Tuesday, November 14, 2017
'তখন হলুদ নদী নরম নরম হয়'
Sunday, November 12, 2017
ভাবনার চিরকুট : বিখ্যাত লেখকের অখাদ্য পুস্তক
[পুনশ্চঃ সেইসব লেখকের নাম উল্লেখ করে বিব্রত করলাম না। আমাদের সবারই পছন্দ অপছন্দের বই আছে নিজেদের বুকশেলফে। সেখানেই তাঁদের নাম মিলবে]
পাওয়া না পাওয়ার সুখ
আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম। এটার অর্থ কী? পাওয়া বলতে ঠিক কী বোঝায়?
আমার পকেটে অনেক কাংখিত একটি টাকার নোট আসলো। ৫০০ টাকার একটা চকচকে নোট। এই নোট একান্ত আমার। আমি চাইলে এটাকে খরচ করতে পারি, চাইলে ভাঙ্গাতে পারি। চাইলে ভেঙ্গে ভেঙ্গে দশ বারে খরচ করতে পারি, চাইলে একবারেও করতে পারি অথবা এটাকে ভাঙিয়ে দশটা পঞ্চাশ কিংবা পাঁচটা একশো অথবা অন্য যে কোন রূপে ভাংতি করিয়ে পকেটে রেখে দিতে পারি। এই পাঁচশো টাকার নোটটাকে আমি রীতিমত ভালোবেসে ফেললাম। এত সুন্দর নোট কখনো আমার হয়ে আসেনি আগে। এত বড় নোট আগে কখনো দেখিনি আমি। আমার ভীষণ আনন্দ আজ এটাকে পেয়ে। আনন্দে আমার খিদে চলে গেছে। রাতের ঘুম উধাও। আমি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শুধু পাঁচশো টাকার নোটের দিকে তাকিয়ে দিন কাটিয়ে দিতে পারবো। এই হলো পাওয়ার আনন্দ। আমি পাইলাম, যাকে পাইলাম তাকে ইচ্ছেমত ভোগ করিব। কেউ কিছু বলবে না, কেউ আপত্তি করবে না। এ শুধুই আমার। হ্যাঁ এটাকেই বলে পাওয়া। কিন্তু এই টাকা যখন খরচ হয়ে যাবে তখন কী পাওয়ার আনন্দটা জেগে থাকবে? না। খরচ হয়ে যাবার পর আর কোন আনন্দ থাকে না। তখন বড়জোর টাকা পাওয়ার এবং খরচের স্মৃতির সুখ।
যখন কোন মানুষকে পাওয়ার কথা বোঝানো হয়, তখন ঠিক কিরকম দাঁড়ায় ব্যাপারটা? ভালোবাসার মানুষটিকে আমি পাইলাম। পেয়ে যাবার পর মানুষও কি এরকম খরচ হয়ে যেতে পারে? টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে মানুষটির দর্শনসুখ, সঙ্গসুখ, স্পর্শসুখ উপভোগ করতে একসময় ফুরিয়ে যাওয়া? ইন্দ্রিয়ের ভেতর এই তিনটি সুখই মানুষ পেতে পারে প্রিয় মানুষ থেকে। তারপর একদিন সেই সুখের উপর মরিচা পড়ে, আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যেতে থাকে ঐন্দ্রিক আকর্ষণ। পাশে থাকলেও সেই মানুষকে আগের মতো ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে কখনো কখনো। যার উপস্থিতি একসময় প্রবল রকমের কামনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তার অনুপস্থিতিই তখন কামনা হয়ে দাঁড়ায়। বলা হয় সম্পর্ক ঝুলে গেছে। আসলে এখানেও টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে মানুষটি। তখন বড়জোর স্মৃতিটুকু বেঁচে থাকে। কিন্তু খরচ হয়ে যাওয়া জীবিত মানুষের স্মৃতিও বিরক্তির আধার হয়। এমন সময়গুলো মানুষের দুঃসময়।
আসলে পাওয়া জিনিসটা একটা মুহূর্তসুখ মাত্র। পাওয়া মানে কাছে পাওয়া কিংবা দর্শন পাওয়া কিংবা স্পর্শ পাওয়া। তিনটি পাওয়াই একান্ত অনুভবের ব্যাপার। সব রকম পাওয়াই আসলে একেকটি আপেক্ষিক অনুভব। যে অনুভবের ঘটনা ঘটতে পারে বাস্তবের কোন সঙ্গস্পর্শ ছাড়াই। শুধু চোখে দেখে, কানে শুনেও মানুষ পাওয়ার সুখ অনুভব করতে পারে। যদি অনুভবের শক্তি তেমন হয়। এটা মোটেও অলৌকিক নয়, নিতান্তই মানবিক বোধের গভীরতা। যার ছবি দেখে আমার ভালো লাগলো, যার চিঠি পড়ে আমার ভালো লাগলো, তাকে শব্দ এবং দৃশ্যের মাধ্যমেই স্পর্শসুখ অনুভব করতে সক্ষম মানুষের মন। একটা বাস্তব মানুষকে স্পর্শ করে যে সুখ, যে রাসায়নিক বিক্রিয়া আমাদের মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে, আনন্দ ও পুলক জাগায় শরীরে, সেই ঘটনা ঘটতে পারে শুধুমাত্র ছবি দেখে কিংবা কল্পনা করেও। তাহলে কাছে না পেয়েও, স্পর্শ না করেও পাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। সত্যিকারের পাওয়া যেমন ঘটনা ঘটার পর স্মৃতিতে ঠাঁই নেয়, কল্পনায় ঘটা ঘটনাটিও একইভাবে স্মৃতিভুক্ত হয়। যখন স্মৃতিভুক্ত হয় তখন দুই ঘটনার মধ্যে পার্থক্য খুব বেশী থাকে না।
Sunday, November 5, 2017
বই বনাম সিনেমা
Monday, October 30, 2017
অনর্থের অর্থ
আজকেই তেমন একটি ঘটনা দেখলাম। কনক এসে নয়নকে জানালো তার দেড় লাখ টাকা দরকার দুই মাসের জন্য। ব্যবসাটা শুরু করতে পারছে না এই সামান্য টাকার জন্য। কোন উপায় না দেখে নয়নের কাছে ধার চাইতে হচ্ছে। নয়ন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুর একজন।
নয়নের ব্যাংকে যে টাকা জমা আছে তাতে দেড় লাখ টাকা দেবার পরও আরো লাখ খানেক থাকবে। ওই দেড় লাখ না থাকলে দুই মাসের মধ্যে না খেয়ে মরবে না সে। তবু কনকের ধারের কথা শুনে সতর্ক অবস্থানে চলে গেল। জানালো সে ইতিমধ্যে একটা বিপদে পড়ে গেছে। আরেক বন্ধুকে দুই লাখ টাকা দিয়েছিল ব্যাংক ঋণ নিয়ে, সে টাকা এখনো ফেরত আসেনি। নইলে কনককে ঠিকই দিত টাকাটা। নয়নের কথাটা আংশিক সত্য। সে এক বন্ধুকে দু লাখ টাকা দিয়েছিল ছমাসের জন্য, সে টাকা হাওয়া হয়ে গেছে, সাথে বন্ধুটিও। সেই থেকে নয়ন কাউকে টাকা ধার দিতে ভয় পায়। টাকা থাকলেও দেয় না।
নয়নের কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে আমি ফোনটা হাতে নিলাম কনকের সাথে কথা বলার জন্য। গত মাসে আমার হাতে ষাট হাজার টাকা এসেছে। সেই টাকা বাসায় অলস পড়ে আছে। ভাবছি ওখান থেকে পঞ্চাশ হাজার ওকে দেবো কিনা। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়েই একটা স্বার্থপর চিন্তা মাথায় এসে ধাক্কা দিল। ডিসেম্বরের শুরুতে আমার বড় একটা খরচ আছে, বাচ্চাদের স্কুল ভর্তি। সেই সময়ে যদি কনক টাকাটা ফেরত দিতে না পারে? আমি ফোনটা রেখে দিলাম। মনে মনে শান্ত্বনা দিলাম নিজেকে, কনক আমার কাছে তো চায়নি। আমি আগ বাড়িয়ে দেবো কেন?
অর্থ অনর্থের মূল কিনা জানি না, কিন্তু অর্থ জিনিসটা মানুষের অভাব দূর করার কাজে যতটা লাগে, মানুষের চরিত্র এবং আন্তরিকতা মাপার জন্য তারো চেয়ে বেশী লাগে।
Thursday, October 26, 2017
নগরে নতুন উৎপাত
আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত যেসব উৎপাত সহ্য করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো শব্দ দুষণ৷ তার সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে কিছু ইতর তরুনের কান ফাটানো উচ্চ শব্দে যানবাহন চালনার ভয়ানক কুআচার৷
মোটর সাইকেল এবং কার দুই বাহনের সাইলেন্সার খুলে যত জোরে সম্ভব আওয়াজ তুলে মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাওয়া৷
মাঝরাতে ঘটনাটি বেশি ঘটে যখন রাস্তা খালি থাকে৷ এদের একটা দল আছে শহরে যারা রেসিং কার বানাতে চায় সাধারণ গাড়িকেও৷
মানুষের উপর শব্দের অত্যাচার করে বিনা কারণে বিকট শব্দ তুলে গাড়ি চালাবার কুৎসিত মানসিকতার এই নষ্ট তরুনেরা কেউ আইনের শেকলে বাধা পড়েনি এখনো৷ কেননা শব্দ নির্যাতন এদেশে অপরাধ বলে বিবেচিত হয়নি কখনোই৷ অথচ কান ছাড়াও শরীরের অন্য অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে৷ বন্ধ হয়ে যেতে পারে হৃদপিণ্ডের ঘড়ি৷
এই উৎপাত বন্ধ করার উপায় কী? আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিতে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া? নাকি আইন নিজেই এগিয়ে আসবে প্রতিকার করতে?
Tuesday, October 24, 2017
অপরাজিতা স্মৃতি
আমার ঘরের বাইরে অপরাজিতার ঝোপ, পাতার ফাঁকে নীল চোখ মেলে বর্ষায় অপরাজিতা ফুল তাকিয়ে থাকে। শরৎকালে উঠোনে ফোটে স্থলপদ্ম, পায়ের ছোঁয়ায় লজ্জাবতী কুঁকড়ে যায়, ঘাসের সবুজে লাল কেন্নো জ্বলজ্বল করে। শীতের দিনে শুকনো পাতার গন্ধ ভাসে হাওয়ায়। চৈত্র মাসে বাতাস ছুটে আসে দুদ্দাড়- আমার টেবিলের কাগজপত্র উড়িয়ে নেয়, নিবিয়ে দেয় আমার সন্ধেবেলার কেরোসিন ল্যাম্প। খোলা মাঠের মধ্যে একলা সেই টিনের ঘরটা জ্যৈষ্ঠের দুপুরে উনুন হয়ে ওঠে, আর মাঘের রাত্রে বরফের বাক্স। ঘরে বসে শুনি শুকনো পাতা ঝরে পড়ে ঝর্ঝর, কোনো স্তব্ধ রাতে আঁতুড়ের শিশুর গলায় কান্না – বটগাছে কোন পক্ষীশাবক ডেকে উঠলো। কখনো শুনি সারা দুপুর ছাদ পেটানো গান- সারেঙ্গি বাজে একটানা, তালে-তালে মুগুর পড়ে ধ্রাম-ধ্রাম, সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গেয়ে চলে কুড়ি-পঁচিশটি মুগুর পেটানো বাচ্চা ছেলে – উব-হাঁটু হয়ে বসে, সারা গায়ে-মাথায় রোদ্দুর নিয়ে, অক্লান্ত। বর্ষা নামে বিশাল- আকাশ ছেয়ে, প্রান্তর ছেয়ে, পৃথিবী জুড়ে, ধোঁয়াটে নীল কালো মেঘের ভিড়ে নিবিড়- আমাদের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে যেন হাজার সেতারের রিমঝিম বাজনা। বাইরে কাঁচা রাস্তায় কাদা, মাঠে মাঠে ঘাস আরো লম্বা, সব ফোকর ডোবা হয়ে উঠলো, ব্যাঙেদের ফুর্তি অঢেল। কখনো কোনো বৃষ্টি থেমে যাওয়া মধ্যরাতে মেঘ চুঁইয়ে ঝরে পড়ে জ্যোছনা। মাঠের উপর রাত্রি হয়ে ওঠে নীলাভ, আর সবুজ, আর রহস্যময়। কখনো সারারাত বৃষ্টির পরে সূর্য উঠে আসে উজ্জ্বল, নতুন উৎসাহে দখল করে নেয় জগৎটাকে। আবার কখনো কোনো মেঘলা সকালে হাওয়ায়-হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় গান- কনক দাশের কন্ঠে – 'আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে – পিছু ডাকে-' আমার মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সম্মোহন - কোনো সুখ, যা মুখে বলা যায় না, কোন দুঃখ, যা সুখের চেয়েও ভালো।
ছবি কৃতজ্ঞতা : শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদের ফেসবুক পোস্ট
এই বর্ণনার সাথে আমার স্মৃতির সম্পর্কটা এতই গভীর যে পড়ার মাঝখানেই কিছু সময় থেমে গিয়ে ফিরে যাই আশির দশকে। বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনীতে বিশ দশকের নয়াপল্টনের স্মৃতির বর্ণনার সাথে আমার নিজের পুরোনো বাড়িটার অদ্ভুত কিছু মিল। বর্ণনার মধ্যে শুধু কয়েকটি শব্দ একটু বদলে দেয়া হয়েছে।
Saturday, October 21, 2017
প্রথম ডায়েরী ১৯৮৫
বহুদিন পর দেরাজ খুলে বের করে হাতে নিয়ে ৩২ বছরের ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করলাম। ডায়েরিটার ছবি তুলে স্মতির একটা নজির রেখে দিতে ইচ্ছে করলো। আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ার প্রথম তারুণ্যের একটা স্মৃতি। এখানে আমার পরবর্তী এক দশকের চিন্তাভাবনাগুলোর বিবর্তন আঁকা আছে টুকরো টুকরো কথায়। কিছু কিছু কথা পড়ে এখন হাসি পেয়ে গেল। বয়সের তুলনায় অনেক অগ্রসর কিছু ভাবগম্ভীর দার্শনিক ভাবনা। এই বয়স হলে মেনে নেয়া যেতো, কিন্তু তিন দশক আগে আমি তেমনটি ভাবতাম? বিশ্বাস হতে চায় না।
এই ডায়েরীপ্রাপ্তির এক দশকের মধ্যে আমার শিক্ষাজীবনের অবসান ঘটে এবং যেদিন কর্মজীবনে প্রবেশ করি সেদিন থেকে এই ডায়েরীর লেখারও অবসান ঘটে। দশ বছর ধরে একটা ডায়েরীতে সীমাবদ্ধ থাকার অন্যতম কারণ হলো বিশেষ কোন ঘটনা না ঘটলে এখানে লেখা হতো না। এই ডায়েরীর পাতাগুলো এত মসৃণ, এত সুন্দর যে কখনো এলোমেলো কিছু লেখা হতো না। দৈনিক কোন ঘটনার চেয়ে ইস্যুভিত্তিক লেখাই বেশী স্থান পেয়েছে। আমার লেখালেখির যাত্রা শুরু এই ডায়েরী থেকেই। যদিও তখনো আমার ধারণা ছিল না কখনো লেখালেখির জগতে আসবো কিনা।
এই ডায়েরীর পর আরো অর্ধডজন ডায়েরী লেখা হয়েছে পরবর্তী ২০ বছরের কর্মজীবনে, কিন্তু এটাকেই সবচেয়ে মূল্যবান বলে মানি এখনো। এই পাতাগুলোর পরতে পরতে আমার ৩২ বছর পুরোনো জীবনটা লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে উল্টেপাল্টে দেখতে হয় সেই সময়টাকে। মাঝে মাঝে জীবন এমন কিছু কঠিন সময় পাড়ি দিয়েছে তার কোন চিহ্ন এখন আর কোথাও নেই এই ডায়েরীর পাতা ছাড়া। শুধু স্মৃতিকাতরতা নয়, নিজের আদি সত্ত্বাকে আবিষ্কার করার জন্যও পুরোনো ডায়েরীর বিকল্প নেই। যে চিন্তাভাবনাগুলো মগজে খেলতো, যে পৃথিবীকে ওই চোখে দেখেছিলাম, যে সমাজ আমাকে ঘিরে রেখেছিল তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে এই সময়ে এসে? যে আদিম হতাশাগুলো আমাদের জীবনের উপর আরোপিত ছিল তার কতখানি অবসান ঘটেছে এই একুশ শতকে এসে? উত্তরগুলো মনে মনেই খুঁজি।
Thursday, October 19, 2017
(বে)তমিজউদ্দিন কোং লিমিটেড
ভাবনাটি কাজে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হলো সাথে সাথে। দুত পাঠিয়ে রাজার কাছ থেকে একটা অনুমতিপত্র আনা হলো। শর্ত হলো বছরে ৩ হাজার পাউন্ড ট্যাক্স দেয়া লাগবে। তমিজউদ্দিন তাতে রাজী।
অতঃপর নদীর তীরে গাছ কেটে পরিষ্কার করে কয়েকটা ছাউনি তুলে নিজেদের মালামালগুলো রাখতে শুরু করলো তমিজ। কিন্তু স্থানীয় ইংরেজরা ঝামেলা পাকাতে শুরু করলো কদিন না যেতেই। ঘোড়ায় করে এসে হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে উঠে যাবার জন্য। ঝামেলা এড়াতে চারদিকে বড় দেয়াল তুলে ভেতরে কিছু সশস্ত্র সৈন্যকে পাহারায় রাখতে হলো।
একটা দুর্গ তৈরি করতে পারলে আরো ভালো হতো। কদিন পর ইট পাথর দিয়ে মোটামুটি একটা দুর্গও তৈরি করা হলো। এবার সৈন্য দরকার আরো। দরকার কিছু কামানও।
বাংলাদেশে খবর পাঠালে তমিজউদ্দিন লিমিটেডের হেড অফিস আরো তিন জাহাজ ভর্তি করে সিপাহী পাঠিয়ে দিল। সাথে দেড়শো কামান। সেই জাহাজ বন্দরে ঢোকার সময় স্থানীয় ইংরেজ প্রশাসক এণ্ডারসন বাধা দিল। তার বক্তব্য হলো এখানে শুধু বাণিজ্য করা যাবে, দুর্গ নির্মাণ করা যাবে না, এত সৈন্য রাখা যাবে না।
এই কথা শুনে তমিজউদ্দিন ক্ষেপে গেল। মশকারি পাইছস? বচ্ছরে তিন হাজার টাকা টেকসো দিয়া লাইসেন্স নিছি বেবসা করার, লিজ নিছি এই এলাকা। আমি এখানে ব্যবসা করমু, সৈন্য রাখমু, আমার বেবসার নিরাপত্তা আমি দেখমু, তুই এখানে মাতব্বরী করস কোন বাপের সাহসে? বেশী তড়পাইলে গুলি মেরে খুলি উড়িয়ে দেবো। পিস্তল বাগিয়ে বেরিয়ে এলো তমিজউদ্দিন। হুকুম দিল, কামান দেগে গুল্লি মেরে উড়ায়ে দে সব!
দেশ থেকে আসা জাহাজ থেকে কামান দাগানো হলো। দুই পক্ষে তীব্র গোলাগুলি শুরু হলো। তমিজউদ্দিনের বাহিনী সুশিক্ষিত এবং ভয়াবহ রকমের দুর্ধর্ষ। ভদ্রগোছের ইংরেজরা তাদের সাথে টিকতে না পেরে পালিয়ে গেল। ইতিমধ্যে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেলে তমিজউদ্দিন সাউদাম্পটন বন্দর ও পাশের শহরটি দখল করে নিল।
অতঃপর তমিজের সেনাপতি রাজা জেমসের কাছে দুত পাঠিয়ে বললো সাউদাম্পটন শহরটি তমিজউদ্দিনের নামে লিখে দিতে হবে এবং তমিজউদ্দিন লিমিটেডকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য অধিকার দিতে হবে। যদি রাজা তাতে রাজী না হয় তাহলে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বাকিংহাম প্রাসাদও দখল করে নেয়া হতে পারে।
তমিজউদ্দিনের চিঠি পেয়ে এবং যুদ্ধের ফলাফল দেখে ভয় পেয়ে রাজা জেমস ঝামেলা এড়াতে সাউদাম্পটন শহরটি তাকে লিখে দিয়ে সেখানে শুল্কমুক্ত ব্যবসার লাইসেন্স দিলে ধুমিয়ে বাণিজ্য শুরু করলো তমিজউদ্দিন লিমিটেড।
শুধু ব্যবসা না, আরো কিছু কাজে হাত দিল তমিজ। সাউদাম্পটন শহরের নাম বদলে তমিজপুর রাখা হলো। সাউদাম্পটন শহরের আগের নিয়মকানুন বদলে বাংলাদেশের আইন জারি করা হলো। স্থানীয় ইংরেজরা তাতে বাধা দিতে চাইলে বেদম মার খেল। তমিজপুরের ইংরেজদের উপর মোটা করধার্য করা হলো, তাদের ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে শুধু বাঙালীদের জন্য ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো। এভাবে ইংল্যান্ড থেকে নিয়মিত আমদানি রপ্তানি করে বাংলাদেশ ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকলো।
তমিজউদ্দিন ওই শহর দখল করার কয়েক মাস পর খবর পেল রাজা জেমস ইংরেজ ব্যবসায়ীদেরও শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের লাইসেন্স দিচ্ছে। শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তমিজউদ্দিনের। এইটা কী মগের মুল্লুক? আমরা এতদূর থেকে আসছি ব্যবসা করে তোদের দেশকে উন্নত করতে, আর তোরা ঘরে বসেই শুল্কমুক্ত সুবিধা নিবি? কিছুতেই হতে দেবো না। শুল্কমুক্ত সুবিধা খালি আমাদের, বাঙালীদের থাকবে। তমিজউদ্দিন লিমিটেড বাদে দুনিয়ার কেউ এই সুবিধা হাতাতে পারবে না। তুড়ি বাজিয়ে ঘোষণা দিল তমিজউদ্দিন।
ঘাঁটিতে আরো সৈন্য সমাবেশ করে এবার খোদ রাজা জেমসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো তমিজ। আসলে শুধু একটা শহর দখল করে পোষাতে পারছিল না তমিজউদ্দিন লিমিটেড। দিনে দিনে খাই বেড়ে গিয়েছিল তার। তমিজউদ্দিনের বেতমিজ সাহস দেখে ক্ষেপে গেল রাজা জেমস। হুংকার দিয়ে সমগ্র বাঙালী সমাজকে ইংল্যান্ডের মাটি থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে পাল্টা আক্রমণ চালালো।
কিন্তু তমিজের কৌশলী বাহিনীর সাথে পেরে উঠলো না রাজা জেমসের বাহিনী। ইতিমধ্যে ঘুষ দিয়ে বারো জন জেনারেলকে বাঙালীদের পক্ষে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে তমিজউদ্দিন। অধিক সৈন্য থেকেও ইংরেজরা পারলো না বাঙালীদের সাথে। হেরে গিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বাকী সৈন্যরাও তমিজের বশ্যতা স্বীকার করে দলে দলে যোগ দিতে লাগলো তমিজ বাহিনীতে।
অবস্থা বেগতিক দেখে রাজা জেমস পালিয়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নিলেন। এরপর সমগ্র ইংল্যান্ডে জারি হলো বাংলার শাসন। বাংলার প্রথম উপনিবেশ হিসেবে ইংল্যান্ডের নাম সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হলো। তমিজউদ্দিন লিমিটেড পরবর্তী ২০৭ বছর ইংল্যান্ড শাসন করলো।
১৮৩৭ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া জন্মগ্রহন করার পর বাংলাদেশে একবার ভয়াবহ বন্যার পর বেশ বড় আর্থিক ক্ষতি সম্মুখীন হলে তমিজউদ্দিন লিমিটেড ইংল্যান্ডকে মুক্ত করে স্বাধীনতা দিয়ে দেশে ফিরে এল ব্যবসা গুটিয়ে।
বাংলাদেশে এখন চর তমিজউদ্দিন বাদে আর কোন স্থাবর সম্পদ নেই তমিজউদ্দিনের। অনাকাংখিত এই পতনে তমিজউদ্দিনের ২০০ বছর বয়সী শরীর ঘেমে উঠলো।
*** *** ****
*** *** ****
জেগে উঠে তমিজউদ্দিন জাহাজের খোলে নিজেকে আবিষ্কার করলো। দড়ি টানতে টানতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পায়নি। ইতিহাসে এম এ পাশ করে জাহাজের কুলীর চাকরী নিয়ে সাউদাম্পটন বন্দরে এসে পৌঁছেছে গতকাল। জাহাজ থেকে চুপি চুপি একবার নেমে পড়তে পারলেই ফক্কা। কিন্তু এ কী জাতের স্বপ্ন দেখলো সে! এমনও কী সম্ভব, এমনকি স্বপ্নেও? ইংল্যান্ড তিনশো বছর আগে তাদের দেশে যা করেছে সেটাই তার অবচেতন মন করতে চাইছে এখানে এসে?
নাহ, মাথাটা সার্ফ এক্সেল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে কুচিন্তা সব ঝেড়ে ফেলতে হবে।
হারানো দিনের গান......গান নয় জীবন কাহিনী
Wednesday, October 18, 2017
আমাদের ভয়াবহ নাগরিক জীবন
Saturday, October 14, 2017
যুদ্ধের চেয়ে দারিদ্র শ্রেয়
একটি করযোগ্য জীবনাবসান
কিন্তু সংসার খরচ এখান থেকে দিতে হলে এই অংকটার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩৫ মাস। মাসে ৪০ হাজার খরচ করলে এই টাকায় তিনি তিন বছর চলতে পারবেন। ৬৩ বছর বয়সে গিয়ে কী করবেন? এখন কী নতুন করে চাকরী করার সুযোগ আছে? শরীরে নানান অসুখ বাসা বেঁধেছে ইতিমধ্যে। স্ত্রীও খুব বেশী সুস্থ নয়। দুই মেয়ের পড়া শেষ হতে আরো দু বছর বাকী। তাদের বিয়ের খরচ কোথা থেকে আসবে। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসতো না অবসরের কয়েক মাস আগ থেকে। তখনই পৈত্রিক সম্পত্তির কথা মনে হয়েছিল। তিনি নিজের আয়ে এক টুকরো জমিও কোথাও কিনতে পারেননি। কপালগুনে পৈত্রিক সম্পদটা পেয়েছিলেন বলে এখনো শহরে বাস করতে পারছেন। বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট জমিটি বিক্রি করে পেলেন ২৬ লাখ টাকা।
হিসেবের কাগজটা হাতে নিয়ে মাহতাবউদ্দিনের মাথা চক্কর দিল। এত টাকা বেড়ে গেল এক লাফে? তিনি ব্যাপারটা নিয়ে একটু যুক্তি তর্ক দিতে চাইলে ধমক খেলেন ক্লার্কের কাছে- বেশী কথা বলবেন না, এটা সরকারের আইন। বাড়ি থেকে টাকাপয়সা নিয়ে আসেন।
বই পড়া না পড়া
এই আনন্দযোগ শুরু হতে আমাদের আরো কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল। তবে চারপাশে তাকিয়ে দেখি অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এই আনন্দযোগ নেই। একেবারেই নেই। বন্ধুদের মধ্যে এক আধটু আউট বই পড়াশোনা করতো, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পর তা একদমই চলে গেছে। সবাই সংসার, ক্যারিয়ার, টাকাপয়সা ইত্যাদি নিয়ে এত বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে বইয়ের দিকে তাকাবার সময় কারো নেই।
তখন ভাবতাম আর কখনো ফেরা হবে না ওই আনন্দ জগতে। আর সবার মতো আমিও সংসার সমুদ্রে মিশে হারিয়ে গেলাম বুঝি। সারা বছরে মোটামুটি উপভোগ্য কর্মছুটি ছিল দুই ঈদ। এক নাগাড়ে চার-পাঁচদিন ছুটি। একবার অফিসে ঈদের ছুটির সময় শেষ কর্মদিবস শেষে অফিসের বাসে নিজের গন্তব্য আগ্রাবাদ না নেমে চলে গেলাম নিউ মার্কেট। পকেটে ঈদ বোনাসের টাকা। একটু সুখ সুখ অনুভূতি। এই ঈদে দুয়েকটা বই কেনা যাক। নিউ মার্কেটের সামনে কারেন্ট বুক সেন্টারে ঢুকলাম অনেকদিন পর। ছাত্র জীবনের প্রিয় বই কেনার এই জায়গা। ঘুরে ঘুরে বইগুলো ছুঁয়ে দেখতেও আনন্দ। অনেকদিন পর বই কিনলাম, ঈদসংখ্যা কিনলাম, কিনলাম একটি 'উন্মাদ'ও।
আরো অনেক বছর পর .....যখন থেকে জীবিকা বদল হলো, স্বাধীন জীবনের সুত্রপাত ঘটলো, পড়াশোনার দীর্ঘ অবসর ফিরে এলো। এই পর্বের নতুন একটি আনন্দ পাঠানুভূতি বিনিময়। অন্তর্জালের মাধ্যমে সেই আনন্দের সঙ্গী পাওয়া আরো একটি ভাগ্যযোগ। বেঁচে থাকার অনেক সৌন্দর্য তাতে পাখা মেলে অনায়াসে। জীবনের নানাবিধ কুৎসিত উপকরণকে এড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখার একটা আশ্রয়ও। বইবন্ধুর মতো প্রিয় সঙ্গী আর কে হতে পারে?
Thursday, September 7, 2017
রোহিঙ্গা সমস্যা – জাতিগত অস্তিত্ব নির্মূলই প্রধান লক্ষ্য
একটি অবোধ দুগ্ধপোষ্য রোহিঙ্গা শিশুর লাশ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সৈকতের কাদাজলে। শিশুটি যখন জীবিত ছিল তখনো সে জানতো না তার জাত, ধর্ম কিংবা দেশ কোনটি। বোঝার বয়স হবার আগে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় নৌকাডুবিতে জলে পড়ে যাবার আগে সে কেবল চিনতো মায়ের কোল।
রোহিঙ্গাদের ঘরছাড়া হবার ইতিহাস বেশ পুরোনো। সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায় ১৯৮২ সালে বার্মার সামরিক সরকার ঘোষণা করলো ১৮২৩ সালের পর থেকে যেসব মানুষ আরাকানে বাস করতে শুরু করেছে তাদের কাউকে বার্মার নাগরিকত্ব দেয়া হবে না। তাদের কোন ভোটাধিকার থাকবে না। শান্তির নোবেল পুরস্কার নিয়ে মানবতার প্রতীক বলে পরিচিত অং সান সু কি-র গণতান্ত্রিক সরকারও সেই সিদ্ধান্তেই অটল এই ২০১৭ সালেও। রোহিঙ্গা নামে পরিচিত সেই জনগোষ্ঠীর কোন দেশ নেই, তাদের কোন নাগরিকত্ব নেই। কয়েকশো বছর ধরে যারা ওই ভূখণ্ডে বাস করছে তাদের নাগরিকত্ব না থাকার কারণ নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে তারা বাঙালী।
বেছে বেছে শুধু কিছু নির্দিষ্ট জাতি একটা রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাবে, বাকীরা শত শত বছর ধরে ওই ভূখণ্ডে বাস করেও নাগরিকত্ব পাবে না, এই আধুনিক যুগে ভাবা যায়? কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে মগের মুল্লুক বলে পরিচিত ওই ভূখণ্ডে সেই বর্বর নিয়মই আইন। এখানে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অকার্যকর।
ঘটনার মূল খুঁজতে আরো কিছুদূর পেছনে যেতে হবে। মায়ানমারের রাখাইন নামের প্রদেশটি একদা আরাকান নামে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৭৮৪ সালে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কোন্দলের সুযোগে বার্মা আরাকান দখল করার সুযোগ পায়। দখলীকৃত ভূখণ্ডের নাগরিকদের গলায় অপমানজনকভাবে তালপাতায় লিখে ঝুলিয়ে রাখতে হতো – "নিং থোয়া বারাং ক্যোঁয় ডো মো" নামের বাক্যবন্ধ, যার অর্থ উদীয়মান সূর্য বর্মী রাজার আমি দাসানুদাস। ১৭৯৮ সালে আরাকানীদের উপর বার্মার বোদপায়া রাজার নির্যাতন চরমে উঠলে নাগরিকরা পালিয়ে আসতে থাকে বাংলাদেশে।
সেই আরাকানীদের মধ্যে ছিল বৌদ্ধ এবং মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ। ছিল বাঙালীরাও যারা আরাকানে বসবাস করছে শত শত বছর ধরে। সেই পালিয়ে আসা শরণার্থীদের অনেকে বাংলাদেশেই থেকে যায় স্থায়ীভাবে। যাদের কিছু অংশ কক্সবাজারে আর কিছু অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে ঠাঁই নেয়। তখন থেকেই আরাকান নামক রাজ্যটির নাম মুছে যাওয়া শুরু হয়।
১৮২৫ সালে আরাকান বৃটিশ অধিকারে আসার পর অনেকে ফিরে গিয়েছিল নিজ নিজ বাসভূমিতে। তাদের মধ্যে বাঙালী বৌদ্ধ হিন্দু মুসলমান সব জাতিধর্মের মানুষ ছিল। আরাকান বৃটিশ অধিকারে যতদিন ছিল ততদিন পর্যন্ত আরাকানে যাতায়াতে বাঙালীদের পথ ছিল অবারিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় জাপানী আক্রমণের আগ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল।
আরাকান ও চট্টগ্রাম অভিন্ন রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল বহুকাল ধরে। চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকানেরই অংশ ছিল শত শত বছর ধরে। এমনকি হাজার বছর আগেও চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। সেই সুত্রে আরাকানে বাঙালী হিন্দু মুসলমানের বিচরণ বহুকাল ধরে। এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় বসতি স্থাপন করাটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। জাতিসত্ত্বার পরিবর্তন না ঘটিয়েও মানুষ সারা পৃথিবীতে বসতি স্থাপন করে ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র এবং জাতিসত্ত্বার পরিচয় সবসময় অভিন্ন হয় না। একটি রাষ্ট্রে বাস করে বহু জাতি ধর্মের মানুষ। ন্যূনতম সভ্য দেশে এটা মেনে নেয়াই রীতি।
এমনকি অর্ধসভ্য মধ্যযুগেও সেই রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু বার্মার ক্ষমতাসীনেরা সেই রীতিকে কখনো সম্মান করেনি। দুশো বছর আগে যে কায়দায় আরাকানীদের শরণার্থী জীবন বরণ করতে হয়েছিল, আজো সেই শরণার্থী জীবনই বহন করতে হচ্ছে তাদের।
প্রায় দুশো বছর পর ১৯৭৭ সালে আবারো শুরু হয় উদ্বাস্তু সমস্যা। সেই সময়ও লাখ লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়েছিল বার্মা থেকে। সরকারি হিসেবে সংখ্যাটি ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ও বার্মার সাথে যে চুক্তি হয় সে অনুযায়ী কিছু রোহিঙ্গা দেশে ফিরতে পেরেছিল। কিন্তু ১৯৯২ সালে আবারো দেখা দেয় একই সংকট। সেই দফায়ও লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরপর ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ প্রতিবছরই একেক দফায় রোহিঙ্গাদের ঠেলে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
২০১৭ সালে এসে মাত্র দুই সপ্তাহে রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছে দেড় লাখের বেশী। এখনো প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লাখের কম নয়। বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু সংকটের একটি।
খুব পষ্ট করে একটি কথা জানানো দরকার যে এই সমস্যাটা মোটেও ধর্মীয় নয়। মুসলমান বলে রোহিঙ্গাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে না। বার্মার বিভিন্ন প্রদেশে বহু মুসলমান আছে যাদের সাথে কোন সমস্যা নেই। এই সমস্যাটা মূলতঃ জাতিগত। রোহিঙ্গারা বাঙালী বংশোদ্ভুত বলেই তাদেরকে নাগরিক বলে স্বীকৃতি দিতে রাজী নয় মায়ানমার সরকার। শুধু সরকার নয়, সাধারণ বার্মিজদের দৃষ্টিভঙ্গীও অনেকটা সরকারের মতো। তারা রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা না বলে অভিবাসী বাঙালী হিসেবে দেখে আসছে চিরকাল। কিন্তু একজন অভিবাসীর কত শত বছর লাগে নাগরিক হয়ে উঠতে? আমেরিকার মতো দেশে মাত্র ৫ বছর বাস করেও নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু সাত পুরুষ বাস করেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব মেলেনি মায়ানমারে ।
বর্তমান পৃথিবীর অন্ততঃ তিনটি মহাদেশের সমাজ গঠিত হয়েছে ভিনদেশী অভিবাসীদের হাতে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া। খুব বেশীদিন না। মাত্র ৩০০-৫০০ বছরের মধ্যে এই মহাদেশগুলোতে অভিবাসনের ঘটনা ঘটেছে। এখন হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি মেক্সিকো দখল করে স্পেনিশভাষীদের বলে 'তোমরা তো এখানকার অভিবাসী মাত্র, নাগরিক নও, স্পেনে ফিরে যাও'- কেমন দাঁড়াবে ব্যাপারটা?
এবার একটু বিপরীত কথা বলা যাক। ২০১৭ সালে নতুন করে এই সমস্যার উদ্ভব নিয়ে বলতে গেলে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে দায়ী করতেই হয়। সাধারণ রোহিঙ্গারা হয়তো দায়ী নয়, কিন্তু নব্য গঠিত একটি জঙ্গী সংগঠনের নাম শোনা যাচ্ছে The Arakan Salvation Army (ARSA). যে সংগঠন মায়ানমারে কয়েক দফা আক্রমণ চালিয়েছে গত বছরের অক্টোবর থেকে। সর্বশেষ আক্রমণ মায়ানমারের ২৫টি পুলিশ চৌকির উপর। যার প্রতিক্রিয়াতে মায়ানমার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করছে। এই জঙ্গী গোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে। কেননা ওই জঙ্গীদের সাথে বাংলাদেশের জঙ্গীদের যোগাযোগ থাকার ঘোরতর সম্ভাবনা রয়েছে। এই জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকগন এই সমস্যাকে ধর্মীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে যদিও ধর্মের সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই।
আন্তর্জাতিকভাবে এই জঙ্গীদের কোন রাষ্ট্র নেই, যে কোন রাষ্ট্রেই তাদের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘাড়ে চেপে যদি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যদি অস্থিতিশীল করে তোলে তাহলে সেটা হয়ে দাঁড়াবে গুরুতর আঞ্চলিক সমস্যা। যেখানে জড়িত হতে পারে ভারত বা থাইল্যাণ্ডের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো। সন্ত্রাসবাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা থাক। মূল মানবিক সমস্যার দিকে চোখ ফেরানো যাক। সবার উপরে মানুষ যদি সত্য হয়ে থাকে, সেই মানুষের একটি ভূখণ্ডে বাস করার অধিকার আছে। যে ভূখণ্ডে পূর্বপুরুষেরা শত শত বছর ধরে বাস করে গেছে সেটাই আমার বাড়ি, সেটাই আমার দেশ। প্রতিটি মানুষের একটি দেশ থাকার অধিকার আছে। এটা প্রতিটি মানুষের সার্বজনীন অধিকার। সেই অধিকার প্রদানে মায়ানমার সরকারকে বাধ্য করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। শুধু বাংলাদেশের উপর সমস্যা চাপিয়ে বসে থাকলে সমাধান আসবে না। রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক নাগরিক অধিকার না দিলে এমন বর্বর অমানবিক ঘটনার পুনরাবৃত্ত হতেই থাকবে।
Thursday, July 13, 2017
বেনেফিট অব ডাউট
কিন্তু সেবার হঠাৎ এমন এক দুর্যোগ অতর্কিতে হানা দিলো সবাইকে পালাতে হলো ঘর ছেড়ে। এক রাতের অবিরাম ভারী বর্ষণে সমস্ত শহর যখন ডুবে গেল, তখন এই বাড়িটাও খুব দ্রুত এক বুক পানির নিচে ডুবে যাচ্ছিল দেখে সাত সকালে বাড়ির বাসিন্দারা কোনমতে এক কাপড়ে বেরিয়ে কয়েকশো গজ দূরে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলো। পেছনে দরোজা-খোলা বাড়িতে রয়ে গেল যাবতীয় আসবাবপত্র, টিভি-ফ্রিজ-কম্পিউটার, মধ্যবিত্ত পরিবারের অমূল্য সম্পদ।
আলমারী? আলমারীর কথায় মনে পড়ে গেল ওখানে কত কি দামী সব জিনিস রয়ে গেছে। আছে অতিমূল্যবান গয়নার বাক্সগুলো। একদম নীচের তাকে আছে, ভিজে নিশ্চয়ই সুপসুপে হয়ে গেছে। এত বেশী পানি, তালা খুলতে ডুব দিতে হবে। কুচকুচে নর্দমার জলে ডুব দেয়া সম্ভব না। চাইলেও তাই বের করা যাবে না। কিন্তু চোরের কাছে ওসব ঝড় জল কিছুই না। এ কথাটা মনে হতেই বন্যার চেয়ে বড় বিপদের আশংকাটা জাগলো। চোরেরা শাবল দিয়ে আলমারী খোলে। চাবি লাগে না। নিশ্চয়ই চোর আসবে রাতে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই কোথাও। খানিক পরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসবে। এতদিন যেসব চোর চুরি করার সুযোগ না পেয়ে মনে মনে ক্ষুব্ধ ছিল তারা মনের সাধ মিটিয়ে ঘর খালি করে দেবে। যেসব জিনিস অক্ষত আছে এখনো, সেসব চোরের হাতেই নিকেশ হবে।
তখনই আবার মনে পড়ে গেলো তাদের দুজনের কথা। আমার সাহস না থাকলেও তাদের উপস্থিতি চোরকে ঠেকিয়ে দিতে পারে না? ভেবে দেখলাম, নিশ্চয়ই পারে। অন্ততঃ একটা সম্ভাবনা আছে।
Sunday, July 9, 2017
Blockade : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকায় অবরুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানী অস্ত্রবাহী জাহাজ
আমরা জানি ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানী অস্ত্রবাহী জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করেছিল চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকরা, কিন্তু আমাদের জানা ছিল না ১৯৭১ সালে আমেরিকার একটি বন্দরেও পাকিস্তানী জাহাজে অস্ত্র তুলতে অস্বীকার করেছিল সেখানকার শ্রমিকেরা।
আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শরনার্থীদের কেউ কেউ সুয়ারেজ পাইপের ভেতরে জীবনধারণ করেছে। কিন্তু জানা ছিল না ১৯৭১ সালে তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে খোদ হোয়াইট হাউসের সামনের ফুটপাতে কৃত্রিম সুয়ারেজ পাইপ বানিয়ে তার ভেতরে বাস করতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের বেশ কিছু মার্কিন শুভাকাংখী।
পৃথিবীর নানান দেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এরকম অনেক সংহতির চিহ্ন ইতিহাসে আঁকা আছে। সেইসব সংহতির একটি খণ্ডচিত্রকে নিয়ে আরিফ ইউসুফ নির্মিত তথ্যচিত্র Blockade। বহুল কাংখিত সেই তথ্যচিত্রটি স্বয়ং পরিচালকের উপস্থিতিতে গতকাল সন্ধ্যায় দেখার সুযোগ হলো বিস্তারের সৌজন্যে।
তথ্যচিত্রটি নির্মিত হয়েছে মূলতঃ আমেরিকার বাল্টিমোর বন্দরে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানী পতাকাবাহী জাহাজ 'পদ্মা'কে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে অবরোধ করা একদল মার্কিন তরুণদের সাক্ষাতকার নিয়ে। সেই তরুণরা তাদের বাঙালী বন্ধুদের মাধ্যমে জেনেছিল ওই জাহাজে পাকিস্তানের জন্য সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই করা হবে- যে অস্ত্র দিয়ে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হবে। কথাটি প্রচার হবার অনতিবিলম্বে পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির একদল দুঃসাহসী কিন্তু মানবিক চেতনার তরুণ সেই জাহাজটিকে প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নেয়। সভা করে, লিফলেট ছেপে, ব্যানার টাঙ্গিয়ে প্রচার চালাবার পর বন্দরে পাকিস্তানী জাহাজের জন্য অপেক্ষা করে। পাকিস্তানী জাহাজটি যখন বন্দরে নোঙর করে তখন পুলিশী বাধা অতিক্রম করে তারা জাহাজটিকে অবরোধ করে। শুধু অবরোধে থেমে ছিল না, অবরোধ করতে গিয়ে গ্রেফতার বরণ করেছিল, জেল খেটেছিল মার্কিন তরুণেরা। বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের প্রতি সংহতি জানানো এইসব মানুষদের শ্রদ্ধা জানাবার ভাষা আমাদের জানা নেই।
সেই সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্রকে সমন্বয় করে Blockade তথ্যচিত্রটি নির্মান করে আরিফ ইউসুফ মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংরক্ষণ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একদিকে দেশের মানুষকে দেখার সুযোগ দিয়েছেন একাত্তরে মার্কিন দেশে ঘটে যাওয়া সেইসব দুর্লভ কীর্তি এবং অন্যদিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন সেইসব মার্কিন বন্ধুদের যারা দুঃসময়ে আমাদের প্রতি দূর থেকে এমন জোরালো সমর্থন জারি রেখেছিলেন। নিজের খরচে তৈরী করা সেই তথ্যচিত্রটিকে তিনি বিনামূল্যে প্রদর্শন করেছেন ঢাকা চট্টগ্রামসহ আমেরিকার বিভিন্ন শহরেও। আরিফ ইউসুফ ভাইয়ের প্রতি আমাদের সীমাহীন কৃতজ্ঞতা।
Sunday, June 4, 2017
ন কবিতা
তোমাকে দেখি আর নিজেকে দারুন উচ্ছৃংখল লাগে
তোমাকে দেখি আর নিজেকে বড় অপাংক্তেয় লাগে
আমাকে উচ্ছৃংখল রেখে তুমি
দু'পায়ে আলতা মেখে হাঁটছো ওই সংসারে
ভরাডুবি চাঁদটাকে আজ বিষ জ্যোৎস্নায় চুবিয়ে
খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে
(২৪.৪.২০১০)
গাঙ্গেয় ভূগোলের বিবর্তন
প্রথমে এই গুগল মানচিত্রটি দেখা যাক। এই অঞ্চলের ইতিহাস বোঝার জন্য এই মানচিত্রটি বোঝা দরকার। এই অঞ্চলের ৪০০ বছর আগের ইতিহাস পড়তে গিয়ে বর্তমান মানচিত্রের দিকে চোখ রাখতে গেলে বিভ্রান্ত হতে হয়। কেননা এই ৪০০ বছরে নদীর অনেক জল সমুদ্রে গড়াতে গিয়ে আমাদের ভূগোলে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আমরা অনেকেই খেয়াল করি না সেই পরিবর্তনটা কত ব্যাপক বিস্তৃত। গাঙ্গেয় মোহনায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের অধিকারী মেঘনা। এই নদীটার গতিপথ আমূল বদলে গেছে। দুইশো বছর আগেও নদীটা চট্টগ্রাম সন্দ্বীপের মাঝখান দিয়ে বঙ্গোপসাগর স্পর্শ করতো। কিন্তু এখন সেটা পশ্চিমে সরে গিয়ে হাতিয়া বরাবর বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বর্তমান নোয়াখালী জেলার মাঝখান দিয়ে যে মেঘনা বয়ে যেতো, সেটা অবিশ্বাস্যই ঠেকে। অথচ সেটাই সত্যি। ফেনী নদীর সাথে মেঘনার দেখা সাক্ষাতের কথা ভাবাই যায় না এখন। অথচ একসময় ফেনী নদীর মুখেই মেঘনা বঙ্গোপসাগরে মিলিত হতো। এই মানচিত্রে তার কিছুটা ছাপ আছে সে কারণে মানচিত্রটি দেখতে বলা।
স্যাটেলাইট মানচিত্রের উপর হলুদ রেখায় কিছু সীমানা রেখা আঁকা আছে। একসময় মনে হতো হলুদ রেখাগুলো ভুল সীমানা নির্দেশ করছে। হ্যাঁ বর্তমানের জন্য সীমানাগুলো ভুলই। কিন্তু অতীতের জন্য সেই সীমানা চিহ্নই সঠিক ছিল। এই মানচিত্রের হলুদ সীমানাগুলো এই ভূখণ্ডের আদি অবস্থানের চেহারার। মানচিত্রের এই সীমানা রেখা নেয়া হয়েছে পুরোনো কোন এক মানচিত্র থেকে। বলা বাহুল্য, এই হলুদ রেখার মানচিত্রের বয়স ১০০ বছরেরও কম। এর মধ্যেই মেঘনা নদী তার গতিপথকে যেভাবে বদলে ফেলেছে, আগামী একশো বছর এই অঞ্চলের জন্য নতুন মানচিত্র আঁকতে হবে। কেননা সন্দ্বীপের উত্তরদিকে যেসব চর জাগছে তাতে সন্দ্বীপ পঞ্চাশ বছরের মধ্যে নোয়াখালীর সাথে অবিচ্ছিন্ন ভূখন্ড হয়ে মিশে গেলে আশ্চর্যের কিছু না।
এবার দেখি উপনিবেশ আমলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত রেনেলের মানচিত্র। এই মানচিত্রটি আরো দুশো বছর আগের (১৭৮৬ সালের)। সেই মানচিত্রের ভৌগলিক চেহারা আরো অনেক বেশী ভিন্ন।
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের 'বাংলাদেশ' আপত্তি
কিন্তু তিনি বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় নামকরণ বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন সেটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকে যায়। এই বিষয়ে ইতিপূর্বে কোথাও আলোচনা হয়েছে কিনা জানা নেই। কিন্তু দুই বাংলার সাধারণ মানুষের এই অংশ নিয়ে কিছু বলার থাকতে পারে। তাই সেই অংশটুকু এখানে তুলে ধরা হলো আলোচনার স্বার্থে। এই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার কয়েক বছর পরে।
Saturday, May 6, 2017
সময় দাক্ষিণ্য
Tuesday, April 18, 2017
সিপাহী বিদ্রোহ : চট্টগ্রামের ইংরেজ ক্যাপ্টেনের বিদ্রোহ বিবরনী ২৪ নভেম্বর ১৮৫৮
তিনি ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর বৃটিশের বিরুদ্ধে তার অন্যান্য সহযোদ্ধাসহ বিদ্রোহ করেন। তিনি বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরিরত ছিলেন। তার পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। ৩৪নং রেজিমেন্ট। কর্মস্থল ছিল প্যারেডগ্রাউন্ড। যা বর্তমানে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের খেলার মাঠ। ৩৪নং রেজিমেন্ট ছিল বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে সৃষ্ট রেজিমেন্ট। উক্ত রেজিমেন্ট ইংরেজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল।
জেলগেটের সশস্ত্র পাহারাদারদের পরাজিত করে হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলে আটক সকল বন্দীদের মুক্তি দিয়ে ছুটলেন চট্টগ্রাম ট্রেজারির দিকে। ট্রেজারিতে কর্তব্যরত বৃটিশ অফিসারকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা ট্রেজারি দখল করে প্রচুর টাকাকড়ি লুট করে নেয়। তারপর রজব আলীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ইংরেজদের চট্টগ্রামস্থ অস্ত্রাগার লুট করলেন। তিনটি হাতী ও অন্যন্য অস্ত্র সহকারে হাবিলদার রজব আলীর বিদ্রোহী সিপাহীরা ত্রিপুরা রাজার সাহায্য পাবার আশায় তার রাজ্য সীমানায় পৌঁছে গেলেন। এই ঘটনাগুলো দ্রুত গতিতে ঘটেছিল এবং হতাহতের সংখ্যা ইংরেজদের পক্ষে মাত্র একজন। বিদ্রোহীদের কেউ হতাহত হয়নি।
ত্রিপুরার দিকে এগিয়ে গেলেও রাজার সহায়তা না পেয়ে হাবিলদার রজব আলীরা আর ত্রিপুরা না গিয়ে মনিপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মনিপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে অাঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে অবশেষে সিপাহীরা সিলেট এসে পৌঁছলেন। তারা তখন ক্লান্ত। অনেক দুর্গম পথ হেঁটে তারা সিলেটে পৌঁছেন।
ইংরেজরা খবর পেয়ে সেখানে আক্রমণ করতে আসে। খবর পেয়ে হাবিলদার রজব আলী এক পরিকল্পনা করলেন। সৈনিকরা তৈরি করলেন অনেকগুলো খড়ের মূর্তি। পাহাড়ের ঢালুতে তাঁবু গাড়লেন রজব আলী। সন্ধ্যার সাথে সাথে সেই মূর্তিগুলোকে সিপাহীদের পোশাক পরিয়ে তাঁবুর চারপাশে সুন্দরভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। রজব আলী সিপাহীদের নিয়ে পাহাড়ের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে রইলেন। এদিকে মেজর বাইঙ-এর নেতৃত্বে বৃটিশ সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে মুর্তিগুলোর উপর আক্রমণ করে বসল। এ সুযোগে হাবিলদার রজব আলী মেজর বাইঙকে হত্যা করেন। উক্ত যুদ্ধে অনেক বৃটিশ সৈন্য নিহত হয়। এরপর হাবিলদার রজব আলী মনিপুরের দিকে রওয়ানা হন।
সিপাহীরা মনিপুর প্রবেশ করলে সেখানেও আক্রান্ত হয়। এই পর্যায়ে এসে সিপাহীদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা চারদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম ত্যাগ করার পর সিপাহীদের রসদের অভাব দেখা দেয়। স্বাভাবিক কারণে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন সংঘর্ষে ২০৬ জন সিপাহী মারা যায়। অবশেষে রজব আলীর দল রেঙ্গুনের পার্বত্যাঞ্চলে চলে যায় এবং ধারণা করা হয় রেঙ্গুনের পার্বত্য জঙ্গলে খাদ্যাভাবে তাদের মৃত্যু হয়।
"Chittagong, November 24th, 1857.
" I have the honour to report, for the information of Major-general Sir J. Hearsey, K.C.B., commanding the presidency division, that, on the evening of Wednesday, the 18th instant, about nine o'clock, the detachment of the 34th regiment of native infantry mutinied, and instantly occupied the magazine with a strong body of men. Immediately upon hearing the noise from my house, which is quite close to the lines, I went to the parade in company with Lieutenant Hunter; but upon approaching the scene of disturbance, hearing the men very violent and loading their muskets, I directed that officer to retire, and went forward to the mutineers alone. I found a very strong guard in front of the magazine, who challenged me, and shouted out in a most violent tone, ' Don't care for him ! Go away ! you have no business here !'
I advanced up to it, and did my best, with every argument I could use, to persuade the men to their duty; but a Mohammedan, who was in a native dress, and not in uniform like the rest, standing out in front, called out in a loud voice, ' The whole detachment is in a state of mutiny, and we have all determined to die if it is necessary. Go away !' This he said shaking his hand in my face, and using the most violent gestures. A shout was then raised, ' Shoot him ! shoot him !' but a number of voices replied, 'No! no! don't hurt the captain.' Taking encouragement from this, and thinking I might have some men who would stand by me, I again endeavoured, by every persuasion, to bring the men to a sense of their duty, and appealed to several sepoys by name, who had previously borne a good character, to think what they were about, and to remain faithful to their salt; but they all replied that they had joined the mutineers, and that it was not their intention to withdraw.
A shout was again raised, ' Shoot him ! shoot him !' which was again negatived ;and at the same moment two or three sepoys, with their muskets at the charge, came at me. Not liking this demonstration, I stepped back a few paces, and got out of the crowd, which was gradually getting round me; a Sikh of No. 4 company then came up, and giving me a rough push, said, ' Go away from this [Hum suh log bigger gya).'
Not a single native commissioned or non-commissioned officer, or Sikh, remained by me; and seeing nothing could be done, I went to the quarters of Lieutenant Hunter, close by, and found that officer with Lieutenant Thomson, walking in the verandah ; I told them hastily what had occurred, upon which they armed themselves and immediately went away. I then went to every house in the cantonment, to give warning to the residents, but most of them had already taken alarm and fled. Ultimately joining the civil surgeon's family, who live at the extreme end of the cantonment, in their company I sought to make my own escape; but by this time the parade and all the road around were covered with mutineers, so that we were only able to reach the next house, where we were detained for about two hours ; we afterwards disguised ourselves as natives, and, under the guidance of the collector's bearers, proceeded by a jungle path to the banks of the river, when with difficulty we got a boat, and dropped down to the Kortabeea lighthouse, from whence we returned yesterday.
"I have to state that the mutineers plundered the treasury most completely, and in doing so killed a burkandaze. They also broke open the gaol, and forced the prisoners to go with them to carry the treasure ; and afterwards returned to the cantonments, and blew up the magazine and burned down the lines. I am happy to say that none of the European residents have been personally injured, and that, with the exception of a horse or two which were taken away to carry their baggage, the mutineers have left all private property untouched.
" I have been informed by a native named Thakoor Bux, formerly a jemadar of the Chittagong provincial battalion, whom the mutineers forced to go some distance with them, that the pay-havildar of No, 4 company, named Rujub Ali Khan, has assumed command of the detachment, which, we hear, has crossed the Fenny river, and entered the territories of the rajah of Tipperah.
" I took the opportunity while at Kootuhdeen, to write to the commissioner of Arracan, reporting the mutiny, and requesting him to send a copy of my letter for the information of the general commanding, which I hope has been done.
— I have
P.H.K. Dewool,
Captain,
Commanding 34th Regiment Native Infantry.
" P.S. — Lieutenants Hunter and Thomsonare in safety."