Thursday, November 2, 2023

ক্যারিয়ারের হ্যাঁ অথবা না

আমি ক্যারিয়ার বিমুখ মানুষ। তবু মাঝে মাঝে ক্যারিয়ার নিয়ে তরুণদের অনুরোধে কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকি। সেটা ঠিক ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং জাতীয় বিষয় নয়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা নিয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের পরামর্শ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকে এরকম-


আমি ‘আলফা’ কোম্পানিতে চাকরি করছি। মোটামুটি ভালো বেতন পাই। কিন্তু আমার কাছে ‘ডেলটা’ কোম্পানি থেকে আরো বেশি বেতনের অফার এসেছে। আমি কী করবো?


পরামর্শ দেবার আগে আমি নিজের অভিজ্ঞতার গল্পটা শোনাই।


আমি একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ক্যারিয়ার শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের আগেই চাকরিটা হয়ে যায়। পরিবার তখন কঠিন অবস্থায় ছিল, তাই আমাকে কঠিনতম একটা চাকরিতেও হ্যাঁ বলতে হয়েছিল। আমার চেয়ে কঠিন চাকরি করেছে আত্মীয় বন্ধুদের মধ্যে সেরকম একজনও দেখি নাই। শুধু একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। আমি প্রথম ছ মাস বোধহয় কোন সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত অফিস করেছি। কখনো কখনো রাত বারোটায়ও বাসায় ফিরেছি। ছ মাস পর থেকে আমরা মাসে এক শুক্রবার ছুটি পেতাম। এক বছর পর মাসে দুদিন ছুটি। এভাবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। আমার সাথে বারোজন অফিসার যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ টিকে থাকতে পারেনি। আমি কিভাবে পেরেছিলাম সেটা ভাবলে এখনো অবাক হই। কিন্তু প্রথম দেড় বছরের কঠিনতম সময় অতিক্রম করার পুরস্কারও পেয়েছিলাম ডাবল প্রমোশন এবং ডাবল ইনক্রিমেন্ট পেয়ে। তিন বছরের মধ্যে বিভাগীয় প্রধান হতে পেরেছিলাম। কোন সন্দেহ নেই এই পুরস্কারগুলো আমার পরিবারকে দুঃসময় থেকে রক্ষা করেছিল এবং আমার বাকী জীবনের ভিত গড়ে দিয়েছিল। পাঁচ বছরের মধ্যে আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা অবস্থায় পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমার কাজকর্ম পছন্দ হওয়াতে কোম্পানি আমাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে শুরু করে। অনেক সময় যে কাজের যোগ্য আমি নই, সেরকম কাজেও আমাকে পাঠাতেন। সম্ভবত ১৯৯৭/৯৮ সালের দিকে একবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিশিষ্ট শিল্পপতিদের মিটিং হবে। নিমন্ত্রণ করা হয়েছে আমাদের কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীকে। কিন্তু শীর্ষ নির্বাহী না গিয়ে তাঁর স্টিকার লাগানো গাড়িটা দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে। আমার চাকরি তখন তিন বছরও হয়নি। মজার ব্যাপার হলো আমার মতো কম বয়সী একজনকে সেখানে দেখে আমার টেবিলে বসা কয়েকজন শিল্পপতি ভেবেছিলেন আমি হয়তো নব্য ধনী কারো পুত্র কিংবা বাপের টাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। ভাগ্য ভালো সেখানে আমাকে কোন সংলাপে অংশ নিতে হয়নি। শুধু ভোজন সভার দায়িত্ব পালন করেছিলাম নিঃশব্দে।


এই গল্পটা বলার উদ্দেশ্য হলো- কোম্পানির এতখানি ভালোবাসা আর আস্থা, সেটা যেমন আনন্দের, অন্যদিকে বিপদেরও। আনন্দের কথাটা বললাম বিপদের কথাটা বলি এবার। 


ক্যারিয়ারের সেই পর্যায়ে আমি চাইলে দেশ বিদেশের আরো বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে বেশি বেতনে ঢুকে পড়তে পারতাম। আমার কাছে প্রায়ই সেরকম নিমন্ত্রণ আসতো। কিন্তু আমি আটকে গেলাম। কোম্পানি আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না। শীর্ষ নির্বাহীর অনুরোধ অগ্রাহ্য করলে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু  আমি ক্যারিয়ারিষ্ট ছিলাম না বলে থেকে গেলাম। প্রায় বিশ বছর। কিন্তু এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বুঝতে পারি আরো কয়েক বছর পর। 


দশ বছর পর কোম্পানির পলিসিগত এমন কিছু পরিবর্তন আসে, যার প্রতিক্রিয়ায় শীর্ষ নির্বাহী নিজেই পদত্যাগ করেন। ব্যাপারটা আমার জন্য সুখকর ছিল না। আমিও পদত্যাগ করতে পারতাম, কিন্তু তখন আমার হাতে তখন সেই সুযোগগুলো ছিল না, যেটা পাঁচ বছর আগে ছিল।  দেখা গেছে  প্রথম দশ বছরে আমি যতটা এগিয়েছিলাম, পরের দশ বছর তার অর্ধেকও আগাইনি। অথচ সময়মত বদল করলে আমি ততদিনে অন্য কোন কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীর পদ পেতে পারতাম। শেষ দশ বছর আমার কাছে স্রেফ অপচয় মনে হয়েছিল। আমি ওই সময়টাতে আমি নতুন কিছু শিখিনি, করিনি। পুরোনো কাজেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সে কারণে যে কোন ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বোঝা খুব জরুরী। এটা নিজেকেই নির্ধারণ করতে হয় পরিস্থিতি বুঝে। আমি টার্নিং পয়েন্ট বুঝতে অক্ষম ছিলাম না। কিন্তু যখন সিদ্ধান্ত নেবার দরকার ছিল তখন আমি ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে পড়েছিলাম।


তাই আপনার সামনে যখন কোন সুযোগ আসবে তখন আপনি হ্যাঁ কিংবা না বলার আগে কয়েকদিন সময় দিন নিজেকে। নিজের সাথে বোঝাপড়া করা জরুরী। আপনাকে বুঝতে হবে আপনার বর্তমান অবস্থা কী? আপনার কোম্পানির ভবিষ্যত কী? যে কোম্পানি থেকে অফার এসেছে সে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা এবং পরিবেশ কেমন? যদি কর্পোরেট পরিবেশ ভালো না হয় তাহলে বেশি বেতন দিলেও সে চাকরি নেয়া উচিত নয়। ভালো কোম্পানি হলে বেতন বেশি না হলেও হ্যাঁ বলতে পারেন। কিন্তু আপনি বর্তমান চাকরিতে যদি সন্তুষ্ট থাকেন, যদি আপনার কোম্পানি স্থিতিশীল আর্থিক অবস্থায় থাকে তাহলে চট করে লাফঝাপ না দেয়াই ভালো। কিন্তু কোম্পানির কারো প্রেমে অন্ধ হয়ে চাকরিকে আকড়ে ধরা উচিত নয়। সম্ভবত এপিজে আবুল কালাম বলেছিলেন-   Love your job but don't love your company, because you may not know when your company stops loving you!


No comments: