Thursday, October 19, 2017

(বে)তমিজউদ্দিন কোং লিমিটেড

১৬৩০ সালের এক মেঘলা দুপুরে তমিজউদ্দিন চারটা বাণিজ্য জাহাজে পণ্য নিয়ে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দরে ঢুকে পছন্দমতন জায়গা বেছে নোঙর ফেললো। জায়গাটা বড় সুন্দর নিরিবিলি। এখানে একটা ফ্যাক্টরি করতে পারলে মালামাল আমদানি রপ্তানি গুদামজাত করা ইত্যাদির বেশ সুবিধা হতো। আবহাওয়া ঠাণ্ডা মেন্দামারা হলেও জায়গা খারাপ না।

ভাবনাটি কাজে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হলো সাথে সাথে। দুত পাঠিয়ে রাজার কাছ থেকে একটা অনুমতিপত্র আনা হলো। শর্ত হলো বছরে ৩ হাজার পাউন্ড ট্যাক্স দেয়া লাগবে। তমিজউদ্দিন তাতে রাজী।

অতঃপর নদীর তীরে গাছ কেটে পরিষ্কার করে কয়েকটা ছাউনি তুলে নিজেদের মালামালগুলো রাখতে শুরু করলো তমিজ। কিন্তু স্থানীয় ইংরেজরা ঝামেলা পাকাতে শুরু করলো কদিন না যেতেই। ঘোড়ায় করে এসে হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে উঠে যাবার জন্য। ঝামেলা এড়াতে চারদিকে বড় দেয়াল তুলে ভেতরে কিছু সশস্ত্র সৈন্যকে পাহারায় রাখতে হলো।

একটা দুর্গ তৈরি করতে পারলে আরো ভালো হতো। কদিন পর ইট পাথর দিয়ে মোটামুটি একটা দুর্গও তৈরি করা হলো। এবার সৈন্য দরকার আরো। দরকার কিছু কামানও।

বাংলাদেশে খবর পাঠালে তমিজউদ্দিন লিমিটেডের হেড অফিস আরো তিন জাহাজ ভর্তি করে সিপাহী পাঠিয়ে দিল। সাথে দেড়শো কামান। সেই জাহাজ বন্দরে ঢোকার সময় স্থানীয় ইংরেজ প্রশাসক এণ্ডারসন বাধা দিল। তার  বক্তব্য হলো এখানে শুধু বাণিজ্য করা যাবে, দুর্গ নির্মাণ করা যাবে না, এত সৈন্য রাখা যাবে না।

এই কথা শুনে তমিজউদ্দিন ক্ষেপে গেল। মশকারি পাইছস? বচ্ছরে তিন হাজার টাকা টেকসো দিয়া লাইসেন্স নিছি বেবসা করার, লিজ নিছি এই এলাকা। আমি এখানে ব্যবসা করমু, সৈন্য রাখমু, আমার বেবসার নিরাপত্তা আমি দেখমু, তুই এখানে মাতব্বরী করস কোন বাপের সাহসে? বেশী তড়পাইলে গুলি মেরে খুলি উড়িয়ে দেবো। পিস্তল বাগিয়ে বেরিয়ে এলো তমিজউদ্দিন। হুকুম দিল, কামান দেগে গুল্লি মেরে উড়ায়ে দে সব!

দেশ থেকে আসা জাহাজ থেকে কামান দাগানো হলো। দুই পক্ষে তীব্র গোলাগুলি শুরু হলো। তমিজউদ্দিনের বাহিনী সুশিক্ষিত এবং ভয়াবহ রকমের দুর্ধর্ষ। ভদ্রগোছের ইংরেজরা তাদের সাথে টিকতে না পেরে পালিয়ে গেল। ইতিমধ্যে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেলে তমিজউদ্দিন সাউদাম্পটন বন্দর ও পাশের শহরটি দখল করে নিল।

অতঃপর তমিজের সেনাপতি রাজা জেমসের কাছে দুত পাঠিয়ে বললো সাউদাম্পটন শহরটি তমিজউদ্দিনের নামে লিখে দিতে হবে এবং তমিজউদ্দিন লিমিটেডকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য অধিকার দিতে হবে। যদি রাজা তাতে রাজী না হয় তাহলে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বাকিংহাম প্রাসাদও দখল করে নেয়া হতে পারে।

তমিজউদ্দিনের চিঠি পেয়ে এবং যুদ্ধের ফলাফল দেখে ভয় পেয়ে রাজা জেমস ঝামেলা এড়াতে সাউদাম্পটন শহরটি তাকে লিখে দিয়ে সেখানে শুল্কমুক্ত ব্যবসার লাইসেন্স দিলে ধুমিয়ে বাণিজ্য শুরু করলো তমিজউদ্দিন লিমিটেড।

শুধু ব্যবসা না, আরো কিছু কাজে হাত দিল তমিজ। সাউদাম্পটন শহরের নাম বদলে তমিজপুর রাখা হলো। সাউদাম্পটন শহরের আগের নিয়মকানুন বদলে বাংলাদেশের আইন জারি করা হলো। স্থানীয় ইংরেজরা তাতে বাধা দিতে চাইলে বেদম মার খেল। তমিজপুরের ইংরেজদের উপর মোটা করধার্য করা হলো, তাদের ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে শুধু বাঙালীদের জন্য ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো। এভাবে ইংল্যান্ড থেকে নিয়মিত আমদানি রপ্তানি করে বাংলাদেশ ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকলো।

তমিজউদ্দিন ওই শহর দখল করার কয়েক মাস পর খবর পেল রাজা জেমস ইংরেজ ব্যবসায়ীদেরও শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের লাইসেন্স দিচ্ছে। শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তমিজউদ্দিনের। এইটা কী মগের মুল্লুক? আমরা এতদূর থেকে আসছি ব্যবসা করে তোদের দেশকে উন্নত করতে, আর তোরা ঘরে বসেই শুল্কমুক্ত সুবিধা নিবি? কিছুতেই হতে দেবো না। শুল্কমুক্ত সুবিধা খালি আমাদের, বাঙালীদের থাকবে। তমিজউদ্দিন লিমিটেড বাদে দুনিয়ার কেউ এই সুবিধা হাতাতে পারবে না। তুড়ি বাজিয়ে ঘোষণা দিল তমিজউদ্দিন।

ঘাঁটিতে আরো সৈন্য সমাবেশ করে এবার খোদ রাজা জেমসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো তমিজ। আসলে শুধু একটা শহর দখল করে পোষাতে পারছিল না তমিজউদ্দিন লিমিটেড। দিনে দিনে খাই বেড়ে গিয়েছিল তার। তমিজউদ্দিনের বেতমিজ সাহস দেখে ক্ষেপে গেল রাজা জেমস। হুংকার দিয়ে সমগ্র বাঙালী সমাজকে ইংল্যান্ডের মাটি থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে পাল্টা আক্রমণ চালালো।

কিন্তু তমিজের কৌশলী বাহিনীর সাথে পেরে উঠলো না রাজা জেমসের বাহিনী। ইতিমধ্যে ঘুষ দিয়ে বারো জন জেনারেলকে বাঙালীদের পক্ষে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে তমিজউদ্দিন। অধিক সৈন্য থেকেও ইংরেজরা পারলো না বাঙালীদের সাথে। হেরে গিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বাকী সৈন্যরাও তমিজের বশ্যতা স্বীকার করে দলে দলে যোগ দিতে লাগলো তমিজ বাহিনীতে।

অবস্থা বেগতিক দেখে রাজা জেমস পালিয়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নিলেন। এরপর সমগ্র ইংল্যান্ডে জারি হলো বাংলার শাসন। বাংলার প্রথম উপনিবেশ হিসেবে ইংল্যান্ডের নাম সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হলো। তমিজউদ্দিন লিমিটেড পরবর্তী ২০৭ বছর ইংল্যান্ড শাসন করলো।

১৮৩৭ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া জন্মগ্রহন করার পর বাংলাদেশে একবার ভয়াবহ বন্যার পর বেশ বড় আর্থিক ক্ষতি সম্মুখীন হলে তমিজউদ্দিন লিমিটেড ইংল্যান্ডকে মুক্ত করে স্বাধীনতা দিয়ে দেশে ফিরে এল ব্যবসা গুটিয়ে।

বাংলাদেশে এখন চর তমিজউদ্দিন বাদে আর কোন স্থাবর সম্পদ নেই তমিজউদ্দিনের। অনাকাংখিত এই পতনে তমিজউদ্দিনের ২০০ বছর বয়সী শরীর ঘেমে উঠলো।
***   ***  ****
***   ***  ****
জেগে উঠে তমিজউদ্দিন জাহাজের খোলে নিজেকে আবিষ্কার করলো। দড়ি টানতে টানতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পায়নি। ইতিহাসে এম এ পাশ করে জাহাজের কুলীর চাকরী নিয়ে সাউদাম্পটন বন্দরে এসে পৌঁছেছে গতকাল। জাহাজ থেকে চুপি চুপি একবার নেমে পড়তে পারলেই ফক্কা। কিন্তু এ কী জাতের স্বপ্ন দেখলো সে! এমনও কী সম্ভব, এমনকি স্বপ্নেও? ইংল্যান্ড তিনশো বছর আগে তাদের দেশে যা করেছে সেটাই তার অবচেতন মন করতে চাইছে এখানে এসে?

নাহ, মাথাটা সার্ফ এক্সেল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে কুচিন্তা সব ঝেড়ে ফেলতে হবে।


No comments: