Wednesday, November 29, 2023

গাজা: ক্রমশ

যুদ্ধ ও বন্দী বিনিময়/ ২৯.১১.২০২৩

গাজায় যুদ্ধ বিরতি চলছে। কাতার, মিশর, আমেরিকার মধ্যস্ততায় চলছে জিম্মিও বন্দী বিনিময়। ১জন ইসরায়েলী ৩জন প্যালেস্টাইনী এভাবে বিনিময় চলছে। গত পাঁচদিন ধরে চলছে। বন্দী বিনিময় শেষ হলে যুদ্ধবিরতিও শেষ। ইসরায়েল আবারো আক্রমণ শুরু করবে। যেটকু ধ্বংসের বাকী আছে, সেটুকু ধ্বংস করবে। পৃথিবীর আরো অনেক দেশে নানা সংঘাত সমস্যা আছে। যুদ্ধ আছে। সারা বছর ধরেই যুদ্ধ চলে কোন কোন দেশে। কিন্তু এই ছোট্ট জায়গাটায় যে সমস্যা সেটা খুব অদ্ভুত। সবাই জানে কেন অদ্ভুত। অদ্ভুত হবার কারণেই সমস্যাটার কোনদিন সমাধান হবে না। পাশাপাশি দুটো আলাদা রাষ্ট্রের কথা বলা হচ্ছে এখন। সেই থিউরি ইসরায়েল মানে না। পাত্তাও দেয় না। এবার আমেরিকাও বলছে। আমেরিকা বললে পাত্তা দেবে। কিন্তু যতটুকু চাপ দিলে ওরা বাধ্য হবে ততটুকু চাপ আমেরিকা দেবে কিনা সন্দেহ আছে। ইসরায়েল আর কাউকে পাত্তা দেয় না। কারণ তারা জানে তারা আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য শাখা। তাদের সাথে যুদ্ধ করে কেউ টিকতে পারবে না।

ইসরায়েলের সাধারণ মানুষ চায় সব জিম্মি মুক্ত হোক। এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০ জনের মুক্তি হয়েছে। বাকী আরো দুশোজন। তাদের মুক্তি হবে কিনা বলা মুশকিল। তাদের অনেকে মারা গেছে ইসরায়েলী বোমাবর্ষণে। মুক্তি হলেও শান্তি আসবে না। আবারো যুদ্ধ শুরু হবে। সেই যুদ্ধের ইস্যুতে আমেরিকার সাথে বাকী আরব দেশের মতবিরোধ দেখা দিতে পারে, এমনকি কাতারের সাথেও ঝামেলা লেগে যেতে পারে। তখন কোন সন্ধির সম্ভাবনা থাকবে না। আরেকটা বড় যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাবে পৃথিবী। এই ছোট্ট বদমাশ রাষ্ট্রটির জন্য পুরো পৃথিবীর শান্তি হুমকিতে পড়ে যেতে পারে।

আগামীকাল থেকে নতুন কী আপডেট আসে দেখা যাক।

আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩

মানুষের জীবনের মূল্য বাজারভেদে আলাদা। আমেরিকান জীবন, ইউরোপীয়ান জীবন, আফ্রিকান জীবন, এশিয়ান জীবন, ভারতীয় জীবন, পরাধীন জাতির জীবন, আদিবাসী মানুষের জীবন সবকিছুই আলাদা। ডলার, পাউন্ড, ইউরো, টাকা, রূপী, ইয়েনের মতো প্রতিটি মানুষের একটা মুদ্রামূল্য আছে।

কয়েকটি অবান্তর উদাহরণ। এগুলো সত্যিকারের মূল্য নয়। সংবাদপত্র থেকে আহরিত অনুমান:
১ জন আমেরিকানের জীবন = ১০০০ এশিয়ানের জীবন
১ জন এশিয়ানের জীবন = ১০ জন আফ্রিকান জীবন
১ জন ইউরোপীয়ানের জীবন = ১৮,০০০ প্যালেস্টাইনীর জীবন

তালিকা আরো অনেক দীর্ঘ করা যায়। ইসরায়েল বলেছে ১জন হামাসকে হত্যা করার জন্য ১০০ জন সিভিলিয়ান প্যালেস্টাইনী হত্যা করা জায়েজ। এগুলা হলো বাইপ্রোডাক্ট মরণ।

বিজয়ীপক্ষ যুদ্ধবিরতি চায় না। ইসরায়েলের সাথে আমেরিকা, ইউরোপও বিজয়ীপক্ষ। কেউ যুদ্ধবিরতি চায় না। কিন্তু ১ জন ফরাসী এজেন্ট ইসরায়েলের গুলিতে মারা যাবার পর নড়েচড়ে বসেছে ইউরোপ। এখন জার্মানী, ফ্রান্স, বৃটেন যুদ্ধবিরতির উপায় সন্ধান করছে।

জীবনের উপযোগ

প্রতিটি মানুষের কাছে  জীবনকে উপভোগের নিজস্ব পদ্ধতি আছে। কেউ ধন সম্পদে উপভোগ করে, কেউ জ্ঞান বিজ্ঞানে, কেউ শিল্প সাহিত্যে, কেউ একটি ঘাসের ডগায় একটি শিশিরবিন্দু দেখেও জীবনকে উপভোগ করতে পারে। জীবনে সাফল্য লাভ করার বহুবিধ উপায় আছে মানুষের। অন্য প্রাণীদের চেয়ে এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। যে যার সাধ্যমত সে উপায় খুঁজে নেয়। যারা সেই সব উপায়ের কোনটাই খুঁজে নিতে পারে না, তারা দুর্ভাগা। সব সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অনেকে সুখের উপায় খুঁজে পায় না। না পাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু সব সুযোগ সুবিধা থেকেও চোখ মেলে দেখার আগ্রহের অভাবে সে সুখ থেকে বঞ্চিত হয় সে সবচেয়ে বড় দুর্ভাগা।

Sunday, November 26, 2023

‘দ্য চিটাগং জয়েন্ট স্টক কফি কোম্পানি ১৮৪৩’


বাঙালী চা খেতে শেখার আগে কফি খাওয়া শিখেছিল কিনা সেটা জানা না গেলেও চায়ের আগে যে কফি চাষ করতে শুরু করেছিল সেটা নিশ্চিত হওয়া গেল অবশেষে শুনে অবাক হতে পারেন উনিশ শতকের প্রথমভাগে চট্টগ্রাম শহরের মধ্যেই ছিল একাধিক কফি বাগান। তার মধ্যে একটি বাগানের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে চট্টগ্রাম শহরের প্রাচীন এক মানচিত্র থেকে। সেই বাগানটি ছিল বর্তমান চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এবং ওয়ার সেমেট্রি এলাকা জুড়ে। ১৮৪৩ সালে কফি চাষের জন্য বৃটিশ উদ্যোক্তারা একটা কোম্পানিও গঠন করেছিল। তার নাম ছিল দ্য চিটাগং জয়েন্ট স্টক কফি কোম্পানি

অনেকেই জানেন ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামের কমিশনার মি. স্কন্স বাংলাদেশের প্রথম চা বাগানের সূচনা করেছিলেন চট্টগ্রামে। তিনি আসাম থেকে কিছু চায়ের চারা এনে  চট্টগ্রাম ক্লাবের আশপাশের টিলাগুলোর মধ্যে লাগিয়েছিলেন। তিন বছর পর সে চা বাগান থেকে নমুনা নিয়ে কলকাতায় এগ্রিকালচারাল সোসাইটিতে পাঠানোর পর সরকারের অনুমোদন লাভ করেছিলেন তিনি।  তারপর থেকে চট্টগ্রাম শহর এবং আশপাশের এলাকায় চায়ের বাগান গড়ে উঠতে থাকে।

 

কিন্তু চা বাগানের উদ্যোগ নেবার আগ থেকেই যে চট্টগ্রামে কফি চাষ শুরু হয়েছিল এতদিন সেটা জানা ছিল না। একটি প্রাচীন মানচিত্র থেকে ব্যাপারটার সন্ধান পাওয়া গেলকিছুদিন আগে চট্টগ্রাম শহরের একটি দুর্লভ প্রাচীন মানচিত্র হাতে আসলো সৌখিন ইতিহাস গবেষক শেখ শওকত কামালের মাধ্যমে

 


লন্ডনের বৃটিশ লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করা সেই মানচিত্রটি এঁকেছিলেন বৃটিশ সার্ভেয়ার এডওয়ার্ড রেমন্ড বোইলিউ। ১৮৩৫-৪১ সময়কালে তিনি চট্টগ্রামের ভূমি জরিপের কাজে হেনরি সিডনের সহকারী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। শহরের সদর এলাকা নিয়ে তৈরি সেই মানচিত্রের সীমানা ছিল বর্তমান ফিরিঙ্গীবাজার এলাকা থেকে উত্তরে মুরাদপুর পর্যন্ত, পুবে চাক্তাই খাল থেকে পশ্চিমে টাইগারপাস পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৮১৮ সালে আঁকা জন চিপের মানচিত্রটির কথা বাদ দিলে চট্টগ্রাম শহর নিয়ে এত বিশাল এবং বিস্তারিত মানচিত্র এর আগে কখনো আঁকা হয়নি। জন চিপের মানচিত্রে শহরের আরো বড় এলাকা ধারণ করা হলেও রেমন্ড বোইলিউর মানচিত্রে শহরটি অনেক বেশি বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত। উনিশ শতকে চট্টগ্রাম শহরে কয়টি পুকুর ছিল সেটিও গুনে ফেলা সম্ভব ওই মানচিত্র ধরে।

সেই মানচিত্রের অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে বর্তমান চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় কফি বাগানটা খুঁজে পাওয়া যায়। ১৮৪০ সালের মানচিত্রে সেই এলাকায় একটি  কফি প্ল্যানটেশন দেখানো হয়েছে। ব্যাপারটা কৌতূহল জাগানিয়া। সেই সূত্র ধরে চট্টগ্রামের কফি চাষ বিষয়ে আরো খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করি নানান সূত্র থেকে অনুসন্ধানপর্বে ফোর্ট উইলিয়ামের পুরোনো দলিলপত্রের মধ্যে বেশ কিছু চিঠিপত্র পাওয়া গেল যেখানে কফি চাষের ব্যাপারে চমকপ্রদ কিছু তথ্য দেয়া আছে।  তার একটি হলো ১৮৪৩ সালে কফি চাষের জন্য চট্টগ্রামে গঠিত হওয়া দি চিটাগং জয়েন্ট স্টক কফি কোম্পানির অনুমোদন বিষয়ক একটি প্রস্তাব এটা খুব অপ্রত্যাশিত একটা প্রাপ্তি।

 

মি. স্কন্স চট্টগ্রামে কমিশনার হয়ে আসার পর দেখতে পেয়েছিলেন এখানে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের উদ্যোগে কফির চাষ করছে এবং সেই কফি বেশ ভালো মানের। এদেশের লোক কফি না খেলেও এখান থেকে বিদেশে কফি রপ্তানী হয় তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উৎপাদিত কফি সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন এবং কফির মান সম্পর্কে উৎসাহিত হবার মতো ফলাফল পেয়েছিলেন। সেই কারণে তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে বৃটিশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ এবং রপ্তানীর উদ্দেশ্যে সেই কোম্পানি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন

 

নথিপত্রগুলো দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে  চট্টগ্রাম শহরে চা এবং কফি দুটোরই চাষ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কাছাকাছি সময়েচিঠিপত্রগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে তিনি ১৮৪৩ সালের আগষ্ট মাসে চা বাগানের যে প্রস্তাবটি পাঠিয়েছিলেন, তারও তিন মাস আগে এপ্রিল মাসে তিনি কফি কোম্পানির প্রস্তাবটা পাঠিয়েছিলেন।[সূত্র: জার্নাল অব দ্য এগ্রিকালচারাল অব দ্য হর্টিকালচারাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া]

 

চট্টগ্রামে কফির আদি নিবাস ছিল নাকি ইউরোপীয় বণিকরা এনেছিল সেটা নিয়ে নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। কিন্তু চট্টগ্রামে প্রাকৃতিকভাবে কফি জন্মানোর একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ১৭৮৬ সালে স্যার উইলিয়াম জোনসের লেখা একটা চিঠিতে। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে অবকাশ যাপনের জন্য কয়েক মাসের জন্য চট্টগ্রাম এসেছিলেন। তখন তাঁর বন্ধুকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন- for the sake of my wife's health and my own, to spend a few weeks in this Indian Montpelier, where the hillocks are covered with pepper vines, and sparkle with the blossoms of the coffee tree ; but the description of the place would fill a volume

[ Memoirs of The Life, Writings, and Correspondence of Sir William Jones by Lord Teignmouth(London, 1807)]

 

আমি ও আমার স্ত্রীর স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য আমি এই শহরে অবকাশ যাপন করতে এসেছি। এই শহরের টিলাগুলো গোলমরিচের লতায় ছেয়ে আছে, তার পাশাপাশি কফি ফুলে ঝলমল করছেকিন্তু এই শহরের সবটুকু সৌন্দর্য লিখতে হলো আস্তে একটা বই লিখতে হবে।

যদিও এখানে কফি ও গোলমরিচের বিবরণ থেকে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না সেটা প্রাকৃতিকভাবে চট্টগ্রামে জন্মাতো নাকি  চাষ করা হয়েছিল? কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে চট্টগ্রামে বৃটিশদের আগমনের আগ থেকেই কফি গাছের উপস্থিতি ছিল। হয়তো পর্তুগীজ কিংবা আরব বণিকরা এনেছিল।

 

বৃটিশরা চট্টগ্রামে কফি চাষ শুরু করার আগ থেকে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কফি চাষে জড়িত ছিল, সেই বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় মি. স্কন্সের পাঠানো সেই প্রস্তাবে। ৭ এপ্রিল ১৯৪৩ তারিখে কমিশনার স্কন্সের পাঠানো সেই প্রস্তাবে শেখ ওবায়দুল্লাহ নামের এক ব্যবসায়ীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁর বাগান থেকে কফির নমুনা সংগ্রহ করে কলকাতার এগ্রিকালচারাল সোসাইটিতে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে তিনি ভাল ফলাফল পেয়েছিলেন। শেখ ওবায়দুল্লাহ উনিশ শতকে চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থ  আহাদিসুল খাওয়ানিনের লেখক হামিদুল্লাহ খানের পিতা। 

 

 

১৮৪৩ সালের এপ্রিল মাসে পাঠানো মি. স্কন্সের সেই প্রস্তাবনার একাংশ:

 

আমি চিটাগং জয়েন্ট স্টক কফি কোম্পানি প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে সরকারী অনুমোদনের জন্য আবেদন করছি। আমরা সবাই জানি যে এই স্টেশনে (চট্টগ্রামে) খুব ভালো কফি জন্মায় এবং বেশ ভাল ফলন হয়।  আমরা এটাও জানি যে, এখানকার উৎপাদিত কফির মান বেশ ভালো এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক। কিছুদিন আগে আমি শেখ ওবায়দুল্লাহর বাগানে উৎপাদিত কফির একটি নমুনা এগ্রিকালচারাল সোসাইটিতে পাঠিয়েছিলাম এবং সোসাইটির মাসিক সভায় এটিকে ভাল বিক্রয়যোগ্য কফি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। 

 

আমি যে কারণে এই ব্যবসাটিকে লাভজনক বলে মনে করছি, সেইসব কারণ তথ্য প্রমাণ সহযোগে এই প্রস্তাবের সাথে যুক্ত করছি।

 

ধরা যাক আমরা ৬ একর জমিতে চাষ করবো। ৬ একরে ১ দ্রোন। ১ একরে যদি ৪৩,৫৬০ বর্গফুট হয় তাহলে ১ দ্রোণ বা ৬ একরে হবে ২,৭৬,৪৮০ বর্গফুট। পাশের মার্জিনে আমি হিসেবটা দিয়েছি। বলা হয়ে থাকে প্রতিটি কফি গাছের মধ্যে কমপক্ষে নয় ফুট দূরত্ব থাকা উচিত, ১২ ফুট থাকলে সবচেয়ে ভালো। সে ক্ষেত্রে একটি কফি গাছের জন্য কমপক্ষে ৮১ বর্গফুট থেকে ১৪৪ বর্গফুট জায়গা দরকার। আমি সর্বোচ্চ জায়গা রাখার কথা ভাবছি।

 

অতএব একটি গাছের জন্য ১৪৪ বর্গফুট রাখলে প্রতি দ্রোণ জমিতে ১৯২০টি গাছ নিশ্চিন্তে লাগানো যাবে। তবে ১২ ফুটের বদলে দশফুট রাখা যায়, আগেই বলেছি ৯ ফুট রাখলেও চলে। যদি ১০ ফুট জায়গা রাখি তাহলে ৩৪১৩টি গাছ লাগানো যাবে এক দ্রোণ জমিতে। তবু আমি প্রতি দ্রোণে মাত্র ১৯২০টি গাছ ধরে হিসেবটা করছি নিরাপদ অবস্থানে থাকার জন্য। 

 

তবে কফি আবাদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের একটা সমস্যা আছে। প্রথম কয়েক বছর বাগান থেকে কোন মুনাফা আসবে না। কমপক্ষে চার বছর পার হতে হবে মোটামুটি অংকের লাভ চোখে দেখার জন্য। শুরুতেই এই বিষয়টা মেনে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। আমি আশ্বস্ত করে বলতে পারি প্রাথমিক ধৈর্যটুকু রাখতে পারলে পরবর্তীকালে যে মুনাফা অর্জিত হবে সেটা দিয়ে এই ঘাটতিটা অনায়াসে পুষিয়ে যাবে।

 

মি. পোর্টার জানিয়েছেন যে সব কফি গাছের ফলন এক নয়। কোন কোন গাছ এক পাউন্ডের বেশি ফলন হয় না, আবার অনেক গাছে বছরের পর বছর ধরে চার পাউন্ড উৎপন্ন হয়। এমনকি কোন কোন গাছ আছে যেগুলোর মধ্যে পঞ্চম বছরে সাত পাউন্ড বিক্রিয়যোগ্য কফি হয়। আমি আমার হিসেবটা আধা পাউন্ড এবং এক পাউন্ডের মধ্যে সীমিত রেখেছি।

 

মূল্য হিসেব করার ব্যাপারে আরেকটা বিষয় বিবেচনা করেছি আমি। আমার হিসেবটা বিশ্বসেরা মোকা কফির ওপর ভিত্তি করে ধরা হয়নি যেটার দাম বাজারে অনেক বেশি। আমরা হিসেব করতে পারি কাছাকাছি বাজারে উৎপাদিত কফির দামে, যেমন মহীশূর এবং সিলোন। লন্ডনের বাজারে এই দুই জায়গায় উৎপাদিত কফির দামটা নিন্মরূপ:

 

মহীশূর কফি: ৫৫-৭০(১৮৪১)

সিলোন কফি: ৬৫-৮০(১৮৪১)

 

এই মূল্যকে ভিত্তি করে আমি ৬ দ্রোণ জমিতে প্রতি গাছে ১/২ পাউন্ড কফি উৎপাদন হলে কত আয় হতে পারে তার একটা হিসেব করেছি। সেই হিসেবে চতুর্থ বছরে ৬ দ্রোন জমির ১১,৫২০টি গাছ থেকে ১/২ পাউন্ড হিসেবে ১৪৪০ টাকা আয় হবে। এটা হলো সর্বনিন্ম আয়ের হিসেব। ন্যায্য আয় হিসেব করতে গেলে এই অংকটা ২৮৮০ টাকা হবে।

 

এখন আমি এই পরিমান কফি উৎপাদন করতে গিয়ে কোন খাতে কত খরচ হতে পারে সেই হিসেবটা তুলে ধরবো চার বছরের হিসেবে।

 

১ জন মালী, মাসিক ৬ টাকা বেতন হিসেবে বছরে খরচ :                                ৭২ টাকা

১ জন সহকারী মালী, মাসিক ৪ টাকা বেতন হিসেবে বছরে খরচ:                     ৪৮ টাকা

১৬ জন দক্ষ শ্রমিক মাসিক ২ টাকা করে, ৮ আনা করে ৪০ জন শ্রমিক :            ৪৮০ টাকা

------------------------------------------------------------------------------------------------------

১ বছরে মোট খরচ:                                                                                  ৬০০ টাকা

------------------------------------------------------------------------------------------------------

৪ বছরে মোট মজুরী খরচ:            ২৪০০ টাকা

 

দুই জোড়া ষাঁড়:                           ৬০ টাকা

দুটো গরুর গাড়ি:                         ৪০ টাকা

কোদালী এবং অন্যন্য:                  ৫০ টাকা

মালীর ঘর:                                 ৫০ টাকা

-----------------------------------------------------------------------------------------------

অন্যন্য খরচ:                              ২০০ টাকা

-----------------------------------------------------------------------------------------------

চার বছরে মোট খরচ : ২৬০০ টাকা

 

এটার সাথে আরো কিছু খরচ যোগ হতে পারে। সেটা হিসেব করে অংকটা ৩০০০ টাকা পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে।

 

কফি বাজারজাত করার মতো অবস্থায় পৌঁছাতে চার বছর লাগে। অর্থাৎ চতুর্থ বছরে গিয়ে কফি বাজারজাত করা যাবেকিন্তু এই পর্যায়ে আরো কিছু খরচ যুক্ত হবে। শিপিং, ইনস্যুরেন্স, বিক্রয় খরচ সব মিলিয়ে খরচ হবে ৩৯৫ টাকা। ১৪৪০ টাকা আয় থেকে এই খরচ বাদ দিলে বাকী থাকবে ১০৪৫ টাকা। ৩০০০ টাকা খরচের বিনিময়ে ১০০০ টাকা আয় হলে চতুর্থ বছরে বিনিয়োগের অনুপাতে লোকসান হবে ৩৩%। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই হিসেবটা করা হয়েছে সবচেয়ে খারাপ উৎপাদনের হিসেব ধরে। যদি আমরা মোটামুটি ভালো উৎপাদনের হিসেবটা ধরি, প্রতি গাছে এক পাউন্ড করে কফি উৎপাদন হয় তাহলে হিসেবটা অন্যরকম হবে। সেক্ষেত্রে চতুর্থ বছরে এসে কোম্পানি ২০৯০ টাকা নেট লাভ করতে পারবে।

 

সুতরাং আমাদের ধরে নিতে হবে চতুর্থ বছর পর্যন্ত আমাদের কোন লাভ হবে না। লাভের শুরু হবে পঞ্চম বছর থেকে। পঞ্চম বছরে আমাদের আয়ের হিসাব দিলাম।

 

পঞ্চম বছরে আমাদের আয় হবে     ২৮৮০ টাকা

বিক্রয় খরচ বাদ যাবে                  ৭৯০ টাকা

মজুরী ইত্যাদি খরচে বাদ যাবে      ৬০০ টাকা

অন্য খরচ বাদ যাবে                     ১৯০ টাকা

অতএব, পঞ্চম বছরে আমাদের নেট লাভ হবে ১৩০০ টাকা।

 

এই হিসেবের ভিত্তিতে আমরা যে কোম্পানির প্রস্তাব করছি সেটার প্রাথমিক মূলধন হবে ৬০০০ টাকা। আমরা ৫০ জনের মধ্যে ১২০ টাকা শেয়ারে ভাগ করতে পারি। শুরুতে এর অর্ধেকটা বিনিয়োগ করেই প্রাথমিক কাজ শুরু করা যাবে। 

 

এই প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য হলো কোম্পানিকে চট্টগ্রামে কফি চাষের ব্যাপারে উৎসাহিত করাআশা করছি কোম্পানি এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে কফি চাষে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে।  

 

[সংক্ষেপিত]

 

মি. স্কন্সের পাঠানো এই প্রস্তাব থেকে বোঝা যাচ্ছে কফি চাষ করে লাভ করতে হলে ৪ বছর অপেক্ষা করতে হবে। পঞ্চম বছর থেকে কোম্পানি লাভের মুখ দেখতে শুরু করবে। কফি চাষের ধরণটাই এরকম। গাছ যত বড় হতে থাকে ফলন তত বাড়তে থাকে। সুতরাং ৫ বছরের পর থেকে লাভের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকবে

 

কিন্তু মি. স্কন্সের এই প্রস্তাবে কোম্পানির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বিরোধিতা করার ফলে সেটা তখনকার মতো বাতিল হয়ে পড়ে। সেই কর্মকর্তা কফির চেয়ে চা বাগানে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু মি. স্কন্স তাতে দমে যাননি। তিনি কোম্পানির তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কফি চাষের কাজটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কোম্পানির পক্ষ থেকেও একটা কফি বাগানের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। সেই বাগানটি প্রথম দিকে ভালোভাবে চালু হলেও মি. স্কন্স বদলি হয়ে যাবার পর লোকবলের অভাবে ঝিমিয়ে পড়েছিল।

 

মি. স্কন্সের সেই কফি চাষের পরিণতি সম্পর্কে জানা যায় আরো দুই দশক পর। ১৮৬২ সালে গর্ডন ইয়াং চট্টগ্রামের কমিশনারের দায়িত্ব নেবার পর তিনি চট্টগ্রামে চা ও কফি চাষ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি তখনকার সল্ট এজেন্ট মি. ব্রুসের কাছে বিষয়টা নিয়ে জানতে চান। কারণ মি. ব্রুস দীর্ঘকাল ধরে চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন। কমিশনার স্কন্সের সেই কফি চাষ প্রকল্পের সময় মি. ব্রুসও যুক্ত ছিলেন। মি. ব্রুস বিয়ে করেছিলেন চট্টগ্রামের এক বৃটিশ ব্যবসায়ীর কন্যাকে।  তাঁর শ্বশুরও চট্টগ্রামে কোকো বাগান করে চকোলেট উৎপাদন করেছিলেন প্রথমবারের মতো। মি. ব্রুসের চিঠিতে জানা যায় চট্টগ্রামে কফি চাষ আরো ত্রিশ বছর আগে শুরু হয়েছিল। বৃটিশদের মধ্যে জনৈক মি. চ্যাপম্যান প্রথম কফি বাগান করেছিলেন চট্টগ্রামে। মি. ব্রুস চট্টগ্রামে চা-কফি চাষের ইতিবৃত্ত নিয়ে ১৮৬২ সালে গর্ডন ইয়াং এর কাছে একটা জবাব লিখেছিলেন সেই চিঠির সারসংক্ষেপ:

 

স্যার, আপনার অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে আমি চট্টগ্রামে চা ও কফি চাষ বিষয়ক যে সকল তথ্য আমার কাছে আছে সেগুলো সংক্ষেপে জানাচ্ছি।

 

আমি এই শহরে ১৮৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির বাগান এবং অন্যন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগানগুলিতে যেসব কফি গাছ দেখেছি তার ভিত্তিতে পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যদি উপযুক্ত মাটিতে কফি চাষ করা হয় তাহলে এখানে খুব ভালো ফলন পাওয়া যাবে।

 

ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগানগুলোতে কফি খুব ভালো ফলন হচ্ছে। কোম্পানির বাগানগুলোতে কফি উৎপাদিত হচ্ছে, কিন্তু ফলন তেমন বেশি না। গাছের আকার হিসেবে উৎপাদন ঠিক আছে, কিন্তু যেখানে গাছগুলো রোপন করা হয়েছে সেখানকার মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি, ফলে অনেক বেশি পানি লাগে। উর্বরাশক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রচুর গাছ লাগাতে হয়েছে, এসব খাতে বেশি খরচ হয়। এই গাছগুলোর ছায়াতে কফি গাছ বেড়ে উঠতে পারে এবং ভালো ফলন হয়। কোম্পানির লোকজনের মধ্যে  মি. স্কন্স এবং আমিই বাগান নিয়ে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু তিনি সবসময় দেখাশোনা করতে পারতেন না এবং আমি সাড়ে চার মাস শহরের বাইরে ছিলাম লবন উৎপাদনের কাজে। তবে আমার কোন সন্দেহ নেই যে নীচু ভূমিতে চাষ করা হলে কফি ব্যবসা থেকে বেশ ভালো আয় করা সম্ভব।

 

কোম্পানির বাগানটা দেখাশোনা করার জন্য আমি এবং মি. ফ্রেইটাস বাদে আর কেউ ছিল না। কিন্তু যেহেতু আমরা দুজনেই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, বাগানটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া ছোট্ট এই বাগানের ভাড়া গুনতে হতো ১৪ রুপী করে। তার উপর জমি চাষ করা, পানি দেয়া, সার দেয়া, আগাছা সাফ করা, বেড়া দেয়া ইত্যাদি ছিল ব্যয়বহুল।

 

মি. হগ নামের একজন রাঙ্গুনিয়াতে নদী তীরের একটা জায়গার মধ্যে বড় মাপে কফি চাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি এক বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করলে প্রকল্পটা টিকতে পারেনি। 

 

৩০ বছর আগে ১৮৩২ সালের আগে ডাক্তার চ্যাম্পম্যান কফি গাছ লাগিয়েছিলেন সিপাহী লাইনের পেছনে। আমি এখানে আসার পর কথাটা শুনে নিজের হাতে জঙ্গল থেকে সেই কফি গাছের ফল তুলেছিলাম পনের বছর আগে। আমি যখন ফলগুলো তুলেছিলাম তখন সেগুলো যথেষ্ট পরিপক্ক হয়নি। আমি পরে সেদিকে যাইনি, কিন্তু এখনো চাইলে জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারবো।

 

আরেকটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখান থেকে এক মন কফি লন্ডনে পাঠানোর পর সেগুলো বেশ সমাদর পেয়েছিল। যদিও সেগুলা ভালভাবে প্যাক করা হয়নি। যেনতেনভাবে পাঠানো হয়েছিল।

 

মি. স্কন্স যে বাগানটি করেছিলেন সেটা সম্পূর্ণ নিজের খরচে করেছিলেন। সেখানে তিনি চা গাছও লাগিয়েছিলেন। মি. স্কন্সের সেই বাগানটি বর্তমানে এলসের বাগান নামে পরিচিত। সেটার মালিক মিসেস ফুলার।

[Parliamentary Papers-Public Works,Plantations, Waste Lands-East India Vol-15]

 

১৮৬২ সালে কমিশনার মি. গর্ডন ইয়াং চট্টগ্রামে চা ও কফি চাষের বিষয়ে এসব তথ্য সংগ্রহ করে কলকাতায় বেঙ্গল গভর্নমেন্টের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বেঙ্গল গভর্নমেন্ট মি. গর্ডন ইয়াং এবং মি. ব্রুসের চিঠি দুটো চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। ততদিনে সিলেটেও পরীক্ষামূলক চায়ের চাষ সফল হয়েছিলচট্টগ্রাম ও সিলেটে চা বাগানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। চট্টগ্রামে প্রথমদিকে ছোট আকারে চা বাগান করার সময় তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু বড় আকারে করতে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে চা ব্যবসায়ীদের সংঘাত শুরু হয়। খুনোখুনি থেকে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছিল। কারণ চা বাগানের জন্য জমি অধিগ্রহন স্থানীয়রা মেনে নেয়নি। কফি চাষ নিয়েও প্রায় একই সমস্যা হয়েছিল। কফি চাষের জন্য যেরকম উর্বর জমি দরকার ছিল সেই জমিগুলোতো ধান চাষ হতো। সেই জমি কফি চাষের জন্য দিতে রাজী ছিল না স্থানীয় লোকেরা। সেটা নিয়ে ঝামেলায় যেতে রাজী ছিল না কোম্পানি। তাছাড়া কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে দেখাশোনার মতো যথেষ্ট লোকবল ছিল না। এইসব কারণে আস্তে আস্তে কফি চাষ কমতে থাকে। একসময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। শুধু বন্ধ হয়ে যায় না, চট্টগ্রামে কফি চাষের ব্যাপারটা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় লন্ডনের বৃটিশ লাইব্রেরির পুরোনো মানচিত্র আর নথিপত্র ছাড়া আর কোথাও দ্য চিটাগং জয়েন্ট স্টক কফি কোম্পানির চিহ্নমাত্র নেই।

.............................................................. 


 দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড লিংক:

https://www.tbsnews.net/bangla/%E0%A6%87%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B2/news-details-182214

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রথম মহাজন

 




The man whose money kick-started the Bank of England was William Phips.

Martin Parker

Professor of Organisation and Culture, University of Leicester

 

 

ডুবে যাওয়া স্পেনিশ জাহাজ

 

১৬৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যারিবিয়ান সমুদ্রে মূল্যবান সম্পদবাহী একটি স্পেনিশ জাহাজ ডুবে যায়। খবরটি প্রথমে চেপে রাখা হয়। কারণ জানাজানি হলে নিমজ্জিত জাহাজের মধ্যে থাকা ধনসম্পদ লুট হয়ে যেতে পারে। আলমিরান্তা নামের  ৬০০ টনের জাহাজটি মেক্সিকো থেকে স্পেনের উদ্দেশ্যে যাবার পথে ঝড়ের কবলে পড়ে। ৫৩২ জন যাত্রীর মধ্যে কোনমতে ১৯৪ জন প্রাণে বেঁচে গেলেও জাহাজের সকল সোনা-দানা  টাকা-পয়সার সলিল সমাধি ঘটেছিল। সেই সম্পদের বড় অংশের মালিকানা ছিল স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপের। সেই কালে  দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশগুলো থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে স্পেনিশ জাহাজ প্রায়ই আটলান্টিক পাড়ি দিতো। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনায় কোন কোন জাহাজ চিরতরে হারিয়ে যেতো। এই জাহাজটি ছিল ডুবে যাওয়া জাহাজগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। তাই রাজকীয় উদ্যোগে স্পেনিশ অনুসন্ধানীরা ওই এলাকায় তন্নতন্ন করে  জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। জাহাজের ধ্বংসাবশেষ কিংবা হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান সম্পদের কিছুই উদ্ধার করা যায়নি। 

 

জাহাজডুবির খবরটা বেশিদিন চাপা থাকেনি। জানাজানি হবার পর নানান দেশের সম্পদলোভী অভিযাত্রীরা ক্যারিবিয়ান সাগরে একের পর এক অভিযান চালিয়ে গেছে গুপ্তধনের খোঁজে। কিন্তু জাহাজটি ঠিক কোথায় ডুবে গিয়েছিল তার কোন হদিস ছিল না কারো কাছে। তাই খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে ফিরে গেছে অভিযাত্রীরা। কারো ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি দীর্ঘ ৪৫ বছর 

 

১৬৮৭ সালের জানুয়ারী মাসে সেই ডুবে যাওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান উইলিয়াম ফিপস নামের এক আমেরিকান গুপ্তধন সন্ধানী।

 

গুপ্তধন শিকারী উইলিয়াম ফিপস

উইলিয়াম ফিপসের জন্ম  ১৬৫১ সালে বৃটিশ শাসিত আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের দরিদ্র এক পরিবারে। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত গ্রামে ভেড়ার পাল চরানো বাদে আর কোন জীবিকা ছিল না তার। আঠারো বছর বয়সে জীবিকার সন্ধানে তিনি বোস্টন শহরে চলে আসেন। চার বছর যাবত জাহাজ নির্মানের কাজে হাত পাকানোর পর তিনি বোস্টনের এক স্বচ্ছল ব্যবসায়ীর বিধবা কন্যা মেরি স্পেনসারকে বিয়ে করেন। বৈবাহিক সূত্রে তিনি বেশ কিছু সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। সেই টাকায় ১৬৭৫ সালে তিনি একটা নৌযান নির্মানের কারখানা খোলেন বোস্টন শহরে। সমুদ্রগামী নৌযান তৈরি করে হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর জাহাজের কারবারী। কিন্তু ১৯৭৬ সালে আমেরিকান আদিবাসীদের সাথে ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের মধ্যে সংগঠিত একটা যুদ্ধ তাঁর সদ্য আলোর মুখ দেখা ব্যবসার ওপর আঘাত হানে। আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের আক্রমণে তাঁর কারখানা ধ্বংসের মুখে পতিত হয়।

 

কিছুকাল পর  তাঁর মধ্যে সমুদ্রের তলদেশ থেকে ডুবন্ত জাহাজের গুপ্তধন উদ্ধারের নেশা ভর করে। ১৬৮০ সালে বাহামা দ্বীপের পাশে এক অভিযানে গিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো কিছু জাহাজডুবির সম্পদ উদ্ধার করেন। অভিযানে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের সবাই বেশ ভালো রকমের লাভ করেছিল। সেই থেকে বোস্টন শহরে ডুবন্ত জাহাজের সম্পদ উদ্ধার করার বিষয়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন ফিপস 

 

১৬৮৩ সালে তিনি ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে লন্ডন শহরে গিয়ে উপস্থিত হন। কাকতালীয়ভাবে ওই সময়ে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের অন্যতম উপদেষ্টা স্যার জন নারব্রুর সাথে দেখা হয় তাঁর। যিনি অল্প কিছুদিন আগে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ডুবন্ত জাহাজের গুপ্তধন উদ্ধারের একটা গোপন অভিযান পাঠিয়েছিলেন। স্যার নারব্রুর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে তিনি সমুদ্রের তলদেশ থেকে ডুবন্ত জাহাজের সম্পদ উদ্ধারের ব্যাপারে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান। তখন স্যার নারব্রু রাজা দ্বিতীয় চার্লসের অনুমতি নিয়ে আরেকটি অভিযানের জন্য নির্বাচিত করেন উইলিয়াম ফিপসকে।

 

সাধারণত এমন অভিযানের ক্ষেত্রে রয়েল নেভিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকলে কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছিল ক্যারিবিয়ান সমুদ্রে তাঁর সম্পদ আহরণের পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে। অভিযানের জন্য তাঁকে কোন টাকাপয়সা দেয়া হয়নি। স্যার নারব্রু শুধু প্রয়োজনীয় জাহাজ সরবরাহ করেন। অভিযানে যারা অংশ নেবেন তাদের নিজেরদের টাকায় অভিযান শেষ করতে হবে। অভিযান সফল হলেই তারা লাভের অংশ পাবে।  জন ফিপসের সাথে যে চুক্তি হয়েছে তাতে অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদের ৩৫% রাজাকে দেবার পর বাকী অংশ নাবিকদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে পারবে। সেই লাভের আশায় নাবিকরা এই অভিযানে যুক্ত হয়েছিলেন।

 

অভিযান পরিকল্পনা চুড়ান্ত হবার পর উইলিয়াম ফিপস লন্ডন থেকে রোজ অব আলজিয়ার্স নামের ২০ কামানের একটা ফ্রিগেট নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে বোস্টনে পৌঁছান। সেখান থেকে তিনি আরো কয়েকটি জাহাজ এবং ডুবুরি যোগাড় করে ক্যারিবিয়ান সাগরে গুপ্তধনের সন্ধানে নেমে পড়েন। অভিযানটি চলেছিল প্রায় বছরখানেক ধরে। সেই সময়কালে  তাঁকে অনেক অনাহুত পরিস্থিতি এবং প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছিল অন্য অভিযাত্রী দলের সাথে। অনেক ঝক্কি ঝামেলার পর অভিযান শেষ করে তিনি লন্ডনে ফিরে যান ১৬৮৫ সালের আগষ্ট মাসে। যে পরিমাণ সম্পদ উদ্ধার হয়েছিল সেখান থেকে রাজার অংশ ছিল মাত্র ৪৭১ পাউন্ডলাভের অংকটা তেমন লোভনীয় না হলেও তিনি অভিযান শেষ করে লন্ডন ফিরে এসে যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সে জন্য তাঁকে ১৬৮৬ সালের পরবর্তী ক্যারিবিয়ান অভিযানের জন্য নির্বাচিত করা হয়।

 

আলমিরান্তার সন্ধান লাভ

 

পরের অভিযানে তিনি দুটি জাহাজ নিয়েছিলেন। ২০০ টনের জাহাজ জেমস এণ্ড মেরি এবং ৪৫ টনের একটি ছোট জাহাজ হেনরি অব লন্ডনবড় জাহাজটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি নিজেই। ছোট জাহাজটির দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন রজার্স।  

১৬৮৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি যাত্রা শুরু করে হিসপানিওয়ালা(বর্তমান ডমিনিকান রিপাবলিক) দ্বীপের কাছে পৌঁছান নভেম্বর ২৮ তারিখে। কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি আশপাশের অঞ্চলে জরিপ এবং অনুসন্ধান করার পর ১২ জানুয়ারী ১৬৮৭ তিনি তিনি ক্যাপ্টেন রজার্সকে বাহামার দক্ষিণ দিকে নির্দিষ্ট একটা অঞ্চলে অনুসন্ধান চালাবার নির্দেশ দেন। অনুসন্ধানে কয়েকজন নেটিভ আমেরিকান আদিবাসীকেও ডুবুরি হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল 

 

জানুয়ারীর ২০ তারিখে দলটা উপকূলের কাছে কয়েকটি কামানের সন্ধান পায়। কামানগুলোর একটু দূরেই ছিল একটা ডুবন্ত জাহাজের ভগ্নাংশ। ডুবুরিরা একের পর এক ডুব দিয়ে উদ্ধার করতে থাকে অসংখ্য রৌপ্যমুদ্রা। খবরটা ক্যাপ্টেন ফিপসের কানে পৌঁছানোর পর তিনি নিজের জাহাজ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হন। তিনি দেখেশুনে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান এটাই সেই বহুল কাঙ্খিত জাহাজ, যার খোঁজে গত চার দশকে অসংখ্য অভিযান হয়েছে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে।

 

গুপ্তধন খুঁজে পাওয়ার উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি একটা আশঙ্কাও দেখা দেয়। ফিপস জানেন এত বিপুল সম্পদের লোভ সামলানো কঠিন। নাবিকদের মধ্যে অনাকাঙ্খিত কোন বিদ্রোহের সম্ভাবনা দেখা না দেয়, তিনি সেদিকে খেয়াল রেখে আগেভাগে সবাইকে ডেকে বলে দিলেন, এই সম্পদ উদ্ধার করে লন্ডনে নিতে পারলে সবাইকে নির্ধারিত মজুরির দ্বিগুন পরিশোধ করা হবে। পাশাপাশি উদ্ধারকৃত সম্পদের অংশও তাদের দেয়া হবে। প্রয়োজন হলে তিনি নিজের অংশ থেকে তাদের পাওনা পরিশোধ করবেন বলে ব্যক্তিগতভাবে আশ্বস্ত করলেন।

 

তারপর দলবল নিয়ে কয়েক মাস ধরে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে প্রচুর পরিমান রৌপ্য মুদ্রাসহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র উদ্ধার করেন। উদ্ধারকৃত সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩৪ টনের মতো। আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছিল ২০৫,৫৩৬ পাউন্ড। ইতোপূর্বে যে কোন জাহাজডুবি সম্পদ উদ্ধারের ক্ষেত্রে এটাই ছিল সর্বোচ্চ রেকর্ড।

 

উদ্ধারকৃত মালপত্র জাহাজে বোঝাই করে খুব সতর্কতার সাথে আটলান্টিক পাড়ি দেন তিনি। টেমস নদীর মোহনায় প্রবেশ করার আগে কোন বন্দরে নোঙর করার সাহস করেননি। টেমসের মোহনায় গ্রেভসেন্ড বন্দরে নোঙর করার পর তিনি লন্ডনে খবর পাঠালেন। জাহাজ নিয়ে লন্ডনে পৌঁছানোর পর রাতারাতি খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন উইলিয়াম ফিপস।

 

উদ্ধারকৃত সম্পদের মধ্য থেকে পুরস্কার হিসেবে ফিপসকে দেয়া হয়েছিল ১৬,০০০ পাউন্ড। তাঁর অভিযান সঙ্গীদের জন্য দেয়া হয়েছিল আরো ৮০০০ পাউন্ড। রাজা ২য় জেমস তাঁকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন

 

সেই বছরই তাঁকে আবারো পাঠানো হয় বাকী সম্পদগুলো উদ্ধারের জন্য। কিন্তু ততদিনে খবর ছড়িয়ে পড়লে অন্যন্য অভিযাত্রী জাহাজ গিয়ে ওই এলাকায় ভিড় করে এবং অবশিষ্ট সম্পদ লুটপাট হয়ে যায়। তিনি মাত্র দশ হাজার পাউন্ডের মতো সম্পদ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন দ্বিতীয় পর্বে। পরের বছর তিনি বোস্টনে ফিরে যান প্রোভোস্ট মার্শাল জেনারেল পদ নিয়ে। পরবর্তীতে তিনি ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের প্রথম গভর্ণর হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।

 

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের জন্মলগ্নে

ম্যাসাচুসেটসের গভর্ণর হবার আগে তিনি লন্ডন শহরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে অংশ নিয়ে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন।

 

১৬৯০ সালে ফ্রান্সের সাথে দীর্ঘসময়ের নৌযুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল ইংল্যান্ড। পুরো দেশের অর্থনীতি তখন নাজুক অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। যুদ্ধে পরাজিত হবার প্রধান কারণ ছিল ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর দুর্বলতা। একটা শক্তিশালী নৌবাহিনী ছাড়া তখনকার দুনিয়ায় টিকে থাকা অসম্ভব ব্যাপার। নৌবহর পুনর্গঠনের জন্য যে পরিমাণ পুঁজির দরকার ছিল ইংল্যান্ডের রাজকোষে সে পরিমাণ পুঁজি ছিল না।  এই সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য স্কটিশ ব্যবসায়ী উইলিয়াম প্যাটারসন প্রস্তাব করেন সাধারণ জনগণের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করার মাধ্যমে বিষয়টার সমাধান করা যায়। অতঃপর সিদ্ধান্ত হয় গভর্নর এন্ড কোম্পানি অব দ্য ব্যাংক অব ইংল্যান্ড নামের একটি সংস্থা গঠিত হবে যারা শতকরা ৮ ভাগ সুদের বিনিময়ে বন্ড ইস্যু করবে সাধারণ জনগণের মধ্যেযারা যত টাকা বিনিয়োগ করবে তাদেরকে সেই অংকের ব্যাংক নোট ইস্যু করা হবে। এটি একটি অভিনব প্রস্তাব ছিল। কিন্তু উদ্যোগটিতে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। মাত্র ১২ দিনের মধ্যে ১.২ মিলিয়ন পাউন্ডের তহবিল সংগৃহিত হয়েছিল।

 

সেই উদ্যোগে মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি স্যার উইলিয়াম ফিপস। তাঁর বিনিয়োগের পরিমান ছিল ১১,০০০ পাউন্ড। 

 

বৃটিশ নৌবহর পুনর্গঠনের কাজে ১.২ মিলিয়ন পাউন্ড তহবিলের প্রায় অর্ধেক অংশ বিনিয়োগ করা হয়েছিল। বিনিয়োগের বহুগুন ফিরিয়ে দিয়েছিল রাজকীয় নৌবহর। পুনর্গঠিত শক্তিশালী সেই নৌবাহিনীকে ব্যবহার করে পরবর্তী একশো বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বিশাল উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতবর্ষ।

 

চার বছর পর ১৬৯৪ সালের ২৭ জুলাই সেই বিনিয়োগ সংস্থাটি রয়েল চার্টারের মাধ্যমে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছিল বাণিজ্যিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার জন্য।

 

যদিও সূচনায় পুঁজির যোগান দেয়া ছাড়া স্যার উইলিয়াম ফিপস ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের পরিচালনার সাথে কোনভাবে জড়িত ছিলেন না, কিন্তু প্রাথমিক পর্বের বৃহত্তম বিনিয়োগকারী হিসেবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে তাঁর নামটা পাকাপাকিভাবে থেকে গেছে।

 

 

তথ্যসূত্র:

১. The New England Knight: Sir William Phips(16511695) -  Emerson W. Baker

২. The Treasure Expedition of Captain William Phips to the Bahama Banks - Cyrus H. Karraker

৩. Nuestra Señora de la Concepción (1641) -  Ricardo Borrero and Filipe Castro

৪. How Stolen Treasure Kick-started the Bank of England -  Martin Parker


https://bonikbarta.net/magazine_details/4679?fbclid=IwAR0b66PTFqg9QDSnyRM52FntxxOsMbF53NNCwSYaAiqBM4edT9J1Zh_pZRg

শার্লট অব চিটাগং : ১৭৯২

 


[শার্লট অব চিটাগং১৭৯২ শিল্পীবালথাজার সলভিন]


১৭৯৬ সালের ঘটনাকলকাতায় নির্মিত ৪০০ টনের ননসাচ (Nonsuch) নামের একটা ফ্রিগেটের কাঠে পচন ধরলে সেটার কারণ খুঁজে বের করার জন্য চট্টগ্রামের এক জাহাজ নির্মাতা মি. হোয়াইটের মতামত চাওয়া হলো। কলকাতা তখনো বড় জাহাজ নির্মানের জন্য তেমন উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। জাহাজটি ছিল ১৭৮১ সালে কলকাতায় নির্মিত প্রথম বড় জাহাজ যা এশিয়া জুড়ে কোম্পানির বাণিজ্য পণ্য বহন করা ছাড়াও ইউরোপে  ফ্রান্সের সাথে চলমান যুদ্ধে ফ্রিগেট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। 

 

হোয়াইট সাহেব কলকাতায় গিয়ে জাহাজের আগপাশতলা পরীক্ষা করে জানালেন, .......জাহাজটির ফ্রেম বাদে বাকী অংশ সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি। কিন্তু যে কীলক বা পেরেক ব্যবহার করা হয়েছিল সেই কাঠ ভালো ছিল না। সেই কাঠ পচে গিয়ে অন্য কাঠেও সমস্যা সৃষ্টি করেছে। আমার মনে হয় ৭৪ কামানের বড় জাহাজ কলকাতায় তৈরী করাটা বাস্তবতাবিবর্জিত সিদ্ধান্ত। কারণ ওখানে জাহাজ নির্মানের জন্য যথাযথ মাপের উপযুক্ত কাঠের অভাব আছে। যেটা চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে হয় না। চট্টগ্রামে জাহাজ নির্মানের জন্য যে কোন আকৃতির গাছ পাওয়া যায়। সবচেয়ে ভালো কাঠের নাম হলো লাল জারুল। লাল জারুল তিন রকমের হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে মজবুত হলো কাঁটা জারুল গাছ।..

 

এই বিবরণটুকু পড়ে বোঝা যায়  অষ্টাদশ শতকে জাহাজ নির্মানের সক্ষমতায় কলকাতার তুলনায় চট্টগ্রাম অনেকখানি এগিয়ে ছিল। বস্তুতপক্ষে জাহাজ নির্মানের উপযুক্ত কাঠের প্রাচুর্যের কারণেই প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামে জাহাজ নির্মান শিল্প গড়ে উঠেছিল। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেগুল, জারুল, শাল জাতীয় গাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতো। সেই কাঠ দিয়ে স্থানীয় কারিগরেরা শত শত বছর ধরে জাহাজ তৈরি করে বিদেশে রপ্তানী করে আসছিলগ্রীক সভ্যতার সময়েও চট্টগ্রামের জাহাজ আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে রপ্তানী হয়েছে সেরকম কিংবদন্তীও আছে। যদিও সেই  প্রাচীন যুগের কোন জাহাজের উদাহরণ আমাদের কাছে নেই। এমনকি মোগল যুগে তৈরি জাহাজের রেকর্ডপত্রও নেই। বৃটিশ নির্মাতারাই চট্টগ্রামে তৈরি জাহাজের তালিকা রাখতে শুরু হয়েছিল। 

 

চট্টগ্রামে বৃটিশ শাসন শুরু হবার পর স্থানীয়দের পাশাপাশি বৃটিশ ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মান শিল্পে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। বড় বড় জাহাজগুলো বৃটিশদের নির্মাতাদের অধীনে তৈরি হতো। আদিকাল থেকে তৈরি হওয়া সেইসব জাহাজের কোন হিসেব রাখেনি কেউ। প্রথম দিকে বৃটিশ নির্মাতারা যখন এই খাতে স্বল্প পরিসরে বিনিয়োগ শুরু করে তখনো জাহাজগুলোর কোন হিসেব রাখা হতো না। কারণ তখন কলকাতার তুলনায় চট্টগ্রাম নিতান্তই অখ্যাত শহর। চট্টগ্রাম বন্দরের সমৃদ্ধি অতীত হয়ে গেছে মোগল যুগের আগেই। আরাকান পর্তুগীজ যৌথ দুর্বৃত্তপনায় এই অঞ্চল বাণিজ্যরহিত হয়ে পড়ে। মোগল আমল থেকে এটি মূলত আরাকান সীমান্তের একটা বাফার জোন হিসেবে ছিল। কোম্পানির কাছে স্টেশন হিসেবে চট্টগ্রামের গুরুত্ব একটা মফস্বল শহরের মতো। কিন্তু জাহাজ নির্মান শিল্পটা কোনভাবে টিকে ছিল। বৃটিশরা এই শহর অধিকার করার পর থেকে সেই শিল্প আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠতে শুরু করে। চট্টগ্রামে নির্মিত জাহাজগুলোর তালিকা পাওয়া যায় ১৭৯৪ সাল থেকে। সেই তালিকায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে এবং উনিশ শতকের প্রথম দুই দশকে  চট্টগ্রাম থেকে ছোটবড় কয়েকশো জাহাজ রপ্তানী হয়েছিল। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জাহাজ:

 

Thetis(1794) - 498 ton,

Margaret(1794)-300 ton,

Union(1794) -350 ton,

Ceres(1796)- 400 ton,

Hellen(1802) -450 ton,

Harriett(1803)- 450 ton,

Forbes(1803) -530 ton,

Hibernia(1810) -450 ton,

Orient(1812)- 579 ton,

Alexander(1812) - 660 ton,

Frances Sherburne(1814) -450 ton,

Thalia(1815) 641 ton,

Percy(1815) 650 ton,

Victory(1816) 677 ton,

Dorah(1816) 695 ton,

Alfred(1818) 681 ton,

 

এই তালিকার সবচেয়ে পুরোনো জাহাজটি হলো  থেটিস (Thetis)১৭৯৪ সালে নির্মিত হয়েছিল ৪৯৮ টনের এই জাহাজ। লয়েডস রেজিষ্টার থেকে জানা যায় জাহাজটি ১৮৩৯ সালের পরও চালু ছিল। তালিকায় থেটিস সবচেয়ে পুরোনো জাহাজ হলেও তার আগেও চট্টগ্রামে চমৎকার সব জাহাজ তৈরি হতো। তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি বলে সেই জাহাজগুলোর কথা হারিয়ে গেছে। চট্টগ্রামে জাহাজ নির্মানের সেই স্বর্ণযুগে বছরে গড়ে ৮-১০টি বড় জাহাজ রপ্তানী হতো। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের তৈরি জাহাজগুলো হিসেব করলে সংখ্যাটা আরো বেশি হবে। সেই জাহাজগুলো এশিয়া ছাড়াও ইউরোপ আমেরিকার বন্দরগুলোতেও যাতায়াত করতো। উপরের তালিকার মধ্যে ১৮১৮ সালে নির্মিত ৬৮১ টনের Alfred জাহাজটি ছিল সবচেয়ে খ্যাতিমান। জাহাজটি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সারা পৃথিবীর সবগুলো মহাদেশে চলাচল করেছে। জার্মান নৌবাহিনীতে যুক্ত হবার পরে নতুন নাম হয়েছিল Frigate Deutchland নামে। অচল হয়ে যাবার পরও জাহাজটি সংরক্ষণ করা হয়েছিল মেরিটাইম জাদুঘরে। ২০১৮ সালে জাহাজটির খোঁজ পেয়েছিলাম জার্মানীর ব্রেমারহেভন মেরিটাইম জাদুঘরের সূত্র থেকে।

 

ততটা বিখ্যাত না হলেও চট্টগ্রামে তৈরি আরেকটি জাহাজের খোঁজ মিলেছে সম্প্রতি। জাহাজটির নাম শার্লট অব চিটাগং উপরের তালিকায় জাহাজটির নাম নেই, কারণ তালিকা রাখা শুরু হয়েছিল আরো দুবছর পর থেকে। রেজিষ্টারে নাম না থাকলেও জাহাজটির ছবি এখনো ঝোলানো আছে লন্ডনে পৃথিবীর সময়কেন্দ্র বলে পরিচিত গ্রীনউইচ মানমন্দিরের পাশের ন্যাশনাল মেরিটাইম জাদুঘরে। শুধু ছবি নয়, ছবির সাথে একটা বিস্তারিত বিবরণীও ঝোলানো আছে। 

  


 

গ্রীনউইচ মেরিটাইম মিউজিয়ামের বিবরণীতে জাহাজটি সম্পর্কে লেখা হয়েছে:

 

হুগলী নদীতে নোঙর করা শার্লট অব চিটাগং এবং অন্যন্য জাহাজ

 

এই ছবিতে কলকাতার হুগলী নদীতে নোঙর করা স্নো জাতের জাহাজ শার্লট অব চিটাগং এর দুটি দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ছবির বাম দিকে স্টার্ণ ভিউ দেখা যাচ্ছে যেখানে জাহাজের নামটা লেখা আছে। মাঝখানে প্রশস্ত অংশে পুরো জাহাজটা দৃশ্যমান যেখানে বৃটিশ পতাকা উড়ছে। পেইন্টিংটার তারিখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সেই সময়ে কলকাতা বৃটিশ ভারতের রাজধানী ছিল এখান থেকে যেসব জাহাজ চলাচল করে তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রনে থাকে যেটা রাজকীয় নেভাল জাহাজের মতো দেখায়। বড় বড় যাত্রীবাহী জাহাজগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের মালামাল এবং কর্মচারীদের পরিবহন করার কাজে ব্যবহার করতো এবং ভারতের বিভিন্ন নদী পথ এবং সমুদ্র উপকূলে চলাচল করতোএইসব বাণিজ্য নিঃসন্দেহে লাভজনক ছিল বলে শার্লটের মতো পুবে তৈরি দেশীয় মালিকানাধীন ছোট ছোট জাহাজগুলোকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এশিয়ার বিভিন্ন বন্দরে মালামাল আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহার করতো। ইউরোপীয়ানরা ভারত মহাসাগরে পা দেবার শত শত বছর আগে এই ধরণের সমুদ্র বাণিজ্য এই অঞ্চলে চালু ছিল।

 

জাহাজটিকে নোঙর করা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। জাহাজের উপরিভাগে ছায়া দেবার জন্য একটা সামিয়ানা টাঙানো আছে, সেখানে পাগড়ি পরা কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। জাহাজের মধ্যভাগে এক নারীকে দেখা যাচ্ছে। আলোর স্বল্পতা এবং মেঘের পেছনে সোনালী রঙের আভা দেখে মনে হচ্ছে এটা  সূর্যোদয়ের সময়। ছবিতে খুব বেশি জনসমাগম দেখা যাচ্ছে না। যে কোন পশ্চিমা শিল্পী ভারতীয় শহরগুলোর ক্ষেত্রে এরকম জনবিরল দৃশ্য এঁকে থাকে। ছবিটার মধ্যে একটা শান্ত নীরবতা বিরাজ করছে এবং ছবির নিন্মভাগে জলের প্রতিবিম্বের মধ্যে সেটা প্রতিফলিত হয়েছে। কলকাতার দালানকোঠার মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্যের মধ্যে পশ্চিমা প্রভাব ফুটে উঠেছে উদিত সূর্যের সোনালী আভার মতো। ডানদিকে যে ব্রিগ ধরনের ইয়ট দেখা যাচ্ছে সেটা নৌবাহিনীর নয়। দূরে ডানদিকে দেখা যাচ্ছে জেটির পাশে কয়েকটা ষাঁড় একটা গরুগাড়িকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির পেছনে পেছেনে হেঁটে যাচ্ছে দুই ভদ্রলোক।

 

ছবিটা এঁকেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী বালথাজার সলভিন। তিনি ১৭৮৯ সালে ভারতে এসেছিলেন। তখন তিনি ভারতীয় নৌযান নিয়ে বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। যেই ছবিগুলো পরবর্তীকালে 'Pleasure Boats and Boats of Landing' নামে একটা গ্রন্থে যুক্ত করেছিলেন।

 

এ যাবত প্রাপ্ত চট্টগ্রামে তৈরি জাহাজের মধ্যে সেই প্রথম চট্টগ্রামের নাম যুক্ত করা হয়েছিল। যেহেতু ১৭৯২ সালে জাহাজটির ছবি আঁকা হয়েছে তাতে নিশ্চিত বলা চলে জাহাজটি সেই বছর কিংবা তার অল্প কিছুকাল আগে নির্মিত হয়েছিল। জাহাজের নির্মাতা হিসেবে ইংরেজ নাবিক জর্জ পালভাসের নাম পাওয়া গেছে। এই জাহাজটির ইতিহাস বেঁচে আছে বিখ্যাত শিল্পী বালথাজার সলভিনের কারণে। তিনি ১৭৯২ সালে হুগলী বন্দরে নোঙর করা অবস্থায় জাহাজটিকে দেখে একটি ছবি এঁকেছিলেন। সেই ছবিটাই সংরক্ষণ করেছে লন্ডনের ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে এটি অনেকটা প্রমোদ তরী ধরণের জাহাজ ছিলো। তবে ভিন্ন একটি সূত্রে জানা যায় এই জাহাজটি ১৭৯৪ সালে চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশকারী বার্মিজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে কর্নেল এরস্কিনের অভিযানের সময় রসদ পরিবহনের কাজেও ব্যবহার করা হয়েছিল। এ যাবত খোঁজ পাওয়া চট্টগ্রামে নির্মিত জাহাজের মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাচীন। জাহাজটির নাম শার্লট অব চিটাগংশিল্পী একই ফ্রেমে জাহাজের দুই দিকের ছবি এঁকেছেন যাতে পেছন দিকে খোদাই করা জাহাজের নামটা পড়া যায়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে  জাহাজের পেছন দিকে খোদাই করা আছে - CHARLOTTE of CHITTAGONG

 

কিন্তু চট্টগ্রামের সেই সমৃদ্ধ জাহাজ নির্মান শিল্পে ধীরে ধীরে ভাটা নেমে আসতে থাকে। কারণ কর্নফুলী নদীর চেয়ে হুগলী নদী অনেক বেশি ব্যস্ত বন্দর।  কোম্পানির কাছে হুগলী নদীতে জাহাজ নির্মান সুবিধাজনক ছিল। বিশেষ করে ১৮০৩ সালে কলকাতার খিদিরপুর ডক নির্মিত হবার পর কলকাতার জাহাজ নির্মানশিল্প নতুন ভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। তবে সেখানে পুরোদমে জাহাজ নির্মান শুরু হতে আরো কয়েক দশক লেগেছিল। তার হবার আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামেই সবচেয়ে বেশি জাহাজ তৈরি করা হতো। ১৮৩৪ সালের পর থেকে চট্টগ্রামের চেয়ে কলকাতায় নির্মিত জাহাজের সংখ্যা বেড়ে যায়। উনিশ শতকের শেষভাগে চট্টগ্রামের বৃটিশ মালিকানাধীন জাহাজ নির্মানের কারখানাগুলো কমে আসতে থাকে। একসময় চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জাহাজ নির্মানশিল্প ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নেয়।

 

তথ্যসূত্র:

1. National Maritime Museum, Greenwich, London.

2. A Collection of Papers Relative to Ship Building in India - John Phippy (Calcutta, 1840)

3. অতীত চিত্রে চট্টগ্রাম - শেখ শওকত কামাল

৪. Accounts and Papers of East India(For House of Commons), Vol-34 (1845)


দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড লিংক :

https://www.tbsnews.net/bangla/%E0%A6%87%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B2/news-details-179334