Wednesday, April 23, 2014

ভয়কেতু

বৈশাখী মেঘের বিকট সংঘর্ষজনিত দ্রুমদ্রামের ত্রিতাল তরঙ্গে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এর পরপরই বুঝতে পারলাম কী ভয়াবহ ভুল করে বসেছি। এই ঘরে ঘুমিয়ে পড়া আর মৃত্যুদুতের কোলে শুয়ে থাকা প্রায় একই জিনিস। এ পর্যন্ত তিন জন প্রাণ হারিয়েছে পাহারার সময় ঘুমোতে গিয়ে। আজ কি আমার পালা?

আমি নিজেই কাজটা নিয়েছি। আমার প্রাণটা কৈ মাছের প্রাণের চেয়ে শক্ত এবং টাকার অংকটা বেশ মোটা বলেই সিদ্ধান্ত নেয়া।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আরেক দফা চমকে উঠলাম। ঘড়িতে এখনো সোয়া দশটা! মানে কী? রাতের খাবারের সময মুরগীর হাড় চিবোতে গিয়ে যখন আক্কেল দাঁতটা ক্যাচ করে উঠেছিল তখনো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম পৌনে দশ। এরপর কমপক্ষে দুঘন্টা বসে বসে 'সবজি' টেনেছি। তবু এখনো বাজে সোয়া দশ - ব্যাপারটা গোলমেলে তো! কাছে গিয়ে আবছা আলোতে কয়েক মিনিট ভালো করে তাকিয়ে থেকে বুঝলাম এই ঘড়ির ঘন্টার কাঁটাটা অচল হয়ে গেছে। মিনিটের কাঁটাটাই ঘুরে ঘুরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এখন তাহলে সময় বোঝার উপায় কি?

এই গ্রামে কোন বিদ্যুত নেই। ঘরের এক কোনে টিমটিম করে যে হারিক্যানটা জ্বলছে, সেটাও নিভে যাবার সময় হয়ে এসেছে। হারিক্যান নিভে গেলে টর্চলাইট ভরসা। কিন্তু ওই জীবটা টর্চলাইট দেখলে এমন তোলপাড় করে সেটা আরো ভয়ানক ব্যাপার, তাই টর্চ ছাড়া কাজ করতে হবে।

আমাকে বলা হয়েছিল ঠিক আড়াইটায় ওটা আসবে। প্রতিদিন আসে। দরোজার নীচ দিয়ে বুকে হেঁটে বসার ঘর পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। রান্নাঘরের যে হাড়িতে দুধ জ্বাল দেয়া থাকে সেই হাড়ির ঢাকনা খুলে নিঃশব্দে দুধগুলো খায়, তারপর কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে আবারো বসার ঘর পার হয়ে দরোজার তলা দিয়ে বেরিয়ে যায়। 

প্রাণীটা কি সেটা কেউ জানে না। প্রথমে ভেবেছিল সাপখোপ। কার্বলিক এসিড এনে, সাপুড়িয়া ডেকে অনেক কিছু দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে। কোন কাজ হয়নি। তবে এ বাড়ির বাসিন্দাদের কখনো ক্ষতি করেনি সে। তবু ওরা ভয় পেয়ে পালিয়েছে ঘর ছেড়ে। জিনিসপত্র পোষা প্রাণী ইত্যাদি নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে পাশের গ্রামের আত্মীয় বাড়িতে।

বাড়ি দেখাশোনার জন্য একের পর তিনজন পাহারাদার নিয়োগ দিয়েছে গত এক বছরে, কিন্তু সবাই মারা পড়েছে সেই অজানা জীবের হাতে। তারা পাহারা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল হয়তো। প্রতিবারই দেখা গেছে চোখ দুটো তুলে নিয়ে গেছে। কোন সাপের পক্ষে এটা সম্ভব না। এর পর আমাকে খুঁজে বের করার আগ পর্যন্ত আর কেউ পাহারার দায়িত্বটা নিতে রাজী হয়নি।

বাড়ির মালিক পালিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু প্রতিদিন তাকে আধাকেজি গরুর দুধ রেখে যেতে হয় রান্নাঘরের ডেকচিতে। তাকে স্বপ্নে বলে দেয়া হয়েছিল, যদি কোনদিন দুধ না রাখা হয় তাহলে তাকে দৈনিক একটা করে খেসারত দিতে হবে। হয় পোষা প্রাণী নয়তো সন্তান। মালিকের মতে, স্বপ্নের সেই বিকট চেহারার তুলনায় যমদূতকে নিরীহ শিশু বলা যায়।

প্রথমবার হুমকিটাকে উপেক্ষা করে দুধ রাখেনি মালিক। পরদিন তার সবচেয়ে সুন্দর ছাগলটাকে মাঠের পাশে মরে থাকতে দেখা গেল। ছাগলের চোখের জায়গায় কেবল দুটো গর্ত ছিল। এরপর দুধ রাখা নিয়ে আর কেউ কোন প্রশ্ন তোলেনি।

আমি গঞ্জে থাকতাম। একটা ঘর ছিল, সেখানে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাতাম। সন্ধ্যায় জেগে নেশার আসরে বসতাম। দুনিয়ার তাবত জিনিস চলতো। গাঁজা চরস আফিং ট্যাবলেট হেরোইনসহ নানান বস্তু। আমর সব শুকনো নেশা। আমি কখনো মদ খাই না। মদের গন্ধে আমার বমি আসে। কিন্তু শুকনা পেলে আমার ভাত লাগে না। শুকনারে আমরা আদর করে বলি সবজি। আমি সারাদিনই প্রায় সবজির উপর থাকি।

আমার তিনকুলে কেউ নেই। এতিমখানায় বড় হবার পর বখে গেলে একবার কে যেন ধরে আমাকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দিল। ওখানে গিয়ে অবশ্য লাভ হলো। ওরা আমাকে নানান জাতের ওষুধ দিয়ে টেস্ট করলো, ইনজেকশান দিল কয়েক রকম। ওখানে একটা ইনজেকশানে সবজি খাওয়ার আমেজ পেলাম। সেই ইনজেকশানের নাম টুকে রাখলাম। তারপর ভাণ করতে লাগলাম ভালো হয়ে গেছি। কদিন পর আমাকে চেকটেক করে ডাক্তার বললো সুস্থ হয়ে গেছি। 

ছেড়ে দেয়া হলো আমাকে। আমি বেরিয়েই আবার নতুন নেশার জগতে ঢুকে গেলাম। এবার সবজির সাথে যোগ হলো ইনজেকশানও।

আমার তেমন কোন কাজ করতাম না। কিন্তু আয় খারাপ না। গঞ্জের জুয়ার আসরে লিডার ছিলাম। জুয়া খেলে আমি কোন কোনদিন দু চার হাজার টাকা কামিয়ে ফেলতাম। এই কামানো টাকা যে শুধু নিজে খাই তা না, মাঝে মাঝে আর্তমানবতার সেবায়ও লাগাতাম। বুঝতেই পারছেন আমি লোক হিসেবে একেবারে খারাপ না।

একবার এক বড় দুর্ঘটনার পর লেগে গেলাম উদ্ধার কাজে। একজন বললো, প্রচুর রক্ত লাগবে, চলো হাসপাতালে যাই। আমি হাসপাতালে যাই রক্ত দিতে। আমার রক্তের স্যাম্পল নিয়ে টেষ্ট করার পর আমাকে হাসপাতালের একজন ডাক্তার তার রুমে ডাকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বললেন, আপনার রক্ত লাগবে না। আপনি যেতে পারেন।

আমি অবাক। কেন, আমি রক্ত দিলে সমস্যা কী? ডাক্তার অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনার রক্তে যে পরিমান বিষ আছে তাতে আপনাকে যদি কোন কালসাপও কামড় দেয়, আপনার কিছু হবে না কিন্তু সেই সাপের মৃত্যু অনিবার্য। এই ঘটনা চাউর হবার পর চেনা লোকেরা আমাকে বিষধর সাপ ঠেঙাতে ডেকে পাঠাতো। সত্যি সত্যি কিন্তু সাপেরা আমাকে দেখা মাত্র পালাবার পথ খোঁজে।

বলাই বাহুল্য আমি দুর্দান্ত সাহসী এবং প্রচণ্ড বেপরোয়া একজন মানুষ। কিন্তু কখনো খুন খারাবি করি নি। এমনকি জীবনে একটা টিকটিকিও মারিনি। যদিও আমার মনে হতো চাইলে আমি যে কোন মানুষকে বিনা কারণে খুন করে ফেলতে পারি। কোন অজুহাত ছাড়াই। আমার মেজাজটা অতিমাত্রায় রুক্ষ।

কিন্তু এই কাজটা করতে এসে প্রথমে যতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলাম রাত নামার পর থেকে সেটা কমতে কমতে অদ্ভুত একটা অনুভূতি জায়গা করে নিচ্ছিল। আগে কখনো এমন হয়নি। এটা ঠিক ভয় বলবো না। ভয় ব্যাপারটা আমার ছিলই না। এটা একরকমের গা শিউরে ওঠার মতো একটা ব্যাপার।

সারাদিন এখানে বসে আছি। দুপুরে ভাত আর বিকেলে চা খেলাম। রাতেও ভাত খেলাম মুরগীর ঝোল মাংস দিয়ে। মালিক সব ব্যবস্থা করে গেছে। আমি কোথায় শোবো তাও দেখিয়ে দিয়েছে। হাতে লাঠি আছে, বড় একটা ছোরা আছে। টর্চ লাইট আছে। আর কি চাই। তবু চামড়ার নীচে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে সন্ধ্যার আলো নেভার পর পর। রোমকূপগুলো ক্ষণে ক্ষণে সোজা হচ্ছে, আবার বসে যাচ্ছে। এটা কি রোমাঞ্চ না ভয়?

এত অন্ধকার গ্রাম আমি আগে কোনদিন দেখিনি। ঘুটঘুটে নরকের ছায়া যেন। এই গ্রামে বিদ্যুত কেন নেই সেই কারণটা অদ্ভুত। বিশ পঁচিশ ঘরের এই ছোট্ট গ্রাম নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের একটা বিরোধ আছে। এটার মালিক নির্দিষ্ট হয়নি এখনো। এটা না ভারত না বাংলাদেশ। এখানকার লোকে ভোট দিতে পারে না। বাসিন্দারা নিজেদের বাংলাদেশী মনে করে, কিন্তু বাজার করে ভারত থেকে। দেশ নিয়ে মালিকানা বিরোধে এখানে বিদ্যুত আসেনি।

বাতাস শুরু হয়েছে বাইরে।

মেঘের গর্জন আর বাতাসের আর্তনাদ মিলে মিশে পরিস্থিতির উপর আরেকদফা কালিমা লেপে দিল যখন হারিক্যানটা দপ করে নিভে গেল। কটা বাজে এখন? দেয়ালের ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে না। জীবটা ঢুকেছে কিনা, ঢুকে বেরিয়ে গেল কিনা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমি হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরে বসে আছি। টর্চ জ্বালানো কঠিনভাবে নিষেধ করা আছে। টর্চের আলো দেখলে নাকি জীবটা সোজা উড়ে আসে, ঘরের মালিক জানিয়েছিল। শিরশিরে অনুভুতিটা আবারো চেপে বসেছে। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে পা দুটো তুলে খাটের উপর বসলাম।

টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। সেই সাথে বিদ্যুত চমক। বিদ্যুতের চমকে যেটুকু আলো, তাতে বোঝার চেষ্টা করছি সাপটা দরোজার তলা দিয়ে ঢুকছে কিনা। আবারো বিকট শব্দে একটা বাজ পড়লো।  এত প্রচণ্ড শব্দ যেন পুরো আকাশটাই ভেঙ্গে পড়েছে এই ঘরের চালে। কয়েক মিনিট কানে শুনতে পেলাম না।

হঠাৎ দমকা বাতাসে রান্নাঘরের জানালাটা বোধহয় খুলে গেল। জানালার দুটো পাল্লা বাড়ি খাচ্ছে দেয়ালে। তখনি রান্নাঘরে কিছু একটা ঘটলো। ঝনঝন করে খালি ডেকচি কলসিসহ নানান তৈজসপত্র গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। বাতাসের তাণ্ডব আর মেঘের গর্জনের সাথে অনুনাদ ঘটিয়ে একটা নারকীয় সিম্ফোনি তৈরী হলো ঘরের ভেতর।

ওটা কি এসে গেছে? আমি ডানহাতে লাঠি আর বামহাতে ছুরিটা বাগিয়ে বসে থাকলাম শক্ত হয়ে। চোখ কান সতর্ক। রাত শেষ না হওয়া অবধি আর চোখ বন্ধ করা যাবে না।

হঠাৎ একটা অস্বস্তি হলো। মনে হচ্ছে অন্ধকারে আমার দিকে কেউ একজন তাকিয়ে আছে। আমি আরেকটি বিদ্যুত চমকের অপেক্ষায় আছি। দেখামাত্র দফারফা করে ফেলবো। শালার শালা বানচোত কাল সাপ অজগর যাই হোস, তোর আজ রক্ষা নাই। কপালে যাই থাকে থাক। কিন্তু পরবর্তী বিদ্যুতটা চমকে উঠতেই যে দৃশ্যটি দেখতে হলো সেটা আমার সব আত্মবিশ্বাস শুষে নিল এক সেকেণ্ডেই। অদ্ভুত একটা জীব খাটের মশারি টাঙাবার রেলিং থেকে ঝুলে আমার কপালের সামনে এসে কমলা দুটো চোখে তাকিয়ে আছে।

আমি কখনো সাপের চোখ দেখিনি, কিন্তু নিশ্চিত যে এই জীবটা আর যাই হোক, সাপ না। সাপ হতেই পারে না। এটা সাপের মতো লম্বাটে, কিন্তু কাঁকড়ার মতো দুটো দাড় আছে। আমি নিশ্চিত এটা সরাসরি নরক থেকে আসা কোন প্রাণী। বজ্র বিদ্যুতের এক সেকেণ্ডের আলোটা নিভে গেলে আমি টের পেলাম প্রাণীটা লকলকে জিব বের করে আমার কপালে ভীষণ ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ দিল। এবং পরমুহুর্তেই অতিশীতল একটা দড়ি আমার গলার চারপাশে জড়িয়ে গেল। টানটান একটা বরফের লেজ আমার কন্ঠনালীকে চাপতে চাপতে চাপতে............

এর পরের আর কোন দৃশ্য আমার মনে নেই। শেষ দৃশ্যটা এত গভীর অন্ধকারে চিত্রায়িত হয়েছিল যখন একটা বিজলির চমকও ছিল না। ফলে আমি জীবনের শেষ দৃশ্য বলে কোন কিছুর স্মৃতি নিয়ে যেতে পারছি না মনে হচ্ছিল।

*****
*****

কখনো কখনো বেঁচে থাকাটাও একটা দুর্ঘটনা। আমি যে বেঁচে গেছে সেটি অতি দুর্লভ একটি অলৌকিক দুর্ঘটনা। যে দুর্ঘটনার রহস্য আর কখনো উদঘাটিত হবে না।

আমাকে পরদিন অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ওই ঘরের ধ্বংসস্তুপ থেকে। আমি মৃত্যুমুখে জ্ঞান হারাবার পর কী ঘটেছিল জানি না। কিন্তু সেই রাতে ওই গ্রামে যে ভয়ংকর টর্নেডো বয়ে গিয়েছিল তাতেই ওই ঘরটির চাল সম্পূর্ণ উড়ে গিয়ে ঘরটি একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। আমাকে  খুঁজে বের করা হয় অনেক কষ্টে।

ওই জীবটির কী হয়েছিল কেউ জানে না। কিন্তু সে এসেছিল এটা খুব সত্যি। পৃথিবীতে জীবিত মানুষদের মধ্যে একমাত্র আমিই তাকে দেখেছিলাম এবং এখনো এক যুগ পরও সেই দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার সকল নেশা ছুটে গিয়েছিল সেই ঘটনার পর। প্রচণ্ড বেপরোয়া এক মানুষ বদলে গিল ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ হয়ে গেল। আমি এখন যে কোন প্রাণীর চোখের দিকে তাকাতেই ভয় পাই। এমনকি সেটা টিকটিকি হলেও।

No comments: