Tuesday, November 14, 2017

'তখন হলুদ নদী নরম নরম হয়'


(ছবি কৃতজ্ঞতা : রায়হান সাঈদ. স্থান : মানিকগঞ্জ)


ছবিটার দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। আটকে থাকে তার মোহনীয় মাধুর্যে। এই ফ্রেমটার ভেতরে এমন কিছু উপকরণ আছে যা মুহূর্তের দৃশ্য হলেও চিরন্তন কোন অনুভব যেন ভেসে আছে। ওই নীলাভ কুয়াশা রঙের নরম নরম নদী, ওপারে হলুদ সরষে ক্ষেতের হলুদ রেখা। নদীর মাঝে চার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ কুঁড়ে ও তার প্রতিচ্ছায়া। শুকনো গাছের ডালে বসা কাক বা চিল। অভিভূত হয়ে থাকার মতো একটি মুহূর্ত এখানে স্থির হয়ে আছে। বুঝি এমনসব দৃশ্যই জীবনানন্দের কাব্যে ভেসে থাকে। এই গোটা ছবিটাই যেন একটি কবিতা। বছর আসে বছর চলে যায় কিন্তু বাংলার বুকে এই দৃশ্যগুলো পরমায়ু নিয়ে যুগ যুগ টিকে থাকে।

ছবিটা দেখে জীবনানন্দের 'কুড়ি বছর পর' কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়। ছবিটা দেখার সাথে সাথে যে লাইনটি মাথায় চলে এসেছিল - তখন হলুদ নদী নরম নরম হয়........এখানে নদী হলুদ নয়, সরষে ক্ষেতের হলুদই নদীতে ভেসে এসেছে যেন।

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভিতরে!

অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাইকো আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল!

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু সরু কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের-আমের;
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!

তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে
          বাবলার গলির অন্ধকারে
          অশথের জানালার ফাঁকে
         কোথায় লুকায় আপনাকে!
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি চিলের ডানা থামে-

সোনালি সোনালি চিল-শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !

[আবার কুড়ি বছর পরে - জীবনানন্দ দাশ]

Sunday, November 12, 2017

ভাবনার চিরকুট : বিখ্যাত লেখকের অখাদ্য পুস্তক

আমি পাঠক। বই আমার পাঠতৃষ্ণা মেটায়। কিন্তু সব বই নয়। কিছু বই তুমুল আনন্দের সাথে পড়ি। আবার কিছু বই পড়ে মনে হয় সময় নষ্ট করলাম। সেই নষ্ট সময়ের জন্য আমি কিছুটা দায়ী, কিছুটা দায়ী লেখক। আমি দায়, আমি নিজেই বইটা কিনেছি। আর কেন লেখক দায়ী সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।

জীবনের প্রথমভাগে কিছু না জেনে কেবল পাঠতৃষ্ণার জন্য পাইকারী হারে বই কিনতাম। শিল্প রুচির ধার ধারতাম না। তরুণ বয়সে অনেক কিছুই হজম হয়ে যায়। পরিণত বয়সে সব হজম হয় না। তখন বই কিনতে সতর্ক হতে হয়। নষ্ট করার মতো যথেষ্ট সময় তখন হাতে থাকে না।

পরিচিতি বিখ্যাত লেখকদের বই আমরা চোখ বন্ধ করে কিনি। অপরিচিত বা নতুন লেখকের বই কিনি না। সে বই ভালো হলেও। ভালো কিনা জানতে হলে বইটা কিনে পড়তে হয়। আমরা সেটা করি না। করি না বলে নতুন লেখকদের উঠে আসতে খুব কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়। নতুন লেখকের ভালো বইটি যেখানে বাজার পায় না সেখানে বিখ্যাত লেখকের অখাদ্য বইও বহুগুন বেশী বিক্রি হয়।

বিখ্যাত লেখকদের সবাই চেনেন। তাঁরা যা লেখেন তাইই প্রকাশিত হয়। পড়ে সময় নষ্ট হয় তেমন বইও হু হু করে বিক্রি হয়ে যায় বলে জেনে শুনেই অখাদ্য লেখা লিখতে থাকেন। সাইনবোর্ডের কারণেই সব বিক্রি হয়ে যায়। বইয়ের দোকানগুলোর একটা বড় অংশ বিখ্যাত লেখকের অখাদ্য বইতে ভরে থাকে। অথচ সেই বইগুলো না লিখলে জগতের ক্ষতি তো হতোই না বরং অন্য কিছু লেখকের উপকার হতো।

বিখ্যাত লেখকরা অবসর নেন না। লেখার ধার মরে গেছে, সৃষ্টিশীলতার সময় শেষ হয়ে গেছে বলে কোন লেখক লেখা থামিয়ে দিয়েছেন, তেমন লেখক দেখিনি। বইমেলা আসলেই দেখা যায় একই লেখকের ডজন ডজন বই বের হয়ে বাজার সয়লাব। ফলে বইমেলায় রুচি বৈচিত্রের অভাব দেখা যায়। পরিণত পাঠক কাংখিত বই খুঁজে পায় না, নতুন বইয়ের প্রতি আগ্রহ জাগে না। তবু সংখ্যার বিচারে নব্য পাঠকের পাল্লা ভারী থাকে বলে বিখ্যাত লেখকের শিল্পমানহীন নিন্মরুচির বইও শীর্ষ কাতারে ভাসতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখে গেছেন। কিন্তু সবাই রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন না। চাইলেই

এই প্রসঙ্গে একজন লেখক আত্মসমালোচনা করে লিখেছিলেন - 'আমরা লেখক। অন্য গ্রহ থেকে এসে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছি। নিত্য প্রসবিনী। নিত্য প্রকাশমান। অশক্ত হওয়া অবধি লিখে যাব.........বাবুর প্রথম গল্প ১৯৪৬ সালে সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৫৬ সালে তিনি যুগের প্রথম মশালচি হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকেই তিনি একটি নাম। এবং এই নাম হবার পর থেকে তিনি অহম্, যা-লিখি-তাই-ই-লেখার মনোভাবে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে যান। তখন তিনি আর শিল্প নন। তিনি পত্রিকার অলংকার।' [মহাকাল মেলের প্যাসেঞ্জার- শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়]

অলংকার শব্দটি এখানে গুরুত্ববাহী। পত্রিকার 'অলংকার' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর থেকেই তাঁর রচনাবলী আক্ষরিক অর্থেই পাঠকের সময় নষ্টের হাতিয়ার হয়ে যায়। অর্থ ছাড়া অন্য কোন তাগিদ না থাকলেও তিনি লিখতেই থাকেন। নেহায়েত অর্থের জন্য উৎপাদিত পুস্তকসমূহ পাঠকের বিপুল সময়ের অপচয় ঘটায়। পাঠক হিসেবে এই বিষয়ে আমি বিরক্ত বোধ করি। বিখ্যাত হলেই বছর বছর অখাদ্য রচনা লিখে বাজার সয়লাব করে ফেলতে হবে? বই তখন পণ্য, কাগজ তখন সের দরে বিক্রিযোগ্য।

প্রিয় লেখক, আপনি ততক্ষণই লিখুন, যতক্ষণ আপনার ভেতর সৃষ্টিশীলতা কার্যকর থাকে। নইলে নীরব অলংকার হয়েই আপনি সৌন্দর্য বিতরণ করুন। পেটের দায় না থাকলে লিখে পাঠকের সময় নষ্ট না করাই ভালো।

[পুনশ্চঃ সেইসব লেখকের নাম উল্লেখ করে বিব্রত করলাম না। আমাদের সবারই পছন্দ অপছন্দের বই আছে নিজেদের বুকশেলফে। সেখানেই তাঁদের নাম মিলবে]

পাওয়া না পাওয়ার সুখ


আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম। এটার অর্থ কী? পাওয়া বলতে ঠিক কী বোঝায়?

আমার পকেটে অনেক কাংখিত একটি টাকার নোট আসলো। ৫০০ টাকার একটা চকচকে নোট। এই নোট একান্ত আমার। আমি চাইলে এটাকে খরচ করতে পারি, চাইলে ভাঙ্গাতে পারি। চাইলে ভেঙ্গে ভেঙ্গে দশ বারে খরচ করতে পারি, চাইলে একবারেও করতে পারি অথবা এটাকে ভাঙিয়ে দশটা পঞ্চাশ কিংবা পাঁচটা একশো অথবা অন্য যে কোন রূপে ভাংতি করিয়ে পকেটে রেখে দিতে পারি। এই পাঁচশো টাকার নোটটাকে আমি রীতিমত ভালোবেসে ফেললাম। এত সুন্দর নোট কখনো আমার হয়ে আসেনি আগে। এত বড় নোট আগে কখনো দেখিনি আমি। আমার ভীষণ আনন্দ আজ এটাকে পেয়ে। আনন্দে আমার খিদে চলে গেছে। রাতের ঘুম উধাও। আমি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শুধু পাঁচশো টাকার নোটের দিকে তাকিয়ে দিন কাটিয়ে দিতে পারবো। এই হলো পাওয়ার আনন্দ। আমি পাইলাম, যাকে পাইলাম তাকে ইচ্ছেমত ভোগ করিব। কেউ কিছু বলবে না, কেউ আপত্তি করবে না। এ শুধুই আমার। হ্যাঁ এটাকেই বলে পাওয়া। কিন্তু এই টাকা যখন খরচ হয়ে যাবে তখন কী পাওয়ার আনন্দটা জেগে থাকবে? না। খরচ হয়ে যাবার পর আর কোন আনন্দ থাকে না। তখন বড়জোর টাকা পাওয়ার এবং খরচের স্মৃতির সুখ।

যখন কোন মানুষকে পাওয়ার কথা বোঝানো হয়, তখন ঠিক কিরকম দাঁড়ায় ব্যাপারটা? ভালোবাসার মানুষটিকে আমি পাইলাম। পেয়ে যাবার পর মানুষও কি এরকম খরচ হয়ে যেতে পারে? টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে মানুষটির দর্শনসুখ, সঙ্গসুখ, স্পর্শসুখ উপভোগ করতে একসময় ফুরিয়ে যাওয়া? ইন্দ্রিয়ের ভেতর এই তিনটি সুখই মানুষ পেতে পারে প্রিয় মানুষ থেকে। তারপর একদিন সেই সুখের উপর মরিচা পড়ে, আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যেতে থাকে ঐন্দ্রিক আকর্ষণ। পাশে থাকলেও সেই মানুষকে আগের মতো ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে কখনো কখনো। যার উপস্থিতি একসময় প্রবল রকমের কামনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তার অনুপস্থিতিই তখন কামনা হয়ে দাঁড়ায়। বলা হয় সম্পর্ক ঝুলে গেছে। আসলে এখানেও টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে মানুষটি। তখন বড়জোর স্মৃতিটুকু বেঁচে থাকে। কিন্তু খরচ হয়ে যাওয়া জীবিত মানুষের স্মৃতিও বিরক্তির আধার হয়। এমন সময়গুলো মানুষের দুঃসময়।

আসলে পাওয়া জিনিসটা একটা মুহূর্তসুখ মাত্র। পাওয়া মানে কাছে পাওয়া কিংবা দর্শন পাওয়া কিংবা স্পর্শ পাওয়া। তিনটি পাওয়াই একান্ত অনুভবের ব্যাপার। সব রকম পাওয়াই আসলে একেকটি আপেক্ষিক অনুভব। যে অনুভবের ঘটনা ঘটতে পারে বাস্তবের কোন সঙ্গস্পর্শ ছাড়াই। শুধু চোখে দেখে, কানে শুনেও মানুষ পাওয়ার সুখ অনুভব করতে পারে। যদি অনুভবের শক্তি তেমন হয়। এটা মোটেও অলৌকিক নয়, নিতান্তই মানবিক বোধের গভীরতা। যার ছবি দেখে আমার ভালো লাগলো, যার চিঠি পড়ে আমার ভালো লাগলো, তাকে শব্দ এবং দৃশ্যের মাধ্যমেই স্পর্শসুখ অনুভব করতে সক্ষম মানুষের মন। একটা বাস্তব মানুষকে স্পর্শ করে যে সুখ, যে রাসায়নিক বিক্রিয়া আমাদের মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে, আনন্দ ও পুলক জাগায় শরীরে, সেই ঘটনা ঘটতে পারে শুধুমাত্র ছবি দেখে কিংবা কল্পনা করেও। তাহলে কাছে না পেয়েও, স্পর্শ না করেও পাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। সত্যিকারের পাওয়া যেমন ঘটনা ঘটার পর স্মৃতিতে ঠাঁই নেয়, কল্পনায় ঘটা ঘটনাটিও একইভাবে স্মৃতিভুক্ত হয়। যখন স্মৃতিভুক্ত হয় তখন দুই ঘটনার মধ্যে পার্থক্য খুব বেশী থাকে না।

Sunday, November 5, 2017

বই বনাম সিনেমা

বই পড়ার আনন্দ আর সিনেমা দেখার আনন্দ - দুটো আলাদা বিষয়। এর মাঝে কোনটি বেশী আনন্দের সেটা ব্যক্তিভেদে নিশ্চয়ই আলাদা হবে। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত যে একই গল্প বইয়ে পড়া এবং সিনেমায় দেখার মধ্যে তুলনা করতে গেলে বইই জিতবে। শব্দের শিল্পিত উপস্থাপনা চলচ্চিত্রে হুবহু আনা অসম্ভব। সিনেমার যে সীমবদ্ধতা আছে সেটা মেনে নিতেই হবে। কোন উপন্যাসকে যখন চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করা হয় তখন সেই চলচ্চিত্র উপন্যাসকে ছুঁতে পেরেছে তেমন নজির খুব কম। পঠিত কোন উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ নির্মিত হলে সেটা সযত্নে এড়িয়ে থাকি স্বপ্নভঙ্গের আশায়। খুব প্রিয় বই হলে আরো বিপদ। সেই বই পড়তে গিয়ে পাঠকমনে যে চিত্র দাঁড়িয়েছিল, সিনেমার নতুন চিত্র দেখে পুরোনো চিত্রটি আহত তো হয়ই, কখনো কখনো কালিমালিপ্ত হয়ে যায়। সমরেশের 'কালবেলা' অবলম্বনে তৈরি সিনেমার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল।

একটা সময় পঠিত উপন্যাসের চলচ্চিত্র দেখার খুব আগ্রহ ছিল। খুঁজে খুঁজে বের করতাম। কিন্তু কয়েকটা দেখার পর এমন স্বপ্নভঙ্গ হলো এখন আর ওপথ মাড়াই না। এখানে একটা বিষয় স্বীকার করে নিতে হয় যে পৃথিবীর অনেক উপন্যাসনির্ভর বিখ্যাত চলচ্চিত্র দেখা হয়নি আমার, সব বিখ্যাত বই পড়াও হয়নি, সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু যতটা দেখা হয়েছে তার ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে সিনেমা কখনো বইকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।

আমার তেমন কয়েকটা ব্যতিক্রমও আছে যেখানে বই এবং সিনেমা দুটোই আলাদা রকমের আনন্দ দিয়েছে। কে কাকে ছাড়িয়েছে তার বিচার করতে হয়নি। 'পথের পাঁচালী' সেরকম একটা ব্যতিক্রম। একই ঘটনা আশা করেছিলাম Crime and Punishment এর চলচ্চিত্ররূপ দেখতে গিয়ে। বলা বাহুল্য হতাশ হয়েছিলাম। সিনেমা হিসেবে অবশ্যই উত্তীর্ণ কিন্তু বইয়ের সাথে তুলনা? অসম্ভব। আবার কাফকার The Trial এর চলচ্চিত্ররূপ আলাদা রূপে মুগ্ধতা আনে পরিচালনার দক্ষতায়।

যে হতাশা থেকে লেখাটা মাথায় ঘুরছিল সেটা অন্য একটা হালকা রকমের বই। জেরোমে কে জেরোমের Three Men in a Boat (সেবার অনুবাদ ত্রিরত্নের নৌবিহার)। আমার সর্বকালের সেরা প্রিয় বইয়ের একটি। বইটি অসংখ্যবার পড়েছি সেবার অনুবাদে। মূলটাও পড়েছি। এই বইটি সেবা ছাড়া অন্য অনুবাদে সেই রস নেই। প্রায় বিশ বছর পর সেদিনও আবার পড়লাম। এখনো হেসে গড়িয়ে পড়ি। চ্যাপলিনের সিনেমার মতো এই বইটিও কখনো পুরোনো হবে না আমার কাছে। কিন্তু বইটির উপর কোন ভালো চলচ্চিত্র নির্মান হয়নি। যে কয়টি নির্মিত হয়েছে তার সবগুলোই অতি নিন্মমানের। যে কেউ বইটি পড়ার আগে যদি সিনেমাটা দেখে তাহলে অবশ্যই হতাশ হবে। চুটকি টাইপের মজা হয়তো পাবে, কিন্তু বইটা পড়ার মধ্যে যে সর্বগ্রাসী একটা আনন্দের ব্যাপার আছে তা সিনেমায় এক শতাংশও পাবে না।

আরেকটি বই ন্যাথানিয়েল বেঞ্চলির Russians are Coming অবলম্বনে যে সিনেমাটি তৈরী হয়েছে সেটার শিল্পিত অবস্থান বিচারে ভাল বলা গেলেও মূল বইয়ের অনেকখানিই তুলে আনতে পারেনি। এই সিনেমাটিও অনেক আগ্রহ নিয়ে খুঁজে বের করেছিলাম। তবে জেরোমের বইয়ের সিনেমার চেয়ে এটাকে ভালো রেটিং দেয়া যায়।

একটা প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এখন। তা হলো বইয়ের সাথে সিনেমার তুলনা আদৌ প্রাসঙ্গিক কিনা। সবসময় নয়। যখন বইটি চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয় তখন এই প্রশ্নটি আসতে পারে। আমরা যখন কোন বই পড়ি তখন মাথার ভেতরে, স্মৃতির কোষে কোষে সেই শব্দের একটি রূপকল্প জমা হতে থাকে। একই বই একেক জনের মস্তিষ্কে একেক রকমের রূপকল্প জমা করে। যখন একটা ঘটনার বর্ননা পড়ি তখন সেই ঘটনার একটা চলমান রূপ আমাদের স্মৃতিতে বসে যায়। বইটি যখন আবার পড়ি তখন ওই রূপকল্পটি ভেসে ওঠে। যতবার পড়ি ততবার সেই একই চিত্র। অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে তাই দেখেছি। কিছু কালো কালো অক্ষর আমার ভেতরে যে রঙিন চিত্র ধারণ করে রেখে দিয়েছে, সেটা কখনোই আরেকজনের সাথে মিলবে না। যার যার চিত্র তার ভেতরে জমা আছে। যিনি সিনেমা তৈরী করছেন তাঁর মাথায়ও নিশ্চয়ই সেরকম একটা চিত্র বাঁধানো আছে। সেটাকে ভিত্তি করেই তিনি গল্পটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন। সুতরাং যে মানের সিনেমাই তিনি বানান, আমার সাথে কখনোই মিলবে না। যতটা অমিল, যত বেশী দূরত্ব, তত বেশী হতাশ হই আমরা সিনেমাটি দেখে। সুতরাং প্রিয় কোন উপন্যাস অবলম্বনে তৈরী হওয়া সিনেমা না দেখাই শ্রেয়।

বইয়ের সাথে সিনেমার তুলনা হয় না। অক্ষরের সাথে দৃশ্যের প্রতিযোগিতা হয় না। একটা বই তার প্রতিটি অক্ষরের ছায়ায় যে আনন্দ লুকিয়ে রাখতে পারে সেটা আর কিছুতে সম্ভব নয়। একেকটি বাক্যে যে কটি শব্দ আছে, সেই শব্দে যে কটি অক্ষর আছে, তার সুবিন্যস্ত উপস্থাপনা আমাদের মগজের কোষে কোষে ছড়িয়ে দেয় অপার্থিব কিছু অনুভূতি যা পাঠ-প্রতিক্রিয়া জাতীয় লেখা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সে আনন্দ একেবারে নিজস্ব। সে ভূবনে অন্য কিছুর যাতায়াত নেই। বইয়ের সাথে এই বন্ধুতা যে অনুভব করে না, তার বই পড়া অর্থহীন।

সিনেমার আনন্দ আসলে অন্যত্র। কোন একটা দৃশ্য যা আমাদের স্মৃতিতে জমা থাকে, যা আমার একার সম্পদ, তাকে চোখের সামনে উপস্থাপন করা গেলে আর সবার সাথে বসে উপভোগ করা সম্ভব। যে গল্পটি আমরা বই পড়ে আলাদা আলাদা চিত্রকল্প সংরক্ষণ করতাম মাথার ভেতর, তাকে যদি চলচ্চিত্ররূপে দেখি তাহলে আমাদের সবার স্মৃতিকোষে একই রকম চেহারায় জমা থাকবে। এটা ভালো কিংবা মন্দ সে বিচার প্রত্যেকের কাছে আলাদা।

তবে সর্বযুগে বইই সেরা থাকবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগেও এমন কিছু আবিষ্কার হয়নি, যা বইকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। মজার ব্যাপার হলো এই সত্যটা জানে কেবল যারা বই পড়ে, ভালোবাসে তারাই। বাকী দুনিয়ার কাছে এ সত্য কখনো পৌঁছে না। যারা বই পড়ে তারা ভাবে - ওরা বই না পড়ে কিভাবে থাকে? আর যারা পড়ে না তারা ভাবে - ওরা বই পড়ে সময় নষ্ট করে কোন দুঃখে? পৃথিবীতে বই না পড়া দল অবশ্যই ভারী, অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতও থাকবে। এর একটা অন্ততঃ ভালো দিক আছে। সবাই বই পড়লে অত বই ছাপাতে গিয়ে পৃথিবীর গাছপালা সব কেটে ফেলতে হতো। কাগজ হতো পৃথিবীর প্রধান বাণিজ্য।



Monday, October 30, 2017

অনর্থের অর্থ

সামর্থ্য থাকলে বিপদগ্রস্থ বন্ধুবান্ধবকে সাহায্য করা হলো সাধারণ মানবিক একটি চরিত্র। আজকাল এই মানবিকতাটা উঠে যাচ্ছে। বিপদগ্রস্থ বন্ধুবান্ধব দেখলে ভয় পায় স্বচ্ছল বন্ধুরা। যদি ফেরত দিতে না পারে সেই ভয়ে অনেকে বিপদগ্রস্থ বন্ধুর সাক্ষাতে প্রথমেই জানিয়ে দেয় কিরকম অসুবিধার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে সে। এমনকি ঘনিষ্টতম বন্ধুও তাই করে।

আজকেই তেমন একটি ঘটনা দেখলাম। কনক এসে নয়নকে জানালো তার দেড় লাখ টাকা দরকার দুই মাসের জন্য। ব্যবসাটা শুরু করতে পারছে না এই সামান্য টাকার জন্য। কোন উপায় না দেখে নয়নের কাছে ধার চাইতে হচ্ছে। নয়ন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুর একজন। 

নয়নের ব্যাংকে যে টাকা জমা আছে তাতে দেড় লাখ টাকা দেবার পরও আরো লাখ খানেক থাকবে। ওই দেড় লাখ না থাকলে দুই মাসের মধ্যে না খেয়ে মরবে না সে। তবু কনকের ধারের কথা শুনে সতর্ক অবস্থানে চলে গেল। জানালো সে ইতিমধ্যে একটা বিপদে পড়ে গেছে। আরেক বন্ধুকে দুই লাখ টাকা দিয়েছিল ব্যাংক ঋণ নিয়ে, সে টাকা এখনো ফেরত আসেনি। নইলে কনককে ঠিকই দিত টাকাটা। নয়নের কথাটা আংশিক সত্য। সে এক বন্ধুকে দু লাখ টাকা দিয়েছিল ছমাসের জন্য, সে টাকা হাওয়া হয়ে গেছে, সাথে বন্ধুটিও। সেই থেকে নয়ন কাউকে টাকা ধার দিতে ভয় পায়। টাকা থাকলেও দেয় না।

কিন্তু এ হলো কনক। তার জানের বন্ধু। যে বন্ধু তার যে কোন বিপদে সহায়। যে কোন সমস্যার কথা প্রথমে যাকে খুলে বলে সে হলো কনক। তাছাড়া বর্তমানে নয়নের ব্যাংকে আড়াই লাখের বেশী আছে। অলস পড়ে আছে। নয়ন চাইলে সেখান থেকে অনায়াসে কনককে দেড় লাখ টাকা ধার দিতে পারে। তবু দিল না। বরং নিজেও কঠিন অভাবে আছে জানিয়ে কনকের কাছে অপারগতা প্রকাশ করলো।

কনক ফিরে যাবার পর নয়নের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিল। কাজটা ঠিক হলো না। নয়ন ব্যবসা শুরু করতে না পারলে পরিবার নিয়ে বিপদে পড়ে যেতে পারে। নয়ন আমাকে ফোন করে ঘটনাটা বললো। দুজনেই আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। কে বেশী ঘনিষ্ট ভাবিনি কখনো। তবে দুজনেই কিছু গোপন কথা আমার কাছে জমা রাখে। নয়নের অপারগতা আমাকে ব্যথিত করলেও এই সরল স্বীকারোক্তি আমাকে মুগ্ধ করলো। কনক আমারো বন্ধু। তবু আমার কাছে না এসে নয়নের কাছে চেয়েছে কেননা কনক জানে আমার হাতে অত টাকা থাকে না। আমার সাথে ওর লেনদেন দশ হাজার টাকার ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে।

নয়নের কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে আমি ফোনটা হাতে নিলাম কনকের সাথে কথা বলার জন্য। গত মাসে আমার হাতে ষাট হাজার টাকা এসেছে। সেই টাকা বাসায় অলস পড়ে আছে। ভাবছি ওখান থেকে পঞ্চাশ হাজার ওকে দেবো কিনা। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়েই একটা স্বার্থপর চিন্তা মাথায় এসে ধাক্কা দিল। ডিসেম্বরের শুরুতে আমার বড় একটা খরচ আছে, বাচ্চাদের স্কুল ভর্তি। সেই সময়ে যদি কনক টাকাটা ফেরত দিতে না পারে? আমি ফোনটা রেখে দিলাম। মনে মনে শান্ত্বনা দিলাম নিজেকে, কনক আমার কাছে তো চায়নি। আমি আগ বাড়িয়ে দেবো কেন?

ভাবছি, আমি ও নয়ন দুজনের মধ্যে কে বেশী খারাপ বন্ধু? বন্ধুতার সংজ্ঞা নিরূপিত হয় স্বার্থত্যাগের মাত্রার উপর। আমরা কে বেশী মাত্রার স্বার্থপর? নয়ন কনককে বিশ্বাস করতে পারছে না, আর আমি বন্ধুর স্বার্থকে পরিবারের স্বার্থের উপরে বসাতে পারছি না।

অর্থ অনর্থের মূল কিনা জানি না, কিন্তু অর্থ জিনিসটা মানুষের অভাব দূর করার কাজে যতটা লাগে, মানুষের চরিত্র এবং আন্তরিকতা মাপার জন্য তারো চেয়ে বেশী লাগে।

Thursday, October 26, 2017

নগরে নতুন উৎপাত

আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত যেসব উৎপাত সহ্য করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো শব্দ দুষণ৷ তার সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে কিছু ইতর তরুনের কান ফাটানো উচ্চ শব্দে যানবাহন চালনার ভয়ানক কুআচার৷

মোটর সাইকেল এবং কার দুই বাহনের সাইলেন্সার খুলে যত জোরে সম্ভব আওয়াজ তুলে মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাওয়া৷

মাঝরাতে ঘটনাটি বেশি ঘটে যখন রাস্তা খালি থাকে৷ এদের একটা দল আছে শহরে যারা রেসিং কার বানাতে চায় সাধারণ গাড়িকেও৷

মানুষের উপর শব্দের অত্যাচার করে বিনা কারণে বিকট শব্দ তুলে গাড়ি চালাবার কুৎসিত মানসিকতার এই নষ্ট তরুনেরা কেউ আইনের শেকলে বাধা পড়েনি এখনো৷ কেননা শব্দ নির্যাতন এদেশে অপরাধ বলে বিবেচিত হয়নি কখনোই৷ অথচ কান ছাড়াও শরীরের অন্য অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে৷ বন্ধ হয়ে যেতে পারে হৃদপিণ্ডের ঘড়ি৷

এই উৎপাত বন্ধ করার উপায় কী? আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিতে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া? নাকি আইন নিজেই এগিয়ে আসবে প্রতিকার করতে?

Tuesday, October 24, 2017

অপরাজিতা স্মৃতি

আমার ঘরের বাইরে অপরাজিতার ঝোপ, পাতার ফাঁকে নীল চোখ মেলে বর্ষায় অপরাজিতা ফুল তাকিয়ে থাকে। শরৎকালে উঠোনে ফোটে স্থলপদ্ম, পায়ের ছোঁয়ায় লজ্জাবতী কুঁকড়ে যায়, ঘাসের সবুজে লাল কেন্নো জ্বলজ্বল করে। শীতের দিনে শুকনো পাতার গন্ধ ভাসে হাওয়ায়। চৈত্র মাসে বাতাস ছুটে আসে দুদ্দাড়- আমার টেবিলের কাগজপত্র উড়িয়ে নেয়, নিবিয়ে দেয় আমার সন্ধেবেলার কেরোসিন ল্যাম্প। খোলা মাঠের মধ্যে একলা সেই টিনের ঘরটা জ্যৈষ্ঠের দুপুরে উনুন হয়ে ওঠে, আর মাঘের রাত্রে বরফের বাক্স। ঘরে বসে শুনি শুকনো পাতা ঝরে পড়ে ঝর্ঝর, কোনো স্তব্ধ রাতে আঁতুড়ের শিশুর গলায় কান্না বটগাছে কোন পক্ষীশাবক ডেকে উঠলো। কখনো শুনি সারা দুপুর ছাদ পেটানো গান- সারেঙ্গি বাজে একটানা, তালে-তালে মুগুর পড়ে ধ্রাম-ধ্রাম, সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গেয়ে চলে কুড়ি-পঁচিশটি মুগুর পেটানো বাচ্চা ছেলে উব-হাঁটু হয়ে বসে, সারা গায়ে-মাথায় রোদ্দুর নিয়ে, অক্লান্ত। বর্ষা নামে বিশাল- আকাশ ছেয়ে, প্রান্তর ছেয়ে, পৃথিবী জুড়ে, ধোঁয়াটে নীল কালো মেঘের ভিড়ে নিবিড়- আমাদের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে যেন হাজার সেতারের রিমঝিম বাজনা। বাইরে কাঁচা রাস্তায় কাদা, মাঠে মাঠে ঘাস আরো লম্বা, সব ফোকর ডোবা হয়ে উঠলো, ব্যাঙেদের ফুর্তি অঢেল। কখনো কোনো বৃষ্টি থেমে যাওয়া মধ্যরাতে মেঘ চুঁইয়ে ঝরে পড়ে জ্যোছনা। মাঠের উপর রাত্রি হয়ে ওঠে নীলাভ, আর সবুজ, আর রহস্যময়। কখনো সারারাত বৃষ্টির পরে সূর্য উঠে আসে উজ্জ্বল, নতুন উৎসাহে দখল করে নেয় জগৎটাকে। আবার কখনো কোনো মেঘলা সকালে হাওয়ায়-হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় গান- কনক দাশের কন্ঠে 'আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে পিছু ডাকে-' আমার মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সম্মোহন -  কোনো সুখ, যা মুখে বলা যায় না, কোন দুঃখ, যা সুখের চেয়েও ভালো।





ছবি কৃতজ্ঞতা : শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদের ফেসবুক পোস্ট


এই বর্ণনার সাথে আমার স্মৃতির সম্পর্কটা এতই গভীর যে পড়ার মাঝখানেই কিছু সময় থেমে গিয়ে ফিরে যাই আশির দশকে। বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনীতে বিশ দশকের নয়াপল্টনের স্মৃতির বর্ণনার সাথে আমার নিজের পুরোনো বাড়িটার অদ্ভুত কিছু মিল। বর্ণনার মধ্যে শুধু কয়েকটি শব্দ একটু বদলে দেয়া হয়েছে।


আগ্রাবাদের বেপারিপাড়া মসজিদের পশ্চিমের গলিটা একশো গজ উত্তর দিকে এগিয়ে বামদিকে তাকালে ধূ ধু সবুজ ধানক্ষেত। তার মধ্যে দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন একতলা টিনশেড বাড়ি উঠেছে। এলাকাটির নতুন নাম গুলবাগ। জনবিরল সেই আবাসিক এলাকায় যাবার একটি কাঁচা মাটির রাস্তা এঁকে বেঁকে থেমে গেছে একটি নির্জন পুকুর পাড়ে। তারো কয়েকশো গজ আগে একটা একটি বাড়ি। চারপাশ ঘেরা একতলা টিনের চৌচালা বাড়ি। বাড়ির সামনে একটা বাগান। ফুল ফল তরিতরকারি সবুজে সজীবতা ছড়ানো একটা গ্রামীণ পরিবেশ। শহরের মাঝখানে এমন দৃশ্য খুব বিরল। চারদিকে শহর রেখে মাঝখানে যেন এক টুকরো গ্রাম। যেখানে তখনো কৃষকেরা ধান কেটে শুকোতে দিত হেমন্তের রোদে। কুয়াশাভেজা খড়ের সোঁদা গন্ধে উতলা হয়ে যেতো প্রাণ। নগর হয়ে ওঠার আগে বেশ কয়েক বছরের দৃশ্য ছিল এমনই মুগ্ধতার। বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিকথা উস্কে দিল এমন কিছু নিমজ্জিত অতীতের ছবি।

Saturday, October 21, 2017

প্রথম ডায়েরী ১৯৮৫

কিছু কিছু পুরোনো জিনিস আমার কাছে এতই যত্নের সাথে আছে যে শতেক দুর্যোগ, দুঃসময়, দুর্ভোগ সবকিছু পেরিয়েও কিভাবে যেন ঠিকঠাক রয়ে গেছে। বাবার দেয়া এই ডায়েরীটাও তেমন। আমার জীবনের প্রথম ডায়েরী। বাবার সর্বশেষ কর্মস্থলের স্মারক।


বহুদিন পর দেরাজ খুলে বের করে হাতে নিয়ে ৩২ বছরের ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করলাম। ডায়েরিটার ছবি তুলে স্মতির একটা নজির রেখে দিতে ইচ্ছে করলো। আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ার প্রথম তারুণ্যের একটা স্মৃতি। এখানে আমার পরবর্তী এক দশকের চিন্তাভাবনাগুলোর বিবর্তন আঁকা আছে টুকরো টুকরো কথায়। কিছু কিছু কথা পড়ে এখন হাসি পেয়ে গেল। বয়সের তুলনায় অনেক অগ্রসর কিছু ভাবগম্ভীর দার্শনিক ভাবনা। এই বয়স হলে মেনে নেয়া যেতো, কিন্তু তিন দশক আগে আমি তেমনটি ভাবতাম? বিশ্বাস হতে চায় না।

এই ডায়েরীপ্রাপ্তির এক দশকের মধ্যে আমার শিক্ষাজীবনের অবসান ঘটে  এবং যেদিন কর্মজীবনে প্রবেশ করি সেদিন থেকে এই ডায়েরীর লেখারও অবসান ঘটে। দশ বছর ধরে একটা ডায়েরীতে সীমাবদ্ধ থাকার অন্যতম কারণ হলো বিশেষ কোন ঘটনা না ঘটলে এখানে লেখা হতো না। এই ডায়েরীর পাতাগুলো এত মসৃণ, এত সুন্দর যে কখনো এলোমেলো কিছু লেখা হতো না। দৈনিক কোন ঘটনার চেয়ে ইস্যুভিত্তিক লেখাই বেশী স্থান পেয়েছে। আমার লেখালেখির যাত্রা শুরু এই ডায়েরী থেকেই। যদিও তখনো আমার ধারণা ছিল না কখনো লেখালেখির জগতে আসবো কিনা।

এই ডায়েরীর পর আরো অর্ধডজন ডায়েরী লেখা হয়েছে পরবর্তী ২০ বছরের কর্মজীবনে, কিন্তু এটাকেই সবচেয়ে মূল্যবান বলে মানি এখনো। এই পাতাগুলোর পরতে পরতে আমার ৩২ বছর পুরোনো জীবনটা লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে উল্টেপাল্টে দেখতে হয় সেই সময়টাকে। মাঝে মাঝে জীবন এমন কিছু কঠিন সময় পাড়ি দিয়েছে তার কোন চিহ্ন এখন আর কোথাও নেই এই ডায়েরীর পাতা ছাড়া। শুধু স্মৃতিকাতরতা নয়, নিজের আদি সত্ত্বাকে আবিষ্কার করার জন্যও পুরোনো ডায়েরীর বিকল্প নেই। যে চিন্তাভাবনাগুলো মগজে খেলতো, যে পৃথিবীকে ওই চোখে দেখেছিলাম, যে সমাজ আমাকে ঘিরে রেখেছিল তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে এই সময়ে এসে? যে আদিম হতাশাগুলো আমাদের জীবনের উপর আরোপিত ছিল তার কতখানি অবসান ঘটেছে এই একুশ শতকে এসে? উত্তরগুলো মনে মনেই খুঁজি।

আরো একটি কারণে ডায়েরীটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার তারুণ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটা এই ডায়েরীর অন্তর্গত। না, এমন না যে আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সম্পর্কে খুব একটা লিখেছি। কিন্তু সেই সময়টা, আশির দশকের সেই ক্রান্তিলগ্নটা আমার বেড়ে ওঠার গতিপথ নির্ধারণ করে দিচ্ছিল। আমি কোন পথে যাচ্ছিলাম, ভাবছিলাম, পড়ছিলাম, দেখছিলাম সবকিছুর টুকরো টুকরো উদাহরণ ছড়ানো আছে বিক্ষিপ্তভাবে। কোন কোন লেখার তারিখও দেয়া হয়নি। ওই সময়টা বর্তমানের 'আমি'কে গড়ে তুলছিল। সেই আমি আর এই আমির মধ্যে যে পার্থক্য সেটা শুধু বয়স এবং সামাজিক অবস্থান। বাকীটা অনেকাংশে পুরোনোতে রয়ে গেছে। পেছনের দিন তাই আমাকে এত বেশী টানে।


Thursday, October 19, 2017

(বে)তমিজউদ্দিন কোং লিমিটেড

১৬৩০ সালের এক মেঘলা দুপুরে তমিজউদ্দিন চারটা বাণিজ্য জাহাজে পণ্য নিয়ে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দরে ঢুকে পছন্দমতন জায়গা বেছে নোঙর ফেললো। জায়গাটা বড় সুন্দর নিরিবিলি। এখানে একটা ফ্যাক্টরি করতে পারলে মালামাল আমদানি রপ্তানি গুদামজাত করা ইত্যাদির বেশ সুবিধা হতো। আবহাওয়া ঠাণ্ডা মেন্দামারা হলেও জায়গা খারাপ না।

ভাবনাটি কাজে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হলো সাথে সাথে। দুত পাঠিয়ে রাজার কাছ থেকে একটা অনুমতিপত্র আনা হলো। শর্ত হলো বছরে ৩ হাজার পাউন্ড ট্যাক্স দেয়া লাগবে। তমিজউদ্দিন তাতে রাজী।

অতঃপর নদীর তীরে গাছ কেটে পরিষ্কার করে কয়েকটা ছাউনি তুলে নিজেদের মালামালগুলো রাখতে শুরু করলো তমিজ। কিন্তু স্থানীয় ইংরেজরা ঝামেলা পাকাতে শুরু করলো কদিন না যেতেই। ঘোড়ায় করে এসে হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে উঠে যাবার জন্য। ঝামেলা এড়াতে চারদিকে বড় দেয়াল তুলে ভেতরে কিছু সশস্ত্র সৈন্যকে পাহারায় রাখতে হলো।

একটা দুর্গ তৈরি করতে পারলে আরো ভালো হতো। কদিন পর ইট পাথর দিয়ে মোটামুটি একটা দুর্গও তৈরি করা হলো। এবার সৈন্য দরকার আরো। দরকার কিছু কামানও।

বাংলাদেশে খবর পাঠালে তমিজউদ্দিন লিমিটেডের হেড অফিস আরো তিন জাহাজ ভর্তি করে সিপাহী পাঠিয়ে দিল। সাথে দেড়শো কামান। সেই জাহাজ বন্দরে ঢোকার সময় স্থানীয় ইংরেজ প্রশাসক এণ্ডারসন বাধা দিল। তার  বক্তব্য হলো এখানে শুধু বাণিজ্য করা যাবে, দুর্গ নির্মাণ করা যাবে না, এত সৈন্য রাখা যাবে না।

এই কথা শুনে তমিজউদ্দিন ক্ষেপে গেল। মশকারি পাইছস? বচ্ছরে তিন হাজার টাকা টেকসো দিয়া লাইসেন্স নিছি বেবসা করার, লিজ নিছি এই এলাকা। আমি এখানে ব্যবসা করমু, সৈন্য রাখমু, আমার বেবসার নিরাপত্তা আমি দেখমু, তুই এখানে মাতব্বরী করস কোন বাপের সাহসে? বেশী তড়পাইলে গুলি মেরে খুলি উড়িয়ে দেবো। পিস্তল বাগিয়ে বেরিয়ে এলো তমিজউদ্দিন। হুকুম দিল, কামান দেগে গুল্লি মেরে উড়ায়ে দে সব!

দেশ থেকে আসা জাহাজ থেকে কামান দাগানো হলো। দুই পক্ষে তীব্র গোলাগুলি শুরু হলো। তমিজউদ্দিনের বাহিনী সুশিক্ষিত এবং ভয়াবহ রকমের দুর্ধর্ষ। ভদ্রগোছের ইংরেজরা তাদের সাথে টিকতে না পেরে পালিয়ে গেল। ইতিমধ্যে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেলে তমিজউদ্দিন সাউদাম্পটন বন্দর ও পাশের শহরটি দখল করে নিল।

অতঃপর তমিজের সেনাপতি রাজা জেমসের কাছে দুত পাঠিয়ে বললো সাউদাম্পটন শহরটি তমিজউদ্দিনের নামে লিখে দিতে হবে এবং তমিজউদ্দিন লিমিটেডকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য অধিকার দিতে হবে। যদি রাজা তাতে রাজী না হয় তাহলে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বাকিংহাম প্রাসাদও দখল করে নেয়া হতে পারে।

তমিজউদ্দিনের চিঠি পেয়ে এবং যুদ্ধের ফলাফল দেখে ভয় পেয়ে রাজা জেমস ঝামেলা এড়াতে সাউদাম্পটন শহরটি তাকে লিখে দিয়ে সেখানে শুল্কমুক্ত ব্যবসার লাইসেন্স দিলে ধুমিয়ে বাণিজ্য শুরু করলো তমিজউদ্দিন লিমিটেড।

শুধু ব্যবসা না, আরো কিছু কাজে হাত দিল তমিজ। সাউদাম্পটন শহরের নাম বদলে তমিজপুর রাখা হলো। সাউদাম্পটন শহরের আগের নিয়মকানুন বদলে বাংলাদেশের আইন জারি করা হলো। স্থানীয় ইংরেজরা তাতে বাধা দিতে চাইলে বেদম মার খেল। তমিজপুরের ইংরেজদের উপর মোটা করধার্য করা হলো, তাদের ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে শুধু বাঙালীদের জন্য ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো। এভাবে ইংল্যান্ড থেকে নিয়মিত আমদানি রপ্তানি করে বাংলাদেশ ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকলো।

তমিজউদ্দিন ওই শহর দখল করার কয়েক মাস পর খবর পেল রাজা জেমস ইংরেজ ব্যবসায়ীদেরও শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের লাইসেন্স দিচ্ছে। শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তমিজউদ্দিনের। এইটা কী মগের মুল্লুক? আমরা এতদূর থেকে আসছি ব্যবসা করে তোদের দেশকে উন্নত করতে, আর তোরা ঘরে বসেই শুল্কমুক্ত সুবিধা নিবি? কিছুতেই হতে দেবো না। শুল্কমুক্ত সুবিধা খালি আমাদের, বাঙালীদের থাকবে। তমিজউদ্দিন লিমিটেড বাদে দুনিয়ার কেউ এই সুবিধা হাতাতে পারবে না। তুড়ি বাজিয়ে ঘোষণা দিল তমিজউদ্দিন।

ঘাঁটিতে আরো সৈন্য সমাবেশ করে এবার খোদ রাজা জেমসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো তমিজ। আসলে শুধু একটা শহর দখল করে পোষাতে পারছিল না তমিজউদ্দিন লিমিটেড। দিনে দিনে খাই বেড়ে গিয়েছিল তার। তমিজউদ্দিনের বেতমিজ সাহস দেখে ক্ষেপে গেল রাজা জেমস। হুংকার দিয়ে সমগ্র বাঙালী সমাজকে ইংল্যান্ডের মাটি থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে পাল্টা আক্রমণ চালালো।

কিন্তু তমিজের কৌশলী বাহিনীর সাথে পেরে উঠলো না রাজা জেমসের বাহিনী। ইতিমধ্যে ঘুষ দিয়ে বারো জন জেনারেলকে বাঙালীদের পক্ষে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে তমিজউদ্দিন। অধিক সৈন্য থেকেও ইংরেজরা পারলো না বাঙালীদের সাথে। হেরে গিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বাকী সৈন্যরাও তমিজের বশ্যতা স্বীকার করে দলে দলে যোগ দিতে লাগলো তমিজ বাহিনীতে।

অবস্থা বেগতিক দেখে রাজা জেমস পালিয়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নিলেন। এরপর সমগ্র ইংল্যান্ডে জারি হলো বাংলার শাসন। বাংলার প্রথম উপনিবেশ হিসেবে ইংল্যান্ডের নাম সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হলো। তমিজউদ্দিন লিমিটেড পরবর্তী ২০৭ বছর ইংল্যান্ড শাসন করলো।

১৮৩৭ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া জন্মগ্রহন করার পর বাংলাদেশে একবার ভয়াবহ বন্যার পর বেশ বড় আর্থিক ক্ষতি সম্মুখীন হলে তমিজউদ্দিন লিমিটেড ইংল্যান্ডকে মুক্ত করে স্বাধীনতা দিয়ে দেশে ফিরে এল ব্যবসা গুটিয়ে।

বাংলাদেশে এখন চর তমিজউদ্দিন বাদে আর কোন স্থাবর সম্পদ নেই তমিজউদ্দিনের। অনাকাংখিত এই পতনে তমিজউদ্দিনের ২০০ বছর বয়সী শরীর ঘেমে উঠলো।
***   ***  ****
***   ***  ****
জেগে উঠে তমিজউদ্দিন জাহাজের খোলে নিজেকে আবিষ্কার করলো। দড়ি টানতে টানতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পায়নি। ইতিহাসে এম এ পাশ করে জাহাজের কুলীর চাকরী নিয়ে সাউদাম্পটন বন্দরে এসে পৌঁছেছে গতকাল। জাহাজ থেকে চুপি চুপি একবার নেমে পড়তে পারলেই ফক্কা। কিন্তু এ কী জাতের স্বপ্ন দেখলো সে! এমনও কী সম্ভব, এমনকি স্বপ্নেও? ইংল্যান্ড তিনশো বছর আগে তাদের দেশে যা করেছে সেটাই তার অবচেতন মন করতে চাইছে এখানে এসে?

নাহ, মাথাটা সার্ফ এক্সেল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে কুচিন্তা সব ঝেড়ে ফেলতে হবে।


হারানো দিনের গান......গান নয় জীবন কাহিনী

কোন কোন দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরে রেডিওতে প্রায়ই বাজতে শুনতাম এই গানটা। সম্ভবতঃ অনুরোধের আসরে খুব জনপ্রিয় ছিল এটি। গানটা বহুবার শোনা হলেও সিনেমাটা সম্পর্ক কিছুই জানি না। গানের কথার মর্ম বোঝারও বয়স হয়নি সেই সত্তর দশকের শেষভাগে, কিন্তু সেই বালকের কানে গানের সুরটি গেঁথে গিয়েছিল ঠিক।

বহুকাল পেরিয়ে সেদিন ইউটিউবে হঠাৎ করে গানটা শুনতে পেয়ে কানে যেন ঝংকার দিয়ে উঠলো পুরোনো স্মৃতির সুর। সেই দুপুর, স্কুলের টিফিন ছুটিতে বাসায় যাবার পথে কলোনীর রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ বাগান, সারি সারি হলুদ রং করা দালান, দালানের ছায়ায় ডাংগুলি খেলছে ডানপিঠে ছেলের দল, সবুজ ঘাসের মাঠে ফুটবলের গোলপোস্ট, সব ভেসে উঠলো। ভীষণ আপ্লুত হয়ে গানটা শুনলাম। দেখলাম প্রথমবারের মতো। দেখেও মুগ্ধ হয়েছি। এই গানের কথা, সুর, গায়কী, অভিনেতা অভিনেত্রী সবকিছু যেন বাংলাদেশের প্রচলিত সিনেমার গানের চেয়ে আলাদা।

'আমারি আগুনে বন্ধু, আমারি পাখা পুড়েছে....'
কিংবা
'আমি যে বিরহেরই অশ্রু, কেউ তাই চোখে রাখেনি....'

এই লাইনগুলো কথায় এবং সুরের মাধুর্যে কানের মধ্যে এমন একটা আনন্দ বেদনার অনুরণন সৃষ্টি করলো। আমার কান এই গানটির প্রেমে পড়ে গেল আবারো। কিছু অদৃশ্য স্মৃতির পর্দা এসে এসে ভিড় জমালো চোখের সামনে। যেন বিগত জনমের সুর ভাসছে অবিরত। রেখে দিলাম স্মৃতির টুকরোটা।



এই সিনেমায় ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন ওয়াহিদ নামের এক অভিনেতা, যাঁকে আর কোথাও দেখিনি। চিত্রায়নে তাঁকেও ভালো লাগলো নীরব কিন্তু সপ্রতিভ উপস্থিতিতে।

ইউটিউব লিংক

Movie: BONDINI ( বন্দিনী ),
Director: Mustaq
Lyrics: Gazi Mazharul Anwar,
Music: Anwar Parvej

Wednesday, October 18, 2017

আমাদের ভয়াবহ নাগরিক জীবন

১. আমার শহর, আমার দুঃখ

এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে আমি যে শহরে বাস করি সেই সৌন্দর্যের সুনাম সমৃদ্ধ সবুজ শহরটা ক্রমাগত বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। আমার শহর নিয়ে বছর দশেক আগেও মোটামুটি যেটুকু আত্মতৃপ্তির রেশ ছিল এখন তার কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। আমি চট্টগ্রাম শহরের কথা বলছি। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, সবকিছুর প্রথম স্মৃতি এই শহর জুড়েই। এই শহরের উনিশ শতকের স্মৃতিলেখনগুলো আমাকে নস্টালজিক করে তোলে। আমি আক্ষেপ করি কেন সেই সময়ে আমার জন্ম হলো না। চট্টগ্রাম শহরের সেই অনিন্দ্য সৌন্দর্যের কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই এখন। বিশ শতকের শেষভাগে আমরা যেটুকু পেয়েছি, আমার সন্তানেরা তাও পাবে না।

এই সৌন্দর্য নষ্টের কারিগর এই শহরের মানুষ। মানুষের নাগরিক অসভ্যতা শহরকে ধ্বংস করে। এই অসভ্যতাকে উৎসাহিত করেছে কয়েকটি দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী প্রতিষ্ঠান। শহর ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মানের সাথে জড়িত সংস্থাগুলো এর জন্য দায়ী। সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, ট্রাফিক পুলিশ ইত্যাদি  কতৃপক্ষের অস্তিত্ব আমরা টের পাই না।

কয়েক দশকের স্মৃতির আলোয় নির্দ্বিধায় বলা যায় ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাঘাট পরিবেশ অতীতের চেয়ে সবচেয়ে জঘণ্য চেহারায় আছে। তবে টাইগারপাস থেকে লালখানবাজার ঘুরে কাজির দেউড়ি হয়ে আন্দরকিল্লা মোড় পর্যন্ত সড়ক এই হিসেব থেকে বাদ যাবে। এই সড়কটি চট্টগ্রামের একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে সড়কদ্বীপ সবুজে সজ্জিত। আধুনিক ল্যাম্পপোস্টে উজ্জ্বল সন্ধ্যা, পালিশে পালিশে অনেকাংশের ফুটপাতও শয্যাবাসের উপযুক্ত হয়ে গেছে। কেননা এই পথে আছে ভিভিআইপি চলাচল। এই পথে আছে ধনীক্রীড়াগৃহ চট্টগ্রাম ক্লাব, পাঁচতারা র‍্যাডিসন ব্লু এবং রাষ্ট্র/সরকার প্রধানের চট্টগ্রাম নিবাস সার্কিট হাউস। এই পথ শেষ হয়েছে নগরপিতার কর্মস্থল কর্পোরেশন অফিসের গোড়ায়। এখানে ঝাড়ুদার ময়লাবিহীন রাস্তার ধুলো কুড়িয়ে বেড়ায় প্রতিদিন। এদিকের সড়ক চিতল মাছের পেটির মতো মসৃণ। বাকী শহরের কান্না এখানে পৌঁছে না। শহর যে কাঁদে তাও তারা জানে না।

২. সড়ক অসভ্যতা

চট্টগ্রাম শহরের নাগরিক অসভ্যতার প্রধান ক্ষেত্র হলো সড়ক ও যানবাহন। চট্টগ্রাম শহরের সড়কগুলো বর্তমানে ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় আছে। এই ভয়াবহতা লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব। তবু লিখে রাখছি ভবিষ্যতের জন্য। আমাদের বর্তমান জীবনটা কতো দুর্বিসহ কাটছে সেটা যেন ভবিষ্যতের মানুষেরাও জানতে পারে। এমনিতে আমাদের অনিবার্য দুঃখ দুর্দশার কমতি নেই ব্যক্তিগত জীবনে। তার দায়দায়িত্ব আমরা অন্যকে দিতে পারি না। সেসব বাদ দিয়ে সম্মিলিতভাবে সামাজিক যে দুর্ভোগগুলো আমরা প্রতিদিন বহন করি এগুলোর জন্য আমাদের দায়ী করতে হয় কতৃপক্ষ নামক কোন প্রতিষ্ঠানকে। কেননা ওই প্রতিষ্ঠানগুলো আমদের দুর্ভোগ লাঘবের দায়িত্বে নিয়োজিত আছে এবং তাদেরকে সেজন্য সরকারের কাছ থেকে টাকাপয়সা দেয়া হয়।

মাইলের পর মাইল রাস্তা জুড়ে গর্ত কেন থাকবে সারা বছর ধরে? আপনারা কি বিনামূল্যে রাস্তা তৈরী করেন? নাকি রাস্তা বানাবার প্রযুক্তি আপনাদের আয়ত্বে আসে নাই? ভারী যানবাহন বা বৃষ্টিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশের চেয়ে ভারী যানবাহন বা বৃষ্টিবহুল দেশেও রাস্তাঘাটে গর্ত দেখা যায় না। বাংলাদেশের রাস্তার এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী সড়ক নির্মানের দুর্বলতা। যে দুর্বলতার জন্য দায়ী প্রযুক্তি নাকি দুর্নীতি আমি জানি না। আমি শুধু জানি যে আমরা এখনো ৫ বছর গাড়ি চলতে পারে তেমন রাস্তা বানাতে পারি না।

৩) শাহ আমানত সেতুর কুৎসিত মোড়
সড়কে নরক গুলজার দেখতে হলে এখানে আসতে হবে। এই সেতুর সাথে শুধু নগরবাসী যুক্ত নয়। বাংলাদেশের হাজার কোটি টাকার পর্যটন ব্যবসাও জড়িত। এই সেতু পেরিয়েই যেতে হয় কক্সবাজার বান্দরবান, সেন্টমার্টিনসহ সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামে। সরকার কর্ণফুলী নদীর উপর নান্দনিক সেতু বানিয়েছেন কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে। সেই সেতু থেকে নামার পর পৃথিবীর জঘন্যতম যানজটে পড়ার কারণ কী? দশ বছর আগেও তো পুরোনো তক্তা সেতু পেরিয়ে এক টানে বহদ্দার হাটের দিকে রওনা দিতে পারতাম।  কর্নফুলী ব্রীজের গোড়ায় অবৈধ বাসস্ট্যাণ্ড গড়ে উঠলো কার নির্দেশে? ওখানে কী সরকার বলে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়? মানুষ চুপচাপ দুর্ভোগ সয়ে গেলেই অন্যায় জায়েজ হয়ে যায়?

আমরা অনেকে কর্ণফুলীর দক্ষিণে যাওয়া বাদ দিয়েছি শুধুমাত্র কর্ণফুলী সেতু এলাকার ভয়ানক বিশ্রী যানজটের কারণে। আমি বাংলাদেশের অনেক এলাকার যানজট দেখেছি। কিন্তু কর্নফুলী সেতু এলাকার মতো অসভ্য যানজট একটিও দেখিনি। এটাও ভাষায় বর্ননা করা অসম্ভব। আপনি নিজে সেই এলাকা অতিক্রম না করলে বুঝবেন না মানুষ কতোটা অসভ্য, অর্বাচীন, আত্মহত্যাপ্রবণ হতে পারে। এরকম টুকরো টুকরো সড়ক অসভ্যতার অসংখ্য গল্প আছে সমস্ত শহর জুড়ে।

কিন্তু বিশ শতকের শেষভাগেও এতটা অসভ্য ছিল না এই নগর। পৃথিবীর প্রতিটা দেশ নানা ক্ষেত্রে এগিয়েছে। বাংলাদেশও এগিয়েছে বিভিন্ন সূচকে। কিন্তু নাগরিক সভ্যতার সূচকে আমাদের এই অধঃপতন কেন? এই অধঃপতন নিয়ে কারো মাথা ব্যথা আছে? ব্যক্তিগতভাবে আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি। কিন্তু সম্মিলিত ক্ষোভ প্রতিক্রিয়া দেখিনি। সরকারের তো কোন অস্তিত্বই টের পাই না এখানে। ছোট একটা জায়গায় দানবীয় আকারের বাসগুলোর বেপরোয়া মোচড়ামুচড়ি পিষে ফেলছে মানুষের সকল নাগরিক অধিকার৷ সভ্যতা এখানে অনুপস্থিত৷ 

৪) কর্ণফুলী মরে যাচ্ছে

কর্ণফুলী নদী মরে যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনেই। অর্ধেক নদী চর পড়ে গেছে। চর পড়তে পড়তে মাঝনদীদে চলে গেছে চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই অংশ। যে অংশে নতুন কর্নফুলী সেতু নির্মিত হয়েছে সেই অংশে নদীর সীমানা ছিল সেতুর গোড়ার কাছে। এখন গত দশ বছরে নদী ভরাট হতে হতে অর্ধেক হয়ে গেছে। ভরাট অংশ নিয়ে খুশী আছে মানুষ এবং সরকার উভয়ই। তারা রীতিমত রাস্তাঘাট দালান কোটা তৈরী করে ভরাট অংশ কাজে লাগিয়ে ফেলেছে। কর্ণফুলী সেতু থেকে নদীর পাড় দিয়ে যে রাস্তাটি ফিরিঙ্গিবাজারে গিয়ে উঠেছে সেই রাস্তাটি মূলত মাঝদরিয়া দিয়ে চলছে।

নদী ভরাটের লাভের গুড় পেয়ে যারা আনন্দিত জোয়ার জলে শহর নিমগ্ন হবার খবরে তাদের কী প্রতিক্রিয়া জানতে ইচ্ছে করে। কর্ণফুলী নদী ছোট হচ্ছে কয়েকশো বছর ধরে। কিন্তু গত দশ বছরে সর্বাধিক ভরাট হয়েছে। অপরিকল্পিত সেতু নির্মান তার প্রধান কারণ।

পুরো বর্ষাকাল জুড়ে সংবাদ শিরোনাম থাকে শহর ডুবে গেছে। শহর ডুবে যায় জোয়ারের প্লাবনে, কর্নফুলীর উজানের পানিতে। যে পানি নদী দিয়ে বয়ে যাবার কথা সে পানি নদী বহন করতে পারে না। বাড়তি পানি নদী বিলিয়ে দেয় শহরে। নদীকে ভরাতে ভরাতে ছোট করেছি আমরা কিন্তু নদীর পানি তো কমেনি। নদী মরে যাবার আগে আমাদের ভাসিয়ে নিচ্ছে। এই শহরের জন্ম হয়েছে নদীগর্ভ থেকে। আবারো নদীগর্ভেই ফিরে যাবে এই শহর।




Saturday, October 14, 2017

যুদ্ধের চেয়ে দারিদ্র শ্রেয়

পৃথিবী কখনো যুদ্ধের আশংকামুক্ত হবে না। অন্ততঃ আরো একশো বছরেu না। শতবর্ষের হিসেবে এমন কোন বছর নেই যখন পৃথিবী যুদ্ধ ছিল না। বিশ শতকে ইতিহাসের ভয়াবহতম যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়েছিল। একুশ শতকে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কিনা কেউ জানে না। কিন্তু যুদ্ধবাজদের হিংস্র চেহারা এই শতকেও বিদ্যমান। এশিয়া আফ্রিকার দেশে দেশে এখনো যুদ্ধের দামামা বেজেই চলেছে। বড় শক্তিগুলো সরাসরি যুদ্ধে জড়িত না হলেও যুদ্ধ ব্যবসায় তাদের অংশগ্রহন অতি সরল চোখেই বোঝা যায়। যুদ্ধ পৃথিবীতে ভয়ংকর উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি করে। একাত্তরে বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল। বর্তমান সময়ে অন্ততঃ দশ লাখ রোহিঙ্গা বার্মা থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে যদি আরেকটি যুদ্ধ হয় তখন উদ্বাস্তু হয়ে কোথায় যাবে মানুষ? মাঝে মাঝে এই আশংকাটা খোঁচা দেয়। ভাবনাটা ভাবতে চাই না বলেই বোধহয় বারবার সামনে এসে দাঁড়ায়।

ভাবনাটা আরো গভীরে আঘাত করলো First They Killed My Father নামে কম্বোডিয়া যুদ্ধের সিনেমা দেখে। যুদ্ধ এমনই ভয়ানক বস্তু চোখের পলকে সুখের জীবন পরিণত হতে পারে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। দেশে দেশে সব যুদ্ধ, সব হানাহানির মানবিক দুর্যোগ প্রায় একই। Loung Ung এর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বইয়ের উপর নির্মিত সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন এঞ্জেলিনা জোলি।

সিনেমাটি দেখা শেষে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাড়ির সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি চলছে অসংখ্য গাড়ি। হর্ন বাজছে, রিকশার টুং টাং, টেম্পুতে ঝুলে ঝুলে কাজে যাচ্ছে মানুষ, ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলছে নানা রঙের মানুষ, সারি সারি দোকানে ঝুলছে নানান পন্য। কেনা বেচা হচ্ছে হাটবাজারে। অফিস আদালত ব্যবসা সব চলছে নানান সুবিধা অসুবিধা নিয়ে। সবার অবস্থা এক না, কেউ আছে সুখী, কেউবা অসুখী। পথের মাঝে আছে সন্তুষ্ট মানুষ, আছে অসন্তুষ্টও। কেউ জীবিকায় অসন্তুষ্ট, কেউ দেশের প্রতি, কেউবা প্রতিপক্ষ দলের প্রতি। নানান ঝামেলায় প্রতিনিয়ত প্রচুর ত্যক্তবিরক্ত মানুষ দেখা যায়।

এখন যদি হঠাৎ একটা যুদ্ধ লেগে যায়, এই সব নানান জাতের মানুষ সবকিছু ভুলে ছুটবে শুধু প্রাণটা নিয়ে। বাকী সব সমস্যার কথা ভুলে যাবে এক নিমেষে। ভুলে যাবে দৈনিক অভাবের টানাটানি, চাকরীজীবি ভুলে যাবে চাকরির যন্ত্রণা, বেকার ভুলে যাবে কর্মহীনতার কথা, পাওনাদার ভুলে যাবে কতটাকা বাকী রইল, পথচারী ভুলে যাবে রাস্তায় এত যানজট কেন, গৃহস্থ বলবে না ঘন ঘন কারেন্ট যায় কেন, বেগুনের কেজি আশি টাকা কেন? তখন শুধু একটাই ইস্যু থাকবে, বাঁচতে হবে, যে কোন মূল্যে। প্রাণ নিয়ে পরিবার নিয়ে দূরে, এমন কোন সুদূর পারে চলে যেতে হবে যেখানে যুদ্ধের আগুন ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে না।

যদি কখনো যুদ্ধ আসে আমার দেশে আমি কী করবো তখন? যোগাযোগ সুবিধার জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলে বাসা নিয়ে যে সুখের উদযাপন করেছি এতকাল, সেটাই হয়ে দাঁড়াবে সবচেয়ে ভয়ানক সমস্যা। শহরের প্রধান সড়কের উপর অবস্থিত যে কোন বাড়িই যুদ্ধাস্ত্রের সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। নিমেষে চোখে ভাসলো সিরিয়া লেবাননের কংকাল হয়ে যাওয়া শতশত বাড়ির চেহারা। কিছুই নেই, চিহ্নমাত্র নেই। সর্বশান্ত মানুষ কে কোথায় হারিয়ে পথের ভিখিরি হয়ে গেছে কেউ জানে না।

দারিদ্র বনাম যুদ্ধের ভয়াবহতার তুলনা করলে দারিদ্রকে শ্রেয়তর মনে হয়। আমরা দরিদ্র-  তবু এখনো আমাদের স্বস্তি - যুদ্ধ নেই। আমরা উদ্বাস্তু হইনি। সব ছেড়ে পালাইনি। যদি যুদ্ধ আসে সব ছেড়ে পালাতে হয়। চিরতরে সর্বশান্ত হতে হয়। বাস্তুভিটে ফেলে কে কোথায় চলে যাবে কেউ জানে না। যাদের ঘাড়ে সেই দুর্ভাগ্য চেপেছে, তারা রক্ষা পায়নি কেউ।

পৃথিবী থেকে চিরতরে যুদ্ধ নির্মূল হবার মতো সভ্যতা কী কখনো আসবে? আগামী পাঁচশো কিংবা হাজার বছরে কি মানুষ ততখানি সভ্য হয়ে উঠবে না?

একটি করযোগ্য জীবনাবসান

মাহতাবউদ্দিনেরা কখনো পত্রিকার শিরোনাম হতে পারে না। গলি ঘুপচির আড়ালে নিঃশব্দে থেমে যায় তাদের অনুল্লেখ্য জীবন। তাদের নিয়ে লেখা এবং পড়া দুটোই সময়ের নিদারুণ অপচয়।

***    ****   *****  ***  ***    ****   *****  ***
অবসর গ্রহনের পর জীবনটা আগের মতো থাকবে না জানতেন মাহতাবউদ্দিন। বেসরকারী চাকরী থেকে অবসর নিলে পেনশন থাকে না। সঞ্চয় আর প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের টাকাটাই একমাত্র সম্বল। কিন্তু এ দিয়ে বাকী আয়ুষ্কাল পাড়ি দেয়া অসম্ভব। অবসরের আগে মনে মনে ঠিক করেছিলেন পৈত্রিক সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে সেই টাকা ব্যাংকে রেখে নিজের পেনশনের ব্যবস্থা করবেন, দুই কন্যার বিয়ের খরচ মেটাবেন।

মাহতাবউদ্দিন সার্বিক অর্থেই নিরীহ মানুষ। তিনি জগতের অনেক হিসেবই মেলাতে পারেন না। চাকরিকালীন সময়ে তিনি ভেবে পেতেন না একই বেতনে চাকরী করে তাঁর কয়েকজন সহকর্মী কিভাবে প্লট/ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে। চল্লিশ হাজারে সংসার খরচ সামলাতেই হিমশিম। পৈত্রিক বাড়িটা না থাকলে কী যে হতো। তিনি যেটুকু সঞ্চয় করেছেন সেটুকু মাসিক ডিপিএস থেকেই এসেছে। নিজের টুকটাক খরচ বাঁচিয়ে মাসে দুহাজার টাকার একটা ডিপিএস চালাতেন। অবসর গ্রহনের পর ওটা থেকে ৫ লাখ টাকার মতো পেয়েছেন। সাথে প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের ৯ লাখ। সব মিলিয়ে চৌদ্দ লাখ টাকার মোটা একটা অংক।

কিন্তু সংসার খরচ এখান থেকে দিতে হলে এই অংকটার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩৫ মাস। মাসে ৪০ হাজার খরচ করলে  এই টাকায় তিনি তিন বছর চলতে পারবেন। ৬৩ বছর বয়সে গিয়ে কী করবেন? এখন কী নতুন করে চাকরী করার সুযোগ আছে? শরীরে নানান অসুখ বাসা  বেঁধেছে ইতিমধ্যে। স্ত্রীও খুব বেশী সুস্থ নয়। দুই মেয়ের পড়া শেষ হতে আরো দু বছর বাকী। তাদের বিয়ের খরচ কোথা থেকে আসবে। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসতো না অবসরের কয়েক মাস আগ থেকে। তখনই পৈত্রিক সম্পত্তির কথা মনে হয়েছিল। তিনি নিজের আয়ে এক টুকরো জমিও কোথাও কিনতে পারেননি। কপালগুনে পৈত্রিক সম্পদটা পেয়েছিলেন বলে এখনো শহরে বাস করতে পারছেন। বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট জমিটি বিক্রি করে পেলেন ২৬ লাখ টাকা।

এবার সব মিলিয়ে ৪০ লাখ টাকা হলো। মোটামুটি সন্তুষ্ট তিনি। একটা লিজিং কোম্পানীর সাথে কথা হলো। তাদের কাছে জমা রাখলে ১০% লাভে মাসে ৩৩ হাজার টাকা আয় হবে। বেতনের অংকের চেয়ে ৭ হাজার টাকা কম। তবু টেনে চললে, মাছ মাংস খাওয়া কমিয়ে দিলে, রিক্সার বদলে হেঁটে চললে এটা দিয়েও চালানো যাবে।

কিন্তু মাসের কিস্তি তুলতে গিয়ে দেখা গেল ৩৩ হাজার থেকে আরো ৫ হাজার টাকা চলে যাচ্ছে আয়কর বাবদ। তাঁর মতো আয়হীন মানুষকেও মাসে মাসে ৫০০০ টাকা আয়কর দিতে হবে? এই দিকটা তো আগে ভাবা হয়নি।

বাসায় ফিরে স্ত্রীর হাতে মাসিক কিস্তির ২৮০০০ টাকা তুলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি। মাথা ঘুরাচ্ছে তাঁর। ভাবতে থাকলেন এই মাস থেকে কোন কোন খাতের খরচ কমাতে হবে। কিভাবে কমাবেন? দেশে সব খাতের খরচ বেড়েছে। বুকের ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা। কাউকে বোঝানো অসম্ভব।

তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়িটা ভাড়া দিয়ে সস্তা কোন একটা বাসায় চলে যাবেন। ২০ হাজার টাকায় বাড়িটা ভাড়া দিয়ে তিনি ১০ হাজার টাকার ছোট বাসায় গিয়ে উঠলেন। মাসে দশ হাজার টাকা বাড়তি আয় হওয়াতে তিনি ৩৮ হাজারে সংসারটা আগের মতো চালাতে পারবেন।

কয়েকদিন পর সপরিবারে ঢাকায় যাবার দরকার একটা বিয়েতে। মেয়েকে বললেন অনলাইনে টিকেট কাটতে। তাঁর চাকরীকালীন সময়ের একটা ডেবিট কার্ড আছে ওটায় এখনো কিছু টাকা অবশিষ্ট আছে। চারজনের টিকেট কেটে প্রিন্ট নিয়ে আসার পর দেখলেন ট্রেনের ভাড়া ১৮৯০ + ভ্যাট ২৮৫ টাকা + অনলাইন সেবা ৪০ টাকা = ২২১৫ টাকা। তিনি ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন পথের চা-নাস্তার খরচটা সরকার নিয়ে নিল?

ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর একদিন সিটি কর্পোরেশন অফিসে ডাক পেলেন। গিয়ে দেখলেন তাঁর বাড়ির উপর নতুন কর ধার্য করা হয়েছে। এতদিন তিনি মিউনিসিপ্যাল কর দিতেন ৪১০০ টাকা। নতুন হিসেবে তাঁকে কর দিতে হবে ৩৪০০০ টাকা!

হিসেবের কাগজটা হাতে নিয়ে মাহতাবউদ্দিনের মাথা চক্কর দিল। এত টাকা বেড়ে গেল এক লাফে? তিনি ব্যাপারটা নিয়ে একটু যুক্তি তর্ক দিতে চাইলে ধমক খেলেন ক্লার্কের কাছে- বেশী কথা বলবেন না, এটা সরকারের আইন। বাড়ি থেকে টাকাপয়সা নিয়ে আসেন।

মিউনিসিপ্যাল অফিস থেকে বের হয়ে মাহতাব সাহেব একটু হেঁটে নিরিবিলি একটা ফুটপাতের চায়ের দোকানে বসে পড়লেন। তারপর হিসেব করতে লাগলেন কিভাবে তাঁর সীমিত আয় একের পর এক আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হতে শুরু হতে শুরু করেছে।

তিনি কারো সাহায্য নিয়ে জীবন চালান না। না সরকার, না মানুষ। তিনি বরাবর নিজের আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখনো তাই আছেন। তাঁর সীমিত আয়ের উপর এই আঘাত কেন? ৪০ লাখ টাকার সম্পদ থেকেও তিনি তা দিয়ে সংসার চালাতে পারছেন না কেন? মনে হচ্ছে চাকরী থেকে অবসর নেবার পর তাঁর উপর অভিশাপ নেমে এসেছে। কর অভিশাপ। তাঁর মতো বেকার মানুষকে বছরে আয়কর দিতে হবে ৬০,০০০ টাকা!! তিনি বার্ষিক ঈদে পরিবারের জন্য ১০ হাজার টাকা বাজেট করতে হিমশিম খান, বেঁচে থাকার জন্য নিজের ঘরের আয় সাশ্রয় করতে চেয়েছেন। তবু তাঁকে গৃহকর দিতে হবে ৩৪০০০ টাকা!!

যদি ভ্যাট ইত্যাদি হিসেব করা হয় বছরে এক লাখ টাকা তিনি সরকারকে দিয়ে দিচ্ছেন। যিনি বাজারে গিয়ে সবচেয়ে সস্তা মাছটা বেছে কিনেন, তাজা বাদ দিয়ে পচা মাছ কিনে সংসার চালান, তার উপরে লাখ টাকার এই করের বোঝা একটা অভিশাপ ছাড়া আর কী? তিনি কার কাছে বিচার দেবেন?

খুব অসহায় বুকভাঙ্গা একটা চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন মাহতাব সাহেব। এসে টেবিলে বসে একটা কাগজ টেনে নিয়ে ঈশ্বরের কাছে চিঠি লিখতে বসলেন -

প্রিয় ঈশ্বর,

তুমি আমাকে চেনো কিংবা চেনো না। এই চিঠি তোমার কাছে কখনো পৌঁছাবে না। তোমার কাছে লিখেও আমার কোন লাভ নেই। তবু আমি নিতান্ত অসহায় হয়ে কিছু কথা বলতে চাইছি যেটা বলে ফেললে আমি হয়তো চাপমুক্ত হতে পারবো।

আমি একজন বেসরকারী কর্মজীবি ছিলাম। ৩৫ বছরের কর্মজীবন শেষ করার পর ৬০ বছর বয়সে অবসর গ্রহনের পর আমার আয়ু কতদিন আছে আমি জানি না। কিন্তু অবসর গ্রহনের পর আমার ৪ সদস্যের পরিবার নিয়ে আমি চট্টগ্রাম শহরে বেঁচে থাকার জন্য কিছু উপায় করেছিলাম নিজের সামর্থ্য অনুসারে। সেই উপায়টি কপালদোষে হুমকির মুখে পড়ে গেছে। অনেকের জন্য এগুলো হয়তো তেমন গুরুতর নয়। কিন্তু আমার কাছে এই হুমকি জীবন মরনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমি যতদিন কর্মজীবনে ছিলাম কখনো কোন অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়াইনি। সীমিত আয়ে সংসার টেনে নিয়ে গেছি। অবসর গ্রহনের পর আয়েশ করার বাসনা করিনি কেননা তখনো আমার কাজ বাকী আছে। আমার দুটি বিবাহযোগ্য কন্যা আছে যারা আর দুতিন বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করবে। আমার আত্মীয় পরিজনের কেউ কেউ অভিযোগ করে এত বয়স পর্যন্ত কেন কন্যাদের বিবাহ দেইনি। কিন্তু আমি চাই আমার কন্যারা শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে নিজের দায়িত্বে নিজের পছন্দে বিয়ে করবে। কন্যারাও তাতেই খুশী।

কিন্তু অবসর গ্রহনের পরপর আমি আমার আয় নিয়ে এক মহাসংকটে পড়েছি। আমি আত্মনির্ভরশীল একজন মানুষ। বাকী জীবন নিজের সঞ্চয় ও সম্পদের উপর কাটিয়ে দিতে পারবো বলে ভাবলেও বর্তমানে সেটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। সেই আঘাত এসেছে আমি যে দেশে বাস করি সেই দেশের আইনের কাছ থেকে। আমি চিরকাল জেনে এসেছি আইন দুর্বলকে রক্ষা করার জন্য তৈরী। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই আইনই আমার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমি একজন কর্মহীন, আয়হীন অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, যাকে বয়সের চাপে অসুস্থতা যে কোন সময় কাবু করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে। তবু আমার উপর চাপানো হয়েছে মোটা অংকের বাধ্যতামূলক কর। আমি টিপে টিপে বেছে বেছে পচা মাছ কিনে বাড়ি ফিরি বেঁচে থাকার আশায়। কিন্তু লাখ টাকার করের বোঝা এসে আমার বুকে চেপে বলে - এদেশের আইন আমি, আমাকে তোমার সেবা করতে হবে সবার আগে।

আমি কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো? এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার কোন উপায় থাকলে তাও চলে যেতাম। আমি এদেশের একজন অযোগ্য নাগরিক।

হে ঈশ্বর, তুমি হয়তো জানো আমি আইনের চাপেই মারা যাবো।
হে মাতৃভূমি, এ কিম্ভুত আইনের দেশে জন্মই আমার অভিশাপ।

ইতি,
অভাগা মাহতাব উদ্দিন


চিঠি লিখে একটা খামে ভরে ড্রয়ারে রেখে দিলেন তিনি। কয়েকদিন শয্যাশায়ী থাকার পর সুস্থ বোধ করলে এক বিকেলে বাজারে গেলেন। চাল ডাল কিনে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার গর্তে পড়ে রিকশা উল্টে গেলে তিনি রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলেন।

কয়েকদিন পর তাঁর চিঠিটা ড্রয়ার থেকে বের করে পড়ার পর কয়েকজন প্রতিবেশী নিন্মোক্ত মন্তব্যগুলো করেছিলেন-
১) মাহতাব সাহেব ভাগ্যবান মানুষ। তিনি করের চাপে মারা যাননি। গাড়ির চাপে মারা গেছেন।
২) দেশপ্রেমিক গর্তে রিকশা উল্টে গেলে সরকার বা মিউনিসিপ্যালিটির কোন দোষ দেয়া যায় না।
৩) মাহতাব সাহেব বেঁচে গেলেন। মৃত্যুর উপর এখনো কর ধার্য করা হয়নি।

বই পড়া না পড়া

বই পড়ে যখন থেকে আনন্দ পেতে শুরু করি তখন ভাবতাম সবাই এই আনন্দ গ্রহন করছে না কেন? সুলভে এত এত আনন্দের সমাহার থেকেও তা সবাই নিচ্ছে না কেন?

আসলে ইচ্ছে করলেই পড়তে শুরু করা যায় না। একটা শব্দ, বাক্য, প্যারা পড়তে পারলেই তা থেকে আনন্দ বের হয়ে আসে না। সেই আনন্দ গ্রহন করার মতো একটা তৈরী মন থাকতে হয়। গ্রহন করার ক্ষমতাসম্পন্ন অনুভূতি যার নেই সে কখনো বই পড়ে আনন্দ পেতে পারে না।

আমাদের চোখ যখন বইয়ের পাতার অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় শব্দে শব্দে পা ফেলে, তখন মস্তিষ্কের একটা অনুভূতি দৃষ্টির মাধ্যমে শব্দগুলো থেকে রস আহরণ করে, সেই রস যদি উপাদেয় হয় তখন আমাদের মস্তিষ্ক আনন্দ অনুভূতিকে বুকের ভেতর ছড়িয়ে দিতে থাকে ধীর লয়ে, পরপর কয়েক পৃষ্ঠা যখন এই ঘটনাটি ঘটতে থাকে তখনই আমরা বইটিতে বুঁদ হয়ে পড়ি। এটা একটা মোহ, একটা প্রেম, শব্দের সাথে একটা সম্পর্ক। এই সম্পর্কটা যতক্ষণ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পাঠের আনন্দ। আমাদের সব প্রিয় বইয়ের সাথে এই সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

যাদের চোখের সাথে মস্তিস্কের ওই অংশের যোগাযোগ ঘটে না, তারা বইয়ের মধ্যে কোন আনন্দ খুঁজে পাবে না। এ কারণে সবার দ্বারা বই পড়া সম্ভব হয় না। যারা নিয়মিত পড়ে টড়ে তাদের সাথে মাঝে মাঝে বইয়ের বিচ্ছেদ ঘটে। সেই বিচ্ছেদকালীন সময়ে বইয়ের অক্ষরগুলো চোখে পড়লে তা থেকে কোন অনুভূতি আমাদের বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে না। সেই সময়টাতে আমরা বই বর্জন করে চলি। বইয়ের সাথে যে ঘটনাটি ঘটে একই ঘটনা লেখার সাথেও ঘটতে পারে। যারা লেখক তাঁরা যখন এই সমস্যায় ভোগেন তখন বলেন রাইটারস ব্লক। রাইটারস ব্লকের মতো রিডার্স ব্লকও হতে পারে।

ছেলেবেলায় ছুটিতে যখন গ্রামে গিয়ে যখন পড়ার চেয়ে ডানপিটেমিতে বেশি ব্যস্ত থাকতাম, তখন দেখতাম আমাদের সমবয়সী এক তুতো ভাই বনে জঙ্গলে না ছুটে ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ কোন না কোন বইতে ডুবে আছে। অবাক হতাম প্রকৃতির এত বন্য সৌন্দর্য বাদ দিয়ে সাদা কালো কতগুলো অক্ষরে কী এমন আনন্দ আছে? পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ুয়া একটি বালকের জন্য সেটি খুব অস্বাভাবিক লাগতো।

এখন জানি তার মধ্যে অল্প বয়সেই পড়ার আনন্দযোগ শুরু হয়েছিল। সে কারণেই বইয়ের প্রেমে মগ্ন হতে পেরেছিল ওই কাঁচা বয়সেই।

এই আনন্দযোগ শুরু হতে আমাদের আরো কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল। তবে চারপাশে তাকিয়ে দেখি অধিকাংশ মানুষের মধ্যে  এই আনন্দযোগ নেই। একেবারেই নেই। বন্ধুদের মধ্যে এক আধটু আউট বই পড়াশোনা করতো, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পর তা একদমই চলে গেছে। সবাই সংসার, ক্যারিয়ার, টাকাপয়সা ইত্যাদি নিয়ে এত বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে বইয়ের দিকে তাকাবার সময় কারো নেই।

ছাত্রজীবনে যখন থেকে আমার বুকশেলফ একটু একটু ভারী হতে শুরু করে তখন একটা আশংকা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো যদি কখনো পড়াশোনার এই আনন্দ নষ্ট হয়ে যায় তাহলে বইগুলোর তো পোকার খাদ্য হওয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই। সংসারের বিবিধ ঝামেলায় পড়ুয়া মনটা অক্ষত রাখা খুবই কঠিন কাজ। আসলেই কঠিন কাজ। আমি নিজেই ভুক্তভোগী ছিলাম কয়েকটি বছর।

একটা সময় সেই বাস্তবতা আমার কাছেও উপস্থিত হয়েছিল। জীবনের কঠোর কঠিন চাপে থমকে গিয়েছিল সকল পড়াশোনার আনন্দ। মাসের পর মাস কোন বই হাতে নেইনি। বছরের পর বছর বই কিনিনি এমনও গেছে। চাকরীর প্রথম কঠিনতম বছরগুলোতে দম ফেলার ফুরসত ছিল না। প্রায় প্রতিটি দিন ঘুম ভাঙতো দুর্বিসহ দুশ্চিন্তার নাভিশ্বাস নিয়ে। ভোর ছটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত জীবিকার যাঁতাকলে পিষে যাচ্ছিল রক্ত মাংস স্নায়ু সব। চরম প্রতিকূল একটা সময়। জীবনকে নিয়ে একবিন্দু ভবিষ্যত পরিকল্পনা ঠাঁই পেতো না। সেই কঠিন সময়ের মেয়াদ কতদিন তার কোন ধারণা ছিল না। অন্য কিছু ভাবার কোন অবকাশ ছিল না। বইপত্রের জগত থেকে একেবারে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলাম সেই কবছর।

তখন ভাবতাম আর কখনো ফেরা হবে না ওই আনন্দ জগতে। আর সবার মতো আমিও সংসার সমুদ্রে মিশে হারিয়ে গেলাম বুঝি। সারা বছরে মোটামুটি উপভোগ্য কর্মছুটি ছিল দুই ঈদ। এক নাগাড়ে চার-পাঁচদিন ছুটি। একবার অফিসে ঈদের ছুটির সময় শেষ কর্মদিবস শেষে অফিসের বাসে নিজের গন্তব্য আগ্রাবাদ না নেমে চলে গেলাম নিউ মার্কেট। পকেটে ঈদ বোনাসের টাকা। একটু সুখ সুখ অনুভূতি। এই ঈদে দুয়েকটা বই কেনা যাক। নিউ মার্কেটের সামনে কারেন্ট বুক সেন্টারে ঢুকলাম অনেকদিন পর। ছাত্র জীবনের প্রিয় বই কেনার এই জায়গা। ঘুরে ঘুরে বইগুলো ছুঁয়ে দেখতেও আনন্দ। অনেকদিন পর বই কিনলাম, ঈদসংখ্যা কিনলাম, কিনলাম একটি 'উন্মাদ'ও।

বাড়ি ফেরার পথে সুখ সুখ অনুভূতির সাথে ভাবছিলাম- একদিন পর ঈদ কিন্তু এবার ঈদের চেয়েও বই কেনার আনন্দটা যেন একটু বেশী। সবচেয়ে স্বস্তি লেগেছে সেই দুশ্চিন্তা কেটে যাওয়াতে। আমি এখনো বই পড়তে পারি। পড়াশোনার আনন্দযোগ এখনো নষ্ট হয়ে যায়নি পুরোপুরি। চাইলে ফিরিয়ে আনতে পারি নতুন করে। সে বছর থেকে নিয়ম করে প্রতি ঈদের ছুটি শুরু হলে কারেন্ট বুক সেন্টারে ঢুঁ মারি। বছরে অন্তত একবার দেখা সাক্ষাত হলেও ক্ষতি কী। সীমাহীন কর্মব্যস্ত সময়ের অবসরে মাঝে মধ্যে বইয়ের সাথে পুনর্মিলন শুরু হলো। সালটা কী ২০০০? নাকি ২০০১? মনে নেই। তবে সেই কর্মস্থল থেকে ছুটি পেলেই আবারো ছুটে যেতে শুরু করি বই পুস্তকের দোকানে। নতুন করে আবারো যুক্ত হলাম বই জগতের সাথে।

আরো অনেক বছর পর .....যখন থেকে জীবিকা বদল হলো, স্বাধীন জীবনের সুত্রপাত ঘটলো, পড়াশোনার দীর্ঘ অবসর ফিরে এলো। এই পর্বের নতুন একটি আনন্দ পাঠানুভূতি বিনিময়। অন্তর্জালের মাধ্যমে সেই আনন্দের সঙ্গী পাওয়া আরো একটি ভাগ্যযোগ। বেঁচে থাকার অনেক সৌন্দর্য তাতে পাখা মেলে অনায়াসে। জীবনের নানাবিধ কুৎসিত উপকরণকে এড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখার একটা আশ্রয়ও। বইবন্ধুর মতো প্রিয় সঙ্গী আর কে হতে পারে?


Thursday, September 7, 2017

রোহিঙ্গা সমস্যা – জাতিগত অস্তিত্ব নির্মূলই প্রধান লক্ষ্য


একটি অবোধ দুগ্ধপোষ্য রোহিঙ্গা শিশুর লাশ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সৈকতের কাদাজলে। শিশুটি যখন জীবিত ছিল তখনো সে জানতো না তার জাত, ধর্ম কিংবা দেশ কোনটি। বোঝার বয়স হবার আগে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় নৌকাডুবিতে জলে পড়ে যাবার আগে সে কেবল চিনতো মায়ের কোল।



রোহিঙ্গাদের ঘরছাড়া হবার ইতিহাস বেশ পুরোনো। সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায় ১৯৮২ সালে বার্মার সামরিক সরকার ঘোষণা করলো ১৮২৩ সালের পর থেকে যেসব মানুষ আরাকানে বাস করতে শুরু করেছে তাদের কাউকে বার্মার নাগরিকত্ব দেয়া হবে না। তাদের কোন ভোটাধিকার থাকবে না। শান্তির নোবেল পুরস্কার নিয়ে মানবতার প্রতীক বলে পরিচিত অং সান সু কি-র গণতান্ত্রিক সরকারও সেই সিদ্ধান্তেই অটল এই ২০১৭ সালেও। রোহিঙ্গা নামে পরিচিত সেই জনগোষ্ঠীর কোন দেশ  নেই, তাদের কোন নাগরিকত্ব নেই। কয়েকশো বছর ধরে যারা ওই ভূখণ্ডে বাস করছে তাদের নাগরিকত্ব না থাকার কারণ নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে তারা বাঙালী।


বেছে বেছে শুধু কিছু নির্দিষ্ট জাতি একটা রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাবে, বাকীরা শত শত বছর ধরে ওই ভূখণ্ডে বাস করেও নাগরিকত্ব পাবে না, এই আধুনিক যুগে ভাবা যায়? কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে মগের মুল্লুক বলে পরিচিত ওই ভূখণ্ডে সেই বর্বর নিয়মই আইন। এখানে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অকার্যকর।


ঘটনার মূল খুঁজতে আরো কিছুদূর পেছনে যেতে হবে। মায়ানমারের রাখাইন নামের প্রদেশটি একদা আরাকান নামে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৭৮৪ সালে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কোন্দলের সুযোগে বার্মা আরাকান দখল করার সুযোগ পায়। দখলীকৃত ভূখণ্ডের নাগরিকদের গলায় অপমানজনকভাবে তালপাতায় লিখে ঝুলিয়ে রাখতে হতো "নিং থোয়া বারাং ক্যোঁয় ডো মো" নামের বাক্যবন্ধ, যার অর্থ উদীয়মান সূর্য বর্মী রাজার আমি দাসানুদাস। ১৭৯৮ সালে আরাকানীদের উপর বার্মার বোদপায়া রাজার নির্যাতন চরমে উঠলে নাগরিকরা পালিয়ে আসতে থাকে বাংলাদেশে।


সেই আরাকানীদের মধ্যে ছিল বৌদ্ধ এবং মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ। ছিল বাঙালীরাও যারা আরাকানে বসবাস করছে শত শত বছর ধরে। সেই পালিয়ে আসা শরণার্থীদের অনেকে বাংলাদেশেই থেকে যায় স্থায়ীভাবে। যাদের কিছু অংশ কক্সবাজারে আর কিছু অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে ঠাঁই নেয়। তখন থেকেই আরাকান নামক রাজ্যটির নাম মুছে যাওয়া শুরু হয়।


১৮২৫ সালে আরাকান বৃটিশ অধিকারে আসার পর অনেকে ফিরে গিয়েছিল নিজ নিজ বাসভূমিতে। তাদের মধ্যে বাঙালী বৌদ্ধ হিন্দু মুসলমান সব জাতিধর্মের মানুষ ছিল। আরাকান বৃটিশ অধিকারে যতদিন ছিল ততদিন পর্যন্ত আরাকানে যাতায়াতে বাঙালীদের পথ ছিল অবারিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় জাপানী আক্রমণের আগ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল।


আরাকান ও চট্টগ্রাম অভিন্ন রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল বহুকাল ধরে। চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকানেরই অংশ ছিল শত শত বছর ধরে। এমনকি হাজার বছর আগেও চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। সেই সুত্রে আরাকানে বাঙালী হিন্দু মুসলমানের বিচরণ বহুকাল ধরে। এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় বসতি স্থাপন করাটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। জাতিসত্ত্বার পরিবর্তন না ঘটিয়েও মানুষ সারা পৃথিবীতে বসতি স্থাপন করে ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র এবং জাতিসত্ত্বার পরিচয় সবসময় অভিন্ন হয় না। একটি রাষ্ট্রে বাস করে বহু জাতি ধর্মের মানুষ। ন্যূনতম সভ্য দেশে এটা মেনে নেয়াই রীতি।


এমনকি অর্ধসভ্য মধ্যযুগেও সেই রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু বার্মার ক্ষমতাসীনেরা সেই রীতিকে কখনো সম্মান করেনি। দুশো বছর আগে যে কায়দায় আরাকানীদের শরণার্থী জীবন বরণ করতে হয়েছিল, আজো সেই শরণার্থী জীবনই বহন করতে হচ্ছে তাদের।

প্রায় দুশো বছর পর ১৯৭৭ সালে আবারো শুরু হয় উদ্বাস্তু সমস্যা। সেই সময়ও লাখ লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়েছিল বার্মা থেকে। সরকারি হিসেবে সংখ্যাটি ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ও বার্মার সাথে যে চুক্তি হয় সে অনুযায়ী কিছু রোহিঙ্গা দেশে ফিরতে পেরেছিল। কিন্তু ১৯৯২ সালে আবারো দেখা দেয় একই সংকট। সেই দফায়ও লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরপর ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ প্রতিবছরই একেক দফায় রোহিঙ্গাদের ঠেলে  বাংলাদেশে পাঠানো হয়।


২০১৭ সালে এসে মাত্র দুই সপ্তাহে রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছে দেড় লাখের বেশী। এখনো প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লাখের কম নয়। বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু সংকটের একটি।


খুব পষ্ট করে একটি কথা জানানো দরকার যে এই সমস্যাটা মোটেও ধর্মীয় নয়। মুসলমান বলে রোহিঙ্গাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে না। বার্মার বিভিন্ন প্রদেশে বহু মুসলমান আছে যাদের সাথে কোন সমস্যা নেই। এই সমস্যাটা মূলতঃ জাতিগত। রোহিঙ্গারা বাঙালী বংশোদ্ভুত বলেই তাদেরকে নাগরিক বলে স্বীকৃতি দিতে রাজী নয় মায়ানমার সরকার। শুধু সরকার নয়, সাধারণ বার্মিজদের দৃষ্টিভঙ্গীও অনেকটা সরকারের মতো। তারা রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা না বলে অভিবাসী বাঙালী হিসেবে দেখে আসছে চিরকাল। কিন্তু একজন অভিবাসীর কত শত বছর লাগে নাগরিক হয়ে উঠতে? আমেরিকার মতো দেশে মাত্র ৫ বছর বাস করেও নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু সাত পুরুষ বাস করেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব মেলেনি মায়ানমারে ।


বর্তমান পৃথিবীর অন্ততঃ তিনটি মহাদেশের সমাজ গঠিত হয়েছে ভিনদেশী অভিবাসীদের হাতে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া। খুব বেশীদিন না। মাত্র ৩০০-৫০০ বছরের মধ্যে এই মহাদেশগুলোতে অভিবাসনের ঘটনা ঘটেছে। এখন হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি মেক্সিকো দখল করে স্পেনিশভাষীদের বলে 'তোমরা তো এখানকার অভিবাসী মাত্র, নাগরিক নও, স্পেনে ফিরে যাও'- কেমন দাঁড়াবে ব্যাপারটা?


