আমার ঘরের বাইরে অপরাজিতার ঝোপ, পাতার ফাঁকে নীল চোখ মেলে বর্ষায় অপরাজিতা ফুল তাকিয়ে থাকে। শরৎকালে উঠোনে ফোটে স্থলপদ্ম, পায়ের ছোঁয়ায় লজ্জাবতী কুঁকড়ে যায়, ঘাসের সবুজে লাল কেন্নো জ্বলজ্বল করে। শীতের দিনে শুকনো পাতার গন্ধ ভাসে হাওয়ায়। চৈত্র মাসে বাতাস ছুটে আসে দুদ্দাড়- আমার টেবিলের কাগজপত্র উড়িয়ে নেয়, নিবিয়ে দেয় আমার সন্ধেবেলার কেরোসিন ল্যাম্প। খোলা মাঠের মধ্যে একলা সেই টিনের ঘরটা জ্যৈষ্ঠের দুপুরে উনুন হয়ে ওঠে, আর মাঘের রাত্রে বরফের বাক্স। ঘরে বসে শুনি শুকনো পাতা ঝরে পড়ে ঝর্ঝর, কোনো স্তব্ধ রাতে আঁতুড়ের শিশুর গলায় কান্না – বটগাছে কোন পক্ষীশাবক ডেকে উঠলো। কখনো শুনি সারা দুপুর ছাদ পেটানো গান- সারেঙ্গি বাজে একটানা, তালে-তালে মুগুর পড়ে ধ্রাম-ধ্রাম, সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গেয়ে চলে কুড়ি-পঁচিশটি মুগুর পেটানো বাচ্চা ছেলে – উব-হাঁটু হয়ে বসে, সারা গায়ে-মাথায় রোদ্দুর নিয়ে, অক্লান্ত। বর্ষা নামে বিশাল- আকাশ ছেয়ে, প্রান্তর ছেয়ে, পৃথিবী জুড়ে, ধোঁয়াটে নীল কালো মেঘের ভিড়ে নিবিড়- আমাদের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে যেন হাজার সেতারের রিমঝিম বাজনা। বাইরে কাঁচা রাস্তায় কাদা, মাঠে মাঠে ঘাস আরো লম্বা, সব ফোকর ডোবা হয়ে উঠলো, ব্যাঙেদের ফুর্তি অঢেল। কখনো কোনো বৃষ্টি থেমে যাওয়া মধ্যরাতে মেঘ চুঁইয়ে ঝরে পড়ে জ্যোছনা। মাঠের উপর রাত্রি হয়ে ওঠে নীলাভ, আর সবুজ, আর রহস্যময়। কখনো সারারাত বৃষ্টির পরে সূর্য উঠে আসে উজ্জ্বল, নতুন উৎসাহে দখল করে নেয় জগৎটাকে। আবার কখনো কোনো মেঘলা সকালে হাওয়ায়-হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় গান- কনক দাশের কন্ঠে – 'আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে – পিছু ডাকে-' আমার মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সম্মোহন - কোনো সুখ, যা মুখে বলা যায় না, কোন দুঃখ, যা সুখের চেয়েও ভালো।
ছবি কৃতজ্ঞতা : শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদের ফেসবুক পোস্ট
এই বর্ণনার সাথে আমার স্মৃতির সম্পর্কটা এতই গভীর যে পড়ার মাঝখানেই কিছু সময় থেমে গিয়ে ফিরে যাই আশির দশকে। বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনীতে বিশ দশকের নয়াপল্টনের স্মৃতির বর্ণনার সাথে আমার নিজের পুরোনো বাড়িটার অদ্ভুত কিছু মিল। বর্ণনার মধ্যে শুধু কয়েকটি শব্দ একটু বদলে দেয়া হয়েছে।
No comments:
Post a Comment