Saturday, October 14, 2017

বই পড়া না পড়া

বই পড়ে যখন থেকে আনন্দ পেতে শুরু করি তখন ভাবতাম সবাই এই আনন্দ গ্রহন করছে না কেন? সুলভে এত এত আনন্দের সমাহার থেকেও তা সবাই নিচ্ছে না কেন?

আসলে ইচ্ছে করলেই পড়তে শুরু করা যায় না। একটা শব্দ, বাক্য, প্যারা পড়তে পারলেই তা থেকে আনন্দ বের হয়ে আসে না। সেই আনন্দ গ্রহন করার মতো একটা তৈরী মন থাকতে হয়। গ্রহন করার ক্ষমতাসম্পন্ন অনুভূতি যার নেই সে কখনো বই পড়ে আনন্দ পেতে পারে না।

আমাদের চোখ যখন বইয়ের পাতার অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় শব্দে শব্দে পা ফেলে, তখন মস্তিষ্কের একটা অনুভূতি দৃষ্টির মাধ্যমে শব্দগুলো থেকে রস আহরণ করে, সেই রস যদি উপাদেয় হয় তখন আমাদের মস্তিষ্ক আনন্দ অনুভূতিকে বুকের ভেতর ছড়িয়ে দিতে থাকে ধীর লয়ে, পরপর কয়েক পৃষ্ঠা যখন এই ঘটনাটি ঘটতে থাকে তখনই আমরা বইটিতে বুঁদ হয়ে পড়ি। এটা একটা মোহ, একটা প্রেম, শব্দের সাথে একটা সম্পর্ক। এই সম্পর্কটা যতক্ষণ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পাঠের আনন্দ। আমাদের সব প্রিয় বইয়ের সাথে এই সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

যাদের চোখের সাথে মস্তিস্কের ওই অংশের যোগাযোগ ঘটে না, তারা বইয়ের মধ্যে কোন আনন্দ খুঁজে পাবে না। এ কারণে সবার দ্বারা বই পড়া সম্ভব হয় না। যারা নিয়মিত পড়ে টড়ে তাদের সাথে মাঝে মাঝে বইয়ের বিচ্ছেদ ঘটে। সেই বিচ্ছেদকালীন সময়ে বইয়ের অক্ষরগুলো চোখে পড়লে তা থেকে কোন অনুভূতি আমাদের বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে না। সেই সময়টাতে আমরা বই বর্জন করে চলি। বইয়ের সাথে যে ঘটনাটি ঘটে একই ঘটনা লেখার সাথেও ঘটতে পারে। যারা লেখক তাঁরা যখন এই সমস্যায় ভোগেন তখন বলেন রাইটারস ব্লক। রাইটারস ব্লকের মতো রিডার্স ব্লকও হতে পারে।

ছেলেবেলায় ছুটিতে যখন গ্রামে গিয়ে যখন পড়ার চেয়ে ডানপিটেমিতে বেশি ব্যস্ত থাকতাম, তখন দেখতাম আমাদের সমবয়সী এক তুতো ভাই বনে জঙ্গলে না ছুটে ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ কোন না কোন বইতে ডুবে আছে। অবাক হতাম প্রকৃতির এত বন্য সৌন্দর্য বাদ দিয়ে সাদা কালো কতগুলো অক্ষরে কী এমন আনন্দ আছে? পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ুয়া একটি বালকের জন্য সেটি খুব অস্বাভাবিক লাগতো।

এখন জানি তার মধ্যে অল্প বয়সেই পড়ার আনন্দযোগ শুরু হয়েছিল। সে কারণেই বইয়ের প্রেমে মগ্ন হতে পেরেছিল ওই কাঁচা বয়সেই।

এই আনন্দযোগ শুরু হতে আমাদের আরো কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল। তবে চারপাশে তাকিয়ে দেখি অধিকাংশ মানুষের মধ্যে  এই আনন্দযোগ নেই। একেবারেই নেই। বন্ধুদের মধ্যে এক আধটু আউট বই পড়াশোনা করতো, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পর তা একদমই চলে গেছে। সবাই সংসার, ক্যারিয়ার, টাকাপয়সা ইত্যাদি নিয়ে এত বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে বইয়ের দিকে তাকাবার সময় কারো নেই।

ছাত্রজীবনে যখন থেকে আমার বুকশেলফ একটু একটু ভারী হতে শুরু করে তখন একটা আশংকা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো যদি কখনো পড়াশোনার এই আনন্দ নষ্ট হয়ে যায় তাহলে বইগুলোর তো পোকার খাদ্য হওয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই। সংসারের বিবিধ ঝামেলায় পড়ুয়া মনটা অক্ষত রাখা খুবই কঠিন কাজ। আসলেই কঠিন কাজ। আমি নিজেই ভুক্তভোগী ছিলাম কয়েকটি বছর।

একটা সময় সেই বাস্তবতা আমার কাছেও উপস্থিত হয়েছিল। জীবনের কঠোর কঠিন চাপে থমকে গিয়েছিল সকল পড়াশোনার আনন্দ। মাসের পর মাস কোন বই হাতে নেইনি। বছরের পর বছর বই কিনিনি এমনও গেছে। চাকরীর প্রথম কঠিনতম বছরগুলোতে দম ফেলার ফুরসত ছিল না। প্রায় প্রতিটি দিন ঘুম ভাঙতো দুর্বিসহ দুশ্চিন্তার নাভিশ্বাস নিয়ে। ভোর ছটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত জীবিকার যাঁতাকলে পিষে যাচ্ছিল রক্ত মাংস স্নায়ু সব। চরম প্রতিকূল একটা সময়। জীবনকে নিয়ে একবিন্দু ভবিষ্যত পরিকল্পনা ঠাঁই পেতো না। সেই কঠিন সময়ের মেয়াদ কতদিন তার কোন ধারণা ছিল না। অন্য কিছু ভাবার কোন অবকাশ ছিল না। বইপত্রের জগত থেকে একেবারে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলাম সেই কবছর।

তখন ভাবতাম আর কখনো ফেরা হবে না ওই আনন্দ জগতে। আর সবার মতো আমিও সংসার সমুদ্রে মিশে হারিয়ে গেলাম বুঝি। সারা বছরে মোটামুটি উপভোগ্য কর্মছুটি ছিল দুই ঈদ। এক নাগাড়ে চার-পাঁচদিন ছুটি। একবার অফিসে ঈদের ছুটির সময় শেষ কর্মদিবস শেষে অফিসের বাসে নিজের গন্তব্য আগ্রাবাদ না নেমে চলে গেলাম নিউ মার্কেট। পকেটে ঈদ বোনাসের টাকা। একটু সুখ সুখ অনুভূতি। এই ঈদে দুয়েকটা বই কেনা যাক। নিউ মার্কেটের সামনে কারেন্ট বুক সেন্টারে ঢুকলাম অনেকদিন পর। ছাত্র জীবনের প্রিয় বই কেনার এই জায়গা। ঘুরে ঘুরে বইগুলো ছুঁয়ে দেখতেও আনন্দ। অনেকদিন পর বই কিনলাম, ঈদসংখ্যা কিনলাম, কিনলাম একটি 'উন্মাদ'ও।

বাড়ি ফেরার পথে সুখ সুখ অনুভূতির সাথে ভাবছিলাম- একদিন পর ঈদ কিন্তু এবার ঈদের চেয়েও বই কেনার আনন্দটা যেন একটু বেশী। সবচেয়ে স্বস্তি লেগেছে সেই দুশ্চিন্তা কেটে যাওয়াতে। আমি এখনো বই পড়তে পারি। পড়াশোনার আনন্দযোগ এখনো নষ্ট হয়ে যায়নি পুরোপুরি। চাইলে ফিরিয়ে আনতে পারি নতুন করে। সে বছর থেকে নিয়ম করে প্রতি ঈদের ছুটি শুরু হলে কারেন্ট বুক সেন্টারে ঢুঁ মারি। বছরে অন্তত একবার দেখা সাক্ষাত হলেও ক্ষতি কী। সীমাহীন কর্মব্যস্ত সময়ের অবসরে মাঝে মধ্যে বইয়ের সাথে পুনর্মিলন শুরু হলো। সালটা কী ২০০০? নাকি ২০০১? মনে নেই। তবে সেই কর্মস্থল থেকে ছুটি পেলেই আবারো ছুটে যেতে শুরু করি বই পুস্তকের দোকানে। নতুন করে আবারো যুক্ত হলাম বই জগতের সাথে।

আরো অনেক বছর পর .....যখন থেকে জীবিকা বদল হলো, স্বাধীন জীবনের সুত্রপাত ঘটলো, পড়াশোনার দীর্ঘ অবসর ফিরে এলো। এই পর্বের নতুন একটি আনন্দ পাঠানুভূতি বিনিময়। অন্তর্জালের মাধ্যমে সেই আনন্দের সঙ্গী পাওয়া আরো একটি ভাগ্যযোগ। বেঁচে থাকার অনেক সৌন্দর্য তাতে পাখা মেলে অনায়াসে। জীবনের নানাবিধ কুৎসিত উপকরণকে এড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখার একটা আশ্রয়ও। বইবন্ধুর মতো প্রিয় সঙ্গী আর কে হতে পারে?


No comments: