লাটিমের পেটে লেত্তিটা পেঁচিয়ে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মাঝে সবুজ-লালে মসৃন আঁকা লাটিমটা চেপে ধরে যখন 'হুপপপস' বলে সামনের মাটিতে দাগানো গোল চক্করে ছুড়ে মারলো আবেদ, তখনো বোঝেনি শুক্কুরের চালটা।
গত দুদিন পরপর চারটি লাটিম হারিয়েছে শুক্কুরের কাছে। আজকে নতুন লাটিম কিনে গোড়া থেকে গেজটা খুলে নিয়ে চকচকে নতুন পেরেকের হুল ঢুকিয়ে তৈরী করেছে লাল-সবুজ এই লাটিম ঘোড়া। সারাদিন ঘরে লাটিম চালিয়ে আবেদ হাতের নজর পাকা করেছে, নিয়ন্ত্রনে এনেছে লাটিম লেত্তির গতি। লাঠিম খেলায় তাকে হারাতে পারবে না কেউ এখন। বাবার পকেট কেটে নতুন লাটিমের টাকা যোগাড় করেছে। বাবার পকেট হাতিয়ে সুখ আছে। বলতে পারে না কত খোয়া গেছে। পকেটে সবসময় উপরি গিজগিজ করে সরকারী চাকুরে বাবার।
*************************************************
লাটিম খেলা সবাই বোঝে না। বুঝতে হলে তাকে ছেলেবেলায় ফিরে যেতে হবে, নইলে কোন লাটিম বালককে ধরে ছোট্ট একটা কোর্স করে নিতে হবে।
আমি বলি। ব্যাপারটা সহজ। পাড়ার ছুটকো মুদী দোকানেই লাটিম পাওয়া যায়। বিশেষতঃ যে দোকানগুলি কাঠের চারপায়ের উপর টিনের বাক্সের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তিনপাশে ড্রামশিটের দেয়ালে ঘেরা, উপরে মরচেধরা ঢেউটিন সামনে ভাজকরা টিনের কব্জার ফটক। দোকানের ঘোলা কাঁচের শোকেসের ভেতর সাজানো থাকে নানাব্রান্ডের দামী সিগারেটের প্যাকেট। সবগুলাই নিশ্চিত খালি। খালি সিগারেটের বাক্সের পেছনে সাজানো থাকে স্টার, সিজার, ক্যাপস্টান কিংবা গোল্ডফ্লেকের আধখোলা প্যাকেট। পাশে আবুল কারিগর কিংবা আকিজ বিড়ির বান্ডিল। শোকেসের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে কয়েকটা কাঁচের বৈয়াম। বৈয়ামে সাজানো থাকবে চকোলেট, আচার, আর চিনির তৈরী মিষ্টি দানা যাকে সন্দেশ বলে বিক্রি করে পঁচিশ পয়সায়। উপরের দিকে জং ধরা দুটো খাঁচা ঝুলবে, যার একটিতে মুরগী অন্যটিতে হাসের ডিম।
পরিপাটি এই দোকানের পেছনের দেয়ালে পলিথিনের একটা ঝোলার পাশে দুটো সুতলীতে ঝোলানো থাকবে দুই সারি লাটিম। একটা পনের পয়সা আরেকটা পঞ্চাশ পয়সা। ১৫ পয়সার লাটিমের কোন বাহার নেই, দায়সারা গোলাপী রঙে চুবিয়ে তার গোড়ায় কোনমতে একটা গেজ ঢুকিয়ে লাটিম নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এই লাটিমগুলো মূলত টোপ লাটিম। বাজি ধরতে এদের ব্যবহার করা হয়। পাশের সারিতে ঝোলানো দুই বা তিন রঙের পাংকি লাটিমগুলোই আসল খেলোয়াড়। ওগুলোর শরীর মসৃন মজবুত কাঠ থেকে তৈরী। লাল-নীল, লাল-সবুজ, লাল-বেগুনী এরকম বাহারী রঙের লাটিম। দেখতে যেমন দামেও তেমন!
লাঠিম খেলার বাজি দুই প্রকার। একটা হলো হেরে গেলে দোষী লাঠিমের উপর 'গেজ' মারা। গেজ মারার শুদ্ধ কোন প্রতিশব্দ জানা নেই। তবে গেজ মারা হলো, বিজয়ী লাঠিমের চোখা মাথা দিয়ে পরাজিত লাটিমের ভুড়ি বা মুন্ডু দুই ফাঁক করে দেয়া। আরেকটা বাজি হলো হলো পরাজিত লাটিমটি বিজয়ী দখলে নিয়ে নেবে।
লাটিমের বাজি খেলতে হলে রঙিন লাটিমের পাশাপাশি ভুসভুসে সস্তা দশ পয়সার গোলাপী লাটিমও থাকতে হয়। নইলে বাজিতে আসল লাটিম হারিয়ে পথে বসে কাঁদতে হবে। নেহায়েত বড়লোকের পোলা না হলে একসাথে দুটো পাংকি লাটিম কেউ পোষাতে পারে না। লাটিমের বাজি ছাড়াও নানান কেরামতী আছে লাটিম খেলার। যা সবাই পারে না। আবেদ সকল খেলায় পারদর্শী। যে কোন স্থানে লাটিম ঘুরানোর কায়দা রপ্ত করা আসল। সমতল অসমতল নরম শক্ত মাটি, সব জায়গায় চলে এরকম।
বাসায় বাবার বকার ভয়ে পাকা মেঝেতে লাটিম চালাতে পারেনা সে। তাই কায়দা করে হাতের তালুতে লাটিম ঘুরায় আবেদ। ব্যাপারটা অদ্ভুত শৈল্পিক। লাটিমটাকে লেত্তির মধ্যে পেচিয়ে গেজটা উপরের দিকে রাখা অবস্থায় ডান হাত দিয়ে সোজা সামনে ছুড়ে দিয়ে আবার পিছুটান দিলে লাটিমটা চিত থেকে সপাত করে সোজা পায়ে এসে পড়ে হাতের তালুতে, এবং ঘুরতে থাকে মনের আনন্দে। হাতের তালুতে নিরাপদ লাটিম ঘোরাবার কায়দা রপ্ত করার পর থেকে বাবার বকুনি কমেছে তার। পকেটে করে স্কুলেও নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে সে। পেছনের বেঞ্চে জায়গা করে নিয়ে আস্ত লাটিম ঘোরানোর খেলা চলে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে।
আবেদ স্কুলে যায়। শুক্কুর যায় না। শুক্কুর স্কুলে পড়বে না, এটাই যেন স্বাভাবিক। ওর বড় ভাই রহিম গুন্ডা। ওদের স্কুলে না গেলেও চলে। কিন্তু আবেদের না গেলে চলে না। পিঠের উপর চিক্কন নিম ডালের অত্যাচার নেমে আসে একদিন পড়াশোনা না করলে। তার ইচ্ছে করে শুক্কুরদের সাথে থাকতে। সোলেমানও স্কুলে যায় না। সে আবার লাটিম খেলায় আগ্রহী না। চাক্কু ছোড়ায় ওস্তাদ সে। লাটিমের বদলে চাকু ছুড়ে মারে মাটিতে। দুরে গিয়ে অদ্ভুত সুন্দর গেঁথে যায় চাকুটা মাটিতে। এত প্রতিভা যাদের, তাদের স্কুলে না গেলেও চলে।
শর্ত ছিল শুক্কুর নতুন লাটিম বসাবে গোল চক্করে, ভুসভুসে গোলাপী লাটিম না। বসিয়েছেও ঠিক ঠাক। একদম নতুন লাল-সবুজ-বেগুনী টাট্টু ঘোড়া। আবেদের চোখজোড়া স্বপ্নে ভরে যায় ওই লাল-সবুজ-বেগুনী ঘোড়াটার জন্য। তেরঙা লাটিম দুর্লভ একটা জিনিস। পাড়ায় এই একটি লাটিমই আছে। তার সাথে খেলার জন্য আবেদ নতুন কেনা লাল-সবুজকে তৈরী করেছে।
*******************************************************
লাটিমটা ছুড়ে মেরেই চোখ ছানাবড়া করে আবেদ দেখতে পেল, তার লালসবুজ বন বন করে ঘোরার বদলে ওই গোলাকার দাগের ভেতর পা গুটিয়ে বসে গেল। ব্যাপার কি? কাছে গিয়ে দেখতে পেল যেখানে গোল্লাটা আঁকা হয়েছে, সেটায় নরম মাটির আস্তরন। আর নরম মাটিতে লাটিমের পক্ষে বনবন ঘোরা অসম্ভব। তাই সে পরাজিত গরুর মতো পা গুটিয়ে বসে গেছে শুক্কুরের লাল-সবুজ-বেগুনী লাটিমের পাশে। শুক্কুরের মুখে বিটলামী হাসি, আবেদ নিরুপায় তাকিয়ে দেখে তার চোখের সামনে নতুন কেনা লাটিমটি ওর পকেটে চলে গেল।
শুক্কুর খেলা শুরুর আগেই কায়দা করে খেলার জায়গা নির্ধারণ করেছিল নরোম মাটিতে যা ছিল একটা ফাঁদ। কিন্তু বুঝতে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। আবেদের করার কিচ্ছু নেই। কদিন আর লাটিম কেনা হবে না তার। বাবাকে বললে তেড়ে উঠবে এখন। শুক্কুর টিটকারীর সুরে বললো, আরেক দান খেলবি নাকি আবিদ্যা?
আবেদ জবাব না দিয়ে চোখের জল সামলে মাথা নীচু করে বসে রইল। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না।
শুক্কুরের এই প্রতারণার অভিযোগ জানাবার কোন আদালত নেই।
No comments:
Post a Comment