এবার একটু বিপরীত কথা বলা যাক। ২০১৭ সালে নতুন করে এই সমস্যার উদ্ভব নিয়ে বলতে গেলে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে দায়ী করতেই হয়। সাধারণ রোহিঙ্গারা হয়তো দায়ী নয়, কিন্তু নব্য গঠিত একটি জঙ্গী সংগঠনের নাম শোনা যাচ্ছে The Arakan Salvation Army (ARSA). যে সংগঠন মায়ানমারে কয়েক দফা আক্রমণ চালিয়েছে গত বছরের অক্টোবর থেকে। সর্বশেষ আক্রমণ মায়ানমারের ২৫টি পুলিশ চৌকির উপর। যার প্রতিক্রিয়াতে মায়ানমার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করছে। এই জঙ্গী গোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে। কেননা ওই জঙ্গীদের সাথে বাংলাদেশের জঙ্গীদের যোগাযোগ থাকার ঘোরতর সম্ভাবনা রয়েছে। এই জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকগন এই সমস্যাকে ধর্মীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে যদিও ধর্মের সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই।


আন্তর্জাতিকভাবে এই জঙ্গীদের কোন রাষ্ট্র নেই, যে কোন রাষ্ট্রেই তাদের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘাড়ে চেপে যদি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যদি অস্থিতিশীল করে তোলে তাহলে সেটা হয়ে দাঁড়াবে গুরুতর আঞ্চলিক সমস্যা। যেখানে জড়িত হতে পারে ভারত বা থাইল্যাণ্ডের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো। সন্ত্রাসবাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।


আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা থাক। মূল মানবিক সমস্যার দিকে চোখ ফেরানো যাক। সবার উপরে মানুষ যদি সত্য হয়ে থাকে, সেই মানুষের একটি ভূখণ্ডে বাস করার অধিকার আছে। যে ভূখণ্ডে পূর্বপুরুষেরা শত শত বছর ধরে বাস করে গেছে সেটাই আমার বাড়ি, সেটাই আমার দেশ। প্রতিটি মানুষের একটি দেশ থাকার অধিকার আছে। এটা প্রতিটি মানুষের সার্বজনীন অধিকার। সেই অধিকার প্রদানে মায়ানমার সরকারকে বাধ্য করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। শুধু বাংলাদেশের উপর সমস্যা চাপিয়ে বসে থাকলে সমাধান আসবে না। রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক নাগরিক অধিকার না দিলে এমন বর্বর অমানবিক ঘটনার পুনরাবৃত্ত হতেই থাকবে।

Thursday, July 13, 2017

বেনেফিট অব ডাউট

চোর ডাকাতেরা জানতো না ফাঁকা মাঠের মাঝে এই বাড়িটার দরোজাগুলো কতো নাজুক। ভেতর থেকে কোনমতে বন্ধ করা গেলেও বাইরে তালা দেবার কোন উপায় নাই। এ বাড়ির কেউ কখনো একসাথে কোথাও যায় না। কেউ না কেউ থাকেই।

কিন্তু সেবার হঠাৎ এমন এক দুর্যোগ অতর্কিতে হানা দিলো সবাইকে পালাতে হলো ঘর ছেড়ে। এক রাতের অবিরাম ভারী বর্ষণে সমস্ত শহর যখন ডুবে গেল, তখন এই বাড়িটাও খুব দ্রুত এক বুক পানির নিচে ডুবে যাচ্ছিল দেখে সাত সকালে বাড়ির বাসিন্দারা কোনমতে এক কাপড়ে বেরিয়ে কয়েকশো গজ দূরে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলো। পেছনে দরোজা-খোলা বাড়িতে রয়ে গেল যাবতীয় আসবাবপত্র, টিভি-ফ্রিজ-কম্পিউটার, মধ্যবিত্ত পরিবারের অমূল্য সম্পদ।

ছেড়ে আসা বাড়িটা ছিল আমাদের। সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। অবিরাম বর্ষণ তখনো চলছিল। জল নামার কোন লক্ষণ নেই। থই থই করছে চারপাশ। প্রতিবেশীর দোতলা বাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম বন্যা কবলিত গাছপালা ঘেরা নিঃসঙ্গ বাড়িটার দিকে। গত বিশ বছরে এই প্রথম বাড়িটা একা হলো। বাড়ির ভেতরে একটা জিনিসও অক্ষত থাকবে না। বইগুলোর জন্য বেশী মায়া লাগলো। টিভি আর ফ্রিজটা কোনমতে টেবিলের উঁচুতে তুলে রাখা হয়েছে। সার্টিফিকেটের ব্রিফকেসটা আলমারীর উপরে। 

আলমারী? আলমারীর কথায় মনে পড়ে গেল ওখানে কত কি দামী সব জিনিস রয়ে গেছে। আছে অতিমূল্যবান গয়নার বাক্সগুলো। একদম নীচের তাকে আছে, ভিজে নিশ্চয়ই সুপসুপে হয়ে গেছে। এত বেশী পানি, তালা খুলতে ডুব দিতে হবে। কুচকুচে নর্দমার জলে ডুব দেয়া সম্ভব না। চাইলেও তাই বের করা যাবে না। কিন্তু চোরের কাছে ওসব ঝড় জল কিছুই না। এ কথাটা মনে হতেই বন্যার চেয়ে বড় বিপদের আশংকাটা জাগলো। চোরেরা শাবল দিয়ে আলমারী খোলে। চাবি লাগে না। নিশ্চয়ই চোর আসবে রাতে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই কোথাও। খানিক পরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসবে। এতদিন যেসব চোর চুরি করার সুযোগ না পেয়ে মনে মনে ক্ষুব্ধ ছিল তারা মনের সাধ মিটিয়ে ঘর খালি করে দেবে। যেসব জিনিস অক্ষত আছে এখনো, সেসব চোরের হাতেই নিকেশ হবে।

ফিরে গিয়ে বাড়ি পাহারা দেবো? অন্ধকারে এক বুক পানির ভেতরে দাঁড়িয়ে কী পাহারা দেবো? মালের চেয়ে জানের মায়া বেশী। থাক, জিনিস গেলে যাক। প্রাণ থাকলে কত কিছু কেনা যাবে।

তখনই আবার মনে পড়ে গেলো তাদের দুজনের কথা। আমার সাহস না থাকলেও তাদের উপস্থিতি চোরকে ঠেকিয়ে দিতে পারে না? ভেবে দেখলাম, নিশ্চয়ই পারে। অন্ততঃ একটা সম্ভাবনা আছে।

অন্ধকারে জল ঠেলে তাদেরকে পাহারায় নিয়োজিত করার জন্য ফিরে গেলাম থই থই জলে ডুবন্ত বাড়িটাতে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। দরোজাটা হা করে খোলা। টর্চের আলোয় দেখলাম ঘরের সমস্ত জিনিস ভাসছে। ঘটি বাটি সোফা চেয়ার ওয়ার্ড্রোব জামা কাপড় সব। দেখেও দেখিনি ভাণ করে মনোকষ্ট চেপে ভেতরে ঢুকে একজনকে আলগোছে আলমারীর উপর বসিয়ে দিলাম। অন্যজনকে জলে চুবিয়ে বাইরের বারান্দার দড়িতে ঝুলিয়ে দিলাম। তারপর দরোজা ভেজিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ফিরে এলাম প্রতিবেশীর বাড়িতে। তখনো জানি না কতটা কাজ হবে এই কৌশলে।

পরদিন সকালে জল খানিকটা নেমেছে। ভয়ে ভয়ে আমি জল ডিঙ্গিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখলাম জিনিসপত্র কিছুই খোয়া যায়নি। চোর ডাকাত কেউ আসেনি। বারান্দার দড়িতে ঝোলানো লুঙ্গিটা তখনো শুকোয়নি। ঘরের ভেতর হ্যারিকেনটা তখনো জ্বলছে মিটমিট করে। লুঙ্গি আর হারিকেনের যৌথ পাহারায় টিকে গেছিল অক্ষত মূল্যবান সম্পদগুলো।


Sunday, July 9, 2017

Blockade : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকায় অবরুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানী অস্ত্রবাহী জাহাজ

আমরা জানি ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানী অস্ত্রবাহী জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করেছিল চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকরা, কিন্তু আমাদের জানা ছিল না ১৯৭১ সালে আমেরিকার একটি বন্দরেও পাকিস্তানী জাহাজে অস্ত্র তুলতে অস্বীকার করেছিল সেখানকার শ্রমিকেরা।

আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শরনার্থীদের কেউ কেউ সুয়ারেজ পাইপের ভেতরে জীবনধারণ করেছে। কিন্তু জানা ছিল না ১৯৭১ সালে তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে খোদ হোয়াইট হাউসের সামনের ফুটপাতে কৃত্রিম সুয়ারেজ পাইপ বানিয়ে তার ভেতরে বাস করতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের বেশ কিছু মার্কিন শুভাকাংখী।

পৃথিবীর নানান দেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এরকম অনেক সংহতির চিহ্ন ইতিহাসে আঁকা আছে। সেইসব সংহতির একটি খণ্ডচিত্রকে নিয়ে আরিফ ইউসুফ নির্মিত তথ্যচিত্র Blockade। বহুল কাংখিত সেই তথ্যচিত্রটি স্বয়ং পরিচালকের উপস্থিতিতে গতকাল সন্ধ্যায় দেখার সুযোগ হলো বিস্তারের সৌজন্যে।

তথ্যচিত্রটি নির্মিত হয়েছে মূলতঃ আমেরিকার বাল্টিমোর বন্দরে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানী পতাকাবাহী জাহাজ 'পদ্মা'কে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে অবরোধ করা একদল মার্কিন তরুণদের সাক্ষাতকার নিয়ে। সেই তরুণরা তাদের বাঙালী বন্ধুদের মাধ্যমে জেনেছিল ওই জাহাজে পাকিস্তানের জন্য সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই করা হবে- যে অস্ত্র দিয়ে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হবে। কথাটি প্রচার হবার অনতিবিলম্বে পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির একদল দুঃসাহসী কিন্তু মানবিক চেতনার তরুণ সেই জাহাজটিকে প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নেয়। সভা করে, লিফলেট ছেপে, ব্যানার টাঙ্গিয়ে প্রচার চালাবার পর বন্দরে পাকিস্তানী জাহাজের জন্য অপেক্ষা করে। পাকিস্তানী জাহাজটি যখন বন্দরে নোঙর করে তখন পুলিশী বাধা অতিক্রম করে তারা জাহাজটিকে অবরোধ করে। শুধু অবরোধে থেমে ছিল না, অবরোধ করতে গিয়ে গ্রেফতার বরণ করেছিল, জেল খেটেছিল মার্কিন তরুণেরা। বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের প্রতি সংহতি জানানো এইসব মানুষদের শ্রদ্ধা জানাবার ভাষা আমাদের জানা নেই।

সেই সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্রকে সমন্বয় করে Blockade তথ্যচিত্রটি নির্মান করে আরিফ ইউসুফ মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংরক্ষণ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একদিকে দেশের মানুষকে দেখার সুযোগ দিয়েছেন একাত্তরে মার্কিন দেশে ঘটে যাওয়া সেইসব দুর্লভ কীর্তি এবং অন্যদিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন সেইসব মার্কিন বন্ধুদের যারা দুঃসময়ে আমাদের প্রতি দূর থেকে এমন জোরালো সমর্থন জারি রেখেছিলেন। নিজের খরচে তৈরী করা সেই তথ্যচিত্রটিকে তিনি বিনামূল্যে প্রদর্শন করেছেন ঢাকা চট্টগ্রামসহ আমেরিকার বিভিন্ন শহরেও। আরিফ ইউসুফ ভাইয়ের প্রতি আমাদের সীমাহীন কৃতজ্ঞতা।



ছবিটার ট্রেলার দেখার সুযোগ আছে অনলাইনে।


Sunday, June 4, 2017

ন কবিতা

তোমাকে দেখি আর নিজেকে দারুন উচ্ছৃংখল লাগে
তোমাকে দেখি আর নিজেকে বড় অপাংক্তেয় লাগে

আমাকে উচ্ছৃংখল রেখে তুমি
দু'পায়ে আলতা মেখে হাঁটছো ওই সংসারে

ভরাডুবি চাঁদটাকে আজ বিষ জ্যোৎস্নায় চুবিয়ে
খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে

(২৪.৪.২০১০)


গাঙ্গেয় ভূগোলের বিবর্তন

পদ্মা মেঘনা যমুনার সমস্ত জল যে পথ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে নামতো সে পথটি আমূল বদলে গেছে। যেখানে ছিল দুটি পথ সেখানে আছে আছে একটি পথ। কিভাবে এই পরিবর্তন হলো, কোন পথে যাত্রা করলো সেটা বোঝার জন্য কিছু মানচিত্র দেখা দরকার। একটা নদী আগাগোড়া মুছে গিয়ে সেখানে নতুন ভূখণ্ড জেগে উঠেছে ভাবতেই অবাক লাগে। কিন্তু সেটাই ঘটেছে। মুছে যাওয়া সেই নদীটি মেঘনা মোহনায় এসে যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশতো সেখানে এখন নোয়াখালীর বিস্তৃর্ণ চরাঞ্চল।

প্রথমে এই গুগল মানচিত্রটি দেখা যাক। এই অঞ্চলের  ইতিহাস বোঝার জন্য এই মানচিত্রটি বোঝা দরকার। এই অঞ্চলের ৪০০ বছর আগের ইতিহাস পড়তে গিয়ে বর্তমান মানচিত্রের দিকে চোখ রাখতে গেলে বিভ্রান্ত হতে হয়। কেননা এই ৪০০ বছরে নদীর অনেক জল সমুদ্রে গড়াতে গিয়ে আমাদের ভূগোলে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আমরা অনেকেই খেয়াল করি না সেই পরিবর্তনটা কত ব্যাপক বিস্তৃত। গাঙ্গেয় মোহনায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের অধিকারী মেঘনা। এই নদীটার গতিপথ আমূল বদলে গেছে। দুইশো বছর আগেও নদীটা চট্টগ্রাম সন্দ্বীপের মাঝখান দিয়ে বঙ্গোপসাগর স্পর্শ করতো। কিন্তু এখন সেটা পশ্চিমে সরে গিয়ে হাতিয়া বরাবর বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বর্তমান নোয়াখালী জেলার মাঝখান দিয়ে যে মেঘনা বয়ে যেতো, সেটা অবিশ্বাস্যই ঠেকে। অথচ সেটাই সত্যি। ফেনী নদীর সাথে মেঘনার দেখা সাক্ষাতের কথা ভাবাই যায় না এখন। অথচ একসময় ফেনী নদীর মুখেই মেঘনা বঙ্গোপসাগরে মিলিত হতো। এই মানচিত্রে তার কিছুটা ছাপ আছে সে কারণে মানচিত্রটি দেখতে বলা।




স্যাটেলাইট মানচিত্রের উপর হলুদ রেখায় কিছু সীমানা রেখা আঁকা আছে। একসময় মনে হতো হলুদ রেখাগুলো ভুল সীমানা নির্দেশ করছে। হ্যাঁ বর্তমানের জন্য সীমানাগুলো ভুলই। কিন্তু অতীতের জন্য সেই সীমানা চিহ্নই সঠিক ছিল। এই মানচিত্রের হলুদ সীমানাগুলো  এই ভূখণ্ডের আদি অবস্থানের চেহারার। মানচিত্রের এই সীমানা রেখা নেয়া হয়েছে পুরোনো কোন এক মানচিত্র থেকে। বলা বাহুল্য, এই হলুদ রেখার মানচিত্রের বয়স ১০০ বছরেরও কম। এর মধ্যেই মেঘনা নদী তার গতিপথকে যেভাবে বদলে ফেলেছে, আগামী একশো বছর এই অঞ্চলের জন্য নতুন মানচিত্র আঁকতে হবে। কেননা সন্দ্বীপের উত্তরদিকে যেসব চর জাগছে তাতে সন্দ্বীপ পঞ্চাশ বছরের মধ্যে নোয়াখালীর সাথে অবিচ্ছিন্ন ভূখন্ড হয়ে মিশে গেলে আশ্চর্যের কিছু না।

গুগল মানচিত্রের হলুদ সীমান্তের সমর্থন পাওয়া যায় নীচের এই মানচিত্রটিতেও। এই মানচিত্রে বাংলাদেশের সমস্ত নদীগুলোকে গতিপথ সহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই মানচিত্রটি খুব বেশী পুরোনো না। এই মানচিত্রেও দেখা যাচ্ছে মেঘনার মোহনা সন্দ্বীপের পূর্বদিকে বহমান ছিল। আমাদের দেশে খুঁজলে এখনো পাওয়া যাবে পুরোনো পাঠ্যপুস্তকে। যেখানে বাংলাদেশের মানচিত্র আছে সবগুলোতে মেঘনার মোহনাকে সন্দ্বীপের পূর্বদিকে দেখানো হয়েছে। এর কারণটা পরিষ্কার। বৃটিশরা যখন এই অঞ্চলের মানচিত্র তৈরী করতে শুরু করে তখন তার ভৌগলিক চেহারা এমনটিই ছিল। এই মানচিত্র ৬০ বছরের কম বয়সী। কেননা এখানে কাপ্তাই লেকের অস্তিত্ব আছে।



এবার দেখি উপনিবেশ আমলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত রেনেলের মানচিত্র। এই মানচিত্রটি আরো দুশো বছর আগের (১৭৮৬ সালের)। সেই মানচিত্রের ভৌগলিক চেহারা আরো অনেক বেশী ভিন্ন।


যে দ্বীপগুলো এখন সত্যের মতো বিদ্যমান একসময় সেগুলো সমুদ্রের অংশ ছিল। যে অংশ একসময় সমুদ্র ছিল, তা এখন ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। ভৌগলিক এই বিবর্তনগুলো বোঝা দরকার ইতিহাসকে পরিষ্কার করে বোঝার জন্য।




ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের 'বাংলাদেশ' আপত্তি

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের সুলিখিত গ্রন্থ  'বাংলা দেশের ইতিহাস'  এই বইটি বাংলার অন্যতর ইতিহাস গ্রন্থের মধ্যে একটু ব্যতিক্রম। এখানে তিনি রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্যের ঐতিহাসিক উপাদানগুলো নিয়েও আলোচনা করেছেন। সেই কারণে বইটি অতুলনীয় এবং অতীত খু‌ঁড়তে ইচ্ছুক পাঠকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।

কিন্তু  তিনি বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় নামকরণ বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন সেটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকে যায়। এই বিষয়ে ইতিপূর্বে কোথাও আলোচনা হয়েছে কিনা জানা নেই। কিন্তু দুই বাংলার সাধারণ মানুষের এই অংশ নিয়ে কিছু বলার থাকতে পারে। তাই সেই অংশটুকু এখানে তুলে ধরা হলো আলোচনার স্বার্থে।  এই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার কয়েক বছর পরে।




এই অংশে আমার আপত্তি হলো ইতিহাসের দিক থেকে পূরবঙ্গের 'বাংলাদেশ' নাম গ্রহনের কোন সমর্থন নেই। এই মন্তব্যটির সপক্ষে তিনি যে যুক্তি দিয়েছেন তা হলো




Bengal শব্দটির প্রতিশব্দ হলো 'বাংলা'। এটা কখনোই 'বাংলাদেশ' বোঝায়নি। এটার অনুবাদেও কেউ কখনো 'বাংলাদেশ' লেখেননি। অতীতে শত শত বছর ধরে বাংলা বলতে অবিভক্ত বঙ্গকেই বোঝাতো। রাজ্য হিসেবে অবিভক্ত একটি দেশ ছিল বাংলা। কিন্তু বাংলাদেশ নামের কোন রাজ্য কোথাও ছিল না। কবি সাহিত্যিকগণ বাংলাদেশ শব্দটি বহুদিন ধরে ব্যবহার করে আসলেও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ শব্দটির ব্যবহার হয়নি ১৯৭১ সালের আগে।

পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা বাঙালী পরিচয় দিতে পারবে না এ দাবী কেউ করেছে বলে জানা নেই। আবার স্বাধীন পূর্ববঙ্গকে বাংলাদেশ বললে কেন হাস্যকর শোনাবে সেটাও বোধগম্য নয়।

তবে সবচেয়ে গুরুতর মনে হয়েছে নীচের অংশটুকু-


'বাংলাদেশ' নামটি গ্রহন করার ব্যাপারে কারো আপত্তি থাকতে পারে, কারো অনুমতি নিতে হতে পারে এমন বিষয় এই প্রথম চোখে পড়েছে। মনে হচ্ছে রমেশচন্দ্র মজুমদার দেশভাগ মেনে নিতে পারলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়ে বিব্রত ছিলেন।

সাধারণ লোকে বাংলাদেশ নামের অর্থ পরিবর্তনকে গ্রহন করতে পারেনি- এই ব্যাপারটা কিভাবে নিশ্চিত হলেন তিনি?


Saturday, May 6, 2017

সময় দাক্ষিণ্য

সব এলোমেলো হয়ে যাবার আগে যেন আসে একটুখানি অবসর। সামান্য হাওয়া ভাবনা প্রান্তরে। প্রায়শ্চিত্বের কঠোরতায় বিলীন হতে না হয় সবটুকু সবুজকে। নিকষ অন্ধকার নেমে আসার আগে যেমন খানিক গোধূলির আলো জেগে থাকে, ততটুকুই যথেষ্ট। স্মৃতিবিস্মৃতির মর্মজটিলতায় হ্যাং হয়ে যাবার চেয়ে সুচিন্তিত শাট ডাউন.......।

Tuesday, April 18, 2017

সিপাহী বিদ্রোহ : চট্টগ্রামের ইংরেজ ক্যাপ্টেনের বিদ্রোহ বিবরনী ২৪ নভেম্বর ১৮৫৮

একজন মঙ্গলপাণ্ডে যখন ২৯শে মার্চ ১৮৫৭ তারিখে বিদ্রোহ করেছিলেন ইংরেজের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন একা। ছোট্ট একটি ঘটনায় তিনি প্রতিবাদী হয়ে প্রমান করেছিলেন হাজার মাইলের দাবানল ছোট্ট একটি আগুনের ফুলকি থেকেই শুরু হয়। তাঁকে প্রাণ দিতে হয় এক সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু সেই ফুলকি কোলকাতা ছাড়িয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল কয়েক মাসের মধ্যেই। সেই বিদ্রোহ ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে পারেনি ঠিক, কিন্তু একশো বছরের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসন থেকে ভারতকে সরাসরি ইংরেজ সরকারের শাসনে রূপান্তরিত করেছিল। এটাও একটা অর্জন। কোম্পানী শাসন ছিল বস্তুতপক্ষে দুবৃত্ত শাসন। ভারতবর্ষের মতো বিশাল একটি অঞ্চলের জন্য চরম অপমান। ভাড়াটে গুণ্ডাপাণ্ডা সৈন্য দিয়ে এত বিশাল একটা দেশকে দখল করে শাসন করায় ঔপনিবেশিক শক্তির চেয়েও বেশী কারণ ছিল আমাদের নিজস্ব বিভেদ এবং দুর্বলতা। অনেক রাজা মহারাজা যুদ্ধ বিগ্রহ করে যা পারেনি, এক মঙ্গল পাণ্ডে তা করতে পেরেছিল। তাই সিপাহী বিদ্রোহকে প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধও বলা হয়।

মঙ্গলপাণ্ডের সেই বিদ্রোহ এ আত্মদানের প্রভাব প্রায় আট মাস পরে পূর্ববঙ্গের বন্দর শহর চট্টগ্রামেও এক ঝলক দেখা গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে পূর্ববাংলা সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব থেকে মুক্তই ছিল। চট্টগ্রামের ওই্ একটি ঘটনা ছাড়া আর কোথাও কিছু ঘটেনি। ঢাকার লালবাগে একটু বিদ্রোহপ্রচেষ্টা গোড়াতেই থামিয়ে দেয়া হয়েছিল।

চট্টগ্রামের ঘটনার নায়ক ছিলেন হাবিলদার রজব আলী খান। নাম ছাড়া তাঁর আর কোন পরিচয় পাওয়া যায় না।

তিনি ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর বৃটিশের বিরুদ্ধে তার অন্যান্য সহযোদ্ধাসহ বিদ্রোহ করেন। তিনি বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরিরত ছিলেন। তার পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। ৩৪নং রেজিমেন্ট। কর্মস্থল ছিল প্যারেডগ্রাউন্ড। যা বর্তমানে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের খেলার মাঠ। ৩৪নং রেজিমেন্ট ছিল বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে সৃষ্ট রেজিমেন্ট। উক্ত রেজিমেন্ট ইংরেজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল।

জেলগেটের সশস্ত্র পাহারাদারদের পরাজিত করে হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলে আটক সকল বন্দীদের মুক্তি দিয়ে ছুটলেন চট্টগ্রাম ট্রেজারির দিকে। ট্রেজারিতে কর্তব্যরত বৃটিশ অফিসারকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা ট্রেজারি দখল করে প্রচুর টাকাকড়ি লুট করে নেয়। তারপর রজব আলীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ইংরেজদের চট্টগ্রামস্থ অস্ত্রাগার লুট করলেন। তিনটি হাতী ও অন্যন্য অস্ত্র সহকারে হাবিলদার রজব আলীর বিদ্রোহী সিপাহীরা ত্রিপুরা রাজার সাহায্য পাবার আশায় তার রাজ্য সীমানায় পৌঁছে গেলেন। এই ঘটনাগুলো দ্রুত গতিতে ঘটেছিল এবং হতাহতের সংখ্যা ইংরেজদের পক্ষে মাত্র একজন। বিদ্রোহীদের কেউ হতাহত হয়নি।

ত্রিপুরার দিকে এগিয়ে গেলেও রাজার সহায়তা না পেয়ে  হাবিলদার রজব আলীরা আর ত্রিপুরা না গিয়ে মনিপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মনিপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে অাঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে অবশেষে সিপাহীরা সিলেট এসে পৌঁছলেন। তারা তখন ক্লান্ত। অনেক দুর্গম পথ হেঁটে তারা সিলেটে পৌঁছেন।

ইংরেজরা খবর পেয়ে সেখানে আক্রমণ করতে আসে। খবর পেয়ে হাবিলদার রজব আলী এক পরিকল্পনা করলেন। সৈনিকরা তৈরি করলেন অনেকগুলো খড়ের মূর্তি। পাহাড়ের ঢালুতে তাঁবু গাড়লেন রজব আলী। সন্ধ্যার সাথে সাথে সেই মূর্তিগুলোকে সিপাহীদের পোশাক পরিয়ে তাঁবুর চারপাশে সুন্দরভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। রজব আলী সিপাহীদের নিয়ে পাহাড়ের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে রইলেন। এদিকে মেজর বাইঙ-এর নেতৃত্বে বৃটিশ সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে মুর্তিগুলোর উপর আক্রমণ করে বসল। এ সুযোগে হাবিলদার রজব আলী মেজর বাইঙকে হত্যা করেন। উক্ত যুদ্ধে অনেক বৃটিশ সৈন্য নিহত হয়। এরপর হাবিলদার রজব আলী মনিপুরের দিকে রওয়ানা হন।

সিপাহীরা মনিপুর প্রবেশ করলে সেখানেও আক্রান্ত হয়। এই পর্যায়ে এসে সিপাহীদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা চারদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম ত্যাগ করার পর সিপাহীদের রসদের অভাব দেখা দেয়। স্বাভাবিক কারণে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন সংঘর্ষে ২০৬ জন সিপাহী মারা যায়। অবশেষে রজব আলীর দল রেঙ্গুনের পার্বত্যাঞ্চলে চলে যায় এবং ধারণা করা হয় রেঙ্গুনের পার্বত্য জঙ্গলে খাদ্যাভাবে তাদের মৃত্যু হয়।

ঘটনার এইটুকু আগেই জানা ছিল।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক পড়াশোনা করতে গিয়ে সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষদর্শী একটি বিবরণের সন্ধান পাওয়া গেল বৃটিশ সরকারের একটি তথ্যভাণ্ডার থেকে। চট্টগ্রাম শহরে সেই সময় Captain P.H.K. Dewool ছিলেন ৩৪ রেজিমেন্টের প্রধান। তিনি বিদ্রোহের ঘটনাটির বিবরণ দিয়ে একটি পত্র লিখেছিলেন মেজর জেনারেল Sir J. Hearsey, K.C.B. এর কাছে যিনি প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের প্রধান ছিলেন।

১৮ নভেম্বর বিদ্রোহের এক সপ্তাহ পর ২৪শে নভেম্বর লিখিত সেই দুর্লভ চিঠির সম্পূর্ণ বিবরণী-

"Chittagong, November 24th, 1857.

 

" I have the honour to report, for the information of Major-general Sir J. Hearsey, K.C.B., commanding the presidency division, that, on the evening of Wednesday, the 18th instant, about nine o'clock, the detachment of the 34th regiment of native infantry mutinied, and instantly occupied the magazine with a strong body of men. Immediately upon hearing the noise from my house, which is quite close to the lines, I went to the parade in company with Lieutenant Hunter; but upon approaching the scene of disturbance, hearing the men very violent and loading their muskets, I directed that officer to retire, and went forward to the mutineers alone. I found a very strong guard in front of the magazine, who challenged me, and shouted out in a most violent tone, ' Don't care for him ! Go away ! you have no business here !'


I advanced up to it, and did my best, with every argument I could use, to persuade the men to their duty; but a Mohammedan, who was in a native dress, and not in uniform like the rest, standing out in front, called out in a loud voice, ' The whole detachment is in a state of mutiny, and we have all determined to die if it is necessary. Go away !' This he said shaking his hand in my face, and using the most violent gestures. A shout was then raised, ' Shoot him ! shoot him !' but a number of voices replied, 'No! no! don't hurt the captain.' Taking encouragement from this, and thinking I might have some men who would stand by me, I again endeavoured, by every persuasion, to bring the men to a sense of their duty, and appealed to several sepoys by name, who had previously borne a good character, to think what they were about, and to remain faithful to their salt; but they all replied that they had joined the mutineers, and that it was not their intention to withdraw. 


A shout was again raised, ' Shoot him ! shoot him !' which was again negatived ;and at the same moment two or three sepoys, with their muskets at the charge, came at me. Not liking this demonstration, I stepped back a few paces, and got out of the crowd, which was gradually getting round me; a Sikh of No. 4 company then came up, and giving me a rough push, said, ' Go away from this [Hum suh log bigger gya).'


Not a single native commissioned or non-commissioned officer, or Sikh, remained by me; and seeing nothing could be done, I went to the quarters of Lieutenant Hunter, close by, and found that officer with Lieutenant Thomson, walking in the verandah ;  I told them hastily what had occurred, upon which they armed themselves and immediately went away. I then went to every house in the cantonment, to give warning to the residents, but most of them had already taken alarm and fled. Ultimately joining the civil surgeon's family, who live at the extreme end of the cantonment, in their company I sought to make my own escape; but by this time the parade and all the road around were covered with mutineers, so that we were only able to reach the next house, where we were detained for about two hours ; we afterwards disguised ourselves as natives, and, under the guidance of the collector's bearers, proceeded by a jungle path to the banks of the river, when with difficulty we got a boat, and dropped  down to the Kortabeea lighthouse, from whence we returned yesterday.

 

"I have to state that the mutineers plundered the treasury most completely, and in doing so killed a burkandaze. They also broke open the gaol, and forced the prisoners to go with them to carry the treasure ; and afterwards returned to the cantonments, and blew up the magazine and burned down the lines. I am happy to say that none of the European residents have been personally injured, and that, with the exception of a horse or two which were taken away to carry their baggage, the mutineers have left all private property untouched. 


" I have been informed by a native named Thakoor Bux, formerly a jemadar of the Chittagong provincial battalion, whom the mutineers forced to go some distance with them, that the pay-havildar of No, 4 company, named Rujub Ali Khan, has assumed command of the detachment, which, we hear, has crossed the Fenny river, and entered the territories of the rajah of Tipperah.

 

" I took the opportunity while at Kootuhdeen, to write to the commissioner of Arracan, reporting the mutiny, and requesting him to send a copy of my letter for the information of the general commanding, which I hope has been done.


— I have

 

P.H.K. Dewool,

Captain,

Commanding 34th Regiment Native Infantry.

 

" P.S. — Lieutenants Hunter and Thomsonare in safety."




১৮৫৮ সালে প্রকাশিত The Mutiny of Indian Army থেকে সংকলিত।