Sunday, November 26, 2023

‘দ্য চিটাগং জয়েন্ট স্টক কফি কোম্পানি ১৮৪৩’


বাঙালী চা খেতে শেখার আগে কফি খাওয়া শিখেছিল কিনা সেটা জানা না গেলেও চায়ের আগে যে কফি চাষ করতে শুরু করেছিল সেটা নিশ্চিত হওয়া গেল অবশেষে শুনে অবাক হতে পারেন উনিশ শতকের প্রথমভাগে চট্টগ্রাম শহরের মধ্যেই ছিল একাধিক কফি বাগান। তার মধ্যে একটি বাগানের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে চট্টগ্রাম শহরের প্রাচীন এক মানচিত্র থেকে। সেই বাগানটি ছিল বর্তমান চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এবং ওয়ার সেমেট্রি এলাকা জুড়ে। ১৮৪৩ সালে কফি চাষের জন্য বৃটিশ উদ্যোক্তারা একটা কোম্পানিও গঠন করেছিল। তার নাম ছিল দ্য চিটাগং জয়েন্ট স্টক কফি কোম্পানি

অনেকেই জানেন ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামের কমিশনার মি. স্কন্স বাংলাদেশের প্রথম চা বাগানের সূচনা করেছিলেন চট্টগ্রামে। তিনি আসাম থেকে কিছু চায়ের চারা এনে  চট্টগ্রাম ক্লাবের আশপাশের টিলাগুলোর মধ্যে লাগিয়েছিলেন। তিন বছর পর সে চা বাগান থেকে নমুনা নিয়ে কলকাতায় এগ্রিকালচারাল সোসাইটিতে পাঠানোর পর সরকারের অনুমোদন লাভ করেছিলেন তিনি।  তারপর থেকে চট্টগ্রাম শহর এবং আশপাশের এলাকায় চায়ের বাগান গড়ে উঠতে থাকে।

 

কিন্তু চা বাগানের উদ্যোগ নেবার আগ থেকেই যে চট্টগ্রামে কফি চাষ শুরু হয়েছিল এতদিন সেটা জানা ছিল না। একটি প্রাচীন মানচিত্র থেকে ব্যাপারটার সন্ধান পাওয়া গেলকিছুদিন আগে চট্টগ্রাম শহরের একটি দুর্লভ প্রাচীন মানচিত্র হাতে আসলো সৌখিন ইতিহাস গবেষক শেখ শওকত কামালের মাধ্যমে

 


লন্ডনের বৃটিশ লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করা সেই মানচিত্রটি এঁকেছিলেন বৃটিশ সার্ভেয়ার এডওয়ার্ড রেমন্ড বোইলিউ। ১৮৩৫-৪১ সময়কালে তিনি চট্টগ্রামের ভূমি জরিপের কাজে হেনরি সিডনের সহকারী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। শহরের সদর এলাকা নিয়ে তৈরি সেই মানচিত্রের সীমানা ছিল বর্তমান ফিরিঙ্গীবাজার এলাকা থেকে উত্তরে মুরাদপুর পর্যন্ত, পুবে চাক্তাই খাল থেকে পশ্চিমে টাইগারপাস পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৮১৮ সালে আঁকা জন চিপের মানচিত্রটির কথা বাদ দিলে চট্টগ্রাম শহর নিয়ে এত বিশাল এবং বিস্তারিত মানচিত্র এর আগে কখনো আঁকা হয়নি। জন চিপের মানচিত্রে শহরের আরো বড় এলাকা ধারণ করা হলেও রেমন্ড বোইলিউর মানচিত্রে শহরটি অনেক বেশি বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত। উনিশ শতকে চট্টগ্রাম শহরে কয়টি পুকুর ছিল সেটিও গুনে ফেলা সম্ভব ওই মানচিত্র ধরে।

সেই মানচিত্রের অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে বর্তমান চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় কফি বাগানটা খুঁজে পাওয়া যায়। ১৮৪০ সালের মানচিত্রে সেই এলাকায় একটি  কফি প্ল্যানটেশন দেখানো হয়েছে। ব্যাপারটা কৌতূহল জাগানিয়া। সেই সূত্র ধরে চট্টগ্রামের কফি চাষ বিষয়ে আরো খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করি নানান সূত্র থেকে অনুসন্ধানপর্বে ফোর্ট উইলিয়ামের পুরোনো দলিলপত্রের মধ্যে বেশ কিছু চিঠিপত্র পাওয়া গেল যেখানে কফি চাষের ব্যাপারে চমকপ্রদ কিছু তথ্য দেয়া আছে।  তার একটি হলো ১৮৪৩ সালে কফি চাষের জন্য চট্টগ্রামে গঠিত হওয়া দি চিটাগং জয়েন্ট স্টক কফি কোম্পানির অনুমোদন বিষয়ক একটি প্রস্তাব এটা খুব অপ্রত্যাশিত একটা প্রাপ্তি।

 

মি. স্কন্স চট্টগ্রামে কমিশনার হয়ে আসার পর দেখতে পেয়েছিলেন এখানে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের উদ্যোগে কফির চাষ করছে এবং সেই কফি বেশ ভালো মানের। এদেশের লোক কফি না খেলেও এখান থেকে বিদেশে কফি রপ্তানী হয় তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উৎপাদিত কফি সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন এবং কফির মান সম্পর্কে উৎসাহিত হবার মতো ফলাফল পেয়েছিলেন। সেই কারণে তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে বৃটিশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ এবং রপ্তানীর উদ্দেশ্যে সেই কোম্পানি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন

 

নথিপত্রগুলো দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে  চট্টগ্রাম শহরে চা এবং কফি দুটোরই চাষ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কাছাকাছি সময়েচিঠিপত্রগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে তিনি ১৮৪৩ সালের আগষ্ট মাসে চা বাগানের যে প্রস্তাবটি পাঠিয়েছিলেন, তারও তিন মাস আগে এপ্রিল মাসে তিনি কফি কোম্পানির প্রস্তাবটা পাঠিয়েছিলেন।[সূত্র: জার্নাল অব দ্য এগ্রিকালচারাল অব দ্য হর্টিকালচারাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া]

 

চট্টগ্রামে কফির আদি নিবাস ছিল নাকি ইউরোপীয় বণিকরা এনেছিল সেটা নিয়ে নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। কিন্তু চট্টগ্রামে প্রাকৃতিকভাবে কফি জন্মানোর একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ১৭৮৬ সালে স্যার উইলিয়াম জোনসের লেখা একটা চিঠিতে। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে অবকাশ যাপনের জন্য কয়েক মাসের জন্য চট্টগ্রাম এসেছিলেন। তখন তাঁর বন্ধুকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন- for the sake of my wife's health and my own, to spend a few weeks in this Indian Montpelier, where the hillocks are covered with pepper vines, and sparkle with the blossoms of the coffee tree ; but the description of the place would fill a volume

[ Memoirs of The Life, Writings, and Correspondence of Sir William Jones by Lord Teignmouth(London, 1807)]

 

আমি ও আমার স্ত্রীর স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য আমি এই শহরে অবকাশ যাপন করতে এসেছি। এই শহরের টিলাগুলো গোলমরিচের লতায় ছেয়ে আছে, তার পাশাপাশি কফি ফুলে ঝলমল করছেকিন্তু এই শহরের সবটুকু সৌন্দর্য লিখতে হলো আস্তে একটা বই লিখতে হবে।

যদিও এখানে কফি ও গোলমরিচের বিবরণ থেকে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না সেটা প্রাকৃতিকভাবে চট্টগ্রামে জন্মাতো নাকি  চাষ করা হয়েছিল? কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে চট্টগ্রামে বৃটিশদের আগমনের আগ থেকেই কফি গাছের উপস্থিতি ছিল। হয়তো পর্তুগীজ কিংবা আরব বণিকরা এনেছিল।

 

বৃটিশরা চট্টগ্রামে কফি চাষ শুরু করার আগ থেকে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কফি চাষে জড়িত ছিল, সেই বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় মি. স্কন্সের পাঠানো সেই প্রস্তাবে। ৭ এপ্রিল ১৯৪৩ তারিখে কমিশনার স্কন্সের পাঠানো সেই প্রস্তাবে শেখ ওবায়দুল্লাহ নামের এক ব্যবসায়ীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁর বাগান থেকে কফির নমুনা সংগ্রহ করে কলকাতার এগ্রিকালচারাল সোসাইটিতে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে তিনি ভাল ফলাফল পেয়েছিলেন। শেখ ওবায়দুল্লাহ উনিশ শতকে চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থ  আহাদিসুল খাওয়ানিনের লেখক হামিদুল্লাহ খানের পিতা। 

 

 

১৮৪৩ সালের এপ্রিল মাসে পাঠানো মি. স্কন্সের সেই প্রস্তাবনার একাংশ:

 

আমি চিটাগং জয়েন্ট স্টক কফি কোম্পানি প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে সরকারী অনুমোদনের জন্য আবেদন করছি। আমরা সবাই জানি যে এই স্টেশনে (চট্টগ্রামে) খুব ভালো কফি জন্মায় এবং বেশ ভাল ফলন হয়।  আমরা এটাও জানি যে, এখানকার উৎপাদিত কফির মান বেশ ভালো এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক। কিছুদিন আগে আমি শেখ ওবায়দুল্লাহর বাগানে উৎপাদিত কফির একটি নমুনা এগ্রিকালচারাল সোসাইটিতে পাঠিয়েছিলাম এবং সোসাইটির মাসিক সভায় এটিকে ভাল বিক্রয়যোগ্য কফি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। 

 

আমি যে কারণে এই ব্যবসাটিকে লাভজনক বলে মনে করছি, সেইসব কারণ তথ্য প্রমাণ সহযোগে এই প্রস্তাবের সাথে যুক্ত করছি।

 

ধরা যাক আমরা ৬ একর জমিতে চাষ করবো। ৬ একরে ১ দ্রোন। ১ একরে যদি ৪৩,৫৬০ বর্গফুট হয় তাহলে ১ দ্রোণ বা ৬ একরে হবে ২,৭৬,৪৮০ বর্গফুট। পাশের মার্জিনে আমি হিসেবটা দিয়েছি। বলা হয়ে থাকে প্রতিটি কফি গাছের মধ্যে কমপক্ষে নয় ফুট দূরত্ব থাকা উচিত, ১২ ফুট থাকলে সবচেয়ে ভালো। সে ক্ষেত্রে একটি কফি গাছের জন্য কমপক্ষে ৮১ বর্গফুট থেকে ১৪৪ বর্গফুট জায়গা দরকার। আমি সর্বোচ্চ জায়গা রাখার কথা ভাবছি।

 

অতএব একটি গাছের জন্য ১৪৪ বর্গফুট রাখলে প্রতি দ্রোণ জমিতে ১৯২০টি গাছ নিশ্চিন্তে লাগানো যাবে। তবে ১২ ফুটের বদলে দশফুট রাখা যায়, আগেই বলেছি ৯ ফুট রাখলেও চলে। যদি ১০ ফুট জায়গা রাখি তাহলে ৩৪১৩টি গাছ লাগানো যাবে এক দ্রোণ জমিতে। তবু আমি প্রতি দ্রোণে মাত্র ১৯২০টি গাছ ধরে হিসেবটা করছি নিরাপদ অবস্থানে থাকার জন্য। 

 

তবে কফি আবাদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের একটা সমস্যা আছে। প্রথম কয়েক বছর বাগান থেকে কোন মুনাফা আসবে না। কমপক্ষে চার বছর পার হতে হবে মোটামুটি অংকের লাভ চোখে দেখার জন্য। শুরুতেই এই বিষয়টা মেনে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। আমি আশ্বস্ত করে বলতে পারি প্রাথমিক ধৈর্যটুকু রাখতে পারলে পরবর্তীকালে যে মুনাফা অর্জিত হবে সেটা দিয়ে এই ঘাটতিটা অনায়াসে পুষিয়ে যাবে।

 

মি. পোর্টার জানিয়েছেন যে সব কফি গাছের ফলন এক নয়। কোন কোন গাছ এক পাউন্ডের বেশি ফলন হয় না, আবার অনেক গাছে বছরের পর বছর ধরে চার পাউন্ড উৎপন্ন হয়। এমনকি কোন কোন গাছ আছে যেগুলোর মধ্যে পঞ্চম বছরে সাত পাউন্ড বিক্রিয়যোগ্য কফি হয়। আমি আমার হিসেবটা আধা পাউন্ড এবং এক পাউন্ডের মধ্যে সীমিত রেখেছি।

 

মূল্য হিসেব করার ব্যাপারে আরেকটা বিষয় বিবেচনা করেছি আমি। আমার হিসেবটা বিশ্বসেরা মোকা কফির ওপর ভিত্তি করে ধরা হয়নি যেটার দাম বাজারে অনেক বেশি। আমরা হিসেব করতে পারি কাছাকাছি বাজারে উৎপাদিত কফির দামে, যেমন মহীশূর এবং সিলোন। লন্ডনের বাজারে এই দুই জায়গায় উৎপাদিত কফির দামটা নিন্মরূপ:

 

মহীশূর কফি: ৫৫-৭০(১৮৪১)

সিলোন কফি: ৬৫-৮০(১৮৪১)

 

এই মূল্যকে ভিত্তি করে আমি ৬ দ্রোণ জমিতে প্রতি গাছে ১/২ পাউন্ড কফি উৎপাদন হলে কত আয় হতে পারে তার একটা হিসেব করেছি। সেই হিসেবে চতুর্থ বছরে ৬ দ্রোন জমির ১১,৫২০টি গাছ থেকে ১/২ পাউন্ড হিসেবে ১৪৪০ টাকা আয় হবে। এটা হলো সর্বনিন্ম আয়ের হিসেব। ন্যায্য আয় হিসেব করতে গেলে এই অংকটা ২৮৮০ টাকা হবে।

 

এখন আমি এই পরিমান কফি উৎপাদন করতে গিয়ে কোন খাতে কত খরচ হতে পারে সেই হিসেবটা তুলে ধরবো চার বছরের হিসেবে।

 

১ জন মালী, মাসিক ৬ টাকা বেতন হিসেবে বছরে খরচ :                                ৭২ টাকা

১ জন সহকারী মালী, মাসিক ৪ টাকা বেতন হিসেবে বছরে খরচ:                     ৪৮ টাকা

১৬ জন দক্ষ শ্রমিক মাসিক ২ টাকা করে, ৮ আনা করে ৪০ জন শ্রমিক :            ৪৮০ টাকা

------------------------------------------------------------------------------------------------------

১ বছরে মোট খরচ:                                                                                  ৬০০ টাকা

------------------------------------------------------------------------------------------------------

৪ বছরে মোট মজুরী খরচ:            ২৪০০ টাকা

 

দুই জোড়া ষাঁড়:                           ৬০ টাকা

দুটো গরুর গাড়ি:                         ৪০ টাকা

কোদালী এবং অন্যন্য:                  ৫০ টাকা

মালীর ঘর:                                 ৫০ টাকা

-----------------------------------------------------------------------------------------------

অন্যন্য খরচ:                              ২০০ টাকা

-----------------------------------------------------------------------------------------------

চার বছরে মোট খরচ : ২৬০০ টাকা

 

এটার সাথে আরো কিছু খরচ যোগ হতে পারে। সেটা হিসেব করে অংকটা ৩০০০ টাকা পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে।

 

কফি বাজারজাত করার মতো অবস্থায় পৌঁছাতে চার বছর লাগে। অর্থাৎ চতুর্থ বছরে গিয়ে কফি বাজারজাত করা যাবেকিন্তু এই পর্যায়ে আরো কিছু খরচ যুক্ত হবে। শিপিং, ইনস্যুরেন্স, বিক্রয় খরচ সব মিলিয়ে খরচ হবে ৩৯৫ টাকা। ১৪৪০ টাকা আয় থেকে এই খরচ বাদ দিলে বাকী থাকবে ১০৪৫ টাকা। ৩০০০ টাকা খরচের বিনিময়ে ১০০০ টাকা আয় হলে চতুর্থ বছরে বিনিয়োগের অনুপাতে লোকসান হবে ৩৩%। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই হিসেবটা করা হয়েছে সবচেয়ে খারাপ উৎপাদনের হিসেব ধরে। যদি আমরা মোটামুটি ভালো উৎপাদনের হিসেবটা ধরি, প্রতি গাছে এক পাউন্ড করে কফি উৎপাদন হয় তাহলে হিসেবটা অন্যরকম হবে। সেক্ষেত্রে চতুর্থ বছরে এসে কোম্পানি ২০৯০ টাকা নেট লাভ করতে পারবে।

 

সুতরাং আমাদের ধরে নিতে হবে চতুর্থ বছর পর্যন্ত আমাদের কোন লাভ হবে না। লাভের শুরু হবে পঞ্চম বছর থেকে। পঞ্চম বছরে আমাদের আয়ের হিসাব দিলাম।

 

পঞ্চম বছরে আমাদের আয় হবে     ২৮৮০ টাকা

বিক্রয় খরচ বাদ যাবে                  ৭৯০ টাকা

মজুরী ইত্যাদি খরচে বাদ যাবে      ৬০০ টাকা

অন্য খরচ বাদ যাবে                     ১৯০ টাকা

অতএব, পঞ্চম বছরে আমাদের নেট লাভ হবে ১৩০০ টাকা।

 

এই হিসেবের ভিত্তিতে আমরা যে কোম্পানির প্রস্তাব করছি সেটার প্রাথমিক মূলধন হবে ৬০০০ টাকা। আমরা ৫০ জনের মধ্যে ১২০ টাকা শেয়ারে ভাগ করতে পারি। শুরুতে এর অর্ধেকটা বিনিয়োগ করেই প্রাথমিক কাজ শুরু করা যাবে। 

 

এই প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য হলো কোম্পানিকে চট্টগ্রামে কফি চাষের ব্যাপারে উৎসাহিত করাআশা করছি কোম্পানি এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে কফি চাষে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে।  

 

[সংক্ষেপিত]

 

মি. স্কন্সের পাঠানো এই প্রস্তাব থেকে বোঝা যাচ্ছে কফি চাষ করে লাভ করতে হলে ৪ বছর অপেক্ষা করতে হবে। পঞ্চম বছর থেকে কোম্পানি লাভের মুখ দেখতে শুরু করবে। কফি চাষের ধরণটাই এরকম। গাছ যত বড় হতে থাকে ফলন তত বাড়তে থাকে। সুতরাং ৫ বছরের পর থেকে লাভের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকবে

 

কিন্তু মি. স্কন্সের এই প্রস্তাবে কোম্পানির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বিরোধিতা করার ফলে সেটা তখনকার মতো বাতিল হয়ে পড়ে। সেই কর্মকর্তা কফির চেয়ে চা বাগানে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু মি. স্কন্স তাতে দমে যাননি। তিনি কোম্পানির তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কফি চাষের কাজটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কোম্পানির পক্ষ থেকেও একটা কফি বাগানের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। সেই বাগানটি প্রথম দিকে ভালোভাবে চালু হলেও মি. স্কন্স বদলি হয়ে যাবার পর লোকবলের অভাবে ঝিমিয়ে পড়েছিল।

 

মি. স্কন্সের সেই কফি চাষের পরিণতি সম্পর্কে জানা যায় আরো দুই দশক পর। ১৮৬২ সালে গর্ডন ইয়াং চট্টগ্রামের কমিশনারের দায়িত্ব নেবার পর তিনি চট্টগ্রামে চা ও কফি চাষ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি তখনকার সল্ট এজেন্ট মি. ব্রুসের কাছে বিষয়টা নিয়ে জানতে চান। কারণ মি. ব্রুস দীর্ঘকাল ধরে চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন। কমিশনার স্কন্সের সেই কফি চাষ প্রকল্পের সময় মি. ব্রুসও যুক্ত ছিলেন। মি. ব্রুস বিয়ে করেছিলেন চট্টগ্রামের এক বৃটিশ ব্যবসায়ীর কন্যাকে।  তাঁর শ্বশুরও চট্টগ্রামে কোকো বাগান করে চকোলেট উৎপাদন করেছিলেন প্রথমবারের মতো। মি. ব্রুসের চিঠিতে জানা যায় চট্টগ্রামে কফি চাষ আরো ত্রিশ বছর আগে শুরু হয়েছিল। বৃটিশদের মধ্যে জনৈক মি. চ্যাপম্যান প্রথম কফি বাগান করেছিলেন চট্টগ্রামে। মি. ব্রুস চট্টগ্রামে চা-কফি চাষের ইতিবৃত্ত নিয়ে ১৮৬২ সালে গর্ডন ইয়াং এর কাছে একটা জবাব লিখেছিলেন সেই চিঠির সারসংক্ষেপ:

 

স্যার, আপনার অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে আমি চট্টগ্রামে চা ও কফি চাষ বিষয়ক যে সকল তথ্য আমার কাছে আছে সেগুলো সংক্ষেপে জানাচ্ছি।

 

আমি এই শহরে ১৮৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির বাগান এবং অন্যন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগানগুলিতে যেসব কফি গাছ দেখেছি তার ভিত্তিতে পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যদি উপযুক্ত মাটিতে কফি চাষ করা হয় তাহলে এখানে খুব ভালো ফলন পাওয়া যাবে।

 

ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগানগুলোতে কফি খুব ভালো ফলন হচ্ছে। কোম্পানির বাগানগুলোতে কফি উৎপাদিত হচ্ছে, কিন্তু ফলন তেমন বেশি না। গাছের আকার হিসেবে উৎপাদন ঠিক আছে, কিন্তু যেখানে গাছগুলো রোপন করা হয়েছে সেখানকার মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি, ফলে অনেক বেশি পানি লাগে। উর্বরাশক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রচুর গাছ লাগাতে হয়েছে, এসব খাতে বেশি খরচ হয়। এই গাছগুলোর ছায়াতে কফি গাছ বেড়ে উঠতে পারে এবং ভালো ফলন হয়। কোম্পানির লোকজনের মধ্যে  মি. স্কন্স এবং আমিই বাগান নিয়ে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু তিনি সবসময় দেখাশোনা করতে পারতেন না এবং আমি সাড়ে চার মাস শহরের বাইরে ছিলাম লবন উৎপাদনের কাজে। তবে আমার কোন সন্দেহ নেই যে নীচু ভূমিতে চাষ করা হলে কফি ব্যবসা থেকে বেশ ভালো আয় করা সম্ভব।

 

কোম্পানির বাগানটা দেখাশোনা করার জন্য আমি এবং মি. ফ্রেইটাস বাদে আর কেউ ছিল না। কিন্তু যেহেতু আমরা দুজনেই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, বাগানটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া ছোট্ট এই বাগানের ভাড়া গুনতে হতো ১৪ রুপী করে। তার উপর জমি চাষ করা, পানি দেয়া, সার দেয়া, আগাছা সাফ করা, বেড়া দেয়া ইত্যাদি ছিল ব্যয়বহুল।

