Thursday, March 30, 2017

দুটি চলচ্চিত্র, দুটি অভ্যূত্থান, একটি ষড়যন্ত্র ফরমূলা

The House of Spirits (1993)

'ইসাবেল আলেন্দে' নামটি এদেশে পরিচিত না হলেও তাঁর নামের শেষাংশটুকুর জন্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। আমরা জানি চিলির সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে এক নিষ্ঠুর অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে । তিনি সালভাদর আলেন্দের ভাতিজি।

প্রেসিডেন্ট নিহত হবার সময় তিনি পেরুতে চিলির দুতাবাসে কর্মরত ছিলেন। আলেন্দের আত্মীয়া হবার অপরাধে তাঁকেও হত্যার চেষ্টা করা হলে তিনি লিমা থেকে পালিয়ে ভেনিজুয়েলার কারাকাস চলে যান। সেখানে দীর্ঘ ১৩ বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করেন।

ভেনিজুয়েলায় নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৮১ সালে তিনি চিলি থেকে টেলিফোনে সংবাদ পান তাঁর ৯৯ বছর বয়স্ক পিতামহ মৃত্যুশয্যায় আছেন। কিন্তু তাঁকে দেখতে যাওয়া সম্ভব নয় বলে তিনি তাঁকে দীর্ঘ একটি উদ্দীপনামূলক চিঠি লিখতে বসেন যে চিঠি তাঁকে মানসিকভাবে যদি চাঙ্গা রাখতে সক্ষম হয় শেষ সময়ে।

সেই চিঠিটাই পরবর্তীতে একটা উপন্যাসে বিবর্তিত হয়েছিল যে উপন্যাসটিতে উঠে এসেছিল চিলির রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিত্র। সেই রাজনৈতিক পরাবাস্তব উপন্যাসটি ইংরেজিতে The House of Spirits নামে অনুদিত হয়। পিনোচেটের আমলে পুরো ল্যাটিন আমেরিকাতে উপন্যাসটি প্রকাশ করতে রাজী হয়নি কোন প্রকাশক। পরে ইসাবেল স্পেন থেকে বইটি প্রকাশ করেন। প্রকাশের পরপর বইটি খুব সাড়া জাগিয়েছিল এবং বিশের অধিক সংস্করণ বের হয়, একাধিক ভাষায় অনুদিত হয়।

সেই প্রথম বইটির তুমুল জনপ্রিয়তায় তিনি ল্যাটিন সাহিত্যে উপন্যাসিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে তাঁকে ল্যাটিন আমেরিকার ৩য় সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তম লেখক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। কিছু কিছু সমালোচক ম্যাজিক রিয়েলিজমের আলোচনায় মার্কেজের পাশাপাশি তাঁর নামও উচ্চারণ করে থাকে। সেই প্রথম উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে।

সম্প্রতি সেই সিনেমাটি দেখার সুত্রে জানা গেল একদম অজানা এই লেখক সম্পর্কে। সিনেমায় মেরিল স্ট্রিপের অসাধারণ অভিনয়ের সাথে বাড়তি পাওনা ছিল এন্টোনিও বান্দেরাসের বিপ্লবী চেহারা। নতুন করে আগ্রহ জন্মালো চিলির সেই মর্মান্তিক অভ্যূত্থানের সাথে, যাকে আমরা প্রায়ই বাংলাদেশের পচাত্তরের ১৫ আগষ্টের সাথে তুলনা করে থাকি।

Missing (1982)

চিলির অভ্যূত্থানের সময়কার একটি সাড়া জাগানো সত্য ঘটনা নিয়ে তৈরী হয়েছিল Missing নামের আরেকটি চলচ্চিত্র। নির্মিত হয়েছিল Thomas Hauser এর বই The Execution of Charles Horman: An American Sacrifice (1978) অবলম্বনে।

১৯৮২ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রটি বিখ্যাত গ্রীক পরিচালক Costa Gavras এর অন্যতম সেরা কাজ। আলেন্দেকে হত্যার সময়কালে চিলির ভয়াবহ অস্থিরতার সময়ে Charles Horman এক আমেরিকান সাংবাদিক নিখোঁজ হয়েছিলেন চিলিতে। সেই ঘটনার ভিত্তিতে তৈরী করা সিনেমাটিতে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছিল তাতে সিআইএ এবং আমেরিকান সরকারকে দায়ী করা হয়েছিল। আরো অনেক বছর পর আমেরিকান সরকার স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল ঘটনার সাথে জড়িত ছিল আমেরিকান সরকার এবং সিআইএ। বিচারে দণ্ডিত হয়েছিল রাষ্ট্রদুত সহ ১১ জন কর্মকর্তা। অথচ ছবিটা নির্মান করার পর চিলিতে নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং আমেরিকার রাষ্ট্রদুতসহ জড়িত ব্যক্তিগণ Costa Gavras এর বিরুদ্ধে দেড়শো মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করেছিল যা আদালতে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। অভ্যূত্থানের পর নিক্সনের কাছে কিসিঞ্জার স্বীকার করেছিল সিআইএ জড়িত থাকার ব্যাপারে। কিন্তু এই স্বীকারোক্তি অনেক বছর চাপা পড়েছিল ক্লাসিফায়েট স্টিকারের নীচে। নব্বই দশকের শেষে ক্লিনটন সরকারের আমলো সেটাকে আনক্লাসিফায়েড করা হলে সমস্ত ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয় জনসমক্ষে।

আজ আমরা সবাই জানি সিআইএ আলেন্দেকে যে কারণে হত্যা করে উৎখাত করেছিল, একই কারণে শেখ মুজিবকেও সপরিবারে হত্যা এবং উৎখাত করেছিল। সেখানেও নিক্সন কিসিঞ্জার, এখানেও। একই স্বার্থ দুই দেশেই।

সাংবাদিক চার্লস হরম্যান কোন বিখ্যাত ব্যক্তি নন। তবু চলচ্চিত্রটি আমাদের কাছে যে বার্তা তুলে ধরে তা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সিআইএ কতোটা কুৎসিত ভূমিকা নিতে পারে সেটা চিলির ঘটনা একটি উদাহরণ মাত্র। আরো কতশত ঘটনা ক্লাসিফায়েড স্টিকারের নীচে চাপা পড়ে আছে কেউ জানে না। পচাত্তরের হত্যাকাণ্ডে সিআইএ জড়িত থাকার আমাদের কানে শোনা হলেও এখনো কাগজে কলমে প্রকাশিত নয়। একদিন সেটাও প্রকাশিত হতে পারে। সেই সময় হয়তো জানা যাবে আমাদের নিখোঁজ সাংবাদিক জহির রায়হান কেন নিখোঁজ হয়েছিলেন ৩০ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে। একটি স্বাধীন মুক্ত দেশে জহির রায়হানের মতো মানুষের নিখোঁজ হবার কোন কারণ নেই। চার্লস হরম্যানের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, জহির রায়হানের লাশও আমরা পাইনি।

চার্লস হরম্যানের নিখোঁজের ব্যাপারে সিআইএ-এর স্বীকারোক্তি - 'সে খুব বেশী জেনে ফেলেছিল'।
সেই 'বেশী' ছিল আলেন্দেকে উৎখাতে সিআইএ জড়িত আছে তা জেনে ফেলা।

জহির রায়হানও কি তেমন কিছু 'বেশী' জেনে গিয়েছিলেন?


Tuesday, March 28, 2017

একজন অন্তরালের মানুষ : মমিনুল হক খোকা

হঠাৎ করে পেয়ে যাওয়া একটা বই। কিছু না জেনেই কেনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ নিয়ে লেখা বই 'অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জল'। কখনো নামও শুনিনি লেখক মমিনুল হক খোকার। কিন্তু ভূমিকাটুকু পড়ে বুঝলাম বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর জীবনী লেখার ক্ষেত্রে বইটির গুরুত্ব কতখানি। বইটির ভূমিকা লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। বঙ্গবন্ধুর ডাক নামে নাম 'খোকা' নামে পরিচিত এই লেখক বঙ্গবন্ধু পরিবারের অতি ঘনিষ্ট এক স্বজন যিনি দীর্ঘ দুই দশক বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে ছিলেন। তাঁর পারিবারিক রাজনৈতিক এমন অনেক ঘটনা এই বইতে বিস্তৃত যা আর কোন বইতে পড়িনি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়ে বঙ্গবন্ধু পরিবার কী অবস্থায় ছিল সেটা পড়ে যে কোন সংবেদনশীল পাঠক বেদনার্ত হবেন। লেখক পুরোটা সময় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে ছিলেন বলে নিজের চোখে দেখেছেন সব কিছু। অনেক দুর্লভ ঘটনার বিবরণ এই বই থেকে পেয়ে যাই অনায়াসে। সম্প্রতি বেশ কিছু দুর্লভ ভিডিও ক্লিপ দেখা হয়েছে এপি'র আর্কাইভের সৌজন্যে। যার একাধিক ভিডিওতে তাঁর উপস্থিতি পাই বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে। বইটিতে বাড়তি পাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের একদম ঘরোয়া কিছু ঝকঝকে ছবি। 

সৈয়দ শামসুল হকের ভূমিকার একটি পাতা-

অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালে। সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হকের মাধ্যমে। অডিও রেকর্ড করা বক্তব্য থেকে টাইপ করে লেখা হয়েছিল পাণ্ডুলিপি। তারপর সৈয়দ সামসুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

প্রচারের আড়ালে থাকা এই মানুষটিকে চিনতেন আবদুল গাফফার চৌধুরীও। ২৩ মে ২০১৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পর দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি চমৎকার একটি স্মৃতিচারণ করেছেন। সেই স্মৃতিচারণে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায় বলে লেখাটির একটি কপি এখানে রেখে দিলাম।


একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ কথা

আবদুল গাফফার চৌধুরী ( দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ মে ২০১৪)


২৩মে শুক্রবার। লন্ডনের অপরাহ্ন। হঠাত্ টেলিফোন বেজে উঠলো। রিসিভার তুলতেই একটি কান্নাভেজা কণ্ঠ শুনলাম। শেখ রেহানার কণ্ঠ। রেহানা বললো, "চাচা, খোকা চাচা মারা গেছেন।" কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, কখন, কোথায়? রেহানা বললো, এই কিছুক্ষণ আগে সিঙ্গাপুরে মারা গেছেন। তার ক্যান্সার হয়েছিল। শেষ সময়ে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। আপা (শেখ হাসিনা) তার লাশ ঢাকায় নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
খোকা মানে মমিনুল হক খোকা। বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই। তিনি রাজনীতি করতেন না। কিন্তু ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ছায়াসঙ্গী। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতিটি দুর্দিনে খোকা চাচাই ছিলেন তাদের পরম নির্ভরতা। তার মৃত্যু শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মনে গভীর শোক সৃষ্টি করেছে তাতে সন্দেহ নেই। আমিও শোকান্বিত হয়েছি। আমার চাইতে বয়সে বেশ বড়। কিন্তু ছিলেন আমার দুর্দিনের বন্ধু। ছিলেন ব্যবসায়ী। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে তার নেপথ্য রাজনৈতিক ভূমিকার কথা কখনো ভুলতে পারবো না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও ঢাকায় অন্তরীণ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচাইতে বড় নির্ভর ও অভিভাবক ছিলেন এই মমিনুল হক খোকা। আমি তাকে ডাকতাম খোকা ভাই।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য হলেও খোকা ভাই ছিলেন একেবারেই একজন সাধারণ মানুষ। কেউ হয়তো জিজ্ঞাসা করতে পারেন এই সাধারণ এবং খ্যাতিবিমুখ মানুষটির মৃত্যু নিয়ে আমি কেন আজ লিখতে বসেছি? সেকি তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য ছিলেন বলে? আমার জবাব, মোটেই তা নয়। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বহু সদস্য এখনো বেঁচে আছেন, তাদের অনেককেই আমি চিনি এবং জানি। কিন্তু আমার আগে তাদের মৃত্যু হলে (এমন কামনা করি না), তাদের সকলকে নিয়ে লিখবো তা মনে হয় না।

খোকা ভাইকে নিয়ে যে লিখতে বসেছি তার কারণ আছে। মানুষটি ছিলেন সাধারণ। খ্যাতি-অখ্যাতির পর্দার আড়ালে। নিকট আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব ছাড়া তার নামটিও অনেকে জানেন, তা মনে হয় না। কিন্তু মানুষটি সাধারণ এবং একজন নেপথ্যচারী হলেও তার জীবনের কাজকর্ম ছিল অসাধারণ। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি নিয়ে কেউ যদি বড় বই লেখেন, তাহলে সে বইয়ে মমিনুল হক খোকার নাম উল্লেখ করা না হলে অন্যায় করা হবে।

খোকা ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার আগেই তার নামের সঙ্গে আমি পরিচিত হয়ে উঠি। বঙ্গবন্ধুর মুখে প্রায়ই খোকা কোথায় ডাকটি শুনতাম এবং প্রায়শই তিনি খোকা ভাইকে কাছে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু ঘন ঘন জেলে যেতেন। আর এই সময় খোকা ভাই হয়ে উঠতেন তার পরিবারের সবচাইতে বড় নির্ভরতা। বঙ্গবন্ধু-পত্নীর হাতের লাঠি। এই পরিবারের দেখাশোনা করতে গিয়ে তিনি গোয়েন্দাদের পিছু ধাওয়া, আইয়ুব-মোনেমের আমলের চোখ রাঙানি গ্রাহ্য করেননি। এমনকি সেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। বত্রিশ নম্বর বাড়ির আশেপাশে একটা কাকপক্ষীও ঘেঁষে না। তখনো খোকা ভাই এই পরিবারের সবচাইতে বড় নির্ভর এবং বাইরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী ছিলেন। নিজের সংসারের চাইতেও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের গুরুত্বই ছিল তার কাছে বেশি।

খোকা ভাইয়ের একটি সাদা টয়োটা গাড়ি ছিল। এই গাড়িটি বঙ্গবন্ধু প্রায়ই ব্যবহার করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ঢাকায় মার্চ মাসে (১৯৭১) মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকটি হতো ঢাকায় তখনকার প্রেসিডেন্ট ভবনে (স্বাধীনতার পর প্রথম গণভবন)। বঙ্গবন্ধু বত্রিশ ধানমন্ডি থেকে খোকা ভাইয়ের সাদা টয়োটা গাড়িটিতে চেপে প্রেসিডেন্ট হাউসে এই বৈঠকে যাতায়াত করতেন। কখনো কখনো খোকা ভাই গাড়িটি ড্রাইভ করেছেন। এই গাড়িটি তাই একটি ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করেছিল। যদিও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর গাড়িটির সেই মর্যাদা ক্ষমতা দখলকারী ঘাতকেরা আর রক্ষা করেনি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায়, বঙ্গবন্ধুকে যখন (পশ্চিম) পাকিস্তানের এক জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাহারায় অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে ধানমন্ডির অন্য একটি বাড়িতে; তখন ভয়ে এই পরিবারের খোঁজ-খবরও কেউ নিতেন না। তখন খোকা ভাই নিত্য এই বাড়িতে যেতেন। তাদের জন্য বাজার সওদা পর্যন্ত করে দিতেন। হানাদার সৈন্যদের বেয়নেট এবং বডি সার্চের মধ্য দিয়ে খোকা ভাইকে এই বাড়িতে যেতে হতো। হানাদার কর্তৃপক্ষ তাকে এই পারমিশন দিয়েছিল, তবে তার উপর কঠোর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হতো। সামান্য সন্দেহ হলেই তারও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার অথবা চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। খোকা ভাই সেই ভয়টি জয় করেই ওই বাড়িতে যাতায়াত করতেন।

এই একাত্তর সালেরই এপ্রিল মাসের একদিনের কথা। ঘণ্টা তিনেকের জন্য কারফিউ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আমি তোপখানার প্রেসক্লাব থেকে বেরুচ্ছি, দেখি খোকা ভাই একটা স্কুটারে বসে আছেন। বললাম, কোথায় যাচ্ছেন? বললেন, "বন্দী ভাবী ও তার ছেলে-মেয়ের কাছে। উত্সুক্য ছিল, জিজ্ঞাসা করলাম, তাদের কোথায় রাখা হয়েছে? খোকা ভাই বললেন, বলবো না, আপনিও জানতে চাইবেন না। অনেকেই তাদের খোঁজ চাচ্ছে, এমনকি আওয়ামী লীগেরও কেউ কেউ।

আমি তাদের মতলব কি তা জানি না। তাই বলি না।" বললাম, আপনার গাড়ি কোথায়? বললেন, সৈন্যরা বড় বেশি গাড়ি সার্চ করে, হয়রানি করে। তাই স্কুটারে যাচ্ছি। তার কথা শুনে সেদিন মনে মনে ভেবেছি, বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের প্রতি কতোটা আত্মীয়তার টান থাকলে একজন মানুষ সকল ভয় উপেক্ষা করে রোজ তাদের কাছে এমনভাবে যাতায়াত করতে পারে।

শুধু আত্মীয়দের জন্য নয়, অনাত্মীয়দের জন্যও এই মানুষটির কত বড় হূদয়ের টান ছিল, সে সম্পর্কে আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা আছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭৩ সাল। আমার স্ত্রী হঠাত্ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। চিকিত্সার জন্য বিলাতে নেওয়া প্রয়োজন। বিমান ভাড়া না হয় কষ্টেসৃষ্টে জোগাড় করলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে খরচ চালাবো কি করে? বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন রহমান তখন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। খোকা ভাই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওদিকে কর্পোরেশনের জনসংযোগ অফিসার রকিব আমার বন্ধু। আমি তার অফিসে প্রায়ই আড্ডা মারতে যাই।
একদিন ওই শিপিং কর্পোরেশনের অফিসে রকিবের কক্ষে বসে আমার স্ত্রীর চিকিত্সা সংক্রান্ত সমস্যার কথা আলোচনা করছিলাম। এই সময় খোকা ভাই এসে হাজির। আমার সমস্যার কথা শুনে বললেন, আপনি ভাববেন না। লন্ডনে আমাদের শিপিং কর্পোরেশনের একটা অফিস খোলা হচ্ছে। সেখানে আপনাকে জনসংযোগ অফিসার পদে নিয়োগ দিলে যে টাকা পাবেন, তাতে খরচ চলে যাবে।

খোকাভাইয়ের সঙ্গে তখন আমার পরিচয় তেমন নিবিড় নয়। আমি তার আত্মীয়ও নই। কিন্তু আমাকে সাহায্য করার জন্য তার আগ্রহ দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা জাগলো। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু আমাকে চাকরিটি কে দেবেন? খোকাভাই বললেন, কেন, ক্যাপ্টেন রহমান দেবেন। তিনি আমার বন্ধু। আমি তাকে বলবো। সত্যি সত্যি খোকাভাই আমাকে চাকরি দেওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন রহমানকে বলেছিলেন। ক্যাপ্টেন রহমানও রাজি হয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত চাকরিটি নেওয়া আর হয়নি। সে অন্য প্রসঙ্গ।

১৯৭৫ সালের আগস্ট ও নভেম্বর ট্রাজেডির পর লন্ডনে সামরিক শাসন-বিরোধী একটা আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আমিও তাতে যোগ দেই। আমরা 'বাংলার ডাক' নামে আন্দোলনের একটি মুখপত্র বের করার ব্যবস্থা করি। কিন্তু টাকা কোথায়? এই সময় খোকাভাই এসে আমার ম্যাথুয়েন রোডের বাসায় হাজির। তিনি আমাদের প্রচেষ্টার কথা বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন। শেখ হাসিনাও খোকাভাই যাতে আমাদের সমর্থন দেন তাকে সেই অনুরোধ জানিয়েছেন। তার কাছে হাসিনার লেখা একটা চিঠিও তিনি আমাকে দেখালেন।

খোকাভাই বাংলার ডাকের জন্য অর্থসংগ্রহের নিশ্চয়তা দিলেন। বললেন, আমরা বেশকিছু লোক প্রতি মাসে কিছু টাকা দেব। এই বেশকিছু লোকের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকারের ওয়ার্কস সেক্রেটারি মইনুল ইসলাম সাহেব। তিনি জিয়াউর রহমানের জেল থেকে বেরিয়ে তখন ম্যানেচেস্টারে বাস করতেন। তিনি প্রতি মাসে বাংলার ডাকের জন্য একটা মোটা ডোনেশন খোকাভাইয়ের মাধ্যমে দিতেন।

খোকাভাই রাজনীতি করতেন না। কিন্তু বাংলাদেশের সেই দুর্দিনে আমাদের ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি সভা ও মিছিলে যোগ দিতেন। লন্ডনের বাঙালি পাড়ায় বাংলার ডাক বিক্রির জন্য রাস্তায় ঘুরেছেন। দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে কয়েক বছর থাকার পর শেখ রেহানা লন্ডনে খোকাভাইয়ের বাসাতেই এসে ওঠে। তার নিরাপত্তার জন্য কথাটা কিছুদিন গোপন রাখা হয়েছিল। আমি একদিন খোকাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার বাসায় টেলিফোন করতেই রেহানাই রিসিভার তুললো। বললো, 'চাচা, আমি রেহানা।' আমি তাকে মা ডাকি। মাতা-পুত্রের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হলো।

মমিনুল হকের মতো একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবন কথা লিখতে গেলে আমি একটা বই লিখতে পারি। কিন্তু তা এখানে সম্ভব নয়। তবু বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যত্ নির্মাণে এই মানুষটির একটি নেপথ্য ভূমিকার কথা লিখে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই। আমরা বঙ্গবন্ধুর বহু অনুসারী তখন ইংল্যান্ডে ফ্যাসিবিরোধী ও সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলনে রত। কিন্তু নেতৃত্ব কোথায়? দেশে আওয়ামী লীগ তখন নিষ্ক্রিয়, নানা কোন্দলে বিভক্ত। বিদেশেই বা নেতৃত্ব কোথায় এবং এতো বাধা-বিপত্তির মধ্যে আন্দোলন করে কতো দূর এগুনো যাবে? নানা প্রশ্ন আন্দোলনকারীদের মনে।
আমাদের তখন ভরসা ড. কামাল হোসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী ছিলেন এবং এখন অক্সফোর্ডে অবস্থান করছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনিই আওয়ামী লীগ দলের এবং দেশের পরবর্তী কাণ্ডারি হবেন। কিন্তু আমরা হতাশ এবং ক্ষুব্ধ তার মধ্যে পলায়নি মনোবৃত্তি দেখে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হতো, তিনি দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে আন্তরিকভাবে কতোটা আছেন? এখন একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দেশে বসে তিনি যতোই আত্মসাফাইয়ের কথা বলেন না কেন, তখন (৭৫ এর পর) ব্রিটেনে অবস্থানের সময় তার কার্যকলাপের ইতিহাস যদি আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরি, তাহলে 'গণতন্ত্রের এই আরেক মানসপুত্রের' আসল চেহারাটি জানা যাবে। এখানে সেই প্রসঙ্গ টানা অবান্তর। সময় ও সুযোগ হলে সেই কাহিনী একদিন লিখবো।

এখন লন্ডনে আমাদের প্রতিরোধ আন্দোলনের দিনগুলোর কথায় ফিরে যাই। ড. কামাল হোসেনের কার্যকলাপে তখন আমরা ত্যক্তবিরক্ত। এক সন্ধ্যায় প্রয়াত গউস খান সাহেবের (যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তখনকার সভাপতি) রেস্টুরেন্টে আমরা সমবেত হয়েছি। জাতীয় নেতাদের জেলে বন্দী অবস্থায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আহূত লন্ডনের কনওয়ে হলের সভা থেকে ড. কামাল হোসেনের পেছনের দরোজা দিয়ে গোপনে আকস্মিকভাবে প্রস্থান নিয়ে ক্ষুব্ধ কর্মীদের গউস খান নানাভাবে বোঝাচ্ছেন।

আমিও সেখানে ছিলাম, বললাম, অসুস্থ স্ত্রী এবং ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রোসারি শপে সেলসম্যানের চাকরি করে সংসার চালাচ্ছি এবং দেশে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছি। এই আন্দোলনের ফলে যদি ড. কামাল হোসেনের মতো লোকেরা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে এতো আর্থিক ও পারিবারিক কষ্টের মধ্যে আর বিদেশে বসে আন্দোলন করতে চাই না।

ওই বৈঠকে খোকা ভাইও ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে ড. কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রী হবেন কিভাবে? হবে শেখ হাসিনা। আপনি নিশ্চিত থাকুন গাফফার।

আমি হতবাক। খোকাভাই বলেন কি? শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন এই সম্ভাবনা আমরা কেউ তখনো ভেবে দেখিনি। কল্পনাও করিনি। হাসিনার কি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো বয়স হয়েছে, না অভিজ্ঞতা আছে? খোকাভাই আমার মনের কথা বুঝলেন। বললেন, হাসিনার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে। কলেজে পড়ার সময় সে কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভানেত্রী নির্বাচিত হয়নি?

তাকে বললাম, একটা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি হওয়া আর একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এক কথা নয়।
খোকাভাই বললেন, বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর সাহস আছে হাসিনার শরীরে। দেখবেন, দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ড. কামাল হোসেনসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে শেখ হাসিনাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা দেখাবেন এবং আওয়ামী লীগ সংগঠনটিকেও ধরে রাখতে পারবেন।

সেদিন খোকা ভাইয়ের কথা নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে তার প্রেডিকশন কতোটা সঠিক। একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু কী অসাধারণ দূরদৃষ্টি! আজ তার মৃত্যু সংবাদ শুনে একজন আত্মীয় বিয়োগের ব্যথা অনুভব করছি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনকে আন্তরিক সমবেদনা জানাই। আর তাকে জানাই পরম শ্রদ্ধা।

http://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDVfMjVfMTRfMV80XzFfMTMzMDY0

Monday, March 20, 2017

স্বাধীনতার স্বপ্ন বহন করা অসম্পূর্ণ একটি ভ্রমণ [আগরতলা ১৯৬২]

১.
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ। সূর্যাস্তের বেশ কিছু সময় পর ঢাকা শহরের একটি গলির মুখে লাল নাম্বার প্লেট লাগানো একটি গাড়ি দাঁড়ানো। খানিক পর একটি বাড়ি থেকে দুজন মানুষ বেরিয়ে গাড়ির দিকে হেঁটে আসছে। আবছা আঁধারেও বোঝা যাচ্ছে একজন বেশ দীর্ঘাকায় মজবুত গড়নের, গায়ে চাদর মোড়ানো। অন্যজন একটু ক্ষীণ স্বাস্থ্যের। চাদর মোড়ানো ব্যক্তি বসলেন গাড়ির পেছনের সিটে, সঙ্গী বসলেন চালকের পাশের আসনে।

গাড়ি চলতে শুরু করলো। গন্তব্য কুর্মিটোলা রেলস্টেশন। পেছনের যাত্রী সিটের উপর কাত হয়ে শুয়ে পড়লেন যেন কেউ বাইরে থেকে দেখতে না পায়। গাড়ির জানালা বন্ধ করা আছে। রাস্তায় তেমন গাড়িঘোড়া নেই। কিছুক্ষণ পরে সামনে পড়লো ক্যান্টনমেন্টের চেকপোস্ট। প্রতিটি গাড়িকে এখানে দাঁড় করিয়ে চেক করা হয়।

হেডলাইটের আলোতে সেন্ট্রিকে দেখা যাচ্ছে। গাড়ির গতি কমাতে হবে, সেন্ট্রি গাড়ির দরোজা খুলে চেক করবে। যাত্রীর পরিচয় জিজ্ঞেস করতে পারে। কিন্তু এই গাড়িটা কিছুতেই দেখা চলবে না। গাড়িটা চেক না করার জন্যই সরকারী নাম্বার প্লেটের দরকার ছিল। লাল নেমপ্লেট দেখলে হয়তো সেন্ট্রি গাড়ির দরজা খুলবে না, যাত্রীর পরিচয় নেবে না।  গাড়ির গতি এমনভাবে কমাতে হবে যেন সেন্ট্রি নেমপ্লেটে রং দেখতে পায়। একটুও ভুল করা চলবে না। ভুল হলে যে সর্বনাশ তার ক্ষমা নেই।

চেকপোস্ট এলো। গাড়ির গতি কমলো। সেন্ট্রি এগিয়ে এসে হাত তুললো। প্রতিটি সেকেন্ডের ভগ্নাংশ অনিশ্চিত। চালক যাত্রী সবার শ্বাসরুদ্ধ । কিন্তু না, গাড়িটা থামার আগেই সেই হাতটি আবার নড়ে উঠে ক্লিয়ার সিগন্যাল দিল। রাস্তা পরিষ্কার। আর কোথাও থামতে হবে না। গাড়ি ক্যান্টনমেন্টের গেট  পার হয়ে গেলে চেপে থাকা তিনটা ফুসফুস এতক্ষণে অক্সিজেন পেল। ছুটে চললো গাড়ি কুর্মিটোলা রেল স্টেশনের দিকে।

পেছনের চাদর মুড়ে শুয়ে থাকা আগন্তুক যাত্রী উঠে বসলেন এবার। মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে নিলেন। সড়ক বাতির আবছা আলোয় যে চেহারাটি ভেসে উঠলো সেটা পাকিস্তান সরকারের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তি সৃষ্টিকারীর মুখ। সেই দুর্দমনীয় রাজনৈতিক সিংহের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব পাকিস্তানের এই সিংহকে বেশীদিন জেলখানার বাইরে রাখা সরকার নিরাপদ মনে করে না- সেই সরকার আইয়ুব খানের মতো জাদরেল সামরিক উর্দির হলেও।

২.
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই শেখ মুজিবের সাথে জেলখানার একটা গভীর সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল। নিয়মিত জেলখানার আতিথ্য গ্রহন করতে হতো বলে শেখ মুজিবের স্ত্রী একটা ব্যাগ সবসময়ই গুছিয়ে রাখতেন জেলখানার জন্য। এই ঘটনার সময় শেখ মুজিব আইয়ুব খানের প্রথম দফার ১৪ মাস জেলের মেয়াদ পেরিয়ে কিছুদিনের জন্য মুক্ত ছিলেন ৭ ডিসেম্বর ১৯৬০ থেকে। কিন্তু সেই মুক্তি আংশিক। জেলের বাইরে থাকতে পারলেও শহরের বাইরে যাওয়া বারণ তাঁর। অন্তরীণ আদেশ। শুধু তিনি নন, পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনীতিবিদের উপর নিষেধের খাড়া।  আইয়ুব সরকার নতুন এক সামরিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার চেষ্টা করছিল। সেটার প্রতিবাদ উঠার চেষ্টা করতেই পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে আবারো ধরপাকড়। দুদিন আগেই সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল করাচী জেলে। আরো অনেককে গ্রেফতার করা হচ্ছিল।  পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারীতে আছেন শেখ মুজিবও।

সেই অসম্ভব রুদ্ধশ্বাস সময়েও শেখ মুজিব একটি দুঃসাহসী পরিকল্পনা করলেন। চিরকাল প্রথাগত রাজনৈতিক পন্থায় বিশ্বাসী হলেও এই প্রথম সুভাস বসুর পথে নিজের চিন্তাকে প্রসারিত করলেন। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন। তখনো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের চিন্তায় স্বাধীনতা ব্যাপারটি আসেনি। কিন্তু শেখ মুজিবের মাথায় স্বাধীনতা শব্দটি ঢুকে বসে আছে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ থেকে।

রাজনীতিবিদদের উপর জেনারেল আইয়ুব খানের নির্বিচার অত্যাচারকে প্রথাগত রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছিল না। শত শত নেতা যদি জেল খেটে প্রাণও দেয় তবু মুক্তি আসবে না। তাই শেখ মুজিব মরিয়া হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিদেশের মাটি থেকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবেন।

কিন্তু এই পরিকল্পনা তিনি খুব গোপনীয়তার সাথে রক্ষা করেছেন। অতি অল্প সংখ্যক নেতা জানতেন। যারা জানতেন তাদের একজন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। এই পরিকল্পনার সাথে কিছু উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন। রুহুল কুদ্দুস সিএসপি(স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ক্যাবিনেট সেক্রেটারী), আহমদ ফজলুর রহমান সিএসপি এবং মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী নামে সিলেটের একজন চা বাগান মালিক।

সিদ্ধান্ত হয়েছিল শেখ মুজিব প্রথমে ভারতে পাড়ি দেবেন। তারপর সেখান থেকে লণ্ডনে গিয়ে বিশ্বজনমত গড়ে তুলে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন।  ভারতীয় দুতাবাসের সাথে ইতিমধ্যে যোগাযোগ করা হয়েছে রুহুল কুদ্দুসের মাধ্যমে। ভারতের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেলে শেখ মুজিব আগরতলা যাবেন, সেখানে মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী আগে থেকেই বেসামরিক কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে রাখবেন। শেখ মুজিব আগরতলা যাবেন কুলাউড়া দিয়ে। এখান থেকে ট্রেনে করে সীমান্ত স্টেশনে পৌছে সেখান থেকে হেঁটে ওপারে যাবেন।

কুলাউড়া যাবার ব্যবস্থা করার জন্য যাকে দায়িত্ব দেয়া হলো তিনি মমিনুল হক খোকা। বঙ্গবন্ধুর ফুপাতো ভাই এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তিনি পঞ্চাশের দশক থেকেই তাঁর ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে আছেন। একই বাসাতেই থাকেন শেখ মুজিব পরিবারের সাথে। ১৯৫৩ সালে ঢাকায় আরমানিটোলার রজনী বোস লেনে শেখ মুজিব প্রথম তাঁর বাসাতেই উঠেছিলেন পরিবার নিয়ে।

খোকার জন্য ব্যাপারটা সহজ ছিল না। নজরদারী এড়িয়ে কুলাউড়া যেতে হলে ঢাকার বাইরে গিয়ে টঙ্গি থেকে ট্রেন ধরা উচিত। ফুলবাড়িয়ায় তখন কড়া পাহারা। ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা। ওদিকে টঙ্গি অনেক দূর। তাই ফুলবাড়িয়া এবং টঙ্গিকে বাদ দিয়ে আবার নতুন কৌশল গ্রহন করে কুর্মিটোলা থেকে ট্রেনে ওঠার একটা পরিকল্পনা গ্রহন করা হলো। তবে শান্তিনগরের বাসা থেকে কুর্মিটোলা পর্যন্ত পথটা গাড়িতে যেতে হবে।

কিন্তু গাড়িতে যেতেও একটা সমস্যা আছে। গাড়িটাকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে চেকপোস্ট পার হয়ে যেতে হবে। সুতরাং এমন একটি গাড়ি দরকার যেটা চেক করা হবে না। ভেবে চিন্তে মমিনুল হকের মনে পড়লো হারুন নামের এক বন্ধুর কথা। হারুনের ভগ্নিপতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদের কর্মকর্তা। লাল নাম্বার প্লেটের সরকারী গাড়ি আছে তাঁর। সেই গাড়ির পক্ষে চেকপোস্ট পার হওয়া সহজ। তাঁকে বিশ্বাস করা যায়। হারুনের কাছে চাইতেই গাড়ি সাহায্য পাওয়া গেল।

ঢাকা থেকে কুলাউড়া যাত্রাপথের সহায়তাকারী হিসেবে এই পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলেন আরো দুজন। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী তারেক চৌধুরী (অভিনেতা সোহেল চৌধুরীর পিতা) এবং মমিনুল হকের বন্ধু রেজা আলী (সিলেটের মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর ভাগ্নে)। এরা দুজনই শেখ মুজিবের অকুন্ঠ ভক্ত। বলা হলো নির্ধারিত তারিখে ওই দুজন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে রাতের একটা ট্রেনে প্রথম শ্রেণীর বগিতে চড়ে রওনা দেবেন। কুর্মিটোলা পৌঁছে তারেক ট্রেনের জানালা দিয়ে হাতের টর্চ জ্বালিয়ে সংকেত দেবেন। সেই সংকেত দেখে শেখ মুজিব বুঝবেন কোন বগিতে উঠতে হবে। শেখ মুজিব ওঠার পর সেই বগি থেকে আলী রেজা যাবেন। কুর্মিটোলায় ট্রেন খুব অল্প সময়ের জন্য থামে। খুব দ্রুততার সাথে যাত্রী বিনিময় ঘটাতে হবে। পরিকল্পনা করার পর রুহুল কুদ্দুসের বার্তার অপেক্ষা। রুহুল কুদ্দুস ফোন করে জানাবেন মমিনুল হককে। সরকারী নজরদারীর কারণে শেখ মুজিবের কিছু কিছু যোগাযোগের কাজ মমিনুল হকের মাধ্যমে করা হতো।

কয়েকদিন পর রুহুল কুদ্দুস টেলিফোন করে মমিনুল হককে জানালেন জরুরী ভিত্তিতে দেখা করতে। কুদ্দুস সাহেব থাকতেন ঢাকা কলেজের কাছে ধানমণ্ডির ১ নম্বর সড়কের কাছের একটা বাড়িতে। দেখা করার পর তিনি জানালেন – 'মোয়াজ্জেমের কোন খবর পাচ্ছি না, তার তো আগরতলা গিয়ে শেখ মুজিবকে রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করার কথা। এদিকে দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে সিগন্যাল এসে গেছে। শেখ মুজিবের অবিলম্বে  আগরতলা পৌঁছানো দরকার'।

খবর পেয়ে শেখ মুজিব দেরী করলেন না। নির্ধারিত দিনে পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একেবারে অনিশ্চিত একটা ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ালেন। জীবনে অনেক জেল জুলুমের শিকার হলেও এই প্রথম দেশের বাইরে একটা অনিশ্চয়তাপূর্ণ জীবনের জন্য পা বাড়াচ্ছেন। নিজের জীবনের উপর বাজি ধরা নতুন কিছু না, কিন্তু নতুন একটা স্বপ্ন নিয়ে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে এই প্রথম পলাতক জীবনে পা বাড়ানো।

কুর্মিটোলা পৌঁছে জানলেন ট্রেন আসতে আরো কিছুক্ষণ সময়। অপেক্ষার সময়টুকু ভাবনায় ডুবে থাকলেন। জীবনের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে কী লাভ। দেশটাই তো অনিশ্চয়তার পথে হাটতে শুরু করেছে ১৯৫৮ সাল থেকেই। তারো আগে পূর্ববর্তী নেতারা একের পর এক ব্যর্থ হয়েছেন, ক্ষমতার কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছেন, দল বিভক্ত করেছেন। এইসব বিভক্তি সুযোগ দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের। কিন্তু এই দেশ আমাদের, এই দেশ শাসনের অধিকার আমাদেরই বেশী। পশ্চিমের হাত থেকে মুক্তি আমাদের পেতেই হবে। সে মুক্তির জন্য যত রক্ত লাগে দেবো, সবার আগে আমার রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত। মরতে আমি ভয় পাই না। আমার মৃত্যু দিয়েও যদি স্বাধীনতার স্বপ্ন এগিয়ে যায় আমি তাতেই সন্তুষ্ট।

শেখ মুজিবের ভাবনায় ছেদ পড়লো ট্রেনের হুইসেল শুনে।

ট্রেন প্ল্যাটফর্মে আসার আগেই তিনি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন। শীতের রাত হলেও উত্তেজনায় শরীর উষ্ণ হয়ে আছে। তবু চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিলেন নিরাপত্তার স্বার্থে। ট্রেন পুরোপুরি থামার আগেই একটি বগির জানালা দিয়ে টর্চের আলো দেখা গেল। তিনি সেদিকে এগিয়ে গেলেন। সোজা গিয়ে ওই বগিতে উঠে পড়লেন। প্রায় সাথে সাথে ওই বগি থেকে নেমে এলেন একজন। তিনি আলী রেজা। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক ঘটলো। ট্রেন ছেড়ে দিল।

কিন্তু সপ্তাহখানেক পর একদিন সেহরীর সময় শেখ মুজিবের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। কড়া নাড়া শুনে বাড়ির বাসিন্দারা আতংকিত হলো। বাড়িতে বেগম মুজিব আর ছোট ছেলেমেয়েরা বাদে পুরুষ বলতে মমিনুল হক খোকা। তাঁকে শেখ মুজিব পরিবারকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। এত রাতে পুলিশ ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। বেগম মুজিব আর খোকা সেহরী খাওয়ার জন্য উঠেছিলেন খানিক আগে। আরো জোরে কড়া নাড়া হতে খোকা ভয়ে ভয়ে দরোজা ফাঁক করে চমকে উঠে বললেন- মিঞা ভাই! বেগম মুজিব এগিয়ে এসে দেখলেন চাদর মোড়ানো পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরা উষ্কোখুষ্কো চুল নিয়ে শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে আছেন।

ঘরে ঢুকেই বেগম মুজিবকে বললেন, 'আমাকে খেতে দাও আগে, আমি খুব ক্লান্ত, সারা পথ হেঁটে এসেছি'।

খাওয়াদাওয়া সেরে সংক্ষেপে সব কথা খুলে বললেন। সীমান্ত পার হতেই সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন শেখ মুজিব। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী তাঁকে আটক করেছিল। কথা ছিল মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর ভারতীয় কতৃপক্ষের সাথে সব ঠিক করে রাখবেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি কোন কারণে। যদিও সব খুলে বলার পর ভারতীয়রা কোন অসৌজন্যমূলক আচরণ করেনি, তবু শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য সেখান থেকে লণ্ডন যেতে দিতে রাজী হয়নি। ভারতীয় কতৃপক্ষ বলেছিল আগরতলা থেকেই পাকিস্তান বিরোধী প্রচারণা করতে। শেখ মুজিব রাজী হননি তাতে এবং ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

৩.
আরো ছয় বছর পরে ১৯৬৮ সালে যখন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' দায়ের করা হয়, সেই মামলার নামের সাথে 'আগরতলা' শব্দটি যুক্ত হবার কারণ ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই পরিকল্পিত অসমাপ্ত আগরতলা অভিযান। যে ভ্রমণ পাকিস্তানী আগ্রাসী শাসকের কবল থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ খুঁজতে বেরিয়েছিল।


তথ্যসুত্র :
১. অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জল : মমিনুল হক খোকা
২. বঙ্গবন্ধুর জীবন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুনতাসির মামুন, দৈনিক জনকন্ঠ ১৭ মার্চ ২০১২
৩. India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation & Pakistan : Sashanka S. Banerjee

পুরোনো পত্রিকা থেকে: রবিঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা' গানটি যেদিন আমাদের হলো

অবসরে পুরোনো পত্রিকা ঘাঁটতে গিয়ে দুটো বিষয়ের সংবাদ নজরে পড়লো। সংবাদ দুটোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে নিজের খাতায় জমা রাখা।

সংবাদ দুটো ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠকের দুটি উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে। সিদ্ধান্ত দুটো ছিল জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত বিষয়ে।

প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল জাতীয় পতাকা থেকে হলুদ মানচিত্রটি বাদ দেয়া হবে। কেননা সাধারণ মানুষের পক্ষে মানচিত্র আঁকা পতাকা বানানো কষ্টকর। তাই সিদ্ধান্ত হলো মানচিত্র বাদ দিয়ে শুধু লাল সবুজের পতাকাই বাংলাদেশের আকাশে উড়বে। যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল নিঃসন্দেহে।

দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত ছিল জাতীয় সঙ্গীত বিষয়ে। জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা'র প্রথম দশ লাইনকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহন করা হয়। আমার সোনার বাংলার বর্তমান সংস্করণটি রবীন্দ্রনাথের আদি সুর থেকে একটু ভিন্ন।

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এইচ এম ভি প্রথম 'আমার সোনার বাংলা' গানের রেকর্ড প্রকাশ করে সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠে। কিন্তু সুচিত্র মিত্র গাইবার সময় একটু ভিন্ন সুরে গেয়েছিলেন শান্তিদেব ঘোষের তৈরী স্বরলিপি অনুসারে। সেই সুরটিই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল পরবর্তীকালে। আমাদের শিল্পীরা সুচিত্রা মিত্রকেই অনুসরণ করেছিলেন। যুদ্ধের সময় মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে যে সুরে 'সোনার বাংলা' গেয়েছিলেন, সেই সুরেই রেকর্ডে গাওয়া হয়। সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া সুরের অনুসরণে মুক্তিযুদ্ধের সময় গাওয়া সুরটি ধরে রাখার জন্য তা রেকর্ডে ধারণ করা হয়।
 
মন্ত্রীসভার বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শোনেন যে, স্বরবিতানের ছাপানো মূল সুরের সঙ্গে আমাদের শিল্পীদের গাওয়া সুরের মিল নেই। তখন তিনি বলেছিলেন, 'যে সুর গেয়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে সুরেই আমাদের জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে, সেটিই জাতীয় সংগীতের সুর'। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুও সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া সুরকেই বেছে নিলেন।


বিষয়টি চুড়ান্ত করার জন্য একটি দলকে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়। সেই দলে ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী আবদুল আহাদ, আতিকুল ইসলাম এবং আফসারী খানম। বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ডের সভায় উপস্থিত হয়ে তারা জানালেন, 'আমার সোনার বাংলা গানটি স্বরলিপি বইয়ে যেভাবে ছাপা আছে, সেটা আমরা গাই না। সুচিত্রা মিত্র যে রেকর্ডটি করেছিলেন  বাংলাদেশের দরকার সেই সুরটির স্বরলিপির অনুমোদিত কপি।

শান্তিদেব ঘোষ যিনি রেকর্ডে সুচিত্রা মিত্রের ট্রেনার ছিলেন, সভায় তিনিও ছিলেন। আলোচনা শেষে বিশ্বভারতী বাংলাদেশের প্রস্তাবে সম্মত হলো। জানানো হলো স্বরলিপি তৈরি করে বাংলাদেশের সরকারকে কিছুদিনের মধ্যে পাঠিয়ে দেবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারী বিশ্বভারতী কতৃপক্ষ বাংলাদেশ সরকারকে আমার সোনার বাংলার কপিরাইট প্রদান করে।

সেদিন থেকে 'আমার সোনার বাংলা' আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের হলো।

Sunday, March 19, 2017

ও হেডমাস্টার

১. যে দেশের অধিকাংশ স্কুল সম্পূর্ণ শিক্ষাদানে ব্যর্থ, সেদেশে শিক্ষিতের হার নিশ্চয়ই অশুদ্ধ ৷

২. দৈনিক ৬ ঘন্টার স্কুল শেষে আরো ৪-৫ ঘন্টার কোচিং, প্রাইভেট টিউটর ইত্যাদির পেছনে কেন ছুটতে হয় শিশুটিকে? ৬ ঘন্টায় কী শেখানো হয়? স্কুলের জন্য বরাদ্দ সময়টুকু যদি শিক্ষা সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট না হয় তাহলে হয় বই সংখ্যা কমাতে হবে, না হয় অপ্রয়োজনীয় পড়া বাদ দিতে হবে, এটা তুচ্ছ সাধারণ জ্ঞানটুকু নেই তাদের হাতে শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা নিরাপদ?

৩. স্কুল এবং কোচিং এর যুগপৎ অস্তিত্ব সবাই যখন মেনে নিয়েছে (সরকার ও জনগণ) তখন দেখা যাক- এই দুটোর মধ্যে কে বেশী যোগ্য, কে অযোগ্য? কোচিং এ না পড়লে যদি জিপিএ-৫ না হয় তাহলে শিক্ষাদানে কোচিং সেন্টারই যোগ্য। সুতরাং অযোগ্যতা মেনে স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হোক এবং শিক্ষা বাজেট কোচিং বাণিজ্যের উন্নয়নে ব্যয়িত হোক।

৪. স্কুল সময়টা যখন নিতান্তই অপচয়, ওই সময়ে বাচ্চারা খেলাধূলা করুক। শিক্ষার পেছনে সমস্ত সময় ব্যয় করতে গিয়ে শিশুদের জীবন থেকে আনন্দ কেন নির্বাসনে যাবে?

৫. ব্যাগের ওজন কমাতে বলেন কিন্তু বই সংখ্যা কমাতে বলেন না। ব্যাগের ওজন কী বাতাসে বাড়ে? কোন বয়সে কতটা বিদ্যা শেখাতে হবে সেই জ্ঞান যাদের নেই, তারা জাতির শিক্ষাপিতা।

৬. দেশের জনসংখ্যা বাড়ে, শিক্ষা হার বাড়ে, জিপিএ-৫ বাড়ে, কিন্তু স্কুল সংখ্যা বাড়ে না কেন? শিক্ষা শিশুর মৌলিক অধিকার হলে ভর্তিযুদ্ধ নামের আতংকের জন্মদাতা কে? 

Saturday, March 18, 2017

চৈত্রের বাতাসে পৌষের আবেশ

মার্চের আঠারো তারিখ আজ। চৈত্রের চতুর্থ দিন। এই সময়ে বাংলাদেশের বাতাসে ধুলো ওড়ে, মাতাল হাওয়ার নাচন চলে, কালবোশেখীর ঝড় ওঠে। ফেব্রুয়ারী থেকেই গরমের যাত্রা শুরু হয়। বসন্তের অস্তিত্ব অনুভব করার আগেই গ্রীষ্মের তাড়াহুড়ো আগমন ঘটে।

কিন্তু এবার অন্যরকম। এখনো আকাশে বাতাসে প্রকৃতিতে শীতের আমেজ। হালকা শীত। না গরম না ঠাণ্ডা আরামদায়ক একটা আবহাওয়া। সারা বছর এমন আবহাওয়া থাকলে বাংলাদেশ স্বস্তি পেত। প্রতিবছর যেমন এক মাস অন্তত কঠিন শীত পড়ে, এবার তেমন ছিল না। হালকা শীতেই কেটেছে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী এই চার মাস। এখন এই মার্চের দ্বিতীয়ার্ধেও হালকা শীতল বায়ু।

আজকে বোধহয় বায়ুর মতি ফিরেছে খানিকটা। দুপুরের পর হঠাৎ করে জড়ো হতে থাকলো মেঘের দল। বাতাসে বেগ উঠলো, আকাশ থেকে বিভঙ্গ তরঙ্গে গর্জন উঠলো, তারপর বিকেল জুড়ে বেশ খানিকটা বর্ষণ ছড়িয়ে দিল নববর্ষার রূপ ছড়িয়ে। যতটা গর্জেছে ততটাই বর্ষেছে। সন্ধ্যার পর সব সুনসান। মেঘের দল বাড়ি ফিরে ঘুমোতে গেল। বাতাসে তখনো ভিজে বাতাসের ঘ্রাণ।


Friday, March 17, 2017

The Sapphires : অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী নারীদের আলো এবং অন্ধকার নিয়ে নির্মিত সিনেমা

মানুষের পৃথিবীতে নিজের ভূখণ্ডে যারা চিড়িয়াখানায় বাস করতে বাধ্য হয় তাদেরকে 'রিজার্ভ' নামক সংরক্ষিত নামে অভিহিত করা হয়। তাদের অবস্থা পৃথিবীর যে কোন আদিবাসীর চেয়ে করুণ। আমেরিকার রিজার্ভ সম্পর্কে আমরা অল্প বিস্তর জানলেও অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যাণ্ডের আদিবাসীদের সম্পর্কে তেমন জানা হয় না সিনেমা টিভিতে।

The Sapphires আমাদেরকে সেই অজ্ঞতা থেকে খানিকটা মুক্ত করে। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমার পরিচালক নিজেও একজন আদিবাসী। তিনি কিছুটা দায়বোধ থেকে সিনেমাটি বানিয়েছেন এবং বিশ্বব্যাপী নন্দিত হয়েছেন। তাঁর 'সেপ্টেম্বর অব শিরাজ' দেখার পর এই সিনেমার সন্ধান পাই। একটি আদিবাসী রক্ষণশীল পরিবারের কয়েক বোন ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সৈন্যদের সঙ্গীত মনোরঞ্জনের জন্য নির্বাচিত হবার ঘটনার পূর্বাপর নাটকীয়তা নিয়ে সুনির্মিত একটি সিনেমা।

সিনেমাটির সুসমাপ্তি এবং সেই মেয়েগুলোর পরবর্তী জীবনে সফলতা সত্ত্বেও যে সত্যিটা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে তা হলো রিজার্ভ বংশোদ্ভুত মেয়েদের শৈশবে বেড়ে ওঠার সময় যেসব অমানবিকতা পর্ব পার হয়ে আসতে হয় সেটা সত্যি খুব মর্মান্তিক এবং তথাকথিত সভ্য দেশের সভ্য সরকারের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। যেখানে আলোর নীচে প্রবল অন্ধকার লুকোনো।



The Tin Drum ২য় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে অপ্রচলিত বর্ননার একটি সিনেমা

যদিও তুলনার ব্যাপার নেই তবু 'লাইফ ইজ বিউটিফুল' কিংবা 'বাইসাইকেল থিফ' এর মতো দীর্ঘ সময় দাগ কেটে রাখার মতো একটি উপাখ্যান 'দ্য টিন ড্রাম'। পটভূমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলেও ঘটনার যাত্রা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ থেকেই। তিন বছর বয়সী অস্কারের 'বড়' হতে না চাওয়া তাকে থামিয়ে দিয়েছিল যে সময়, সেই সময়ের গল্প বলা হয়েছে সমস্ত সিনেমা জুড়ে। যেদিন হিটলারের নাৎসী পার্টি পোল্যাণ্ডের উপর আগ্রাসন দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিল, অস্কার ছিল তার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন। বিচিত্রতর সেই সব অভিজ্ঞতা কোন কোন জায়গায় দর্শককেও প্রত্যক্ষদর্শী বানিয়ে তুলেছিল এই সিনেমাটিতে। জাতি-ধর্ম-গোত্র ভেদে যে যুদ্ধ শুধু ধ্বংস আর হত্যাযজ্ঞই চালাতে পারে সেই যুদ্ধের বিভীষিকার ভেতরেও থাকে অন্য রকম কিছু ঘটনা। চলমান ছবির জানালা দিয়ে আমরা সেই অভিজ্ঞতাই অর্জন করি।

The Tin Drum (১৯৫৯) এর জন্য গুন্টার গ্রাস নোবেল পেয়েছিলেন বইটি প্রকাশের ৪০ বছর পরে(১৯৯৯)। তবে নোবেল পাবার ২০ বছর আগেই (১৯৭৯) 'দ্য টিন ড্রাম'কে নিয়ে সিনেমাটি বানাবার জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি Palme d'or পেয়েছিলেন জার্মান পরিচালক Volker Schlöndorff.

গুন্টার গ্রাসের নাম প্রথম শুনেছিলাম যখন তিনি ঢাকায় আসেন ১৯৮৬ সালে। পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছিল। তারো অনেক পরে দ্য টিন ড্রাম বইটির অনুবাদ পড়েছিলাম। এত বছর পরে সিনেমাটি খুঁজে পাওয়া গেল ইন্টারনেটের খনিতে। 

Saturday, March 4, 2017

Septembers in Shiraz : খোমেনি বিপ্লবের ভুক্তভোগি

Dalia Sofer ইরানী বংশোদ্ভুত আমেরিকান লেখিকা। কিন্তু ইরানের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ হয় ১১ বছর বয়সে। ১৯৭৯ সালে ইরানের খোমেনী বিপ্লবের সময় তার ধনী জুয়েলারী পিতা বিপ্লবীদের হাতে আক্রান্ত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ইরানের সুন্দরতম শহর শিরাজ ছেড়ে পালিয়ে নিউইয়র্ক চলে আসে। ২০০৮ সালে সেই স্মৃতির উপর ভিত্তি করে লেখেন আত্মজৈবনিক উপন্যাস Septembers in Shiraz

সেই উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মান করেন অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী বংশোদ্ভুত পরিচালক Wayne Blair. যিনি The Sapphires বানিয়ে পুরস্কার ও পরিচিত লাভ করেন বিশ্বব্যাপি।

Septembers in Shiraz নির্মান তাঁকে এখনো কোন পুরস্কার ও খ্যাতি এনে দিতে না পারলেও ডালিয়া সোফের ও তার পরিবারের অভিজ্ঞতার চিত্রায়ন একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হয়ে থাকবে। কেননা এই ছবিতে দর্শক রোমান পোলানস্কির 'পিয়ানিস্ট' Adrien Brody কে নতুন করে আবিষ্কার করবে।

Thursday, March 2, 2017

উনিশশো চুরাশির স্কুল বন্ধুরা

অভূতপূর্ব এক সম্মিলনীতে ৩৩ বছর আগে স্কুল ছেড়ে আসা কিছু সহপাঠী নিজেদের খুঁজে পেল কৈশোর আনন্দে। সহপাঠী মানে বন্ধু নয়, সব সহপাঠি বন্ধু হয় না, তবু সেই মেলায় আবারো যেন বন্ধুতার আনন্দ মিললো। সারাদিন আড্ডায় স্মৃতিচারণায় অনেকদিন পর অনেকখানি বদলে যাওয়া চেহারার ভুগোল মানচিত্র থেকে খুঁজে খুঁজে  আবারো পুরোনো নামে নতুন করে পরিচিত হওয়া সে এক রোমাঞ্চকর আবিষ্কার। এসএসসি পরীক্ষার পর ছিটকে যাওয়া বন্ধুগুলোর চেহারায় যখন গোফের রেখাও ওঠেনি, সেই মুখে কাঁচাপাকা দাড়ির জঙ্গলে অদ্ভুত লাগছিল কাউকে কাউকে, অচেনাও।

মনন মানস কার কতখানি বদলে গেছে জানি না। তবু পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরী শতবর্ষ প্রাচীন রেলওয়ে ক্লাবে যখন সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছিল হলঘরের ভেতরে, বাইরে, বাগানে, বারান্দায়, তখন আবারো একটা স্কুল যেন উঁকি দিল। বয়সের ভারে ন্যুজ্ব হয়ে পড়া অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা যখন তিন দশক পুরোনো ছাত্রদের ডাকে আসতে লাগলো তখন আসরে সত্যি একটা স্কুল আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছিল। আমার স্কুল, আমাদের স্কুল। প্রিয় শিক্ষককে জড়িয়ে আনন্দে কেউ কেঁদে ফেললো। আহ, শেষবেলায় এসে এই স্মৃতির আড্ডাতে ভাসতে ভাসতে কখন যে সূর্যাস্ত হয়ে যায়, টেরও পাই না। দীর্ঘ দশ ঘন্টা যেন পাড়ি দিল আধঘন্টার দ্রুততায়। হঠাৎ করে ভচকে যাওয়া পা টেনে কষ্টকে সামলে তবু মাঝরাত পার করে দিতে ইচ্ছে করছিল।

বাঁ পায়ের খোঁচা খোঁচা ব্যথাটা সয়েও বলতে পারি একটা অনন্য আনন্দ দিন কেটেছিল ২৪শে ফেব্রুয়ারী ২০১৭। স্মৃতির খাতায় আরো একটি বড় যোগফল।