Wednesday, February 8, 2012

সড়ক হত্যাকান্ডঃ আর কতোগুলো স্পীড ব্রেকার দরকার আমাদের?

১.
এবার বাসটা পিষ্ট করলো শিশু পালোমার কোমল শরীর!! কেমন লেগেছে চালক রহিজুল ইসলামের? কেমন লেগেছিল সীতাকুন্ডের মফিজুর রহমানের? একের পর এক মানুষ চাপা দিয়ে কেমন অনুভুতি হয় আপনাদের? আপনাদের সন্তানেরা কি চাপা মুক্ত থাকবে চিরকাল?

আমাদের এসব কথা বলা, লেখা অর্থহীন। আর বলতে ইচ্ছে করে না। ক্লান্তি লাগে, বিরক্তি লাগে। পরবর্তী দুর্ঘটনার খবরের আতংকে দিন গুনি। বাংলাদেশে দৈনিক ৩০ জন মানুষ প্রাণ হারায় বেসরকারী সুত্র অনুসারে। সরকারী সুত্রে দিনে ১০ জন।

দেশে যুদ্ধ নেই মহামারী নেই, দুর্যোগ নেই এখন। শান্তিকালীন সময়ে প্রতিদিন ১০-৩০ পরিবারের বুক খালি হয়। তবু কেমন স্বাভাবিক জীবন যাপন করি আমরা!! এই ব্লগ লেখা শেষে আমি একটা দাওয়াতে যাবো। পোলাও খাবো, কোরমা খাবো, রেজালা খাবো তারপর বোরহানির গ্লাসটা নিঃশেষ করে বাড়ি ফিরে পরিবারের সাথে খুনসুটি করবো। ভুলে যাবো আমারও দিন আসছে। আমার পালা আসতে পারে যে কোন দিন। কতোখানি মনুষ্যত্ব অবশিষ্ট আছে আমাদের ভেতর?

২.
মাদ্রাজ থেকে গত সপ্তাহে নয়াটোলার দোতলা ঘরটিতে ফিরেছ ফারহানা।

বিয়ের পর দশ বছর এই ঘরে তার সুখের বসত ছিল। দুবছর আগে মগবাজার মোড়ে হলুদ ট্রাকটার 'মৃদু' ধাক্কাটার আগ পর্যন্ত। ধাক্কায় রিকশা থেকে পড়ে যায় সে। পতনের পর আর কিছু মনে নেই। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারলো দুপায়ের চারটা হাড় বাদেও শরীরের আরো তেরো জায়গায় ফাটল হয়েছে। অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে ৭ বছরের তিশা। ওকে স্কুল থেকে আনার পথেই সুখের পতনটা ঘটলো। দুবছর বহু কষ্ট করে হাড় জোড়া লাগার পর কোনমতে হাঁটতে শিখছিল সে। হারিয়ে যাওয়া বিকেলগুলো ফিরে পেতে যাচ্ছিল। দুবছর ধরে বাড়ির জানালার পাশের হুইল চেয়ারে বসে দিন গুনতো আবার কখন নীচের বাগানে তিশা আর তিশমাকে নিয়ে আগের মতো লুকোচুরি খেলবে রাশেদের বাড়ি ফেরার সময়। দিন গোনার পালা শেষ হবার আগে মাথার প্রচন্ড যন্ত্রনা পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়লো ব্রেন টিউমার। দেশে ব্যর্থ হয়ে মাদ্রাজে গেল, দুবছর আয়ুর একটা ডেডলাইন নিয়ে ফিরে এল।

আচ্ছা, রাশেদ কি আবারো বিয়ে করবে সে চলে যাবার পর? তিশা তিশমার কী হবে তাহলে? নিজের কষ্ট ভুলে তিশা তিশমার ভবিষ্যত ভেবে ডুকরে কেঁদে উঠে ফারহানা।

এই খবরটি পত্রিকায় আসেনি, এরকম ঘটনা আসে না। দুর্ঘটনায় সাথে সাথে মৃত্যু হলে হয়তো পত্রিকায় খবর হয়, গুরুত্ব বুঝে কয়েকদিন হৈ চৈ থাকে। কিন্তু আহত হবার ছমাস পর কেউ মারা গেলে সেটা আর দুর্ঘটনার খবরে থাকে না। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে যায়। স্বাভাবিক মৃত্যু!!!

৩.
পত্রিকা পড়ে জানা গেল, "সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রথমে রয়েছে নিকটবর্তী দেশ নেপাল। সড়কে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা হয় ইংল্যান্ডে। সড়কের পাশে যত্রতত্র অবৈধ হাটবাজার ও নির্মাণ অবকাঠামো, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ডিজাইন ও যানবাহন, চালকদের আইন না মানা, এ জন্য তাদের যথাযথ শাস্ড়ি না দেয়া, ট্রাফিক আইন প্রয়োগকারীদের দায়িত্বে অবহেলাসহ ১১টি কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। আশংকাজনক হারে মারা যাচ্ছে কর্মক্ষম মানুষ।"

আরো জানা গেল ", জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় মিলে দেশে মোট সড়কের দৈর্ঘ ১ লাখ ৮০ হাজার কিলোমিটার। সড়কগুলোতে সারাদেশে নিবন্ধিত যন্ত্রচালিত সড়কযানে চলে প্রায় ১৫ লাখ ৫ হাজার। গত বছরই নিবন্ধন হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার। এর মধ্যে রাজধানীতেই চলাচল করে প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ যানবাহন। দেশের দ্রুত বর্ধিষ্ঞু জনসংখ্যার তুলনায় গাড়ির মালিক খুবই কম। প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে মাত্র আটজন যন্ত্রচালিত গাড়ি মালিক। যাত্রীর তুলনায় গণপরিবহনের অনুপাতও খুব কম।"

"চলাচলরত গাড়ির সংখ্যার তুলনায় রাস্তার ধারণ ক্ষমতার অভাব, রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার না থাকা, রোড সাইন না থাকা, ভাঙাচোরা ও খানাখন্দে ভরা রাস্তা,রাস্তার পাশেই দোকানপাট, হাট-বাজার ও জনসমাগমপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, ঝুঁকিপূর্ণ কালভার্ট ও ব্রিজ, একই রাস্তায় একই লাইনে বিভিন্ন ধরনের দ্রতগামী ও ধীর গতিসম্পন্ন যানবাহন চলাচল, স্ট্যান্ডের অভাবে রাস্তার ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা, বেপরোয়া গাড়ি চালনা ও ওভারটেকিংসহ নানা কারণে অহরহই দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।"

৪.
চট্টগ্রাম শহরেও স্পীড ব্রেকারের ছড়াছড়ি। সল্টগোলা ক্রসিং থেকে কাস্টম ব্রীজ এলাকায় একশো গজের মধ্যে তিন সাইজের তিনটি স্পীড ব্রেকিং বানানো হয়েছে। বাস ট্রাক ড্রাইভারদের নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে জোর করে গতি কমানোর বিদঘুটে পরিকল্পনা যার মাথা থেকে বেরিয়ে আসুক সেটাকে কিছুতেই সুস্থ বলা যাবে না। আমরা ড্রাইভারকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে রাস্তাজুড়ে ব্যারিক্যাড বসিয়ে আরো নিরাপত্তাহীন অবস্থা সৃষ্টি করছি।

আর কতোটা স্পীডব্রেকার বসলে এসব হত্যাকান্ড বন্ধ হবে বলতে পারেন কোন কর্তা মহাশয়?

No comments: