Tuesday, February 28, 2012

তৎবচন

১. আত্মরক্ষা প্রকৃতির প্রথম আইন। আত্মরক্ষার নিয়ম মানতে ব্যর্থ হলে বিরাট মূল্য পরিশোধ করতে হয়। 

২. কোথায় ফাউল করতে হবে, সেটা জানা খেলোয়ারোচিত প্রজ্ঞা। ভুল জায়গায় ফাউল করলে নিশ্চিন পেনাল্টি।

৩. কিছু কিছু দুঃসময়ের পুনারাবৃত্তি ঘটে অতীতের কাছ থেকে শিক্ষা নেবার জন্য। যারা শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয় তারা প্রকৃতই নির্বোধ।

৪. হাটে হাড়ি ভেঙ্গে সুসংবাদ প্রচারের সময়ও খেয়াল রাখতে হবে অন্ততঃ একটা রসগোল্লা যেন নিজের হাতে থাকে।

৫. কোন কোন তুলনা বেদনাদায়ক, সেরকম তুলাদন্ড হাতে না নেয়াই উত্তম।

৬. আবেগের সাথে যুদ্ধে যুক্তি প্রায়ই হারে। কিন্তু বেলাশেষে যুক্তিরই জয়জয়কার

৭. অবিচার মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে, জমানো বিক্ষোভে রাষ্ট্রেরও পতন ঘটায়

৮. একটা জানালায় মুখ রেখেও আকাশের অনেকদূর দেখা যায়

৯. ভুল করার সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত সময় - ঘোর

১০. একই বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা হতে পারে। প্রেম পাপ লজ্জা নিন্দা তার অন্যতম উদাহরন।

১১. সময়কে ভুল বোঝা আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে।






Monday, February 27, 2012

বইবিহীন বইমেলা ভ্রমণঃ ২০১২

জীবনে এই প্রথমবার বইমেলায় গিয়ে বইযোগ হলো না।

ঢাকা গিয়েছিলাম অন্য একটা কাজে। আজকাল ঢাকায় থাকা-খাওয়া-ঘোরা সবকিছুর উপর আমি চরম পরনির্ভরশীল, সবকিছু কতৃপক্ষের(মানে অফিসের) উপর ছেড়ে দেই। ছাত্রজীবনে যেরকম বেহুদা ঘুরে বেড়াতাম ঢাকার রাস্তা ঘাটে, এখন আর সেই ঢাকা নেই। সব রাস্তাঘাট দালানকোঠা অচেনা লাগে। বিশাল দানবীয় সব ব্যাপার। ঢাকার সবকিছু যেন একটু বড় বড়। এমনকি সাইনবোর্ডের সাইজগুলো। দেয়ালের চিকাগুলোও দেখতাম একসময় বিশাল বিশাল। গুলশান বনানী উত্তরা বারিধারার দিকে তো রীতিমতো গোলকধাঁধা। বাকী ঢাকার মধ্যে মতিঝিল কারওয়ান বাজার শাহবাগ টিএসসি এই অঞ্চলগুলো বাদ দিলে বাকী ঢাকায় আমি পথ হারানো বালক।

কাজ সেরে হাতে সময় ছিল কয়েক ঘন্টা। সময় দুপুর দেড়টা। শান্তিনগরের 'হোয়াইট হাউস' থেকে থেকে বেরিয়ে ভয়াবহ যানজটের মুখোমুখি। যেখানে যাবার কথা সেদিকে গাড়ি ঘোরানোই যাচ্ছে না। ড্রাইভারকে বললাম গুল্লি মারি কাজের। যেদিকে গাড়ি নড়তে পারে সেদিকে চালাও। হাতে যেটুক সময় আছে বইমেলা ঘুরে যাই। আড়াইটায় পৌঁছালাম, কিন্তু মেলার গেট তখনো আটকানো। বলা হলো তিনটায় খুলবে। আধঘন্টা পর গেট খুললো, কিন্তু দোকান তো খোলে না। ৯০% দোকান বন্ধ। যে দুয়েকটা খোলা আছে আমাকে দেখে বইপ্রেমিক মনে হলো তাদের। ডাকাডাকি করতে লাগলো 'ভাই আসেন জাফর ইকবালের কেপলার টুটুবি আছে', 'আহসান হাবীবের সায়েন্সফিকশন আছে'...........ইত্যাদি! রীতিমতো ফেরিঅলা কায়দা। জনপ্রিয় লেখক আর বই আমাকে কোনদিনই টানেনি। আমি তবু ইশারায় আস্বস্ত করলাম যেন একটু সবুর করো, আমি জাস্ট বস্তাটা কিনে ফিরছি বই নিয়ে যাবার জন্য।

বেকার সময়। ঘুরে ঘুরে ব্লগারদের বইটই কি আছে খুঁজছিলাম। কিন্তু লিটলম্যাগ চত্বরে তখনো ঘুঘু চড়ছে। গোল চত্বরটাতে একটা মাত্র স্টল খুলে বই সাজাচ্ছে একজন। সাজানো বইয়ের মধ্যে দুটো বইয়ে নজর পড়তে থমকে দাঁড়ালাম। আমাকে না বলে আমার দুটো গদ্যপদ্যর বই প্রকাশ করে ফেলেছে কেডায় জানি!! বিশ্বাস হয় না? ফটু দেখেন। :p


তবে সাবধান.... মলাট উল্টালে ভিন্ন খবর ;)

কাজ নেই তো খই ভাজ। কাজ না থাকলে আজকাল ফেসবুক ভাজে লোকজন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম তাই বাংলা একাডেমীর পুকুরপাড়ে বসে- 'তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত আছি মেলায়'।

এই সময়ে কাউকে পাবার কথা না, তবুও সাঈদভাই, টুটুল ভাই, তানিম ভাইসহ কয়েকজনের সাড়া পাওয়া গেল নেটে। বোঝা গেল এই অসময়ে মেলায় ঢুকে বসে থাকার মতো হাঁদারামের সংখ্যা খুব বেশী না। আমি মুসাফির মানুষ আমি ঘুরতে পারি বেহুদা। চারটা বেজে গেছে। ছটার মধ্যে এয়ারপোর্ট না পৌঁছালে মুশকিল। রাস্তাঘাটের উপর ভরসা করা যাচ্ছে না। বেরিয়ে পড়লাম। গেটের একপাশে দাঁড়িয়ে তখন তিন আঁতেল গলা ফাটিয়ে হাঁকছে জ্ঞানের ছক্কা। বলটা কানের পাশ ঘেষে বেরিয়ে গেল।

টিএসসির দিকে হাঁটা দিলাম। কিছুদুর গিয়ে ফুটপাতে এক মার্বেল বিক্রেতাকে বসে থাকতে দেখে ছেলেবেলার লোভী চোখটা জেগে উঠলো। এত সুন্দর সব মার্বেল!! দেখে শুনে রঙিন মার্বেল কিনে ফেললাম এক তোড়া। নাকের বদলে নরুণ, বইয়ের বদলে মার্বেল। খানিকক্ষণের জন্য ছেলেবেলায় ফিরে যেতে যেতে দীর্ঘশ্বাস চেপে চাঁটগা ফেরার পথ ধরলাম।

Saturday, February 25, 2012

দুষিত ক্যাম্পাস, ছাত্র-অছাত্র রাজনীতি এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশ

ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষার পর এক ইঁচড়ে পাকা বন্ধু বলছিল এবার ক্লাস নাইনে উঠবো তারপর 'লাইন' করবো। 'লাইন' করা মানে প্রেম করা সেটা শিখলাম ওইদিন। শেখার কোন বয়স নেই। নাইনে উঠে লাইন করার ভাগ্য না খুললেও টেনে উঠে আরেকটা শিক্ষা পেলাম। এবার আরেকজনকে বলতে শুনলাম, কলেজে উঠলে নাকি স্বাধীন। ইচ্ছেমতো ক্লাস ফাঁকি দেয়া যায়। রোলকল করা হয় ঠিকই স্কুলের মতো বেতিয়ে ক্লাস করানো হয় না। যেদিন ইচ্ছে যাবি যেদিন ইচ্ছে যাবি না। যেদিন যাবি সেদিন সবগুলো ক্লাস করতে হবে এমন কথা নাই। কিছু ক্লাস করে সিনেমা দেখতে যাওয়া যায় দিব্যি। কেউ কিছু বলে না। কলেজের স্বাধীনতাটা উপভোগ করেছিলাম ঠিকমতোই।

কলেজ শেষের দিকে আবার শুনলাম ভার্সিটির কথা। কলেজে তাও ফাঁকিঝুকি দিয়েও ক্লাস করতে হয়। কিন্তু ভার্সিটিতে নাকি সে বালাই নেই। ওখানে সারাবছর গায়ে ফু দিয়ে বেড়ালেও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না। তাছাড়া মাসের পর মাস ভার্সিটি তো অটো বন্ধই থাকে। বেহুদা মাষ্টারি করার কেউ নেই। শিক্ষকরা নাকি একদম বন্ধুর মতো আচরণ করে। শিক্ষক কি করে ছাত্রের বন্ধু হয় এটার ব্যাখ্যা না জেনে ব্যাপারটা প্র্যাকটিক্যাল করতে গিয়েছিল এক বন্ধু। প্রথমদিন ক্লাস শেষে এক শিক্ষকের কাছ থেকে 'ভাই আগুনটা দেন' বলে এক স্যারের কাছে সিগারেট ধরানোর জন্য ম্যাচটা চেয়ে নিয়েছিল।

যাই হোক, এটা বললাম একদম সাধারণ ছাত্রদের কথা। কিন্তু তার একটু উপরে যারা? উপরে মানে যারা রাজনীতির সাথে সক্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের অনেকের ক্লাস দূরে থাক, বছর বছর পরীক্ষা না দিলেও চলে। যুগ যুগ ছাত্র হয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। এই কদিন আগেও বিএনপি সাংসদ আমানউল্লাহ আমান তো ছাত্রনেতাই ছিল। তাদের সমসাময়িক আরেকজন ছাত্রনেতা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি নাজিম নাকি ছাত্রত্ব গ্রহণ করেছিলেন আমার জন্মের কাছাকাছি সময়ে। আবার আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করি তিনি তখনো পঞ্চাশোর্ধ ছাত্রনেতাই।

এই যে বাংলাদেশের পড়াশোনার উন্নতির ধাপগুলো বললাম, এইসবই জীবন থেকে নেয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া দরকার ভর্তি হলাম। কিন্তু পড়াশোনা বাধ্যতামূলক সেটা কোথাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু ছাত্র দেখেছি যারা অনেক কিছুর সাথে জড়িতে পড়াশোনা বাদে। স্কুল বন্ধু নিজামউদ্দিন কলেজ থেকে শিবিরে যোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সক্রিয় ক্যাডারের পরিণত হয়। তাকে আমি মদ গাঁজা জুয়া নামাজ রোজা সব করতে দেখি শিবিরের সক্রিয় কর্মী থাকা অবস্থায়, কেবল পড়াশোনা করতে দেখিনি। কে জানে পড়াশোনা ব্যাপারটাকে হয়তো আড়ালে রাখতো।

আরেক প্রচন্ড প্রতিভাধর স্কুলবন্ধু সাঈদ ঢাকা মেডিক্যালে পড়তে গিয়ে খালেদা জিয়াকে দেখে এত মুগ্ধ হয় যে ছাত্র দলের সদস্যপদ গ্রহণ করে সেদিনই। তাকে সমস্ত শিক্ষাজীবন জুড়ে বুলেটের সাথেই ঘুমুতে হয়েছে। একবার ঢাকা গেলে মেডিক্যাল হোস্টেলে ওর খোঁজ করতে গিয়ে দেখি রুমটা আগুনে বিধ্বস্ত। আগের দিন তার দলের বিপক্ষ গ্রুপ এসে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। সে ফেরারী থাকে বছর খানেকের জন্য। তারপর জগাখিচুড়ি উপায়ে পাশ করে বের হয় নির্ধারিত সময়ের বছর পাঁচেক পরে। নষ্ট জীবনের মালিক হয় সে।

সাজ্জাদ নামের আরেকটা ছেলেকে দেখেছি স্কুলে নম্রতার জন্য খ্যাতি থাকলেও কলেজে ওঠার পর হঠাৎ দানব হয়ে উঠে ছাত্রলীগের ব্যানারে। ইন্টার পাশের পর আর পড়াশোনা করেনি, কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত থাকে আরো বছর বিশেক। নিজের এবং তার আশপাশের কয়েক ডজন ছেলের ছাত্রজীবনের বারোটা বাজিয়ে গেছে তার ছাত্রনেতা জীবনে।

আমার অফিসের কাছেই একটা কলেজ আছে। গত ২০০৯ এর নির্বাচনের দুদিন পর ওই কলেজের একদল ছাত্রনেতা এল আমার কাছে। বললো, আমরা ইলেকশানে জিতেছি। আজ থেকে আমাদের দিকে খেয়াল রাখবেন। আগের বার যারা জিতেছিল ওদের দিকে খেয়াল রাখার জন্যও দলবল নিয়ে এসেছিল আরেকটা দল। আমি দুটো দলকেই স্থানীয় পাণ্ডা হিসেবেই দেখে আসছি বছরের পর বছর। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে জোর করে চাঁদা আদায় করে কিংবা টেণ্ডার হাতিয়ে নেয়। এরাই এলাকার হর্তাকর্তা।

কেন যেন মনে হয় এরশাদ পতনের আগ পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতির ন্যূনতম কিছু নীতি আদর্শ ছিল। কিন্তু এরশাদ পতনের পর ছাত্ররাজনীতির ধারাটাই পাল্টে গেছে। দল উপদলের কোন্দল, দখল বেদখলের খেলা ছাড়া ছাত্ররাজনীতির আর কোন সুখবর দেখা যায় না পত্রিকার পাতায়। বর্তমানে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির হেতু কী? রাজনীতির দখলমুক্ত কোন ক্যাম্পাস নেই বাংলাদেশে। পড়ুয়া ছেলেরা রাজনীতির দিকে পা বাড়াচ্ছে না বহুকাল। মেধার সাথে রাজনীতির বিরোধও কয়েকযুগের। সেটা ছাত্র রাজনীতি হোক আর জাতীয় রাজনীতি হোক। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিন্দুমাত্র আশা জাগানিয়া খবর নেই। ছাত্ররাজনীতিকে ছাত্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডেই আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে।

এই সবকিছুই প্রকাশ্য। গোপনে কিছুই হচ্ছে না। রাষ্ট্রপরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গই এই অপরাজনীতির প্রধান পৃষ্টপোষক। কাউকে দোষারোপ করতে গেলেও নিজের দিকেই আঙুলের একাংশ চলে আসে। আমিও তো কোন একটা দলকে নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলাম।

দরিদ্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে শিক্ষাখাতের বিশাল বাজেটের ব্যয় বহন করতে গলদঘর্ম হতে হয়। সেই অর্থের কতোটা অপচয় হচ্ছে ছাত্ররাজনীতির অপব্যবহারের কারণে? ছাত্র রাজনীতি কি সুস্থ ধারায় ফিরতে পারবে নাকি ক্যাম্পাসে রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে? বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধার দায়িত্ব কার?

প্রশ্নের শেষ নেই, মগজের ভেতর থেকে একের পর এক প্রশ্ন আসতেই থাকে-

কাদের স্বার্থে ছাত্রদের অছাত্রমূলক কাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে?
অছাত্রদের কবল থেকে ছাত্ররাজনীতিকে মুক্ত করার দায়িত্ব কার?
রাজনীতিকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার জন্য কি করতে হবে?
ক্যাম্পাসে কোন রকম রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
আমাদের ভবিষ্যতের নেতা কারা?

আজকের ছাত্র আগামীর বাংলাদেশ, নাকি আজকের মাস্তান আগামীর বাংলাদেশ?

১৪ ফেব্রুয়ারী: থুথু দিন, বিশ্ববেহায়ার ফুলে

আগুন ঝরানো ফাগুন দিন পেরিয়ে আজ নাকি ভালোবাসা দিবস!! প্রিয়জনের সাথে ফুল প্রেম মিষ্টি উপহার বিনিময়ের মধুর সময়!! শুধু কি মধু? তেতো কিছু নেই? আছে। সেই তেতো কথা বলি। ১৯৮৩ সালের এই দিনে লেজেহোমো এরশাদের টিয়ার গ্যাস-রাইফেল-বন্দুকের ভালোবাসায় রক্তাক্ত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। বলি হয়েছিল কমসে এক ডজন প্রাণ।

"১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী মিছিল করে স্মারকলিপি পেশ করতে সচিবালয়ের দিকে যায়। মিছিলটি যখন হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছেছে তখন মিছিলের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর পুলিশ লাঠি, টিয়ারগ্যাস, জল কামান ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হয়নি, গুলিও চালায়। গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়। একসময় ছাত্ররা আশ্রয় নেয় শিশু একাডেমীতে। সেখানে তখন শিশুদের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিলো। পুলিশ সেখানেও ঢুকে যায় অস্ত্রহাতে। কোমলমতি শিশুরাও সেদিন রক্ষা পায়নি এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর হাত থেকে। প্রায় সারাদিনব্যাপী এই অসম সংঘর্ষে জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চন প্রমুখ নিহত হন। সব মিলিয়ে ডজনের মতো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।"

সেই কবিলুল বিশ্ববেহায়া হোমো এরশাদ এখনো জীবিত। প্রেম ভালোবাসায় কতোটা সক্রিয় না জানলেও রাজনীতির এক্কা দোক্কার কোলে চড়ে সক্রিয় আছে, ভালো আছে, সুখে আছে বলে জানি। সেই জানাটা বড় লজ্জার।

তবে এরশাদকে নিয়ে যারা নীতিহীন রাজনৈতিক ঐক্য গড়েছে তাদের লজ্জা নেই। যারা একসময় এরশাদকে থুথু দিয়েছিল তারাই গত বিশ বছরে এরশাদের সাথে একই মঞ্চে গলাগলি করেছে, করছে, করবে।

কেবল আমাদেরই লজ্জা। জাফর জয়নাল আমাদের দিকে তাকয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসছে। আমাদের প্রতিশোধ নেয়া হয়নি। তাই আমরা সকল প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রসমাজ যুগে যুগে এরশাদকে থুথু দিয়ে আপ্যায়ন করে যাই।

ভালোবাসার দিনে গর্বিত প্রেমিক এরশাদের ফুল নেবার মতো কোন নারী অবশিষ্ট আছে কি? যদি থেকে থাকেন- হে অজানা অদেখা নারী, একটি আবেদন শুনুন। আপনি এরশাদের ফুল নিয়ে তাতে অন্ততঃ এক দলা থুথুতে ভরিয়ে দিন টবে সাজাবার আগে। ওই সামান্য ঘেন্নাটুকুতেও জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা সহ এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর হাতে নিহত আমাদের সকল পূর্বসূরী ছাত্রদের আত্মা খানিকটা শান্তি পাবে।

আমাদের টিভিতে আশিটা চ্যানেল, তোমাদের?

বাসায় একটা টিভি কেনার জন্য বাবার সাথে কতবার অভিমানে গাল ফুলিয়েছি ঠিক নেই। ১৯৭৯ সালে মাসখানেকের জন্য একটা বারো ইঞ্চির সাদাকালো ন্যাশনাল টিভি বাসায় এসেছিল। কিন্তু মাত্র ১টা চ্যানেলের ৫ ঘন্টার প্রোগ্রামের কারণে পড়াশোনা 'উচ্ছন্নে' যাচ্ছে বলে ওটা বিক্রি করে দেয়া হয় শীঘ্রি।

আরো অনেক পরে কলেজে ওঠার পর ১৯৮৫ সালে আরো একটা ছোট্ট সনি টিভি কেনা হয় বাসায়। এবার রঙিন টিভি! প্রথমদিন টিভি আসার পর সেই দুপুরবেলা থেকে আমরা সব ভাইবোন জড়ো হয়ে টিভির রঙিন ঝিকিমিকি উপভোগ করেছিলাম অনেকক্ষণ। সেদিন দুপুরে খেতে বসে 'তাড়াতাড়ি খা' বলে মাকে তাড়া দিতে হয়নি কাউকে। সবাই নির্বিবাদে খেয়েদেয়ে দুপুরে খানিক ঘুমিয়ে পাঁচটা বাজার আগেই টিভির সামনে হাজির।

বিটিভির প্রোগ্রাম শুরু হতো বিকেল পাঁচটায়। প্রোগ্রাম শুরুর আগে কুউউউউউ শব্দ নিয়ে একটা বেনীআসহকলা বর্ণের পর্দা চলে আসতো। সেটা দেখেই কী খুশী আমরা!! আর বেশী দেরী নেই। কিছুক্ষণ পর পর্দাটা বদলে গিয়ে গোলাকার ডিজাইনের একটা বিচিত্র ডিজিটাল জ্যামিতিক প্যাটার্নের পর্দা আসে। সেখানে লেখা আছে 'বাংলাদেশ টেলিভিশন'। উফফ আর মাত্র কয়েক মিনিট, তারপর সেই কাংখিত মুহূর্ত। হালকা একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজতো এই পর্বে। অল্পক্ষণ পরেই ঘোষকের মুখ দেখা যায়। হাস্যোজ্জ্বল উপস্থাপিকা বলে উঠলো, 'আসলামুআলাইকুম, বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে আমি কুমকুম হাসান...." ইত্যাদি সূচনা বানী। এরপর কোরান পাঠ হয়। তারপর ত্রিপিটক কিংবা গীতা।

ওরা কি পাঠ করছে সেদিকে মন নেই আমাদের। আমরা কেবল রঙিন ছবিগুলির দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছি। মানুষগুলো কী স্পষ্ট! যে যেই রঙের পোষাক পরেছে ঠিক সেরকমই দেখা যায়। আজব দুনিয়া। এত সুন্দর ঝকঝকে ছবি আমাদের ইহজনমে আর দেখিনি। তখন আমাদের চেহারার বিরামহীন হাসি দিয়ে নির্ঘাত কোটি টাকার বিজ্ঞাপন হয়ে যেতো সনি কর্পোরেশনের।

প্রথমদিন বলে সবার পড়াশোনা মাফ ছিল ওইদিন। বাবা মা খুব উদার মনে আমাদের পাশে বসে টিভি দেখলো, বকুনি-বিহীন একটা রাত। টিভি পর্দায় আঠার মতো সেঁটে আছে আটজোড়া চোখ। সীট ছেড়ে কেউ উঠছে না। কেবল রাতে খাওয়ার সময় উঠলাম খানিকক্ষণের জন্য। তবু একটা দল পাহারায় থেকে গেল, যদি কিছু মিস হয়। সেটা ওরা দেখে জানাবে আমাদের। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে রাত পৌনে বারোটায় জাতীয় পতাকা দোলানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিভির সামনে বসে রইলাম আমরা। কী চরম উত্তেজনা! রাতে বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুম এলো না। পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল নিজেদের। তখন আত্মীয় স্বজনের কারো কারো বাসায় টিভি থাকলেও, রঙিন টিভিতে আমরাই ফার্স্ট হয়েছি, এটা নিয়ে আরেকদফা গর্ব হলো।

২৮ বছর পেরিয়ে গেছে তারপর। এখন বস্তির দরিদ্রতম ঘরেও ৫০-৬০ চ্যানেলের টিভি থাকে। সেদিন গুনে দেখলাম চট্টগ্রামে আমার এলাকায় ৮০টা চ্যানেল দেখায়। সারাদেশেও গড়পড়তা সেরকমই হবে। কিন্তু ৮০টা চ্যানেল থাকার পরও টেলিভিশনের প্রতি লোকজনের আগ্রহের মাত্রা আমাদের ওই সুদূর দিনের ১% ও হবে না। অনেক সুলভ হয়ে গেছে প্রযুক্তি, বিনোদন। অথচ আগ্রহ কমে গেছে সেই বিপরীত অনুপাতে।

তবে সবগুলো চ্যানেলের সারাংশ করতে গিয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য পেয়েছি, সেটা বলতেই এই লেখার সূচনা-

১. ৮০টা চ্যানেলের মধ্যে 'দেশ' ভেদে চ্যানেল সংখ্যা
বাংলাদেশী ২৩,
ভারতীয় ৩৭,
অন্যান্য ২০

২. ৮০টা চ্যানেলের মধ্যে 'ভাষা' ভেদে চ্যানেল সংখ্যা
বাংলা ২৩,
হিন্দি ২৬,
ইংরেজি ১৮
অন্যন্য ১৩

৩. ৮০টা চ্যানেলের মধ্যে কোন দেশের 'বিজ্ঞাপন'এর প্রাধান্য
বাংলাদেশী ২৩,
ভারতীয় ৪৫,
বিজ্ঞাপনবিহীন অন্যন্য ১২

এখানে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হলো ৩ নম্বরের হিসেবটা। ঘোষিত ভারতের চ্যানেল ৩৭টা হলেও বিজ্ঞাপনে ভারতের নিয়ন্ত্রণ ৪৫টি চ্যানেলে। ডিসকভারি বা জিওগ্রাফিক চ্যানেলের মতো অভারতীয় চ্যানেলও ভারতীয় বিজ্ঞাপনে চলছে কারণ ওদের আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ অফিস সম্ভবত: ভারত। জ্ঞানের স্বার্থে বিনোদনের স্বার্থে আমরা বিজ্ঞাপন অত্যাচার সয়েও ডিসকভারি স্পোর্টস ট্রাভেল ইত্যাদি চ্যানেলগুলো দেখবো। কিন্তু বিরাট সংখ্যক ভারতীয় চ্যানেল নিরেট অখাদ্য। সেরকম প্রায় ২৫টি অখাদ্য ভারতীয় চ্যানেল আমরা গিলে যাচ্ছি কার স্বার্থে?

ওই অখাদ্য বাদ দিয়ে আমরা কি করতে পারতাম? আমরা আরো চারটি মহাদেশের কমপক্ষে ৫০টি দেশের চ্যানেল দেখতে পারতাম একদম বিনে পয়সায়। এশিয়ার অনেক দেশের চ্যানেল, আফ্রিকার, রাশিয়ার, পূর্ব ইউরোপের, দক্ষিণ আমেরিকার অনেক চ্যানেল আমরা ফ্রীতে দেখতে পারি যদি কেবল সরকার আর অপারেটর দেখাতে চায়। টেলিভিশন একটা বৈশ্বিক জানালা। সারা বিশ্বকে দেখতে পারি আমরা ছোট্ট এই শক্তিশালী মিডিয়ায়।

কিন্তু বিশ্বের এত দেশ থাকতে বাংলাদেশের কেবল নেটওয়ার্ক কেবল ভারতকে ঘিরে মরছে কেন? আমাদের জানালায় অর্ধেকের বেশী সংখ্যক ভারত কেন বসে থাকে? আমরা ওই ৪৫টি চ্যানেলে ভারতীয় বিজ্ঞাপন গিলছি শুধু তাই না, ওইসব চ্যানেলের অখাদ্য সিরিয়ালগুলোতে মেয়েরা যে শাড়ি চুড়ি গহনা পরে, বাংলাদেশের মেয়েরা তাই কেনার জন্য মার্কেটে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছে তবু আমাদের ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি ডলারের ভারতীয় শাড়ি জামা কাপড় আমদানি করে এইসব হতভাগা দর্শকদের জন্য। ঈদের সময় বিশাল অংকের টাকা ব্যয় করে মানুষ ভারতীয় জবড়জং পোষাক ক্রয় করতে। উচ্চবিত্তের প্রভাবে মধ্যবিত্তরাও পাল্লা দিয়ে ওসব কিনে নিজেরা ফতুর হয় ঈদের বাজেটে।

আমরা কি ভেবে দেখেছি ওদের টিভি অনুষ্ঠান যতটা গিলছি আমরা, আমাদের বোকা জনগণ তার চেয়ে বহুগুণ বেশী গিলছে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের পণ্য।

Wednesday, February 8, 2012

প্রবৃত্তি

.......রুমে ঢুকতেই ওদের দুজনের ঘনিষ্ঠতম অবস্থান দেখা গেল। ত আর ম। দুজনেই আমার চোখের সামনে। কিন্তু নিজেদের দিকে এত বেশী মনযোগী যে আমি একটা মানুষ পাত্তাই দিচ্ছে না। আমিও ব্যক্তিত্ব প্রচারে বিশ্বাসী না বলে চুপ করে থাকলাম। গলা খাকারি দিতেও ইচ্ছে করছে না পাছে রণে ভঙ্গ দেয়। আদতে সামান্য গলা খাকারিতে ভঙ্গ দিত কিনা সন্দেহ। নিজেদের নিয়ে এতটা মগ্ন।

আসলে সবাই নিজেদের প্রয়োজনেই মগ্ন থাকে। নিজেদের স্বার্থেই ডুবে থাকে। জগতের সকল প্রাণীর জন্য এই নিয়ম। এই নিয়মের ব্যতিক্রম কেউ হলে তাদের আমরা বিশেষায়িত করি। এই দুজন সেই কাতারে পড়ে না। এদের কান্ডকীর্তি মহান হবার প্রশ্নই ওঠে না।

দৃশ্যটাকে আমার কি ঘেন্না করা উচিত? মানবিক দৃষ্টিতে ঘেন্নাই সুলভ। কিন্তু পাশবিক দৃষ্টিতে ঠিক একই দৃশ্যটাকে বলা হয় প্রবৃত্তি।

আমার নির্বিকার দৃষ্টিও এখন কৌতুহলের সীমানা ছাড়িয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উত্তেজিত। এখানে একটা প্রতিযোগিতা আছে। কে জিতবে? কে হারবে? আমি কার পক্ষে যাবো? যে কোন খেলায় কোন একটা পক্ষ নিতেই হয়। এখানেও ব্যতিক্রম নেই। তাছাড়া আমি তো রেফারী না, দর্শকমাত্র।

আমি বিজয়ীর পক্ষই নেবো, সিদ্ধান্ত নিলাম। যে-ই বিজয়ী হোক আমি তার জয়গান গাইবো।

লড়াই চলছে। যুগলবন্দী লড়াই। নিঃশব্দ লড়াই। হারজিতের মাত্রা বোঝা যাচ্ছে না তাই। দুজনেই দুজকেই কাবু করে ফেলেছে মনে হচ্ছে। কার শক্তি বেশী? দুজন দুজনের কঠিন বাঁধনে আটকে আছে। যেন অতিপ্রাকৃতিক কুস্তি।

নিঃশ্বাস আটকে বসে আছি আমি।

অবশেষে একসময় শেষ হলো লড়াই খেলা। পরাজিত নেতিয়ে পড়ে আত্মসমর্পন করলো বিজয়ীর বাহুতে। অবাক হয়ে দেখি বিজয়ী মাকড়সাটা বিজিত তেলাপোকাটাকে বগলে নিয়ে ধীরে ধীরে আস্তানার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। তিন বেলার অন্নসংস্থান হয়ে গেল বুঝি তার।

বিজয়ীরাই যুগে যুগে জগতে রাজত্ব করে গেছে, করবে। প্রতিষ্ঠিত এই ধারণাটা আবারো রিভাইস দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।

নেট জাল

আলসেমি ধরে গেছে। নেটে বসা হয় না অনেকদিন। হাতে পায়ে খিল ধরে গেছে বসে থাকতে থাকতে। দিনে ঘুম রাতে ঘুম। খিদে পেলে জাগি। মুখের কাছে যা পাই খেয়ে আবারো ঘুম। বুড়ো হয়ে গেছি। নড়ে চড়ে খেতে ইচ্ছে করে না। নেট জগত থেকে বিদেয় নেবার সময় হয়ে গেছে। আর কতো। নিজের তৈরী খাবার মুখে রুচে না। অন্যের তৈরী খাবারে নজর পড়ে থাকে তাই।

নিজের নেট নেই অনেকদিন। ধার করা নেট দিয়ে চরে খাচ্ছিলাম। ধার করা নেটে বোঝা মুশকিল কার ওজন কতো। সেদিনো বুঝিনি। নেটে কিছুক্ষণ ঝুলোঝুলি করতে না করতেই ধপাস করে পতন ঘটলো। পুরোনো নেট বুঝিনি এক্সপায়ার করেছে। পড়বি তো পড় মস্ত কালো এক আরশোলার পিঠে। নইলে হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকতো না।

বোকা আরশোলাটা বুঝতেই পারেনি পিঠে কি সওয়ার হয়েছে। পালাবার বদলে শিকারের মতলবে শুড় বাগিয়ে তাকালো। এক চোখ কানা ছিল তার নির্ঘাত। গুটি গুটি পায়ে ভালো করে দেখার জন্য কাছে কাছে আসতেই খপ করে ঘাড় চেপে ধরে বললাম,

"চোপড়াও শয়তান! নড়েচ কি মরেচ! আমি টারান্টুলার খালাতো বোনের তালতো ভাই নান্দাইলের জান্টু মাকড়সা। নিজে নেট বুনি না, অন্যের নেট থেকে শিকার ধরি। "

আমদানী বড়ি দিয়ে ভারতীয় গাড়ি গেলানোঃ একটি খসড়া আলাপ

চট্টগ্রাম ইপিজেডে Mapple International ১৯৯৫ সালে ২০৮০০ ডলার দিয়ে একটি জাপানী নতুন টয়োটা গাড়ি কিনেছিল তখনকার লেটেস্ট মডেলের। পরের বছর বুদ্ধিমানের পরামর্শ নিয়ে ৮০০০ ডলার করে ১৬০০০ ডলারে দুটো ভারতীয় গাড়ি কিনে তৃপ্ত হয়েছিল। কেননা দুটো গাড়ি কেনার পরও নগদ সাশ্রয় ৪ হাজার ডলার!!

কিন্তু ১৯৯৯ সালের মধ্যে তিন বছর আয়ুর ভারতীয় গাড়ি দুটোর দম ফুরিয়ে লুটিয়ে পড়ে অফিস ইয়ার্ডে। অনেক চেষ্টা করেও জাগানো যায়নি তাদের। বরং আরো ২০০০ ডলার গচ্ছা গেছে ওগুলোর চিকিৎসা করতে গিয়ে। কাজের কাজ হয়েছে দুটো। গাড়ি দুটো অফিসের দুটো পার্কিং দখল করে জঞ্জালের সৃষ্টি করেছে। আর বেপজা ও কাস্টমস কতৃপক্ষের কাছে বছর বছর মৃত গাড়ির রিপোর্ট জমা দিতে হচ্ছে। মৃত গাড়িগুলো সরাবার জন্য আবেদন করা হলে কাস্টম থেকে জানানো হয় ওগুলো সরানো যাবে ধার্যকৃত যাবতীয় শুল্ককর পরিশোধ করার পরে। কারণ গাড়ি দুটো ইপিজেড আইনের শুল্কমুক্ত কোটায় আমদানী। মৃত গাড়ির আবার শুল্ককর?

গাড়ি জীবিত মৃত বড় কথা নয়, গাড়ির বয়স অনুসারে শুল্ককর ধার্য করা হয়। ইপিজেড এলাকায় হলেও মৃত গাড়ির সৎকারের জন্য শুল্কবিহীন সুবিধা নেই। অত ঝামেলায় গিয়ে গাড়িগুলোর সৎকার করা হয়নি আর। গাড়ি দুটোর লাশ ১৪ বছরের রোদ বৃষ্টি ঝড়ে কুড়কুড়ে মুড়মুড়ে হয়ে কটকটি খাবার অবস্থায় এসে মাটির তলায় অর্ধেক দেবে গেছে। ওদিকে বেশী দামে কেনা টয়োটা গাড়িটা ২০১২ সালে এসেও সচল আছে, ভালোভাবেই আছে। পরে ২০০০ সালে আরো দুটো জাপানী রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কেনা হয়েছিল ভারতীয় নতুন গাড়ির চেয়ে কম দামে। ১১ বছর পরে এসেও গাড়ি দুটো রাস্তা মাতিয়ে চলছে।

Mapple International বুঝে গিয়েছিল জাপানী পুরোনো গাড়ি আর ভারতীয় নতুন গাড়ির পার্থক্য। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বোঝেনি। না বর্তমান সরকার, না অতীতের কয়েকটা সরকার। প্রত্যেক বছর বাজেট বিবরনীতে গাড়ি আমদানী পর্বটা যেন লেখা হয় ভারতীয় গাড়ির বাজারকে উৎসাহ দিতে। আইন করা হয়েছে রিকন্ডিশনড গাড়ি ৪ বছরের বেশী পুরোনো হতে পারবে না। নইলে দেশের আবহাওয়ার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। যেন বলা হচ্ছে- 'সাধ্যমত সবাই নতুন গাড়িতে চড়ুন। নতুন জাপানী গাড়ি কিনতে পোষাচ্ছে না? ভারতের কমদামী গাড়ি আছে, প্রতিবেশী দেশ, চট করে আমদানী করা যায়। এত্তো সুবিধা থাকতে খামাকা জাপানী গাড়ি কিনবেন কেন?' প্রায় ধাক্কা দিয়ে আমরা পাবলিককে ভারতীয় গাড়ির বাজারে পাঠাচ্ছি।

এবার কিছু কাল্পনিক তথ্য নিয়ে আলাপ করা যাক।

ধরা যাক, একটা জাপানী গাড়ি ৩০০০০ ডলার টাকা দাম তাই ভারতীয় নতুন গাড়ি কিনা ভালো ১০০০০ ডলারে
বছরে ৫০০০ নতুন ভারতীয় গাড়ি কিনলে খরচ হয়: ৫০,০০০,০০০ ডলার
বছরে ৫০০০ নতুন জাপানী গাড়ি কিনলে খরচ হতো ১৫০,০০০,০০০ ডলার
অনেক সাশ্রয়!

এবার আসুন নতুন জাপানী না কিনে একটু পুরোনো জাপানী গাড়ি কিনি। ১০ বছরের পুরোনো জাপানী গাড়ির দাম পড়ে ৬০০ ডলারের মতো।
বছরে ৫০০০ নতুন ভারতীয় গাড়ি কিনলে খরচ হয়: ৫০,০০০,০০০ ডলার
বছরে ৫০০০ পুরোনো জাপানী গাড়ি কিনলে খরচ হতো ৩,০০০,০০০ ডলার
কতো সাশ্রয়?

এবং অবশ্যই ২০০১ মডেলের জাপানী গাড়ি ২০১১ সালের ভারতীয় গাড়ির চেয়ে দশগুন টেকসই! কারো কোন সন্দেহ থাকলে বলতে পারেন।

আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদের ভারসাম্য সবসময়ই ঋনাত্মক। গত বছরের হিসেবে সেটা ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশী। আমাদের সর্বোচ্চ আমদানী চীন থেকে। যেটা প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। তার পরেই আসে ভারত। ভারত থেকে আমদানী ঘোষিত মূল্যে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু অঘোষিত মূল্যে(চোরাচালান) ৭ বিলিয়ন হতে পারে, যা চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে। ভারতের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি এমনিতেই ৮০% এর কম নয়। টেক্সটাইল, মেশিনারী, ভোগ্যপন্য ইত্যাদি তো আছেই্ তার মধ্যে ভারতীয় গাড়ির বাজারকে বাংলাদেশে সম্প্রসারিত হতে দিয়ে আমরা ঘাটতিটা বাড়িয়েই চলছি!!

আর এই ঘাটতিটা পুরণ করে বিদেশী শ্রমিকদের রক্তশ্রমে অর্জিত ডলার আর খানিকটা আইএমএফ বিশ্বব্যাংক বা দাতাদের ভিক্ষা। ভারতের সাথে গাড়ি বাণিজ্য করে আমরা প্রতিবছর কতো মিলিয়ন ডলার হারাচ্ছি সেটার পুর্নাঙ্গ কোন হিসেব কি সরকার করেছে? আওয়ামীলীগ বিএনপি সবগুলো সরকারের আমলেই এই চিত্রটা একই পাওয়া গেছে। রাজনীতির মাঠে বিরোধী বক্তৃতা দিলেও ভারতের সাথে বাণিজ্য বেসাতিতে দুই দলেরই নীরব ঐক্য। এমনকি যারা ভারতীয় জুজুর ব্যবসা করে তারা ভারতীয় গাড়ির বাণিজ্যেও তুমুল এগিয়ে।

কেবল সিএনজি চালিত ৩ চাকার নড়বড়ে টিনের টেক্সিগুলোর কথা বলি। সারা দেশে এগুলোর সংখ্যা লাখের কম হবে না। তিন চাকার এই বাহনগুলো কতোটা অবৈজ্ঞানিক, কতোটা নাগরিক উপদ্রপ, কতোটা যানজটসহযোগী, কতোটা দুর্ঘটনামূখী, কতোটা নগর সৌন্দর্য বিনষ্টকারী আমরা সবাই জানি। এই লাখখানেক তিনচাকাবাহন আমদানী করতে আমাদের ব্যয় করতে হয়েছে ২০০মিলিয়ন ডলারের বেশী। সমপরিমান জাপানী রিকন্ডিশন গাড়ি(২০০১ মডেল) আমদানী করতে খরচ হতো ৬০ মিলিয়ন ডলারের মতো। কার স্বার্থে ১৪০ মিলিয়ন ডলার বেশী ব্যয় করা হলো? শুধু টাকা বেশী খরচ হলো তাই না, আয়ুর হিসেবেও ভারত আর জাপানের গাড়ির যোজন যোজন দূরত্ব। বাংলাদেশের মানুষ প্রাইভেট গাড়ি কিনতে গেলে এখনো জাপানী গাড়িই খোঁজে। তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্টে জোর করে গিলিয়ে দেয়া হচ্ছে ভারতীয় জরাজীর্ন গাড়িগুলো।

ভারতের সাথে বাণিজ্যে আমার আপত্তি নেই। আমরা অবশ্যই প্রয়োজনীয় পন্যগুলো আনবো ভারত সহ অন্যন্য প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে। কিন্তু যে পন্য ভারত থেকে আমদানী করার দরকার নেই সেটা কেন করবো? যে পন্য যে দেশ থেকে আমদানী করলে আমাদের অর্থনীতির জন্য পরিবেশের জন্য মানুষের জন্য সহায়ক সেই ভাবেই আমদানী নীতি তৈরী করা হয় না কেন?

অর্থমন্ত্রীকে বলি-
ভারতীয় গাড়ি প্রমোট করে আমদানী শুল্কে আমাদের কতো বেশী আয় হচ্ছে?
জাপানের বদলে ভারত থেকে আমদানী করে আমাদের কতোগুন বেশী ডলার খরচ করতে হচ্ছে?
দেশকে ভারতীয় গাড়ির ভাগাড়ে পরিণত করা হচ্ছে কার টাকা দিয়ে?

আমদানী নীতির শেকল পরিয়ে আমাদেরকে ভারতীয় গাড়ি গেলানো থেকে বিরত থাকবেন কি?

সড়ক হত্যাকান্ডঃ আর কতোগুলো স্পীড ব্রেকার দরকার আমাদের?

১.
এবার বাসটা পিষ্ট করলো শিশু পালোমার কোমল শরীর!! কেমন লেগেছে চালক রহিজুল ইসলামের? কেমন লেগেছিল সীতাকুন্ডের মফিজুর রহমানের? একের পর এক মানুষ চাপা দিয়ে কেমন অনুভুতি হয় আপনাদের? আপনাদের সন্তানেরা কি চাপা মুক্ত থাকবে চিরকাল?

আমাদের এসব কথা বলা, লেখা অর্থহীন। আর বলতে ইচ্ছে করে না। ক্লান্তি লাগে, বিরক্তি লাগে। পরবর্তী দুর্ঘটনার খবরের আতংকে দিন গুনি। বাংলাদেশে দৈনিক ৩০ জন মানুষ প্রাণ হারায় বেসরকারী সুত্র অনুসারে। সরকারী সুত্রে দিনে ১০ জন।

দেশে যুদ্ধ নেই মহামারী নেই, দুর্যোগ নেই এখন। শান্তিকালীন সময়ে প্রতিদিন ১০-৩০ পরিবারের বুক খালি হয়। তবু কেমন স্বাভাবিক জীবন যাপন করি আমরা!! এই ব্লগ লেখা শেষে আমি একটা দাওয়াতে যাবো। পোলাও খাবো, কোরমা খাবো, রেজালা খাবো তারপর বোরহানির গ্লাসটা নিঃশেষ করে বাড়ি ফিরে পরিবারের সাথে খুনসুটি করবো। ভুলে যাবো আমারও দিন আসছে। আমার পালা আসতে পারে যে কোন দিন। কতোখানি মনুষ্যত্ব অবশিষ্ট আছে আমাদের ভেতর?

২.
মাদ্রাজ থেকে গত সপ্তাহে নয়াটোলার দোতলা ঘরটিতে ফিরেছ ফারহানা।

বিয়ের পর দশ বছর এই ঘরে তার সুখের বসত ছিল। দুবছর আগে মগবাজার মোড়ে হলুদ ট্রাকটার 'মৃদু' ধাক্কাটার আগ পর্যন্ত। ধাক্কায় রিকশা থেকে পড়ে যায় সে। পতনের পর আর কিছু মনে নেই। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারলো দুপায়ের চারটা হাড় বাদেও শরীরের আরো তেরো জায়গায় ফাটল হয়েছে। অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে ৭ বছরের তিশা। ওকে স্কুল থেকে আনার পথেই সুখের পতনটা ঘটলো। দুবছর বহু কষ্ট করে হাড় জোড়া লাগার পর কোনমতে হাঁটতে শিখছিল সে। হারিয়ে যাওয়া বিকেলগুলো ফিরে পেতে যাচ্ছিল। দুবছর ধরে বাড়ির জানালার পাশের হুইল চেয়ারে বসে দিন গুনতো আবার কখন নীচের বাগানে তিশা আর তিশমাকে নিয়ে আগের মতো লুকোচুরি খেলবে রাশেদের বাড়ি ফেরার সময়। দিন গোনার পালা শেষ হবার আগে মাথার প্রচন্ড যন্ত্রনা পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়লো ব্রেন টিউমার। দেশে ব্যর্থ হয়ে মাদ্রাজে গেল, দুবছর আয়ুর একটা ডেডলাইন নিয়ে ফিরে এল।

আচ্ছা, রাশেদ কি আবারো বিয়ে করবে সে চলে যাবার পর? তিশা তিশমার কী হবে তাহলে? নিজের কষ্ট ভুলে তিশা তিশমার ভবিষ্যত ভেবে ডুকরে কেঁদে উঠে ফারহানা।

এই খবরটি পত্রিকায় আসেনি, এরকম ঘটনা আসে না। দুর্ঘটনায় সাথে সাথে মৃত্যু হলে হয়তো পত্রিকায় খবর হয়, গুরুত্ব বুঝে কয়েকদিন হৈ চৈ থাকে। কিন্তু আহত হবার ছমাস পর কেউ মারা গেলে সেটা আর দুর্ঘটনার খবরে থাকে না। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে যায়। স্বাভাবিক মৃত্যু!!!

৩.
পত্রিকা পড়ে জানা গেল, "সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রথমে রয়েছে নিকটবর্তী দেশ নেপাল। সড়কে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা হয় ইংল্যান্ডে। সড়কের পাশে যত্রতত্র অবৈধ হাটবাজার ও নির্মাণ অবকাঠামো, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ডিজাইন ও যানবাহন, চালকদের আইন না মানা, এ জন্য তাদের যথাযথ শাস্ড়ি না দেয়া, ট্রাফিক আইন প্রয়োগকারীদের দায়িত্বে অবহেলাসহ ১১টি কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। আশংকাজনক হারে মারা যাচ্ছে কর্মক্ষম মানুষ।"

আরো জানা গেল ", জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় মিলে দেশে মোট সড়কের দৈর্ঘ ১ লাখ ৮০ হাজার কিলোমিটার। সড়কগুলোতে সারাদেশে নিবন্ধিত যন্ত্রচালিত সড়কযানে চলে প্রায় ১৫ লাখ ৫ হাজার। গত বছরই নিবন্ধন হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার। এর মধ্যে রাজধানীতেই চলাচল করে প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ যানবাহন। দেশের দ্রুত বর্ধিষ্ঞু জনসংখ্যার তুলনায় গাড়ির মালিক খুবই কম। প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে মাত্র আটজন যন্ত্রচালিত গাড়ি মালিক। যাত্রীর তুলনায় গণপরিবহনের অনুপাতও খুব কম।"

"চলাচলরত গাড়ির সংখ্যার তুলনায় রাস্তার ধারণ ক্ষমতার অভাব, রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার না থাকা, রোড সাইন না থাকা, ভাঙাচোরা ও খানাখন্দে ভরা রাস্তা,রাস্তার পাশেই দোকানপাট, হাট-বাজার ও জনসমাগমপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, ঝুঁকিপূর্ণ কালভার্ট ও ব্রিজ, একই রাস্তায় একই লাইনে বিভিন্ন ধরনের দ্রতগামী ও ধীর গতিসম্পন্ন যানবাহন চলাচল, স্ট্যান্ডের অভাবে রাস্তার ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা, বেপরোয়া গাড়ি চালনা ও ওভারটেকিংসহ নানা কারণে অহরহই দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।"

৪.
চট্টগ্রাম শহরেও স্পীড ব্রেকারের ছড়াছড়ি। সল্টগোলা ক্রসিং থেকে কাস্টম ব্রীজ এলাকায় একশো গজের মধ্যে তিন সাইজের তিনটি স্পীড ব্রেকিং বানানো হয়েছে। বাস ট্রাক ড্রাইভারদের নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে জোর করে গতি কমানোর বিদঘুটে পরিকল্পনা যার মাথা থেকে বেরিয়ে আসুক সেটাকে কিছুতেই সুস্থ বলা যাবে না। আমরা ড্রাইভারকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে রাস্তাজুড়ে ব্যারিক্যাড বসিয়ে আরো নিরাপত্তাহীন অবস্থা সৃষ্টি করছি।

আর কতোটা স্পীডব্রেকার বসলে এসব হত্যাকান্ড বন্ধ হবে বলতে পারেন কোন কর্তা মহাশয়?

আরশোলা কীর্তি

উইপোকার খাদ্য তালিকায় বই জিনিসটা কতোটা উৎকৃষ্ট জানি না। বাসা বদলের সময় নতুন বাসায় অতিথি হিসেবে কিছু পুরোনো উইপোকা বইয়ের ভাঁজে চলে এসেছিল। তাদের ভয়ে বইগুলো ব্যাপক ঝাড়পোছ করে নতুন বুক শেলফে তোলা হয়েছিল। উইপোকা মুক্ত বুকশেলফে বইগুলোকে অবমুক্ত করতে পেরে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। সাতফুট বাই আটফুটের নতুন বুকশেলফটা বানানো হয়েছে শিপব্রেকিং দোকান থেকে কেনা পুরোনো জাহাজভাঙ্গার প্লাইউড দিয়ে। জাহাজের জিনিসে কেন যেন পোকায় ধরে না বলে বিশ্বাস করা হয়। তাই পুরোনো কাঠে তৈরী হলেও জিনিসটা মজবুতই মনে হলো।

বছর পেরোবার পরও উইপোকার কোন চিহ্ন না থাকলেও বইপত্রের প্রতি আমার উদাসীনতা লক্ষ্য করলো পোকাদের আরেকটা দল। ঘরের বাতি নেবানো হলেই সক্রিয় হয় ওরা। বই ঘরের প্রশস্ত মেঝেতে রাত জুড়ে সভা সমিতি মিছিল মিটিং করার সময় কয়েকবার আমার চোখে ধরা পড়েছিল। বাতি জ্বালালেই চট করে উধাও হয়ে যায় সব কটা। বাতি নেবালে গুটি গুটি পায়ে আবার এসে জড়ো হয়। প্রাণীটা সবার খুব পরিচিত রেসিডেন্ট আরশোলা। কিন্তু তাদের যে কতো জাতি উপজাতি আছে তা এই বাসায় আসার আগে জানতাম না। জার্মান তেলাপোকা নামের একটা প্রজাতি এখানে আছে যারা রীতিমতো মানুষখেকো। মশারি ছাড়া কেউ যদি ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে তাকে আংশিক খেয়ে ফেলবে। বারো তলার অ্যাপার্টমেন্টে আপনা থেকেই ওরা এসেছে, নাকি কেউ ওদের চালান করেছে সেটা এখনো অনুদঘাটিত। তবে এটা ঠিক যে এদের লজ্জা শরম আবুল এরশাদ কিংবা মওদুদের চেয়েও কম।

বসার ঘরটাই আমার পড়ার ঘর। বই ঘর। বইগুলো তাকে সাজানো থাকলেও পত্রপত্রিকা সাময়িকী ইত্যাদি সব চরম বিশৃংখল অবস্থায় সারা ঘরে ছড়ানো থাকে। বৃহস্পতিবার ছাড়া অন্য সব দিন রাত এগারোটার দিকে আমি বসার ঘর থেকে শোবার ঘরে চলে আসি। ভোরে অফিস, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হয়। মাঝে মাঝে কোন কারণে মাঝরাতে বসার ঘরে আসতে হলো, বাতি জ্বালাবার সাথে সাথে দেখি সমস্ত ফ্লোর সোফা ডিভানজুড়ে মহা উৎসাহে সমাবেশ চলছে ওদের। কিন্তু বাতি জ্বালাবার মাত্র দুতিন সেকেন্ডে আস্ত মহাসমাবেশটা গায়েব। ঝাড়ুপেটা করার কোন সুযোগ থাকে না। কিন্তু সবকটা কোথায় লুকায়? পরদিন তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো সবগুলো লুকোনোর জায়গা। নেই! এতোগুলা প্রাণী ভোজবাজির মতো কোথায় মিলিয়ে গেল? রহস্যময় ঠেকলো ব্যাপারটা। কিন্তু রহস্য উদঘাটনে সময়ের অভাব। মাসের পর মাস কেটে যায় সেভাবেই।

অনেকদিন পর বই পড়তে ইচ্ছে করছিল সেদিন। ছফাসমগ্রটা বের করে বাদ পড়া উপন্যাসটা দেখছিলাম। তখন পাশ থেকে হলুদ মলাটের রাহুল সাংকৃত্যায়নের তিব্বতে সওয়া বছর বইটা বেজার কন্ঠে বললো, 'আমাকে তুমি গত সতের বছর আধপড়া ফেলে রেখেছো!' মায়া হলো, ওকেও হাতে নিলাম। ওমা! তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেধে রেখেছে কিসে?? পাতাগুলো খুলছে না। ভালো করে দেখি দুটো আরশোলার ডিম নিজেদেরকে কাগজের আড়াল করে এমনভাবে আড়াআড়ি বসে আছে যাতে বইটা খোলা না যায়।

আরশোলার ডিমের ডিজাইনে খানিকটা ডিজিটাল ভাব আছে। প্রকৃতি থেকে আসা সকল প্রাণীর মধ্যে গোলাকার প্রধান্য পেলেও আরশোলার ডিম লম্বালম্বি এবং এক পাশে ডিজিটাল পাঞ্চ করে ডিমের মুখ বন্ধ করা। রাহুলের বইয়ে যে ডিমদুটো দেখলাম তা আরো উন্নত। ডিমকে অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষার জন্য তার উপর কাগজের প্লাস্টার করা হয়েছে আগাগোড়া। বইয়ের কাগজ খনন করে অতিখুদে কাগজবিন্দু দিয়ে ডিমদুটো এমন নিপুনভাবে ঢেকে দেয়া হয়েছে প্রথম দেখায় যে কেউ ওটাকে বইয়ের অংশ বলে ভুল করবে। রাহুলের বইটার এহেন অবস্থায় নিজেকে ধিক্কার দিলাম। কারণ সতের বছর বেচারাকে অবহেলায় ফেলে রেখেছি বলেই প্রযুক্তিপ্রানী আরশোলা সুযোগ নিয়েছে। মানুষের বিবর্তনের পাশাপাশি আরশোলারাও প্রযুক্তিতে এতটা এগিয়েছে দেখে চমৎকৃত হলাম।

কিন্তু রাহুলের বুক থেকে ডিম দুটোকে উচ্ছেদ করতে না করতেই নীচের তাক থেকে আরেকজন ডাক দিল, "বালক ভুল করে নেমে পড়েছে ভুল জলে......" রফিক আজাদ সমগ্র!
এই মোটা বইটা হাতে নিয়ে রীতিমতো শিউরে উঠলাম। তেলাপোকার ডিম যতই ডিজিটাল হোক, এদের ত্যাগ প্রণালী মোটেও সুখদৃশ্য নয়। পুরো ভাঁজ জুড়ে নানান ডিজাইনে তাণ্ডব চালিয়ে বইয়ের তেরোটা বাজিয়ে ফেলেছে। বইয়ের সাজানো কাভার দেখে মোটেও বোঝা যাবে না ভেতরে কি অবস্থা। তারপর একের পর এক বই সরাচ্ছি বের হয়ে আসছে কালো কালো অনীরিহ প্রাণীগুলো। এতক্ষণে বুঝলাম সমাবেশ ভেঙ্গে প্রাণীগুলি কোথায় লুকোতো!!

লক্ষণীয় বিষয় হলো ডিম পাড়া বইতে এরা হাগুপিসু করে না, হাগুপিসুর বইতে ডিম পাড়ে না। র‍্যাকের প্রত্যেকটা খোপে ওদের আলাদা আলাদা আচরন বিচরণ। টেকনোলজি নৈতিকতা ওদের মধ্যেও সম্প্রসারিত হয়েছে। আগে অ্যারোসল স্প্রে করলে মরে ভুত হয় থাকতো। আজকাল সরাসরি গায়ে স্প্রে করলেও কিছু হয় না। ওরা মাস্ক জাতীয় কিছু ব্যবহার শিখে গেছে হয়তো।

প্রায় সবগুলো বইয়ের এই করুণ দশা করে রেখেছে। আমার এত বছরের জমানো সাধের বইগুলোর এহেন দুরাবস্থায় বুকটা ফেটে গেল। সাজানো গোছানো বইগুলোর পেছনে সমাজ পেতে নিরুপদ্রব সংসার করে যাচ্ছে কুৎসিত প্রাণীগুলো। সবচেয়ে অবাক লাগলো এত দুর্যোগেও অক্ষত রয়ে গেছে আশির দশকের যায়যায়দিনের বাঁধানো কপিগুলো। শফিক রেহমান পচে গেছে, কিন্তু তার পত্রিকাগুলো অক্ষত থাকলো কি করে? তাহলে কি তেলাপোকারাও এতটা বাঁচিয়ে চলে নিজেদের!! মগজ নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর বইতে হাগামুতা করতেও আপত্তি তাদের? আমি আরো অবাক হলাম ফরহাদ মজহারের বইতেও কোন তেলাপোকা হাগেনি, গোলাম আজমের জীবনীতে হাগেনি, হাগেনি প্রথম আলোর একটা ঈদ সংখ্যায়ও।

মা বললেন, তুই নিশ্চয়ই কোন বিষটিষ দিয়েছিলি বইগুলোতে।

আমি জানি আমি কিছুই দেইনি আলাদা করে। ওরা নিজেদের বিষেই বিষাক্ত হয়েছে হয়তো।

কে জানে? জগতে কতো অজানা রহস্য উদঘাটনের বাকী!