Wednesday, August 17, 2022

দৃষ্টিবিভ্রম

দৃশ্যত আমরা যা দেখছি তা হয়তো সত্যি নয়। সিনেমা আর বাস্তবের মাঝামাঝি একটা অবস্থানে আমরা বাস করছি। ওই যে সামনে যে লোকটাকে দেখছি, তার পোশাকের অন্তরালে, মুখোশের আড়ালে সে আসলে অন্য মানুষ। পোশাক আর মুখোশের কারণে আমরা তার কাছ থেকে যে ভূমিকা আশা করছিলাম সে ভূমিকা পাচ্ছি না বলে হতাশ হচ্ছি। আবার উল্টোটাও হতে পারে, পোশাক আর মুখোশ দুটোর ভূমিকা তার বাস্তব অবস্থানের বিপরীত। আমরা পর্দায় ভেসে ওঠো মুখ ও মুখোশের চিত্রটাই দেখি। পেছনের কারিগরকে দেখতে পাই না। কিন্তু তার অভিনয় দেখে আমরা যা বুঝতে পারছি সেটা আসলে কারিগরের ভাষা। ঐ চেয়ারে যে বসে আছে, সে আসলে অন্য কেউ। সে আমাকে যে কথাটা বলছে সেটা তার স্ক্রিপ্টের ভাষা। পর্দা নেমে গেলে সে অন্য ভাষায় কথা বলবে।


Sunday, August 7, 2022

সফলতার গতিরোধক

সফলতার একটা গতিরোধক থাকা উচিত। নইলে মানুষ ক্রমাগত ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সফলতা ব্যাপারটা নিজের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়। অনেক মানুষ বুঝতে পারে না ঠিক কখন তার সুখী হওয়া উচিত। অনেক কিছু পাওয়ার পরেও সে নিজের মধ্যে আত্মতৃপ্তি খুঁজে পায় না। কারণ সে ভাবছে সফলতা মানে হলো উপরের দিকে যাওয়া। আরো বড় কিছু করা, আরো বড় কিছু হওয়া, আরো উন্নতির ধাপে উঠে যাওয়া। সব সফল মানুষ সুখী হতে পারে না এই কারণে। 

সফলতা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। কেউ বড় চাকরী পেয়ে সফল। কেউ ব্যবসায় বড় দাও মেরে সফল। কেউবা বড় পুরস্কার সম্মান অর্জন করে সফল। আবার কেউ একটা মেঘলা দুপুরে এক কাপ লেবু চায়ের সাথে 'এমন দিনে তারে বলা যায়' শুনতে শুনতেও নিজেকে সফল ভাবতে পারে।

আমাদের মূল সমস্যা হলো অন্যদের চোখে আমি সফল কিনা সেটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া। সুখী হবার জন্য অন্যের চোখে সফল হবার দরকার নেই। নিজের চোখে নিজে সফল কিনা সেটাই আসল। নিজের যতটুকু সীমানা, সেটার মধ্যে সুখী হতে পারাই সফলতা।

তাই প্রত্যেকে যদি সফলতার একটা নিজস্ব গতিরোধক মেনে চলতো তাহলে নিজের উপকার করতো। শুধু যদি বুঝতে পারতো উপরে উঠে যাওয়াই সফলতা নয়। কোথাও গিয়ে এক দণ্ড বসে নিঃশ্বাস নিয়ে ছোট্ট করে বলতে পারা, ভালো আছি। এই মুহূর্তে ভালো আছি।

Monday, July 25, 2022

আমাদের অনৈক্য বিভক্তি আর সংকীর্ণতার ঐতিহ্য

আমরা বাঙালীরা নানান সময় ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে গৌরবের কথা বলি। যতটা সম্ভব আমাদের গৌরবকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করি। এই বাড়াবাড়িটা সন্তানের প্রতি পিতার যে স্নেহের আতিশয্য তার সাথে তুলনীয়। বাস্তবে আমাদের গৌরবের অনেক কিছু থাকলেও সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার হলো আমরা অগৌরবের বিষয়ে অগ্রগামী। আমাদের চরিত্রের ঐতিহ্য হলো বিভক্তি, সংকীর্ণতা আর স্বার্থপরতা। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তার নজির ছড়িয়ে আছে। মোগলরা আমাদের পূর্বপুরুষ নয়, কিন্তু মোগলদের অনৈক্যের উত্তরাধিকার আমরা নিয়েছি। প্রতিটা পরিবারে সংসারে অনৈক্য, বিবাদ, হানাহানি। আমাদের রক্তে মিশে গেছে সেই সংকীর্ণতা। আমাদের মুক্তি নেই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল সবসময় বিভক্ত ছিল। বিএনপি আওয়ামী লীগ দুই দলের সমর্থক দেশের প্রধান দুটি ভাগ ছিল। ইতিহাস নিয়ে বিভক্তিটা সীমাবদ্ধ ছিল মুজিব জিয়ার মধ্যে। সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের মধ্যেও নানান বিভক্তি শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে অপ্রীতিকর হলো শেখ মুজিব আর তাজউদ্দিনকে নিয়ে দুটো আলাদা শিবির হয়ে গেছে। দশ বছর পর দেখা যাবে এমনসব গবেষণা হয়েছে যাতে মনে হবে একাত্তরে এরা দুজন দুটো বিপরীতমুখী দলের নেতা ছিলেন। অথচ বাস্তবে এরা দুজন বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বেঁচে থাকার সময় তাঁরা পরস্পরকে বন্ধুর মতো জানতেন। এখন তার সমর্থকগণ দুজনের মধ্যে মরনোত্তর বিবাদ ঘটিয়ে দেশের রাজনৈতিক চরিত্রের মহা উন্নতি ঘটাতে চাইছেন। কট্টর তাজ সমর্থকগণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যেটা বলতে চান, সেটা হলো ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে চাননি। শেখ মুজিব সমর্থকগণ বলতে চান, তাজউদ্দিন কৌশলে মুজিবনগর সরকারের প্রধান হয়ে বসেছিলেন। তিনি শেখ মুজিবের কথামতো কাজ করেননি। আমরা যারা ইতিহাস নিয়ে সামান্য কাজ করি, তারা জানি দুই দলের মতই অতি সংকীর্ণ মানসিকতায় ভরপুর। ভরসা হলো এই সংখ্যা এখনো খুব বেশি না। এই মতবাদগুলো টিকবে না। শেখ মুজিব বা তাজউদ্দিন কেউ কারো প্রতিযোগী ছিলেন না। ঘুণাক্ষরেও সেটা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। দুজনই আমাদের ইতিহাসের সম্পদ। দুজন দুজনের পরিপুরক। তাঁদের দুজনকে সমান করতে গেলে যেমন অবিচার হবে, তেমনি দূরত্ব সৃষ্টি করতে গেলেও অন্যায় হবে। অংকের ভাষায় মানুষের তুলনা করা যায় না।

Saturday, January 15, 2022

অড্রে হেপবার্নের অপেক্ষা

একটি টেলিফোন বেজে ওঠার মধ্য দিয়ে ঘটনার সুত্রপাত। সকাল সাড়ে সাতটায় টেলিফোনটা বেজে উঠেছিল আমার টেবিলে। খুব অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল, যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা একটি নারীকন্ঠ। কী আশ্চর্য আমাকে এই সাত সকালে কে টেলিফোন করে? পরিচয় পেয়ে আমি চমকে উঠি। অন্তত আমার কাছে ওর কাছ থেকে ফোন আসার কথা নয়। অফিস কলিগ পরিচয়ের নারীকন্ঠটি বলছে, আমার সাথে জরুরী আলাপ আছে। এখনি দেখা করতে চায়। কোথায়, কেন? প্রশ্ন জেগে ওঠে। দ্বিধা নিয়ে আমি রাজী হলাম। এমন কী ব্যাপার? আমার সাথে কী কথা অড্রে হেপবার্নের? 

.....................................................................................................................

যে কৃষ্ণচুড়া গাছটার নীচে অড্রে হেপবার্ন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, সেটি এখনো আছে। আগের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে। রাস্তা বড় করা হলেও গাছটা কাটা পড়েনি। মাত্র তেইশ বছর আগের কথা। সেবার খুব বন্যা হয়েছিল। ৯৮ সালের বন্যায় ঢাকার রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে সারাদেশের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। চট্টগ্রামের আকাশও জলভরা মেঘে পরিপূর্ণ ছিল। সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল  বৃষ্টি এলে আশ্রয় নেবার কোন জায়গা ছিল না সেখানে। কৃষ্ণচুড়া গাছটি কেবল ছায়া দিতে পারতো, ছাতার আশ্রয় দিতে পারতো না। ভাগ্যিস বৃষ্টি সেদিন বিরতি নিয়েছিল কিছুটা সময়। লোকচক্ষু এড়িয়ে একা একটা মেয়ের পক্ষে রাস্তার পাশে  দীর্ঘ ৯০ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সহজ কথা ছিল না। বিশেষ করে অড্রে হেপবার্নের জন্য বিষয়টা প্রাণঘাতী ছিল। তবু সে স্থির সিদ্ধান্তে অপেক্ষা করাই স্থির করেছিল। কারণ আমি ওকে বলেছিলাম 'কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি আমি'। কিছুক্ষণ বলতে কতটা সময় কেউ জানে না। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে আমার কিছুক্ষণের মেয়াদ ৯০ মিনিটের বদলে ৯ মিনিটে নেমে আসতো যদি জানতাম সে কেন আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। প্রথমত অড্রে হেপবার্ন আমার সাথে জরুরী কথা আছে বলে যখন ফোন করেছে, তখন যে বিস্ময়ের ঘোর লেগেছিল সেটা কাটিয়ে ওঠা সহজ ছিল না। আমার সাথে কখনো কেউ এমন জরুরী ডাক দিয়ে দেখা করতে চায়নি। জরুরী ডাকের কারণটা জানার আগে অড্রে হেপবার্নের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই।

বই আছে, সময় নেই

কত কত বই জমে আছে! এত বই পড়ার সময় কই? সীমিত আয়ুষ্কালে এতসব বই কী পড়া শেষ করা যাবে? পড়তে পড়তে প্রায়ই এই দুশ্চিন্তাটা মাথাচাড়া দেয় পড়ুয়াদের। বিশেষ করে সেই পড়ুয়া যারা 'বেঁচে থাকার জন্য পড়ে' কিংবা 'পড়ার জন্য বেঁচে আছে'। পড়াশোনা ব্যাপারটা তাদের কাছে বেঁচে থাকার অক্সিজেনের মতো। বইয়ের কাছে না থাকলে এরা রীতিমত হাঁসফাস করে। 


সময় কম, বই বেশী। কম সময়ে বেশী বই পড়ে এগিয়ে থাকার যুদ্ধে চাপটা এসে পড়ে দৃষ্টিশক্তির উপর।  লক্ষ্য যদি হয় বেশীদিন পড়া, তাহলে চোখকে বাঁচাতে হবে। অন্য যেসব কাজে আমাদের চোখ ব্যবহার করতে হয় সেসব কাজ কমিয়ে বইয়ের খাতে বেশী বরাদ্দ রাখতে হবে। সেটা কী আদৌ সম্ভব?  ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমাদের চোখ গড়ে ৮ ঘন্টা বন্ধ থাকে ঘুমের জন্য। কমপক্ষে ৮ ঘন্টা জীবিকার কাজে লাগে। বাকী থাকে ৮ ঘন্টা। এই ৮ ঘন্টার মধ্যে স্নাহাহার, যাতায়াত এসবে ৪ ঘন্টা (ঢাকা শহরে যাতায়াত বাবদ আরো বেশী খরচ হয়)। বাকী থাকলো ৪ ঘন্টা। এই চারঘন্টা ভাগাভাগি করতে হবে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, অতিথি, আড্ডা, ফেসবুকসহ নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদির মধ্যে। সবাইকে সময় দিতে গেলে বই পড়ার জন্য দৈনিক আধঘন্টা সময়ও কি মিলবে? গাণিতিক হিসেবে বই পড়ার জন্য কোন সময় খুঁজে পাওয়া যায় না।