 

মি. হগ নামের একজন রাঙ্গুনিয়াতে নদী তীরের একটা জায়গার মধ্যে বড় মাপে কফি চাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি এক বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করলে প্রকল্পটা টিকতে পারেনি। 

 

৩০ বছর আগে ১৮৩২ সালের আগে ডাক্তার চ্যাম্পম্যান কফি গাছ লাগিয়েছিলেন সিপাহী লাইনের পেছনে। আমি এখানে আসার পর কথাটা শুনে নিজের হাতে জঙ্গল থেকে সেই কফি গাছের ফল তুলেছিলাম পনের বছর আগে। আমি যখন ফলগুলো তুলেছিলাম তখন সেগুলো যথেষ্ট পরিপক্ক হয়নি। আমি পরে সেদিকে যাইনি, কিন্তু এখনো চাইলে জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারবো।

 

আরেকটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখান থেকে এক মন কফি লন্ডনে পাঠানোর পর সেগুলো বেশ সমাদর পেয়েছিল। যদিও সেগুলা ভালভাবে প্যাক করা হয়নি। যেনতেনভাবে পাঠানো হয়েছিল।

 

মি. স্কন্স যে বাগানটি করেছিলেন সেটা সম্পূর্ণ নিজের খরচে করেছিলেন। সেখানে তিনি চা গাছও লাগিয়েছিলেন। মি. স্কন্সের সেই বাগানটি বর্তমানে এলসের বাগান নামে পরিচিত। সেটার মালিক মিসেস ফুলার।

[Parliamentary Papers-Public Works,Plantations, Waste Lands-East India Vol-15]

 

১৮৬২ সালে কমিশনার মি. গর্ডন ইয়াং চট্টগ্রামে চা ও কফি চাষের বিষয়ে এসব তথ্য সংগ্রহ করে কলকাতায় বেঙ্গল গভর্নমেন্টের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বেঙ্গল গভর্নমেন্ট মি. গর্ডন ইয়াং এবং মি. ব্রুসের চিঠি দুটো চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। ততদিনে সিলেটেও পরীক্ষামূলক চায়ের চাষ সফল হয়েছিলচট্টগ্রাম ও সিলেটে চা বাগানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। চট্টগ্রামে প্রথমদিকে ছোট আকারে চা বাগান করার সময় তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু বড় আকারে করতে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে চা ব্যবসায়ীদের সংঘাত শুরু হয়। খুনোখুনি থেকে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছিল। কারণ চা বাগানের জন্য জমি অধিগ্রহন স্থানীয়রা মেনে নেয়নি। কফি চাষ নিয়েও প্রায় একই সমস্যা হয়েছিল। কফি চাষের জন্য যেরকম উর্বর জমি দরকার ছিল সেই জমিগুলোতো ধান চাষ হতো। সেই জমি কফি চাষের জন্য দিতে রাজী ছিল না স্থানীয় লোকেরা। সেটা নিয়ে ঝামেলায় যেতে রাজী ছিল না কোম্পানি। তাছাড়া কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে দেখাশোনার মতো যথেষ্ট লোকবল ছিল না। এইসব কারণে আস্তে আস্তে কফি চাষ কমতে থাকে। একসময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। শুধু বন্ধ হয়ে যায় না, চট্টগ্রামে কফি চাষের ব্যাপারটা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় লন্ডনের বৃটিশ লাইব্রেরির পুরোনো মানচিত্র আর নথিপত্র ছাড়া আর কোথাও দ্য চিটাগং জয়েন্ট স্টক কফি কোম্পানির চিহ্নমাত্র নেই।

.............................................................. 


 দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড লিংক:

https://www.tbsnews.net/bangla/%E0%A6%87%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B2/news-details-182214

No comments: