Thursday, October 31, 2013

৩১ অক্টোবর ২০১৩: শীতের ঘ্রাণ

অক্টোবরের শেষদিন আজ। এবার অক্টোবরের শেষ সপ্তাহটা রাজনীতিতে উত্তপ্ত থাকলেও আবহাওয়াতে ঠাণ্ডা ছিল। শীতের আগমনের একটা গন্ধ আছে। এই গন্ধটা কৈশোর থেকে প্রিয় আমার। গ্রামে এসময় সন্ধ্যা নামার আগে আগে বাতাসে একটা ধোঁয়াটে গন্ধ ভর করে। ওই গন্ধে কোন গৃহস্থের মাটির চুলোর শুকনো পাতা পোড়ানোর গন্ধ। ভীষণ আপন লাগে গন্ধটাকে। অনেক বাড়িতে এই সময়েই রাতের রান্নাবান্না হয়ে যায়। মাটির হাড়িতে লাল ঝোলের তরকারীর মিষ্টি গন্ধটা অদ্ভুত লাগে। সেই গ্রাম এখন নেই। তবু গ্রাম বললে ওই দৃশ্যটা ভেসে ওঠে।

গতকাল আর আজ হরতাল নেই। দুই দলের সমঝোতার লক্ষণও নেই। আরো সংঘাত সহিংসতার বাজেট রয়ে গেছে দুই পক্ষেই। ক্রসফায়ারে জনগণ।

একটা তুর্কী মুভি নামালাম আজ। Ay Lav Yu, মনে হচ্ছে হাসির মুভি। খুঁজে গিয়েছিলাম Vizontele, অনেক বছর আগে বিটিভিতে দেখেছিলাম। পেলাম না ওটা। সম্প্রতি ইউটিউব থেকে মুভি নামাবার একটা রাস্তা পাওয়াতে বেশ কিছু ভালো মুভি দেখা হলো।

একটা অস্বস্তি কাটিয়ে একটু ভালো লাগছে আজ।


Tuesday, October 29, 2013

২৯ অক্টোবর ২০১৩ : হরতাল পর্ব

আজ টানা হরতালের তৃতীয় দিন। আন্দোলন হরতাল নতুন কিছু না। সব দলের আন্দোলনের চরিত্র প্রায় এক। তবু এবার নতুন করে সহিংসতা আর হিংস্রতার মাত্রা যোগ করেছে জামাত-শিবির। গত এক বছর ধরে দেখছি। বাস, কার টেক্সি থেকে কাভার্ড ভ্যান আর ট্রেনেও আগুন দিচ্ছে। এমনকি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকলেও। এদের কাছে এটা শত্রুদেশ। শুধু বস্তুতে আগুন না, জীবন্ত মানুষকেও আগুন। শুধু এই দেশ না, এদেশের মানুষও এদের শত্রু। অথচ এই বিভৎস রাজনীতির স্বঘোষিত মার্কেটিং এজেন্ট বিএনপির মতো বৃহৎ একটা দল। বিএনপির এখন নিজস্ব কোন রাজনৈতিক প্রোডাক্ট নেই। আশা করা যায় তারা আগামীতে জামাতের বিক্রয় কর্মী হিসেবে রাজনীতি থেকে অবসর নেবে।

জীবিকার বিকল্প সন্ধানে পথে নামতে হবে শীঘ্রই। আমি আর আমার বর্তমান জীবিকা কেউ কাউকে পছন্দ করছি না আর।

ঠেকতে ঠেকতেও জীবনের পনের আনা সাধ পূর্ন হয়ে গেছে। সব পাওয়া হয়ে গেছে বলবো না। মানুষের চাওয়ার কোন শেষ নেই। কিন্তু আমি চাওয়ার সীমানা দেয়ালকে কমিয়ে পাওয়ার কাছাকাছি নিয়ে এসেছি বলে না পাওয়ার আক্ষেপ নেই। নতুন করে কিছু চাই না আর। পুরোনো যা আছে তা বহাল থাকলেই হবে। একটা দুর্ভাবনা -পরবর্তী প্রজন্মের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য। স্বার্থপর মানুষ ভবিষ্যত ভাবে না। বর্তমান নিয়েই থাকে।

গতকালও না, আজও না।








Monday, October 28, 2013

২৮ অক্টোবর ২০১৩: প্রথম শীত

আজ বৃষ্টি ছিল না। তবে সকালে গাঢ় কুয়াশা ছিল। হরতালে অফিসে আসতে হয়েছে খুব ভোরে। লালখান বাজার মোড় থেকে ২০০ টাকা দিয়ে টেক্সি নিলাম। হরতালের গচ্ছা। আরো কয়মাস এভাবে চলবে কে জানে। ক্ষমতা দখল নিয়ে দু পক্ষের যুদ্ধের ভিকটিম তারাই, যাদের নামে রাজনীতি চালু আছে।

অনেকদিন ধরে INCENDIES নামের মুভিটা খুঁজছিলাম। আজ পেয়ে গেলাম ইউটিউবে পুরোটাই। নামিয়ে নিলাম সাথে সাথে।

আজ কোন কথা হয়নি। নৈঃশব্দ দিবস।

Tuesday, October 22, 2013

সেই সব পুরোনো দিনগুলি


স্বচ্ছ স্মৃতির পুকুর কিংবা স্মৃতির স্বচ্ছ পুকুর

খুব ছেলেবেলা না, হাই স্কুল বয়সের স্মৃতি। ছুটির দিনগুলো গ্রামে গিয়ে থাকতাম। তিনটি গ্রামের স্মৃতি সঞ্চিত আছে আমার। আজিমপুরের দাদাবাড়ির গ্রাম। গোমদণ্ডীতে নানাবাড়ির গ্রাম আর ধলঘাটে বড় খালার গ্রাম। কদুরখীলের ছোট ফুফুর গ্রামেও মাঝে মাঝে গিয়েছি। তবে প্রথম তিনটা গ্রামেই সবচেয়ে বেশী সময়।

গ্রামের স্মৃতিতে পুকুর অবধারিত। আমি সাঁতার জানতাম না, কিন্তু ভীষণ প্রিয় সময় কাটতো পুকুরে। সাঁতার না জেনে যতটুকু নামা যায় সেই বুক পানি পর্যন্ত ডুবে থাকার কি যে আনন্দ। নাক বন্ধ করে ডুব দিয়ে পুকুরের তলায় কতক্ষণ বসে থাকা যায় তার প্রতিযোগিতা হতো। আজিমপুরের  দাদাবাড়ির পুকুরটা আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। প্রথমতঃ এটা নিজেদের পুকুর, বেশী আপন লাগতো, যেন নিজের ঘরে আছি। দ্বিতীয়ত এই পুকুরে কোন কাদা ছিল না। পুকুরের তলা পর্যন্ত পরিষ্কার।

এই এলাকায় বালি মাটি, কাদা হয় না,পুকুরের তলায় হাঁটলে সমুদ্র সৈকতে হাঁটার মতো অনুভুতি হতো। তলদেশটা ছিল সমতল প্রায়। বেশী ঢালু ছিল না। হাঁটুপানি থেকে বুক পানি পর্যন্ত জায়গার বিস্তার ছিল অনেক বড়। তাই আমরা সাতার না জানা ছেলেপেলেরা পুকুরে নেমে হাঁটাহাঁটি করতাম। এমনকি ডুবসাঁতার না জানলেও, ডুব মেরে এক জায়গা থেকে হেঁটে হেঁটে অন্য জায়গায় উঠতাম। তখন পাকা ঘাট ছিল না। লম্বা গাছের গুড়ি ছিল ঘাটের মতো। তক্তা দিয়ে আটকানো। ঘাটের পাশে ছিল একটা হেলানো তালগাছ। তালগাছটা পুকুরের উপর পনেরো বিশ ফুটের মতো গিয়ে বাঁকা হয়ে উঠে গিয়েছিল। অদ্ভুত সুন্দর লাগতো পুকুরে হেলানো গাছটিকে। ওই গাছের কাণ্ড বেয়ে কিছুদুর গিয়ে নীচের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া দারুণ মজা।

ওখানে পানির গভীরতা কোমর পর্যন্ত তাই ওটাকে সুইমিং পুলের কায়দায় ব্যবহার করা  আমার পক্ষেও সম্ভব ছিল। ওখানে পা ঝুলিয়ে বসে বরশীতে মাছ ধরা দারুণ ব্যাপার ছিল। পানি এত স্বচ্ছ ছিল যে মাছের আনাগোনা উপর থেকেই দেখতে পেতাম। শোলমাছ, টাকি মাছ, কইমাছ, পুটি মাছ ইত্যাদি ঘোরাফেরা করতো অহরহ। আমাদের টার্গেট মাছও ছিল তারাই। মাঝে মাঝে অবশ্য বড় চিংড়ি এসে হাজির হতো। ছায়াঘেরা জায়গা পছন্দ ছিল ওদের। ঘাটের পাশে গাছের ছায়ায় লুকিয়ে থাকতো বড় বড় চিংড়ি। একবার আমি সেরকম ঘাপটি মেরে বসে থাকা দুটো গলদা চিংড়িকে খালি হাতে ধরে ফেলেছিলাম। আমার মাছধরার ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত ওটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড। বড়রা অবশ্য ঘটনাটিকে ঝড়ে বক হিসেবেই ধরে নিয়েছিল।

আমাকে ভাবায় পানির সেই স্বচ্ছতা। গ্রামের অধিকাংশ প্রধান পুকুরের পানি এরকম টলটলে স্বচ্ছ থাকতো। যখন যে গ্রামে গিয়েছি ওই স্বচ্ছতাই আমাকে নির্মল আনন্দ দিয়েছে। সূর্যের আলো যখন কিনারের স্বচ্ছ পানি ভেদ করে তলদেশে পৌঁছাতো তখন ওই স্বচ্ছ পানির মধ্যে ঘুরে বেড়ানো মাছেদের দেখতে যে কী অপূর্ব সুন্দর লাগতো, তার সাথে এ যুগের কোন একুয়ারিয়ামের তুলনা হয় না। আমাদের একটা পুকুরের পাড়গুলো ঘেরা ছিল পাটি পাতার ঝোপে। পাটি পাতা হলো চার পাচফুট লম্বা চকচকে কাণ্ডের কিছু গাছ, যা কেবল পুকুর পাড়েই হতো। ওই গাছের কাণ্ডের ছাল দিয়ে পাটি তৈরী হয়। সেই পাটিপাতার ঝোপে লুকিয়ে থাকতো নানান জাতের মাছ। সূর্যের আলো পাটিপাতার ডুবে থাকা ঝোপের তলায় যে আলো ছায়ার মায়া তৈরী করতো সেই মায়াবী আলো আজো আমি দেখতে পাই। পানির ওই স্বচ্ছতা আজ বোধহয় আর কোন পুকুরে অবশিষ্ট নেই। আমি এখনো যখনই যে গ্রামে যাই, ওই স্বচ্ছতা খুঁজি, কোথাও পাই না। কৃত্রিম মাছ চাষের কবলে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো পুকুর জলাশয়।

পুকুরে নেমে সাঁতার প্রচেষ্টা কম ছিল না। কাছেই ছিল বাঁশবন। সেখান থেকে বিরাট বাঁশ এনে পুকুরে ফেলে রাখা হতো মাছ ধরার প্রয়োজনে। সেই বাঁশ ধরে সাঁতার দিয়েছি মাঝে মাঝে। দুই হাতে বাঁশ ধরে পেছনে দুই পা দাপিয়ে সাঁতরানো। একবার সাঁতার শিখতে গিয়ে বাঁশটা চলে যায় মাঝপুকুরে। আমি আর ফিরতে পারি না। মাঝপুকুরে দাপাতে থাকি আর ত্রাহি চিৎকার। কুলে দাড়িয়ে মজা দেখছিল সাতারু কাজিনরা। পরে এক বন্ধু কাজিন ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার করে আনে মাঝ পুকুর থেকে। তারপর থেকে বাঁশ ধরে সাঁতার শেখায় ইস্তফা দেই।

ওই পুকুরের অন্য পাড়ে ছিল বিশাল দুটো তেতুল গাছ। একটা গাছ কত বড় হতে পারে তখন জানতাম না। ভাবতাম তেতুল গাছই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাছ। আসলেই এত বয়সে এসেও আমি যত গাছ দেখেছি তার মধ্যে ওই দুটো তেতুল গাছ সবচেয়ে বড়। এত মোটা বেড়ের কোন  গাছ আজ অবধি দেখিনি। আফ্রিকার বাওবাব গাছ দেখেছি টিভিতে, এ ছাড়া এই তেতুল গাছ দুটোই আমার দেখা সবচেয়ে বড় গাছ। এর প্রস্থ কত হবে জানি না। আন্দাজ করি কমপক্ষে বিশফুট হবে একেকটা গাছের বেড়। শোনা যায় ওই গাছ দুটো লাগিয়েছিল এই এলাকার প্রাক্তন বাসিন্দা মগেরা। কয়েকশো বছর আগে এই গ্রামটা মগদের দখলে ছিল। মগ ধাওনীর সময় এরা সব ফেলে পালিয়ে যায় বার্মায়।

আমাদের পূর্বপুরুষ ওদের কাছ থেকে কিনে নেয় এই এলাকার সবকিছু। গাছ দুটো সম্পর্কে কিংবদন্তী আছে - একদা এই গাছে জ্বীনদের বসতি ছিল। মগেরা জ্বীন তাড়াতে গাছের মধ্যে মগা তাবিজ পুতে দেয় দেড় হাত লম্বা পেরেক দিয়ে। সেই জ্বীনেরা এখনো মানুষের উপর আছর করার চেষ্টা করে, তাই তেতুল গাছের নীচ দিয়ে চলাফেরা করতে দিনের বেলাতেও ভয় পায় সবাই। কিন্তু দস্যি ছেলেদের কাছে জ্বীনভুতের ভয়ডর কম, তাই তারা মধ্য দুপুরে যখন গ্রামের সবাই খেয়ে ভাতঘুমে গা এলিয়ে দিয়েছে, তখন চুপি চুপি গাছে উঠে পড়তো। পাকা পাকা তেতুল কোচড় ভর্তি করে নিত। কিছু কিছু ছুড়ে মারতো পুকুরে। পাকা তেতুল পুকুরে  ভাসতে থাকতো। আমরা লম্বা কঞ্চি কিংবা কাঠি দিয়ে টেনে নিতাম আলগোছে। কখনো গাছের মালিক পক্ষ এসে হাজির হতো, কে রে.........বলে। তখন গাছে থাকা বালক বা বালিকাটি চুপ করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়তো। এত ঘন ডালপালা আর এত মোটা শাখা ছিল যে, কেউ বুঝতেই পারতো না উপরে লুকিয়ে আছে আরো দুয়েকজন।

একবার গ্রামে গিয়ে দেখি গাছ দুটোর জায়গায় প্রকাণ্ড একটা আকাশ। আকাশ আমার খুব প্রিয়, কিন্তু ওই আকাশটুকু আমার একটুও ভালো লাগলো না। বুকের ভেতর কেমন একটা কষ্টবোধ। তেতুল গাছ দুটো হেরে গেছে। কয়েকশো বছরের ঝড়ঝঞ্ছা সহ্য করে টিকে থাকা গাছ দুটো পরাজিত হলো মানুষের আর্থিক প্রয়োজনের কাছে। কেটে বিক্রি করে দিয়েছে গাছের মালিক। গাছ দুটো বাঁচানোর জন্য মানব বন্ধন করার কোন সুশীল জনতা ছিল না আমাদের গ্রামে। হারানোর ব্যথাটা তাই আমার বুকেই লুকিয়ে থাকলো।

===========

সেই সব সস্তা দিনগুলি

টাকা পয়সার তখনো দাম ছিল। ৮৬ সালের কথা বলছি। যে বছর ইন্টার পরীক্ষা দিলাম। মাহবুব আমাকে এসে বললো, সিজিও বিল্ডিং এর সামনে নতুন একটা ব্যাংক এসেছে, দেখেছিস? কী সুন্দর এয়ারকণ্ডিশন চলে। আর কোন ব্যাংকে এয়ারকণ্ডিশন নেই। চল ওখানে একটা ব্যাংক একাউন্ট খুলি।

ওর বাবার অনেক টাকা, বাবার কাছ থেকে বেশ টাকাপয়সা পায় খরচের জন্য। একাউন্ট খুললে সে খুলতে পারে। আমার বাবারও টাকা আছে, কিন্তু দেদারসে খরচের মতো না। আমি দরকারী খরচের বাইরে আলগা কোন হাত খরচ পাই না। তাই বললাম, আমার অত টাকা নাই, পারবো না।

সে বললো, দুশো টাকা ম্যানেজ কর। তাতেই হবে।

আমি ভাবলাম। দুশো টাকা! সেও তো অনেক টাকা। আমাদের বাসা ভাড়ার ১০%।

বিশাল ড্রইং রুম সহ তিন বেডরুমের দোতলা বাসাটার ভাড়া ২০০০ টাকা! ভাবছেন এত কম? মোটেও না। অবিশ্বাস্য বেশী।  অত ভাড়ায় আমার চেনাজানা কেউ ভাড়া থাকতো না, অত দামী বাসা নিয়েছিলাম বলে অনেকে আমাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে শুরু করেছিল। কারণ আমাদের কলোনীর বাসাটার ভাড়া ছিল মাত্র ৬০০ টাকা। হুট করে এক ঝামেলায় পড়ে কয়েক ঘন্টার নোটিশে ওটা ছেড়ে দিতে হলো বলে নগদে বেশী ভাড়ায় এই বাসা। কিভাবে ছাড়তে হলো সে কাহিনী সংক্ষেপে বলছি।

সরকারী কলোনীতে যে বাসায় ভাড়া থাকতাম সেটা ছিল তৃতীয় শ্রেণীর এক সরকারী কর্মচারীর তিন রুমের বাসা। বছর দুয়েক হলো ওই বাসায় উঠেছি। বাবা তখন মাত্র দেশে ফিরে এসেছে বিদেশের চাকরী ছেড়ে। আমার সেদিন ইন্টারের টেষ্ট পরীক্ষা ছিল। আমি সকালে পরীক্ষা দিতে চলে যাই। পরীক্ষা শেষে দুপুরে বাসায় ঢুকে চোখ কপালে উঠে গেল। বাসাটা আগের মতো নেই। একদম বদলে গেছে হঠাৎ। পুরো বাসা প্রায় ফাঁকা। ফার্নিচারগুলো নেই। খুচরো জিনিসপত্র এলোমেলো। মা গোছগাছ করছে বুয়াকে নিয়ে। আমাদের বেড়ালছানাটা লেজ উঁচিয়ে এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করছে। ব্যাপার কি? বাইরে তাকিয়ে দেখি বাড়িওয়ালা সিড়ির মধ্যে বসে আছে। তার সামনে তিনটে বস্তা রাখা। ডেকচি পাতিল ইত্যাদি ভর্তি বস্তা।

মা বললো, আমি কলেজে যাবার পর হঠাৎ করে আবদুল মালেক(বাসার মালিক) এসে হাজির বউ বাচ্চা নিয়ে। কোনরকম আগাম নোটিশ নাই, কিছু না। এসেই বলে তারা আজকেই বাসাটা ফেরত চায়। আমাদের অন্য কোথাও চলে যেতে হবে আজই। বাবা কিছুক্ষণ বৃথা তর্ক করে বাসা খুঁজতে বেরিয়ে গেছে। হাজীপাড়ায় একটা বাসা পাওয়া গেছে। এখন মালামাল ঠেলাগাড়িতে করে ওখানে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। বাকী জিনিস নিয়ে ঘন্টাখানেক পর আমরাও চলে যাবো। সেই হলো আমাদের বিচিত্র বাসা বদল কাহিনী।

আসল কথা হলো সেই সময়ে ২০০ টাকাও নেহায়েত ফালতু না। আগ্রাবাদ থেকে নিউমার্কেটের বাস ভাড়া তখন ৭৫ পয়সা। রিকশায় গেলে ৫/৬ টাকা। ১০ টাকা দিলে একটা মাসুদ রানা কিংবা দুটো কুয়াশা পাওয়া যায়। তাই বাসায় এসে মাকে শখের কথাটা বললাম। মা বুঝলো ছেলে বড় হয়েছে। বাপের একাউন্টে লাখ লাখ টাকা থাকলে ছেলের একাউন্টে দুশো টাকা থাকলে এমন কি ক্ষতি।

টাকাটা পেয়েই গেলাম। দুশো টাকা দিয়ে একাউন্ট খুলে ফেললাম এয়ারকণ্ডিশন ব্যাংকে। কত কিছু ভুলেছি কিন্তু  একাউন্ট নাম্বারটা এখনো ভুলিনি। ভুলিনি কেননা ওটা ছাড়া জীবনে আর কোন ব্যাংক একাউন্ট কখনো খোলা হবে কিনা নিশ্চিত ছিলাম না।  ২২৮৭ নাম্বারের সেই ২০০ টাকাটা ২০০০ টাকায় উন্নীত হতে আরো দশ বছর লেগেছিল। দশ বছর পর অবশ্য জীবনের মোড়টাই ঘুরে গিয়েছিল। সেই মোড়ের কথায় না গিয়ে এখন আবারো পেছন দিকে তাকাই।

হাজীপাড়ায় সেই বাড়িটার নাম ছিল সিরাজী মহল। বাসার এক তলায় আমাদের সদাশয় বাড়িওয়ালা বাস করতেন। তিনি নিতান্তই ভদ্রলোক। একসময় সিনেমায় অভিনয়ও করেছিলেন। নবাব সিরাজদৌলার যে সিনেমায় আনোয়ার হোসেন অভিনয় করে বাংলাদেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, সেই সিনেমায় তিনি গোলাম হোসেন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ভদ্রলোকের নাম ছিল শাহ গোলাম আহমেদ। গেট দিয়ে  ঢুকতেই ওনার সদর দরজা। সেই দরজার পাশে একটা সাইনবোর্ড সর্বদা টাঙ্গানো। সাইনবোর্ডে লেখা - শাহ সাহেব বাড়িতে নেই।
এরকম বিচিত্র সাইনবোর্ড আমরা আগে কখনো দেখিনি। আমাদের বাড়িতে আগত অতিথিরাও কখনো দেখেনি। তাই সবাই আসা যাওয়ার পথে সাইনবোর্ড পড়ে হাসতে  থাকে, শুধু তাই না কেউ কেউ সশব্দে আবৃত্তিও করে- শাহ সাহেব বাড়িতে নেই। ভদ্রলোকের পাওনাদারের সংখ্যা বেশী ছিল কিনা জানি না, কিন্তু তাঁর পাঁচ কন্যা আর এক পুত্রের কাণ্ড কিন্তু কম ছিল না।

দোতলা বাড়ির ছাদ আমাদের মাথার উপরই। একটা সুবিধা হলো, জামাকাপড় শুকানো যাবে ইচ্ছেমতো। কিন্তু বাড়িতে ওঠার একদিন পর বাসার এক অতিথি গোসল সেরে শাড়ি শুকাতে দেবার এক ঘন্টা পর তিনি কাপড় আনতে গেলে দেখেন তাঁর শাড়িটা নীচে লুটাচ্ছে। পাশে দাড়ানো বাড়িওয়ালার কন্যাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এটা ওদের ছাদ, তাই এখানে কাপড় শুকাতে দেয়া নিষেধ। তখনো ওদের পরিবারের কারো সাথে পরিচয়ই ঘটেনি। শুধু বাড়িওয়ালাকে দেখেছি আমরা। বাকীদের সাথে পরিচয় হবার আগেই শুরু হলো ছাদ কাহিনী। তখনো জানার অনেক কিছু বাকী ছিল। সন্ধ্যার সময় পাশের দোকানে চাল কিনতে গেলে দেখা হলো আমাদের স্কুলের হেডস্যারের সাথে। স্যার আমাকে দেখে অবাক। বললেন,তুমি এখানে কি করো। বললাম, আমি এই বাসায় উঠেছি। সাথে সাথে স্যারের চোখ কপালে। তুমি? এই বাড়িতে? কেমনে উঠলা? কখন উঠলা?

আমি স্যারের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। স্যার তখন বললেন, পাশের একতলা টিনশেড বাড়িটায় উনি ভাড়া থাকেন। ওটাও একই শাহ সাহেবের বাড়ি। কিন্তু ওটা তো পাগলের কারখানা। তোমরা খোঁজ খবর না নিয়েই উঠে গেছো? দোতলার বাসাটায় তো কোন ভাড়াটে তিন মাসও টেকে না।

আমি বললাম, খোঁজ নেবার সুযোগ ছিল না। বিপদে পড়ে উঠে গেছি। স্যার বললেন, উঠেছো যখন কি আর করা। দেখে শুনে চলবে।

চিন্তায় পড়ে গেলাম। দুপুরে বিনা কথায় খালাম্মার শাড়িটা যেভাবে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, ভবিষ্যতে আরো কি কাণ্ড দেখায় কে জানে!

ওদের ছোট মেয়েটা অবশ্য খুব ভালো। দেখতে খুব মিষ্টি। বয়স চার বছরের মতো। খুব আদর করে কথা বলে। একমাত্র ওর সাথেই আমাদের যোগাযোগ হয়। মেয়েটাকে আমরা সবাই খুব আদর করতাম বলে মেয়েটাও আমাদের বাসায় নিশ্চিন্তে খেলতো শোকেসের জিনিসপত্র নিয়ে। ছোটবোনের জন্মদিনে সে আমাদের সাথে বসে বসে সারাদিন বেলুন ফোলালো, ঘর সাজালো। সব কাজ শেষে অনুষ্ঠান শুরুর আগে ওকে বললাম, যাও নতুন জামা পরে আসো, ছবি তুলবো। বাড়িওয়ালার বাসার সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যায় দেখা গেল ওরা তো আসেইনি, ছোট মেয়েটাকেও আসতে দেয়নি। বেচারী কেঁদেকেটে ঘরে আটকে আছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল আমাদের। এ কেমন মানসিকতা।

ওর বড় আরো চারবোন ছিল। ওরা আট থেকে বারো ক্লাস পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাসে পড়তো। কি পড়াশোনা করতো জানি না তবে দিনের বেলার অধিকাংশ সময় ওরা ছাদে কাটাতো। ওদের ছাদ বিহার ওই পাড়ার তরুণদের অন্যতম বিনোদন। ওরা যখন ছাদে থাকতো তখন আশেপাশের নানান ছাদে ভিড় করতো উঠতি বয়সের তরুণেরা।

এত মেয়ের ভিড়ে আমি কখনো ছাদে উঠতাম না। একদিন কিছু বন্ধুবান্ধব বেড়াতে আসলে ওদের নিয়ে বিকেলটা ছাদে কাটালাম। বাড়িওয়ালীর কন্যাদের নিত্যদিনের কর্মসূচী সেদিন বাধার সম্মুখীন হলো। ওরা ছাদে উঠে আমাদের দেখে নেমে গেল। নেমে গিয়ে কি করেছে সেটা টের পেলাম সন্ধ্যার সময়।

বন্ধুদের বিদায় দিতে আমি বের হলাম ঘর থেকে। গলিপথে কিছুদূর যাবার পর একদল ছেলে আমাদের পথ আটকালো। বললো, আমরা কোন সাহসে ওই ছাদে উঠেছি।
আমি বললাম, ওটা আমার বাসা। আমার ছাদে উঠতে সাহস লাগবে কেন?
ওরা বললো, আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে তোমরা ওই মেয়েদের উত্যক্ত করেছো। তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি। আর যদি কোনদিন ছাদে উঠো, তাহলে ঠ্যাং ভেঙ্গে হাতে ঝুলায় দেবো।

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ওই পাড়ায় আমরা নতুন হলেও আমাদের কিছু দশাসই বন্ধুবান্ধবও ছিল যার মধ্যে দুজনের বেপরোয়া মাস্তানির খ্যাতি আছে। ঘটনাটা তাদের কানে গেলে সেই পাতি মাস্তানদের ডেকে উল্টো হুমকি দিল। পাল্টাপাল্টি হুমকির ঘটনায় আমাদের জিত হওয়ায় ছাদের উপর আমাদের রাজত্ব কায়েম হলো।

তবু আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ছাদে না উঠে বাসার সামনের খোলা বারান্দায় বসে আড্ডা দেবো। ওরা ওদের ছাদ নিয়ে থাকুক। ভেজালের দরকার নাই।

কিন্তু বারান্দার সামনে বসা নিয়েও ঝামেলা লাগলো আবার। এবারের ঝামেলা একটা পেয়ারা গাছ। নীচতলার ঘরের সামনে বাড়ীওয়ালার একটা পেয়ারা গাছ ছিল। পেয়ারা গাছটা হঠাৎ বড় হয়ে গেল লকলক করে এবং সুন্দর সুন্দর পেয়ারা ধরে আমাদের বারান্দার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। হাত বাড়িয়ে ধরলে আমরা পেয়ারা গাছে নজর দেয়া ছাড়া আর কিছু করলাম না, কেননা গাছটা আমাদের না। তাছাড়া পেয়ারাগুলো এখনো অনেক ছোট। খাবার যোগ্য হলে তখন দেখা যাবে। আমরা ধৈর্য ধরলেও বাড়িওয়ালার মেয়েরা ধৈর্য ধরতে পারলো না। ওরা আমাদের বারান্দায় ঢুকে কাঁচা কাঁচা সব পেয়ারা পেড়ে নিয়ে কিছু খেল আর অধিকাংশ নর্দমায় ফেলে দিল। আশংকা এই যে পেয়ারা যদি কোনদিন বড় হয় তাহলে আমরা যে কোন সুযোগে তা হাপিস করে দিতে পারি। আমাদের কোনরকম সুযোগ না দেবার জন্য অকালে সবগুলো পেয়ারাকে নর্দমায় আশ্রয় নিতে হলো।

কিছুদিন পর নতুন এক যন্ত্রণা। পাড়ায় কে কার সাথে 'লাইন' করে সেটা সবাই জানতো। বিশেষ করে আমাদের ছাদবিলাসী কন্যাগুলো ব্যাপার পাড়ায় রসের অন্যতম যোগানদার। বিভিন্ন ছেলের সাথে চোখাচোখি, কানাকানি, চিঠিপত্র, ফোনাফুনি সবকিছুই একসময় প্রকাশ পেয়ে যেতো। সেই সুত্রে তিন মাসের মধ্যে জেনে গেছি কোন মেয়ের সাথে কার কার 'লাইন' আছে। যাদের সাথে লাইন আছে তাদের মধ্যে আমাদের চেনা বন্ধুও ছিল।

বাড়িওয়ালার মেয়েদের সাথে আমার সাথে সাপে নেউলে সম্পর্ক হওয়াতে আমাদের পরিবার নিশ্চিন্ত ছিল যে ওদের কারো সাথে আমার অন্ততঃ লাইন-টাইন হবে না। তবু একদিন দুপুরের ভাতঘুমটা ভেঙ্গে গেল ছাদের উপর থেকে আসা একটা শব্দে। আমি প্রথমে ভাবলাম কেউ দরকারি কোন কাজ করছে। কিন্তু না। শব্দটা যেন কেউ একজন পা দিয়ে একটা ইঠ নাড়াচ্ছে। নাড়াচ্ছে তো নাড়াচ্ছে। একটু বিরতি দিয়ে আবারো। গরমে অস্থির এমনিতে, তার উপর ওই শব্দটা ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল। আমি গায়ে শার্ট গলিয়ে ছাদে উঠে দেখলাম বাড়িওয়ালার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেয়েটা পা দিয়ে  একটা ইঠ এদিক সেদিক নাড়াচ্ছে। সে আমাকে দেখামাত্র ভদ্রলোক। আমি কিছু না বলে বিরক্ত চাউনি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। এসে শোবার সাথে সাথে আবারো সেই শব্দ।

প্রতিদিন এই যন্ত্রণা দিতে থাকলো মেয়েটা। আন্দাজ করতে পারছিলাম এই শব্দ করে সে আমাকে ছাদে আহ্বান করছে, কিন্তু তার আহ্বানে সাড়া দেবার মতো মানসিক অবস্থা আমার কোনদিন ছিল না। তাই সাড়া দেবার বদলে একদিন আমি একটা পাথর এনে আমার ফ্লোরে ঘষাঘষি শুরু করলাম। সেই শব্দে থামাতে নীচতলা থেকে ছুটে এলো জ্যৈষ্ঠ কন্যার অভিযোগের আঙুল। আমি তখন পাল্টা আঙুল দিয়ে ছাদের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, ওটা বন্ধ হলে এটাও বন্ধ হবে। এভাবেই দুপুরের যন্ত্রণা লাঘব করা গেল সেদিন থেকে।

২৮ বছর পার হয়ে গেছে? আশ্চর্য হই। সময় কত দ্রুত চলে যায়। এই সেদিন ইন্টার পরীক্ষার রেজাল্টের দিন সকালে বন্ধুরা সবাই মিলে কাপ্তাই গেলাম বেড়াতে। সীতার ঘাটে সাম্পান থেকে নেমে পাহাড়ে উঠলাম। সাম্পানে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে গেলাম লেকের পানিতে। সাঁতার জানতাম না। সেই মাঝি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার না করলে আজকে এই গল্প লেখার সুযোগ হতো না।

আচ্ছা সেদিন যদি আমি ডুবে যেতাম, এত বছরে আমাকে কেউ মনে রাখতো? মা ছাড়া আর কেউ মনে রাখতো না আমি নিশ্চিত। আমাদের পরিবারের মোড়টাই ঘুরে যেতো না তখন? বর্তমান অবস্থায় থাকার কোন সম্ভাবনাই থাকতো না। কারণ এর দশ বছর পর আবার বাবা মারা যেতো। চার কন্যাকে নিয়ে অসহায় মা দুর্বিসহ জীবন কাটাতো। ভাগ্যিস যাইনি সেদিন। আমার এক বন্ধু কিন্তু চলে গিয়েছিল। সেই ক্লাস সেভেনেই। তুখোড় স্মার্ট একটা ছেলে। ওর বাবার একটা খান্দানী টেইলার্স ছিল। সৌখিন ভদ্রলোক। সুটেট বুটেট থাকতেন। আমার বাবার সাথে খাতির ছিল। সেই প্রথম একটা বন্ধু হারিয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম। আমরা তখন সিজিএস কলোনীতে থাকতাম। সেটা আরো আগের কথা। ৩৪ বছর আগে। যত পেছনে তাকাই, আরো পেছনে চলে যাই।