ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষার পর এক ইঁচড়ে পাকা বন্ধু বলছিল এবার ক্লাস নাইনে উঠবো তারপর 'লাইন' করবো। 'লাইন' করা মানে প্রেম করা সেটা শিখলাম ওইদিন। শেখার কোন বয়স নেই। নাইনে উঠে লাইন করার ভাগ্য না খুললেও টেনে উঠে আরেকটা শিক্ষা পেলাম। এবার আরেকজনকে বলতে শুনলাম, কলেজে উঠলে নাকি স্বাধীন। ইচ্ছেমতো ক্লাস ফাঁকি দেয়া যায়। রোলকল করা হয় ঠিকই স্কুলের মতো বেতিয়ে ক্লাস করানো হয় না। যেদিন ইচ্ছে যাবি যেদিন ইচ্ছে যাবি না। যেদিন যাবি সেদিন সবগুলো ক্লাস করতে হবে এমন কথা নাই। কিছু ক্লাস করে সিনেমা দেখতে যাওয়া যায় দিব্যি। কেউ কিছু বলে না। কলেজের স্বাধীনতাটা উপভোগ করেছিলাম ঠিকমতোই।
কলেজ শেষের দিকে আবার শুনলাম ভার্সিটির কথা। কলেজে তাও ফাঁকিঝুকি দিয়েও ক্লাস করতে হয়। কিন্তু ভার্সিটিতে নাকি সে বালাই নেই। ওখানে সারাবছর গায়ে ফু দিয়ে বেড়ালেও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না। তাছাড়া মাসের পর মাস ভার্সিটি তো অটো বন্ধই থাকে। বেহুদা মাষ্টারি করার কেউ নেই। শিক্ষকরা নাকি একদম বন্ধুর মতো আচরণ করে। শিক্ষক কি করে ছাত্রের বন্ধু হয় এটার ব্যাখ্যা না জেনে ব্যাপারটা প্র্যাকটিক্যাল করতে গিয়েছিল এক বন্ধু। প্রথমদিন ক্লাস শেষে এক শিক্ষকের কাছ থেকে 'ভাই আগুনটা দেন' বলে এক স্যারের কাছে সিগারেট ধরানোর জন্য ম্যাচটা চেয়ে নিয়েছিল।
যাই হোক, এটা বললাম একদম সাধারণ ছাত্রদের কথা। কিন্তু তার একটু উপরে যারা? উপরে মানে যারা রাজনীতির সাথে সক্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের অনেকের ক্লাস দূরে থাক, বছর বছর পরীক্ষা না দিলেও চলে। যুগ যুগ ছাত্র হয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। এই কদিন আগেও বিএনপি সাংসদ আমানউল্লাহ আমান তো ছাত্রনেতাই ছিল। তাদের সমসাময়িক আরেকজন ছাত্রনেতা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি নাজিম নাকি ছাত্রত্ব গ্রহণ করেছিলেন আমার জন্মের কাছাকাছি সময়ে। আবার আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করি তিনি তখনো পঞ্চাশোর্ধ ছাত্রনেতাই।
এই যে বাংলাদেশের পড়াশোনার উন্নতির ধাপগুলো বললাম, এইসবই জীবন থেকে নেয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া দরকার ভর্তি হলাম। কিন্তু পড়াশোনা বাধ্যতামূলক সেটা কোথাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু ছাত্র দেখেছি যারা অনেক কিছুর সাথে জড়িতে পড়াশোনা বাদে। স্কুল বন্ধু নিজামউদ্দিন কলেজ থেকে শিবিরে যোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সক্রিয় ক্যাডারের পরিণত হয়। তাকে আমি মদ গাঁজা জুয়া নামাজ রোজা সব করতে দেখি শিবিরের সক্রিয় কর্মী থাকা অবস্থায়, কেবল পড়াশোনা করতে দেখিনি। কে জানে পড়াশোনা ব্যাপারটাকে হয়তো আড়ালে রাখতো।
আরেক প্রচন্ড প্রতিভাধর স্কুলবন্ধু সাঈদ ঢাকা মেডিক্যালে পড়তে গিয়ে খালেদা জিয়াকে দেখে এত মুগ্ধ হয় যে ছাত্র দলের সদস্যপদ গ্রহণ করে সেদিনই। তাকে সমস্ত শিক্ষাজীবন জুড়ে বুলেটের সাথেই ঘুমুতে হয়েছে। একবার ঢাকা গেলে মেডিক্যাল হোস্টেলে ওর খোঁজ করতে গিয়ে দেখি রুমটা আগুনে বিধ্বস্ত। আগের দিন তার দলের বিপক্ষ গ্রুপ এসে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। সে ফেরারী থাকে বছর খানেকের জন্য। তারপর জগাখিচুড়ি উপায়ে পাশ করে বের হয় নির্ধারিত সময়ের বছর পাঁচেক পরে। নষ্ট জীবনের মালিক হয় সে।
সাজ্জাদ নামের আরেকটা ছেলেকে দেখেছি স্কুলে নম্রতার জন্য খ্যাতি থাকলেও কলেজে ওঠার পর হঠাৎ দানব হয়ে উঠে ছাত্রলীগের ব্যানারে। ইন্টার পাশের পর আর পড়াশোনা করেনি, কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত থাকে আরো বছর বিশেক। নিজের এবং তার আশপাশের কয়েক ডজন ছেলের ছাত্রজীবনের বারোটা বাজিয়ে গেছে তার ছাত্রনেতা জীবনে।
আমার অফিসের কাছেই একটা কলেজ আছে। গত ২০০৯ এর নির্বাচনের দুদিন পর ওই কলেজের একদল ছাত্রনেতা এল আমার কাছে। বললো, আমরা ইলেকশানে জিতেছি। আজ থেকে আমাদের দিকে খেয়াল রাখবেন। আগের বার যারা জিতেছিল ওদের দিকে খেয়াল রাখার জন্যও দলবল নিয়ে এসেছিল আরেকটা দল। আমি দুটো দলকেই স্থানীয় পাণ্ডা হিসেবেই দেখে আসছি বছরের পর বছর। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে জোর করে চাঁদা আদায় করে কিংবা টেণ্ডার হাতিয়ে নেয়। এরাই এলাকার হর্তাকর্তা।
কেন যেন মনে হয় এরশাদ পতনের আগ পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতির ন্যূনতম কিছু নীতি আদর্শ ছিল। কিন্তু এরশাদ পতনের পর ছাত্ররাজনীতির ধারাটাই পাল্টে গেছে। দল উপদলের কোন্দল, দখল বেদখলের খেলা ছাড়া ছাত্ররাজনীতির আর কোন সুখবর দেখা যায় না পত্রিকার পাতায়। বর্তমানে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির হেতু কী? রাজনীতির দখলমুক্ত কোন ক্যাম্পাস নেই বাংলাদেশে। পড়ুয়া ছেলেরা রাজনীতির দিকে পা বাড়াচ্ছে না বহুকাল। মেধার সাথে রাজনীতির বিরোধও কয়েকযুগের। সেটা ছাত্র রাজনীতি হোক আর জাতীয় রাজনীতি হোক। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিন্দুমাত্র আশা জাগানিয়া খবর নেই। ছাত্ররাজনীতিকে ছাত্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডেই আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে।
এই সবকিছুই প্রকাশ্য। গোপনে কিছুই হচ্ছে না। রাষ্ট্রপরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গই এই অপরাজনীতির প্রধান পৃষ্টপোষক। কাউকে দোষারোপ করতে গেলেও নিজের দিকেই আঙুলের একাংশ চলে আসে। আমিও তো কোন একটা দলকে নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলাম।
দরিদ্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে শিক্ষাখাতের বিশাল বাজেটের ব্যয় বহন করতে গলদঘর্ম হতে হয়। সেই অর্থের কতোটা অপচয় হচ্ছে ছাত্ররাজনীতির অপব্যবহারের কারণে? ছাত্র রাজনীতি কি সুস্থ ধারায় ফিরতে পারবে নাকি ক্যাম্পাসে রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে? বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধার দায়িত্ব কার?
প্রশ্নের শেষ নেই, মগজের ভেতর থেকে একের পর এক প্রশ্ন আসতেই থাকে-
কাদের স্বার্থে ছাত্রদের অছাত্রমূলক কাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে?
অছাত্রদের কবল থেকে ছাত্ররাজনীতিকে মুক্ত করার দায়িত্ব কার?
রাজনীতিকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার জন্য কি করতে হবে?
ক্যাম্পাসে কোন রকম রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
আমাদের ভবিষ্যতের নেতা কারা?
আজকের ছাত্র আগামীর বাংলাদেশ, নাকি আজকের মাস্তান আগামীর বাংলাদেশ?
No comments:
Post a Comment