Saturday, October 21, 2017

প্রথম ডায়েরী ১৯৮৫

কিছু কিছু পুরোনো জিনিস আমার কাছে এতই যত্নের সাথে আছে যে শতেক দুর্যোগ, দুঃসময়, দুর্ভোগ সবকিছু পেরিয়েও কিভাবে যেন ঠিকঠাক রয়ে গেছে। বাবার দেয়া এই ডায়েরীটাও তেমন। আমার জীবনের প্রথম ডায়েরী। বাবার সর্বশেষ কর্মস্থলের স্মারক।


বহুদিন পর দেরাজ খুলে বের করে হাতে নিয়ে ৩২ বছরের ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করলাম। ডায়েরিটার ছবি তুলে স্মতির একটা নজির রেখে দিতে ইচ্ছে করলো। আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ার প্রথম তারুণ্যের একটা স্মৃতি। এখানে আমার পরবর্তী এক দশকের চিন্তাভাবনাগুলোর বিবর্তন আঁকা আছে টুকরো টুকরো কথায়। কিছু কিছু কথা পড়ে এখন হাসি পেয়ে গেল। বয়সের তুলনায় অনেক অগ্রসর কিছু ভাবগম্ভীর দার্শনিক ভাবনা। এই বয়স হলে মেনে নেয়া যেতো, কিন্তু তিন দশক আগে আমি তেমনটি ভাবতাম? বিশ্বাস হতে চায় না।

এই ডায়েরীপ্রাপ্তির এক দশকের মধ্যে আমার শিক্ষাজীবনের অবসান ঘটে  এবং যেদিন কর্মজীবনে প্রবেশ করি সেদিন থেকে এই ডায়েরীর লেখারও অবসান ঘটে। দশ বছর ধরে একটা ডায়েরীতে সীমাবদ্ধ থাকার অন্যতম কারণ হলো বিশেষ কোন ঘটনা না ঘটলে এখানে লেখা হতো না। এই ডায়েরীর পাতাগুলো এত মসৃণ, এত সুন্দর যে কখনো এলোমেলো কিছু লেখা হতো না। দৈনিক কোন ঘটনার চেয়ে ইস্যুভিত্তিক লেখাই বেশী স্থান পেয়েছে। আমার লেখালেখির যাত্রা শুরু এই ডায়েরী থেকেই। যদিও তখনো আমার ধারণা ছিল না কখনো লেখালেখির জগতে আসবো কিনা।

এই ডায়েরীর পর আরো অর্ধডজন ডায়েরী লেখা হয়েছে পরবর্তী ২০ বছরের কর্মজীবনে, কিন্তু এটাকেই সবচেয়ে মূল্যবান বলে মানি এখনো। এই পাতাগুলোর পরতে পরতে আমার ৩২ বছর পুরোনো জীবনটা লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে উল্টেপাল্টে দেখতে হয় সেই সময়টাকে। মাঝে মাঝে জীবন এমন কিছু কঠিন সময় পাড়ি দিয়েছে তার কোন চিহ্ন এখন আর কোথাও নেই এই ডায়েরীর পাতা ছাড়া। শুধু স্মৃতিকাতরতা নয়, নিজের আদি সত্ত্বাকে আবিষ্কার করার জন্যও পুরোনো ডায়েরীর বিকল্প নেই। যে চিন্তাভাবনাগুলো মগজে খেলতো, যে পৃথিবীকে ওই চোখে দেখেছিলাম, যে সমাজ আমাকে ঘিরে রেখেছিল তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে এই সময়ে এসে? যে আদিম হতাশাগুলো আমাদের জীবনের উপর আরোপিত ছিল তার কতখানি অবসান ঘটেছে এই একুশ শতকে এসে? উত্তরগুলো মনে মনেই খুঁজি।

আরো একটি কারণে ডায়েরীটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার তারুণ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটা এই ডায়েরীর অন্তর্গত। না, এমন না যে আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সম্পর্কে খুব একটা লিখেছি। কিন্তু সেই সময়টা, আশির দশকের সেই ক্রান্তিলগ্নটা আমার বেড়ে ওঠার গতিপথ নির্ধারণ করে দিচ্ছিল। আমি কোন পথে যাচ্ছিলাম, ভাবছিলাম, পড়ছিলাম, দেখছিলাম সবকিছুর টুকরো টুকরো উদাহরণ ছড়ানো আছে বিক্ষিপ্তভাবে। কোন কোন লেখার তারিখও দেয়া হয়নি। ওই সময়টা বর্তমানের 'আমি'কে গড়ে তুলছিল। সেই আমি আর এই আমির মধ্যে যে পার্থক্য সেটা শুধু বয়স এবং সামাজিক অবস্থান। বাকীটা অনেকাংশে পুরোনোতে রয়ে গেছে। পেছনের দিন তাই আমাকে এত বেশী টানে।


No comments: