Friday, November 29, 2013

প্রতিপক্ষ যখন মানুষ

১.
আমি নিরপেক্ষ মানুষ না। আওয়ামী লীগ দুর্নীতি বাটপারি করেছে বলে বিএনপিকে ভোট দিয়ে জামাতকে ক্ষমতায় আনবো না। বরং ভোটদানে বিরত থাকবো। কিন্তু জব্বার সাহেব দোদুল্যমান (তাঁর ভাষায় নিরপেক্ষ মানুষ)। গতবার নৌকায় ভোট দিলেও তিনি এবার বিএনপিকে ভোট দেবার নিয়ত করেছেন। টেক্সিতে যাচ্ছিলেন দোকানে। দোকানের কাছের মোড়ে এসে অবরোধের কবলে পড়ে হঠাৎ ছুঁড়ে দেয়া বোমায় টেক্সিসহ আপাদমস্তক ঝলসে যান তিনি। ঝলসানো শরীরে জব্বার সাহেব বুঝতে পারলেন যারা গণতন্ত্রের নামে আন্দোলন করছে, যারা তাঁর কাছে ভোট ভিক্ষা করবে কয়েকদিন পর, তারা আসলে তাঁর কথা ভাবছে না। তাদের চোখে অন্য স্বপ্ন, অন্য জিঘাংসা। তিনি বাধ্য হলেন তার ভোট দেবার নিয়ত বদলে ফেলতে।

২.
বাসভর্তি কাজের মানুষ। চাকরী বাঁচাতে ছুটছে। হঠাৎ একঝাঁক ককটেল আর পেট্রোলবোমার আক্রমণে বাসচালক দ্রুত থামাতে গিয়ে প্রায় উল্টে দেয় গাড়ি। ততক্ষণে ভেতরে আগুন ধরে গেছে। ভাগ্যবান বিশ পঁচিশজন হাত পা ছড়ে বের হয়ে আসতে পারলো, আরো পনের বিশজন বেরুতে বেরুতে ঝলসে আধা কাবাব এবং একজন সম্পূর্ন কাবাব হয়ে মারা গেলেন। ওই বাসের যাত্রীদের বিরাট অংশ ধানের শীষের ভোটার হতে পারে জেনেও যারা বোমা ছুড়ে, তারা কি ভোটের জন্য আন্দোলন করছে?

৩.
ট্রেন লাইন উপড়ে হাজার হাজার মানুষকে নানা জায়গায় আটকে রাখা হয়েছে, উল্টে গেছে বগি, হতাহত হয়েছে মানুষ। তীব্র ভোগান্তিতে লাখ লাখ মানুষ, পরীক্ষার্থী। দেশে কি যুদ্ধ চলছে? কে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে? ট্রেনে করে কি শত্রু দেশের সেনাবাহিনী চলাচল করে? ট্রেনে বাসে গাড়িতে টেক্সিতে করে যারা যাতায়াত করে তারা তোমাদের শত্রু? তোমাদের হরতাল অবরোধে কেউ কাজে যেতে পারবে না, স্কুলে যেতে পারবে না, অসুস্থ হতে পারবে না, হাসপাতালে যেতে পারবে না, বড়জোর মরতে পারবে। যারা কোথাও যেতে চায় তারাই তোমাদের শত্রু? তাদের বিরুদ্ধেই তোমাদের আন্দোলন? অবরোধ মানে দেখামাত্র আগুনে ঝলসে দেয়া? হরতালের সংজ্ঞা কি? অবরোধের সংজ্ঞা কি? পার্থক্য কি?

৪.
১৮ দলের মিছিলে যাদের কন্ঠ সবচেয়ে সোচ্চার, সবচেয়ে তীব্র, সেই জামাত শিবিরের কন্ঠে সবচেয়ে সোচ্চার হয়ে বাজে - বিপ্লব বিপ্লব, ইসলামী বিপ্লব। দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ছদ্মবেশে ইসলামী বিপ্লবের প্রস্তুতি চলছে? যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তারা ইসলামী বিপ্লবের স্লোগান সহ্য করে কি করে? যদি বিএনপিও ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে থাকে, তাহলে আর নির্বাচন, গণতন্ত্র ইত্যাদির জন্য মায়াকান্না দেখিয়ে কি কাজ। আন্দোলনের ভণ্ডামি না করে সরাসরি বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামুক।

বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, এখন যারা আন্দোলনের নামে দেশব্যাপি নৈরাজ্য চালাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য নির্বাচন নয়, গণতন্ত্র নয়, এমনকি তাদের প্রতিপক্ষ সরকার মনে হলেও তাদের আসল প্রতিপক্ষ মানুষ, তাদের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ।

মানুষকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে কেউ কখনো জিততে পেরেছে ইতিহাসে?

Sunday, November 24, 2013

মফিজ গার্মেন্টসের ১৩ সেন্ট

কথাটা পেড়েই মফিজউদ্দিনের তোপের মুখে পড়ে গিয়েছিলাম। গালিগালাজের ব্রাশফায়ার কানের শ্রবণসীমা অতিক্রম করার আগেই আমি প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে যাই। বেনিয়া লোকটা হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেলেও মুখের ভাষাটার কোন ব্যবস্থা করতে পারে নি। শালার গাড়ল! ব্যাবসা বন্ধ করে দেবে বলেও হুমকি দিল। দিলে দে, আমার কি? গজগজ করতে করতে অফিস ত্যাগ করলাম।  
নামকরা এক গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক তিনি। না পোষালে তাঁর ব্যবসা তিনি বন্ধ করে দিতেই পারেন। আমার করার কি আছে?
বিতর্কটা গার্মেন্টস শিল্পে ন্যুনতম মজুরী নিয়ে। শ্রমিক পক্ষ থেকে দাবী উঠেছে ন্যুনতম মজুরি ৮০০০ করতে হবে। এই দাবীর সাথে তিনি একমত নন, আমিও না। এক সাথে এত টাকা বাড়ানো সম্ভব না। তবু একটা যৌক্তিক সমাধানের জন্য আমি বললাম, এতটা যখন সম্ভব না, অন্ততঃ মাঝামাঝিতে আসি চলুন। ন্যুনতম বেতন ৬০০০ টাকা করে দিন তাহলে ঝামেলা চুকে যাবে। এটা শুনেই মফিজ সাহেব তেল-বেগুন-মরিচে বিস্ফোরিত হলেন।
"বছরে ১৬ কোটি টাকা বাড়তি লাগবে, ১৬ কোটি টাকা!! এই টাকা কি আমার ইয়ে থেকে বের করবো, নাকি আপনার.......?"
বাকীটা বললাম না প্রকাশের অযোগ্য বলে। মফিজ সাহেবের টাকাপয়সার হিসাব রাখতাম আমি। শ্রমিক -মালিকের মজুরী যুদ্ধের ক্রস ফায়ারে চাকরীটা গেলেও যে হিসেবের কথা মফিজ সাহেব শুনতে চাননি সেটা আপনাদের উদ্দেশ্যে বলতে ইচ্ছে হলো-
মফিজ গ্রুপের শ্রমিক সংখ্যা ৫৫০০ জন, কিন্তু এদের অনেকেরই বেতন ৬০০০ টাকার লেভেল পার হয়ে গেছে। অতএব বেতন তাদেরই বাড়াতে হবে যাদের এখনো ৬০০০ টাকার নীচে। নীচের লেভেলে আছে ১৫০০ জন। এই ১৫০০ জনের সবার বেতন ৩৫০০ নয়, তবু হিসেবের খাতিরে  ধরে নিলাম ১৫০০ জনের মজুরি ৩৫০০টাকার লেভেলে আছে এবং এদের সবাইকে ৬০০০ টাকায় উন্নীত করার জন্য মাথাপিছু ২৫০০ টাকা বাড়তি দরকার হবে প্রতিমাসে।  
১৫০০ শ্রমিকের বেতন ২৫০০ টাকা করে বাড়াতে হলে বছরে কত টাকার দরকার হয়? 
১৫০০ x ২৫০০ x ১২ = ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অবশ্যই অনেকগুলো টাকা, কিন্তু মফিজ সাহেবের হিসেবের ১৬ কোটির অনেক কম!
তবু কথা হচ্ছে এই টাকাটাই বা কোত্থেকে আসবে? ক্রেতার কাছ থেকে নাকি মফিজ সাহেবের লাভের অংশ থেকে।
বছরে মফিজ কোম্পানী ৪৫ লাখ পিস গার্মেন্টস রপ্তানী করে। যদি এই বাড়তি টাকাটা ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করতে হয় তাহলে মফিজ সাহেবকে প্রতি পিসে ১০ টাকা বা ১৩ সেন্ট বেশী পেতে হবে। মফিজ কোম্পানীর জ্যাকেটের বাজার মূল্য প্রতি পিসে ১০০ ডলার ডলার হলেও FOB মূল্য ১০ ডলার। আমেরিকার ক্রেতা বাংলাদেশের কারখানাকে যে মূল্য পরিশোধ করে সেটাকে FOB মূল্য বলে। এই ১০ ডলারের মধ্যে ৭ ডলার কাঁচামাল আমদানীতে যায়। শ্রমিক মজুরীতে যায় ১ ডলার। অন্যন্য খরচ ১ ডলার। বাকী ১ ডলার মফিজউদ্দিনের নেট লাভ।
ওদিকে পশ্চিমা মানবাধিকারের অন্যতম সোল এজেন্ট আমেরিকার ক্রেতা 'গিলমার্ট' মফিজ কোম্পানীর ১০ ডলারের জিনিস ১০০ ডলারে বিক্রি করে তাদের সুপার মার্কেটে। ওরা চাইলে মফিজ কোম্পানীকে এই ১৩ সেন্ট বাড়িয়ে দিতে পারে। এই সামান্য বৃদ্ধি তাদের লাভের এক দানা চিনিও না। তবু মাল্টি বিলিওনিয়ার গিলমার্ট শ্রমিক অধিকার রক্ষার বাণী যত সহজে দেয়, এক দানা বাড়তি দিতে তার দশগুন কষাকষি করে। এই ১৩ সেন্টও হয়তো দেবেও না। 
গিলমার্ট যদি ১৩ সেন্ট না দেয়, মফিজউদ্দিন কি কারখানা বন্ধ করে দেবে?
মফিজ গ্রুপের কারখানা ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত। যার মধ্যে ব্যাংকের ঋন ১২৫ কোটি টাকা। বছরে ৩৫০ কোটি টাকার গার্মেন্টস রপ্তানী করে মফিজ কোং, কাঁচামাল খাতে ব্যয় করে ২০০ কোটি টাকা। মজুরী ও কারখানার বার্ষিক খরচ ৮৫ কোটি টাকা এবং ঋনের সুদ ২০ কোটি টাকা বাদ দিলে তাঁর করমুক্ত নীট লাভ ৪৫ কোটি।
আমি মফিজ হলে কি করতাম? মজুরি বৃদ্ধির বাড়তি খরচটা ক্রেতার কাছ থেকে না পেলে কি ব্যবসা বন্ধ করে দিতাম? নাকি শ্রমিক বেতন বৃদ্ধি করে বার্ষিক লাভ ৪৫ কোটির জায়গায় ৪০ কোটি টাকা মেনে নিয়ে চুপচাপ ব্যবসা করতে থাকতাম?
সুতরাং মফিজউদ্দিন আমার চাকরী খেলেও নিজে ব্যবসাচ্যুত হবেন বলে মনে হচ্ছে না।

স্মৃতিময় গান, কোজাগরী রাত

শতেক আলোর ভিড়ে, নিভে গেল......
কোজাগরী রাত জাগা... চাঁদিনীর এত আলপনা....
(অজয় চক্রবর্তী)


প্রাঙ্গন জুড়ে সবুজের মেলা। আম, কাঠাল, পেয়ারা, কামরাঙ্গা, নারিকেল, বরই, জাম্বুরা সহ নানা জাতের ফলের গাছে আকাশ প্রায় ঢাকা। মাত্র কবছর আগেও গাছগুলো একদম চারাগাছ। ফকফকা জোছনা ছিল প্রান্তরজুড়ে। কিন্তু এখন জোছনাদের অনেক কসরত করতে হয় এই প্রাঙ্গনে প্রবেশ করতে। কোন কোন মাতাল করা চাঁদনী রাতে বেতের মোড়া নিয়ে বারান্দা বসে গাছের ফাঁক গলে পড়া জোছনা দেখতে বসতাম। কত বছর ধরে সেই মায়াবী জোছনার রূপ দেখছি, তবু যেদিন প্রথম অজয়ের এই গানের সাথে জোছনা দেখলাম সেদিন আমি জোছনার এক নতুন রূপ দেখলাম। আগে কখনো দেখিনি। গাছের ফাঁক গলে পড়া জোছনার আলো প্রাঙ্গন জুড়ে সৃষ্টি করেছে অসাধারণ এক আলপনা। অপূর্ব সেই দৃশ্য, বর্ননাতীত সেই সৌন্দর্য। আমি রাতভর সেই সৌন্দর্যে ডুবে থাকতাম। এমনকি রাত পোহাবার পরও আমার চোখে ভাসতো সেই আলপনার মায়া। অজয়ের এই গানটা আমি হারিয়ে ফেলেছি অনেক বছর আগে। তারপর থেকে ক্রমাগত খুঁজে গেছি। আর কোথাও পাইনি।

সেই মায়াবী জোছনার আলপনা ঢাকা বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে সেই কবে। তবু আমার সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতির একটি সেই কোজাগরি রাতের চাঁদের আলপনা।

আমি গানটি খুঁজে যাবো। যতদিন না পাই। এই গানের সাথে আমার প্রিয় স্মৃতিদের বসবাস।

আহা, কেউ যদি খুঁজে দিত? অথবা কোন একটা লিংক?

Thursday, November 21, 2013

আরো এক লক্ষ বছর পরে

শোনা যায়, আগামী এক লক্ষ বছর এই পৃথিবীটা টিকবে না। জমে বরফ হয়ে যাবে নাকি গরমে টগবগ করে ফুটবে আমি জানি না। পৃথিবীতে মানুষ আছে লক্ষ বছর ধরে অথচ এদের ইতিহাস জানা যায় মাত্র ছ হাজার বছরের। কারণ ছ হাজার বছর ধরে মানুষ সভ্য হচ্ছিল। দশ হাজার বছর আগে যা ছিল তাকে ঠিক সভ্যতা বলা যায় না। আর এক লাখ বছর আগে মানুষ নেহায়েতই আদিম পশু। এখন বলছি মানুষ সভ্যতার শীর্ষে উঠে বসে আছে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ উৎকর্ষতা ঘটে গেছে। মানুষের হাতে সভ্যতা বিধ্বংসী অস্ত্র চলে এসেছে। পৃথিবী ধ্বংস হতে আর বেশী দেরী নাই।

হয়তো যেদিন মানুষ প্রথম আগুন আবিষ্কার করেছিল পাথর ঘষে, সেদিনও তার সেরকম অনুভুতি হয়েছিল। মানুষ সূর্যের মতো গরম জিনিস পৃথিবীতে নামিয়ে এনেছে। মানুষের ক্ষমতা বিধাতার মতো হয়ে গেছে। বিশ্বজগত হয়তো একদিন এই আগুনেই পুড়ে যাবে। আদিম মানুষ সেদিন আগুনের আবিষ্কার করে নিজকে নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের শীর্ষগুরু ভেবেছিল।

দশ হাজার বছর পরের মানব প্রজন্মের তুলনায় আমরাও সেরকম আদিম। আমাদের আবিষ্কারের কতোকিছু বাকী রয়ে গেছে। আমরা এখনো জানি না। আমাদের কল্পনা খুবই সীমিত। পাথরঘষা আদিম মানুষ যেমন মোবাইল ফোনের কথা কল্পনা করতে পারতো না, আমরাও তেমনি জানি না দশ হাজার বছর পরের প্রযুক্তি কি? দশ হাজার নয়, এক হাজার বছরও আমাদের কল্পনায় আসে না। দুশো বছর কল্পনা করতে বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদেরও ঘাম ছুটে যাবে।

মনে হচ্ছে আগামী এক লক্ষ বছর পর এই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে না। শুক্র কিংবা বুধের মতো মৃত গ্রহ হয়ে থাকবে অনন্তকাল।  গ্রহ থাকবে কিন্তু মানুষ থাকবে না। ধার্মিকরা বলবেন ততদিনে কেয়ামত হয়ে যাবে, গোটা বিশ্বের অস্তিত্বই নড়ে যাবে। সেটা কোন একদিন ঘটবে, কিন্তু আগামী এক লাখ বছর পর সেরকম কিছু ঘটার কথা না। শোনা কথাটা তাই বিশ্বাস করলাম না। আমার বিশ্বাস চুড়ান্ত কেয়ামতের বাকী আছে আরো কয়েকশো কোটি বছর। বিলিভ ইট অর নট!!

আরো এক লক্ষ বছর পরে তোমার ফসিলের কার্বনেও কী লুকোনো থাকবে এই ভালোবাসা? তাহলে তোমার ঝলমল হাসিটা আরো একবার হাসো আমার জন্য।

Wednesday, November 20, 2013

বাড়ি ফেরা

১.
সোজা পথগুলো রূদ্ধ। বাঁকা পথেই রওনা দিল সে।

সবচেয়ে সোজা ছিল সল্টগোলা বারিকবিল্ডিং হয়ে আগ্রাবাদ পেরিয়ে টাইগার পাস লালখান বাজার। এটা হবে না, বারিকবিল্ডিং থেকে আগ্রাবাদ হয়ে দেওয়ানহাট পর্যন্ত দাউ দাউ জ্বলছে।

দ্বিতীয় বিকল্প পোর্টকানেকটিং রোড হয়ে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড দিয়ে বাদামতলি মোড় পেরিয়ে সোজা উত্তরে। তাতেও জ্বলছে আগুন আগ্রাবাদ এক্সেস রোডে।

তৃতীয় বিকল্প নয়াবাজার দিয়ে ঈদগাহ ঢাকা ট্রাংকরোড দিয়ে পাহাড়তলীর জিলিপির প্যাচ পেরিয়ে আমবাগান হয়ে টাইগারপাস।

তৃতীয় পথটা যথেষ্ট বাঁকা তবু তাতেই রওনা দিল সে। আর কোন পথ নেই। কিন্তু তৃতীয় পথে এসেও আমবাগানে থেমে যেতে হলো। আর যাবে না গাড়ি। সামনে প্রচণ্ড জ্যাম, তারও সামনে গণ্ডগোল। আশ্চর্য হলো সে, পুরো শহরটাই কি নারকীয় তাণ্ডবের আওতায় চলে আসলো?
আমবাগান নেমে, একে খান পাহাড়ের গলিতে ঢুকে পড়লো সে। এই রাস্তাটা নিরাপদ, এটা নিশ্চয়ই গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে দেবে।

অনিশ্চয়তায় ভর দিয়ে নতুন এই পথে হাঁটতে থাকে। এই রাস্তায় পৃথিবীর সকল নির্জনতা যেন লুকিয়ে আছে। পাহাড়ের উপর উঠতে উঠতে দেড় শতক পুরোনো স্থাপনা বাড়ি ইত্যাদি দেখতে দেখতে শহরের বিদ্যমান তাণ্ডব খানিক সময়ের জন্য ভুলে থাকতে পেরে স্বস্তি পেল সে।

ঘন্টাখানেক হাঁটার পর সে যে রাস্তায় উঠলো সেটা পরিচিত। বাঘঘোনা হয়ে গলিপথ পেরিয়ে যখন ওয়াসার মোড়ে পৌঁছুলো তখন সামনে অনেক লোকের ভিড়। সব ভিড় রাস্তার পশ্চিম দিকে। পূর্বদিক সুনসান নির্জন। অথচ তাকে যেতে হবে পূর্বদিকেই।

রাস্তা জনশূন্য,যানবাহনশূন্য। এমনকি রিকশাও চলছে না। ফুটপাতেও কেউ হাঁটছে না। জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের পাশের এই রাস্তায় কখনো এত নির্জনতা দেখেনি সে। রাস্তাটা পেরুতে হলে এই নির্জনতা পেরুতে হবে। মাঝখানে একদল দাঙ্গা পুলিশ। না, দুই দল। একদল মার্চ করছে বন্দুক হাতে। অন্যদল হেলমেট পরে বিক্ষিপ্ত ধমক দিচ্ছে লোকজনকে। ওই পথটুকু তাকে পেরুতেই হবে।

ওয়াসা থেকে আলমাস। মাত্র কয়েকশো গজ। একটা দৌড় লাগালে পৌঁছে যাবে সে। কিন্তু দৌড় লাগালে পেছনে গুলি ছুটে আসবে নিশ্চিত। আবার কাপুরুষের মতো এখানে দাঁড়িয়ে থাকাও পছন্দ হলো না তার। একটু ভেবে মার্চ করতে থাকা পুলিশের পেছনে সেও মার্চ করতে শুরু করলো। সামান্য যাবার পর রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটা গাড়ির ঝলসে যাওয়া কংকাল। ঘন্টাখানেক আগেও এটা একটা চকচকে কার ছিল, তবে টয়োটা নাকি নিশান বোঝা গেল না। পুড়ে কয়লা। আরোহী বেঁচেছে কি পুড়েছে জানে না সে। না বাঁচলে অবাক হবার কিছু নেই।

আচ্ছন্নের মতো পুলিশ দলের পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলো সে। সামনে কি আছে জানে না। পুলিশের সামনে দৌড় দেয়া অপরাধ হলেও পেছন পেছন অনুসরণ করা অপরাধ কিনা জানে না সে। পুলিশ ঘুরছে ডানদিকে ভিআইপি টাওয়ারের দিকে। সে কোনদিকে যাবে?

তখনি কোথা থেকে ১৩/১৪ বছরের একটা ছেলে পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে তাকে বললো, 'ওদিকে একটু আগে দুজন রিকশা আরোহী গুলিতে মারা গেছে। একটা বাচ্চা আর তার মা। মিছিল থেকে গুলি চালিয়েছে। ওদিকে যাবেন না'। ছেলেটার কথা শুনে চমকে গিয়েও সামলে নিল। কোন এক মা মেয়ে মারা গেছে। কিন্তু তাকে মরা চলবে না। জীবিত ফিরতে হবে বাসায় অপেক্ষায় থাকা আরো দুজন মা মেয়ের কাছে। ঝাপসা চোখ সামলে সে বাঁয়ে ঘুরলো। ব্যাটারি গলি দিয়ে ঢুকতে পারলে চিন্তা নাই।

ব্যাটারী গলি দিয়ে ঘুরার সময় দেখতে পেলো চট্টেশ্বরী মোড়েও ধোঁয়া, তখনো পুড়ছে। হাতে কালচে লোহার রড হাতে একদল লোক ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। চোখ ফেরাতে না ফেরাতেই দুয়েকজন লোহার রড উঁচু করে ইশারা করতেই আকাশবাতাস কাঁপিয়ে গুড়ুম করে উঠলো। ওগুলো রড নয় রাইফেল। গুলির লক্ষ্য সে নয়, পুলিশ। তবু অবুঝ বুলেট না বুঝে ঢুকে যাবে বুকের খাঁচায়। ছুটছে সবাই, ছুটলো সেও। এক ছুটে ব্যাটারি গলিতে ঢুকে গেল। বুকের ভেতর তখনো ধড়ফড়, মাত্র বেঁচে যাওয়া হৃদপিণ্ডটা।

আরো বেশ কিছুদূর হেঁটে, নানান গলি ঘুপচি পেরিয়ে যখন সে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালো সেখানেও সুনসান নীরবতা। এই রাস্তা কখনো জনশূন্য দেখেনি সে। কলাপসিবল গেট খুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে বাসায় পৌঁছে হাঁপাতে হাপাতে কলিংবেল। দরোজা খুললো উদ্বিগ্ন চেহারার পারমিতা। জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে বাংলাদেশের? সে কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ করে থাকলো। ভাবছে কোনদিকে যাবে সে? গতবার যাদের ভোট দিয়ে জেতাতে পারেনি, এবার তাদের ভোট না দিয়েও কি হারাতে পারবে? এতদিন পর নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে তার।

২.
সোজা পথেই রওনা দিল আরেকজন। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কা শেষ হবার পর পথঘাট পরিষ্কার। দুই পক্ষই সরে গেছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। সন্ধ্যার আলো জ্বলতে শুরু করেছে রাস্তার দুপাশের দোকানগুলোতে। কোন মোড়েই ট্রাফিক নেই। জ্যামও নেই। গাড়িতে চোখ বুজে আসলো আরামে। শোনা যাচ্ছিল শহরে খুব যুদ্ধ হয়েছে, দাঙ্গা লেগেছে। কোথাও তার কোন চিহ্ন নেই। আজব দুনিয়া। এত গুজব রটায় মানুষ!

চিটাগং ক্লাব পেরিয়ে এল গাড়ি। সার্কিট হাউসটা পেরোলেই পৌঁছে যাবে গন্তব্যে। গাড়িটা থেমে গেল সার্কিট হাউসের সামনেই। পুলিশের ব্যারিকেড এখানে। শত শত সবুজ পুলিশ। ড্রাইভার বললো, আর যাওয়া যাবে না।

নেমে গেল সে। পায়ে হেঁটে বাকী পথ যেতে কোন সমস্যাই না। কিন্তু সান্ধ্যকালীন প্রচণ্ড ভীড় সমৃদ্ধ কাজির দেউড়ির মোড়ে আজ একটা গাড়িও নেই, একজন মানুষও হাঁটছে না। সব দোকান বন্ধ। সব রাস্তা অন্ধকার। মাত্র সন্ধ্যা নেমেছে, কিন্তু যেন গভীর রাত।

সে কিছুই বুঝতে পারলো না। আশংকার মেঘ দানা বাঁধছে। ডানে, বামে, সামনে পেছনে সবখানে চকচকে হেলমেটের পুলিশ। একটা পোড়ানো জ্বীপ ঘিরে কয়েকজন দাঁড়িয়ে। সাইরেন বাজিয়ে হঠাৎ একটা পুলিশের অ্যাম্বুলেন্স। সে দ্রুত পেরিয়ে গেল মোড়। তারপর বাজার পেরুলো। পেছনে তাকাচ্ছে না।

কোথাও মানুষ নেই এই রাস্তায়। সে একা হাঁটছে আবছা অন্ধকারে। কিছু একটা ঘটেছে অথবা ঘটবে। খেয়াল করে দেখলো, সবগুলো বন্ধ দোকানের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে একাধিক চোখ। ফিসফিস করছে নিজেদের মধ্যে। এক বুড়ো দারোয়ান ফিসফিস করে বললো, জোরসে হাঁটেন। কোথাও ঢুকে পড়েন। ওই ওরা সোজা ওদিকে গেছে।

কারা? শিবিরের ছেলেরা। মানে তার সামনের দিকে শিবির। পেছনে পুলিশ। দুই পক্ষের হাতের অগ্নিবর্ষক নল। নিশ্চয়ই অগ্নিবর্ষক নলই ক্ষমতার উৎস। সে কোন শব্দ না শুনেই ঢুকে পড়লো বাড়ির গেটের ভেতর।

ওখানে তাকে ঢুকিয়ে যারা গেট বন্ধ করে দিল তারা জানালো - এই কিছুক্ষণ আগেই গোলাগুলিতে মারা গেছে দুজন।


একটি মন্তব্যঃ

এই একজন, অথবা দুজন অথবা এরকম কয়েকজন অথবা আরো কয়েক লক্ষ বা কোটি মানুষ এই দৃশ্যপট কিংবা এর চেয়ে অনেকগুন ভয়াবহ দৃশ্যপট অতিক্রম করছে। তবু আপনি বলছেন - গণতন্ত্রের দোহাই, জনস্বার্থে এটা তেমন বড় কোন ক্ষতি নয়। গণতন্ত্রের স্বার্থে এদের পোড়া কংকাল প্রকল্পে আত্মত্যাগ করুন। দেশকে ভালোবাসুন এবং যারা বাসে না, তাদের সহ্য করুন।

Monday, November 18, 2013

১৮ নভেম্বর ২০১৩ নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে

১.
নীলকন্ঠ পাখির খোঁজ আমিও জানতাম না। যখন শুনলাম তখন থেকে খুঁজে শুরু করলাম। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। অবশেষে পেয়ে গেলাম নীলকন্ঠ পাখির সন্ধান। পিডিএফে পেলাম সহব্লগার নিলয় নন্দীর কাছ থেকে(অশেষ কৃতজ্ঞতা ভদ্রলোকের কাছে), আবার কাগজে ছাপাটাও পেলাম বাতিঘরে। পিডিএফে পড়া শুরু করেছি তবু কাগজে ছাপা 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে' কিনতে বাতিঘরে যেতে হবে। অতীন বন্দোপাধ্যায়ের ক্লাসিক উপন্যাসটি কালেকশানে রাখার ইচ্ছে।

২.
মাঝে মাঝে ঘুরে দাঁড়ানো ভালো। মাঝে মাঝে ফিরে তাকানোও। ফিরবো না বলেও তখন ফেরা যায়।

৩.
একটা দিন নিভে গেলে, একটা রাত আসে। একটা নদী চলে গেলে আরেকটা নদী আসে না।

৪.
এই দিনটা অন্যরকম হতে যাচ্ছিল। অপ্রত্যাশিত, অনাকাংখিত, অনাহুত। প্রত্যাশা বিমুখ হয়েও কখনো কখনো বিপর্যয় ঠেকানো মুশকিল হয়ে দাঁড়ায় যখন চেনা মানুষ অপ্রত্যাশিত আচরণ করে। উথাল পাতাল ঝড়েও ঠাণ্ডা মাথায় মাঝি নৌকা সামালায়। জলপদ্ম তখন হাসে।



Sunday, November 17, 2013

একটি চেনা গল্প: স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট

১.
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ
দীর্ঘ দাঁতের করাত ও ঢেউ নীল দিগন্ত সমান করে
বালিতে আধ-কোমর বন্ধ
এই আনন্দময় কবরে
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ |
হাত দুখানি জড়ায় গলা, সাঁড়াশি সেই সোনার অধিক
উজ্জ্বলতায় প্রখর কিন্তু উষ্ণ এবং রোমাঞ্চকর
আলিঙ্গনের মধেযে আমার হৃদয় কি পায় পুচ্ছে শিকড়
আঁকড়ে ধরে মাটির মতন চিবুক থেকে নখ অবধি ?
সঙ্গে আছেই
রুপোর গুঁড়ো, উড়ন্ত নুন, হল্লা হাওয়ার মধ্যে, কাছে
সঙ্গে আছে
হয়নি পাগল
এই বাতাসে পাল্লা আগল
বন্ধ ক'রে
সঙ্গে আছে …
এক অসুখে দুজন অন্ধ !এক অসুখে দুজন অন্ধ !এক অসুখে দুজন অন্ধ !এক অসুখে দুজন অন্ধ !

[এটি শক্তি চট্টোপধ্যায় লিখেছেন। কিন্তু কি অদ্ভুত মিল! আমার চেনা দুজন মানুষকে দেখেছি এরকম একই অসুখে ভুগতে।]

২.
মাঝে মাঝে আরো কিছু অদ্ভুত মিল পাই। নীচের গল্পটিতে আমার চেনা মানুষের গল্প খুঁজে পেলাম। গল্পটি পড়তে গিয়ে আবার চোখ ভিজে গিয়েছিল। কিছু কিছু মধ্যবিত্ত জীবন ভয়ংকর সংকট লুকিয়ে প্রত্যেকটা দিন ভাণ করে কাটিয়ে দেয়। মানুষের জীবনের কত শতাংশ ভাণ হতে পারে? এদের কি ভাণ ছাড়া আর কোন গতি আছে? সচলায়তনে প্রকাশিত গল্পটি সংগ্রহ করে রেখে দিলাম তাই।
http://www.sachalayatan.com/aaynamoti/49814



স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট
----------------------------

আমি এ যুগের হরিপদ কেরানী। আমার গ্রামের ঠিকানা আপনারা জানবেন না। কিন্তু আমার শহরের ঠিকানা আপনারা চেনেন। শহরে নিন্মবিত্তদের জন্য তৈরী অগুনতি খুপড়ির একটিতে আমি থাকি। আমি একা থাকি না, আমার সাথে মা থাকে, বউ থাকে, সন্তান থাকে, ছোট দুই ভাই থাকে। বাবা বেঁচে থাকলে তিনিও থাকতেন। সুমনের 'দশফুট বাই দশ ফুট' গানটি শুনেছেন? আমি ছাত্রজীবনে শুনেছিলাম। এখন আমি সেই দশ ফুট বাই দশফুট ঘরে থাকি। সবাইকে নিয়ে। বিশ্বাস হয় না? না হবারই কথা। কারণ আপনারা এরকম জীবন দেখেননি।

আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেছি ইতিহাসে। পাশ করে আমি চাকরী পেয়ে গেছি তিন মাসেই। তার আগে আমি টিউশানি করে সংসার চালাতাম। তখন বেড়ার একটা বস্তি ঘরে থাকতাম। চাকরী পেয়ে আমি উন্নত বাসায় চলে আসি। হ্যাঁ আগের চেয়ে খুব উন্নত এই বাসা। ঝড় বৃষ্টি বাদলায় না ঘুমিয়ে চৌকির উপর বসে থাকতে হবে না আর। একটা পাঁচতলা দালানের তিন তলায় দশ ফুট বাই দশফুট একটা ঘর। সাথে লাগোয়া রান্নাঘর আর বাথরুম। গ্যাসের লাইন আছে। সপ্তাহে তিন দিন পানি আসে লাইনে। আর কি চাই। ভাড়াও নেহায়েত খারাপ না। ৩৫০০ টাকা। আর একশো টাকা দিলে ডিশের লাইনও দেবে। কিন্তু আমার টিভি নেই, ডিশ কি করবো। আমি যখন চাকরীতে ঢুকি তখন ৮০০০ টাকা বেতন। দুবছরে আমার বেতন বেড়ে ১০০০০ ছুঁই ছুঁই করছে।

আমি যখন ভার্সিটিতে ঢুকি তখন স্বপ্নে দশ হাজার টাকার একটা চাকরী ঘাপটি মেরে বসে ছিল। বাস্তবে বছরে ১০% হারে মুদ্রাস্ফীতি যোগ হলেও স্বপ্নে তার কোন ছাপ পড়েনি। আমার স্বপ্ন সফল হতে তাই কোন অসুবিধা হয়নি। আমি যখন স্বপ্ন দেখছিলাম তখন বাবার দোকানটা ছিল, দোকানের আয়ে সংসার চলতো ফুরফুর করে। আমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতাম দশ হাজার টাকার একটা স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্নে ছিলাম কেবল আমি আর সুনন্দা। আমাদের দুজনের একটা সংসার, ফুটফুটে একটা বাচ্চা।

কি অবাক কাণ্ড দেখুন, আমার সেই স্বপ্নটা কেমন হুবহু পূরণ হয়ে গেল! শুধু একটা পার্থক্য। তিন বছর আগে হুট করে বাবা মারা গেলে আমার স্বপ্নের সংসারে ঢুকে গেল মা আর দুইভাইও। বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের মধ্যে ছিল ছাপ্পান্নো হাজার টাকার একটা ঋণের বোঝা। সাড়ে তিন বছরের টিউশানীর জমানো টাকা থেকে বোঝাটা হালকা করেছি। ফলে আমি যখন চাকরীতে ঢুকি তখন ঋণমুক্ত।

চাকরীর এক বছরের মাথায় সুনন্দাকে বিয়ে করতে হলো। ভাবছেন সুনন্দাকে কেন বিয়ে করতে হলো এরকম চাপাচাপি সংসারে? উপায় কি বলুন, না করলে তো সে চলে যেতো অন্য ঘরে। "চাকরীটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো...."..বলে কাঁদলে কোন লাভ হতো না তখন।

সে যাই হোক, আমি কেবল চাকরীটা আছে বলেই সন্তুষ্ট। সুনন্দা, ছোট্ট বাবু, মা, দুই ছোট ভাই, এদেরকে নিয়ে একটা ছাদ দেয়া ঘরে বাস করতে পারছি এতেই সুখী। আমি যেখানে কাজ করি সেটা বাসা থেকে দুই মাইল দূরে। রিকশায় গেলে বিশ টাকা, বাসে গেলে পাঁচ টাকা। আমি হেঁটেই যাই। ঝড় বাদলার দিনে একটু অসুবিধে হয়। তবু ভেবে সুখী হই দুই কায়দায়। রিকশায় না গিয়ে বাঁচলো মাসে পাঁচশো টাকা। বাসে না গিয়ে বাঁচলো দেড়শো টাকা। ভাবছেন অভিনব সুখপন্থা? আসলে পাঁচশো টাকায় মায়ের ওষুধের খরচ উঠে যায়, দেড়শো টাকায় মাসে একবার রুই মাছ কিংবা মাংস খেতে পারে পরিবার।

আমরা সাধারণত নিরামিষভোজী। মাছ মাংস তেমন ছুঁই না। শাক, ভাত, ডাল - এই তিনে চলে যায়। শরীরের জন্য তেল ক্ষতিকর, তাই আমরা তেল কিনি না। চিনি খেলে মায়ের সুগার বাড়ে, তাই চিনিও বাদ। আমরা চা নাস্তা করি না। তবে মেহমান আসলে একটু বিপদে পড়ে যাই, তাই আমি কাউকে বাসায় আসতে বলি না। বাবুর জন্মের পর বিপদে পড়েছি খানিক। খরচপাতি বেড়ে গেছে। সুনন্দা ট্যা ট্যা করে বাবুর জন্য দুধ কেনা দরকার, বাইরে খাবার না খেলে শরীর বাড়বে না। আমি চুপ করে থাকি। করার কিসসু নাই। আমার বাজেটে বাড়তি সুযোগ আছে কি? হিসেবটা দেখুন- দৈনিক তিন বেলা খাবার পেছনে দেড়শো টাকা লাগে, পুরো মাসে সাড়ে চার হাজার। খাওয়া ঘর ভাড়া বাদ দিলে বাকী থাকে দুই হাজার। দুই ভাইয়ের স্কুলের খরচ আটশো টাকা। বইখাতা পেন্সিল কলম বাবদ আরো দুশো। মায়ের ওষুধপত্র, বাথরুমের সাবান, টুথপেষ্ট এসবে লাগে আরো চার পাঁচশো টাকা। দশ হাজার টাকার হিসেবটা তো প্রায় খতম, আর বাড়তি কোথায় পাই। বাবুটাকে আমাদের তিন পদে অভ্যস্ত করতে বলি।

তবে হ্যাঁ কেউ যদি অবিবেচকের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন বিপদ। তেমন বিপদ মাত্র একবার ঘটেছিল গত বছর। ধার করে এরকম বিপদ সামাল দেয়া যায়, কিন্তু তেমন ধার শোধ করতে অপেক্ষা করতে হয় বছরের ঈদ বোনাসের সময় পর্যন্ত। হ্যাঁ ঈদের সময়টা খুব আনন্দের। ওই একটা দিন আমরা নিরামিষভোজী থেকে বেরিয়ে আসি। জামা কাপড়ে ব্যয় কমিয়ে একদিন একটু ভালো খাই। অতিথি সেবা করি। ওই্ একদিনের পোলাওয়ের স্বাদ আমাদের নস্টালজিক করে দেয়। বাবার আমলে আমরা মাসে দুয়েকবার এমন খেতে পারতাম।

এই দেখেন কেবল খাওয়াদাওয়া নিয়েই আছি। বাসস্থানের দিকে নজর দেয়া হলো না এখনো। চলুন বাসস্থানের গল্প করি। আগেই বলেছি দশফুট বাই দশফুট। বাবা মারা যাবার পর আমরা যখন বস্তিতে চলে যাই তখন একটা চৌকি বাদে আর সব আসবাব বিক্রি করে দিয়েছিলাম। জায়গা নেই রাখবো কোথায়? বস্তি ছেড়ে এখানে আসার সময় চৌকিটাও বেচে দিয়েছি দুইশো টাকায়। চৌকি থাকলে বরং এখানে শোবার অসুবিধা। এখন মাদুরের উপর কাঁথা বিছিয়ে তার উপর বিছানার চাদর পেতে পাশাপাশি দুটো বিছানা তৈরী করি রাতে শোবার আগে। এক বিছানায় আমি সুনন্দা আর বাবু। অন্য বিছানায় মা আর দুই ভাই। আমরা ম্যানেজ করে নিয়েছি। করতেই হয়। অসুবিধা হয়নি।

এই দালানে মোট ৫৫টি খুপড়ি ঘর। বড়লোকেরা এরকম জিনিসকে বলে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। শখ করে কিনে বিদেশে এমনকি কক্সবাজারের সৈকতে। আমাদের এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে এসি নেই। টিভি, ফ্রীজ নেই। এমনকি খোলা জানালার আকাশও নেই তবে বৈদ্যুতিক আলো আর ফ্যানের বাতাস আছে। তবু এখানে আমি সুখী। কেননা সুনন্দা আমাকে অভিযোগ করে না। মা আমাকে অভিযোগ করে না, ভাইয়েরা অভিযোগ করে না। ওরা জানে আমি সীমাবদ্ধ। প্রবল প্রবল সীমাবদ্ধতা আমার হাত পায়ে সমস্ত শরীরে। ওরা তাই দিনের পর দিন একই রঙের শাক ভাত আর ডাল খেয়ে কাটিয়ে দেয়। বাবুটা মাত্র ছমাস, সে এখনো বোঝে না দুনিয়ার হালচাল। তার চোখে হয়তো গোটা দুনিয়াটাই আলোবাতাসহীন একটা ষ্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট।

আমি যেখানে কলম পিষি, সেখানে দুপুরে খাবার মেলে। এক সাথে কয়েকশো মানুষের খাবার রান্না হয়। ভাত আর ডাল যত খুশী খাও, সবজি মাছ মাংস ডিম যে কোন একটা এক বাটি করে। আমার সামনে যখন মাছ মাংসের বাটি আসে, আমার ইচ্ছে করে ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে মাছ বা মাংসের টুকরোটা কাগজে মুড়ে ঘরে নিয়ে যাই। কিন্তু আমার আশেপাশে যারা বসে তাদের সবাই স্বচ্ছল ঘরের সন্তান। তাদের পাশে বসে এই কাজ করা যায় না। ওরা কেউ জানে না আমি কেমন জীবন কাটাই। আমার মুখোশকেই সত্যি মনে করে ওরা। জানি ওরাও দশ হাজার টাকাই বেতন পায়, কিন্তু ওই টাকার উপর ছ জনের একটা পরিবার নির্ভর করে না।

আমি খুব টানাটানি সংসারী? কথা সত্যি। তবে আমার দশ হাজার টাকাকে কখনো কখনো যখন বেশী টানটান মনে হয় তখন আমি আরেকটু নীচের দিকে তাকাই। নীচের ফ্লোরে রঙিন জামা পরা মেয়েগুলো মাসে চার পাঁচ হাজার টাকার বেশী পায় না। তবু ওদেরকে কোন কোন সময় আমার চেয়েও বেশী হাসতে দেখি। ওই হাসির পেছনেও কি কষ্টের নহর? জানি না। ওদের কষ্টের কথা ভেবে সমবেদনার বদলে আমি বরং সুখী হয়ে উঠি আবার।

সন্ধ্যে ছটার পরে কাজ থাকলে একটা ছোট বিস্কুটের প্যাকেট আর একটা কলা দেয় আমাদের। এই দুটো জিনিস পকেটে করে বাড়ি নিয়ে আসতে কষ্ট হয় না আর। কলাটা মাকে দেই, মা অর্ধেক দেয় সুনন্দাকে, বিস্কুট সবাই একটা করে খাই। তখন আমরা সবাই খুব হাসি এক সাথে হাসি, যেন আমরা আসলেই সুখী নগরীর বাসিন্দা।

এই পাঁচ তলা দালানের ছাদের উপর দিয়ে হু হু বয়ে যাওয়া বাতাসে বিনে পয়সার সুখ। কোন কোন রাতে ছাদে উঠে আমি সেই সুখ স্পর্শ করি। সুখের আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলি অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভুলে। আমি প্রতিদিন একটা পুরোনো ঘ্রাণের নতুন জীবন নিয়ে জেগে উঠি এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে।

[ পাদটীকাঃ না দেখা জীবন নিয়ে গল্প লেখার অভিজ্ঞতা আমার নেই। দেখা জীবন নিয়ে গল্প লিখতেই হিমশিম খাই। তবু এই গল্পটা লিখতেই হলো একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনে। লিখতে হলো সেই সব ধনবান নিয়োগকর্তাদের উদ্দেশ্যে যারা নিয়োগ পত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার চাহিদাটা যেরকম মোটা অক্ষরে লিখেন, পারিশ্রমিকের অংকটা সেই অক্ষরে লিখতে পারেন না। শ্রমিক শোষণ নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্য দেশে বিদেশে অনেক মানবাধিকার গোষ্ঠী থাকলেও এসব শিক্ষিত অর্ধাহারী তরুণদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই। অথচ প্রায় ভিক্ষুকের জীবনযাপন করে এদের কেউ কেউ। যদি কোথাও অতিরঞ্জন মনে হয় তবে সাভার আশুলিয়া বা রামপুরা রোডের যে কোন গার্মেন্টস কর্মীর আবাস স্থলে ঘুরে আসতে পারেন। ]




Saturday, November 16, 2013

১৬ নভেম্বর ২০১৩, অম্লান অঘ্রান

১.
তোমার জন্য বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তুমি জানো না তোমার জন্য আমার কতখানি পেট পুড়ে, কতখানি বুক জ্বলে, কতখানি আমি লণ্ডভণ্ড হয়ে যাই। আজ দুপুর থেকে জ্বলছে, গতকাল জ্বলেছে, হয়তো আগামীদিনও জ্বলবে। দিনের পর দিন তুমি কি এভাবেই আমার ভেতর ঢুকে আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেবে হে ক্যান্টিনের পোড়া তেলে ভাজা ডিমের মামলেট? আমি আর কতকাল তোমাকে সহ্য করবো?

২.
গতকাল এক টিভি চ্যানেলে সকালে বলছিল আজ শুক্রবার ১ অগ্রাহয়ন, শীতকাল, ১৪২০ সাল।
আমি চোখ গোল করে তাকিয়ে ভাবছিলাম শীতকাল তাহলে সত্যি সত্যি অঘ্রানে ঢুকে গেল?

৩.
কিছু কিছু অন্ধকার আলোতেও দৃশ্যমান।


Thursday, November 14, 2013

১৪ নভেম্বর ২০১৩ সিনেমা টিনেমা

১.
কমলেশ্বর মুখোপধ্যায়ের 'মেঘে ঢাকা তারা' ছবিটা দেখে ফেললাম সেদিন। এই ছবিটা অতীতে আমার দেখা উপমহাদেশের সব ছবিকে ছাড়িয়ে গেল। এই একটা ছবির ভেতর উপমহাদেশের ইতিহাস আন্দোলনের বিরাট একটা সারাংশ চলে এসেছে। এই মাপের নির্মান, এই মানের চলচ্চিত্র আর কয়টি হয়েছে জানি না। তবে আমি দেখিনি। 'মেঘে ঢাকা তারা ২০১৩' তাৎক্ষণিকভাবে আমার চোখে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসে গেল। আমার বিশ্বাস এই ছবি যদি আটলান্টিকের পূর্ব-পশ্চিমে নির্মিত হতো, এটা অবশ্যই খান কয়েক অস্কার পকেটে পুরে আনতো। ঋত্বিক ঘটকের জীবনের বৈচিত্র্যময় অধ্যায়গুলো ততোধিক বৈচিত্রময়রূপে উপস্থাপন করার যে দক্ষতা কমলেশ্বর দেখিয়েছেন, সেটা সাম্প্রতিক ইতিহাসে তুলনাবিহীন। ছবির দেশকাল মানুষ নিয়ে গানগুলো মর্মভেদী। বিটোফেনের ফিফথ সিম্ফোনীর এমন মর্মান্তিক ও প্রাসঙ্গিক ব্যবহার সম্ভবতঃ বিশ্বের আর কোন চলচ্চিত্রে হয়নি। এই নতুন মেঘে ঢাকাও তারা(http://en.wikipedia.org/wiki/Meghe_Dhaka_Tara_%282013_film%29) দর্শকের স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে অনেক কাল। যদি সম্ভব হতো এই ছবির একটা রিভিউ লিখতাম। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় সেই দুঃসাহস আমার নেই।

২.
প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার যে আনন্দ, তার বিপরীত ঘটনাটাই ঘটলো মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর 'টেলিভিশন' দেখে। এটার উপর ব্লগ ফেসবুক আর পত্রিকার লেখালেখি পড়ে, ছবিটা নামিয়ে দেখেই ফেললাম। ছবিটা সম্পর্কে আলোচনা করে শব্দ অপচয় করবো না। শুধু দেখতে বসে যে তেতো বেরিয়েছে তার খানিকটা বলি। তবে ছবি দেখার সময় যে অনুভূতি হয়েছে তার সাথে তুলনা করা যায় আশির দশকের বিটিভির হীরামনের সাথে। আপনি বলতে বাধ্য হবেন, ফারুকী ইগ্গা জিনিস বটে!  এই জিনিস আবার বিদেশের হলে প্রদর্শিত হয়েছে শুনে আমি বাংলাদেশের জন্য সমবেদনা অনুভব করলাম। বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের সিনেমাকে অপমান করার জন্য এই সিনেমার চেয়ে উপযুক্ত আর কিছু হতে পারে না। সিনেমা আর টিভি নাটকের মধ্যে ব্যবধান তৈরী করা দূরূহ হয়ে যায় এই ছবিতে। সিনেমাটোগ্রাফি বলে একটা জিনিস আছে চলচ্চিত্র নির্মানের কায়দায়। এটি তার ধারে কাছেও ছিল না। এবার নাকি অস্কারের জন্যও লাইনে দাঁড়িয়েছে ছবিটা। শুনে লজ্জাই পেয়ে গেলাম। ধন্য হে ফারুকী।

৩.
গত কয়েক মাসে যে শখানেক ছবি যোগাড় করেছি সেগুলো নিয়ে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ প্রায় ৫০০ ছুঁয়ে গেছে। মূল টার্গেট নন হলিউডি এবং নন ইংরেজি ছবি সংগ্রহ অব্যাহত থাকবে। কিন্তু যে পরিমান যোগাড় করছি সেই গতিতে ছবি দেখার সুযোগ পাচ্ছি না। ফলে জমে যাচ্ছে অঢেল অঢেল। পরশুদিন একটা শর্ট ফিল্ম দেখলাম The Crush. ভালো লেগেছে। তার আগে শ্রীলংকান ছবি 'আকাশ কুসুম' দেখলাম। বাণিজ্যিক ছবি হলেও রুচিসম্মত বাণিজ্য। এই প্রথম শ্রীলংকার ছবি দেখলাম। নেপালের 'কাগবেনি' অবশ্য আরো ভালো লেগেছিল। তবে ভূটানের 'ট্রাভেলার্স এণ্ড ম্যাজিশিয়ান' তুলনাবিহীন। গতবার ভূটান গিয়ে ওই মুভিটা কিনেছিলাম চড়া দাম দিয়ে। দেশে অনেক খুঁজেও পাইনি। কদিন আগে ইউটিউবে দেখি ছবিটা কে যেন আপ করে রেখেছে। বিনে মাগনাতেই পাওয়া যাচ্ছে এখন। এরকম ঘটনায় মনটা একটু খারাপ হয়। যেমন বাংলাপিডিয়া যখন প্রথম বেরোয় ১০০০০ টাকা দিয়ে কিনতে হতো। আমি সেই দামে কিনে পরের বছর দেখলাম ডিসকাউন্টে ৩৫০০ টাকায় দিচ্ছে। এক কলিগ ৮০ টাকা দিয়ে একটা সিডি কিনে পুরো সবগুলো খন্ডই পেয়ে গেল। কেমন অবিচার! ২০০৩ সালে দশ হাজার টাকা আজকের এক লাখ টাকার সমান ছিল। টাকাগুলোর জন্য মায়াই লেগেছিল পরে।

৪.
কাল রাতে যে এক ঘন্টাও ঘুম হয়নি, তা আজ দুপুরের চমৎকার লাঞ্চ পুষিয়ে দিয়েছে। খুব বেশী কিছু না, ছোট মাছের চচ্চড়ি আর চিংড়ি-ফুলকপি। অপূর্ব। নতুন ওঠা শীতের তরকারি ভীষণ ভালো লাগে এই সময়ে। অফিসের জঘন্য খাবার এড়াতে মাঝে মাঝে বাসা থেকে আনা খাবার অমৃতের মতো লাগে। বিশ্রী রাজনীতির বিবমিষা নিয়ে লিখতে ভালো লাগছে না বলে খাবারদাবারের কথা চলে এল।


 




Tuesday, November 12, 2013

১২ নভেম্বর ২০১৩ : উর্বর চিন্তাসমূহ

১.
বুদ্ধি বিভ্রান্ত মানুষই আজকাল রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেই নেতৃত্ব সমর্থন করছে জ্ঞানের সওদাগরেরা। জীবনভর যে মূল্যবোধের কথা পড়েছেন, শিখেছেন, লিখেছেন, তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছেন।

২.
স্বাধীন মত প্রকাশ করার সুযোগ থাকলেও সুবিধাজনক ভবিষ্যতের বাসনায় নিজের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিচ্ছে কিছু মানুষ। জ্ঞানী লোকের বিভ্রান্ত পথে হাঁটাটা গাছপাকা ফল পোকায় ধরার মতো।

৩.
সুস্থ চিন্তাকে গ্রাস করেছে অপরাজনীতি। অব্যাহত ধ্বংসকে নিয়তি মেনে নিয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ জাতি পৃথিবীতে কমই আছে।

৪.
আমরা বর্তমানে যা দেখছি, এর চেয়ে খারাপ অবস্থা আগে কখনো আসেনি। এই ভাবনাটা মানুষের মগজে ঢুকে আছে আরো কয়েকশো বছর ধরে। আগামী কয়েকশো বছরও থাকবে হয়তো। মানুষ সবসময়ই বলে এসেচে আগের সবকিছু ভালো ছিল, বর্তমানে সব নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাটা মানুষের নিয়মে নেই।

৫.
আমি ভালো আছি। বর্তমান নিয়ে সবচেয়ে ভালো আছি। অতীতেও ভালো ছিলাম না। ভবিষ্যতেও ভালো থাকবো না। এরকম ভাবনার মার্কেটিং করা খুব অসুবিধা জনক হবে?


নোটস-
টাকাপয়সা আনন্দদায়ক ব্যাপার এটা মুখে কেউ স্বীকার করে না৷ হাতে মোটা অংকের টাকা আসলে ফুরফুরে হয়ে যায় মন৷ আমার এখন কিছু টানাটানি যাচ্ছে৷ মন খারাপ তাই৷ কয়েক লাখ টাকা আটকে আছে পাওনাদারের হাতে৷ কেউ জানে না৷ টাকাগুলো পেলে ভরে যেতো বুকটা৷ আহ টাকা তোমাকে বেশী ভালোবাসি এই অনটন দিবসে৷ প্রিয়তমার চেয়েও বেশী৷ 

Who is she?
The one who causes me travail?
Or whom I never saw yet

আমার প্রিয়তমা কে? যার সাথে প্রেম হবার ছিল অথচ হয়নি সে কি প্রিয়তমা হতে পারে? 

তার কথা মনে পড়ে৷ সে কেন এমন মনোযোগ দিয়েছিল আমার দিকে৷

তার কথা মনে পড়ে৷ সে কেন এতটা মমতাময়ীর চোখে তাকিয়েছিল৷

তার কথা মনে পড়ে৷ অসম্ভব জেনেও সে কেন হাত বাড়িয়েছিল৷

তার কথা মনে পড়ে৷ সে আমার চোখে পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে বসে থাকবে৷

আমি জানি আমার কথাও তার মনে পড়ে, নিশ্চয়ই পড়ে৷ তার জন্য মঙ্গলকামনা৷ 

Thursday, November 7, 2013

৭ নভেম্বর ২০১৩ ভুল বিপ্লবের উদরপূর্তি আজ

১/ আজ কমলেশ্বরের 'মেঘে ঢাকা তারা ২০১৩' কপি করেছি। আরো অনেক ছবি জমে গেছে। আফ্রিকার অনেকগুলো। দক্ষিন এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যেরও বেশ কটা। বাংলা আছে কয়েকটা। পুরোনো মুভি। ক্লাসিক আর বিশ্বখ্যাত মুভিগুলো জমে গেলে আক্ষেপ লাগে। কিন্তু এক নাগাড়ে দুঘন্টা বসার অবসর কই। বই পড়তে গেলে মুভি দেখা হয় না, মুভি দেখতে গেলে বই পড়া হয় না। দুটোতেই সমান নেশা।

২/ রাজনীতি প্রতিদিন বিরক্ত করছে। ২০১৩ সালের মার্চ আর মে মাসের অন্ধকার যদি আবারো ফিরে আসে, তাহলে বাংলাদেশের সকল ভবিষ্যত বিপদগ্রস্থ।

৩/ যাদের আছে তাদেরই ভয় বেশী, যাদের নেই তাদের ভয়ও নেই। ব্যাপারটা বেশ মজার।

৪/ মাথায় ভ্রমণ পরিকল্পনা ঘুরছে। এডভেঞ্চার সিজন আগামী তিনমাস। এবার শুধু পরিকল্পনাই হবে। কোথাও যাওয়া হবে না।

৫/ আজ একটা ঐতিহাসিক ভুল দিবস। এই ভুলের খেসারত বাঙালী দেবে দশকের পর দশক।


Tuesday, November 5, 2013

৫ নভেম্বর ২০১৩ : পুড়ছে মানুষ

১.
কোথাও পড়েছিলাম - একজন নিরপরাধ মানুষ শাস্তি পাবার বদলে গোটা পৃথিবীর ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভালো। কথাটা আক্ষরিক অর্থে সঠিক নয়, কিন্তু বলা হয়েছে নিরপরাধ মানুষের শাস্তিটা কতবড় অপরাধ তা বোঝাতে। অথচ সেরকম অপরাধ আজকাল শয়ে শয়ে হচ্ছে দেশে দেশে। বাংলাদেশে আরো বেশী। হরতালে মানুষসহ গাড়ি পুড়িয়ে দেবার ঘটনা এত বেশীবার ঘটে গেছে যে এখন তা আমাদের স্বাভাবিক ঘটনার ডিকশেনারীতে ঢুকে গেছে। এটাকে এখন ভয়ংকর অপরাধ বলার চেয়ে সাধারণ একটা খবর হিসেবেই দেখা হয়। যারা পোড়ায় তাদের অজুহাতের অভাব নেই।

মানুষসহ গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা শুনে এক সমর্থক বলে উঠলো - "গাড়িটা যখন পোড়াচ্ছিল তখন সে চট করে নেমে না পড়ে ভেতরে বসে ছিল কেন?" সমর্থকের এই কথা শুনে আমি বোকার মতো চমকে উঠেছিলাম। জামাত-শিবির সমর্থকরা যে পৃথিবীর সবচেয়ে নাদান হিংস্র প্রাণী সেটা জানলেও দলীয় অন্ধ সমর্থক কত ভয়ংকর একটা জিনিস এই বাক্যটা শোনার আগে বুঝিনি।

গতকাল গাজীপুরে একটা কাভার্ডভ্যানে আগুন দিয়ে তার ভেতরে থাকা ১৪ বছরের একটা কিশোরকে পুড়িয়েছে জামাত-শিবির-বিএনপি। পত্রিকায় ছবি দেখে যতটা শিউরে উঠেছি তারচেয়ে বেশী শিউরে উঠেছি এটার সমর্থনে তাদের সমর্থকদের যুক্তি কল্পনা করে।
 

২.
দ্বিতীয় ৬০ ঘন্টা হরতালের আজ দ্বিতীয় দিন। আজ রাতের খাবার নিমতলা খেতে হবে। ছোট মাছের দাওয়াত। শিহান ফোন করেছিল দুপুরে। আধো বোলে ডাক দিয়েছে, "তুমি কখন আসবা? আজ সন্ধ্যায় তুমি আসবা কিন্তু"। এরকম  ডাক শুনলে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে।

৩.
ভাইবার একটা চমৎকার অ্যাপস। আরো কদিন আগে ইনস্টল করলেও আজই তার সঠিক মর্ম অনুভব করলাম।

Monday, November 4, 2013

৪ নভেম্বর ১৯১৩ : প্রান্তিক আয়ের মানুষ

১/ এই সপ্তাহের ৬০ ঘন্টার হরতালের প্রথম দিন আজ। ছুটির পর বাড়ি ফিরতে ঝামেলা হবে। হেঁটে বা রিকশায় যা পাই তাতে কয়েক কিস্তিতে যেতে হবে।

২/ দুটো লেখা লিখলাম। একটা চেনা জায়গার জন্য আরেকটা অচেনা জায়গার জন্য। দুটোই ছেড়ে দিয়ে থিতু হলাম এখন। অফিসে আজ কাজ কম ছিল। লেখালেখিতে সময় পেয়েছি।

৩/ প্রান্তিক আয়ের কিছু মানুষের জীবনযাপন নিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরী করছি। দশ বারোজনের সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। তাদের ব্যয়ের খাতগুলো জরীপ করেছি গত কয়দিনে। ১০০ ডলারের নীচে আয় করা মানুষ কিরকম জীবন যাপন করে বাংলাদেশে, সেটা বের করাই মূল উদ্দেশ্য। শ্রমিকদের মজুরি কতটা বাড়লে জীবনটা সহনীয় হয় সেটাও জানা দরকার। আমি নিজে একটা কারখানার মালিক হলে কি করতাম। এরকম কিছু চিন্তাভাবনা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।

বিউগল রেষ্টুরেন্ট ও আতিক্কা হোঁচট

গল্প-১
বিউগল রেষ্টুরেন্ট

সুবেদার আলীর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। শরীর বললে ভুল হবে। কাঁপছে তার দুই গ্যালন সাইজ ভুড়িটা।

জীবনে এই প্রথম তার এরকম কোন জায়গায় আসা। তার নিজের কখনো সুযোগ হতো না যদি হাতেম তাকে এই সুযোগ না দিত। হাতেম তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী। একই মেস ঘরে থাকে দুজনে। বিউগল রেষ্টুরেন্টে কাজ করে হাতেম। ভালোমন্দ খাবার সুযোগ হলেও হাতেমের দিন কাটে হয় মুলার ঝোল নয় শশার ঝোলের তরকারি আর বড়জোর একটা ডিম।  সুবেদার মেট্রিক পাশ। হাতেমের চেয়ে শিক্ষিত। কিন্তু খাবার দাবারে দরিদ্র। কারণ সে একটা গুদামে বস্তা গুনার কাজ করে। হাতেমের কাছ থেকে খাবার দাবারের গল্প শুনতে শুনতে অবিশ্বাস্য লাগে তার। কোন কোন বেলায় নাকি দুইশো পদের খাবারও সাজানো থাকে ওখানে। তার নাম বুফে। এত খায় কেমনে? এমনকি তার দুই গ্যালনের পেটের মধ্যেও বড়জোর বিশ পদ ঢুকানো যাবে ঠেসেঠুশে। 

অনেক আবদার অনুরোধ করে হাতেমকে রাজী করিয়ে একটা সুযোগ বের করে এই ঢেকি গিলতে আসা। এক বড়লোকের বিয়ে। বিশাল হল ঘরের তিন দেয়াল জুড়েই খাবারের রুপোলী বাক্সগুলো সাজানো। প্রতিটা বাক্সের নীচে মোমবাতি জ্বালানো। হাতেমের টেবিলে বসেছে আরো কয়েকজন। তাদের একজনের পিছু নেয় হাতেম। স্পাইসি প্রন সুপ উইথ ইয়ং কোকোনাট মিল্ক নামের আইটেমটা নেয়। মজা লাগে না।  আবার উঠে আসে। এবার নিল স্পাইসি ক্লিয়ার প্রন সুপ। এটা একটু ঝাল, কিন্তু ঝোল পাতলা। একটু খেয়ে রেখে দিল। এবার গিয়ে নিয়ে আসলো স্পাইসি ক্লিয়ার চিকেন সুপ। এটায় মুরগীর টুকরাগুলো কেমন সাদা সাদা।

ধুত্তারি!

সে আবার গিয়ে নিল সিফুড সুপ উইথ ইয়ং কোকোনাট মিল্ক। আবারো মেজাজ খারাপ হয়। এত মিল্ক মিল্ক কেন? সে কি দুধ খাইতে আসছে? সে খুজে নিল ভিন্ন একটা ফিশ সুপ, মজা পেলে উঠে গিয়ে নিল চাইনিজ থাই সুপ। বাহ এটাতো দারুণ! তারপর নিল ডাক নুডলস সুপ, বিফ নুডলস সুপ, কর্ন সুপ, তোফু সুপ। নাহ এত জায়গা হবে না। একটু রেষ্ট নিল সে। তারপর গিয়ে নিয়ে আসলো  কয়েকটা চিকেন অর বিফ বলস এবং নুডলস সুপ উইথ ফিশ রোল।

সুপ পর্ব শেষ হলো তার।

ডান দিকে তাকিয়ে দেখলো ওখানে আসল খাবার। প্রথমেই দেখলো ফ্রাইড মিক্সড ভেজিটেবল উইথ ওস্টার সস। প্লেটের একপাশে নিয়ে সাজাতে শুরু করলো ফ্রাইড মিক্সড ভেজিটেবল উইথ সয়াসস, ফ্রাইড মিক্সড ভেজিটেবল উইথ গ্র্যাভি, ফ্রাইড মাশরুম অ্যান্ড ব্যাম্বো সস উইথ ওস্টার সস, ফ্রাইড গ্রিন ভেজিটেবল, মিক্স ভেজিটেবল উইথ তোফু, ফ্রাইড ব্রোকানি উইথ ওস্টার সস, মিক্স ভেজিটেল ইন গ্রিন কারি। প্লেটটা উচু হয়ে গেল মৈনাক পর্বতের মতো। 

সে এমন সবজি কখনো খায়নি। গপাগপ গিলতে থাকে। শেষ হলে হাঁপাতে শুরু করলো। পানি খেলে যদি পেটের জায়গা নষ্ট হয় সেই ভয়ে সে এক চুমুক পানিও খায়নি।

আশেপাশের লোকজন মাঝে মাঝে তার দিকে তাকাচ্ছে খাওয়া থামিয়ে। এসবে সে পরোয়া করে না। এখানে কেউ তাকে চেনে না। না চিনলে লজ্জার কিছু নাই। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা একবারই পায় মানুষ।

প্লেট খালি হয়ে গেলে সে একটু বিশ্রাম করে এবার এগিয়ে গেল পরবর্তী ইনিংসের দিকে। এবার ধরলো ফ্রাইড রাইস উইথ শ্রিম্প এণ্ড চিকেন। পাশে ফ্রাইড রাইস উইথ ক্র্যাব মিট দেখে সে আন্দাজ করার চেষ্টা করলো জিনিসটা কি। তারপর সামান্য করে নিতে শুরু করলো ফ্রাইড রাইস উইথ গ্রিনকারি, ফ্রাইড রাইস উইথ বাসিল লিফ, ফ্রাইড রাইস উইথ বয়ড কারি, ফ্ল্যাট রাইস নুডলস, রাইস নুডলস উইথ গ্রিন ভেজিটেবল, রাইস নুডলস উইথ সি ফুড অ্যান্ড মিক্সস ভেজিটেবল কারি, চিকেন চাউমিন ইত্যাদি।

বামদিকে ঘুরে তার চোখ পড়লো আরো কিছু বাদ পড়া আইটেমের দিকে। হাতেম তাকে বলে দিয়েছে সবকিছুই নিতে পারবো। কোন বাধা নেই। এবার সে কিছু রাইস আইটেম সরিয়ে নতুন একটা প্লেট নিয়ে এগিয়ে গেল নতুন আইটেমের দিকে। এবার নিতে শুরু করলো  প্রণ বল প্যালেট, সুইট এন্ড সাওয়ার প্রণ, চাইনিজ বিফ কাটলেট, সিচুয়ান বিফ, চিকেন ড্রাম স্টিক, ফ্রাইড স্প্রিং চিকেন, পিকিং চিকেন,  চিকেন স্প্রিং রোল, ম্যানডারীন ফিশ, অ্যামেরিকান চপসুয়ে, সিচুয়ান শ্রিম্প রোল এবং  বাটার ফ্লাই শ্রিম্প
। এবারো প্লেটের উপর তৈরী হলো আরেকটা পর্বত।

এই পর্বতটা যখন প্লেটের সমান হয়ে গেল তখনই তার ভুড়িটা কাঁপতে শুরু করলো। সে প্রথমে ভেবেছে ভূমিকম্প হচ্ছে। ভূমিকম্পের সময় সে সিলিং এর দিকে তাকায় ফ্যানটা দুলছে কিনা দেখার জন্য। এখানে ফ্যান নেই কিন্তু সিলিং এ ঝোলানো ঝাড়বাতিগুলো একদম অনড়। সুতরাং ভূমিকম্প নয়। তখনই তার নজর গেল শার্টের বোতাম চেপে বসা দুই গ্যালন সাইজের ভুড়িটার দিকে। ওটার ভেতরেই কম্পনটা হচ্ছে। ভয় পেয়ে গেল সুবেদার আলী। এত পদের খাওয়া গিয়ে ভুড়ির ভেতরে হজমের ঝড় তুলেছে। সে চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে আটকে গেল। বসে পড়লো আবার। এবার বুঝলো কি পরিমান ঢুকেছে ভেতরে।

পেটের ঝামেলাটার দিকে দীর্ঘসময়  তাকিয়ে ছিল বলে টের পায়নি তার চারপাশে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে।

ব্যাপার কি? সে কি ধরা পড়ে গেল হাকুল্যা খেতে গিয়ে? এত খাওয়া উচিত হয়নি। সবার নজরে পড়ে গেছে। এখন উপায়?

তাকে ঘিরে ফেলেছে ভিড়টা। দাওয়া বিহীন বুফে খাওয়ার শাস্তিটা মনে হয় এবার পিঠের উপর পড়বে। অথচ তখনো কোনার ডেজার্ট আইটেমগুলো বাদ রয়ে গেছে। পায়েসম ফ্রুট সালাদ, লাচ্ছি, বোরহানি, আইসক্রিম, দই,সন্দেশের কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল এই দুঃসময়ে। মারটা খাবার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হতে হতে ভাবলো হাতেম শালাটা গেল কই। এই সময় তাকেও একটা ভাগ দেবার দরকার ছিল।

তখন রেষ্টুরেন্টের কোলাহল থেমে গেল হঠাৎ। ছাদের কোনে ঝোলানো স্পিকারে একটা ঘোষণা ভেসে এল -

"উপস্থিত অতিথিবৃন্দ। আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজকের ইচ্ছে অনুসারে আমরা আমাদের কাংখিত শীর্ষ ভক্ষককে পেয়ে গেছি।  জনাব সুবেদার আলী আজ সম্মানিত খাদক নির্বাচিত হয়েছেন। সবাই হাত তালি দিয়ে অভিননন্দন জানান তাঁকে। আপনার জন্য আগামী সাত দিনের খাবার ফ্রি এখানে। আপনার খাদক কার্ড নিয়ে যান দয়া করে।"

সুবেদার আলী তাকিয়ে দেখলো এক কোনায় হাতেম তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

সে খাদক কার্ড নিয়ে দেখলো লেখা আছে-

"অভিনন্দন অতিথি। আপনি আমাদের আজকের খাদক। পুরস্কার হিসেবে এই রেষ্টুরেন্টগলোর নিন্মোক্ত আইটেমগুলো আগামী এক মাসের জন্য আপনার জন্য বরাদ্দ করা হলো।

পুরান ঢাকার হাজীর বিরিয়ানী
লালমাটিয়ার স্বাদ এর তেহারী
মতিঝিলের ঘরোয়ার খিচুড়ী
হাতিরপুলের শর্মা হাউজের শর্মা
বংশালের শমসের আলীর ভুনা খিচুড়ি
কাঁটাবনের অষ্টব্যাঞ্জনের গ্রীল,শর্মা
ফার্মগেটের ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানী
ধানমন্ডির লায়লাতি'র খাশির ভূনা খিচুড়ি,কাবাব"

সুবেদার আলী বুঝতে পারলো না তার কি সম্মানিত বোধ করা উচিত নাকি অপমানিত।


---------------------------------------------------------------------------------------

গল্প-২
আতিক্কা হোঁচট


রাহুল রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ লাগে শালার আনইনস্টল করতে। অথচ ইনস্টল করার সময় কয়েক সেকেণ্ড মাত্র। কি মিষ্টি মিষ্টি কথা শুরুতে। বছর না যেতেই শুরু হলো যন্ত্রণা।

দুবছর আগের কথা।

কাজের অবসরে একটা ওয়েবসাইটে ঢুকে স্টিভেন ওয়েনবার্গের 'ড্রিমস অব এ ফাইনাল থিওরি'র একটা অংশ পড়ছিল গভীর মন লাগিয়ে। কসমোলজি নিয়ে চল্লিশ বছর আগে লেখা বইটি এখনো প্রাসঙ্গিক। এমনিতে কসমোলজি তার প্রিয় বিষয়। তার মধ্যে এই লোক সম্পর্কে তার একটা মোহ কাজ করে।

হঠাৎ পাশ থেকে মিষ্টি গলায় চ্যাট করতে ডাকলো এক সুন্দরী। বললো সে ওয়েনবার্গের নাতনীর মেয়ে। চাইলে ওয়েনবার্গের আরো কিছু বইপত্র দিতে পারে। রাহুল অবাক হয়নি। আজকাল সব ওয়েবসাইটেই এরকম সাহায্যকারী হাত থাকে। যারা ভার্চুয়ালী ইন্টারএকটিভ।

রাহুলের নেট একটিভিটি খুবই সীমিত। গবেষণার পাশাপাশি এসব করার কোন সুযোগ নেই। অন্য কেউ হলে ইগনোর করতো। কিন্তু স্টিভেনের নাম শুনে আগ্রহী হলো সে। আমন্ত্রণ গ্রহন করে, ইনস্টল করে নিল তাকে। হ্যাঁ এই যুগে বন্ধুও ইনস্টল করতে হয় আইডি পাসওয়ার্ড দিয়ে। খোলা বন্ধুতার দিন শেষ।

মেয়েটার নাম জেনী, জেনী ওয়েনবার্গ। খুবই চটপটে। গলাও খুবই মিষ্টি। রাহুল ভার্চুয়াল প্রেমে গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো। জেনীই প্রথম অগ্রসর হয়েছিল এটা বলা কি বাহুল্য হবে?

পরদিন থেকে শুরু হলো তথ্য আদানপ্রদান। কিছুকাল পর যা ভাব আদান প্রদানে এসে পৌঁছুলো। আজকাল এমন যুগ এসেছে, ভাব আদান প্রদান করলেও বাস্তবে কারো সাথে দেখা সাক্ষাত করার উপায় নেই। কে কোন দেশ থেকে কথা বলছে সেটা বোঝার উপায়ও নেই। ফলে ভাব ভালোবাসার মতো সম্পর্কের পরিণতিও ভার্চুয়ালী সীমাবদ্ধ। তবু একালের তরুণ সমাজ এই যান্ত্রিক সম্পর্কের জন্য উন্মাতাল।
কয়েক মাস পর দেখা গেল রাহুল ওয়েনবার্গ ছেড়ে ডুমার শপের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। ডুমার শপ হলো গত শতকের মহাযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতিল মালের অনলাইন আখড়া। ওই শপ থেকে মহাযুদ্ধের বাতিল অস্ত্রপাতি এন্টিকস হিসেবে কিনছে একালের ধনপতিরা। জেনীর শখ হয়েছে সেখান থেকে জার্মানীর একটা প্লেনের লেজ কিনবে। ওই লেজের একটা অংশে বিধ্বংসী পরমানু অস্ত্রের নিক্ষেপক ছিল। এটার সাথে কসমোলজির কোন সম্পর্ক নেই। তবু জেনীর শখ মেটাতে রাহুল অর্ডার দিল।

প্রতি সপ্তাহেই এরকম নতুন নতুন শপিং মলে ঘুরতে লাগলো রাহুল আর জেনী। কিছুদিন যাবার পর রাহুল কসমোলজি আর ওয়েনবার্গ ভুলে জেনীর ভেতর ডুবে গেল।

প্রফেসর এসে সেদিন তাগাদা দিতে জেগে উঠলো সে। জেনীর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। ওয়েনবার্গের সাইটে গিয়ে জেনিকে খুঁজতে গেল। দেখলো জেনী নেই। ওখানে বসে আছে ফস্টার নামের গোমড়ামুখো এক তরুণ প্রফেসর। রাহুলকে দেখে বললো, হাই। কি চাই। রাহুল তখন জেনীর কথা জিজ্ঞেস করতে হা হা করে উঠলো ফস্টার।

রাহুল জিজ্ঞেস করলো, ঘটনা কি। তখন ফস্টার বললো, কোথাকার এক হ্যাকার বছর দুই আগে তাদের সাইট হ্যাক করে ঘাপটি মেরে বসেছিল। প্রচুর লোকজনকে ফতুর করে আজ ভেগেছে। রাহুল জিজ্ঞেস করলো, নাম কি তার। প্রফেসর বললো, জেনী বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু আসলে সে একটা ভাইরাস রোবট।

সর্বনাশ!!

রাহুল আঁতকে উঠলো। আজই তাকে একটা বড় পেমেন্ট করাবার কথা ল্যাঙ্গারমেন ডায়মণ্ড শপকে। জেনী ২.৬৩ ক্যারাটের দুটো ডায়মণ্ড পছন্দ করেছে গতকাল। সে তার ডিভাইস খুলে লগইন করে দেখলো জেনী অপেক্ষা করছে। রাহুলের দুবছরের ভালোবাসায় আগুন ধরে গেল। শালার ভাইরাস রোবট!

ক্লিক করলো আন ইনস্টল বাটনে। জেনী ওদিকে টের পেয়ে হায়হায় করে উঠলো। করছো কি করছো কি রাহুল। তুমি আমার এতদিনের প্রেমকে চুলোয় ফেলে দিচ্ছো? প্লীজ অমন করো না সোনা মনা!

রাহুলের মাথায় তখন আগুন। অশ্রাব্য গালিগালাজ বেরুলো মুখ দিয়ে, যার কিছুই পৌঁছায়নি অপরপ্রান্তে। জেনীর অনুনয়ভরা ইমো গুলোর দিকে একবার দেখে রিকনফার্ম বাটনে ক্লিক করে দিল!

দুই বছরের ভার্চুয়াল বন্ধুতা এখানেই খতম। এবার সে মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। পড়ার সাইটে ঢোকার আগে সে একবার ব্যাংক একাউন্টে লগ ইন করলো। হায়, ওখানে ব্যালেন্সের ঘর জুড়ে একটা বিরাট মাইনাস ফিগার! গত সপ্তাহেই রাহুলের ক্রেডিট কার্ডের নাম্বার চেয়ে নিয়েছিল জেনী এক অভিমানী সেশানে। ফোর ডি সাউন্ড ফোনে, জেনীর চোখের জলের সাথে নাকের জলের মিশালো নাসিকা সঙ্গীতে রাহুলের বুকে বেদনার ঝড় তুলেছিল।

[আতিক্কা হোচট]

বোবায়িত স্বপ্ন

অপরূপ এক স্বপ্ন দেখে এইমাত্র জেগে উঠলো সে।

এরকম স্বপ্ন এসময়ে দেখার কথা না তার। তবু দেখেছে এবং বিস্মিত হয়েছে। আবেশটা এখনো ছুঁয়ে আছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলেও আধবোজা চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বাইরে তখনো মিশমিশে কালো আঁধার। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলো ভোরের সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু ঘন মেঘলা বর্ষন ঢেকে রেখেছে চারদিক। একটানা বাতাসের সাথে তুমুল বৃষ্টি বাইরে।

এত ভোরে কখনো ঘুম ভাঙ্গে না তার। বরাবরই দেরীতে ঘুম ভাঙ্গা মানুষ ছিল। ছেলেবেলায় স্কুলে যেতে কষ্ট হতো ভোরবেলা। স্কুল শেষ হবার পর কলেজে কিছুদিন আরাম করার সাধ ছিল। শুনেছে কলেজে নাকি ক্লাস না করেও পরীক্ষা দেয়া যায়, কেউ কিচ্ছু বলে না। কথাটা শোনার পরপর কলেজে ওঠার জন্য তার ভেতর একটা স্বপ্ন জাগতে থাকে। ক্লাস এইট থেকেই সে নিজেকে কলেজে পড়ুয়া ভাবতে শুরু করে। কিন্তু সত্যি সত্যি যেদিন কলেজে উঠলো, মোহভঙ্গ হলো তার।

কলেজে দেরীতে গেলেও চলে, কিন্তু প্রাইভেট স্যারের বাসায় যাবার জন্য সেই সাতটায় উঠতে হতো। শীতকালে ভীষন কষ্ট। রিকশা নিয়ে চেরাগী পাহাড়ের পাশের গলিতে বিজয় স্যারের বাসা। বিজয় স্যার ফিজিক্স পড়াতেন। খুব নমনীয় একজন স্যার, আস্তে আস্তে বোঝাতেন, তার ভীষণ ভালো লাগতো এই স্যারকে। স্যারের বাসা থেকে বেরিয়ে খিদে পেয়ে যেতো। বন্ধুদের নিয়ে ঢুকে পড়তো গলির মুখে দস্তগীর রেস্তোরায়। সুগন্ধী সেঁকা পরোটা চায়ে ভিজিয়ে খেতে অপূর্ব লাগতো। তারপর আন্দরকিল্লায় গিয়ে মুড়ির টিন বাসে উঠে পড়তো। ২৫ পয়সা ভাড়া দিয়ে নিউ মার্কেট নেমে সিটি কলেজ।

কলেজে ক্লাস শেষে কোন কোন দুপুরবেলা কোন বন্ধুর আহবানে কলেজের লাগোয়া লায়ন সিনেমা হলে ঢুকে ৬ টাকার ব্যালকনি টিকেটে ১২-৩টার শো দিয়ে সেদিনের প্রাকটিক্যাল ক্লাসটা সেরে নেয়া হতো। এভাবে কতোবার যে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে! কখনোই ভালো ছাত্রের কাতারে ছিল না সে।

খারাপও হতে পারেনি সুযোগের অভাবে। সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই সে এক বড় সড় রাজনৈতিক পান্ডা হতে পারতো। একবার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। যখন তাকে বিনা দোষে হাজতবাস করিয়েছিল স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার। বিদ্রোহী হয়ে উঠে রাজনৈতিক অস্ত্র তুলে নিতে চেয়েছিল হাতে। কিন্তু কেন যেন হওয়া হয়নি। আসলে নষ্ট রাজনীতি তখন থেকেই বিষময় হয়ে উঠেছিল তার কাছে।

আজ ভোরে ঘুম ভেঙ্গে কেন যেন সেই দিনগুলি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। অথচ স্বপ্নটার কাছে ওই স্মৃতিগুলো একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। দেশে ফিরেছে তিন মাস হলো। এখনো মনে হয় অচেনা কোন দেশে চলে এসেছি ভুল করে। দীর্ঘ বারো বছর পর চেনা দেশটা অচেনা হয়ে গেল। যেখানে সে বাস করতো সেখানে চেনা কিছুই নেই। মাটির রাস্তাটা হয়ে গেছে চার লেইনের হাইওয়ে। বাড়ীর চারপাশের ধান ক্ষেতগুলো আকাশছোঁয়া দালানে ভরে গেছে। কোথাও এক ফোঁটা দম ফেলার জায়গা নেই। বিকট শব্দে ট্রাক বাস ছুটে যাচ্ছে একের পর এক। সন্ধ্যের পর বিশাল লম্বা জ্যাম লাগে। একটানা হৈ চৈ রাত এগারোটা অবধি। পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়না মাঝরাত পেরিয়ে গেলেও।

আজকের হাইওয়ে এই সেদিনও ছিল নির্জন জলাভূমি। ভাবতে কেমন লাগে। সন্ধ্যা হলেই সুনসান। টেবিলে পড়তে বসে জানালা দিয়ে মনটা উড়ে চলে যেতো কোথাও। আশেপাশে কোন ঘরবাড়ী ছিল না। দখিনের ঘরটাতে থাকতো সে। দখিনের জানালা দিয়ে দখিনো হাওয়া আসতো হু হু করে। ফ্যান লাগতো না তার। ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে একটা চেয়ার একটা টেবিল। একটা চৌকি, দুটো বাশের কঞ্চির বুকশেলফ, আর একটা আলনা। এই নিয়ে ছিল তার নিজস্ব জগত। টেবিলে একটা আকাই স্টেরিও সেট।

সেখানে হারানো দিনের গান বাজতো। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতো। "তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার......." এত প্রিয় ছিল গানটা তখন! গাইতে গিয়ে তার চোখে জল এসে যেত। অথচ সে কাউকে হারায়নি তখনো পর্যন্ত। যখন সত্যি সত্যি হারিয়েছে তখন আর একটা গানও বাজেনি, কোথাও কোন সুর বাজে নি আর।

আজ শেষ রাতের স্বপ্নটিতে কি ছিল? সুন্দর একটা অবাস্তব দৃশ্য। নষ্টালজিক কোন উপাদান ছিল না। তবু বারবার সে ফিরে যাচ্ছে পুরোনো দিনে।

মানুষ বদলে যায়। সময় সবকিছুর বদলের কারিগর। বদলে গেলে কি চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায়? বারো বছর পর দেশে ফিরে সবকিছু অচেনা লাগছে। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। অনেক স্মৃতি মুছে গেছে। এরকমই হবার কথা। কিন্তু বদলে যাওয়ার কষ্ট তাকে এমন পোড়ায় কেন। ফিরে এসে প্রথমেই খুঁজেছে যা খোঁজা উচিত নয় তার খোঁজ নিতে গিয়ে কি বিড়ম্বিত হয়েছে তা কাউকে বলাও যায় না।

মানুষ বদলে যায় সময়ের প্রয়োজনে নাকি নিজের প্রয়োজনে? এতখানি বদলে যাওয়া কি করে সম্ভব? বারো বছর কি খুব দীর্ঘ সময়? চেনা মানুষ এত অচেনা হয়ে যায় কেন? অনুভুতি ব্যাপারটা কি চিরকাল আপেক্ষিক? যখন যার তখন তার- আলাদিনের চেরাগের মতো। প্রতিটি মানুষ কি একেকটি আলাদিনের চেরাগ? যার হাতে পড়বে তার ঘষাতেই হুকুম তামিল করবে। কি অদ্ভুত!

মানুষের মনের চেয়ে পরিবর্তনশীল বস্তু এই জগতে সৃষ্টি হয়নি। কত মিথ্যা বিশ্বাসে কত প্রাণ অহেতুক ঝরে যায়। কত জীবন নষ্ট হয়ে যায় ভুল বিশ্বাসে। যে ফুলের আয়ু মাত্র একদিন সেও প্রতিশ্রুতি দেয় আজীবন সুগন্ধ বিলানোর। এত আত্মপ্রতারণা। তবু জেনে শুনে বিশ্বাসে গা ভাসায় মানুষ।

আগে কখনো এত গভীরভাবে চিন্তা করেনি। আজকের স্বপ্নটা সব উলটপালট করে দিল। স্বপ্নটা মিথ্যা। মিথ্যা হলেও সুন্দর। মুগ্ধ করে রেখেছে তাকে। স্মৃতির পরতে পরতে যে আনন্দগুলি বিষাদের আবরনে ঢাকা ছিল, আজ বিষাদের ব্যান্ডেজ খুলে তাকে ডেকে বলেছে, আসো আমি মরিনি, এখনো আছি বেঁচে। তুমি আসো, নতুন করে বাঁচো। আমি ভুলিনি তোমাকে। তুমি যা দেখেছো তা দুঃস্বপ্নমাত্র। এই দেখো আমাকে। আমি আছি, আমিই সত্যি। আমার কাছেই থাকো তুমি।

ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। তারপর থেকেই মনের ওলটপালট চলছে। এমন মিথ্যা কেউ বলে। সে তো কখনো এমন মিথ্যাবাদী ছিল না। স্বপ্নে এমন ডাহা মিথ্যা বলতে পারলো?

এই মিথ্যা স্বপ্নও তার বুকে দ্রিম দ্রিম করে বাজাতে লাগলো অনুভুতির ঢোল। যে অনুভুতি সে কবর দিয়ে রেখেছিল বারোটি বছর। হঠাৎ সে ভাবতে লাগলো। এই যে জেগে উঠেছি, এটাও কোন স্বপ্ন নয়তো? বাইরের বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ। বিজলীর চমক। অন্ধকার। সবকিছুই স্বপ্ন নাতো?

মশারির বাইরে একটা ছায়া এসে দাঁড়ালো। এলোচুলে দাঁড়ানো। কে? এই ঘরে তো আর কেউ নেই। বিদেশ থেকে আসার পর এই হোটেলে তিনমাস ধরে বাস করছে সে। রুমের দরোজা বন্ধ। কিন্তু এই নারীমূর্তি কোথা থেকে এলো? হঠাৎ ভয়ে গা শির শির করে উঠলো তার। একটু আগের জেগে ওঠা প্রেমানুভুতিময় স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটলো নিমেষে।

বহু বছর আগে এক রাতে এরকম একটা অচেনা মূর্তি তার বুকের উপর চেপে বসেছিল। গলার ওপর দুহাতের সাড়াশি চাপ। দম বন্ধ হয়ে উঠছিল তার। মরে যেতে যেতে প্রচন্ড চীৎকারে জেগে উঠতে চাইছিল। কিন্তু কেউ তার ডাক শুনতে পাচ্ছিল না। একেবারে শেষ পর্যায়ে গোঁ গোঁ শব্দ শুনে মা ছুটে এসেছিল পাশের ঘর থেকে। তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল। বলেছিল, খোকা উঠ, তোকে বোবায় ধরেছে খোকা। জেগে উঠ নইলে মারা যাবি। সে জেগে উঠে দেখে সারা শরীর ঘেমে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।

মশারির পাশে দাঁড়ানো আবছা নারী মূর্তিটা দেখলো সে আবারো। আজকে সে একা। এই হোটেলে আশেপাশের ঘরে কেউ নেই। প্রায়ই খালি থাকে হোটেলটি। এই বর্ষা সিজনে গ্রাহক কম। চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। আজ কে তাকে বাঁচাবে? কে জাগাবে তাকে?

প্রেম খেদ দুঃখ কষ্ট সব ছাড়িয়ে তার মধ্যে জেগে থাকে একটাই অনুভুতি- ভয়। স্বপ্নের ভেতরে আরেক স্বপ্নের প্রতারণায় আবদ্ধ সে। প্রথম স্বপ্নটা দেখে ঘুমিয়ে থাকলেই ভালো ছিল। ঘুমের মধ্যে কেউ বুকের উপর চেপে বসলেও টের পেত না। মৃত্যুভয় কি ঘুমেও জেগে থাকে? কে জানে। আসন্ন পরিণতির জন্য তৈরী হলো সে।

Sunday, November 3, 2013

এবার জল ঘোলা কর!

১.
আইকনের টানাটানির ফাঁসে আটকে পড়েছে সমগ্র জাতি। আইকনে আইকনে দড়ি টানাটানি, নাভিশ্বাস বাংলাদেশের। বাংলাদেশের প্রধান দুটো আইকন বিএনপি আর আওয়ামী লীগ। এর বাইরে আছে বিএনপি ছাতার অপশক্তি জামাতে ইসলামী যারা গ্রাস করছে স্বয়ং নিজের ছাতার আইকনকে। অন্যদিকে আওয়ামী ছাতার নীচে আছে বিশ্ববেহায়া এরশাদের জাতীয় পার্টি যারা পেণ্ডুলামের মতো সকাল বিকাল দুই আইকনের দিকে দুলতে থাকে। তার বাইরে বামসহ যেসব খুচরো ইসলামী দল আছে তারাও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভাগ হয়ে ভিড়ে গেছে দুই আইকনের দলে। দুই আইকনের বাইরে আছে কি ছক্কা ছয়ফুর? কিন্তু তার খবর আমরা জানি না বহুবছর(*ছক্কা ছয়ফুর সিলেট থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিল এরশাদের আমলে, ক্ষমতায় গিয়ে খালেদা হাসিনাকে বোরকা পরাবার প্রতিশ্রুতি ছিল যার)। আইকনে আইকনে এই দড়ি টানাটানির ভগবানের নাম কি কেউ জানে?

২.
বাংলাদেশে নিরপেক্ষ কোন বস্তুর অস্তিত্ব নেই। আছে দোদুল্যমান ভোটার। যারা গতবার নৌকায় ভোট দিয়েছে, তারা এবার ধানের শীষে দেবে। ধানের শীষ জিতবে, হারবে বাংলাদেশ।

৩.
কিছু কিছু রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক বেশ্যার মতো। এদের জন্য বেশ্যাপদক চালু করলে পুরস্কারের শীর্ষে থাকতো যথাক্রমে এরশাদ, ফরহাদ মজহার এবং মাহমুদুর রহমান।

৪.
টানাটানির আড়ালে চলছে নিঃশব্দে কানাকানি
নেকড়েটা ইশারায় বলছে কাউকে, এবার জলটা একটু ঘোলা কর দিকিনি!


Friday, November 1, 2013

পড়াযুদ্ধে হচপচ

সান্ধ্যকালীন পড়াযুদ্ধ চলিতেছে। ওশিনকে তারস্বরে তিরস্কার করিতেছে স্ত্রী। আমার সাত বছরের কন্যা জেদের চোটে খাতায় পেন্সিল ঘষিয়া অসন্তোষ প্রকাশ করিতেছে, বারংবার পেন্সিল রাবার খাতা সংসর্গের ফলে খাতার পৃষ্ঠা ফুটো হইবার উপক্রম হইয়াছে। অংক কষিবার বদলে তাহার মন ঘুরিয়া বেড়াইতেছে পাশের ঘরে যেখানে তার বেড়াইতে আসা ৬ বছর বয়সী ফুপাতো বোন ইলমা তার মায়ের সাথে পড়িতেছে। চার বছরের শিহান যুদ্ধ বিগ্রহ দেখিয়া বরাবরের মতো এই ঘর ত্যাগ করিয়া নিরাপদ কোন জায়গায় খেলাধুলার আশ্রয় লইয়াছে।

আমার মাথায় এখনো খানিক আগের শব্দধাক্কাটি ঘুরিতেছে। শব্দটি  hotchpotch। ওশিনকে এই শব্দের বানান শিখাইতেছিল তাহার মা। এটি খিচুড়ির ইংরেজী শব্দ। এই বয়সে বাচ্চাদের পেটে খিচুড়ি হজম হইলেও তাহাদের মগজে এটি হজম হইবে কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এই শব্দটি আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িবার আগে শিখি নাই চোখে পড়ে নাই বলিয়া। চোখে পড়িলেও শিখিতাম কিনা সন্দেহ। আমার শিক্ষকেরাও এরকম শব্দ প্রাইমারী স্কুলে শিখাইবার চেষ্টা করেন নাই। আমি নিশ্চিত এই শব্দটির অর্থ এবং বানান বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের মধ্যেও অনেকেই পারিবে না।

কিন্তু আজকাল স্কুল সমূহ প্রথম শ্রেণীতেই এই সকল শব্দ শিখাইবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিতেছে শিক্ষার মান আকাশচুম্বী করিবার বাসনায়। সেই বাসনা দেখিয়া আমার ইচ্ছা করিতেছে গড়াইয়া ভুতলে ঢুকিয়া পড়ি যাহাতে আমার সন্তানদের উপর এত উর্বর শিক্ষাপদ্ধতির যন্ত্রণা আমাকে দেখিতে না হয়।