গ্রহ নক্ষত্রের ফেরে আমার বিজ্ঞানী হওয়াটা ঠেকে গেল। নইলে হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্টে প্রমোশন পাবার আগ পর্যন্ত কেবলমাত্র বিজ্ঞানী হবারই স্বপ্ন দেখতাম।
যদিও পড়াশোনায় একবিন্দু মন ছিল না কখনোই। সেটার জন্যও আংশিক দায়ী বিজ্ঞানী হবার বাসনা। কারণ পরিচিত যে তিনজন বিজ্ঞানী ছিলেন তাদের কাউকে স্কুলে যেতে দেখিনি বা শুনিনি। একজন আপেল বাগানে গিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতো, আরেকজন চৌবাচ্চায় গোসল করতে গিয়ে পানি উপচে পড়াতে ইউরেকা বলে চেঁচাতে চেঁচাতে রাস্তায় ছুটে যেতো, শেষের জন দুরবীন হাতে দুর আকাশের অগুনতি নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতো আর কে কার পিছে ঘুরে সেটা আবিষ্কার করতো।
প্রথম দুজনের কাজ আমার পক্ষে সম্ভব না। আমাদের আপেল বাগান নেই, আদতে কোন বাগানই ছিল না আমাদের। বাসার সামনে একফালি ঘাসের লন বাদে কিচ্ছু ছিল না। দ্বিতীয়জনের মতো চৌবাচ্চায় গোসল করিনি কখনো। চৌবাচ্চা কি জিনিস তাও বুঝতাম না ঠিক। তবে আক্কেলের দৌড়ে বুঝতাম পুকুরের মতো কোন বস্তু হবে। আমাদের বাসায় পুকুর ছিল না, সুতরাং ইনিও বাদ।
বাকী থাকলো দুরবীন বিজ্ঞানী। তার সাথে খানিক মিল ছিল, সন্ধ্যের পর বাসার সামনে দাড়িয়ে আমিও খোলা আকাশে লক্ষ কোটি তারকার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু অত দুরের তারা দুরবীন ছাড়া কিছুই বোঝা যায় না। দুরবীন কোথায় পাই? বড়দের জিজ্ঞেস করলে হেসে উড়িয়ে দেয়। ক্লাস থ্রী পড়ুয়া পুঁচকে ছোড়া দুরবীন দিয়ে কি করবে? হতাশ হয়ে বিকল্প উপায় খুঁজতে লাগলাম। দুরবীনে শক্তিশালী কাঁচের ব্যবহার লাগে ওটা জানতাম। সেরকম কাঁচ বাবার চশমায়ও দেখি। কিন্তু ওটা দিয়ে একদিন আকাশ দেখার চেষ্টা করে ঝাপসা ধোঁয়াশা বাদে কিছুই দেখিনি।
একদিন দেখি পাশের বাসার মারুফও সন্ধ্যার পর আকাশের দিকে উঁকি ঝুঁকি মারছে। ব্যাপার কি? জিজ্ঞেস করতেই জানলাম সেও আমার পথের যাত্রী। তবে বিজ্ঞানের পথে সে আমার চেয়ে একধাপ এগিয়ে। জানালো -'বোকারাম, এটা তো একটা কাঁচের কাজ নয়। দুটো কাঁচের যোগফল একটা দুরবীন।'
মর জ্বালা কত কি অজানা! তবে সে নাকি দুটো কাঁচ যোগাড়ও করে ফেলেছে। এখন কাগজের নল যোগাড় হলে, তার দুই প্রান্তে দুটো কাঁচ বসিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। মারুফকে সাথে পেয়ে যেন আমি গ্যালিলিওকে পাশে পেলাম। এবার আমাদের ঠেকায় কে। উত্তেজনায় রাতে ঘুম হলো না।
পরের দিন কলোনীর পাশের একটা গোডাউনের কাছ থেকে মোটা একটা কাগজের চোঙ্গা যোগাড় করা হলো(তখন ওরকম চোঙ্গা আসতো কোন বিদেশী জিনিসের মোড়ক হিসেবে নিয়ে। কাঠের মতো শক্ত ওটি)। দুজনে বসে দুপুরের মধ্যে তৈরী করে ফেললাম জীবনের প্রথম দুরবীন।
কিন্তু যন্ত্র চোখে লাগিয়ে দুরে তাকিয়ে কিছু দেখা যায় না। সব ঝাপসা! গন্ডগোলটা কোথায়। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। কারণ এটি আমাদের দুজনের গোপন প্রজেক্ট। সবকিছু ফাইনাল হলেই ঘোষনা দেয়া হবে চুড়ান্ত আবিষ্কারের। কি আবিষ্কার হবে তা অবশ্য জানতাম না। কিন্তু আশা ছিল দুরবীনের শক্তিশালী লেন্সে চোখ লাগালে সমগ্র নক্ষত্রমন্ডলীই তো হাতের মুঠোয় চলে আসবে। ওখান থেকে বেছে বেছে গ্রহ নক্ষত্র আবিষ্কার করে বিশ্বব্যাপী জানিয়ে দেবো আর সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে আমাদের সুনাম। আপাততঃ আমাদের বিশ্ব ছিল আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীর মেইন গেট পর্যন্ত।
কিন্তু চোখে ঝাপসা দেখা যেতেই আমাদের বিজ্ঞানী হবার আশা মাঠে মারা যাবার উপক্রম হলো। দুদিন ধরে গালে হাত দিয়ে নিউটন হয়ে বসে রইলাম দুজনে। তৃতীয় দিন মারুফ আর্কিমিডিস হয়ে ডাক দিল, ইউরেকা। পেয়েছি!! আমি ছুটে গেলাম। কি পাইছস?
সে বলে, চল সিনেমা বানাই। আমি তাজ্জব। হওয়ার কথা বিজ্ঞানী, সিনেমা বানাবো কেন? মারুফ বললো সে তার কাকার কাছে শুনেছে সিনেমা চলে প্রজেক্টরে। সেই প্রজেক্টরে এরকম মোটা কাঁচের ব্যবহার হয়। প্রজেক্টরের পেছন থেকে আলো ফেলে সামনে সিনেমার ফিল্মগুলো চালালে পর্দায় ভেসে উঠবে চলমান সিনেমা। সে কিছু রিল যোগাড় করেছে কাকার মাধ্যমে। আমি ওর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ভুলে গেলাম গ্যালিলিওর কথা।
এখানে আরো কিছু বাড়তি সরঞ্জাম লাগবে। একটা ছোট বাল্ব আর দুটো ব্যাটারী। যোগাড় করা কোন সমস্যাই না। বাসার টর্চলাইট থেকে এই দুই জিনিস যোগাড় হয়ে গেল। এরপর লাগবে একটা অন্ধকার ঘর। সন্ধ্যের পর মারুফের পড়ার ঘরে বাতি নিভিয়ে ওটাও ব্যবস্থা করা যাবে।
রাতে শুরু হলো আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা। কিন্তু অন্ধকার ঘরে দেয়ালে ঝাপসা যে বস্তুটি প্রতিফলিত তৈরী হলো তাতে কিসসু বোঝা যাচ্ছে। না ফটু না সিনেমা। মারুফের যোগাড়কৃত সিনেমার রীলগুলি খালি চোখে লাইটের বিপরীতে ধরে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, আমাদের বানানো প্রজেক্টারে তার কনাও বোঝা যাচ্ছে না।
এবার আর কোন সুযোগ নেই। নাহ আমাদের সমস্ত বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে মারুফ লাফিয়ে উঠে বললো, আরে এটা তো দেখতে একটা টর্চের মতো লাগছে। আমরা কি তাহলে টর্চলাইট আবিষ্কার করে ফেললাম?
আমিও পুলকিত। যাক একটা কিছু তো আবিষ্কার হয়েছে। কাগজের চোঙ্গা দিয়ে টর্চলাইট আগে কেউ আবিষ্কার করেছে বলে জানা নেই। কিন্তু সেই আবিষ্কারের কাহিনী বাসায় বলা গেল না, বললে টর্চলাইটের খোয়া যাওয়া ব্যাটারী আর বাল্বের মূল্য পরিশোধ করতে হতো পিঠের চামড়ার ছাল দিয়ে।
বহু বছর চেপে রাখা সেই আবিষ্কারের ঘটনাটা আজকে সুযোগ পেয়ে কেবল আপনাকেই বললাম। আর কাউকে বলবেন না কিন্তু!
No comments:
Post a Comment