Tuesday, April 29, 2014

জীবনের বিকেল অথবা সন্ধ্যা

একসময় বলতাম জীবনের মাঝপথে এসে গেছি, সময় বেশী নেই। অনেক অনেক কাজ বাকী। সেই অনেক কাজের খুব সামান্য অংশই শেষ করেছি। আরো নতুন কাজ এসে জমা হয়ে গেছে।

আজকাল বলি জীবনের দুপুর শেষ হয়ে বিকেলও গড়ানোর পথে। আগের কাজ, নতুন আসা বাকী কাজ সবগুলোই কি শেষমেষ অসমাপ্ত থেকে যাবে? কাজ না হয় অসমাপ্ত থাকলো। বইগুলোও কি না পড়া থেকে যাবে? ছাত্রজীবনে মাসে একটা বই কিনতে পারলেও ধন্য হয়ে যেতাম। তখন একটা বই পড়ে হা করে থাকতাম কখন আরেকটা বই কিনতে পারবো। একবার সস্তায় জলের দরে প্রায় বিশ পঁচিশখানা বই কিনে ফেলেছিলাম। সেদিন আমার ঈদ। পরবর্তী এক মাস কোন বই ভাবনা ছিল না। গোগ্রাসে গিলে গেছি সব।

আজকাল পাঁচটা বই কেনা হয় একসাথে, একটা পড়তে পড়তে সপ্তাহ পার। এরমধ্যে আবারো যদি বইয়ের দোকানে ঢুকি আরো তিন চারটা বই চলে আসে। এখন আগের চারটা না পড়া বইয়ের কথা ভুলে নতুন কেনাগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ি। এভাবে যখনই নতুন কেনা হয় পুরোনো বইগুলো পেছনে পড়ে যেতে থাকে। তার উপর আছে বদভ্যাস। সবচেয়ে মজাদার বইটা জমিয়ে রাখি পরে পড়বো বলে। এরকম অনেক মজার বইয়ের কথা ভুলে যাই নতুন আরেক মজার বই পেয়ে। হঠাৎ হঠাৎ যখন অন্য বই খুঁজতে গিয়ে ওই বইয়ের সামনে পড়ে যাই তখন প্রাণহীন বইটার দিকে আমি দুঃখিত চোখে তাকাই। সেদিন দেখলাম দুঃখিত চোখে তাকানোর মতো বইয়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সুতরাং আমাকে নতুন বই কেনা স্থগিত রাখতে হলো। জীবনের বিকেল শেষ হবার আগেই বইগুলো পড়া শেষ করতে হবে।

জীবনের সন্ধ্যাবেলা কারো কারো দীর্ঘ হয়, কারো কারো খুবই অল্প। আমি জানি না আমার কতটা সময় হাতে থাকবে। কিন্তু ওই সময়টা খুব বেদনাদায়ক। শ্যামল বন্দোপাধ্যায়ের ডুমুর গাছের গল্পটার কথা ভেবে শিউরে উঠি যেখানে একজন দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর ধরে জীবনের সন্ধ্যাবেলায় ধুঁকেছিল। ওই মানুষকে নিজের কন্যা আর জামাই মিলে একটা ট্রেনে তুলে নিরুদ্দেশ যাত্রায় পাঠিয়ে পত্রিকায় একটা নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি আর একটা পুলিশে একটা ডায়েরী লিখে নিজেদের বোঝা হালকা করেছিল।

গল্পের কথা থাক। বাস্তবের কথা বলি। চেনা মানুষের কারো কারো জীবনের সন্ধ্যাবেলা দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। দুর্ভাগ্য বলছি এই কারণে দশ বছর আগে যারা জীবনের সুখী বিকেলে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে, সেই একই মানুষ দশ বছর পর দুর্বিসহ জীবনসন্ধ্যা পার করছে। সমগোত্রীয় মানুষ ছাড়া সমব্যথী হবার কেউ নেই তাদের। সমগোত্রীয়গণ সমব্যথী হলেও সহযোগীতায় অপারগ। কারণ সবাই মোটামুটি একই মাত্রার ভিন্ন ভিন্ন দুর্ভোগে দিন পার করছে। কেন এই দুর্ভোগ?

আমি কেবল একজনের কথা বলছি আজ। তিনি সরকারী চাকরীতে ত্রিশ বছর সৎ জীবনযাপন করার পর অবসর গ্রহন করার সময় যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে ছোট একটা বাড়ি তৈরী করেন অংশীদারী ভিত্তিতে। বাড়িটার এক ফ্ল্যাটে তিনি বাস করেন, অন্যফ্ল্যাট ভাড়া। চারতলা বাড়ির বাকী দুটো ফ্ল্যাট অংশীদারের। তিনি ছেলেমেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী পর্যন্ত পার করে নিজের টাকা দিয়ে তাদের বিয়েও দিয়েছেন। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি, ছেলেরা সঙ্গে আছে। তাঁকে একজন সফল মানুষ বলা যায়। এখন ষাট বছর বয়সে তাঁর নিরিবিলি অবসর জীবনযাপন করার কথা।

কিন্তু সেই অবসর ব্যাপারটি হচ্ছে না। এত বছর ধরে একটু একটু করে যতটা সঞ্চয় করেছিলেন, সবকিছু খরচ করে ফেলেছেন বাড়ি করার কাজে এবং ছেলেমেয়ের বিয়েতে। কিছু ঋনও করতে হয়েছে, একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া দিয়ে সেই ঋন পরিশোধ করতে হচ্ছে। সুতরাং তার হাত একেবারেই খালি। ছেলেরা কিছু দিলে পান, নইলে না। ছেলেরা খুব ভালো আয় করে না, তাই ওনার হাত খালিই থাকে। এর মধ্যে একদিন স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার ভয়াবহ সব খবর দিলেন। স্ত্রীর ডায়াবেটিস বহুবছর, এখন তার কিডনী, হার্ট, স্নায়ু, চোখ, দাঁত সবকিছু অকেজো হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার জন্য যে পরিমান টাকা দরকার সেই টাকার এক শতাংশও নেই তার কাছে। ছেলেরা কিছুই করতে পারছে না। অসহায় ভদ্রলোক ভাবতে থাকেন, কি করবেন। শহরে একটা চারতলা দালানের অর্ধেকের মালিক তিনি, কিন্তু কী সর্বস্বান্ত জীবন। এই বাড়ির একটা অংশ বিক্রি করলেও স্ত্রীর চিকিৎসা করা সম্ভব। কিন্তু ছেলেরা বাড়ি বিক্রিতে নারাজ। এই বাড়ি বিক্রি হলে তাদের ভাগে কিছুই থাকবে না। ভবিষ্যত অন্ধকার। এখন তিনি জানেন না, স্ত্রীর জীবন বড় নাকি ছেলেদের ভবিষ্যত বড়। সম্পদ তার কিন্তু সিদ্ধান্ত ছেলেদের। ছেলেরা বিয়ের পর মায়ের প্রয়োজনীয়তা ভুলতে বসেছে। এখন সবাই যার যার সংসারে মনযোগী। মায়ের কয়েক বছরের আয়ুর বিনিময়ে তারা ভবিষ্যতের অন্ধকার দেখতে চায় না। ভদ্রলোক তার জীবনের সন্ধ্যাবেলাতেই অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন।

এই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে চাই না বলে আমি জীবনের সন্ধ্যাবেলা দেখতে চাই না।


No comments: