Wednesday, October 18, 2017

আমাদের ভয়াবহ নাগরিক জীবন

১. আমার শহর, আমার দুঃখ

এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে আমি যে শহরে বাস করি সেই সৌন্দর্যের সুনাম সমৃদ্ধ সবুজ শহরটা ক্রমাগত বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। আমার শহর নিয়ে বছর দশেক আগেও মোটামুটি যেটুকু আত্মতৃপ্তির রেশ ছিল এখন তার কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। আমি চট্টগ্রাম শহরের কথা বলছি। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, সবকিছুর প্রথম স্মৃতি এই শহর জুড়েই। এই শহরের উনিশ শতকের স্মৃতিলেখনগুলো আমাকে নস্টালজিক করে তোলে। আমি আক্ষেপ করি কেন সেই সময়ে আমার জন্ম হলো না। চট্টগ্রাম শহরের সেই অনিন্দ্য সৌন্দর্যের কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই এখন। বিশ শতকের শেষভাগে আমরা যেটুকু পেয়েছি, আমার সন্তানেরা তাও পাবে না।

এই সৌন্দর্য নষ্টের কারিগর এই শহরের মানুষ। মানুষের নাগরিক অসভ্যতা শহরকে ধ্বংস করে। এই অসভ্যতাকে উৎসাহিত করেছে কয়েকটি দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী প্রতিষ্ঠান। শহর ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মানের সাথে জড়িত সংস্থাগুলো এর জন্য দায়ী। সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, ট্রাফিক পুলিশ ইত্যাদি  কতৃপক্ষের অস্তিত্ব আমরা টের পাই না।

কয়েক দশকের স্মৃতির আলোয় নির্দ্বিধায় বলা যায় ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাঘাট পরিবেশ অতীতের চেয়ে সবচেয়ে জঘণ্য চেহারায় আছে। তবে টাইগারপাস থেকে লালখানবাজার ঘুরে কাজির দেউড়ি হয়ে আন্দরকিল্লা মোড় পর্যন্ত সড়ক এই হিসেব থেকে বাদ যাবে। এই সড়কটি চট্টগ্রামের একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে সড়কদ্বীপ সবুজে সজ্জিত। আধুনিক ল্যাম্পপোস্টে উজ্জ্বল সন্ধ্যা, পালিশে পালিশে অনেকাংশের ফুটপাতও শয্যাবাসের উপযুক্ত হয়ে গেছে। কেননা এই পথে আছে ভিভিআইপি চলাচল। এই পথে আছে ধনীক্রীড়াগৃহ চট্টগ্রাম ক্লাব, পাঁচতারা র‍্যাডিসন ব্লু এবং রাষ্ট্র/সরকার প্রধানের চট্টগ্রাম নিবাস সার্কিট হাউস। এই পথ শেষ হয়েছে নগরপিতার কর্মস্থল কর্পোরেশন অফিসের গোড়ায়। এখানে ঝাড়ুদার ময়লাবিহীন রাস্তার ধুলো কুড়িয়ে বেড়ায় প্রতিদিন। এদিকের সড়ক চিতল মাছের পেটির মতো মসৃণ। বাকী শহরের কান্না এখানে পৌঁছে না। শহর যে কাঁদে তাও তারা জানে না।

২. সড়ক অসভ্যতা

চট্টগ্রাম শহরের নাগরিক অসভ্যতার প্রধান ক্ষেত্র হলো সড়ক ও যানবাহন। চট্টগ্রাম শহরের সড়কগুলো বর্তমানে ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় আছে। এই ভয়াবহতা লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব। তবু লিখে রাখছি ভবিষ্যতের জন্য। আমাদের বর্তমান জীবনটা কতো দুর্বিসহ কাটছে সেটা যেন ভবিষ্যতের মানুষেরাও জানতে পারে। এমনিতে আমাদের অনিবার্য দুঃখ দুর্দশার কমতি নেই ব্যক্তিগত জীবনে। তার দায়দায়িত্ব আমরা অন্যকে দিতে পারি না। সেসব বাদ দিয়ে সম্মিলিতভাবে সামাজিক যে দুর্ভোগগুলো আমরা প্রতিদিন বহন করি এগুলোর জন্য আমাদের দায়ী করতে হয় কতৃপক্ষ নামক কোন প্রতিষ্ঠানকে। কেননা ওই প্রতিষ্ঠানগুলো আমদের দুর্ভোগ লাঘবের দায়িত্বে নিয়োজিত আছে এবং তাদেরকে সেজন্য সরকারের কাছ থেকে টাকাপয়সা দেয়া হয়।

মাইলের পর মাইল রাস্তা জুড়ে গর্ত কেন থাকবে সারা বছর ধরে? আপনারা কি বিনামূল্যে রাস্তা তৈরী করেন? নাকি রাস্তা বানাবার প্রযুক্তি আপনাদের আয়ত্বে আসে নাই? ভারী যানবাহন বা বৃষ্টিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশের চেয়ে ভারী যানবাহন বা বৃষ্টিবহুল দেশেও রাস্তাঘাটে গর্ত দেখা যায় না। বাংলাদেশের রাস্তার এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী সড়ক নির্মানের দুর্বলতা। যে দুর্বলতার জন্য দায়ী প্রযুক্তি নাকি দুর্নীতি আমি জানি না। আমি শুধু জানি যে আমরা এখনো ৫ বছর গাড়ি চলতে পারে তেমন রাস্তা বানাতে পারি না।

৩) শাহ আমানত সেতুর কুৎসিত মোড়
সড়কে নরক গুলজার দেখতে হলে এখানে আসতে হবে। এই সেতুর সাথে শুধু নগরবাসী যুক্ত নয়। বাংলাদেশের হাজার কোটি টাকার পর্যটন ব্যবসাও জড়িত। এই সেতু পেরিয়েই যেতে হয় কক্সবাজার বান্দরবান, সেন্টমার্টিনসহ সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামে। সরকার কর্ণফুলী নদীর উপর নান্দনিক সেতু বানিয়েছেন কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে। সেই সেতু থেকে নামার পর পৃথিবীর জঘন্যতম যানজটে পড়ার কারণ কী? দশ বছর আগেও তো পুরোনো তক্তা সেতু পেরিয়ে এক টানে বহদ্দার হাটের দিকে রওনা দিতে পারতাম।  কর্নফুলী ব্রীজের গোড়ায় অবৈধ বাসস্ট্যাণ্ড গড়ে উঠলো কার নির্দেশে? ওখানে কী সরকার বলে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়? মানুষ চুপচাপ দুর্ভোগ সয়ে গেলেই অন্যায় জায়েজ হয়ে যায়?

আমরা অনেকে কর্ণফুলীর দক্ষিণে যাওয়া বাদ দিয়েছি শুধুমাত্র কর্ণফুলী সেতু এলাকার ভয়ানক বিশ্রী যানজটের কারণে। আমি বাংলাদেশের অনেক এলাকার যানজট দেখেছি। কিন্তু কর্নফুলী সেতু এলাকার মতো অসভ্য যানজট একটিও দেখিনি। এটাও ভাষায় বর্ননা করা অসম্ভব। আপনি নিজে সেই এলাকা অতিক্রম না করলে বুঝবেন না মানুষ কতোটা অসভ্য, অর্বাচীন, আত্মহত্যাপ্রবণ হতে পারে। এরকম টুকরো টুকরো সড়ক অসভ্যতার অসংখ্য গল্প আছে সমস্ত শহর জুড়ে।

কিন্তু বিশ শতকের শেষভাগেও এতটা অসভ্য ছিল না এই নগর। পৃথিবীর প্রতিটা দেশ নানা ক্ষেত্রে এগিয়েছে। বাংলাদেশও এগিয়েছে বিভিন্ন সূচকে। কিন্তু নাগরিক সভ্যতার সূচকে আমাদের এই অধঃপতন কেন? এই অধঃপতন নিয়ে কারো মাথা ব্যথা আছে? ব্যক্তিগতভাবে আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি। কিন্তু সম্মিলিত ক্ষোভ প্রতিক্রিয়া দেখিনি। সরকারের তো কোন অস্তিত্বই টের পাই না এখানে। ছোট একটা জায়গায় দানবীয় আকারের বাসগুলোর বেপরোয়া মোচড়ামুচড়ি পিষে ফেলছে মানুষের সকল নাগরিক অধিকার৷ সভ্যতা এখানে অনুপস্থিত৷ 

৪) কর্ণফুলী মরে যাচ্ছে

কর্ণফুলী নদী মরে যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনেই। অর্ধেক নদী চর পড়ে গেছে। চর পড়তে পড়তে মাঝনদীদে চলে গেছে চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই অংশ। যে অংশে নতুন কর্নফুলী সেতু নির্মিত হয়েছে সেই অংশে নদীর সীমানা ছিল সেতুর গোড়ার কাছে। এখন গত দশ বছরে নদী ভরাট হতে হতে অর্ধেক হয়ে গেছে। ভরাট অংশ নিয়ে খুশী আছে মানুষ এবং সরকার উভয়ই। তারা রীতিমত রাস্তাঘাট দালান কোটা তৈরী করে ভরাট অংশ কাজে লাগিয়ে ফেলেছে। কর্ণফুলী সেতু থেকে নদীর পাড় দিয়ে যে রাস্তাটি ফিরিঙ্গিবাজারে গিয়ে উঠেছে সেই রাস্তাটি মূলত মাঝদরিয়া দিয়ে চলছে।

নদী ভরাটের লাভের গুড় পেয়ে যারা আনন্দিত জোয়ার জলে শহর নিমগ্ন হবার খবরে তাদের কী প্রতিক্রিয়া জানতে ইচ্ছে করে। কর্ণফুলী নদী ছোট হচ্ছে কয়েকশো বছর ধরে। কিন্তু গত দশ বছরে সর্বাধিক ভরাট হয়েছে। অপরিকল্পিত সেতু নির্মান তার প্রধান কারণ।

পুরো বর্ষাকাল জুড়ে সংবাদ শিরোনাম থাকে শহর ডুবে গেছে। শহর ডুবে যায় জোয়ারের প্লাবনে, কর্নফুলীর উজানের পানিতে। যে পানি নদী দিয়ে বয়ে যাবার কথা সে পানি নদী বহন করতে পারে না। বাড়তি পানি নদী বিলিয়ে দেয় শহরে। নদীকে ভরাতে ভরাতে ছোট করেছি আমরা কিন্তু নদীর পানি তো কমেনি। নদী মরে যাবার আগে আমাদের ভাসিয়ে নিচ্ছে। এই শহরের জন্ম হয়েছে নদীগর্ভ থেকে। আবারো নদীগর্ভেই ফিরে যাবে এই শহর।




No comments: