Monday, February 26, 2024

শরচ্চন্দ্র দাস বনাম থাংলিয়ানা

 



বই দুটো প্রকাশের পরপর পাঠকের কাছ থেকে যেসব অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা পেয়েছি, তার মধ্যে বিশ্বপড়ুয়া স্নেহের মাশরুফ হোসেনের এই লেখাটা ছিল সবার সেরা।

২৫শে ফেব্রুয়ারী ২০২৪

নন-ফিকশন বা গবেষণামূলক বইয়ের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তির যে বিষয়ে উপযুক্ত অভিজ্ঞতা কিংবা প্রশিক্ষণ নেই, সচরাচর আমি ওই বিষয়ে ওই ব্যক্তির লেখা পড়ি না। জ্ঞানের জগৎ এখন অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে, "এ্যামেচার" দের পক্ষে এতে অবদান রাখাটা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। আগের যুগে মানুষ ঘরে বসে অনেক কিছু আবিষ্কার করে ফেলতো, এখন সেটার সম্ভাবনা খুবই কম। পিউর সায়েন্সে এটা দৃশ্যমান, সোশাল সায়েন্স বা আর্টসে এখনও অতটা দৃশ্যমান না। বাংলাদেশে এখনও কোনোরকম ট্রেনিং বা ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই মানুষজন শখের বশে রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে বই নামিয়ে ফেলে।
এটুকু পড়ে ভুল বুঝবেন না। বই লেখা তো কোনো অপরাধ না, যে কেউ যে কোনো বিষয়ে বই লিখতেই পারে। এসব বইগুলোর মান যে সবটাই খারাপ, তাও না- চমৎকার কিছু বইও আছে। তবে পাঠক হিসেবে আমি খুঁতখুঁতে, এসব বই সন্দেহের চোখে দেখি।
এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম Haroon Rashid ভাই। তিনি কর্পোরেট জগতের মানুষ, ইতিহাসে তাঁর ফর্মাল একাডেমিক ট্রেনিং থাকার কথা না। অথচ এই মানুষটি তীব্র প্যাশন, ভয়াবহ পরিশ্রম এবং বছরের পর বছর লেগে থেকে কয়েকটি বই লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন যেগুলো পেশাদার গবেষকদের লজ্জা দিতে সক্ষম। আমি প্রথম মুগ্ধ হই তাঁর "উপনিবেশ চট্টগ্রাম" বইটা পড়ে। চাকমা রাজাদের ইতিহাস নিয়ে তিনি আরেকটি লেখা লিখেছিলেন সম্ভবত সিল্করুটে, ওটা পড়ে এতই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে ভাইকে সরাসরি কল দিয়েছিলাম।
অত্যন্ত আনন্দের সাথে দেখতে পাচ্ছি, এবার তাঁর হাত ধরে দুটো রোমাঞ্চকর বই আসছে। আমি দুটিই সংগ্রহ করব। থাংলিয়ানা এসেছে কথাপ্রকাশে, আর নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি এসেছে বাতিঘরে।
হারুন রশিদ ভাইয়ের বই মানেই ইতিহাসের অজানা বাঁকের হারিয়ে যাওয়া মণিমুক্তোর সন্ধান, তাঁর অনুবাদ মানেই প্রবল পরিশ্রমে গবেষণালব্ধ খুঁটিনাটি টীকা ও প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যার সমাহার।
আমি নিজেও যেহেতু "এ্যামেচার" হিসেবে একদিন বই লেখার স্বপ্ন দেখি, এ লাইনে আমি উনাকে অনুকরণীয় বলে মনে করি।
সস্তা চাকচিক্যের ভীড়ে একজন নিভৃতচারী গবেষক ও লেখক হারুণ ভাইয়ের বইগুলোর বহুল প্রচার ও পাঠ কামনা করছি।

পরের পোস্ট ছিল বাদল সৈয়দের:

Haroon Rashid নীরবে বছরের পর বছর হারিয়ে যাওয়া দুর্লভ ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন। এমনকি এ কাজ করার জন্য নিয়মিত অবসরে যাওয়ার প্রায় পনের বছর আগে তিনি 'হাই প্রোফাইল' চাকুরি ছেড়ে দেন। সমসাময়িক কালে তাঁর মতো এত সিরিয়াস ইতিহাসভিত্তিক লেখক আমি খুব কম দেখেছি। এবার বইমেলায় তাঁর নিচের বইগুলো বের হয়েছে। প্রকাশ করেছে 'বাতিঘর' এবং কথাপ্রকাশ। অন্তত আমার কাছে এগুলো 'মাস্ট কালেকশন'।

প্রথম আলোতে শরচ্চন্দ্র দাসের বইটি সম্পর্কে বলা হয়েছিল:


"মেলায় বরাবরের মতোই এবারও মননশীল বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ লক্ষ করা করা গেছে। মেলায় আকবর আলি খান, আলতাফ পারভেজ, আলী রীয়াজ, মহিউদ্দিন আহমেদের বই খুঁজছেন পাঠকেরা। তাঁদের বাইরে আনিসুজ্জামান, বদরুদ্দীন উমরের মতো লেখদের বইয়ের নতুন নতুন সংস্করণেরও চাহিদা বাড়ছে।

এবার এমন তালিকায় নতুন সংযোজন হারুন রশীদের লেখা গবেষণাধর্মী ইতিহাস আশ্রয়ী বই শরচ্চন্দ্র দাস: নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি। শরচ্চন্দ্র দাসের মতো এমন বর্ণাঢ্য চরিত্র ব্রিটিশ ভারতে আর দ্বিতীয়টি ছিল না বললেই চলে। চট্টগ্রামের পটিয়ার এই সন্তান একই সঙ্গে ছিলেন অভিযাত্রী, পণ্ডিত ও ব্রিটিশ ভারতের প্রথম কাউন্টার ইন্টিলিজেন্ট (গুপ্তচর)। পরিচয় গোপন করে নিষিদ্ধ তিব্বতে তিনি যেভাবে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তা এক কথায় ছিল দুঃসাহসিক।
১৮৭৯ ও ১৮৮২ সালে দুই দফা সফরে তিব্বতের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সখ্য হয়েছিল শরচ্চন্দ্রের। কিন্তু দ্বিতীয়বার ১৮৮২ সালে তিব্বত গিয়ে ১৪ মাস থাকার পর যখন ফিরে আসেন, তখন সে দেশের সরকারের কাছে তাঁর পরিচয় প্রকাশিত হয়। শরচ্চন্দ্রকে তিব্বত অভিযানে সহায়তা করা তিব্বতের বেশ কয়েকজন নাগরিককে এর মূল্যও দিতে হয়। ব্রিটিশ ভারতের গুপ্তচরকে সহায়তার দায়ে তাঁদের সবার মৃত্যুদণ্ড হয়। গত বেশ কয়েক বছর ধরে শরচ্চন্দ্র দাসকে নিয়ে গবেষণা করেছেন হারুন রশীদ। এই বই শরচ্চন্দ্রকে নিয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা বই, এ কথা বলাই যায়।"

তার আগে তারেক অনু প্রকাশের খবর পেয়ে পাহাড়ে বসেই লিখেছিল:
হারুন ভাইয়ের Haroon Rashid এই বইটির জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান অবশেষে ঘটলো, শরচ্চন্দ্র দাশের জীবন ও অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে 'নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি', এই বইটির সাথে বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণ এককালে তিব্বত গিয়েছিলাম বলে স্নেহ করে হারুন ভাই বারবার বলেছিলেন বইয়ের ব্যাক-কভারে সামান্য কিছু লিখে দিতে। সেই কয়েক লাইন-
প্রতীক্ষিত বইটি প্রকাশ করেছে 'বাতিঘর'।


