Sunday, September 30, 2012

প্রায় দমবন্ধ কয়েকটা দিন

কথা বলা দূরে থাক, পানি খেতে, এমনকি ঢোক গিলতেও সাহস পাইনি কদিন। প্রায় দশ পনের দিন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। মানুষের গলায় যে এরকম কোন গজব নামতে পারে আগে জানতাম না। কথাবার্তা সব ইশারায় চলেছে। মোবাইল ফোন তো হারামই হয়ে গিয়েছিল। পরিবারের সব মানুষ আর সহযোগী অর্ধাঙ্গিনী না থাকলে কি ভয়ংকর অবস্থা হতো ভাবা যায় না। নাক-গান-গলা বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ করে ঘোষণা দিলেন- গলার ভেতর ব্যাকটেরিয়ার কাফেলা আস্তানা গেড়েছে বেশ ভালোভাবেই। ওরা দালানকোটা তুলে মোটামুটি একটা মহানগরী তৈরী করে ফেলেছে ওখানে। ফলে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে গেলেও মরনাঘাত লাগে।
গরম পানি, গরম তরল বাদে আর যে কোন খাবার বন্ধ হয়ে গেল। রাতে ঘুম আসে না, গলাবন্ধ হয়ে নিঃশ্বাস আটকে যায় প্রায়। সমস্ত শরীর জুড়ে অস্বস্তি। মাথা কাজ করে না। গলা জিহবা থেকে কর্নকূহর পর্যন্ত ব্যথায় টনটন। বিছানায় একবার শুই আবার উঠে বসি। শুলে মনে হয় দম আটকে যাবে, বসলে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। ওষুধের কোর্স এগিয়ে যাচ্ছিল, দুবেলা দুটো করে দুই এন্টিবায়োটিক (Merocef 250)+ (Zox 500), দুবেলা দুটো পেইনকিলার (Coxia 120mg), তিন বেলা ভায়োডিন মাউথওয়াশ, আর একটা ঘুমের ওষুধ। কিন্তু ফলাফল শূণ্য থাকে তিনদিন পর্যন্ত। বাড়ছিল হতাশা। বুঝতে পারছিলাম মানুষ কোন সময় আত্মহত্যার কথা ভাবে। শিশু সন্তান দুটোর কথা ভাবি। একজন ছয় আরেকজন তিন। ওদের বাকী জীবন কিভাবে কাটাবে আমিহীন।
নাহ। বাজে চিন্তা বাদ। সুস্থ হয়ে উঠতেই হবে। চারদিনের পর থেকে গলার একটু উন্নতি দেখা যায়। আগে ভোর ছটায় জেগে প্রথম বাক্যটি বের করার জন্য তিন ঘন্টা কসরত করতে হতো। এখন এক ঘন্টায় পারছি। আস্তে আস্তে বেঁচে উঠতে থাকি। তবে রাত হলেই আবার আতংক। ঘুম না আসলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু মৃত্যুদূতের নর্তন কুর্দন সহ্য হচ্ছিল না। একদিন দেখালাম আমাকে একটা গরম পানির ডেকচিতে চুবিয়ে রেখে সেই ডেকচির চারপাশ ঘিরে আট দশজন মৃত্যুদূত কুড়াল হাতে নাচতে শুরু করেছে। চমকে উঠে বসি। মৃত্যুদূতেরা একটু আড়ালে চলে যায়। আমি জানি চোখ বন্ধ করলেই ওরা ফিরে আসবে, তাই ভয়ে চোখ বন্ধ করি না।
এভাবে সাত দিন পার হবার পর আমি উঠে বসি। দশদিনের দিন বারান্দায় গিয়ে বিকেলের রোদ, রাস্তায় চলাচলরত গাড়ি, আর দক্ষিণাকাশে ঝুলে থাকা শাদা মেঘের পুঞ্জগুলি দেখতে থাকি। সেই দিনের আলোতেও একদিন দেখি একফাল অর্ধচন্দ্র এক রঙা ঘুড়ির মতো ভেসে আছে। এখনো আশা আছে বৈকি। জীবনের রূপরস নতুন করে গ্রহন করার জন্য আবারো তৈরী হই।
ওশিন এসে গলা জড়িয়ে ধরে চুপ করে থাকে। পেছন থেকে সোয়া তিনের শিহান এসে হাতের আঙুল ধরে টেনে টেনে বলতে থাকে - 'বাবা তিবি দ্যাকবো, তিবি দাও'!
ওর আবদারে অনেকদিন পর আমার মুখে হাসি ফোটে। আমি ফ্যাসফ্যাস গলায় কোনমতে উচ্চারণ করি - 'আমিও দ্যাকবো!'
এই দুটোর জন্য দীর্ঘসময় বেঁচে থাকার লোভ হয়।
[অসুস্থ সময়ে সবচেয়ে বেশী মনে পড়েছে ব্লগার অনার্য সঙ্গীতের কথা। তার প্রিয় ব্যাকটেরিয়া বাহিনীর কবলে আমি কেমন আছি জানাতে ইচ্ছে করছিল খুব। পোষ্টটা সে উদ্দেশ্যেই লেখা]

Thursday, September 27, 2012

তোমাকে সেদিনের শাড়িতে


রবিবার ২৩ মার্চ
-তুমি সেদিন একটা সাদা জামদানী পরেছিলে
-সাদা নয়, ঘিয়ে
-ঈদের শাড়িতে তোমাকে অপরূপা লাগছিল
-তুমি তাকাওনি বেশীক্ষণ
-আমি তোমাকে একান্তে চেয়েছিলাম
-বলোনিতো!
-একদিন বলেছিলাম
-কবে?
-আরো একদিন  তুমি শাড়ি পরেছিলে রাস্তায় দেখা আমার সাথে
-তুমি আমাকে দেখতে এসেছিলে?
-আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম, শাড়িতে তুমি অপরূপা ছিলে
-আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল শাড়িতে
-তুমি জানতে না কতটা আলো ছড়িয়েছিলে তুমি সেই বিকেলে, আমি তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম আরো কিছুক্ষণ
-বলেছিলে, তবু আমি শাড়ি বদলাতে চলে গিয়েছিলাম
-সেই অপূর্ব শাড়ির রূপ আমি আর কখনো দেখিনি
-তুমি এত বছরে কখনোই কিছু বলোনি পরে
-সেদিনই বলেছিলাম, আরো একটু থাকতে যদি শাড়িটা পরে
-সেদিন আমি সসংকোচে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম
-তোমাকে সেই শাড়িতে আরেকটু দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ আমার সারাজীবনও যাবে না।
-এত কিছু মনে থাকে কেন এত বছরেও!
-কিছু কথা খোদাই করা থাকে স্মৃতির দেয়ালে।

মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ
-কাশবরন শাড়িতে যখন তোমাকে পৃথিবীশ্রেষ্ঠা দেখাচ্ছিল, তুমি আমাকে সেই দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত করলে
-আমি তখন পথের মাঝে, কোথায় দাঁড়াবো?
-তুমি আমার পাশে, আমার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারতে না?


বৃহস্পতিবার ২৭শে মার্চ
-সেদিনের শাড়িতে তোমাকে অপরূপা লেগেছিল
-আমি আয়না দেখিনি সেদিন
-তুমি কার জন্য সেজেছিলে আমি জানি না
-আমি আমার জন্য সেজেছিলাম, তোমার সামনে পড়ে গিয়েছিলাম হঠাৎ
-আমি তোমার মতো শাড়িতে এত সুন্দর আর কোন রমনী দেখিনি
-তোমাকে পাইনি বলে আমি শাড়ি পরাই ছেড়ে দিয়েছি!
-কী চমৎকার লাগে এরকম মিথ্যেগুলো শুনতে!!

শুক্রবার ২৮শে মার্চ
-সেদিনের শাড়িতে তোমাকে দেখার তীব্র তৃষ্ণা জেগে উঠেছিল,আরো কিছুক্ষণ শাড়িতে তুমি থাকতে পারতে। বাঁক ঘুরতেই তোমার মুখোমুখি, নিরালা গলির শেষ প্রান্তে তোমাদের বাড়ি, তুমি নিমন্ত্রণ সেরে বাড়ি ফিরছিলে আর আমি তোমাকে দেখার জন্য যাচ্ছিলাম। আমি নিশ্চিত তুমি জানতে না আমি কেবল তোমাকে দেখার জন্যই ওই বাড়ির সিড়িতে পা রাখতাম। শাড়িতে তোমাকে অপরূপা দেখাচ্ছিল। আমি তোমাকে অমন শাড়িতে আগে কখনো দেখিনি। তুমি রূপ লুকোচুরি করতে, কখনোই সাজতে না আমার জন্য। তোমার সুন্দর দেখার জন্য এতটা তৃষ্ণার্ত ছিলাম আমি, তুমি খেয়ালই করতে না। সেদিনের শাড়িতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যখন আমি তোমাকে দেখছিলাম তুমি লজ্জায় মরে গেলে। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে শাড়িটা বদলে সাধারণ হয়ে এলে। আমি তখন শাড়িতে তোমাকে দেখার তৃষ্ণায় তখন মরে যাচ্ছি। মুখ ফুটে বলা হয়নি কিছু। তুমি জানলে না তেইশের যুবক উনিশের তরুণীর জন্য কতখানি প্রেম জমা করে রেখেছিল গোপন খাঁচায়।
-প্রতিদিন প্রতিদিন একই কথা। শুনতে তবু কি যে ভালো লাগছে! বলো, আবার কি শাড়ি পরে দাঁড়াবো এসে?
-এখন সেই শাড়ি নেই, সেই সময় নেই, সেই তুমি নেই, সেই আমি নেই, কি হবে এখন এসে দাঁড়িয়ে?
-তবু তোমার বুকের ভেতরে দুই যুগ ভাঁজ করে রাখা শাড়িটা দিয়ে আমাকে একবার জড়িয়ে নেবে না?

Wednesday, September 26, 2012

আন্তর্জালিক আচ্ছন্নতা

শাহানা পাশ ফিরে শুয়ে আছে।

বিরক্ত লাগছে তার। রাকিবকে নাকি নিজেকে নাকি.........। বুঝতে পারছে না। রাকিব আজ রাতে আর কথা বলবে না। কাল সকালে উঠে নাস্তা না করে অফিসে চলে যাবে। শৈলিকে স্কুলে দিয়ে এসে শাহানার সারাটা দিন বিষবিষ লাগবে। এই বিষ তার নিজেরই সৃষ্টি। রাকিবকে ওভাবে প্রত্যাখ্যান না করলেও চলতো। কখনো করেনি। বিয়ের পর এই প্রথম। দশ বছরের মাত্র একবার প্রত্যাখ্যান করেছে তাতেই রাকিব ওরকম রিএক্ট করলো! অথচ রাকিব ওকে কতো বার, অগুনতি সময় প্রত্যাখ্যান করেছে। যখন রাকিবের ইচ্ছে করে তখনই হয়। শাহানার কিছু বলার নাই। এটা মেনেই শাহানা এতগুলো বছর কাটিয়েছে ওর সাথে। আশ্চর্য! নারী বলে তার কোন মত নেই? নিষিদ্ধ চার পাচদিন বাদে বাকী দিনগুলোতে সে স্বামীর ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য? এমনকি জ্বর শরীরেও শাহানা সয়ে গেছে। স্বামীর চাহিদা মেটানো অতি আবশ্যক- এই শর্ত বিয়ের কোন কাগজে লেখা ছিল! এসব কি কাউকে বলা যায়?

রাকিবের নাক ডাকার শব্দ আসছে না এখনো। তার মানে সে ঘুমায়নি এখনো। রেগে ফুলে আছে। যখন রেগে ফুলে থাকে তখন সে মটকা মেরে পড়ে থাকে, ঘুমায় না। ঘুমালে নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যায়। সেই শব্দ পাওয়ার পরই শাহানার ঘুম আসে। আজ রাতে শাহানারও ঘুম আসবে না। দুজনেই হয়তো সারারাত নিঃশব্দে জেগে থাকবে। খুব অস্বস্তি হচ্ছে শাহানার। রাকিবের জন্য এটা খুব বড় একটা শক। এই প্রথম রাকিব গায়ে হাত দেয়ামাত্র ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিয়ে চুড়ান্ত বিরক্তি প্রকাশ করেছে শাহানা। শব্দ দুটোর জন্যও এখন শাহানা মনে মনে লজ্জিত।

কিন্তু কি করবে। সে একটা নিষিদ্ধ কাজ করে ফেলেছে আজ। শহীদ ভাইয়ের সাথে একমাস আগে নতুন করে পরিচয় হবার সময়ও কল্পনা করেনি এমন কিছু।
শাহানার বাবা রেলওয়েতে চাকরী করার সময় ওদের পাশের টিলায় শহীদ ভাইদের বাংলো ছিল। শহীদ ভাইয়ের বাবাও রেলওয়েতে চাকরী করতেন। ছেলেবেলায় শাহানা আর শহীদ পাশাপাশি বড় হলেও কেউ কারো সাথে তেমন কথাবার্তা বলতো না। শহীদ ছিল একটু মুখচোরা।  শাহানা ইন্টার পাশ করার পরপর শহীদের বাবা বদলী হয়ে ঢাকা চলে যায়। শাহানার কিছু মনেই নাই ওদের কথা। কিন্তু সেদিন ফেসবুকে একটা ফ্রেণ্ড রিকুয়েষ্ট এলো। শরীফুল ইসলাম। নামটা অচেনা। তবে তিনজন মিচুয়াল ফ্রেণ্ড দেখা যাচ্ছে। ওই তিনজন আবার ওর ঘনিষ্ট বন্ধুদের অন্যতম। তাই দ্বিধা না করে শাহানা গ্রহন করে নিল বন্ধু তালিকায়। ওমা, সাথে সাথে মেসেজ চলে আসলো এর কাছে। দীর্ঘ একটা মেসেজ। শাহানা অবাক। সে এরকম কারো কাছ থেকে মেসেজ আশা করেনি। চেনা কেউ না এমনকি আধচেনাও না। কিন্তু চিঠির শেষে নামটা দেখে চমকে উঠলো। শহীদ। তার মানে শহীদ ভাই! যার সাথে কোনদিন কথাও বলেনি। সে এত বড় একটা চিঠি লিখে বসেছে? তার বুকটা কেমন একটু কেঁপে উঠলো। আনন্দ নাকি ভয় বুঝতে পারলো না। ১৫ বছর আগের কথা!

রাকিব আছে বাসায়। সে দেখলে কি মনে করবে? শাহানার কোন প্রাইভেসী নেই রাকিবের কাছে। রাকিবই ওর প্রায় সব মেসেজের উত্তর লিখে দিত। কারণ শাহানা কম্পিউটারে কাঁচা। আজকাল কিছু কিছু  শিখে উঠেছে। তবু সে রাকিবকেই ডাক দেয় কিছু লিখতে পড়তে। ফলে ওর সব বন্ধবান্ধবের খোঁজ জানে রাকিব। কখনো কোন সংকোচ লাগেনি ওর কাছে। রাকিবই ওর জীবনের সব, ওর কাছে গোপন রাখার মতো কিছু থাকতে পারে কোনদিন ভাবেনি। কিন্তু আজকের এই মেসেজটা তাকে উলটপালট করে দিল। এটা রাকিবকে দেখানোই যাবে না। রাকিব এসে দেখে ফেলবে ভয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল ঝট করে।

রাতে ঘুম হলো না সেদিন। সারারাত চিঠির অক্ষরগুলো চোখের সামনে ভেসেছে। এটা কি লিখলো শহীদভাই এতদিন পর। তিনি নিজে বিবাহিত, একটা ছেলে আছে পাচ বছরের। শাহানাও বিবাহিতা, তারও আট বছরের মেয়ে আছে একটা। দুজনেই সুখী সংসার করছিল। এত বছর পর হঠাৎ এটা কি শোনালো শহীদ ভাই। যে মানুষ কোনদিন চোখ তুলেও তাকায়নি সে মানুষ তাকে এতকাল ধরে পাগলের মতো ভালোবাসছে, এমনকি বিয়ের পরও তার কথা একদণ্ড ভোলেনি! শাহানার বিয়ের খবর পেয়ে উনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। এসব কিছুই জানে না শাহানা! সে এমন কোন আহামরি সুন্দরী না। কেউ তাকে কখনো প্রেমের ঈঙ্গিতও দেয়নি জীবনে। যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার সাথেই সবকিছু। রাকিব ছাড়া কার কাউকে ভাবতে পারতো না সে। কিন্তু সেদিন শহীদ ভাইয়ের চিঠি পেয়ে তার বুকের ভেতর ভাংচুর শুরু হয়েছিল।

পরদিন রাকিব অফিসে গেলে শাহানা নেট খুলে ফেসবুকে ঢুকলো। ভেবেছিল সে যৌক্তিক একটা চিঠি লিখবে। কিন্তু লেখা শেষ করে সে নিজেই চমকে গেল। এসব কি লিখেছে সে। শহীদ ভাইয়ের চেয়ে তার অবস্থাও খুব বেশী ভালো না। সে কখন শহীদভাইয়ের প্রেমে পড়ে গেছে। এই চিঠি পেয়ে নাকি ১৫ বছর আগে? শাহানা জানে না। সে কেবল জানে এই লোকটা তাকে টানছে খুব। সেদিন থেকে নেশা হয়ে গেছে তার। প্রতিদিন শহীদ ভাইয়ের সাথে চিঠি চালাচালি। দুরুদুরু বুকে। চিঠি থেকে চ্যাট শুরু। ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাট। ঘরের কাজ মাথায় উঠলো। রাকিব ঘরে ফিরলে আগের মতো ছুটে যায় না দরোজা খুলতে। কাজের মেয়েটা দরোজা খুলে দেয়। রাকিব এসে দেখে শাহানা বিছানায় শুয়ে আছে বাতি নিবিয়ে। শরীর খারাপ? কপালে হাত রাখে রাকিব। সে বলে মাথাটা ধরেছে। রাকিব বলে দাড়াও আমি টিপে দিচ্ছি বাম লাগিয়ে। সে তাড়াতাড়ি উঠে বসে। আগে এই জিনিস প্রিয় ছিল তার। রাকিব ওর কপাল টিপে দিলে সে আরামে ঘুমিয়ে পড়তো। কিন্তু আজকাল তার সামান্য স্পর্শও বিরক্ত লাগে।

আজ দুপুরে শহীদভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে কেমন আচ্ছন্নতা চলে আসলো। শহীদভাই হঠাৎ ওকে বলে বসলো, তোমাকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে শানু। এই কথা শুনে ওর সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুত বয়ে গেল। এত বছরের বিবাহিত শরীরটা যেন নিমেষে কুমারীত্বে চলে গেল, সে যেন হয়ে উঠলো নবীন অনভিজ্ঞ ষোড়শী তরুণী। চুপ করে থাকলো। শহীদভাই মৌনতাকে সম্মতি ধরে চ্যাটের মধ্যেই ভার্চুয়াল চুমু খেল তাকে। সে তখনো চুপ। তার সমস্ত শরীরের রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে যেন। শহীদভাই তাকে জড়িয়ে ধরে আদর খেতে শুরু করলো। এমন করে আদর করছে যেন সে তার পাশে বসে আছে। একই ঘরে। সে নিজেকে সম্পূর্ন সমর্পন করে দিল শহীদভাইয়ের কাছে। সমস্ত শরীর জুড়ে অবিরাম রিনিঝিনি সুখ। শহীদ ভাই একটু থামতে সে বলে উঠলো, থামবেননা প্লীজ! এরপর যা ঘটলো তা ভাষায় প্রকাশের যোগ্য নয়। আনন্দের তুঙ্গে উঠে গেল দুজনে চরম উত্তেজনায়। শাহানা এক পর্যায়ে বলে দিল আজ থেকে তার শরীরটা শহীদের। আর কেউ এটা স্পর্শ করতে পারবে না। এরকম একটা পাগলামি সিদ্ধান্ত শুনে শহীদও চমকে গেল। কিন্তু শাহানা অনড়। সে সমাজ সংসার সব কিছু অস্বীকার করে শহীদকে পেতে চাইল। বাস্তবে সম্ভব না, তাই ভার্চুয়ালী সে আজ থেকে শহীদের বউ হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল।

দুপুরের সেই আদর সেশানের পর শাহানা অন্য মানুষ হয়ে গেল। সংসারের সবকিছু তার অসহ্য লাগলো। এমনকি শৈলী কি খেল না খেল সেটাও জিজ্ঞেস করলো না। রাতে রাকিব অফিস থেকে ফিরলে সে বাতি নিভিয়ে শুয়ে থাকলো। রাতে কিছু খেতে পারলো না।

রাকিবের সাথে বিয়ে হবার পর কখনো একমাস বিরতি দেয়নি ওরা। প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত হতো ওদের। একদম নিয়ম করে। মাঝে মাঝে বেশীও। কিন্তু শহীদের সাথে পরিচয় হবার পর একবারো সে রাকিবের সাথে করেনি। রাকিব খুব বেশী আগ্রাসী না। শাহানা না এগোলে সে এগোয় না। সবসময় শাহানাকেই শুরু করতে হয়। এই একমাস শাহানা একবারও আগায়নি। তবু রাকিব মাঝে মাঝে গায়ে হাত দিয়েছে। স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে আদর দিয়েছে, কিন্তু শাহানা সাড়া দেয়নি বলে কিছু হয়নি। রাকিব হতাশ হয়ে ঘুমিয়ে গেছে প্রতিবারই। কেবল আজ রাতে রাকিব কেমন আগ্রাসী হয়ে তার উপর চড়াও হয়েছিল। জোর করে আদর করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে শাহানার প্রিয় একটা জায়গায় আদর দিলে সে জেগে ওঠে, সেখানে সে স্পর্শ করতেই শাহানা কটুবাক্যে তাকে ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল। রাকিব আর জোর করেনি, আলগোছে বিছানার ওপাশে সরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।

শাহানার মনে একটা পাপবোধ জাগছে। কিন্তু লোভও ছাড়ছে না। ভালোবাসার লোভ। এমন করে ভালোবাসার কথা শোনেনি সে। রাকিব ছাড়া আর কোন পুরুষের কথা সে জানতো না। পুরুষেরা যে নাটক সিনেমার চেয়েও বাস্তবে অনেক বেশী ভালোবাসার কথা বলতে পারে এটা তার ধারণা ছিল না। সে একটা নতুন জীবন পেয়েছে গত একমাসে। শহীদভাই তার নতুন একটা জগত হয়ে দাড়িয়েছে। যে জগতে আর কেউ নেই। সে আর শহীদ। তারা নিজ নিজ সংসারে থেকেও এই নতুন জগতে স্বামীস্ত্রী হিসেবে থাকবে। শহীদভাই তাকে আজীবন আগলে রাখবে বলে কথা দিয়েছে। কোন সংসারের ক্ষতি না করে দুজন দুজনকে আজীবন ভালোবাসবে।

সকালে নাস্তা না করে অফিসে চলে গেল রাকিব। দুজনের মধ্যে কোন কথা হলো না। শাহানা ঠিক করলো ওর সাথে জীবনেও কথা বলবে না। যদি সে নিজ থেকে এসে কথা না বলে। অকেজো পুরুষ। তার সমস্ত জীবনটাকে একঘেয়ে করে দিয়েছিল। গত এক দশক কি ভয়াবহ বঞ্চনা নিয়ে সময় কাটিয়েছে! যদি শহীদভাইয়ের সাথে বিয়ে হতো তার! ভেবে শিহরিত হয়ে উঠলো আবার। আজ আসবে শহীদভাই? আজকে কিরকম আদর করবে? আজকে ওয়েবক্যাম খুলবে ওরা। কালকে সেভাবেই কথা হয়েছিল। গতকালই খুলতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রথমদিন বলে কেমন লজ্জা গ্রাস করেছিল। আজকে কাজের মেয়েটাকে ছুটি দিয়ে দিল। শৈলী স্কুলে। ফিরতে চারটা। তার আগ পর্যন্ত ওরা দুজন একা। একান্ত সময়। অসহ্য সুখের প্রতীক্ষায় শাহানা। একটা বাজতেই নেট খুলে বসলো। শহীদ এখনো আসেনি। কি করছে এতক্ষণ। আসছে না কেন? অস্থির হয়ে উঠলো সে। অবশেষে অনলাইন দেখালো শহীদকে-

-কী ব্যাপার এত দেরী কেন?
-দেরী কই, মাত্র দশমিনিট
-প্রতীক্ষার দশমিনিটও অনেক দীর্ঘ, জানো না?
-জানি সোনা! আর কখনো হবে না এমন
-এখন ক্যাম খোলো তোমার চাঁদমুখটা দেখি
-আগে তুমি খোলো
-না তুমি
-তুমি
-তুমি
-একটা দুঃসংবাদ আছে।
-কি
-তোমার ভাবী চলে এসেছে ছুটি সংক্ষিপ্ত করে গতরাতে।
-আশ্চর্য। তার না আরো তিনদিন থাকার কথা ছিল?
-তাই তো ছিল। কিন্তু গতকাল নাকি তার খুব খারাপ লাগছিল আমার জন্য। তাই চলে এলো
-এখন কোথায়। এখন গেছে ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে,
-সর্বনাশ!
-আসতে আরো ঘন্টাখানেক আছে, ততক্ষণ আমরা কথা বলি
-শুধু কথা?
-আজ আর কিছু হবে না
-সব শেষ একদিনেই?
-তা কেন, কিন্তু বোঝোই তো, প্রতিদিন সমান যায় না
-কেন কালকে বউ এসে সব প্রেম পুষিয়ে দিল নাকি?
-আরে না, বউয়ের অত প্রেম কই। তোমার কাছেই সব
-রাতে বউয়ের সাথে প্রেম হয় নাই? এতদিন পর পেলেন
-না, এই আর কি
-এই আর কি, খুলে বলেন
-তেমন কিছু না, ও নিয়মিত রুটিন কাজের মতো
-মানে, হয়েছে
-একবার
-বুঝেছি।
-কি বুঝেছ
-পুরুষের প্রেম
-কেন পুরুষ প্রেম করতে জানে না?
-জানবে না কেন। তার প্রেমের ধরনধারন সব আলাদা। দিনে একজন, রাতে অন্যজন। প্রেমের ছড়াছড়ি পুরুষজীবনে।
-ছি তুমি এসব কি বলছো, তোমার সাথে কি ওর তুলনা হয়?
-আমার সাথে তুলনা নাই। আমি কে? একবেলার আনন্দসামগ্রী। হিহিহিহি.......
-তুমি ভুল বোঝো না। আমি সত্যি করতে চাইনি। ও এমন জোর করলো, আমি না করতে পারিনি।
-জোর তো করবেই। এখন তো নারীদের প্রাধান্য ওরা যা চায় তা দিতেই হয়।
-তুমি বোঝার চেষ্টা করো শানু.....
-চুপপপ। আর কখনো ওই নামে ডাকবেন না আমাকে। আজ থেকে সব খেলা শেষ
-মানে?
-মানে খুব সহজ। আপনি আপনার পথে থাকুন, আমি আমার পথে
-কি বলছো এসব। এতদিনের সম্পর্ক, গত একমাসের এত ভালোবাসা, এতসব একদিনে শেষ?
-জী, জনাব। জীবনের প্রথম এবং শেষ ভুল আমার। এবার আপনি বিদেয় হোন, আমিও বিদায় হই
-শোনো, এভাবে যেও না প্লীজ। তোমার পায়ে পড়ি। তুমি জানো না আমি তোমাকে কিরকম......
-আর শুনতে চাই না মিষ্টার। কালকে যথেষ্ট খেসারত দিয়েছি। ভাগ্যিস আজ আর দিতে হয়নি।
-আমি তোমার সাথে দেখা করে সব বলবো
-ব্যাস, বলেছেন ওতেই যথেষ্ট। আর কিছুর দরকার নাই। কাল থেকে আমাদের আর কোনদিন যোগাযোগ হচ্ছে না। দয়া করে আরো কোন মেসেজ দেবার চেষ্টা করবেন না। আপনাকে আমি ব্লক করে দিতে বাধ্য থাকবো তাহলে।


শহীদের সাথে সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে চলে গিয়েছিল। আজ আবার তুমি থেকে আবারো আপনিতে নামিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিল চিরতরে। ল্যাপিটা বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলো শাহানা। মানুষকে কতো সহজে বিশ্বাস করে শাহানা! রাকিব ওকে বারবার সতর্ক করতো এতটা সরল না হতে। কি বোকা ছিল সে। রাকিবকে অগ্রাহ্য করে ভালোবাসার নামে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিল আধচেনা একজনকে । ভালোবাসায় এতটা প্রতারণা লুকিয়ে থাকতে পারে সে কখনো ভাবেনি। পৃথিবীটা তার চোখের সামনে দুলতে থাকলো। গত একমাসের স্মৃতিগুলো এখন কিরকম বিষাক্ত লাগছে ভাবা যায় না। নিজেকে তার খুব নোংরা লাগছে এখন। কি শাস্তি দেবে সে নিজেকে এখন? রাকিব যদি এখন অফিস থেকে চলে আসতো! আসতে পারে না মাঝে মাঝে চমকে দিতে? বিয়ের প্রথম দিনগুলোর মতো। রাকিব ওকে প্রেমের কথা বলে না কখনো, কিন্তু এখন সে জানে যেসব কথা মুখে বলা হয় না সেখানেই লুকিয়ে থাকে অনেক বেশী সত্য! অনেক বেশী সুন্দর সেসব কথা। অকথিত সেসব কথা দিয়ে শাহানা ভেতরে জ্বলতে থাকা আগুনটাকে চাপা দিয়ে রাখতে চায়।

Monday, September 24, 2012

ভাববাচ্যে নিমজ্জিত তরণী-১

তুমি আজকাল দূরে থাকো, কেন থাকো তাও জানি, তবু প্রতিদিন তোমাকে খুঁজি। তুমি নেই জেনেও কড়া নেড়ে আসি বন্ধ দরোজায়। তুমি নিজেকে আর আমাকে রক্ষার জন্য আড়াল হয়েছো জানি, তবু অবোধ ইচ্ছেগুলো ফিরে আসে বারবার। তুমি থাকবে না জেনেও তোমার কুয়াশার আড়াল খোঁজে। আমি তোমাতে ডুব দেবার আয়োজন করি প্রতিদিন, তোমার স্মৃতির ধুলো নাড়াচাড়া করি সযত্নে। জানি তুমি ভালো নেই, তোমাকে ভালো রাখতে না পারার ব্যর্থতা ভুলে থাকার জন্য তোমার দরোজায় কান পাতি। তুমি খিল এটে বসে আছো বিপরীত ছিটকানির নীচে, তুমি জানো দরোজা খুললেই আমি সেই ভয়ে তুমি দরোজা খুলে বাইরে উঁকি দাও না। আমার মুখোমুখি হতে আজ তোমার বড্ড ভয়। তুমি নিজেকে রক্ষার চেয়েও আমাকে রক্ষা করতে বেশী সচেষ্ট। অথচ আমি তোমার কাছ থেকে কোন ক্ষতির আশংকা করিনি কোনদিন। আমি স্মৃতির খোপগুলো জোড়া দিয়ে দুরত্ব কমিয়ে আনি। ভুল স্মৃতিতে শুদ্ধতার প্রলেপ লাগাই। তুমি কি জানো আমার অনেক ভুল স্মৃতি রয়ে গেছে? জেনে কষ্ট পাবে বলি কখনো বলিনি। এখন আমি স্বচ্ছ দীঘির মতো জলে চোখ ডুবিয়ে সব সত্য দেখতে পাই। তুমি যখন ছিলেনা ভাবতাম, তখনো তুমি ছিলে। তুমি কখনোই হারাওনি। তুমি হারিয়ে গেছো বলে যেসব ভুল বেদনা আমি পেয়েছিলাম তার ভেতরে ফুটিয়ে দিয়েছি নতুন গোলাপ। আমি তোমার টলমলে চোখের জল দেখতে পাই সেই গোলাপে। তুমি শুদ্ধতম নারী, ভালোবেসে কখনো আক্ষেপ ছিল না আমার।

Thursday, September 20, 2012

অবসাদের গান

অবসাদ। অনেকদিন হয়ে গেল। ক্লান্ত, অবসন্ন উৎসাহহীনতা। অবসাদ রাজ্যে অবসর। গলায় গলায় জ্বরব্যথা সন্ধ্যাকালীন অস্বস্তি। ঘড়িটা সরে গেছে দক্ষিনে। আগের মতো চট করে সময়ের প্রয়োজন হয় না।  অখণ্ড অবসরে কিছুকাল। সময় এখানে স্থির। দক্ষিন দেয়ালে অস্পষ্ট ঘড়ি। নতুন দেয়ালের চলচ্ছবি মুগ্ধতা হারিয়ে ঝুলে থাকে একা। একদিন দুপুরবেলা, একেকদিন বিষন্ন সন্ধ্যা। মেঘের দল মিছিল করে ঝিরিঝিরি পাতায় আলোড়ন তোলে। পাতারা হলুদ হয়, মরে যায়, পড়ে থাকে পীচের গন্ধ বুকে নিয়ে।

আমি অনেকদিন তোমাকে দেখি না, খুঁজি না। আমি আর অতীত খুঁড়ি না। খননকাজের ব্যথায় শয্যাশায়ী। ধরাশায়ী হতে না চাইলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকাই ভালো। দূরত্ব তোমার স্বস্তি, দুরত্ব আমার স্বস্তি। দুরত্বে সমাজ নিরাপদ থাকে। আমি আর অতীত খুঁড়বো না। মঙ্গলবার্তার জীর্ন পাতা অমসৃন সততা নিয়ে এখনো স্থির। তুমি আছো তাই তোমাকে নতুন করে পেতে হয় না।

চায়ের কাপ হাতে ঝুলবারান্দায় পাতাবাহারের ঝোঁপ, সন্ধ্যার আকাশে নিভু নিভু পশ্চিমা নক্ষত্র, সুগন্ধী মরিচ পাতা, সবজীর সজীবত্ব, হেলান দিয়ে অজুহাত সন্ধানী খালি চায়ের কাপ, একটা গান শোনো, আগে কখনো শোনোনি, নিকটস্থ প্রার্থনালয় থেকে ভেসে আসা সুর, আকাশ জেমকালি মেখে নিঃসঙ্গ প্রতিক্ষায়, কোন কথা বাকী থাকে কিনা, তখনো কেউ জানে না, ঘরে ঘরে বাতি জ্বলে উঠে, দীর্ঘশ্বাস চায়ের কাপে পতিত হলে নীরবতা আর কোন কথা বলে না। এখন সব গল্পের অবসান ঘটেনি। এখানে গল্পেরও সূচনা হয়নি। তবু চায়ের কাপ হাতে ঝুল বারান্দায় অনর্থক লিকারের স্পর্শ  পাই ঠোটে।

জ্বর সেরেছে অবসাদ ছাড়েনি। স্মৃতি এখনো ঘুর্নি পাকায় শুকনো পাতায়। পনের দিনের ক্লান্তি, পনের বছরের শান্তির ঘুম। এবার ঘুমাবো আমি। এবার পাতায় পাতায় শিরায় শিরায় অবসন্নতার ছুটি।

Saturday, September 1, 2012

কতো রবি জ্বলে, কেবা আঁখি মেলে

সময় গেলে মানুষ তার প্রিয় জিনিসকেও অবহেলা করে। এমনকি মানুষও সেই একই অবহেলার স্বীকার। বস্তু বা মানুষ এক্ষেত্রে প্রায় একই কাতারে। তবে নিরাপত্তার খাতিরে মানুষকে বাদ দিয়ে বস্তুকে নিয়েই লিখবো। মানুষ খুব বিপদজনক প্রাণী। বস্তুর সুবিধা হলে তাকে নিয়ে অপ্রিয় সত্যি কথা লিখলেও সে বিগড়ে যায় না চট করে।

একবার খুব প্রিয় একটা জিনিস কেনা হলো। কেনার পর দিনরাত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। জেগে থাকার প্রায় সম্পূর্ন মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকা। কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখা। নিজের জিনিসটা অন্যের চেয়ে কতো বেশী চমৎকার সেটা ভেবে মনে মনে পুলকিত হওয়া। কয়েকদিন যাবার পর জিনিসটার প্রতি অভ্যস্ত হওয়া। ঘনঘন ব্যবহার করার ছুতো খোজা। তৃতীয় পক্ষকে লুকিয়ে একটু বেশী আদর যত্ন করা। যেন হারিয়ে না যায় খুব সতর্ক থাকা। হারিয়ে যেতে পারে এমন জায়গায় নিয়ে না যাওয়া কিংবা তেমন জায়গা পরিহার করা। ঘরের বাইরে গেলে যতটা সম্ভব প্রকাশ্যে না আনা।

অতঃপর প্রাথমিক মুগ্ধতা কাটতে থাকবে আস্তে আস্তে। জিনিসটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে চোখের সামনে। এখন আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে না। আদরের চেয়ে কাজের ব্যাপারেই বেশী দেখা সাক্ষাত হবে। প্রকাশ্যে টেবিলের উপর রেখে দেয়া যাবে। ছিনতাইয়ের ভয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে না। সহজভাবে ব্যবহার করা যাবে। মাঝে মাঝে ব্যবহার না করেও চলে যাবে। থাকলে ভালো, না থাকলেও চলে। অন্যের হাতে থাকা নতুন কোন জিনিসের দিকে নজর যাবে।

অন্যের হাতে থাকা ওই জিনিসের সুবিধা সৌন্দর্য দুটোই বেশী মনে হবে। নিজের জিনিসটার জন্য আক্ষেপ বাড়বে। এটা থেকে মুক্তির সুলভ উপায় খুজতে ইচ্ছে করবে। আগের অর্ধেক দামে বিক্রির উপায় খুজবে। জিনিসটা আগের মতো কাজ করছে না মাঝে মাঝে হ্যাং হয়ে যাচ্ছে বলে বিরক্ত লাগবে। মাঝে মাঝে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া আছাড় দেয়া উচিত হবে না বলে মূলতবী রাখা হবে। বিকল্প আরো উন্নত জিনিসের জন্য পয়সা জমাতে শুরু করবে। বিকল্প পাওয়া মাত্র এটা কাউকে এমনকি বিনামূল্যেও গছিয়ে দিতে ইচ্ছে করবে। নতুন পাওয়ামাত্র পুরোনো জিনিসের নিন্দায় মূখর হতে হবে। পুরোনো জিনিসটা কতো খারাপ ছিল নতুনটা পাওয়ার আগে বুঝিনি বলে নিজে নিজে লজ্জা পাওয়া হবে। নতুনের জয়গান গেয়ে নতুন দিনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তবে একদিন এই নতুনের দিনও ফুরোবে, একই ভাগ্য বরণ করবে এই নতুনও। চিরনতুন বলে কিছুই নেই বস্তু ও মানবজীবনে।

আমার জিনিসটার দৈর্ঘ ১০ সেমি, প্রস্থ ৫সেমি, গভীরতা ১ সেমি। ওজন ১১০ গ্রাম। দেখতে কালো তবে চকচকে। কিন্তু চকচক করলেই সোনা হয় না। এমনকি কালো সোনাও না। হলে কি হবে এটি সোনার চেয়েও দামী। সেটা একটু পরেই বুঝবেন। তবে জিনিসটা চ্যাপটা, পুরো শরীরজুড়ে আয়না। আড়াই ইঞ্চি বাই দেড় ইঞ্চি। এটারে আদর করে বলে ডিসপ্লে এরিয়া। এটা পকেটে বহন করা যায়, হাতের তালুতে ধরে রাখা যায়, ঢিল মেরে ছুড়েও ফেলে যায়। কিন্তু পড়ে ভেঙ্গে গেলে কিংবা পানিতে ডুব দিলে তাকে আর জীবিত পাবেন না। তখন আপনি একাই মাথার চুল ছিড়বেন। আদুরে ডিসপ্লে এরিয়াটা পুরোটাই একটা টাচ স্ক্রীন। আদুরে কারণ এটাকে আদর ছাড়া চালানো যায় না। টাচ স্ক্রিনে আঙুলের আদর দিয়ে তাকে পরিচালানা করতে হয়। আদুরে না হয় হলো কিন্তু তা আপনাকে কি কি সুবিধা দিতে সক্ষম তা দেখা যাক।

১. হুকুম করা মাত্র সে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের সাথে টেলিযোগাযোগ ও মেসেজ সার্ভিস স্থাপন করে দেবে
২. তার ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইমেইল ব্রাউজিং দিয়ে জ্ঞান বিনোদন জগতে ডুবে যেতে পারবেন
৩. কারো ঠিকানা জানেন অথচ তাকে খুজে পাচ্ছেন না? গুগল ম্যাপে ঠিকানা টাইপ করে আলতো চাপ দিন। পৃথিবীর আনাচে কানাচের যে কোন ঠিকানায় চলে যেতে পারবেন মুহুর্তেই
৪. পথিক আপনি পথ হারাইয়াছেন? ভয় নেই। জিপিএস লোকেটর দিয়ে গুগল ম্যাপে নিজের অবস্থান বের করে ফেলতে পারবেন কয়েক সেকেণ্ডেই।
৫. জ্ঞানার্জন করবেন? গুগল উইকিপিডিয়া দিয়ে সারা বিশ্বের তথ্যভাণ্ডার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারবেন
৬. মাথা নষ্ট করার ইচ্ছে আছে? এফএম রেডিওর বাংলিশ টক শো কিংবা গান অথবা খবর কিংবা বকর বকর শুনতে পারেন
৭. বিটিভি দেখায় অরুচি? কিন্তু হাতের তালুতে আস্তে একটা টেলিভিশন খারাপ লাগবে না এমনকি বিটিভি হলেও। জিনিসটাকে আলতো ছোয়ায় টেলিভিশন বানিয়ে দেয়া যায় নিমেষেই
৮. বোরিং? দারুণ সব গেম আছে গেমিং জোনে। বসে বসে ঝিমানোর বদলে মজার মজার গেম খেলুন
৯. কতোদিন গান শোনার সময় পাননি? বোতাম টিপলে এটি মিউজিক প্লেয়ার, আঙুলের পরশে গান শুনুন ইচ্ছেমতো সাজিয়ে
১০. ভিডিও, নাটক মুভি দেখবেন?  ভিডিও প্লেয়ার চেপে উপভোগ করুন পছন্দের আইটেম।
১১. হুটহাট ছবি তোলার শখ? কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরার দরকার নেই। এটাকেই ডিজিটাল ক্যামেরা বানিয়ে ফেলতে পারেন।
১২. শুধু ছবিতে পোষাচ্ছে না? ভিডিও ক্যামেরায় ক্লিক করুন। ঘন্টা পর ঘন্টা ভিডিও করুন ব্যাটারীর বারোটা না বাজা পর্যন্ত্
১৩. ছবি তুলেই সন্তুষ্ট না? ছবিতে রংচং কার্টুন যোগ করবেন? ছবি এডিট অপশন খুলে নিশ্চিন্তে বসে যান কারো চেহারায় মুখোশ কারো পাছায় লেজ জুড়ে কোলাজের মজা নিন।
১৪. এতে আরো আছে একখানা ক্যালকুলেটার
১৫. আছে কয়েক রকমের এলার্ম
১৬. আছে একখানা রঙিলা ক্যালেণ্ডার
১৭. আছে ডিজিটাল ছবির নান্দনিক অ্যালবাম
১৮. আছে বহুমূখী একখানা কনভার্টার (দৈর্ঘ প্রস্থ, ওজন, এরিয়া ইত্যাদি)
১৯. টুকে রাখতে চান অতি জরুরী কোন মেসেজ বা তথ্য? চট করে নোট খুলে লিখে রাখুন
২০. ব্লু টুথ? হ্যাঁ এতে একখানা নীলদাঁতও আছে। বিশ্বাসী বন্ধুর সাথে বিনিময় করুন ছবি কিংবা ভিডিও কিংবা যে কোন ফাইল।
২১. সুযোগের অভাবে আপনি বাথরুম সিঙ্গার? নির্ভয়ে বাথরুমে গিয়ে রেকর্ড করে নিন পছন্দের গান। এটি একটি ভালো রেকর্ডারও।
২২. দৌড়বিদ? দৌড় শুরুর আগে স্টপওয়াচ চালু করে দিন, আপনার পদক্ষেপের গতিময়তার নিখুত হিসেব দিয়ে দেবে।
২৩. আকাশ মেঘলা অথচ বুঝতে পারছেন না বৃষ্টি হবে কিনা? ক্লিক করুন আকু ওয়েদার বাটনে। আবহাওয়ার প্রতিমুহূর্তের আপডেট, আগামী কয়েকদিনের ফোরকাষ্ট
২৪. আর কি চাই? শতশত গান ছবি ভিডিও মেমোরিতে জমা করে রাখুন। দরকার মতো মুছে ফেলুন আবার যোগ করুন।
২৫. কম্পিউটারে মতো ফোল্ডার তৈরী করে সকল গান কবিতা আর তথ্য জমা রাখুন তথ্য ভাণ্ডারে পরিণত করুন হাতের ইশারায়
২৬. এটি একটি ছোটখাট অফিসও। অফিসের মেইলে এটাচমেন্ট থাকে। এই জিনিসে এমএসওয়ার্ড এক্সেল পিডিএফ টেক্সট ইত্যাদি ফাইল স্বচ্ছন্দে পড়তে পারেন
২৭. রিজার্ভ গান বাদ দিয়ে ইন্টারনেটের গান শুনতে চান? ইউটিউব ভিডিও চালু করে দিন
২৮. এছাড়াও আছে ফ্লিকার, পিকাসা, ফটোবাকেট,  সব কিছু এক আঙুলের ইশারায় পাওয়া যায়।
২৯. বিশ্বের টাইমজোন তো এখন আপনার হাতের মুঠোয়। তবে জোরে চাপ দেবেন না, বিশ্বের সময় নড়বড়ে হয়ে যাবে।
৩০. বেকার লোক আপনি? তাই প্রচুর ব্যস্ততা? চিন্তার কিছু নেই। সারা বছরের শিডিউল, ডায়েরী, রিমাইণ্ডার ইত্যাদি জমা রাখা যায় একদম বিনামূল্যে
৩১. ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে অন থাকতে চান? তর্জনীর ইশারায় ঢুকে পড়ুন বন্ধুদের আড্ডাখানায়।
৩২.....৩৩......৩৪.......ইটিসি ইত্যাদি

জিনিসটা কি আর বোধহয় বলে দেবার দরকার নাই।  জিনিসটার নাম মোবাইল ফোন। কিছু সুবিধা কম বেশী হলেও এই জিনিস আজকাল সবার হাতে হাতে। এরকম একটা কার্যকরী যন্ত্র হাতে থাকলে নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম অলস প্রাণীতে পরিণত করতে খুব বেশী কি বেগ পেতে হয়? হয় না। আমারও হয়নি। কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন যাতায়াত সত্ত্বেও হয়ে গেছি প্রচ্ছন্ন বেকার। শুয়ে শুয়েও অফিসের মেইল চেক করে ফেলি। নাম বদলে হয়েছি গৃহিনীর আদুরে ভাষায় 'কুঁড়ের বাদশা' ওরফে অলস দ্য কিং।

তবে আমাকে অলস দ্য কিং বানাবার এই যন্ত্রটিকেও আজকাল নীরস মনে হচ্ছে। এটাই হলো মুশকিল। মুগ্ধতার দিন শেষ। সহনীয়তাও শেষের পথে। দিন যতই যাচ্ছে মনে হচ্ছে আমার আরো অলস হওয়া উচিত। অথচ এটা আমাকে আরো বেশী অলস বানাতে পারছে না। এর চেয়ে ভালো কিছু বাজারে এসেছে কিনা খোঁজ নেই প্রতিদিন। মানুষের চাহিদার শেষ নেই। আরো উন্নত প্রযুক্তি কি হতে পারে আমার ধারণা নেই। শুধু জানি সেটা বিজ্ঞানীদের কাজ, ওরা ঠিকই খুঁজে খুঁজে নয়া প্রযুক্তি আবিষ্কার করে আরো অলস বানাবার ফন্দী করে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমরা কেবল পকেটে কাড়ি নিয়ে তৈরী থাকবো নতুনের স্বাদ নেবার জন্য।

কিন্তু আরো উন্নত প্রযুক্তির স্পর্শে ভবিষ্যতে আমার অলসতা কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে ভাবা যায়? চরম আলস্যে যদি আমাদের ভূতলে পতন ঘটে আমরা শুয়ে শুয়ে কি সেই বেদবাক্যটি আউড়ে যাবো - "কতো রবি জ্বলে, কেবা আঁখি মেলে?"