Wednesday, April 30, 2014

এপ্রিল ৩০, ২০১৪ অসংলগ্ন

অদৃশ্য এক ফেরারী বেদনা নিয়ম করে প্রতিদিন ছুঁয়ে যায় আমার রোমকূপ, স্নায়ু, রক্ত, হৃদপিণ্ড আর স্মৃতিপ্রকোষ্ঠ।

রুটিন মেনে আরো ছুঁয়ে যায় রাস্তার ধুলো, ধূসরতম বিষাক্ত ধোঁয়া, উষ্ণতম নাগরিক যানজট, হেঁটে যাওয়া পথের বিপন্নতা।

চোখের সামনে ভাসতে থাকা ফুটপাতের চটপটি ফুচকা, ঝালমুড়ি, ছোলা-বাদামের পসরা, আলুনি বেগুনী পিঁয়াজুদের খাপখোলা ঘ্রাণ।

আমি জানি তোমরা সকলেই আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসো। কেবল আমি একাই হারিয়ে ফেলেছি সন্নিবদ্ধ ভালোবাসার শক্তিধারা।

উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সকল গন্তব্য আমার দিগদর্শন যন্ত্রকে বিভ্রান্ত করে। আমি তাই কোথাও যাই না, কোন প্রত্যাশা রাখি না। সময় পেলেই স্বেচ্ছাবন্দী জীবনের উপভোগ্য সময়কে পকেটস্থ করি।

Tuesday, April 29, 2014

জীবনের বিকেল অথবা সন্ধ্যা

একসময় বলতাম জীবনের মাঝপথে এসে গেছি, সময় বেশী নেই। অনেক অনেক কাজ বাকী। সেই অনেক কাজের খুব সামান্য অংশই শেষ করেছি। আরো নতুন কাজ এসে জমা হয়ে গেছে।

আজকাল বলি জীবনের দুপুর শেষ হয়ে বিকেলও গড়ানোর পথে। আগের কাজ, নতুন আসা বাকী কাজ সবগুলোই কি শেষমেষ অসমাপ্ত থেকে যাবে? কাজ না হয় অসমাপ্ত থাকলো। বইগুলোও কি না পড়া থেকে যাবে? ছাত্রজীবনে মাসে একটা বই কিনতে পারলেও ধন্য হয়ে যেতাম। তখন একটা বই পড়ে হা করে থাকতাম কখন আরেকটা বই কিনতে পারবো। একবার সস্তায় জলের দরে প্রায় বিশ পঁচিশখানা বই কিনে ফেলেছিলাম। সেদিন আমার ঈদ। পরবর্তী এক মাস কোন বই ভাবনা ছিল না। গোগ্রাসে গিলে গেছি সব।

আজকাল পাঁচটা বই কেনা হয় একসাথে, একটা পড়তে পড়তে সপ্তাহ পার। এরমধ্যে আবারো যদি বইয়ের দোকানে ঢুকি আরো তিন চারটা বই চলে আসে। এখন আগের চারটা না পড়া বইয়ের কথা ভুলে নতুন কেনাগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ি। এভাবে যখনই নতুন কেনা হয় পুরোনো বইগুলো পেছনে পড়ে যেতে থাকে। তার উপর আছে বদভ্যাস। সবচেয়ে মজাদার বইটা জমিয়ে রাখি পরে পড়বো বলে। এরকম অনেক মজার বইয়ের কথা ভুলে যাই নতুন আরেক মজার বই পেয়ে। হঠাৎ হঠাৎ যখন অন্য বই খুঁজতে গিয়ে ওই বইয়ের সামনে পড়ে যাই তখন প্রাণহীন বইটার দিকে আমি দুঃখিত চোখে তাকাই। সেদিন দেখলাম দুঃখিত চোখে তাকানোর মতো বইয়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সুতরাং আমাকে নতুন বই কেনা স্থগিত রাখতে হলো। জীবনের বিকেল শেষ হবার আগেই বইগুলো পড়া শেষ করতে হবে।

জীবনের সন্ধ্যাবেলা কারো কারো দীর্ঘ হয়, কারো কারো খুবই অল্প। আমি জানি না আমার কতটা সময় হাতে থাকবে। কিন্তু ওই সময়টা খুব বেদনাদায়ক। শ্যামল বন্দোপাধ্যায়ের ডুমুর গাছের গল্পটার কথা ভেবে শিউরে উঠি যেখানে একজন দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর ধরে জীবনের সন্ধ্যাবেলায় ধুঁকেছিল। ওই মানুষকে নিজের কন্যা আর জামাই মিলে একটা ট্রেনে তুলে নিরুদ্দেশ যাত্রায় পাঠিয়ে পত্রিকায় একটা নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি আর একটা পুলিশে একটা ডায়েরী লিখে নিজেদের বোঝা হালকা করেছিল।

গল্পের কথা থাক। বাস্তবের কথা বলি। চেনা মানুষের কারো কারো জীবনের সন্ধ্যাবেলা দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। দুর্ভাগ্য বলছি এই কারণে দশ বছর আগে যারা জীবনের সুখী বিকেলে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে, সেই একই মানুষ দশ বছর পর দুর্বিসহ জীবনসন্ধ্যা পার করছে। সমগোত্রীয় মানুষ ছাড়া সমব্যথী হবার কেউ নেই তাদের। সমগোত্রীয়গণ সমব্যথী হলেও সহযোগীতায় অপারগ। কারণ সবাই মোটামুটি একই মাত্রার ভিন্ন ভিন্ন দুর্ভোগে দিন পার করছে। কেন এই দুর্ভোগ?

আমি কেবল একজনের কথা বলছি আজ। তিনি সরকারী চাকরীতে ত্রিশ বছর সৎ জীবনযাপন করার পর অবসর গ্রহন করার সময় যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে ছোট একটা বাড়ি তৈরী করেন অংশীদারী ভিত্তিতে। বাড়িটার এক ফ্ল্যাটে তিনি বাস করেন, অন্যফ্ল্যাট ভাড়া। চারতলা বাড়ির বাকী দুটো ফ্ল্যাট অংশীদারের। তিনি ছেলেমেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী পর্যন্ত পার করে নিজের টাকা দিয়ে তাদের বিয়েও দিয়েছেন। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি, ছেলেরা সঙ্গে আছে। তাঁকে একজন সফল মানুষ বলা যায়। এখন ষাট বছর বয়সে তাঁর নিরিবিলি অবসর জীবনযাপন করার কথা।

কিন্তু সেই অবসর ব্যাপারটি হচ্ছে না। এত বছর ধরে একটু একটু করে যতটা সঞ্চয় করেছিলেন, সবকিছু খরচ করে ফেলেছেন বাড়ি করার কাজে এবং ছেলেমেয়ের বিয়েতে। কিছু ঋনও করতে হয়েছে, একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া দিয়ে সেই ঋন পরিশোধ করতে হচ্ছে। সুতরাং তার হাত একেবারেই খালি। ছেলেরা কিছু দিলে পান, নইলে না। ছেলেরা খুব ভালো আয় করে না, তাই ওনার হাত খালিই থাকে। এর মধ্যে একদিন স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার ভয়াবহ সব খবর দিলেন। স্ত্রীর ডায়াবেটিস বহুবছর, এখন তার কিডনী, হার্ট, স্নায়ু, চোখ, দাঁত সবকিছু অকেজো হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার জন্য যে পরিমান টাকা দরকার সেই টাকার এক শতাংশও নেই তার কাছে। ছেলেরা কিছুই করতে পারছে না। অসহায় ভদ্রলোক ভাবতে থাকেন, কি করবেন। শহরে একটা চারতলা দালানের অর্ধেকের মালিক তিনি, কিন্তু কী সর্বস্বান্ত জীবন। এই বাড়ির একটা অংশ বিক্রি করলেও স্ত্রীর চিকিৎসা করা সম্ভব। কিন্তু ছেলেরা বাড়ি বিক্রিতে নারাজ। এই বাড়ি বিক্রি হলে তাদের ভাগে কিছুই থাকবে না। ভবিষ্যত অন্ধকার। এখন তিনি জানেন না, স্ত্রীর জীবন বড় নাকি ছেলেদের ভবিষ্যত বড়। সম্পদ তার কিন্তু সিদ্ধান্ত ছেলেদের। ছেলেরা বিয়ের পর মায়ের প্রয়োজনীয়তা ভুলতে বসেছে। এখন সবাই যার যার সংসারে মনযোগী। মায়ের কয়েক বছরের আয়ুর বিনিময়ে তারা ভবিষ্যতের অন্ধকার দেখতে চায় না। ভদ্রলোক তার জীবনের সন্ধ্যাবেলাতেই অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন।

এই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে চাই না বলে আমি জীবনের সন্ধ্যাবেলা দেখতে চাই না।


Monday, April 28, 2014

কৃতঘ্নের একদিন

সুবর্ণ এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগির ঝাপসা জানালা দিয়ে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিটা বাড়িয়ে দিলাম বাইরে। ঢাকা এখন আমার কাছে অচেনা একটা শহর। আমার স্মৃতির ঢাকা শহরের সাথে এই গিজগিজ উঁচু দালানের ধোঁয়াটে শহরের কোন মিলই নেই। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্ম আমার খুব চেনা। আমাকে দেখেই যেন ওরা ডাক দিল। কিন্তু আমি কোন ডাক শুনতে আসিনি। টুকরো টুকরো মোজাইকের নকশা মাড়িয়ে আমি এগিয়ে গেলাম টিকেট চেকারের দিকে।

দুপুর সোয়া একটা বাজে। কমলাপুর নামতেই গরমের ঝাপটা মুখে চড় মারলো। গেট পার হয়ে আস্তে আস্তে রাস্তার দিকে হাঁটছি। মোড়ের কাছে একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। সারাদিনের জন্য ভাড়া করলাম চেনা জানা জায়গাগুলো ঘুরেফিরে দেখার জন্য। উদাস হয়ে গেল মনটা। এই শহরে আমার চেনা কেউ নেই। আমার কোথাও যাবার নেই। কয়েক ঘন্টার জন্য এসেছি। দিনের বাকীটা কাটিয়ে রাতের ট্রেনেই ফিরে যাবো। আমি শুধু ঢাকার বাতাসের একটু ঘ্রাণ নিতে এসেছি আর ছোট্ট একটা কাজ…..

কতযুগ পর আসলাম এখানে? রিকশার চাকার সাথে স্মৃতির সেলুলয়েড ঘুরতে শুরু করলো।

আমি কোথায় জন্মেছি মনে নেই। কিন্তু মনে আছে কোথায় বেড়ে উঠেছি। আমি বেড়ে উঠেছি ফুটপাতে, রেলস্টেশানে, মার্কেটের বারান্দায়। আমার কখনো কোন বাবা ছিল না। একজনকে মা ডাকতাম কিন্তু একটু বড় হয়ে জেনেছি সে আমার আসল মা নয়। খুব ছোটকালে আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। একদিন সেও কোথাও উধাও হয়ে যায় আমাকে ফেলে। এরপর আমি নিজের যুদ্ধটা নিজেই করতে শিখে গেলাম। আমার কেউ নেই তবু খিদে পেলে বা ব্যথা পেলে আমি মা মা করতাম, এমনকি এখনো করি, কেন করি আমি জানি না। আমার মাতৃতৃষ্ণা দূর হবার নয়।

শৈশবের স্মৃতি বলতে যা আছে সেটা শুধুই খাবারের কষ্ট। আমার সারাক্ষণই খিদে লাগতো। খিদে ছাড়া আর কোন সমস্যা মনে পড়ে না। আমার কোন ঘর নেই। তাতে কি, খোলা আকাশের নীচে যে কোন জায়গায় আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যেতে পারি। আমার কোন জামা নেই, তাতে কি?একটু খুঁজলেই কোন বাড়ির আশপাশে দুয়েকটা ছেড়া প্যান্ট খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু খিদেটা বড্ড জ্বালাতন করতো। আমি যেখানে খাবার খুঁজে যেতাম, সেখানে কিছু কাক আর কয়েক কুকুর সেই খাবার নিয়ে ঝগড়াঝাটি লাগাতো। আমি ওদের সঙ্গে পেরে উঠতাম না। তাছাড়া কুকুর আমার ঘেন্না লাগতো। কারণ ওরা প্রায়ই আমার ঘুমানোর জায়গাটায় পেচ্ছাব করে যেতো।

কিন্তু একদিন একটা ঘটনা ঘটলো। এক বিয়েবাড়ির ফেলে দেয়া খাবার কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে কঠিন মার খেলাম সঙ্গীদের কাছ থেকে। মার খেয়ে রক্তাক্ত শরীরে বাড়ির গেটের কাছে অজ্ঞান পড়েছিলাম। আমার জ্ঞান ফিরলো একটা পাকা ঘরের ভেতর। তখন শীতকাল, আমার শীত করছিল খুব। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। চারদিকে বদ গন্ধ ভোঁ ভোঁ করছে। গিজগিজ করছে কাটাছেড়া ব্যাণ্ডেজ দেয়া মানুষ। এ কোন জায়গা? মার কাছে দোজখের গল্প শুনছিলাম, এটা সেই জায়গা না তো?

ভয়ে আমি এতটুকু হয়ে গেলাম। হাতটা নাড়াতে গিয়ে খুব ব্যথা করলো। উঠে বসতে চাইলেই কোত্থেকে একটা বাজখাই গলা হুংকার দিয়ে উঠলো, ওই পোলা!! উঠিস না, চুপ করে শুয়ে থাক!!

জায়গাটা হাসপাতাল। হুংকারের মালিক একজন দয়ালু নার্স। কয়েকদিন পর একটু সুস্থ হতে আমাকে একজন এসে বাইরে নিয়ে গেল। অচেনা লোক। আমি কিছু না বলে লোকটার পিছু পিছু একটা রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশাটা যেখানে থামলো সেই বাড়িটা দেখেই চিনলাম। এটা সেই বাড়ি যে বাড়ির বিয়ের খাবার নিয়ে মারামারি করছিলাম।

বাড়ির মালিক আমাকে দেখে বললেন, এখন থেকে আমি যেন ওই বাড়িতে থাকি। আমার জন্য বরাদ্দ হলো বুড়ো দারোয়ানের নীচতলার ঘরটা। যে লোকটা আমাকে নিয়ে এসেছিল, সে বাড়ির দারোয়ান।

সেই যে খাবারের যুদ্ধে মার খেলাম, বাড়ির মালিকের একমাত্র মেয়ের বিয়ে ছিল সেদিন, মেয়ের বিয়ের পর বুড়ো একা হয়ে পড়ে। বিশাল বাড়িতে আর কেউ নেই। বউ মরে গেছে বহুবছর আগে। আমাকে সেদিন অজ্ঞান পড়ে থাকতে দেখে তার কেন যেন তার প্রথম সন্তানের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। যে ছেলে দশ বছর বয়সে কঠিন রোগে মারা গিয়েছিল বহুবছর আগে। আমাকে তাই হাসপাতালে পাঠিয়ে সুস্থ করে তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল।

আমার জীবনের নতুন এক পর্ব শুরু হলো সেদিন থেকে। পরবর্তী নয় বছর আমি ওই বাড়িতে ছিলাম। আমার কোন বেতন ছিল না। কিন্তু ছিল অবাধ স্বাধীনতা। বয়সে ভারাক্রান্ত হয়ে আগের দারোয়ান চাকরী ছেড়ে দিলে আমি নতুন দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ পাই। শুধু দারোয়ানী না, এ বাড়ির সকল কাজের কাজী। এত বড় বাড়িতে আমি আর বুড়ো ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়ের বিয়ের আগে আত্মীয় স্বজন আসতো মাঝে মাঝে। মেয়েটার বিয়ের পর আর কেউ আসে না। বিয়ের পর মেয়েটাও বিদেশে চলে যায় বরের সাথে। বুড়োকেও বিদেশে চলে যাবার কথা বলে। কিন্তু তিনি যেতে রাজী নন। মাঝে মাঝে বেড়াতে যান, কয়েক মাস থেকে আবার ফিরে আসেন। বুড়ো দেশের বাইরে থাকলে পুরো বাড়ি আমার দখলে। বুড়ো না থাকলে এই নির্জন বাড়িতে কেউ আসেও না।

বাড়িটা যখন আমার দখলে থাকে তখন আমি কিছু আলগা কামাই করি। মাঝে মাঝে এটাকে ভাড়া দেই দুয়েক রাতের জন্য। ঢাকা শহরে প্রেম করার নিরাপদ জায়গার খুব অভাব। হোটেলে নানান ঝামেলা। এরকম জায়গা পেলে লোকজন বেশী ভাড়ায়ও রাজী হয়।

আমার এক হোটেল দালালের সাথে আলাপ আছে। সে আমার জন্য কাস্টমার যোগাড় করে। বেশীরভাগ বয়স্ক মানুষ। দেখলেই বোঝা যায় টাকাওয়ালা। একদম চ্যাংড়া কিছু কাস্টমারও আসে মাঝে মাঝে। এদেরকে জায়গা দেয়া রিস্কি, হৈ হুল্লোড় করে বান্ধবী নিয়ে। আশেপাশে লোক জানাজানি হবার ভয় আছে। তবু ভাগ্য ভালো যে বাড়িটার লাগোয়া আর কোন ঘরবাড়ি নাই। চারপাশ গাছপালায় ঘেরা নির্জন একটা বাড়ি। নইলে এই গোপন ব্যবসাটা অসম্ভবই ছিল।

সেদিন এক বয়স্ক লোক একটা ঘর ভাড়া নিল তিনদিনের জন্য। চেহারায় অভিজাত লোকটার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। সাথে তরুণী এক মেয়ে। অন্য কোথাও দেখলে লোকটার নিজের কন্যা মনে করতাম ওকে । কিন্তু এখানে সবাই পরের কন্যাদের নিয়েই আসে। এনে কি করে আমার ভালোই জানা আছে। করলে করুক। আমার পকেটে টাকা আসলেই হলো। দিনে দুই হাজার টাকা ইনকাম হয় দালালের পাঁচশো বাদ দিলে। আমি চাইলে একসাথে চার পাঁচ জোড়াকে ভাড়া দিতে পারি। কিন্তু অত লোভ করলে সব ভেস্তে যাবার সম্ভাবনা আছে। একরাতে এক জোড়া। তার বেশী না। মাঝে মাঝে কিছু জুটি একদিনের জন্য ভাড়া নিয়েও মাত্র ঘন্টা দুই মৌজ করে চলে যায়। তখন আরেক দফা ভাড়া দেয়া যায় বিকালের শিফটে।

এই লোকটাকে প্রথম দেখাতেই আমার অপছন্দ হলো। ভদ্রলোক দেখতে খুব সৌম্য শান্ত ভদ্র গম্ভীর। মোটা পাওয়ারের চশমা। কিন্তু এরকম একটা ভদ্রলোকের ভেতরে কীরকম অমানুষ বাস করলে তার মেয়ের বয়সী এই তরুণীকে নিয়ে রাত কাটাতে আসে? আমি কখনো কোন কাস্টমারের রুমে আড়ি পাতি না। তারা তাদের মতো যা খুশী করুক। আমি আমার ঘরে ঘুমাই। কিন্তু এই লোকটাকে দেখে আড়ি পাতার ইচ্ছে হলো আমার। লোকটা মেয়েটাকে কি কথা বলে জানতে ইচ্ছা করে। পারলে চোখও পাততাম।

মেয়েটা অতি সুন্দরী আর যৌবনবতী। রুমে ঢুকেই দুজনে দরোজা বন্ধ করে দিল। রাতের খাবার খেয়ে শোবার আগে আমি পা টিপে টিপে ওদের রুমের বাইরে দাড়ালাম। তারপর দরোজায় কানটা লাগিয়ে শুনতে লাগলাম। কয়েক মিনিট শোনার পর আমার কান লাল হয়ে আগুন ঝরতে লাগলো। এসব কি কথাবার্তা। জিন্দেগীতে এরকম কিছু শুনি নাই। আমার শরীর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলো। মাথা ঘুরাচ্ছে উত্তেজনায়। আমি পালিয়ে নিজের ঘরে এলাম।

পরদিনও সারাবেলা ওরা ঘরের মধ্যে কপোত কপোতির মতো কাটালো। মাঝে একবার বেরিয়ে লোকটা হোটেল থেকে খাবার ইত্যাদি কিনে আনলো। আমি যেন কিছুই খেয়াল করছি না এভাবে থাকলাম। কিন্তু কানটা সবসময় খাড়া। লোকটা প্রায় অশ্লীল রসিকতা করছে মেয়েটার সাথে। এই শব্দগুলো কোন ভদ্রলোকের মুখ থেকে বেরোতে পারে আমি ভাবতেই পারি না। আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো মেয়েটার জন্য। সত্যি বলতে কি আমার মধ্যে অন্যরকম একটা বোধ জেগে উঠছে। মেয়েটাকে পাবার এক দুর্মর বাসনা ভেতরে কম্পন তুলতে শুরু করেছে। যে কোন সময় ঝড় উঠতে পারে।

মনটাকে অন্যদিকে ঘুরাবার জন্য বাগানের কাজ শুরু করলাম। মাটি কাটলাম। গাছপালা ছাঁটলাম। ঘাসগুলো সমান করলাম। পাইপ দিয়ে সমস্ত বাগানে পানি দিলাম। পাশের দোলনাটাকে ঝেড়ে মুছে পরিস্কার করলাম। তারপর অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল সারলাম। মাথায় বেশ করে পানি দিলাম। কিন্তু কিছুতেই আগুন নিভছে না।

রাতে আবারো সেই দুর্মর কৌতুহল। পা টিপে টিপে হাজির হলাম ওদের ঘরের কাছে। হঠাৎ দরোজা খুলে মেয়েটা  ডাইনিং এ বেরিয়ে এল পানি খেতে। আমি চট করে সরে গেলাম আড়ালে। ওখান থেকেই মেয়েটার বন্য সৌন্দর্যের সবটুকু দৃষ্টি দিয়ে শুষে নিতে লাগলাম। মেয়েটা এমন স্বচ্ছ একটা জামা পরে আছে যা পুরুষ মাত্রেরই মাথা নষ্ট করবে। আমার কপালের দুপাশের রগগুলো দপদপ করছে। ঘামতে শুরু করেছি ভেতরে। মেয়েটা পানি খেয়ে রুমে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিল আবার।

এরপর আমার মাথায় একটা তড়িৎ প্ল্যান খেলে গেল। আমি কান পাতা বাদ দিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর পা টিপে টিপে দরোজার কাছে দাঁড়ালাম। কান পেতে কোন শব্দ পেলাম না। নাক ডাকছে লোকটা। মেয়েটাও ঘুম নিশ্চয়ই। দরোজায় মৃদু টোকা দিলাম।

-স্যার, দরজাটা খোলেন।
-(কোন সাড়া নাই)
-স্যার, দরজাটা খোলেন, একটা বিপদ হইছে।
-কে, কে? (মেয়েটার ভীত সন্ত্রস্ত গলা পাওয়া গেল)
-আমি ম্যাডাম। দরোজাটা খোলেন। বাইরে পুলিশ।
-অ্যাই, অ্যাই যে ওঠেন, বাইরে নাকি পুলিশ।
-হোয়াট দ্য ফাক (লোকটা বিরক্তির সাথে বলে উঠলো)
-স্যার জলদি খোলেন, বিপদ আছে বিপদ।

লোকটা দরোজা খুলে বাইরে আসামাত্র আমার হাতের শাবলটা সরাসরি লোকটার মাথার উপর। আমি খেয়ালই করলাম না লোকটা অজ্ঞান হলো নাকি মরে গেল। আমার মাথায় তখন স্বচ্ছ পোষাকের মেয়েটা। চিৎকার দিয়ে উঠলো মেয়েটা। এবার আমি শাবলটা উঁচিয়ে মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, আওয়াজ করলে তোমারও ওই দশা হবে। একদম চুপ!

মেয়েটা এরপর একদম জোরাজুরি করেনি। যেভাবে যা চেয়েছি, সব দিয়েছে। আমি বাকী রাতটা মেয়েটাকে নিয়ে কাটিয়ে সকালে উঠে ব্যাগট্যাগ গোছালাম ধীরে সুস্থে। বাড়িতে টাকা পয়সা, সোনা দানা যা ছিল, সব পুটলি করে বেঁধে নিলাম। এই বাড়িতে নয় বছর থাকার কোন স্মৃতি আমাকে আলোড়িত করছে না। এখন একমাত্র চিন্তা পালাতে হবে দ্রুত। আশ্চর্য পাষাণ আমার মনটা।

মেয়েটার কাছ থেকে জানলাম লোকটা একটা ব্যাংকের বড় কর্তা। মেয়েটা একটা ভদ্র পরিবারের সদ্য পাশ করা নবীন অফিসার। প্রমোশনের লোভ দেখিয়ে নানান জায়গায় বেড়াতে নিত ওকে। কিন্তু তাতে পোষাচ্ছিল না তার। তাই চুড়ান্ত কিছু করার জন্য এখানে নিয়ে এসেছিল বড় কর্তা। মেয়েটার চেহারায় একরকম অপরাধবোধ দেখা যাচ্ছে। যেন সে কাঁদতে চাইছে কিন্তু পারছে না।

আমি মেয়েটাকে বললাম, “আমি চলে যাচ্ছি তুমিও পালাও জলদি। তবে যদি এই খুনের ঘটনা পুলিশকে জানাও, তাহলে আমার ফাঁসি হলেও, তোমারও কয়েক বছরের জেল হবে, খুনের সহযোগিতা করার জন্যে। তাছাড়া জেল হবার পাশাপাশি তোমার এই অভিসারের খবর পত্রিকায় ছাপানো হবে। বিখ্যাত হয়ে যাবে তুমি। ভেবে দেখো, কী করবে। তার চেয়ে আমি বলি কি, সব চেয়ে ভালো হবে তুমি এখানে কোনদিন আসোনি। একদম চেপে যাও সব। এই দুদিন তুমি ঢাকা শহরেই ছিলে না। বান্ধবীর সাথে বেড়াতে গিয়েছিলে সিলেট বা চট্টগ্রাম।”

আমার পরামর্শ যেন মেয়েটার পছন্দ হলো। রাজী হলো সে। নিজের বিপদটা টের পেল। ভদ্র পরিবারের মেয়ে। এরপর দুজনে নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বের হয়ে দুই দিকের রাস্তা ধরলাম। পেছনে পড়ে থাকলো সেই অনাকাংখিত লাশ।

ঠিকানাবিহীন লোকদের জন্য বাংলাদেশ চমৎকার একটা জায়গা। যদি খুন খারাবি করতে চাও, ঠিকানাবিহীন হও। কেউ তোমাকে খুঁজবে না। বাংলাদেশ হলো ঠিকানাবিহীন অপরাধীদের স্বর্গ। আমি ওখান থেকে পালিয়ে প্রথমে চট্টগ্রাম, তারপর সোজা টেকনাফ হয়ে সেন্টমার্টিন। একটা জেলে নৌকায় কাজ যোগাড় করলাম। পরিশ্রম করলে কী না হয়। কয়েক বছর পর নিজেই একটা নৌকার মালিক।

মাছ ধরার ব্যবসার পাশাপাশি অন্য আমদানী রপ্তানীর ব্যবসাও চলতে শুরু করলো। দিনের আলোয় বার্মা যাওয়া আসা করি। নাসাকা বাহিনীর সাথে খাতির হয়ে গেছে। ওরাই আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে মাঝে মাঝে। এভাবেই চলছিল।

টাকার অভাব চলে গেছে কবেই। নিজেরই কয়েকটা ট্রলার আছে এখন। জায়গা জমি বাড়ি কিনেছি কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, টেকনাফে। ঢাকাতে কিছু করি নাই কেন যেন। ভয়টা এখনো? তবে ঢাকায় গেছি কয়েকবার। সেই ঘটনার দশ বছর পর একদিন ওই বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখি একটা বহুতল ভবনের সাইনবোর্ড। বাড়িটা কি বিক্রি হয়ে গেছে? কি হয়েছিল শেষে? কিছুই জানি না।

হঠাৎ আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। রিকশাওয়ালা পেছনে ফিরে একবার তাকালো।

আমি বললাম, তুমি তোমার মত চালাও, আমি এমনি এমনি হাসি, নিজের সাথে কথা বলি।

তারপর বিড়বিড় করতে থাকলাম - আসলে তো কিছুই ঘটেনি। এই বাড়িতে কেউ আসেনি। কেউ ফিরে যায়নি। মেয়েটা তখন সিলেটে বেড়াতে গিয়েছিল। আর আমি? ঢাকা শহরে আমার কোন অস্তিত্বই ছিল না তখন। আমি জন্মেছি টেকনাফে, বাংলাদেশী নাগরিক। আমার কোন নাম ছিল না। লতু বলে ডাকতো সবাই। আসল নাম বলতে কিছু ছিল না। ছিল না বাবা মায়ের নাম। আমি কিছুই জানতাম না আমার।

অথচ এখন? এখন আমার সকল পরিচয় লিপিবদ্ধ করা আছে জাতীয় পরিচয়পত্রে। মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ করে আমি আঙুলের ছাপ দেয়া বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে গেলাম ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে। এখন আমার নাম লতিফ আকবর। পিতা: শওকত আকবর। মাতা: জোহরা বেগম। জন্মতারিখ: ২রা আগষ্ট। রক্তের গ্রুপ-এবি+। আমার আইডি নং ১৫৭৮৯২........। এই আইডি ফুলের মতো পবিত্র। এই আইডি থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কোন অপরাধের নজীর নেই। বানোয়াট পরিচয়পত্র নিয়ে আমি নিশ্চিন্তে বাংলাদেশের পবিত্র ভূমিতে আচড় কাটতে শুরু করলাম।

ঢাকা শহরের সবগুলো চেনা জায়গায় রিকশা নিয়ে ঘুরে ঘুরে দিন পার করে দিলাম। মাঝে দুবার বিরতি নিয়েছি। দুপুরে লাঞ্চ করেছি, বিকেলে চা খেয়েছি। তারপর সর্বশেষ গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম। ধানমণ্ডির একটা বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড় করালাম। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। রাস্তার ভিড় কমেনি এখনো। লেকের পাড়ে লোকজন বসে আড্ডা দিচ্ছে। চটপটি ফুচকা খাচ্ছে।

আমি যে বাড়ির সামনে নামলাম সেই বাড়িটায় এখন কে থাকে আমি জানি না। বাড়িটার গেট বন্ধ ভেতর থেকে। নক করার সাহস হলো না। কী পরিচয় দেবো। আসল পরিচয় দিলেও কেউ চিনবে না। আসল পরিচয় কী? ফুটপাতে বড় হওয়া লতু? না হবে না। চুরি করেই ঢুকতে হবে। রাত হোক। আরেকটু নির্জন হোক পথঘাট। অভিজাত এলাকায় একটা সুবিধা। পথের ধারে দোকানপাট খাড়া হয়ে থাকে না। রাত আটটা নটা বাজতেই সুনসান। অপেক্ষা করি। রিকশাওয়ালাকে বিদায় করে দিয়েছি।

একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করে খেয়ে নিলাম। টেবিলে বসে যেটুকু বিদ্যা আছে সেটুকু বিদ্যা দিয়ে একটা চিঠি লিখলাম। চিঠিতে মেয়েটার নাম লিখলাম। তারপর প্যাকেটটা খুলে ওটার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম চিঠি।

নটার পর নির্জন হয়ে গেল গলিটা। দেয়াল টপকে ঢুকতে কোন সমস্যা হলো না। একসময় অনেক এসেছি এই বাড়িতে। এটা সাবিহার শ্বশুরবাড়ি। সাবিহা হলো আমার আশ্রয়দাতা বুড়োর মেয়ে যে আমেরিকায় চলে গিয়েছিল। দেশে বেড়াতে এলে এই বাড়িতে থাকতো। চিঠি আর জিনিসটা সাবিহাকে দেবার জন্যই। বাড়িটা এখনো প্রায় আগের চেহারায় আছে। ওদের ড্রইং রুমের দরোজার পাশে বড় একটা জানালা। ওটার একটা পাল্লা খোলা। বাতি জ্বলছে ভেতরে। উঁকি দিয়ে দেখি কে এক মহিলা বসে আছে, টিভি দেখছে। সাবিহার কোন আত্মীয়া হতে পারে।  জানালার পাশে একটা সোফা। ওটায় রাখতে হবে জিনিসটা। আমি হাত ঢুকালেই মহিলা দেখে ফেলবে। দেখে ফেললেও উপায় নাই। দ্রুত সারতে হবে। জিনিসটা টুপ করে সোফার উপর ছেড়ে দিলাম। সাথে সাথে মহিলার গগনবিদারী চিৎকার। চোর চোর চোর!!!

আমি এক দৌড়ে দেয়াল টপকে সোজা বাইরে গিয়ে গলির উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করি। ততক্ষণে মহিলার সাথে আরো অনেক চিৎকার যোগ হয়েছে। লোকজন জড়ো হচ্ছে। আমাকে খুব জলদি এলাকা ছাড়তে হবে।

কমলাপুর পৌঁঁছে একটা সিগারেট ধরিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে আমার প্রাক্তন ঘুমাবার জায়গাগুলো দেখতে দেখতে ভাবছি। ওরা এতক্ষণে প্যাকেট খুলে চিঠি পড়তে শুরু করেছে-

আপা, আমি লতু। আপনি আমাকে অন্ততঃ নামে চিনবেন। বহুবছর আগে আমি আপনাদের বাড়িতে কাজ করতাম। পালাবার সময় আমি অনেক জিনিসের সাথে একটা ছবিও চুরি করি সোনার ফ্রেমের লোভে। আমি জানি চাচা আমাকে কোনদিন ক্ষমা করেননি, আপনিও করবেন না। আমি জীবনে অনেক অপরাধ করেছি, আপনাদের কাছ থেকে চুরি করা অনেক জিনিস বিক্রি করেছি, কিন্তু আপনার ভাইয়ের ছবিটা কিছুতেই বিক্রি করতে পারিনি। আমার আর কোন অপরাধ আমাকে এতটা পোড়ায়নি যতটা পুড়িয়েছে এই ছবিটা। আমি আপনার বাবাকে সারা জীবনের জন্য বঞ্চিত করেছি এই ছবি থেকে। আপনার বাবা হয়তো বেঁচে নেই। তবু আমার ইচ্ছে এই ছেলের ছবিটা অন্ততঃ তার বোনের কাছে থাকুক।

Wednesday, April 23, 2014

ভয়কেতু

বৈশাখী মেঘের বিকট সংঘর্ষজনিত দ্রুমদ্রামের ত্রিতাল তরঙ্গে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এর পরপরই বুঝতে পারলাম কী ভয়াবহ ভুল করে বসেছি। এই ঘরে ঘুমিয়ে পড়া আর মৃত্যুদুতের কোলে শুয়ে থাকা প্রায় একই জিনিস। এ পর্যন্ত তিন জন প্রাণ হারিয়েছে পাহারার সময় ঘুমোতে গিয়ে। আজ কি আমার পালা?

আমি নিজেই কাজটা নিয়েছি। আমার প্রাণটা কৈ মাছের প্রাণের চেয়ে শক্ত এবং টাকার অংকটা বেশ মোটা বলেই সিদ্ধান্ত নেয়া।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আরেক দফা চমকে উঠলাম। ঘড়িতে এখনো সোয়া দশটা! মানে কী? রাতের খাবারের সময মুরগীর হাড় চিবোতে গিয়ে যখন আক্কেল দাঁতটা ক্যাচ করে উঠেছিল তখনো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম পৌনে দশ। এরপর কমপক্ষে দুঘন্টা বসে বসে 'সবজি' টেনেছি। তবু এখনো বাজে সোয়া দশ - ব্যাপারটা গোলমেলে তো! কাছে গিয়ে আবছা আলোতে কয়েক মিনিট ভালো করে তাকিয়ে থেকে বুঝলাম এই ঘড়ির ঘন্টার কাঁটাটা অচল হয়ে গেছে। মিনিটের কাঁটাটাই ঘুরে ঘুরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এখন তাহলে সময় বোঝার উপায় কি?

এই গ্রামে কোন বিদ্যুত নেই। ঘরের এক কোনে টিমটিম করে যে হারিক্যানটা জ্বলছে, সেটাও নিভে যাবার সময় হয়ে এসেছে। হারিক্যান নিভে গেলে টর্চলাইট ভরসা। কিন্তু ওই জীবটা টর্চলাইট দেখলে এমন তোলপাড় করে সেটা আরো ভয়ানক ব্যাপার, তাই টর্চ ছাড়া কাজ করতে হবে।

আমাকে বলা হয়েছিল ঠিক আড়াইটায় ওটা আসবে। প্রতিদিন আসে। দরোজার নীচ দিয়ে বুকে হেঁটে বসার ঘর পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। রান্নাঘরের যে হাড়িতে দুধ জ্বাল দেয়া থাকে সেই হাড়ির ঢাকনা খুলে নিঃশব্দে দুধগুলো খায়, তারপর কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে আবারো বসার ঘর পার হয়ে দরোজার তলা দিয়ে বেরিয়ে যায়। 

প্রাণীটা কি সেটা কেউ জানে না। প্রথমে ভেবেছিল সাপখোপ। কার্বলিক এসিড এনে, সাপুড়িয়া ডেকে অনেক কিছু দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে। কোন কাজ হয়নি। তবে এ বাড়ির বাসিন্দাদের কখনো ক্ষতি করেনি সে। তবু ওরা ভয় পেয়ে পালিয়েছে ঘর ছেড়ে। জিনিসপত্র পোষা প্রাণী ইত্যাদি নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে পাশের গ্রামের আত্মীয় বাড়িতে।

বাড়ি দেখাশোনার জন্য একের পর তিনজন পাহারাদার নিয়োগ দিয়েছে গত এক বছরে, কিন্তু সবাই মারা পড়েছে সেই অজানা জীবের হাতে। তারা পাহারা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল হয়তো। প্রতিবারই দেখা গেছে চোখ দুটো তুলে নিয়ে গেছে। কোন সাপের পক্ষে এটা সম্ভব না। এর পর আমাকে খুঁজে বের করার আগ পর্যন্ত আর কেউ পাহারার দায়িত্বটা নিতে রাজী হয়নি।

বাড়ির মালিক পালিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু প্রতিদিন তাকে আধাকেজি গরুর দুধ রেখে যেতে হয় রান্নাঘরের ডেকচিতে। তাকে স্বপ্নে বলে দেয়া হয়েছিল, যদি কোনদিন দুধ না রাখা হয় তাহলে তাকে দৈনিক একটা করে খেসারত দিতে হবে। হয় পোষা প্রাণী নয়তো সন্তান। মালিকের মতে, স্বপ্নের সেই বিকট চেহারার তুলনায় যমদূতকে নিরীহ শিশু বলা যায়।

প্রথমবার হুমকিটাকে উপেক্ষা করে দুধ রাখেনি মালিক। পরদিন তার সবচেয়ে সুন্দর ছাগলটাকে মাঠের পাশে মরে থাকতে দেখা গেল। ছাগলের চোখের জায়গায় কেবল দুটো গর্ত ছিল। এরপর দুধ রাখা নিয়ে আর কেউ কোন প্রশ্ন তোলেনি।

আমি গঞ্জে থাকতাম। একটা ঘর ছিল, সেখানে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাতাম। সন্ধ্যায় জেগে নেশার আসরে বসতাম। দুনিয়ার তাবত জিনিস চলতো। গাঁজা চরস আফিং ট্যাবলেট হেরোইনসহ নানান বস্তু। আমর সব শুকনো নেশা। আমি কখনো মদ খাই না। মদের গন্ধে আমার বমি আসে। কিন্তু শুকনা পেলে আমার ভাত লাগে না। শুকনারে আমরা আদর করে বলি সবজি। আমি সারাদিনই প্রায় সবজির উপর থাকি।

আমার তিনকুলে কেউ নেই। এতিমখানায় বড় হবার পর বখে গেলে একবার কে যেন ধরে আমাকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দিল। ওখানে গিয়ে অবশ্য লাভ হলো। ওরা আমাকে নানান জাতের ওষুধ দিয়ে টেস্ট করলো, ইনজেকশান দিল কয়েক রকম। ওখানে একটা ইনজেকশানে সবজি খাওয়ার আমেজ পেলাম। সেই ইনজেকশানের নাম টুকে রাখলাম। তারপর ভাণ করতে লাগলাম ভালো হয়ে গেছি। কদিন পর আমাকে চেকটেক করে ডাক্তার বললো সুস্থ হয়ে গেছি। 

ছেড়ে দেয়া হলো আমাকে। আমি বেরিয়েই আবার নতুন নেশার জগতে ঢুকে গেলাম। এবার সবজির সাথে যোগ হলো ইনজেকশানও।

আমার তেমন কোন কাজ করতাম না। কিন্তু আয় খারাপ না। গঞ্জের জুয়ার আসরে লিডার ছিলাম। জুয়া খেলে আমি কোন কোনদিন দু চার হাজার টাকা কামিয়ে ফেলতাম। এই কামানো টাকা যে শুধু নিজে খাই তা না, মাঝে মাঝে আর্তমানবতার সেবায়ও লাগাতাম। বুঝতেই পারছেন আমি লোক হিসেবে একেবারে খারাপ না।

একবার এক বড় দুর্ঘটনার পর লেগে গেলাম উদ্ধার কাজে। একজন বললো, প্রচুর রক্ত লাগবে, চলো হাসপাতালে যাই। আমি হাসপাতালে যাই রক্ত দিতে। আমার রক্তের স্যাম্পল নিয়ে টেষ্ট করার পর আমাকে হাসপাতালের একজন ডাক্তার তার রুমে ডাকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বললেন, আপনার রক্ত লাগবে না। আপনি যেতে পারেন।

আমি অবাক। কেন, আমি রক্ত দিলে সমস্যা কী? ডাক্তার অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনার রক্তে যে পরিমান বিষ আছে তাতে আপনাকে যদি কোন কালসাপও কামড় দেয়, আপনার কিছু হবে না কিন্তু সেই সাপের মৃত্যু অনিবার্য। এই ঘটনা চাউর হবার পর চেনা লোকেরা আমাকে বিষধর সাপ ঠেঙাতে ডেকে পাঠাতো। সত্যি সত্যি কিন্তু সাপেরা আমাকে দেখা মাত্র পালাবার পথ খোঁজে।

বলাই বাহুল্য আমি দুর্দান্ত সাহসী এবং প্রচণ্ড বেপরোয়া একজন মানুষ। কিন্তু কখনো খুন খারাবি করি নি। এমনকি জীবনে একটা টিকটিকিও মারিনি। যদিও আমার মনে হতো চাইলে আমি যে কোন মানুষকে বিনা কারণে খুন করে ফেলতে পারি। কোন অজুহাত ছাড়াই। আমার মেজাজটা অতিমাত্রায় রুক্ষ।

কিন্তু এই কাজটা করতে এসে প্রথমে যতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলাম রাত নামার পর থেকে সেটা কমতে কমতে অদ্ভুত একটা অনুভূতি জায়গা করে নিচ্ছিল। আগে কখনো এমন হয়নি। এটা ঠিক ভয় বলবো না। ভয় ব্যাপারটা আমার ছিলই না। এটা একরকমের গা শিউরে ওঠার মতো একটা ব্যাপার।

সারাদিন এখানে বসে আছি। দুপুরে ভাত আর বিকেলে চা খেলাম। রাতেও ভাত খেলাম মুরগীর ঝোল মাংস দিয়ে। মালিক সব ব্যবস্থা করে গেছে। আমি কোথায় শোবো তাও দেখিয়ে দিয়েছে। হাতে লাঠি আছে, বড় একটা ছোরা আছে। টর্চ লাইট আছে। আর কি চাই। তবু চামড়ার নীচে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে সন্ধ্যার আলো নেভার পর পর। রোমকূপগুলো ক্ষণে ক্ষণে সোজা হচ্ছে, আবার বসে যাচ্ছে। এটা কি রোমাঞ্চ না ভয়?

এত অন্ধকার গ্রাম আমি আগে কোনদিন দেখিনি। ঘুটঘুটে নরকের ছায়া যেন। এই গ্রামে বিদ্যুত কেন নেই সেই কারণটা অদ্ভুত। বিশ পঁচিশ ঘরের এই ছোট্ট গ্রাম নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের একটা বিরোধ আছে। এটার মালিক নির্দিষ্ট হয়নি এখনো। এটা না ভারত না বাংলাদেশ। এখানকার লোকে ভোট দিতে পারে না। বাসিন্দারা নিজেদের বাংলাদেশী মনে করে, কিন্তু বাজার করে ভারত থেকে। দেশ নিয়ে মালিকানা বিরোধে এখানে বিদ্যুত আসেনি।

বাতাস শুরু হয়েছে বাইরে।

মেঘের গর্জন আর বাতাসের আর্তনাদ মিলে মিশে পরিস্থিতির উপর আরেকদফা কালিমা লেপে দিল যখন হারিক্যানটা দপ করে নিভে গেল। কটা বাজে এখন? দেয়ালের ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে না। জীবটা ঢুকেছে কিনা, ঢুকে বেরিয়ে গেল কিনা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমি হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরে বসে আছি। টর্চ জ্বালানো কঠিনভাবে নিষেধ করা আছে। টর্চের আলো দেখলে নাকি জীবটা সোজা উড়ে আসে, ঘরের মালিক জানিয়েছিল। শিরশিরে অনুভুতিটা আবারো চেপে বসেছে। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে পা দুটো তুলে খাটের উপর বসলাম।

টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। সেই সাথে বিদ্যুত চমক। বিদ্যুতের চমকে যেটুকু আলো, তাতে বোঝার চেষ্টা করছি সাপটা দরোজার তলা দিয়ে ঢুকছে কিনা। আবারো বিকট শব্দে একটা বাজ পড়লো।  এত প্রচণ্ড শব্দ যেন পুরো আকাশটাই ভেঙ্গে পড়েছে এই ঘরের চালে। কয়েক মিনিট কানে শুনতে পেলাম না।

হঠাৎ দমকা বাতাসে রান্নাঘরের জানালাটা বোধহয় খুলে গেল। জানালার দুটো পাল্লা বাড়ি খাচ্ছে দেয়ালে। তখনি রান্নাঘরে কিছু একটা ঘটলো। ঝনঝন করে খালি ডেকচি কলসিসহ নানান তৈজসপত্র গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। বাতাসের তাণ্ডব আর মেঘের গর্জনের সাথে অনুনাদ ঘটিয়ে একটা নারকীয় সিম্ফোনি তৈরী হলো ঘরের ভেতর।

ওটা কি এসে গেছে? আমি ডানহাতে লাঠি আর বামহাতে ছুরিটা বাগিয়ে বসে থাকলাম শক্ত হয়ে। চোখ কান সতর্ক। রাত শেষ না হওয়া অবধি আর চোখ বন্ধ করা যাবে না।

হঠাৎ একটা অস্বস্তি হলো। মনে হচ্ছে অন্ধকারে আমার দিকে কেউ একজন তাকিয়ে আছে। আমি আরেকটি বিদ্যুত চমকের অপেক্ষায় আছি। দেখামাত্র দফারফা করে ফেলবো। শালার শালা বানচোত কাল সাপ অজগর যাই হোস, তোর আজ রক্ষা নাই। কপালে যাই থাকে থাক। কিন্তু পরবর্তী বিদ্যুতটা চমকে উঠতেই যে দৃশ্যটি দেখতে হলো সেটা আমার সব আত্মবিশ্বাস শুষে নিল এক সেকেণ্ডেই। অদ্ভুত একটা জীব খাটের মশারি টাঙাবার রেলিং থেকে ঝুলে আমার কপালের সামনে এসে কমলা দুটো চোখে তাকিয়ে আছে।

আমি কখনো সাপের চোখ দেখিনি, কিন্তু নিশ্চিত যে এই জীবটা আর যাই হোক, সাপ না। সাপ হতেই পারে না। এটা সাপের মতো লম্বাটে, কিন্তু কাঁকড়ার মতো দুটো দাড় আছে। আমি নিশ্চিত এটা সরাসরি নরক থেকে আসা কোন প্রাণী। বজ্র বিদ্যুতের এক সেকেণ্ডের আলোটা নিভে গেলে আমি টের পেলাম প্রাণীটা লকলকে জিব বের করে আমার কপালে ভীষণ ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ দিল। এবং পরমুহুর্তেই অতিশীতল একটা দড়ি আমার গলার চারপাশে জড়িয়ে গেল। টানটান একটা বরফের লেজ আমার কন্ঠনালীকে চাপতে চাপতে চাপতে............

এর পরের আর কোন দৃশ্য আমার মনে নেই। শেষ দৃশ্যটা এত গভীর অন্ধকারে চিত্রায়িত হয়েছিল যখন একটা বিজলির চমকও ছিল না। ফলে আমি জীবনের শেষ দৃশ্য বলে কোন কিছুর স্মৃতি নিয়ে যেতে পারছি না মনে হচ্ছিল।

*****
*****

কখনো কখনো বেঁচে থাকাটাও একটা দুর্ঘটনা। আমি যে বেঁচে গেছে সেটি অতি দুর্লভ একটি অলৌকিক দুর্ঘটনা। যে দুর্ঘটনার রহস্য আর কখনো উদঘাটিত হবে না।

আমাকে পরদিন অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ওই ঘরের ধ্বংসস্তুপ থেকে। আমি মৃত্যুমুখে জ্ঞান হারাবার পর কী ঘটেছিল জানি না। কিন্তু সেই রাতে ওই গ্রামে যে ভয়ংকর টর্নেডো বয়ে গিয়েছিল তাতেই ওই ঘরটির চাল সম্পূর্ণ উড়ে গিয়ে ঘরটি একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। আমাকে  খুঁজে বের করা হয় অনেক কষ্টে।

ওই জীবটির কী হয়েছিল কেউ জানে না। কিন্তু সে এসেছিল এটা খুব সত্যি। পৃথিবীতে জীবিত মানুষদের মধ্যে একমাত্র আমিই তাকে দেখেছিলাম এবং এখনো এক যুগ পরও সেই দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার সকল নেশা ছুটে গিয়েছিল সেই ঘটনার পর। প্রচণ্ড বেপরোয়া এক মানুষ বদলে গিল ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ হয়ে গেল। আমি এখন যে কোন প্রাণীর চোখের দিকে তাকাতেই ভয় পাই। এমনকি সেটা টিকটিকি হলেও।

Monday, April 21, 2014

ফিরে যাবার গল্প

সে একদিন চলে যাবে জানতাম। আমাদের গন্তব্য বরাবরই আলাদা ছিল। আমি যে ট্রেনের টিকেট কেটেছিলাম, সেও একই ট্রেনের টিকেট নিয়েছিল, কিন্তু ভিন্ন স্টেশানে। আমরা আলাদা বগিতে উঠেছিলাম। বসার জন্য সিট খুঁজতে খুঁজতে এই বগি সেই বগি ঘুরতে ঘুরতে একটা বগিতে হাজির হলাম দুজন প্রায় একসাথে।


পাশাপাশি দুটো সিট খালি পড়ে ছিল সেটাও কাকতাল হলেও এত মানুষের ভিড়ে দুজনের যে এত গল্প জমে উঠেছিল সেটা কিন্তু কাকতাল নয় মোটেও।


ব্যাপারটা খুব সহজ। আমার কিছু কথা ছিল। তাহার শোনার সময় ছিল। এবং কাংখিত সুত্রের গল্পে মজে যাবার পর আমরা ট্রেন থেকে নামার কথা ভুলেই গেলাম। ফলাফল, দুজনই গন্তব্য ফেলে পার হয়ে গেলাম।


অনেকদূর যাবার পর, অনেক অনেক কথা শেষ হবার পর গল্পের মধ্যে একটা বিতর্কের সুত্রপাত হলো। বিতর্ক থেকে বাকযুদ্ধ, বাকযুদ্ধের পর বাকহীনতা, অতঃপর দুজনেরই সম্বিত ফিরে পাওয়া। অনেক দেরীতে বুঝলাম, আমাদের নির্ধারিত স্টেশন পার হয়ে গেছে! এখন উপায়?


কোন উপায় নেই। হঠাৎ জাগা টর্নেডো রাগের কোন পূর্বপশ্চিম থাকে না। 'তোমার সাথে এই বগিতে থাকার চেয়ে আমি অচেনা স্টেশানে নেমে যাবো'। এই ভাবনায়, পরবর্তী স্টেশান আসতেই সে নেমে গেল। একবারো পেছনে ফিরে তাকালো না।


আমি ভ্রু কুঁচকে কয়েক মিনিট ভাবলাম এবং পরবর্তী স্টেশানে নামার জন্য প্রস্তুত হলাম। দশ মিনিট পরেই পরের স্টেশান। আমিও নেমে গেলাম অনির্ধারিত স্টেশানে।


এবার আমি পেছনে ফিরে যাবার উপায় খুঁজতে থাকলাম। ট্রেন ছাড়ার সময় তাকিয়ে দেখি সেই বগির খালি সিট দুটোতে অন্য দুজন মানুষ বসে কথা বলতে শুরু করেছে। ভাবছি -কিছুক্ষণ পর ওরাও কি গন্তব্য ভুলে যাবে?


মনে হয় না। পৃথিবীতে খুব অল্প পরিমান গল্প আছে যাতে দুজন মানুষ একই সাথে নিজের গন্তব্য ভুলে যেতে পারে। আমরা ছিলাম সেই গল্পের দুটো আলাদা খণ্ড। এখন ফিরে যাচ্ছি দুজনেই। আলাদা স্টেশান থেকে, আলাদা গন্তব্যে। আমাদের এখন কেবল একটাই মিল, দুজনের হাতে দুটো মেয়াদোত্তীর্ণ টিকেট।

Sunday, April 20, 2014

একটি বেরসিক সন্ধ্যার গল্প

শীত বিদায় নিয়েছিল পৌষের শেষে। মাঘ মাসটা শুধু ক্যালেণ্ডারের দায়িত্ব পালন করে। দুদিন আগে শীতের ক্যালেণ্ডারও শেষ হয়ে গেল। বসন্ত চলছে তিনদিন যাবত যদিও বসন্ত হাওয়ার কোন দেখা নেই। কিন্তু আজ হঠাৎ করে আবহাওয়ার মতিভ্রম ঘটে গেল। বসন্তের বাতাস বাদ দিয়ে সে মেঘদুতের কাছ থেকে আকাশ ভরা মেঘ ধার নিয়ে দিনভর সূর্যকে আড়াল করে রাখলো। বিকেলটা শেষ হতে না হতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মন খারাপের ঝাঁপি খুলে বসলো রাখীর সামনে।

রাখী একটা বাটিতে মুড়ি তেল পিয়াজ মরিচ মাখিয়ে বসে আছে শাহ গোলাপের জন্য। শাহ গোলাপ আজ ডিউটি শেষ করে আসলে সিনেমায় যাবার কথা ছিল। একটা ড্যাশিং সিনেমা লাগাইছে আলমাসে। অগ্নিশর্মা নাম তার। নায়ক বুরুজ খান। নায়িকা হাসি ঝিলমিল। পোষ্টার দেখেই মাথা খারাপ হবার যোগাড়। আজ কোন ব্যবসা করার রুচি নাই। আজকে শুধু শাহ গোলাপ থাকবে বসে।

শাহ গোলাপের পরনে মিলিটারী পোষাক হলেও সে তাসমান টাওয়ারের সিকিউরিটি গার্ড। আজকাল কিছু কিছু সিকিউরিটি কোম্পানী মিলিটারীদের মতো ইউনিফর্ম দেয়। রাত দশটা পর্যন্ত ডিউটি হলেও আজ রাখীবানুর মোবাইল আবদার পেয়ে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে আগেই। আলমাসের পিছনেই রাখীর বাসা। সাথে আরো কয়েকজন থাকে। থাকে মাসীমা হারামীর বেটি আর বখতিয়ার সাড়ে হারামজাদা। আজ সব গোলামের বাচ্চাকে উপেক্ষা করে শাহ গোলাপের সাথে সিনেমায় যাবে রাখী। মাসে একদিন তাদের ঐচ্ছিক ছুটি। এদিন তারা কাস্টমার নিলেও নিতে পারে, না নিলেও বাধা নাই। এখানকার মেয়েরা সবাই একদিন করে ছুটি কাটায়।

শাহ গোলাপ কোনদিনই তার কাস্টমার ছিল না। মইজ্যা গুণ্ডা একদিন রাখীকে ভাড়া করে পয়সা না দিয়ে চলে যাবার সময় রাখী বাধা দিয়ে পয়সা চাইলে তার মাথায় তক্তার বাড়ি মেরে ফুটপাতে ফেলে চলে গিয়েছিল। অজ্ঞান পড়ে থাকলেও তাকে কেউ তুলতে আসেনি। রাখীদের মতো মেয়েকে কেউ প্রকাশ্যে খুন করে চলে গেলেও বাধা দেয় না কেউ। এত লোকের সামনে মইজ্যা তাকে বেধড়ক মারছিল, কেউ একটু প্রতিবাদও করেনি। শুধু তার বোনটা এগিয়ে এসেছিল, তাকেও মেরে তাড়িয়েছে গুণ্ডাটা।

তখন অচেনা শাহ গোলাপ ওই পথ দিয়ে যাবার সময় তাকে পড়ে থাকতে দেখে রিকশা ডেকে হাসপাতালে নেয়, চিকিৎসা করায়।  সাত দিনের মতো হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল, সেই সাতদিন বন্ধ ছিল কাস্টমার নেয়া। শাহগোলাপ ডিউটি সেরে বাড়ি ফেরার পথে তাকে দেখতে আসতো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিত আপন মানুষের মতো।

সুস্থ হবার পর  শাহ গোলাপের প্রতি কৃতজ্ঞতা বশে তাকে একদিন ঘরে ডেকে শরীর দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মানুষটা অদ্ভুত। তাকে ছুঁয়েও দেখলো না। খাটের ওই পাশে বসে কথা বলে চলে গেল। যাবার সময় শুধু কাঁধে একবার হাত রেখে বলেছিল, তুমি খুব সুন্দর!

সেই থেকে রাখির মাথায় ঝিমঝিম এক সুখ বাজতে থাকে। শাহ গোলাপ তাকে কি চোখে দেখে রাখী ঠিক জানে না। কিন্তু যখনই রাখী তার মোবাইলে মিসকল দেয়, শাহ গোলাপ সাড়া দেয়। কিন্তু রাস্তায় দেখা হলে অচেনা মানুষের মতো আচরণ করে। এটা তাকে কষ্ট দেয়। তবু শাহ গোলাপকে ভুলতে পারে না। সময় পেলেই মিসকল দেয়। শাহ গোলাপ উত্তর দেয় সময় করে। রাখীর জানতে ইচ্ছে করে সে বিয়ে করেছে কিনা। কিন্তু সংকোচ এসে জড়ো হয়। সে কাস্টমারদের সাথে দুনিয়ার ফটফট করতে পারলেও শাহ গোলাপের ফোন পেলে বাকহীন হয়ে যায়। বুকের মধ্যে কিরকম ছমছম করে। এই ছমছমের নাম কি প্রেম? দেহের আবেদনহীন এই অনুভুতি রাখীর কাছে অজানা ছিল। এই প্রথম একজন পুরুষের জন্য তার এরকম হচ্ছে।

অনেক কথা বললেও কোনদিন প্রেম ভালোবাসার কথা বলে না। অথচ জাউরা কাস্টমারদের কেউ কেউ শরীর গরমের আবেগে অনেক সময় তার উপর ঝাপিয়ে পড়ার সময় লাভ ইউ বলে ফেলে রাখী জানে সেই ভালোবাসার মেয়াদ আধাঘন্টারও কম।

শাহ গোলাপকে আজ নিমন্ত্রণ করেছে রাখী। আসবে তো লোকটা? আজ সে ছুটিতে।
বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই ঘরের দরজায় টোকা। শাহ গোলাপ এসে গেছে।

চা মুড়ি খেয়ে দুজনে বেরিয়ে যায়। আলমাসের টিকেট কাটে। অন্ধকারে পাশাপাশি গিয়ে বসে। এখনো শো শুরু হয় নাই। লোকজন ঢুকছে আস্তে আস্তে। অন্ধকারে টর্চ  জ্বালিয়ে পথ দেখাচ্ছে টিকেট চেকার। সবাই বসে পড়লে সিনেমা শুরু হলো। অ্যাকশান রোমান্টিক সিনেমা। সিনেমা দেখার সময় রাখী তার মাথাটা শাহগোলাপের কাঁধে এলিয়ে দেয়। হাতের উপর হাত রাখে।

ওদিকে সিনেমায় জটিলতা শুরু। এক পর্যায়ে বুরুজ খানের সাথে ঝিলমিলের প্রেম যখন সংকটে পড়ে দর্শককূলকে টেনশানে ঘামিয়ে ফেলেছে, তখনই দুম করে ইন্টারভেল। বাতি জ্বলে উঠলো হল জুড়ে। চানাচুর চিপস কোকের বোতল নিয়ে টুংটাং শব্দে ঘুরতে থাকে বিক্রেতারা।

রাখী আর শাহগোলাপ চোখে চোখে তাকালো। রাখীর খুব ইচ্ছে করছে শাহ গোলাপের হাতটা ধরতে।  রাখী আজ শাড়ি পরে এসেছে। বোরকা ছাড়া তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে। শাহগোলাপের মুগ্ধ চাহনী তাকে কেমন লজ্জাবিধূর করে, বোঝাই যাবে না সে যে ওই পাড়ার মেয়ে। 

ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা নারী কন্ঠ শাহ গোলাপের নাম ধরে ডাকে।

-এ কেমন কথা গোলাপ ভাই। বিয়ে করলেন, অথচ দাওয়াত দিলেন না।

চমকে উঠে দুজনেই। শাহ গোলাপ দেখে পেছনের সিটে পাশের ঘরের রীতাভাবী ফজলু আর সীমা। রীতা ফজলুর বউ, সীমা তার শ্যালিকা। গলাটা রীতাভাবীর। সীমার মুখ গম্ভীর। পেছনে তাকিয়ে রাখীর মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। এরা কারা। শাহ গোলাপ কি জবাব দেবে বুঝতে পারে না। ভ্যানচালক ফজলু একবার সীমার ব্যাপারে তাকে ঈঙ্গিত করেও তার সাড়া না পেয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল।

এরকম আচানক ধরা পড়বে সে কল্পনা করেনি।

[অসমাপ্ত]


Saturday, April 19, 2014

২০ এপ্রিল ২০১৪: এই শনিবারে

১.
ইতিহাস পাঠে একটা ঝামেলা থাকে। যিনি ইতিহাস লিখেন তিনি সচরাচর নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। এর মধ্যেও গ্রহনযোগ্য ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে। পাঠককে একটু সতর্ক থাকতে হবে, মাথাটা সজাগ রাখতে হবে। যিনি ইতিহাস লিখেছেন তাঁর খানিক ইতিবৃত্ত জেনে নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো। এটা সবসময় সম্ভব হয় না, তাই মগজের যুক্তিবাদী কোষগুলোর সঠিক ব্যবহার দরকার। আশ্চর্য হলেও সত্য যে এদেশের গত কয়েকশো বছরের ইতিহাসের অধিকাংশ বই লেখা হয়েছে ভিনদেশী লেখকের হাতে। অষ্টাদশ শতকের উপনিবেশ যুগের সূচনার ইতিহাস পড়তে গিয়ে টের পেলাম বিদেশী লেখকরা যেভাবে বিস্তারিত তথ্য সহকারে ইতিহাস লিখেছেন, এই দেশের কেউ অত বিস্তারিত ইতিহাস লেখেননি। নাকি আমিই তেমন বই খুঁজে পাইনি, কে জানে। আলীবর্দী খাঁর আমল কিংবা তার আগে আরো একশো বছর আগের ইতিহাস ইংরেজ লেখকের বইতে যতটা বিস্তারিত পেয়েছি আর কোথাও পাইনি। ফলে তিনশো বছর আগের কোন ব্যাপারে বিশদ তথ্যের জন্য আমাকে নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে ভিনদেশী লেখকের উপর। মুশকিল হলো একজন ইংরেজ স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখবে। লর্ড ক্লাইভের জীবনী পড়তে গিয়েও একই কাহিনী। ক্লাইভ স্বভাবতই তাদের কাছে হিরো, সিরাজউদ্দৌলা ভিলেন। জগতশেঠ তাদের কাছে একজন মহৎ ধনকুবের। মীরজাফর, ঘসেটি বেগম আলীবর্দী খাঁর সুবিধাবঞ্চিত বিক্ষুব্ধ আত্মীয় মাত্র। তবু ওই ইংরেজ লেখককের জবানী থেকেই ছেঁকে ছেঁকে কিছু তথ্য বের করা যায়। পলাশীর ঘটনা নিয়ে একাধিক ইউরোপীয়ান লেখকের বই আছে। আছে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইতিহাস নিয়েও। সেখানে খুব সতর্কভাবে চোখ বুলালে আমাদের দেশীয় রাজরাজড়াতের কিছু দুর্বলতা বের হয়ে আসে। রাজরাজড়াদের অনৈক্য, লোভ, ঈর্ষাপরায়নতা এই তিনটা দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজ খুব সহজেই জয়লাভ করেছে বাংলায়। তারপর তারা ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতবর্ষে তাদের থাবা বিস্তার করেছে। ভারতের মতো একটা বিশাল দেশকে করায়ত্ত করা, উপনিবেশে পরিণত করার কথা কোন ইউরোপীয় শক্তি কল্পনাও করেনি তার পঞ্চাশ বছর আগেও। তারা শুধু বাণিজ্য করার জন্যই প্রথমে এদেশে এসেছিল। ভাস্কো দা গামার হাত ধরে প্রথমে পূর্তগীজরা পা রাখলো ভারতে, তারপর অন্যন্য ইউরোপীয়ান জাতি এদিকে ছুটে আসতে থাকে বাণিজ্য লোভে। সর্বশেষ আসে ইংরেজ। কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশী সফলতা অর্জন করে। তারাই সক্ষম হয় সমগ্র ভারতের অধীশ্বর হয়ে যেতে। সামান্য কয়েক হাজার সাদা চামড়ার হাতে বন্দী হয়ে গেল কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষ।

২.
ইতিহাসের মতো মানুষ পাঠেও ঝামেলা আছে। একটা মানুষের সাথে দীর্ঘসময় বাস করেও কেউ নিশ্চিত হতে পারবে না সে মানুষটিকে ঠিকভাবে বুঝে ফেলেছে। প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষই একমাত্র যার ভেতরে বাস করে একাধিক মানুষ। আমরা যাদের সাথে খাইদাই ঘুমাই আড্ডাই তাদের মাত্র একটা চেহারার সাথে আমরা পরিচিত। তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বাকী মানুষগুলোকে আমরা দেখি না। দেখা যায় যে মানুষটা সবার খুব হাসিখুশী আড্ডা দিচ্ছে, তার বুকের গভীরে হয়তো জমে আছে কঠিন কোন বেদনা। যা সে দক্ষতার সাথে লুকিয়ে ফেলছে। একই আড্ডায় অনেক মানুষ থাকলেও সবার সাথে সবকিছু শেয়ার করা যায় না। কেউ কেউ খুব প্রিয় কোন বন্ধুর কাছে শেয়ার করে। আবার এমনো কিছু বিষয় আছে যেটা শুধু নিজের সাথেই বলা যায়। প্রিয়তম বন্ধুটিও জানতে পারে না। তাই কেউ যদি বলে ফেলে, আমি তোমার সবটা জেনে গেছি, বুঝে গেছি, সে নিতান্তই অর্বাচীন। আমাদের সবার মনের ভেতরে অনেক জটিল সমীকরণ খেলা করতে থাকে, এমনকি যখন ঘুমাই তখনো। অবচেতন মন মাঝে মাঝে সচেতন মনকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। আমরা দুঃস্বপ্ন ভেবে জেগে উঠি। এরপর আবার যখন ঘুমিয়ে পড়ি তখন আর কিছুই মনে থাকে না। সকালে উঠে শুধু রাতের এটুকুই মনে থাকে যে কিছু একটা দেখেছিলাম। কী সেটা কিছুতেই মনে আসে না। মানুষ বাদে আর কোন প্রাণীর কি এতটা বহুরূপী চেহার আছে? নাই। মানুষ তাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। একই সাথে মানুষ সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবও। কারণ এই মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে ধ্বংসের অমোঘ সব অস্ত্র। যা তার জিহ্বার পেছনে লুকিয়ে থাকে, সময়ে বের হয়ে আসে বিষদাঁত। তখন চেনা মানুষ হয়ে যায় অচেনা। মানুষের ইতিহাস লেখা সহজ নয়। সম্পূর্ণ ইতিহাস লেখা তো প্রায় অসম্ভবই। আমি তাই মানুষ চেনার কাজ বাদ দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসের ভেতরে ডুব দেই।

৩.
গতকাল বাতাসে একটু মমতার ছোঁয়া থাকলেও আজ সকাল থেকে নির্মম কর্কশ। বৈশাখ জ্যেষ্ঠে এরকম গরম পড়বেই। তবু আমরা অভিযোগ করি অনির্দিষ্ট কারো কাছে। যে যার রুটিনে কাজ করবে, এতে অভিযোগ করার কোন মানে হয় না। পৌষমাসে যদি এরকম গরম পড়তো তাহলে অভিযোগ যুক্তিযুক্ত। এই চিন্তা মাথায় আসার পর আমি গরম অনুভব করি কিন্তু অভিযোগ করি না।

৪.
এই শনিবারটা একটু অন্যরকম হবার কথা ছিল। হলো না। মানুষের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় না। ইতিহাসের খাতায় আরেকটি ব্যর্থ শনিবারের নাম যুক্ত হয়ে গেল। স্পেস স্পেস স্পেস.......


Tuesday, April 15, 2014

১৫ এপ্রিল ২০১৪ উত্তাপে বাংলাদেশ

১.
প্রচণ্ড উত্তাপে দিনগুলো তড়পাচ্ছে। চৈত্রের শেষ ভাগে বাতাস উত্তাল হয়, এবার তেমন কিছু দেখা যায়নি। বসন্ত শেষ হয়ে গেল কোনরকম হাওয়ার মাতন ছাড়াই। বৈশাখে বাঙালী খুব উৎসবে মাতে। শহুরে মধ্যবিত্ত ঘরে থাকে না। এই বিরাট জনসংখ্যার চাপ আমাদের রাস্তাগুলো সহ্য করতে পারে না। পথঘাট স্থবির হয়ে থাকে কোথাও কোথাও। ডিসি হিল আর সিআরবিতে উৎসবের আমেজ। আশপাশের কয়েক কিলোমিটারে লাল সাদা পোষাকে মাতোয়ারা নারী পুরুষ। এই অসহ্য গরমকে তুচ্ছ করে বাঙালী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। এই উৎসাহ দশ বছর আগেও খুব বেশী ছিল না। এখন হঠাৎ করে যেন বেড়ে গেল। পহেলা বৈশাখে আমার আনন্দ নেই গত সতের বছর। এই দিনে আমরা ঘর থেকে বের হই না তেমন। বড়জোর গ্রামে যাই। বাবাকে দেখে আসি। এই টুকুই আমার কার্যক্রম। এবার অফিসে কাটিয়েছি সারাদিন। অফিস ফেরার পথে হেঁটে হেঁটে মানুষের আনন্দিত মুখ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, যদি এই সময়টা গ্রীষ্ম না হয়ে হেমন্ত হতো। আনন্দটা আরো অনেক উপভোগ্য হতো। আমি একবার লিখেছিলাম, নববর্ষের সময়টা বদলে ফাল্গুনে বা অঘ্রানে নিয়ে যেতে। আমার ক্ষমতা থাকলে তাই করতাম। তোমার থাকলে কী তাই করতে?

২.
আমি বৃষ্টির অপেক্ষায় আছি। মৌসুমী বায়ু কখন বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে হিমালয়ের দিকে ছুটে আসবে, সেই ছোঁয়ায় বাংলাদেশে বর্ষা নামবে আমি সেই চিরচেনা দৃশ্য দেখার জন্য বসে আছি। আরো দুই মাস অপেক্ষা। হয়তো আরো কম।

৩.
পড়াশোনা বন্ধ হয়ে আছে। প্রায় একমাস। আবারো শুরু করতে হবে। Into The Wild নামালাম। এই ছবিটা ভালো হবে বলে বিশ্বাস। কিন্তু আড়াই ঘন্টা নিজস্ব সময় কি হবে? বই পড়া আর সিনেমা দেখার জন্য একান্ত সময় লাগে। আজকাল যা খুব দুর্লভ হয়ে গেছে। জমে যাচ্ছে অনেক না পড়া বই। শুধু সময়ের আকাল না। মননেরও আকাল পড়েছে। বই হাতে নিয়ে আধঘন্টা বসে থাকার পরও একটা পাতাও পড়া হয় না। কেন যেন বই পড়ার জন্য আলাদা একটা মুডের দরকার হয়। মুড বিষয়টা ছেলেবেলায় ছিল না। বুড়ো হতে হতে মানুষ অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল হয়। আমি কি সত্যি বুড়োত্বের পথে এগিয়ে গেলাম? কিন্তু মনের বয়সতো এখনো ২৩।