উইপোকার খাদ্য তালিকায় বই জিনিসটা কতোটা উৎকৃষ্ট জানি না। বাসা বদলের সময় নতুন বাসায় অতিথি হিসেবে কিছু পুরোনো উইপোকা বইয়ের ভাঁজে চলে এসেছিল। তাদের ভয়ে বইগুলো ব্যাপক ঝাড়পোছ করে নতুন বুক শেলফে তোলা হয়েছিল। উইপোকা মুক্ত বুকশেলফে বইগুলোকে অবমুক্ত করতে পেরে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। সাতফুট বাই আটফুটের নতুন বুকশেলফটা বানানো হয়েছে শিপব্রেকিং দোকান থেকে কেনা পুরোনো জাহাজভাঙ্গার প্লাইউড দিয়ে। জাহাজের জিনিসে কেন যেন পোকায় ধরে না বলে বিশ্বাস করা হয়। তাই পুরোনো কাঠে তৈরী হলেও জিনিসটা মজবুতই মনে হলো।
বছর পেরোবার পরও উইপোকার কোন চিহ্ন না থাকলেও বইপত্রের প্রতি আমার উদাসীনতা লক্ষ্য করলো পোকাদের আরেকটা দল। ঘরের বাতি নেবানো হলেই সক্রিয় হয় ওরা। বই ঘরের প্রশস্ত মেঝেতে রাত জুড়ে সভা সমিতি মিছিল মিটিং করার সময় কয়েকবার আমার চোখে ধরা পড়েছিল। বাতি জ্বালালেই চট করে উধাও হয়ে যায় সব কটা। বাতি নেবালে গুটি গুটি পায়ে আবার এসে জড়ো হয়। প্রাণীটা সবার খুব পরিচিত রেসিডেন্ট আরশোলা। কিন্তু তাদের যে কতো জাতি উপজাতি আছে তা এই বাসায় আসার আগে জানতাম না। জার্মান তেলাপোকা নামের একটা প্রজাতি এখানে আছে যারা রীতিমতো মানুষখেকো। মশারি ছাড়া কেউ যদি ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে তাকে আংশিক খেয়ে ফেলবে। বারো তলার অ্যাপার্টমেন্টে আপনা থেকেই ওরা এসেছে, নাকি কেউ ওদের চালান করেছে সেটা এখনো অনুদঘাটিত। তবে এটা ঠিক যে এদের লজ্জা শরম আবুল এরশাদ কিংবা মওদুদের চেয়েও কম।
বসার ঘরটাই আমার পড়ার ঘর। বই ঘর। বইগুলো তাকে সাজানো থাকলেও পত্রপত্রিকা সাময়িকী ইত্যাদি সব চরম বিশৃংখল অবস্থায় সারা ঘরে ছড়ানো থাকে। বৃহস্পতিবার ছাড়া অন্য সব দিন রাত এগারোটার দিকে আমি বসার ঘর থেকে শোবার ঘরে চলে আসি। ভোরে অফিস, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হয়। মাঝে মাঝে কোন কারণে মাঝরাতে বসার ঘরে আসতে হলো, বাতি জ্বালাবার সাথে সাথে দেখি সমস্ত ফ্লোর সোফা ডিভানজুড়ে মহা উৎসাহে সমাবেশ চলছে ওদের। কিন্তু বাতি জ্বালাবার মাত্র দুতিন সেকেন্ডে আস্ত মহাসমাবেশটা গায়েব। ঝাড়ুপেটা করার কোন সুযোগ থাকে না। কিন্তু সবকটা কোথায় লুকায়? পরদিন তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো সবগুলো লুকোনোর জায়গা। নেই! এতোগুলা প্রাণী ভোজবাজির মতো কোথায় মিলিয়ে গেল? রহস্যময় ঠেকলো ব্যাপারটা। কিন্তু রহস্য উদঘাটনে সময়ের অভাব। মাসের পর মাস কেটে যায় সেভাবেই।
অনেকদিন পর বই পড়তে ইচ্ছে করছিল সেদিন। ছফাসমগ্রটা বের করে বাদ পড়া উপন্যাসটা দেখছিলাম। তখন পাশ থেকে হলুদ মলাটের রাহুল সাংকৃত্যায়নের তিব্বতে সওয়া বছর বইটা বেজার কন্ঠে বললো, 'আমাকে তুমি গত সতের বছর আধপড়া ফেলে রেখেছো!' মায়া হলো, ওকেও হাতে নিলাম। ওমা! তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেধে রেখেছে কিসে?? পাতাগুলো খুলছে না। ভালো করে দেখি দুটো আরশোলার ডিম নিজেদেরকে কাগজের আড়াল করে এমনভাবে আড়াআড়ি বসে আছে যাতে বইটা খোলা না যায়।
আরশোলার ডিমের ডিজাইনে খানিকটা ডিজিটাল ভাব আছে। প্রকৃতি থেকে আসা সকল প্রাণীর মধ্যে গোলাকার প্রধান্য পেলেও আরশোলার ডিম লম্বালম্বি এবং এক পাশে ডিজিটাল পাঞ্চ করে ডিমের মুখ বন্ধ করা। রাহুলের বইয়ে যে ডিমদুটো দেখলাম তা আরো উন্নত। ডিমকে অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষার জন্য তার উপর কাগজের প্লাস্টার করা হয়েছে আগাগোড়া। বইয়ের কাগজ খনন করে অতিখুদে কাগজবিন্দু দিয়ে ডিমদুটো এমন নিপুনভাবে ঢেকে দেয়া হয়েছে প্রথম দেখায় যে কেউ ওটাকে বইয়ের অংশ বলে ভুল করবে। রাহুলের বইটার এহেন অবস্থায় নিজেকে ধিক্কার দিলাম। কারণ সতের বছর বেচারাকে অবহেলায় ফেলে রেখেছি বলেই প্রযুক্তিপ্রানী আরশোলা সুযোগ নিয়েছে। মানুষের বিবর্তনের পাশাপাশি আরশোলারাও প্রযুক্তিতে এতটা এগিয়েছে দেখে চমৎকৃত হলাম।
কিন্তু রাহুলের বুক থেকে ডিম দুটোকে উচ্ছেদ করতে না করতেই নীচের তাক থেকে আরেকজন ডাক দিল, "বালক ভুল করে নেমে পড়েছে ভুল জলে......" রফিক আজাদ সমগ্র!
এই মোটা বইটা হাতে নিয়ে রীতিমতো শিউরে উঠলাম। তেলাপোকার ডিম যতই ডিজিটাল হোক, এদের ত্যাগ প্রণালী মোটেও সুখদৃশ্য নয়। পুরো ভাঁজ জুড়ে নানান ডিজাইনে তাণ্ডব চালিয়ে বইয়ের তেরোটা বাজিয়ে ফেলেছে। বইয়ের সাজানো কাভার দেখে মোটেও বোঝা যাবে না ভেতরে কি অবস্থা। তারপর একের পর এক বই সরাচ্ছি বের হয়ে আসছে কালো কালো অনীরিহ প্রাণীগুলো। এতক্ষণে বুঝলাম সমাবেশ ভেঙ্গে প্রাণীগুলি কোথায় লুকোতো!!
লক্ষণীয় বিষয় হলো ডিম পাড়া বইতে এরা হাগুপিসু করে না, হাগুপিসুর বইতে ডিম পাড়ে না। র্যাকের প্রত্যেকটা খোপে ওদের আলাদা আলাদা আচরন বিচরণ। টেকনোলজি নৈতিকতা ওদের মধ্যেও সম্প্রসারিত হয়েছে। আগে অ্যারোসল স্প্রে করলে মরে ভুত হয় থাকতো। আজকাল সরাসরি গায়ে স্প্রে করলেও কিছু হয় না। ওরা মাস্ক জাতীয় কিছু ব্যবহার শিখে গেছে হয়তো।
প্রায় সবগুলো বইয়ের এই করুণ দশা করে রেখেছে। আমার এত বছরের জমানো সাধের বইগুলোর এহেন দুরাবস্থায় বুকটা ফেটে গেল। সাজানো গোছানো বইগুলোর পেছনে সমাজ পেতে নিরুপদ্রব সংসার করে যাচ্ছে কুৎসিত প্রাণীগুলো। সবচেয়ে অবাক লাগলো এত দুর্যোগেও অক্ষত রয়ে গেছে আশির দশকের যায়যায়দিনের বাঁধানো কপিগুলো। শফিক রেহমান পচে গেছে, কিন্তু তার পত্রিকাগুলো অক্ষত থাকলো কি করে? তাহলে কি তেলাপোকারাও এতটা বাঁচিয়ে চলে নিজেদের!! মগজ নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর বইতে হাগামুতা করতেও আপত্তি তাদের? আমি আরো অবাক হলাম ফরহাদ মজহারের বইতেও কোন তেলাপোকা হাগেনি, গোলাম আজমের জীবনীতে হাগেনি, হাগেনি প্রথম আলোর একটা ঈদ সংখ্যায়ও।
মা বললেন, তুই নিশ্চয়ই কোন বিষটিষ দিয়েছিলি বইগুলোতে।
আমি জানি আমি কিছুই দেইনি আলাদা করে। ওরা নিজেদের বিষেই বিষাক্ত হয়েছে হয়তো।
কে জানে? জগতে কতো অজানা রহস্য উদঘাটনের বাকী!
No comments:
Post a Comment