Sunday, April 20, 2014

একটি বেরসিক সন্ধ্যার গল্প

শীত বিদায় নিয়েছিল পৌষের শেষে। মাঘ মাসটা শুধু ক্যালেণ্ডারের দায়িত্ব পালন করে। দুদিন আগে শীতের ক্যালেণ্ডারও শেষ হয়ে গেল। বসন্ত চলছে তিনদিন যাবত যদিও বসন্ত হাওয়ার কোন দেখা নেই। কিন্তু আজ হঠাৎ করে আবহাওয়ার মতিভ্রম ঘটে গেল। বসন্তের বাতাস বাদ দিয়ে সে মেঘদুতের কাছ থেকে আকাশ ভরা মেঘ ধার নিয়ে দিনভর সূর্যকে আড়াল করে রাখলো। বিকেলটা শেষ হতে না হতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মন খারাপের ঝাঁপি খুলে বসলো রাখীর সামনে।

রাখী একটা বাটিতে মুড়ি তেল পিয়াজ মরিচ মাখিয়ে বসে আছে শাহ গোলাপের জন্য। শাহ গোলাপ আজ ডিউটি শেষ করে আসলে সিনেমায় যাবার কথা ছিল। একটা ড্যাশিং সিনেমা লাগাইছে আলমাসে। অগ্নিশর্মা নাম তার। নায়ক বুরুজ খান। নায়িকা হাসি ঝিলমিল। পোষ্টার দেখেই মাথা খারাপ হবার যোগাড়। আজ কোন ব্যবসা করার রুচি নাই। আজকে শুধু শাহ গোলাপ থাকবে বসে।

শাহ গোলাপের পরনে মিলিটারী পোষাক হলেও সে তাসমান টাওয়ারের সিকিউরিটি গার্ড। আজকাল কিছু কিছু সিকিউরিটি কোম্পানী মিলিটারীদের মতো ইউনিফর্ম দেয়। রাত দশটা পর্যন্ত ডিউটি হলেও আজ রাখীবানুর মোবাইল আবদার পেয়ে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে আগেই। আলমাসের পিছনেই রাখীর বাসা। সাথে আরো কয়েকজন থাকে। থাকে মাসীমা হারামীর বেটি আর বখতিয়ার সাড়ে হারামজাদা। আজ সব গোলামের বাচ্চাকে উপেক্ষা করে শাহ গোলাপের সাথে সিনেমায় যাবে রাখী। মাসে একদিন তাদের ঐচ্ছিক ছুটি। এদিন তারা কাস্টমার নিলেও নিতে পারে, না নিলেও বাধা নাই। এখানকার মেয়েরা সবাই একদিন করে ছুটি কাটায়।

শাহ গোলাপ কোনদিনই তার কাস্টমার ছিল না। মইজ্যা গুণ্ডা একদিন রাখীকে ভাড়া করে পয়সা না দিয়ে চলে যাবার সময় রাখী বাধা দিয়ে পয়সা চাইলে তার মাথায় তক্তার বাড়ি মেরে ফুটপাতে ফেলে চলে গিয়েছিল। অজ্ঞান পড়ে থাকলেও তাকে কেউ তুলতে আসেনি। রাখীদের মতো মেয়েকে কেউ প্রকাশ্যে খুন করে চলে গেলেও বাধা দেয় না কেউ। এত লোকের সামনে মইজ্যা তাকে বেধড়ক মারছিল, কেউ একটু প্রতিবাদও করেনি। শুধু তার বোনটা এগিয়ে এসেছিল, তাকেও মেরে তাড়িয়েছে গুণ্ডাটা।

তখন অচেনা শাহ গোলাপ ওই পথ দিয়ে যাবার সময় তাকে পড়ে থাকতে দেখে রিকশা ডেকে হাসপাতালে নেয়, চিকিৎসা করায়।  সাত দিনের মতো হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল, সেই সাতদিন বন্ধ ছিল কাস্টমার নেয়া। শাহগোলাপ ডিউটি সেরে বাড়ি ফেরার পথে তাকে দেখতে আসতো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিত আপন মানুষের মতো।

সুস্থ হবার পর  শাহ গোলাপের প্রতি কৃতজ্ঞতা বশে তাকে একদিন ঘরে ডেকে শরীর দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মানুষটা অদ্ভুত। তাকে ছুঁয়েও দেখলো না। খাটের ওই পাশে বসে কথা বলে চলে গেল। যাবার সময় শুধু কাঁধে একবার হাত রেখে বলেছিল, তুমি খুব সুন্দর!

সেই থেকে রাখির মাথায় ঝিমঝিম এক সুখ বাজতে থাকে। শাহ গোলাপ তাকে কি চোখে দেখে রাখী ঠিক জানে না। কিন্তু যখনই রাখী তার মোবাইলে মিসকল দেয়, শাহ গোলাপ সাড়া দেয়। কিন্তু রাস্তায় দেখা হলে অচেনা মানুষের মতো আচরণ করে। এটা তাকে কষ্ট দেয়। তবু শাহ গোলাপকে ভুলতে পারে না। সময় পেলেই মিসকল দেয়। শাহ গোলাপ উত্তর দেয় সময় করে। রাখীর জানতে ইচ্ছে করে সে বিয়ে করেছে কিনা। কিন্তু সংকোচ এসে জড়ো হয়। সে কাস্টমারদের সাথে দুনিয়ার ফটফট করতে পারলেও শাহ গোলাপের ফোন পেলে বাকহীন হয়ে যায়। বুকের মধ্যে কিরকম ছমছম করে। এই ছমছমের নাম কি প্রেম? দেহের আবেদনহীন এই অনুভুতি রাখীর কাছে অজানা ছিল। এই প্রথম একজন পুরুষের জন্য তার এরকম হচ্ছে।

অনেক কথা বললেও কোনদিন প্রেম ভালোবাসার কথা বলে না। অথচ জাউরা কাস্টমারদের কেউ কেউ শরীর গরমের আবেগে অনেক সময় তার উপর ঝাপিয়ে পড়ার সময় লাভ ইউ বলে ফেলে রাখী জানে সেই ভালোবাসার মেয়াদ আধাঘন্টারও কম।

শাহ গোলাপকে আজ নিমন্ত্রণ করেছে রাখী। আসবে তো লোকটা? আজ সে ছুটিতে।
বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই ঘরের দরজায় টোকা। শাহ গোলাপ এসে গেছে।

চা মুড়ি খেয়ে দুজনে বেরিয়ে যায়। আলমাসের টিকেট কাটে। অন্ধকারে পাশাপাশি গিয়ে বসে। এখনো শো শুরু হয় নাই। লোকজন ঢুকছে আস্তে আস্তে। অন্ধকারে টর্চ  জ্বালিয়ে পথ দেখাচ্ছে টিকেট চেকার। সবাই বসে পড়লে সিনেমা শুরু হলো। অ্যাকশান রোমান্টিক সিনেমা। সিনেমা দেখার সময় রাখী তার মাথাটা শাহগোলাপের কাঁধে এলিয়ে দেয়। হাতের উপর হাত রাখে।

ওদিকে সিনেমায় জটিলতা শুরু। এক পর্যায়ে বুরুজ খানের সাথে ঝিলমিলের প্রেম যখন সংকটে পড়ে দর্শককূলকে টেনশানে ঘামিয়ে ফেলেছে, তখনই দুম করে ইন্টারভেল। বাতি জ্বলে উঠলো হল জুড়ে। চানাচুর চিপস কোকের বোতল নিয়ে টুংটাং শব্দে ঘুরতে থাকে বিক্রেতারা।

রাখী আর শাহগোলাপ চোখে চোখে তাকালো। রাখীর খুব ইচ্ছে করছে শাহ গোলাপের হাতটা ধরতে।  রাখী আজ শাড়ি পরে এসেছে। বোরকা ছাড়া তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে। শাহগোলাপের মুগ্ধ চাহনী তাকে কেমন লজ্জাবিধূর করে, বোঝাই যাবে না সে যে ওই পাড়ার মেয়ে। 

ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা নারী কন্ঠ শাহ গোলাপের নাম ধরে ডাকে।

-এ কেমন কথা গোলাপ ভাই। বিয়ে করলেন, অথচ দাওয়াত দিলেন না।

চমকে উঠে দুজনেই। শাহ গোলাপ দেখে পেছনের সিটে পাশের ঘরের রীতাভাবী ফজলু আর সীমা। রীতা ফজলুর বউ, সীমা তার শ্যালিকা। গলাটা রীতাভাবীর। সীমার মুখ গম্ভীর। পেছনে তাকিয়ে রাখীর মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। এরা কারা। শাহ গোলাপ কি জবাব দেবে বুঝতে পারে না। ভ্যানচালক ফজলু একবার সীমার ব্যাপারে তাকে ঈঙ্গিত করেও তার সাড়া না পেয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল।

এরকম আচানক ধরা পড়বে সে কল্পনা করেনি।

[অসমাপ্ত]


No comments: