চট্টগ্রাম ইপিজেডে Mapple International ১৯৯৫ সালে ২০৮০০ ডলার দিয়ে একটি জাপানী নতুন টয়োটা গাড়ি কিনেছিল তখনকার লেটেস্ট মডেলের। পরের বছর বুদ্ধিমানের পরামর্শ নিয়ে ৮০০০ ডলার করে ১৬০০০ ডলারে দুটো ভারতীয় গাড়ি কিনে তৃপ্ত হয়েছিল। কেননা দুটো গাড়ি কেনার পরও নগদ সাশ্রয় ৪ হাজার ডলার!!
কিন্তু ১৯৯৯ সালের মধ্যে তিন বছর আয়ুর ভারতীয় গাড়ি দুটোর দম ফুরিয়ে লুটিয়ে পড়ে অফিস ইয়ার্ডে। অনেক চেষ্টা করেও জাগানো যায়নি তাদের। বরং আরো ২০০০ ডলার গচ্ছা গেছে ওগুলোর চিকিৎসা করতে গিয়ে। কাজের কাজ হয়েছে দুটো। গাড়ি দুটো অফিসের দুটো পার্কিং দখল করে জঞ্জালের সৃষ্টি করেছে। আর বেপজা ও কাস্টমস কতৃপক্ষের কাছে বছর বছর মৃত গাড়ির রিপোর্ট জমা দিতে হচ্ছে। মৃত গাড়িগুলো সরাবার জন্য আবেদন করা হলে কাস্টম থেকে জানানো হয় ওগুলো সরানো যাবে ধার্যকৃত যাবতীয় শুল্ককর পরিশোধ করার পরে। কারণ গাড়ি দুটো ইপিজেড আইনের শুল্কমুক্ত কোটায় আমদানী। মৃত গাড়ির আবার শুল্ককর?
গাড়ি জীবিত মৃত বড় কথা নয়, গাড়ির বয়স অনুসারে শুল্ককর ধার্য করা হয়। ইপিজেড এলাকায় হলেও মৃত গাড়ির সৎকারের জন্য শুল্কবিহীন সুবিধা নেই। অত ঝামেলায় গিয়ে গাড়িগুলোর সৎকার করা হয়নি আর। গাড়ি দুটোর লাশ ১৪ বছরের রোদ বৃষ্টি ঝড়ে কুড়কুড়ে মুড়মুড়ে হয়ে কটকটি খাবার অবস্থায় এসে মাটির তলায় অর্ধেক দেবে গেছে। ওদিকে বেশী দামে কেনা টয়োটা গাড়িটা ২০১২ সালে এসেও সচল আছে, ভালোভাবেই আছে। পরে ২০০০ সালে আরো দুটো জাপানী রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কেনা হয়েছিল ভারতীয় নতুন গাড়ির চেয়ে কম দামে। ১১ বছর পরে এসেও গাড়ি দুটো রাস্তা মাতিয়ে চলছে।
Mapple International বুঝে গিয়েছিল জাপানী পুরোনো গাড়ি আর ভারতীয় নতুন গাড়ির পার্থক্য। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বোঝেনি। না বর্তমান সরকার, না অতীতের কয়েকটা সরকার। প্রত্যেক বছর বাজেট বিবরনীতে গাড়ি আমদানী পর্বটা যেন লেখা হয় ভারতীয় গাড়ির বাজারকে উৎসাহ দিতে। আইন করা হয়েছে রিকন্ডিশনড গাড়ি ৪ বছরের বেশী পুরোনো হতে পারবে না। নইলে দেশের আবহাওয়ার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। যেন বলা হচ্ছে- 'সাধ্যমত সবাই নতুন গাড়িতে চড়ুন। নতুন জাপানী গাড়ি কিনতে পোষাচ্ছে না? ভারতের কমদামী গাড়ি আছে, প্রতিবেশী দেশ, চট করে আমদানী করা যায়। এত্তো সুবিধা থাকতে খামাকা জাপানী গাড়ি কিনবেন কেন?' প্রায় ধাক্কা দিয়ে আমরা পাবলিককে ভারতীয় গাড়ির বাজারে পাঠাচ্ছি।
এবার কিছু কাল্পনিক তথ্য নিয়ে আলাপ করা যাক।
ধরা যাক, একটা জাপানী গাড়ি ৩০০০০ ডলার টাকা দাম তাই ভারতীয় নতুন গাড়ি কিনা ভালো ১০০০০ ডলারে
বছরে ৫০০০ নতুন ভারতীয় গাড়ি কিনলে খরচ হয়: ৫০,০০০,০০০ ডলার
বছরে ৫০০০ নতুন জাপানী গাড়ি কিনলে খরচ হতো ১৫০,০০০,০০০ ডলার
অনেক সাশ্রয়!
এবার আসুন নতুন জাপানী না কিনে একটু পুরোনো জাপানী গাড়ি কিনি। ১০ বছরের পুরোনো জাপানী গাড়ির দাম পড়ে ৬০০ ডলারের মতো।
বছরে ৫০০০ নতুন ভারতীয় গাড়ি কিনলে খরচ হয়: ৫০,০০০,০০০ ডলার
বছরে ৫০০০ পুরোনো জাপানী গাড়ি কিনলে খরচ হতো ৩,০০০,০০০ ডলার
কতো সাশ্রয়?
এবং অবশ্যই ২০০১ মডেলের জাপানী গাড়ি ২০১১ সালের ভারতীয় গাড়ির চেয়ে দশগুন টেকসই! কারো কোন সন্দেহ থাকলে বলতে পারেন।
আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদের ভারসাম্য সবসময়ই ঋনাত্মক। গত বছরের হিসেবে সেটা ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশী। আমাদের সর্বোচ্চ আমদানী চীন থেকে। যেটা প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। তার পরেই আসে ভারত। ভারত থেকে আমদানী ঘোষিত মূল্যে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু অঘোষিত মূল্যে(চোরাচালান) ৭ বিলিয়ন হতে পারে, যা চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে। ভারতের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি এমনিতেই ৮০% এর কম নয়। টেক্সটাইল, মেশিনারী, ভোগ্যপন্য ইত্যাদি তো আছেই্ তার মধ্যে ভারতীয় গাড়ির বাজারকে বাংলাদেশে সম্প্রসারিত হতে দিয়ে আমরা ঘাটতিটা বাড়িয়েই চলছি!!
আর এই ঘাটতিটা পুরণ করে বিদেশী শ্রমিকদের রক্তশ্রমে অর্জিত ডলার আর খানিকটা আইএমএফ বিশ্বব্যাংক বা দাতাদের ভিক্ষা। ভারতের সাথে গাড়ি বাণিজ্য করে আমরা প্রতিবছর কতো মিলিয়ন ডলার হারাচ্ছি সেটার পুর্নাঙ্গ কোন হিসেব কি সরকার করেছে? আওয়ামীলীগ বিএনপি সবগুলো সরকারের আমলেই এই চিত্রটা একই পাওয়া গেছে। রাজনীতির মাঠে বিরোধী বক্তৃতা দিলেও ভারতের সাথে বাণিজ্য বেসাতিতে দুই দলেরই নীরব ঐক্য। এমনকি যারা ভারতীয় জুজুর ব্যবসা করে তারা ভারতীয় গাড়ির বাণিজ্যেও তুমুল এগিয়ে।
কেবল সিএনজি চালিত ৩ চাকার নড়বড়ে টিনের টেক্সিগুলোর কথা বলি। সারা দেশে এগুলোর সংখ্যা লাখের কম হবে না। তিন চাকার এই বাহনগুলো কতোটা অবৈজ্ঞানিক, কতোটা নাগরিক উপদ্রপ, কতোটা যানজটসহযোগী, কতোটা দুর্ঘটনামূখী, কতোটা নগর সৌন্দর্য বিনষ্টকারী আমরা সবাই জানি। এই লাখখানেক তিনচাকাবাহন আমদানী করতে আমাদের ব্যয় করতে হয়েছে ২০০মিলিয়ন ডলারের বেশী। সমপরিমান জাপানী রিকন্ডিশন গাড়ি(২০০১ মডেল) আমদানী করতে খরচ হতো ৬০ মিলিয়ন ডলারের মতো। কার স্বার্থে ১৪০ মিলিয়ন ডলার বেশী ব্যয় করা হলো? শুধু টাকা বেশী খরচ হলো তাই না, আয়ুর হিসেবেও ভারত আর জাপানের গাড়ির যোজন যোজন দূরত্ব। বাংলাদেশের মানুষ প্রাইভেট গাড়ি কিনতে গেলে এখনো জাপানী গাড়িই খোঁজে। তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্টে জোর করে গিলিয়ে দেয়া হচ্ছে ভারতীয় জরাজীর্ন গাড়িগুলো।
ভারতের সাথে বাণিজ্যে আমার আপত্তি নেই। আমরা অবশ্যই প্রয়োজনীয় পন্যগুলো আনবো ভারত সহ অন্যন্য প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে। কিন্তু যে পন্য ভারত থেকে আমদানী করার দরকার নেই সেটা কেন করবো? যে পন্য যে দেশ থেকে আমদানী করলে আমাদের অর্থনীতির জন্য পরিবেশের জন্য মানুষের জন্য সহায়ক সেই ভাবেই আমদানী নীতি তৈরী করা হয় না কেন?
অর্থমন্ত্রীকে বলি-
ভারতীয় গাড়ি প্রমোট করে আমদানী শুল্কে আমাদের কতো বেশী আয় হচ্ছে?
জাপানের বদলে ভারত থেকে আমদানী করে আমাদের কতোগুন বেশী ডলার খরচ করতে হচ্ছে?
দেশকে ভারতীয় গাড়ির ভাগাড়ে পরিণত করা হচ্ছে কার টাকা দিয়ে?
আমদানী নীতির শেকল পরিয়ে আমাদেরকে ভারতীয় গাড়ি গেলানো থেকে বিরত থাকবেন কি?
No comments:
Post a Comment