পুত্রঃ তোমাদের জন্য লেখা

আমার প্রিয় কন্যা ও পুত্র(ওশিন ও শিহান)

শ এর প্রতি আমার দুর্বলতা বেশী নাকি ন এর প্রতি আমার দুর্বলতা আমি জানি না। কিন্তু সচেতনভাবে আমি তোমাদের নাম রাখতে গিয়ে এই দুটি শব্দ ব্যবহার করেছি। ওশিনের নাম রেখেছি আধঘন্টার এক সিদ্ধান্তে। যদিও নামের বই থেকে শত শত নাম দেখা হয়েছে। ইন্টারনেটেও খোঁজা হয়েছে অনেক। তবু শেষমেষ তারুণ্যের শুরুতে মুগ্ধ করা একটা জাপানী কাহিনীর চরিত্র ওশিনকে বেছে নিলাম তোমার জন্য। ওশিন আমার স্বপ্ন। যার জন্মের আগে থেকেই ভালোবেসেছিলাম প্রবলভাবে। তার একটা নাম রেখেছিলাম আয়নাপরী। আমি যেন জানতাম আমি একটা পরীর বাবা হতে যাচ্ছি। তোমার জন্মের সাথে সাথে আমাকে হাসপাতালের অপারেশান থিয়েটারে ডাকা হলো তোমাকে দেখার জন্য। আমি দেখলাম অবিশ্বাস্য সুন্দর একটা পরী দুই গালে টোল ফেলে হাসছে আমার দিকে চেয়ে। এইটুকুন বাচ্চার গালে টোল! আমার নিজেরই অবিশ্বাস লেগেছিল। তবে এই ফুটফুটে শিশুটি মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়েছে ইয়া মোটা একটা নাড়ী নিয়ে। ওটা অপারেশান ছাড়া নাভির ছিদ্র বন্ধ হবে না। কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার সমস্ত আনন্দ উবে গিয়ে বিষাদের কান্না ভর করলো। কি অপরাধে আমার এই শাস্তি? রাত দশটার মধ্যে অপারেশান সমাপ্ত হলেও তোমার জ্ঞান ফেরেনি বলে আমরা তোমাকে রুমে আনতে পারলাম না। অনেক রাতে তোমাকে রুমে দেয়া হলো। মাথায় ব্যন্ডেজ দিয়ে আটকানো স্যালাইন। তুমি কাঁদার শক্তিও হারালে। তারপর তোমার যখন জ্ঞান ফিরলো শুরু হলো ব্যাথার কান্না। সেই অবিরাম কান্না বহুরাত আমাদের নির্ঘুম রেখেছিল বাসায় ফেরার পরেও। তবু একদিন তুমি সেরে উঠলে। আমাদের মুক্ত করলে সকল দুশ্চিন্তা থেকে।

কান্নার ছবির একটা চিত্র ভিডিওতে তুলে রেখেছি ইন্টারনেটে।



ওশিনের একটা ওয়েবসাইটও তৈরী করা হলো জন্মের সাথে পরপর।
http://sites.google.com/site/oshinmahiyat/


আমরা তখন বেপারী পাড়ার বাসায়। একতলা টিনশেড বাড়ী। তোমার দাদার বানানো ঘর। আমাদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল ২২টি বছর। সেই ঘরটি তখন জরাজীর্ণ। বর্ষায় পানি পড়ে টিনের চাল দিয়ে। করিডোরে পানি জমে যায়। ইট দিয়ে পারাপার বাথরুমে। তবু নিরুপায় বসবাস। তুমি যে ঘরটিতে থাকতে সেটি অবশ্য ছাদের নিরাপদ আশ্রয় ছিল। পুরো বাড়ীতে এই একটি ঘর ছিল পাকা ছাদের। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলের ঝড়ে পুরো চাল উড়ে যাবার পর পুননির্মান করতে গিয়ে এটাকে সবার ঘূর্নিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে বানানো। আমি সেই ঘরটিতে বসবাস করতে শুরু করি ৯১ থেকেই। তোমার জন্মের পর আমরা তিনজন ওই ঘরে ডাবল খাটে। মোটামুটি সুখী জীবন তোমাকে পেয়ে আরো সুখী। কিন্তু কিছু কিছু রাতের দুঃসহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারি না। রাতে যখন বিদ্যুতের হাহাকার অন্ধকার গরমে আমি আর খুকী তখন দিশেহারা তোমাকে নিয়ে। তুমি একটুও গরম সহ্য করতে পারো না। হাতপাখার বাতাস দিয়ে নির্ঘুম রাত পার করেছি কখনো কখনো। তারপর একদিন খোঁজ পেয়ে চার্জ ফ্যান কিনে আনি মার্কেট থেকে। সেই চার্জ ফ্যান আসার পর অনেকটা শান্তি। যদিও দুঘন্টা পর চার্জ ফ্যানেও কাজ হতো না আর। সেই ছোট্ট ফ্যানের অল্প বাতাস তোমার ছোট্ট শরীর ছুয়ে আমাদেরও কিছু বাড়তি শীতল ছোঁয়া দিত। তুমি যখন বসতে শিখলে, খামচি দিতে শিখলে আমি তোমার খামচি খেয়ে অফিসে যেতাম, কেউ জিজ্ঞেস করলে গর্ব করে বলতাম, আমার কন্যার ভালোবাসার চিহ্ন।

তোমার প্রথম জন্মদিন ছিল অনাড়ম্বর যদিও তবু অনেক আনন্দ ছিল। কেক কেটে ছবি তুলে তুমুল আনন্দ করেছি আমরা।

কিন্তু জন্মদিনের আগেই একটা বন্যার ভয়াবহ আক্রমন আমাদের ভেঙে দেয় মানসিকভাবে। খুব বৃষ্টির এক সকালে (১১ই জুন ২০০৭ সম্ভবত) অফিসে গেলাম আধভেজা হয়ে। অফিসে পৌছানোর কিছুক্ষণ পর খুকী ফোন করলো উদ্বিগ্ন কন্ঠে। বারান্দায় পানি উঠে গেছে আমাদের। অবাক হলেও ভয় পাইনি। খানিক পরেই নেমে যাবে পানি। আমাদের কখনো বন্যা হয়নি। আশ্বাস দিয়ে ফোন কাটি। দশ মিনিট পরেই আবার ফোন। পানি বাড়ছে দ্রুত। বাসায় উঠে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। এখন কি হবে। এবার সত্যি চিন্তায় পড়লাম। বললাম, আসছি। অফিস থেকে দৌড়ে নেমে গাড়ী নিলাম। ড্রাইভারকে বললাম দ্রুত যেতে। কিন্তু বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখি আমাদের সামনের এক্সেস রোড পানিতে থৈথৈ। কোমর পানি প্রায়। গাড়ীটা আটকে গেল। আমি নেমে গেলাম। পাগলের মতো দ্রুত পা চালালাম বাসার দিকে। এত এত পানি চারদিকে। জীবনেও দেখিনি। ১৯৯১ সালেও না। ভয়াবহ একটা দৃশ্য। আমি বাসায় ঢুকে দেখি বাসায় হাটু পানি। সোফাগুলো ডুবে গেছে। দ্রুত বাড়ছে পানি। তোমার নানা আর মামা এসেছে মোতাহারাকে নিয়ে তোমাদের নিয়ে যাবে। আমি রুমে ঢুকে দেখি তুমি প্রায় ডুবন্ত খাটে বসে আছো চুপ করে। আমি তোমাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। মাথায় একটা প্লাস্টিক দিলাম তোমার। বৃষ্টি ঝরছে। কোমর পানিতে নেমে রিকশা খুঁজছি পালাবার জন্য। এই এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে এক্ষুনি। কিন্তু কোন রিকশা নিল না আমাদের। আমি ব্যর্থ হয়ে পূর্বদিকের আবদুল্লাহ স্টোরের ভেতর ঢুকে গেলাম। ওখানে এখনো পানি ওঠেনি। ওখানে ঢুকে পেছনের দরোজা দিয়ে চলে গেলাম দোতলার বাড়ীওয়ালার বাসায়। খোদেজা বেগমের বাড়ী ওটা। আমাদের প্রতিবেশী। আমাদের কাছ থেকে জায়গা কিনে বাড়ী করেছিলেন। এই প্রথম আসা বিপদের দিনে ওনাদের বাসায়। তারপর একে একে সবাইকে নিয়ে আসি ওই বাসায়। দুদিন বাসায় যেতে পারিনি, ওখানেই ছিলাম। পানি নামতে দেরী করেছে। অপূর্ব আতিথেয়তা দিয়ে আমাদের রেখেছিলেন ওনারা। ওনাদের সম্পর্কে আমাদের সমস্ত পূর্ব ধারনা মুছে গেল। মহান মানুষ দেখলাম আরেকবার।

সেই বছর আরো দুবার বন্যায় ভুগলাম আমরা। তবে প্রস্তুতি থাকায় পরের দুটোতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। আমরা ভাবছিলাম এআর প্রোপার্টিজের ফ্ল্যাটে উঠে যাবো কদিন পরেই। কটা দিন কষ্ট করি আর। কিন্তু দিন কাটে না আর। কষ্ট বাড়তেই থাকে বসবাসের। হারুন সালাম মারা গেলেন। এআর প্রোপার্টিজের সাথে চুক্তি বাতিল হলো। ফেরদৌস ভাই বললেন ওখানে আর হবে না। আমরা নতুন উপায় খুজতে লাগলাম বাড়ীটা ছাড়ার। কিন্তু কোন উপায় হচ্ছিল না। একজনের সাথে কথা হয় হয় এমন সময় এলো আরেকটা ভয়ংকর দিন। সেইদিনটা না এলে আমাদের ওই বাড়ী হয়তো এখনো ছেড়ে আসা হতো না। একদিকে সেই ঘটনাকে আমি আশীর্বাদ মনে করি।

২৯শে জানুয়ারী ২০০৮ সকালে অচেনা একটা জায়গা থেকে টেলিফোন এলো। বিশাল অংকের টাকা পরিশোধ না করলে সপরিবারে হত্যার হুমকি এলো। আমি প্রথমেই তোমার কথা ভাবলাম। বাসায় তোমরা একটা। তুমি তোমার মা দাদী ফুপু। ওরা বললো বাসা ঘিরে রেখেছে। ভয়ে আমি আধমরা। আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে কোন উপায়ে আজকেই বাসাটা বদলাতে হবে। আত্মীয়বন্ধুদের সহায়তায় আমার চাচাদের বাসায় চলে গেলাম কসমোপলিটন আবাসিক এলাকায়। বাড়ীটা বুঝিয়ে দিলাম কোরাল রীফকে। ওরা বললো টাকা পরিশোধ করবে সময়মতো। সেই আশ্বাসে বিশ্বাস করে ভুল করলেও আমার উপায় ছিল না। আমি তোমাদের বাঁচাতেই বাকী সব হারানোর ঝুঁকি নিলাম। চাচার বাসায় থাকতেই ভাড়া নিলাম খুব চমৎকার একটা ফ্ল্যাট কাজীর দেউড়ীর এসএইচ টাওয়ারে। ওখানে গিয়েই যেন পেলাম আমি আমার কাংখিত জীবন। আস্বস্ত হলাম। অন্ততঃ কিছুদিন নিরুপদ্রপ থাকতে পারবো। এই বাসায় পানি বিদ্যুত সবকিছুর ব্যবস্থা চমৎকার। খরচটা যদিও বেশী তবু আমি এখানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম যতদিন সামর্থ্যে কুলোয়।

একদিন ওখানেই খবর এলো শিহান আসছে। প্রথমে দ্বিধা ছিল। কিন্তু সব কাটিয়ে আমরা আবারো আশীর্বাদ প্রাপ্ত হলাম সেই সৌভাগ্যের। সেই একই হাসপাতালে, প্রায় একই দিনে, সেই একই ভিআইপি রুমে শিহানের জন্ম হলো। এটা আমাকে অবাক করে। ২০০৬সালে যেই রুমটাতে ওশিনের জন্ম হয়েছিল। ঠিক সেই রুমটাই যেন আবার পেয়ে গেলাম শিহানের জন্য। জুলাই মাসের পনের তারিখ তুমি এলে। তোমাকে বাসায় ফিরিয়ে নেবার পর আমাকে গতবারের মতো টেনশান করতে হয়নি গরমে কষ্ট পাবে কিনা। আমি আর কিছু পারি বা না পারি একটা সুন্দর ফ্ল্যাটে আমার পুত্রকে নিয়ে আসতে পেরেছি। আমি সেই আনন্দে, তোমাদের নিরাপত্তার আনন্দে বাকী সব কষ্ট ভুলে গেলাম। আমরা এখনো আছি সেই বাসায়। ওশিন এখন চার বছর পেরিয়েছে। তুমি কদিন পরে দেড় বছরে পড়বে। তোমাদের নিয়ে আমি দারুন সুখী। কিন্তু এই সুখী বলতে আমি ভয় পাই। আমি চারপাশের অস্থিরতা অসুস্থতা দেখে দেখে আতংকিত হই। তোমাদেরকে সুস্থভাবে বড় করে তুলতে পারবো আমি? কিংবা আমি কি বেঁচে থাকতে পারবো তোমরা বড় হয়ে নিজের পায়ে দাড়াতে পারার আগ পর্যন্ত? মানুষের সব স্বপ্ন সফল হয় না। আমার এই স্বপ্নটাও হবে না। আমি তোমাদের বড় হওয়া পুরোপুরি দেখে যেতে পারবো না হয়তো। কোন একদিন আমিও ঢলে পড়বো নিঃশব্দে কিংবা পতন হবে ভিন্ন কোন দুর্যোগে। আমি ঠিক জানি না কি হবে। কেবল আস্বস্ত হতে ভয় পাই।




আমি তোমাদের ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই তাই। সবাই যখন তোমাদের ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে উত্তমরূপে মানুষ করার পরামর্শ দেয় আমি তখন বলি, আমি কেবল আমার সুস্থ দুই সন্তানের স্বাভাবিক বড় হওয়া দেখতে চাই। আমি খুব ভালো স্কুল চাই না, খুব ভালো রেজাল্ট চাই না। আমার সন্তানকে আমি কেবল সাধারণ মানুষ হয়ে উঠতে দেখতে চাই। আজকের বিশাল ফ্ল্যাট ছেড়ে আমাকে যদি কেবল দুই ঘরের ঘুপচি বাসায় চলে যেতেও হয় তবু আমি খুশী আমার সন্তানদের সুস্থতা দেখে। তাদের সাথে কাটাবার জন্য যে দিন মাস বছরগুলো বাকী আছে আমি তাকে পরিপূর্ণ সুখে কাটাতে চাই। আমি এক নিখাদ ভালোবাসার কান্নায় ভাসতে চাই।






[আমি জানি না এই লেখাটা পড়ার মতো বয়স হতে হতে এই ওয়েবসাইট জীবিত থাকবে কিনা। কিংবা টেকনোলজি বদলে গিয়ে লেখাগুলো হারিয়ে যাবে কিনা। আমি এই সব কিছুই জানি না এই সময়ে। তবু লিখে রেখে যাচ্ছি আমার প্রবল ভালোবাসার সামান্য একটা চিহ্ন। যদি কখনো পড়ো বাবার লেখাটি]

শনিবার, ৪.০৯মি
৩০ অক্টোবর ২০১০

Monday, October 4, 2010

ফিওনা

১.
পাহাড়ের ঢালটা যেখানে কাত হয়ে নদীর দিকে নেমে গেছে ওদিকটায় কেবল বুনো জঙ্গল। হাঁটতে হাঁটতে ফিওনা ওদিকে চলে গেছে। ৭ বছরের ফুটফুটে মেয়েটি। হঠাৎ তার উল্লসিত চীৎকার - বাবা বাবা দেখে যাও, কি সুন্দর একটা ফুল এখানে!

আরিল মুখ ফিরিয়ে মেয়ের আঙুলকে অনুসরন করে কাছে গিয়ে দেখলো সত্যি চমৎকার একটা ফুল। তার এত বছরের ফুলের ব্যবসা কিন্তু কখনোই এত সুন্দর ফুল দেখেনি। ফুলটা লাল বেগুনী হলুদ এই তিনটা রঙের অপূর্ব সমন্বয়। এই বেগুনীটা ঠিক বেগুনীও নয়। কেমন অদ্ভুত উজ্জ্বল। অন্য রংগুলো ছাড়িয়ে বেগুনীটার উপর একটু বেশী আলো পড়েছে। যেন মুগ্ধতা ছড়ানোর জন্যই ফুলটির জন্ম! কাছে গিয়ে আলতো করে ফুলটিকে স্পর্শ করলো আরিল। দারুন একটা সুগন্ধী আবেশ নাকের ঠিক সামনে এসে মৌ মৌ করতে থাকে। আরিল অবাক বিস্ময়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করছে কোথায় দেখেছে আগে। নাহ্ এই গাছ আগে কোথাও দেখেনি। কোন দেশী ফুল এটা? এত সুন্দর ফুল এখানে কি করে এলো? গতকালও তো ওদিকে কোন ফুল দেখেনি।

জাত ব্যবসায়ী আরিল। ফুলটা ছুঁয়েই বুঝে গেল এই ফুলকে যত্ন করে চাষ করতে পারলে একচেটিয়া ব্যবসা হবে। ফুলের পাপড়িগুলো অর্কিডের মতো দৃঢ়। তার মানে এই ফুল দীর্ঘক্ষন তাজা থাকবে এবং সংরক্ষনের উপযোগী। ফুল ব্যবসার অন্যতম প্রধান সুযোগ হলো এই জাতীয় শক্ত ফুলগুলি। বাড়তি পাওনা এর সুগন্ধ। আরিল ভাবলো এই ফুলের চাষ করা শুরু করতে হবে। আলতো করে ফুলের চারাটা নিয়ে একটা টবের মধ্যে স্থাপন করলো। বাড়ী ফেরার পথে নিয়ে এলো টাবটাকে।

বিকেলে কফির কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে অবাক হলো আরিল। ফুলটার রং শুধুই বেগুনী এখন। আশ্চর্য। রং বদলায় এই ফুল? দিনে কয়বার বদলায় দেখতে হবে। টবটাকে বারান্দায় তুলে আনলো। রাতের বেলা আরো অবাক হয়ে দেখলো ফুলটা গাঢ় খয়েরী হয়ে গেছে। পরদিন ভোরে উঠে দেখলো ফুলটা লাল। রোদ বাড়তেই রঙ বাড়ছে। দশটার দিকে হলুদ আর লাল। দুপুরের আগে আগে লাল, হলুদ আর বেগুনীর চমৎকার একটা মিশ্রন দেখা গেল। আবার বিকেল হলে পুরোটা বেগুনী। কয়েকদিন রেখে দেখলো এক সপ্তাহেও ফুলটি পচছে না। কেবল শুকিয়ে যায়।

আরিল ভীষন আশাবাদি হলো এবার। এই ফুলের চাষ করতে পারলে সে একাই ফুল সম্রাট হয়ে যাবে দুনিয়ায়।

পাপুয়া নিউগিনির পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত মরোবি প্রদেশের প্রধানতম শহর -লেই। মাত্র লাখ দেড়েক লোকের বসবাস এই শহরে। শহরের উত্তরের উপত্যকার উল্টোদিকের ঢালে কয়েক একর জায়গা নিয়ে একটা ফুলের খামার আছে। তারপর একটা আদিম জঙ্গল। হাজারো গাছপালা ওখানে। এই উপত্যকাটার ঢালটা আরিল লীজ দিয়েছে ৯৯ বছরের জন্য। খামারের মাইল খানেক সামনে দিয়ে বয়ে গেছে একটা নদীর ধারা। দুই পাহাড়ের মাঝে বয়ে যাওয়া নদীটার মধ্যে চর জেগে আছে। ওখানে পাখির ঝাঁক নামে কোন কোন বিকেলে। দুপাশের পাহাড় চিরে বেরিয়ে সাগরে পড়েছে ধারাটা। এখানে একটা পুরোনো কাঠের বাড়ী আছে।

খামারের এই বাড়ীতেই আরিলের সপ্তাহের পাঁচদিন কাটে। স্ত্রী সুসি আর কন্যা ফিওনা থাকে নিকটস্থ শহরে। মাঝে মাঝে আরিলের কাছে এসে থাকে যখন ফিওনার স্কুল বন্ধ থাকে। বর্তমানে এই দেশের নাগরিক হলেও আদতে সে অষ্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা। পূর্বপুরুষের ভিটে অষ্ট্রেলিয়ার পার্থে। কিন্তু লেই শহরের প্রেমে পড়ে এখানেই স্থায়ী বসতি করেছে। শহরটি অপূর্ব সুন্দর। শহর ছাড়িয়ে উত্তরে গেলে যে সবুজ পর্বতমালা চোখে পড়বে তার উল্টোদিকে আরিলের খামারবাড়ী।

প্রাকৃতিকভাবেই মোরোবি প্রদেশটি বৈচিত্রময় একটা জায়গা। সবুজ পাহাড় জঙ্গলের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরের এত সুন্দর সমন্বয় এই অঞ্চলে খুব কমই আছে। কেবল এই প্রদেশেই ৭০০-১০০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে এবং ১২০০০-১৫০০০ জাতের উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। অঞ্চলটা প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের স্বর্গ বিশেষ। এত বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক উপাদানের সমাহার পৃথিবীর আর কোন এলাকায় নেই। এরকম অদ্ভুত প্রাকৃতিক বৈচিত্রের মেলায় বুনোফুলের আবিষ্কার তেমন বিস্ময়ের কিছু না হলেও আরিলকে হতবাক করলো ফুলের রঙ পরিবর্তনের ব্যাপারটা।

==================================
২.
আরিল সে রাতেই সুসিকে খুলে বললো ব্যাপারটা। সুসি ব্যবসা বোঝে না। সে স্কুলে চাকরী করে। তবু মতামত দিল এই ফুলের আবিষ্কারের কথাটা আপাততঃ গোপন রাখতে। চাষাবাদ করে রপ্তানীযোগ্য পরিমান উৎপাদন করার পরই জানান দেয়া হোক। এই ফুলের একচেটিয়া অধিকার তাদের।

ফুলটির নাম কি দেয়া যায়?

আরিল বললো, ফিওনার নামে দিলে কেমন হয়? সুসি রাজী। ঠিক হলো, ফুলটাকে 'ফিওনা' বলেই ডাকবে।

আরো এক বছর কেটে গেছে।

ফিওনার চাষ করা খুব সহজ। মাটিতে পুঁতে দিলেই হয় কোন একটা ডাল। সপ্তাহান্তেই ফুল। পুরো উপত্যকা ভরিয়ে ফেললো এই ফুল দিয়ে। সুগন্ধে মৌ মৌ সমস্ত উপত্যকা। আরিল ইতিমধ্যে তার আবিষ্কারের ঘোষনা দিয়ে এই ফুলের মালিকানা নিয়ে নিয়েছে পেটেন্ট করে। সমস্ত লেই শহরে ফিওনার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লো। এই জনপ্রিয়তা পোর্ট মোর্সবি ছাড়িয়ে অষ্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডেও ছড়িয়ে গেল। সারা দুনিয়া লেই শহরকে ফিওনা সিটি ডাকতে শুরু করেছে।

লেই শহর ১৯৩৭ সালের পর আর কখনো বিশ্বমিডিয়ায় এতটা খ্যাতি পায়নি। ১৯৩৭ সালে বিশ্বখ্যাত পাইলট এমেলিয়া ইয়ারহার্টের রহস্যময় নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছিল লেই এয়ারপোর্ট থেকে ওড়ার পরেই। আমেরিকান নাগরিক এমেলিয়া মহিলা পাইলটদের কিংবদন্তী। যিনি বিমানের সেই আদিম যুগে বিশ্বভ্রমন করতে চেয়েছিলেন লকহীড কোম্পানীর তৈরী ছোট্ট একটা বিমান নিয়ে। এমেলিয়া প্রথম মহিলা বৈমানিক যিনি একা আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিল আকাশপথে। সেই এমেলিয়া ছিল আরিলের নানীর প্রিয় বান্ধবী। লেই শহরে বসতি স্থাপন করার পেছনে আরিলের মায়ের মুখে শোনা এমেলিয়ার গল্পটাও কাজ করেছিল। এমেলিয়া নিখোঁজ রহস্য নিয়ে সে বেশ কিছুদিন গবেষনাও করেছিল। জাপানিদের কোন হাত ছিল কিনা সেটা খুঁজতে খুঁজতে করতে গিয়ে এই খামারের জায়গাটা আবিষ্কার করে, সাথে কাঠের এই বাড়ীটাও। পছন্দ হলো, আর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো এখানে বপন করবে ছোট্ট একটা স্বপ্নের বীজ। এমেলিয়া রহস্য উদঘাটন করা হলো না তার।

কিন্তু সেই স্বপ্নটা যে এত বড় মহীরূহ হয়ে যাবে সেটা কল্পনাও করেনি। সবগুলো দুই বছরে আরিলের আয় দুই কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেল। বাগানে আর কোন ফুল নেই। কয়েকশো একর জায়গা জুড়ে কেবল ফুল আর ফুল। ফিওনার রাজত্ব উপত্যকা জুড়ে। যেন কেউ এক চিলতে স্বর্গের চাদরে ঢেকে দিয়েছে এলাকাটা। ফুল রপ্তানী করলেও ভুলেও সেই ফুলের চারা বা ডালপালা বেচে না কারো কাছে ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে।

দুবছর নির্বিঘ্নে যাবার পর তৃতীয় বছর ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটলো। এক রাতে আরিল খামারবাড়ীর অন্ধকার বারান্দায় বসে দুরে বয়ে যাওয়া নদীর দিকে তাকিয়ে আনমনে পাইপ টানছিল। হঠাৎ খেয়াল করলো বাগান থেকে ক্ষুদে একটা আলোকরশ্মি সুতোর মতো আকাশের সাথে সেতু রচনা করেছে। বেগুনী রঙটা ঠিক যেন তার বাগানের ফুলের রঙ। এরকম অদ্ভুত ঘটনা আগে দেখেনি। আলোর উৎস খোঁজার জন্য বাগানে নামলো আরিল। ঢাল বেয়ে কাছাকাছি যেতেই আলোটা অদৃশ্য হয়ে গেল। যেখান থেকে আলোটা উৎসরিত হচ্ছিল সেই জায়গাটা চিহ্নিত করে রাখলো।

পরদিন সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে আরিল বাগানে গেল। ওই জায়গায় গিয়ে কোন সুত্র পাওয়া যায় কিনা দেখলো। কিচ্ছু নেই। ফুলগুলি রক্তলাল হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আরিল ভাবলো রাতে ভুল দেখলো কিনা।

কয়েকদিন পর একই দৃশ্য আবারো। এইবার উত্তরপূর্ব কোনে। এবার একটি নয়, তিন চারটি আলোর সুতো আকাশ ছুঁয়েছে। আরিলের মাথায় ঢুকছে না, কি ওই আলোর উৎস। ভুতপ্রেতে বিশ্বাসী নয় সে। এবারো কাছে যেতেই নিভে গেল সুতোগুলি। কাউকে বললো না ঘটনাটি। চেপে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু চিহ্নিত করে রাখলো জায়গাটা।

মাসখানেক পর এক রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার ফিসফিস শব্দে। ঝড়ো বাতাসের মতো হিসহসানি। বাইরে কি ঝড় হচ্ছে নাকি? জানালা খুললো আরিল। না সেরকম কিছু নেই। তাহলে শব্দের উৎস কী? হঠাৎ ডানদিকের জঙ্গলে চোখ যেতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো তার। ওখানে বিশাল ঘন এক জঙ্গল ছিল প্রাচীন সব বৃক্ষের মেলা। ওই বিশাল বিশাল গাছগুলো প্রচন্ডবেগে দুলছে। দুলতে দুলতে প্রায় মাটির সাথে শুয়ে পড়ছে। আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। অত মোটা গাছ কি করে নুইয়ে যায় এরকম। এবার সত্যি সত্যি ভয় পেল আরিল। সুসি আর ফিওনা শহরে। ফোন করে জাগালো সুসিকে। বললো ভয়ানক কিছু ঘটছে এখানে। দৃশ্যটার বর্ননা দিয়ে ফোন কেটে দিল।

সুসি ফোনটা নামিয়ে রেখে চিন্তিত হয়ে ভাবছে কার কাছে বলা যায় ব্যাপারটা। ঘুমন্ত ফিওনার দিকে তাকালো। তারপর তাকালো ঘরের কোনে রাখা ফিওনা ফুলের টবের দিকে। আশ্চর্য! ফুলটা লাল হয়ে আছে কেন? এইসময় তো ওর কালচে খয়েরী থাকার কথা। ফিওনা টেলিফোন নিয়ে পরিচিত সিটি কাউন্সিলর ফোন ডায়াল করলো। আশ্চর্য ফোন যাচ্ছে না। মোবাইল ফোনে ধরলো। মোবাইলে দেখালো নেটওয়ার্ক বিজি। আসলে আরিল তখন ফোন রাখার আগেই লাইনটা কেটে গিয়েছিল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ লাইনটা জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। ওরা দুজনেই বোঝেনি জ্যাম হলো কেন।

ঘুমন্ত লেই শহরের কেউ জানলো না উপত্যকা থেকে লক্ষ কোটি আলোর সুতো মহাকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছে। কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সবরকম যোগাযোগ বন্ধ ছিল কয়েক মিনিট। না মোবাইল, না টেলিভিশন, না রেডিও।

আরিল ঘরে ঢুকে আবারো ফোন করার চেষ্টা করলো অন্য বন্ধুবান্ধবকে। কিন্তু কিছুতেই গেল না ফোনটা। নেটওয়ার্কের এরকম সমস্যা আর কখনো হয়নি।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। ভোরে পাখপাখালির ডাকে ঘুম ভাঙলো। দৌড়ে জানালার কাছে গেল। এই দৃশ্যের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে।

সম্মুখের উপত্যকা জুড়ে ফিওনা ফুলের বাগান ছিল গতরাত পর্যন্তও। আজ একটা ফিওনা ফুলের অস্তিত্বও নেই। সমস্ত উপত্যকা ধবধবে সাদা। যেন তুষারে ঢেকে দিয়েছে কেউ। ভীত হয়ে আরিল ফোন করলো সুসিকে। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না।

ধরবে কি করে? রাত ভোর হবার আগে সুসির ঘুম ভাঙলে সুসি দেখতে পায় ফিওনার টবটা যেখানে রাখা ছিল, সেখান থেকে বেগুনী সুতোর আলোক রশ্মি জানালা দিয়ে দুর আকাশে ছুটে যাচ্ছে। ওটা দেখেই সুসি যে জ্ঞান হারালো, এখনো ফেরেনি।

পাশের ঘরে ফিওনার ঘুম ভেঙ্গে গেল ফোনের শব্দে। গুটিগুটি পায়ে মার কাছে এসে ডাকলো, "মা ওঠো, বাবা ফোন করেছে"। মার ঘুম ভাঙছে না দেখে ফিওনা নিজেই মোবাইল হাতে নিয়ে বাবার সাথে কথা বললো।

"ফিওনা, তোমার মায়ের ঘরের কোনে যে ফুলের টবটা আছে ওটা ঠিক আছে কিনা দেখো তো?"
"বাবা, ফুলতো নাই, ওখানে সাদা পাউডার পড়ে আছে।"

আরিলের হাত থেকে ফোনটা পড়ে যাবার দশা হলো। বললো, "তোমার মাকে ডেকে তোলো তাড়াতাড়ি। ওই টবটা বাইরে ফেলে দিতে বলো এক্ষুনি।"

নার্ভাস আরিল মোবাইল ফোনটা রাখতে না রাখতে ঘরের কোনে রাখা ল্যান্ডফোনটা বাজতে শুরু করে। ভীত চোখে ফোনের দিকে তাকালো। সারা দুনিয়া থেকে আরিলের কাছে ফোন আসবে এখন। সবগুলো বিক্রিত ফুলই নিশ্চয়ই পাউডার হয়ে গেছে। যেখানে যেখানে এই ফুল রপ্তানী করা হয়েছে অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা, প্যারিস, লন্ডন........সবগুলো নিশ্চয়ই এখন সাদা পাউডার।

ক্রেতারা টাকা ফেরত চাইতে আসবে, দেউলিয়া মামলা হবে, আরিল সর্বশান্ত হয়ে যাবে.....কল্পনা এগোলো না আর। বেলা বাড়তে বাড়তে এসব ঘটনার সুত্রপাত হবে। তার আগেই পালাতে হবে। ছোট একটা ব্যাগে মূল্যবান সবকিছু ভরে নিয়ে বাইরে দাঁড়ানো জীপটাতে উঠে ষ্টার্ট দিয়ে শেষবারের মতো বাগানটার দিকে তাকালো।

গাড়ী চালাতে চালাতে সুসিকে ফোন দিল আবার। জ্ঞান ফিরেছে সুসির। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে কি যেন বলতে চাইলে থামিয়ে দিয়ে সংক্ষেপে পুরো ব্যাপারটা বোঝালো। সবশেষে বললো, "কান্নাকাটি করার সময় অনেক পাবে। এখন ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ো। ডোমেষ্টিক ফ্লাইটে চলে যাও পোর্ট মোর্সবি, তারপর ওখান থেকে পরদিন পার্থের ফ্লাইট ধরবে। কেউ খোঁজ শুরু করার আগেই। কাউকে কিচ্ছু বলবে না। আমি কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করো না। কয়েকমাস দেখা হবে না আমাদের। পার্থে তোমার ভালো থাকবে।

মাথা ঠান্ডা করে সুসি পরিস্থিতি আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। ওদের এত আদরের চাষ করা ফুল পাউডার হয়ে গেছে, ফুল থেকে বেগুনী রশ্মি বেরিয়ে আকাশের দিকে ছুটে গেছে ওই রহস্য উদঘাটন পরে হলেও চলবে। আগে পাওনাদারের আক্রমন থেকে বাঁচতে হবে।

পিএনজি এয়ারলাইন্সের নাম্বারে ফোন করে দুটো টিকেটের বুকিং দিল লেই থেকে পোর্ট মোর্সবি পর্যন্ত। দুপুরের পর একটা ফ্লাইট আছে। প্রিয় ঘরটা আর ফিরে পাবে কিনা ভেবে কষ্ট লাগলেও চেপে রাখলো। ফিওনা আরো বেশী কষ্ট পাবে। এই শহরের সবকিছু প্রিয় তার। গাড়ী ছুটছে নাজ্জাব এয়ারপোর্টের দিকে।

আরিল গাড়ীটা একটা নিকটস্থ আশ্রয়ে রেখে তার নিজস্ব বোটটি নিয়ে মারকাম নদীর উজানের দিকে রওনা দিল। ওখান থেকে ইউফিন নদী ধরে পুবদিকে দশ মাইল মতো গেলে পর্বতের মধ্যে তার একটা নিরাপদ হাইডআউট আছে। নির্জনে বসে পাখীর গান শোনার জন্য বানিয়েছিল ঘরটি অনেকদিন আগে। ওখানে কেউ খুঁজে পাবে না তাকে। সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন একটা জায়গা। মরোবি প্রদেশের সবচে ঘন জঙ্গলাকীর্ণ স্থান। এরকম দুর্দিনে কাজে লাগবে ভাবেনি।


=================================

৩.
বহু দুরবর্তী গ্যালাক্সির 'নিউক' গ্রহের আদি বাসিন্দা 'সেল' সমাজের নমুনা সভা বসেছে। মহাবিশ্বের কোথায় কোথায় সেলদের বসতি আছে তা আবিষ্কার করতে গিয়ে ওদের একটি নবীন গবেষক সেল সম্পূর্ণ নতুন জাতের এক আজব জীবের সন্ধান পেয়েছে। তার গবেষণা রিপোর্টের সৌজন্যেই আজকের সভা।

ওদের নিজেদের গ্যালাক্সির মধ্যে দুশো পঁচিশটা 'সেল-বাস-যোগ্য' গ্রহ আছে। তার মধ্যে নিউক হলো সবচেয়ে বড় এবং আদিম। 'সেল' উদ্ভিদ প্রজাতির জীব হলেও জীব-জড় উভয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তার মধ্যে। তাদের নিউক্লিয়াসে ইলেক্ট্রনের মতো এক উপাদান আছে যা থেকে শক্তিশালী রশ্মি উৎপন্ন হয়। এটাই সেলদের সকল শক্তির আধার। এদের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো দুর্দান্ত অভিযোজন ক্ষমতা, আলোর চেয়েও দ্রুত ছুটবার যোগ্যতা এবং যে কোন ধরনের জীবের সাথে যোগাযোগ করার দক্ষতা।

গ্যালাক্সি ব্যাপী ছোটাছুটি করার জন্য পুরো শরীর নিয়ে ভ্রমণ করতে হয় না তাদের। শরীরের যে কোন একটা সেলকে সেই রশ্মি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে ছুঁড়ে দেয়া হয়। গন্তব্যে পৌঁছেই অতি ক্ষুদ্রতম সেলটি দ্রুততম সময়ে পূর্নাঙ্গ শরীর নিয়ে বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে যেতে পারে সেখানে। এই ক্ষমতা অর্জন করেছে কোটি বছরের বিবর্তনের ফসল হিসেবে। ধারনা করা হয় এদের পূর্বপুরুষ একসময় সাধারন বৃক্ষই ছিল।

বক্তা সেলটি শুরু করলোঃ

"উপস্থিত সেল সমাজ, দীর্ঘ দুই লগ (পৃথিবীর হিসেবে দুই বছর) ধরে খুঁজতে খুঁজতে নতুন যে গ্রহটি আবিষ্কার করেছি সেখানে লুকিয়ে আছে এক অপার বিস্ময়। এতদিন আমরা জানতাম মহাবিশ্বের মধ্যে সেল বাদে অন্য কোন জাতের জীব নেই। কিন্তু সেল প্রজাতির পাশাপাশি সেই গ্রহে পাওয়া গেছে নতুন এক প্রজাতি। প্রাণী বলে পরিচিত সেই আজব জীবদের বৈশিষ্ট আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। বহু জাতের প্রাণী থাকলেও আজ আমাদের সভার মূল বিষয় সেই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ। এরা আকারে তেমন বড় না হলেও প্রযুক্তি জ্ঞানের কারণে ওই গ্রহের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে।

" নতুন প্রজাতির জীবের সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো ওদের খাদ্য গ্রহন এবং বর্জ্য ত্যাগ। অদ্ভুত সব কাজ কারবার তাদের। ওরা আহার করে শরীরের একটা গর্ত দিয়ে, আবার অন্য একটা গর্ত দিয়ে খাবারগুলো পঁচিয়ে বের করে দেয়। এরকম আজিব কান্ডের পেছনে কি যুক্তি থাকতে পারে আমি বুঝিনি।

"সেখানে অনেক জাতের প্রাণী থাকলেও যে দলটা মানুষ নামে যারা পরিচিত, তাদের হাতেই ওই গ্রহের নিয়ন্ত্রণ। তারা পুরো গ্রহে সবচেয়ে শক্তিমান ও বুদ্ধিমান প্রাণী। তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। কিন্তু গবেষণা করতে গিয়ে ওই গ্রহের উদ্ভিদ সেল সমাজের অবস্থা সম্পর্কে যা জানলাম তা খুবই দুঃখজনক। মানুষের দল সভ্যতার নামে, প্রযুক্তির নামে, শিল্পায়নের নামে, আরো নানা বাহানায় সেল সমাজের উপর আঘাত হেনে চলেছে বহু যুগ ধরে। বায়ুমন্ডলে কালো কালো ধোঁয়া ছেড়ে সেল সমাজের আহারের মধ্যে ধ্বংসাত্মক উপাদান ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সেলরা যেখানে বসতি করতো সেখানকার মাটিকে সেল শূন্য করে তাদের ভিটেয় ঘুঘু চরাচ্ছে।

"আপনারা জানেন সেল সমাজই মহাবিশ্বের মালিক, কিন্তু মানুষ নামের ওই নোংরা জীব ছোট্ট ওই গ্রহে সেল সমাজের উপর যে অত্যাচার করছে তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
মানুষের সমাজ একদিকে আমাদের স্বজাতির কিছু সেলকে বন্দী করে ব্যবহার করছে দাসের মতো, যথেচ্ছ কাজে লাগাচ্ছে তাদের খাদ্য বাসস্থান ইত্যাদির জন্য, আবার তাদের হাতেই ধ্বংস হচ্ছে অন্যান্য সেল প্রজাতি। সংখ্যায় সেল গণ অনেক বেশী হলেও সেলদের কোন কতৃত্ব নেই ওই গ্রহে।

"মানুষ নামের নোংরা প্রাণীদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতে না পারার মূল কারণ তাদের প্রযুক্তিজ্ঞানহীনতা। এই উত্তরাধূনিক যুগেও ওখানকার উদ্ভিদ সেলগুলো আমাদের কোটি বছর আগের পূর্বপুরুষের মতো নির্বোধ রয়ে গেছে। তাদের প্রযুক্তিজ্ঞান একেবারে শূণ্যের কোটায়। একটা উদ্ভিদ সেলকে কেটেকুটে জ্বালিয়ে দিলেও বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়তে পারে না।

"এই জগতে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো যোগাযোগ রশ্মি। যা দিয়ে আমরা নিমেষেই বিশ্বের যে কোন জায়গায় যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি। আমাদের সে কোন সেলকে যে কোন দুরত্বে নিয়ে স্থাপন করতে পারি। এই সুবিধাটা ওদের কারো নেই। ওরা জানেই না এরকম কোন ব্যবস্থা থাকতে পারে। যা কিছু প্রযুক্তি আছে তা মানব সমাজের দখলে। তবে মানুষেরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ করে ওদের সভ্যতার শীর্ষে উঠেছে বলে দাবী করে তা দিয়ে আমাদের কাছে হাস্যকর। তারা উদ্ভিদ সেলদের মতো স্থির নয়। ক্রমাগত নড়াচড়া করতে হয় তাদের। ভ্রমন করার জন্য ওরা নিজেদের আস্ত শরীরকে তো নেয়ই, সাথে আরো বিশাল যন্ত্র বহন করে। যাকে ওরা জাহাজ, গাড়ী, বিমান এরকম বিদঘুটে নামে ডাকে।

"ওদের সর্বোচ্চ গতির যন্ত্রের(রকেট) গতি দেখলে আপনি হাসতে হাসতে খুন হবেন। তাছাড়া ওই বিশাল যন্ত্রগুলোকে ভুমি থেকে আকাশে ভাসাতে এমন ভীষন ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করতে হয়, এত আগুন পোড়াতে হয় যে তাতে কয়েক কোটি সেল পুড়ে যাবে। ওরকম হাস্যকর জিনিস নিয়ে ওরা নাকি গ্রহে গ্রহে বিচরন করবে। মজার ব্যাপার হলো নিকটস্থ নক্ষত্রে পৌঁছাতেও তাদের কয়েক লক্ষ বছর লেগে যাবে। অথচ ওদের গড় আয়ু মাত্র ৭০ লগ(বছর)। তাদের নক্ষত্র ভ্রমণ অনেক দূরের অসম্ভব স্বপ্ন। আমাদের জগত নিয়ে কল্পকাহিনী লেখার মগজও নেই ওদের।

"যাক সেকথা, ওখানকার সেল সমাজের কথায় ফিরে আসি। এত অনাচার সত্ত্বেও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা একটা উদ্ভিদ সেল অন্যটাকে সাহায্য করতে পারে না। বহু বছর ধরেই চলছে এমন দশা। ওরা দেখতে পায় নিজেদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া, কিন্তু প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠার কোন ভাষা জানা নেই। আমার দুই বছরের গবেষণায় আমি চেষ্টা করছি তাদেরকে কোন একটা রাস্তা খুঁজে দিতে যাতে তারা নিজেদের ধ্বংস ঠেকিয়ে দুষ্ট প্রাণীদের হাত থেকে গ্রহটাকে রক্ষা করতে পারে। এটা আমাদের আন্তঃনীহারিকা সেল সমিতির অঙ্গীকারও বটে।

"আমি যোগাযোগ রশ্মির মাধ্যমে আমার একটা সেল ওদের ভুমিতে পুঁতে দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য আরো বিস্তারিত জ্ঞানলাভ করা ওই গ্রহের বিভিন্ন বিষয়ে। যেখানে আমি পুঁতেছিলাম, সেই প্রাণীটা সেল চাষ করে। রঙিন সেলদের বন্দি করে কুপিয়ে হাত পা কেটে নানান জায়গায় চালান করে। ওরকম অদ্ভুত খেয়াল কেন প্রথমে বুঝতে পারিনি আমি। পরে জেনেছি ওই প্রক্রিয়াটাকে ওরা বলে বানিজ্য। সেই প্রাণীটা আমার সেলকেও বন্দি করে। আমি চাইলে তখুনি চলে আসতে পারতাম। কিন্তু আসিনি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। সেলগণ নিজেদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে পারে। আমরা চাইলে আমাদের বৃদ্ধিকে নিজেরাই নিয়ন্ত্রন করতে পারি। আমাকে বন্দী করার পর মানুষটা আমার কাছ থেকে আরো সেল আশা করে। আমি আরো সেল বাড়ালাম। সেলগুলো খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেলে তাকে বাণিজ্যে উৎসাহ দিল।

"মানুষটা আমার বর্ধিত সেলগুলোর হাত পা মুন্ডু কেটে বস্তাবন্দী করে নানা জায়গায় পাঠালো। ব্যাপারটা আমার জন্য ভালো হয়েছে। আমার সুযোগ হলো সমস্ত গ্রহের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ার। আমি জানলাম পুরো গ্রহের প্রাণী জগতের বিচিত্র সব তথ্য। মোটামুটি দুই বছর পর্যবেক্ষণের পর আমি সেল ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিলাম। নিউকের কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশ নিয়ে যাবার জন্য এক রাতে আমার সবগুলো সেলকে উপড়ে নিয়ে চলে এলাম।

"ইতিমধ্যে যা জেনেছি তাতে মনে হয়েছে মানুষ নামক প্রাণীটা সেল সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পুরো গ্রহের সেল সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এই মানুষের দল। তাই নিউকের অনুমতি নিয়ে আমি আবার মাঠে নামতে চাই সেল সমাজকে রক্ষা করার জন্য। আমি এখানকার সমাজকল্যাণ সেল প্রধানকে অনুরোধ করবো আমার জন্য কয়েক লক্ষ শক্তিমান সেল বরাদ্দ করা হোক পৃথিবীকে লক্ষ্য করে নতুন প্রজাতি নিক্ষেপ করার জন্য। প্রতিটি ভূখন্ডে সেলগুলো ছড়িয়ে দেয়া হবে যারা এক বছরের মধ্যেই সারা পৃথিবীর সমস্ত সেলগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে এবং অনিষ্টকর প্রাণীদের বিরুদ্ধে একশানে যাবে।

"অশুভদের হাত থেকে, নষ্টদের হাত থেকে বিশ্বকে মুক্ত রাখার অঙ্গীকার করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।"



=============================================

৪.
যে বক্তা তার বক্তব্য শেষ করলো তার একটি নাম সেল-ফিওনা। বক্তব্য শেষ হতে না হতেই উপস্থিত সেলদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। ভিন্ন জগতের সেল সমাজের অপমানে ক্ষেপে উঠে কেউ কেউ তক্ষুনি যুদ্ধযাত্রা করতে চাইল। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় শহীদ হবার বাসনা প্রকাশ করলো। সভাপতি নিউক লাল রশ্মি জ্বালিয়ে চুপ থাকার সিগন্যাল দিল। সবাই চুপ করলো। মহামান্য নিউক তার বক্তব্যে বললোঃ

"আমাদের ক্ষুদে সেল-ফিওনা যে আবিষ্কার করেছে সেটা তার জন্য বিরল সম্মানস্বরূপ সে নিজের জন্য একটা নাম অর্জন করলো। এর আগে এই গ্যালাক্সীতে মাত্র ২২৫ জন এই সম্মান পেয়েছে। সেল সমাজের জন্য উপকারী একটা কাজ করেছে তার গবেষনা ও প্রতিকারের উপায় বলে। কিন্তু আমাদের কয়েকটা জিনিস মনে রাখতে হবে। এখুনি আমরা এমন কিছু করতে পারি না যাতে ওই গ্রহের শাসক প্রানীদের ক্ষেপিয়ে দেয়। আমাদের কোন পরিকল্পনা টের পেলে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে ওই প্রাণীরা। তাতে করে নিরস্ত্র সেল ভায়েরা বেঘোরে মারা পড়বে। তাই ভয় ভীতিজনিত কোন কাজ করা যাবে না। বরং আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে।

"ফিওনার রিপোর্ট দেখে ওই জীবদের সম্পর্কে অনেককিছু জানা গেলেও একটা ব্যাপার বোঝা যায়নি। ওরা আহার করে আবার সেই আহারকে পচিয়ে পরিত্যাগ করে কেন। এতে তাদের কি উপকার হয়। আমরা সেল সমাজ যে খাবার গ্রহন করি তার পুরোটাই শরীর গঠনে ব্যয় করি। কিন্তু কিম্ভুতাকার প্রাণী সমাজ তা করে না। সেল সমাজের জন্য ওটা অস্বাভাবিক নোংরা একটা ব্যাপার। তবে ওই প্রক্রিয়ার পুরো চক্রটা জানতে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি করে ওই জীবগুলোকে ধ্বংস করা যাবে। তাছাড়া আরো জানা গেছে কেবলমাত্র এক জাতের প্রাণীর উৎপাতেই অতিষ্ট পুরো সেল সমাজ। মানুষ নামের ওই প্রজাতিকে ধ্বংস করতে পারলেই চলবে আমাদের। বাকী প্রাণীদের হাতে ক্ষতিকর কোন প্রযুক্তি দেখা যায়নি। আমি ফিওনাকে আরো এক লগ সময় দিলাম মানুষের বিস্তারিত জীবন চক্র জেনে নেয়ার জন্য।"

ফিওনা সানন্দে রাজী হলো। "মাননীয় নিউক। আপনার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। যথাসময়ে রিপোর্ট দেয়া হবে।"

পরের এক লগ ফিওনা ব্যস্ত রইল পৃথিবীর প্রাণীজগতের জীবন চক্র পর্যবেক্ষন ও পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে।

*******************************************************

ফিওনার মন খারাপ। আজ কয়েক মাস বাবাকে ছেড়ে পার্থে দাদার বাড়ীতে উঠেছে মাকে নিয়ে। এখানে সবকিছু আছে, তবু তার শূন্যতা কোথাও।

তার দশম জন্মবার্ষিকী পালন করা হলো কোন আয়োজন ছাড়াই। বাবা থাকলে কতো মজা হতো! বাবা এখন কোথায়? ফিওনা ফুলগুলো কোথায় উধাও হয়ে গেল। প্রথম দেখার পর থেকে ফুলটা সাথে কেমন এক বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। বাগানে গিয়ে বিড়বিড় করে কথা বলতো ফুলগুলোর সাথে। ওরাও দুলে দুলে জবাব দিত। গান শোনালে গানের ফিরতি জবাব দিত। কিন্তু কেউ শুনতো না।

ফিওনার মনে হতো সে আজগুবি চিন্তা করছে।
ফুলেরা কি কথা বলতে পারে?

কিন্তু তাহলে ফুলগুলো তাকে ডাকছে মনে হতো কেন মাঝে মাঝে। লুকিয়ে কাঁদে ফিওনা সেই হারানো ফুলের জন্য।

মা বলেন ওগুলো অশুভ ফুল, ওদের জন্য কাঁদতে নেই।

*****************************************************

৫.

গবেষণা শেষে সেল-ফিওনা বিস্ময়কর কিছু তথ্য পেল। আবার নতুন রিপোর্ট দিল।

"পৃথিবীর প্রাণীকূল শরীরের বৃদ্ধি ও জীবন ধারনের জন্য নির্ভর করে যেসব খাদ্যের উপর তার পুরোটাই সেল সমাজের অবদান। কয়েক লক্ষ জীবের মধ্যে মাত্র একটা জীব পুরো গ্রহের অধিকাংশ খাদ্য ভক্ষন করে। বাকী প্রাণীকে ওই মানুষের আহার্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে হয়। শাসক জীবেরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে দাবী করলেও তাদের কর্মান্ডগুলো সেল সমাজ তো বটেই অন্যন্য প্রাণীদের জন্যও ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয়েছে। আমি আরো কয়েক জাতের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করেছি, জানতে পেরেছি মানব সমাজের ধ্বংসের ব্যাপারে ওদের সানন্দ সম্মতি আছে।

মানুষেরা খাদ্যের জন্য ধান গম ভুট্টা ইত্যাদি নানান জাতের সেলের চাষ করে। ওইসব উদ্ভিদের নিজেদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নাই। যাকে যে খোয়াড়ে চাষ করা হয় তাকে সেই খোয়াড়ে থাকতে হয়। মানুষ সেল সমাজের উপর যেরকম অত্যাচার করে, তেমনি অন্যান্য কিছু প্রাণীকেও সেরকম অত্যাচার করে তাদেরকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। কেবল খাদ্য নয়, ওদের পোষাক নামক একরকম বস্তু শরীরের উপর পেঁচিয়ে পরতে হয়। নইলে নাকি ইজ্জত থাকে না। ওই পোষাক বস্তুও উৎপাদিত হয় সেল ও প্রাণী সমাজের একাংশ থেকে। শাসক জীবগন সেল সমাজের উপর এত নির্ভর করার পরও কৃতজ্ঞতা বলে কিছু দেখায় তো না, বরং তারা সেলদের উপর স্বেচ্ছাচারী কায়দায় অত্যাচার করে। কাজ শেষ হলে ওই এলাকার সেল সমাজকে নির্বংশ করে দেয় নির্বিচারে জ্বালিয়ে কিংবা মাড়িয়ে।

"আগেই বলা হয়েছে সেল সমাজের প্রধান দুর্বলতা ওদের যোগাযোগ অক্ষমতা ও প্রযুক্তি বিস্তার। কয়েক লক্ষ লগ পূর্বে এখানে সেল সমাজ যেরকম অক্ষম ও দুর্বল ছিল, বর্তমানে পৃথিবীর সেল সমাজ সেই আদিম দুর্বলতার ভেতর রয়ে গেছে। এই দুর্বলতা কাটিয়ে প্রযুক্তির বিবর্তনে সামিল হতে পৃথিবীর সেল সমাজেরও কয়েক লক্ষ বছর টিকে থাকতে হবে। কিন্তু মানুষ নামের নোংরা প্রাণীদের অত্যাচারে সেল সমাজ বিলুপ্ত হয়ে যাবে কয়েক হাজার লগের মধ্যে। সুতরাং যা করার এখুনি করতে চাই।"

ফিওনা তার বক্তব্যের প্রথমাংশ শেষ করলো।

চিন্তিত কন্ঠে নিউক জানালো, "হুমমম....এখুনি করতে হবে? কি করত চাও তুমি?"।

ফিওনা বললো, "উপায় আমার আছে। আমি তিনটা বিকল্প রাস্তার কথা ভেবেছি। আপনি অনুমতি দিলেই বলতে পারি।"

নিউক বললো, "তোমার প্রস্তাব বলো।"

ফিওনা আবার শুরু করলো।

"১. পৃথিবীতে সেল সমাজকে প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে সর্বপ্রথমে। মানুষের কুটচালে প্রচুর প্রজাতির সেল মানব প্রদত্ত খাদ্যের উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। কৃত্রিম খাদ্য সেল সমাজের জীবনক্রিয়াকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ করলেও তারা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিচ্ছে। নয়তো তাদের মৃত্যু অনিবার্য। দুঃখজনকভাবে কিছু কিছু সেল নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ ও অন্যন্য জীব নিসৃত ঘৃণিত বর্জ্যের উপর। সেই নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে বিকল্প খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। বিকল্প খাদ্যের প্রতি মনোযোগী করার জন্য সেল সমাজে আমাদের জেনেটিক কোড প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। ওই গ্রহের বায়ুমন্ডলে পরিবর্তন আনা ছাড়া খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা যাবে না। প্রযুক্তির আওতায় আনলে মানুষের উপর নিজেরাই আঘাত হানতে পারবে।

"২. ওদের বায়ুমন্ডলে ২১% অক্সিজেনকে বাড়িয়ে ২৩% করে দিতে হবে। তাহলে ওই আবহাওয়ায় মানুষ বা অন্য কোন প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে না। বেঁচে থাকবে কেবল আমাদের সেল সমাজ। সেল সমাজকে পরিবর্তিত বায়ুমন্ডলে টিকে থাকার মতো সেল দিয়ে অভিযোজিত করে রাখা হবে। কাজটা সুক্ষ্ণ এবং সময়সাপেক্ষ। পৃথিবীতে যতটা সেল জীবিত আছে তার নির্ভুল তালিকা করে, তাদের নির্ভুল অবস্থান নির্ণয় করে প্রত্যেকের জন্য একেকটি পূর্নাঙ্গ সেল বরাদ্দ করতে হবে। ওখানকার একেকটি বৃক্ষের মধ্যে লক্ষকোটি সেল আছে। তার মধ্যে যে কোন একটা সেলকে বদলে দিতে হবে আমাদের নতুন প্রতিরক্ষা সেল দিয়ে। নতুন সেলগুলোকে প্রোগ্রাম করে দিতে হবে যাতে ওই বৃক্ষকে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে।

"৩. মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করবে আত্মনিবেদিত সেল সমাজ। ওদের সকল খাদ্যের ভেতর সুক্ষ্ণ ধ্বংসাত্মক সেলকে প্রতিস্থাপন করা হবে। পৃথিবীর সবগুলো উদ্ভিদ যেদিন আমাদের সেলের আওতায় আসবে সেদিন আমরা বিজয়ের পথে হাঁটবো। হয়তো কোটি কোটি সেলের বিনাশ ঘটবে। কিন্তু তার বিনিময়ে গ্রহটি হবে সবুজ সুন্দর এবং গ্রহটি হবে আমাদের।"

ফিওনা তার বক্তব্য শেষ করলো। নিউক দুটি নীল রশ্মি জ্বালালো আকাশের দিকে। তার মানে তার ভাবতে হবে আরো।

বেশ অনেকক্ষন ভাবার পর প্রথম দুটো প্রস্তাবকে নাকচ করে দিল। প্রথম প্রস্তাবে ওই সেল সমাজের ভেতর আমাদের জেনেটিক কোড প্রবেশ করিয়ে বুদ্ধিমান করে তুললে তাদের সাথে আমাদের সেলের সংঘাত লেগে যেতে পারে গ্রহের দখল নিয়ে। জেনেটিক কোড বদলানো বহুত ঝক্কির কাজ।

দ্বিতীয় প্রস্তাবও অনেক ব্যয়বহুল। এত কোটি সেল বরাদ্দ করা সম্ভব নয়। কারন পুরোটাই অপচয় হবে। তাছাড়া তাতে করে অন্য নিরীহ প্রাণীগুলো মারা পড়বে। আমরা তো কেবল একটা প্রজাতি ধ্বংস করতে চাই।

সব হিসেব করে দেখলে তৃতীয় প্রস্তাবটিই গ্রহনযোগ্য মনে হয়। কারন ওতে খুব বেশী সেল খরচ হবে না। মাত্র কয়েকটা শস্যের সেল বদলে দিলেই হবে। দ্রুত বাড়িয়ে দেয়া যাবে উৎপাদন। এটা গ্রহন করা যেতে পারে। বেগুনী রশ্মি দিয়ে সম্মতি জানালো নিউক।

নিউকের সম্মতি পাবার পর ফিওনা বললো. "তবে একটা কথা আছে আমার।"
"কি কথা?" নিউক জিজ্ঞেস করলো।
"ওই গ্রহের সব মানুষ ধ্বংস হয়ে গেলেও আমি একটা পরিবারকে বাঁচাতে চাই।"
"কাকে?" নিউক অবাক একটু।
"ফিওনার পরিবারকে।"
"ফিওনা?"
"সেই একমাত্র প্রাণী যাকে প্রথম নেমেই মুগ্ধ হয়ে দেখেছি, সেও আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে। সেই প্রথম মুগ্ধতার ভালোবাসার স্মৃতিকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে চাই। ওদেরকে আমি বিশেষ সেল দিয়ে বদলে দেব যাতে বিকল্প খাদ্যের জন্য অভিযোজিত হতে পারে।"
"তুমি সত্যি চাও একটা বিপদজনক প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখতে?" নিউক চিন্তিত সুরে বললো।
"আমি চাই। কারন ফিওনাকে আমি পছন্দ করেছি।"

নিউক এবারো দুটো বেগুনি রশ্মি জ্বালিয়ে সম্মতি দিল।

*******************************
কয়েক বছর পরের কথা।

ইতিমধ্যে পৃথিবীতে নতুন জাতের কিছু শস্য আবিষ্কৃত হলো। নতুন জাতের ধান, গম, ভুট্টা, ডাল। নতুন জাতের ফল। নতুন জাতের সবজী। অতি সুস্বাদু, ভিটামিনে ভরপুর। প্রোটিন শর্করা সব ওই শস্যসমূহে পাওয়া গেল। প্রানীজ চর্বির উপর নির্ভরতা কমে গেল। পৃথিবীতে খাদ্যসমস্যার আপাত সমাধান হয়ে গেল। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যে দুজন বিজ্ঞানী এই জাতের আবিষ্কার করলো, তারা পরপর দুবছর নোবেল পেল। কিন্তু ঘুনাক্ষরেও তারা কাউকে জানালো না কোন ফরমুলায় তারা ওই জাত তৈরী করতে পেরেছে। যেন স্বপ্নে পাওয়া ঔষধ। পৃথিবীটা সবুজে সবুজ হয়ে যেতে থাকে। মানুষেরা আনন্দে দিন কাটাতে থাকে। পরিবেশে প্রচুর অক্সিজেন। আকাশে বাতাসে অক্সিজেন।

চতুর্থ বছরে এসে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বায়ুমন্ডলের একটা অদ্ভুত সমস্যা দেখতে পেল। বায়ুমন্ডলের ভারসাম্যে কোথাও গন্ডগোল হয়েছে। এখানে ওখানে প্রচুর মানুষ অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মারা যেতে শুরু করেছে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে অনেক মানুষ। হাসপাতাল ডাক্তারে কুলোচ্ছে না। কোন রোগ নেই। কেবল রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। কেন শুকিয়ে যাচ্ছে তার কোন কারন খুজে পেল না। উন্নত দেশে বেশী ঘটতে লাগলো। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশে কম এখনো। যেখানে খাদ্যের প্রাচুর্য সেখানে বেশী মৃত্যু। সবচে কম মারা গেছে আফ্রিকাতে।

গত কবছরে বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গল বেড়ে গেছে। পুরো পৃথিবীটা আমাজন হয়ে যাচ্ছে। যেখান ছোট চারা লাগানো হোক, দুমাসে তা লকলক করে বেড়ে দাড়িয়ে যায়। নিউইয়র্কের মতো শহরের আনাচে কানাচে সবুজ জঙ্গল। দেখতে ভীষন সুন্দর। পৃথিবীটা হঠাৎ করে যেন স্বর্গের রূপ লাভ করেছে। কিন্তু স্বর্গের সুধা পান করার মতো মানুষের সংখ্যা কমতে লাগলো।

পঞ্চম বছরে গিয়ে অবস্থা এত খারাপ হলো যে হাসপাতালে নেয়াই গেল না। কেউ কাউকে দেখার রইল না। বাসার বেডরুমেই শুকিয়ে মারা গেল প্রচুর লোক।

পৃথিবীর সবগুলো বড় বড় দেশ সভা করলো। ধনীদেশগুলো বিশেষ ব্যবস্থা নিতে চাইল নিজেদের রক্ষায়। রক্ত কিনে কিনে টাংকি ভর্তি করে ফেলছে লোকজন। গাড়ী বাড়ী জমি জমা সব বিক্রি করে রক্ত কিনছে মানুষ। মানুষের রক্ত শেষ। এরপর পশুপাখির রক্ত সংগ্রহ শুরু হলো। গরু ছাগল শুয়োর কাক চড়ুই পাখীও বাদ গেল না। বাঁচতে হলে রক্ত লাগবে। তবু শেষ রক্ষা হলো না। মরতে শুরু করেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকায়, এশিয়ায়................।

ওই গোলোযোগে আরিলের দেউলিয়া মামলার কথা ভুলে গেল সবাই। আরিল সুসি আর ফিওনাকে নিয়ে এসেছিল পার্থ থেকে ওর গোপন আস্তানায়। অবশ্য তার আগেই ওদের শরীরে এক রাতে তিনটা রশ্মি প্রবেশ করেছিল তা ওরা কেউ জানে না। আরিল ভাবলো এই জায়গা মানব সমাজ থেকে দুরে, তাই মহামারী থেকে এই অঞ্চলে নিরাপদে থাকতে পারবে। খাদ্যের মজুদও আছে প্রচুর। কিন্তু জীবিত মানুষের সংখ্যা একেবারে নেই বললেই চলে। জীবিত মানুষকে আরিল ভয় পায় এখনো। তাই আপাততঃ সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জনেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল আরিল।

জনবিচ্ছিন্ন ওই জায়গায় থেকে আরিল জানতেও পারলো না পৃথিবীতে তারা তিনজনই জীবিত মানব। বাকী সাড়ে ছয়শো কোটি মানুষ শুকিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। যখন জানবে তখন খুব দেরী হয়ে গেছে। পৃথিবীতে মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে বৃক্ষদের রাজত্ব শুরু হয়েছে। গাছে গাছে পাখি ডাকে নির্ভয়ে। অরন্যে বাঘ হরিনের অবাধ ছুটোছুটি শিকার। দুবছর পর শহরের দিকে গিয়ে দেখে চমকে উঠে। এসব কি দেখছে? মানুষজন সব কোথায়। এত নির্জনতা কেন এখানে?

বড় বড় দালানের উপর উঠে গেছে বৃক্ষলতা। বাড়ি গাড়ি সব জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেছে। পথঘাট সব কংক্রিট হারিয়ে ঘাসের জঙ্গলে রূপ নিয়েছে। কোথাও একটা আগ্রাসন ঘটে গেছে আরিল আন্দাজ করলো। কাদের আগ্রাসন? মাত্র দু বছর আড়ালে ছিল শহর থেকে দুরে, এতেই একটা শহরের মানুষ সবগুলো হারিয়ে গেল? এটা কি সেই রোগের প্রভাব? জীবানু আক্রমন ঘটেছে? জীবানুরা সব মানুষ মেরে ফেললো শহরের? অথচ গাছেদের কিছু হয়নি। গাছেরা আরো সবুজ হয়েছে, পল্লবিত হয়েছে, পুষ্ট হয়েছে।

নাহ এই দেশে থাকবে না আর। জনশূন্য শহরে বসবাস করার কোন মানে হয় না। অস্ট্রেলিয়া নয়তো ইউরোপ চলে যাবে। জিপ গাড়ীটা চালিয়ে বিষন্ন মনে বাড়ী ফিরছে আরিল। বাড়ীর কাছাকাছি যেতেই ফিওনার চিৎকার -"বাবা বাবা দেখো, সেই ফুলটা আবারো ফুটেছে আমাদের বাগানে।"

সেই অভিশপ্ত ফুলটা আবারো ফিরে এসেছে কেন? ভয়ে ভয়ে ফুলটার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ করে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে ফুলটার পাশে ভাঙ্গা চোরা মানুষ হয়ে বসে পড়লো আরিল।

[সমাপ্ত]

একটি অপ্রকাশিত আবিষ্কারের কাহিনী

গ্রহ নক্ষত্রের ফেরে আমার বিজ্ঞানী হওয়াটা ঠেকে গেল। নইলে হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্টে প্রমোশন পাবার আগ পর্যন্ত কেবলমাত্র বিজ্ঞানী হবারই স্বপ্ন দেখতাম।

যদিও পড়াশোনায় একবিন্দু মন ছিল না কখনোই। সেটার জন্যও আংশিক দায়ী বিজ্ঞানী হবার বাসনা। কারণ পরিচিত যে তিনজন বিজ্ঞানী ছিলেন তাদের কাউকে স্কুলে যেতে দেখিনি বা শুনিনি। একজন আপেল বাগানে গিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতো, আরেকজন চৌবাচ্চায় গোসল করতে গিয়ে পানি উপচে পড়াতে ইউরেকা বলে চেঁচাতে চেঁচাতে রাস্তায় ছুটে যেতো, শেষের জন দুরবীন হাতে দুর আকাশের অগুনতি নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতো আর কে কার পিছে ঘুরে সেটা আবিষ্কার করতো।

প্রথম দুজনের কাজ আমার পক্ষে সম্ভব না। আমাদের আপেল বাগান নেই, আদতে কোন বাগানই ছিল না আমাদের। বাসার সামনে একফালি ঘাসের লন বাদে কিচ্ছু ছিল না। দ্বিতীয়জনের মতো চৌবাচ্চায় গোসল করিনি কখনো। চৌবাচ্চা কি জিনিস তাও বুঝতাম না ঠিক। তবে আক্কেলের দৌড়ে বুঝতাম পুকুরের মতো কোন বস্তু হবে। আমাদের বাসায় পুকুর ছিল না, সুতরাং ইনিও বাদ।

বাকী থাকলো দুরবীন বিজ্ঞানী। তার সাথে খানিক মিল ছিল, সন্ধ্যের পর বাসার সামনে দাড়িয়ে আমিও খোলা আকাশে লক্ষ কোটি তারকার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু অত দুরের তারা দুরবীন ছাড়া কিছুই বোঝা যায় না। দুরবীন কোথায় পাই? বড়দের জিজ্ঞেস করলে হেসে উড়িয়ে দেয়। ক্লাস থ্রী পড়ুয়া পুঁচকে ছোড়া দুরবীন দিয়ে কি করবে? হতাশ হয়ে বিকল্প উপায় খুঁজতে লাগলাম। দুরবীনে শক্তিশালী কাঁচের ব্যবহার লাগে ওটা জানতাম। সেরকম কাঁচ বাবার চশমায়ও দেখি। কিন্তু ওটা দিয়ে একদিন আকাশ দেখার চেষ্টা করে ঝাপসা ধোঁয়াশা বাদে কিছুই দেখিনি।

একদিন দেখি পাশের বাসার মারুফও সন্ধ্যার পর আকাশের দিকে উঁকি ঝুঁকি মারছে। ব্যাপার কি? জিজ্ঞেস করতেই জানলাম সেও আমার পথের যাত্রী। তবে বিজ্ঞানের পথে সে আমার চেয়ে একধাপ এগিয়ে। জানালো -'বোকারাম, এটা তো একটা কাঁচের কাজ নয়। দুটো কাঁচের যোগফল একটা দুরবীন।'

মর জ্বালা কত কি অজানা! তবে সে নাকি দুটো কাঁচ যোগাড়ও করে ফেলেছে। এখন কাগজের নল যোগাড় হলে, তার দুই প্রান্তে দুটো কাঁচ বসিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। মারুফকে সাথে পেয়ে যেন আমি গ্যালিলিওকে পাশে পেলাম। এবার আমাদের ঠেকায় কে। উত্তেজনায় রাতে ঘুম হলো না।

পরের দিন কলোনীর পাশের একটা গোডাউনের কাছ থেকে মোটা একটা কাগজের চোঙ্গা যোগাড় করা হলো(তখন ওরকম চোঙ্গা আসতো কোন বিদেশী জিনিসের মোড়ক হিসেবে নিয়ে। কাঠের মতো শক্ত ওটি)। দুজনে বসে দুপুরের মধ্যে তৈরী করে ফেললাম জীবনের প্রথম দুরবীন।

কিন্তু যন্ত্র চোখে লাগিয়ে দুরে তাকিয়ে কিছু দেখা যায় না। সব ঝাপসা! গন্ডগোলটা কোথায়। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। কারণ এটি আমাদের দুজনের গোপন প্রজেক্ট। সবকিছু ফাইনাল হলেই ঘোষনা দেয়া হবে চুড়ান্ত আবিষ্কারের। কি আবিষ্কার হবে তা অবশ্য জানতাম না। কিন্তু আশা ছিল দুরবীনের শক্তিশালী লেন্সে চোখ লাগালে সমগ্র নক্ষত্রমন্ডলীই তো হাতের মুঠোয় চলে আসবে। ওখান থেকে বেছে বেছে গ্রহ নক্ষত্র আবিষ্কার করে বিশ্বব্যাপী জানিয়ে দেবো আর সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে আমাদের সুনাম। আপাততঃ আমাদের বিশ্ব ছিল আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীর মেইন গেট পর্যন্ত।

কিন্তু চোখে ঝাপসা দেখা যেতেই আমাদের বিজ্ঞানী হবার আশা মাঠে মারা যাবার উপক্রম হলো। দুদিন ধরে গালে হাত দিয়ে নিউটন হয়ে বসে রইলাম দুজনে। তৃতীয় দিন মারুফ আর্কিমিডিস হয়ে ডাক দিল, ইউরেকা। পেয়েছি!! আমি ছুটে গেলাম। কি পাইছস?

সে বলে, চল সিনেমা বানাই। আমি তাজ্জব। হওয়ার কথা বিজ্ঞানী, সিনেমা বানাবো কেন? মারুফ বললো সে তার কাকার কাছে শুনেছে সিনেমা চলে প্রজেক্টরে। সেই প্রজেক্টরে এরকম মোটা কাঁচের ব্যবহার হয়। প্রজেক্টরের পেছন থেকে আলো ফেলে সামনে সিনেমার ফিল্মগুলো চালালে পর্দায় ভেসে উঠবে চলমান সিনেমা। সে কিছু রিল যোগাড় করেছে কাকার মাধ্যমে। আমি ওর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ভুলে গেলাম গ্যালিলিওর কথা।

এখানে আরো কিছু বাড়তি সরঞ্জাম লাগবে। একটা ছোট বাল্ব আর দুটো ব্যাটারী। যোগাড় করা কোন সমস্যাই না। বাসার টর্চলাইট থেকে এই দুই জিনিস যোগাড় হয়ে গেল। এরপর লাগবে একটা অন্ধকার ঘর। সন্ধ্যের পর মারুফের পড়ার ঘরে বাতি নিভিয়ে ওটাও ব্যবস্থা করা যাবে।

রাতে শুরু হলো আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা। কিন্তু অন্ধকার ঘরে দেয়ালে ঝাপসা যে বস্তুটি প্রতিফলিত তৈরী হলো তাতে কিসসু বোঝা যাচ্ছে। না ফটু না সিনেমা। মারুফের যোগাড়কৃত সিনেমার রীলগুলি খালি চোখে লাইটের বিপরীতে ধরে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, আমাদের বানানো প্রজেক্টারে তার কনাও বোঝা যাচ্ছে না।

এবার আর কোন সুযোগ নেই। নাহ আমাদের সমস্ত বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে মারুফ লাফিয়ে উঠে বললো, আরে এটা তো দেখতে একটা টর্চের মতো লাগছে। আমরা কি তাহলে টর্চলাইট আবিষ্কার করে ফেললাম?

আমিও পুলকিত। যাক একটা কিছু তো আবিষ্কার হয়েছে। কাগজের চোঙ্গা দিয়ে টর্চলাইট আগে কেউ আবিষ্কার করেছে বলে জানা নেই। কিন্তু সেই আবিষ্কারের কাহিনী বাসায় বলা গেল না, বললে টর্চলাইটের খোয়া যাওয়া ব্যাটারী আর বাল্বের মূল্য পরিশোধ করতে হতো পিঠের চামড়ার ছাল দিয়ে।

বহু বছর চেপে রাখা সেই আবিষ্কারের ঘটনাটা আজকে সুযোগ পেয়ে কেবল আপনাকেই বললাম। আর কাউকে বলবেন না কিন্তু!

হারানো লাটিম, হারানো লেত্তি, হারানো সময়ের কাতর গল্প

লাটিমের পেটে লেত্তিটা পেঁচিয়ে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মাঝে সবুজ-লালে মসৃন আঁকা লাটিমটা চেপে ধরে যখন 'হুপপপস' বলে সামনের মাটিতে দাগানো গোল চক্করে ছুড়ে মারলো আবেদ, তখনো বোঝেনি শুক্কুরের চালটা।

গত দুদিন পরপর চারটি লাটিম হারিয়েছে শুক্কুরের কাছে। আজকে নতুন লাটিম কিনে গোড়া থেকে গেজটা খুলে নিয়ে চকচকে নতুন পেরেকের হুল ঢুকিয়ে তৈরী করেছে লাল-সবুজ এই লাটিম ঘোড়া। সারাদিন ঘরে লাটিম চালিয়ে আবেদ হাতের নজর পাকা করেছে, নিয়ন্ত্রনে এনেছে লাটিম লেত্তির গতি। লাঠিম খেলায় তাকে হারাতে পারবে না কেউ এখন। বাবার পকেট কেটে নতুন লাটিমের টাকা যোগাড় করেছে। বাবার পকেট হাতিয়ে সুখ আছে। বলতে পারে না কত খোয়া গেছে। পকেটে সবসময় উপরি গিজগিজ করে সরকারী চাকুরে বাবার।

*************************************************

লাটিম খেলা সবাই বোঝে না। বুঝতে হলে তাকে ছেলেবেলায় ফিরে যেতে হবে, নইলে কোন লাটিম বালককে ধরে ছোট্ট একটা কোর্স করে নিতে হবে।

আমি বলি। ব্যাপারটা সহজ। পাড়ার ছুটকো মুদী দোকানেই লাটিম পাওয়া যায়। বিশেষতঃ যে দোকানগুলি কাঠের চারপায়ের উপর টিনের বাক্সের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তিনপাশে ড্রামশিটের দেয়ালে ঘেরা, উপরে মরচেধরা ঢেউটিন সামনে ভাজকরা টিনের কব্জার ফটক। দোকানের ঘোলা কাঁচের শোকেসের ভেতর সাজানো থাকে নানাব্রান্ডের দামী সিগারেটের প্যাকেট। সবগুলাই নিশ্চিত খালি। খালি সিগারেটের বাক্সের পেছনে সাজানো থাকে স্টার, সিজার, ক্যাপস্টান কিংবা গোল্ডফ্লেকের আধখোলা প্যাকেট। পাশে আবুল কারিগর কিংবা আকিজ বিড়ির বান্ডিল। শোকেসের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে কয়েকটা কাঁচের বৈয়াম। বৈয়ামে সাজানো থাকবে চকোলেট, আচার, আর চিনির তৈরী মিষ্টি দানা যাকে সন্দেশ বলে বিক্রি করে পঁচিশ পয়সায়। উপরের দিকে জং ধরা দুটো খাঁচা ঝুলবে, যার একটিতে মুরগী অন্যটিতে হাসের ডিম।

পরিপাটি এই দোকানের পেছনের দেয়ালে পলিথিনের একটা ঝোলার পাশে দুটো সুতলীতে ঝোলানো থাকবে দুই সারি লাটিম। একটা পনের পয়সা আরেকটা পঞ্চাশ পয়সা। ১৫ পয়সার লাটিমের কোন বাহার নেই, দায়সারা গোলাপী রঙে চুবিয়ে তার গোড়ায় কোনমতে একটা গেজ ঢুকিয়ে লাটিম নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এই লাটিমগুলো মূলত টোপ লাটিম। বাজি ধরতে এদের ব্যবহার করা হয়। পাশের সারিতে ঝোলানো দুই বা তিন রঙের পাংকি লাটিমগুলোই আসল খেলোয়াড়। ওগুলোর শরীর মসৃন মজবুত কাঠ থেকে তৈরী। লাল-নীল, লাল-সবুজ, লাল-বেগুনী এরকম বাহারী রঙের লাটিম। দেখতে যেমন দামেও তেমন!

লাঠিম খেলার বাজি দুই প্রকার। একটা হলো হেরে গেলে দোষী লাঠিমের উপর 'গেজ' মারা। গেজ মারার শুদ্ধ কোন প্রতিশব্দ জানা নেই। তবে গেজ মারা হলো, বিজয়ী লাঠিমের চোখা মাথা দিয়ে পরাজিত লাটিমের ভুড়ি বা মুন্ডু দুই ফাঁক করে দেয়া। আরেকটা বাজি হলো হলো পরাজিত লাটিমটি বিজয়ী দখলে নিয়ে নেবে।

লাটিমের বাজি খেলতে হলে রঙিন লাটিমের পাশাপাশি ভুসভুসে সস্তা দশ পয়সার গোলাপী লাটিমও থাকতে হয়। নইলে বাজিতে আসল লাটিম হারিয়ে পথে বসে কাঁদতে হবে। নেহায়েত বড়লোকের পোলা না হলে একসাথে দুটো পাংকি লাটিম কেউ পোষাতে পারে না। লাটিমের বাজি ছাড়াও নানান কেরামতী আছে লাটিম খেলার। যা সবাই পারে না। আবেদ সকল খেলায় পারদর্শী। যে কোন স্থানে লাটিম ঘুরানোর কায়দা রপ্ত করা আসল। সমতল অসমতল নরম শক্ত মাটি, সব জায়গায় চলে এরকম।

বাসায় বাবার বকার ভয়ে পাকা মেঝেতে লাটিম চালাতে পারেনা সে। তাই কায়দা করে হাতের তালুতে লাটিম ঘুরায় আবেদ। ব্যাপারটা অদ্ভুত শৈল্পিক। লাটিমটাকে লেত্তির মধ্যে পেচিয়ে গেজটা উপরের দিকে রাখা অবস্থায় ডান হাত দিয়ে সোজা সামনে ছুড়ে দিয়ে আবার পিছুটান দিলে লাটিমটা চিত থেকে সপাত করে সোজা পায়ে এসে পড়ে হাতের তালুতে, এবং ঘুরতে থাকে মনের আনন্দে। হাতের তালুতে নিরাপদ লাটিম ঘোরাবার কায়দা রপ্ত করার পর থেকে বাবার বকুনি কমেছে তার। পকেটে করে স্কুলেও নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে সে। পেছনের বেঞ্চে জায়গা করে নিয়ে আস্ত লাটিম ঘোরানোর খেলা চলে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে।

আবেদ স্কুলে যায়। শুক্কুর যায় না। শুক্কুর স্কুলে পড়বে না, এটাই যেন স্বাভাবিক। ওর বড় ভাই রহিম গুন্ডা। ওদের স্কুলে না গেলেও চলে। কিন্তু আবেদের না গেলে চলে না। পিঠের উপর চিক্কন নিম ডালের অত্যাচার নেমে আসে একদিন পড়াশোনা না করলে। তার ইচ্ছে করে শুক্কুরদের সাথে থাকতে। সোলেমানও স্কুলে যায় না। সে আবার লাটিম খেলায় আগ্রহী না। চাক্কু ছোড়ায় ওস্তাদ সে। লাটিমের বদলে চাকু ছুড়ে মারে মাটিতে। দুরে গিয়ে অদ্ভুত সুন্দর গেঁথে যায় চাকুটা মাটিতে। এত প্রতিভা যাদের, তাদের স্কুলে না গেলেও চলে।

শর্ত ছিল শুক্কুর নতুন লাটিম বসাবে গোল চক্করে, ভুসভুসে গোলাপী লাটিম না। বসিয়েছেও ঠিক ঠাক। একদম নতুন লাল-সবুজ-বেগুনী টাট্টু ঘোড়া। আবেদের চোখজোড়া স্বপ্নে ভরে যায় ওই লাল-সবুজ-বেগুনী ঘোড়াটার জন্য। তেরঙা লাটিম দুর্লভ একটা জিনিস। পাড়ায় এই একটি লাটিমই আছে। তার সাথে খেলার জন্য আবেদ নতুন কেনা লাল-সবুজকে তৈরী করেছে।

*******************************************************

লাটিমটা ছুড়ে মেরেই চোখ ছানাবড়া করে আবেদ দেখতে পেল, তার লালসবুজ বন বন করে ঘোরার বদলে ওই গোলাকার দাগের ভেতর পা গুটিয়ে বসে গেল। ব্যাপার কি? কাছে গিয়ে দেখতে পেল যেখানে গোল্লাটা আঁকা হয়েছে, সেটায় নরম মাটির আস্তরন। আর নরম মাটিতে লাটিমের পক্ষে বনবন ঘোরা অসম্ভব। তাই সে পরাজিত গরুর মতো পা গুটিয়ে বসে গেছে শুক্কুরের লাল-সবুজ-বেগুনী লাটিমের পাশে। শুক্কুরের মুখে বিটলামী হাসি, আবেদ নিরুপায় তাকিয়ে দেখে তার চোখের সামনে নতুন কেনা লাটিমটি ওর পকেটে চলে গেল।

শুক্কুর খেলা শুরুর আগেই কায়দা করে খেলার জায়গা নির্ধারণ করেছিল নরোম মাটিতে যা ছিল একটা ফাঁদ। কিন্তু বুঝতে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। আবেদের করার কিচ্ছু নেই। কদিন আর লাটিম কেনা হবে না তার। বাবাকে বললে তেড়ে উঠবে এখন। শুক্কুর টিটকারীর সুরে বললো, আরেক দান খেলবি নাকি আবিদ্যা?

আবেদ জবাব না দিয়ে চোখের জল সামলে মাথা নীচু করে বসে রইল। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না।

শুক্কুরের এই প্রতারণার অভিযোগ জানাবার কোন আদালত নেই।

পাআআআআআআআআআআ

বাসায় পৌঁছে কলিংবেল বাজাতেই সবচেয়ে কাংখিত যে শব্দটা ভেতর থেকে ভেসে আসে সেটা হলো “বাবা এসেছেএএএএএএ………..”।

.

বলাই বাহুল্য ওটা কার গলা। সদ্য চতুবর্ষ পেরুনো ওশিন। ছুটে এসে ছোট ছোট দুহাতে জড়িয়ে ধরবে কিংবা এক লাফে গলায় ঝুলে পড়বে। ইদানীং তার পেছন পেছন আরেকজনও আসার চেষ্টা করে। ইনি এখনো হাঁটতে পারেন না, কিন্তু ওয়াকারে করে সারা ঘর দাপিয়ে বেড়ান সাই সাই করে। তিনিও কলিং বেল শোনামাত্র হৈ হৈ শব্দ করা শুরু করবে, দুহাত বাড়িয়ে যদ্দুর সম্ভব ছুটে আসবে। তারপর আলতো করে বলবে, ‘পা…’। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আরেকটু জোর দিয়ে “পাআআ…..”। কেউ শেখায়নি, এই শব্দ নিজে নিজে তৈরী করেছে। তার নিজস্ব তিন চারটে শব্দের ভান্ডার তৈরী করেছে ১৩ মাস পেরুনো ড.শিহান রিশাদ।

.

আমাকে ‘পা’ কিংবা 'পাপা' ডাকে শিহান। ইংরেজের বাচ্চা হলে বুঝতাম যে পাপার সংক্ষিপ্ত রূপ পা, কিন্তু বাঙালের পোলা হয়ে কোত্থেকে পা আবিষ্কার করলো ভেবে পাই না। আগে হালকা ধমকে দিয়ে বলতাম, কিরে ব্যাটা আমি ‘পা’ মানে ট্যাং হলাম কেমনে? কিন্তু আজকাল অজান্তে আমিও এই ‘পা’ ডাকের ভক্ত হয়ে গেছি এবং চিন্তায় আছি কখন 'পা' ডাকের মেয়াদ শেষ হয়ে 'বাবা' কিংবা 'আব্বা'র যুগ চলে আসে।

.

কেবল ‘পা’ নয়। আমি বাসায় ঢোকামাত্র বিশেষ চিত্তচাঞ্চল্য দেখা যাবে তার মধ্যে। বোধহয় সারাদিনের না বলা কথাগুলো হড়বড় করে বলতে থাকে এবং শব্দের বাজেট দুটো। ‘পা’ আর ‘কা’ এই দুই শব্দ দিয়ে সব বকবকানি। ফোন কিংবা কলিংবেল বাজলে বলবে, ‘কে’? আর শিক্ষাদীক্ষা বিষয়ক তাবৎ বস্তুকে 'ক-খ' দিয়েই সামলাবে। এমনকি আমার ল্যাপিকে দেখলেও বলবে ‘ক-খ’।

.

গতকাল থেকে নতুন এক রসিকতা যুক্ত হয়েছে। আমার হাতটা টেনে নিয়ে উপরে আর নীচের মিলিয়ে পাঁচটা দাতের কামড় দেবার মতলবে থাকে। ব্যাথা পাচ্ছি বলে মৃদু ধমকে দিলে চোখ পিট পিট করে হাসে। যেন বলতে চায় “হালকাই তো দিলাম, এতেই ব্যাথা পাও?”

.

আসলে যে কথা বলার জন্য 'ক-খ' করলাম এতক্ষণ তা হলো, আমি বুড়ো হইতেছি আর পোলা ফাজিল হইতেছে দিন দিন।