কালের কন্ঠ পত্রিকায় লিখেছে থাংলিয়ানা নিয়ে।




Wednesday, February 21, 2024

মানুষের অভয়ারণ্য

পৃথিবীতে বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলোর মানচিত্রের অনেকগুলো গল্প আছে। কিভাবে সেই মানচিত্রগুলো তৈরি হয়েছে সেই গল্পগুলো খুব বিচিত্র। কোন কোন মানচিত্রের গল্প খুব অদ্ভুত। অধিকাংশ সীমান্ত বিভাজন মর্মান্তিক যুদ্ধের পরিণতি। মানুষ যতই নিজেকে সুসভ্য বলে ঘোষণা করুক, সীমান্তের এই গল্পগুলোর মধ্যে মানবজাতির সবচেয়ে বড় অসভ্যতাগুলো লুকিয়ে আছে। অস্ত্রশক্তি আর রাজনৈতিক কুটকৌশলের খেলার মাধ্যমে জন্ম হওয়া রাষ্ট্রগুলো বর্তমান সময়ে সভ্য বলে স্বীকৃত হলেও সেই রাষ্ট্রের ভেতরের অনেক জাতির কাছেও মানচিত্রগুলোর সৃষ্টি চরম অবিবেচক একটা সিদ্ধান্ত। পৃথিবীর অল্প কিছু রাষ্ট্র বাদে বৃহৎ সব রাষ্ট্রের মানচিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভয়ানক সব অসভ্যতার ইতিবৃত্ত। কোন কোন অসভ্য মানচিত্র ছিঁড়ে কিছু দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও এখনো অসংখ্য পরাধীন জাতি এসব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে পিষ্ট হচ্ছে সভ্যতার ছাদের নীচে। একেকটা দেশে একেক রকমের বঞ্চনার গল্প।


কাছের দেশ হিসেবে সবার আগে ভারতের উদাহরণ দেই। পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে অনেকগুলো জাতির বসবাস। তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। সরলভাবে চিন্তা করলে ভারতের ভেতরে স্বাধীনতা পাওয়া যোগ্য রাজ্যের সংখ্যা কয়টি? মোটা দাগে বলতে গেলে ভারতের ভেতরে কমপক্ষে দশটি ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র উপযোগী রাজ্য আছে। অনেক জায়গাতেই ভারতের মূলধারার সংস্কৃতি ধারণ করে না তেমন কিছু জাতিকেও জোর করে ভারতের ভেতরে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেঁধে রাখা হয়েছে বলতে হচ্ছে কারণ সে রাজ্যগুলো নিজ থেকে ভারতের সাথে যুক্ত হয়নি। বৃটিশ শাসনের সময় থেকে তাদের জোর করে ভারতভুক্তি করা হয়েছে। যেমনভাবে সোভিয়েত আমলে মধ্য এশিয়ার অনেক রাজ্যকে সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে বন্দী করা হয়েছিল।


হিমালয় অধ্যুষিত এলাকার একটা জাতিও ভারতীয় নয়। বৃটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে মালিকানা না পেলে সেই রাজ্যগুলো কখনোই ভারতের অংশ হতো না। নেপাল ভূটান যে কারণে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, একই কারণে ভারতের ভেতরের সেই রাজ্যগুলোর অধিকার ছিল স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু অসভ্য রাজনীতির কুটনৈতিক চালের কারণে তা হয়নি। অসভ্য রাজনীতি পৈত্রিক উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া সম্পদের মতো রাজ্যগুলোকে ভোগ দখল করছে। রাজ্যগুলোকে যদি জনমত যাচাই করা হয় তবে নিশ্চয়ই তারা স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকতে চাইবে। কোন কোন রাজ্যে এসব নিয়ে অস্থিরতাও আছে। অরুনাচল থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত সমগ্র উত্তরাঞ্চলে একই চিত্রে। পূর্ব দিকে মনিপুর মেগালয় মিজোরাম নাগাল্যাণ্ডের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। ভারতের সঙ্গে এই রাজ্যগুলো নিতান্ত বাধ্য হয়ে যুক্ত আছে। দুশো বছর পর হয়তো এরা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হবে। দুশো বছর আগে পৃথিবীর যেসব জাতি পরাধীন ছিল, তাদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। একইভাবে তিব্বত চীনের অংশ হতে পারে না। পারে না জিনজিয়াং নামের উইঘুরদের দেশটাও। চীনের ভেতরে লুকিয়ে আছে এরকম অন্ততঃ আরো ডজনখানেক আলাদা জাতি। সোভিয়েত রাশিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া রাষ্ট্রগুলো আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। স্বাধীন রাষ্ট্র হবার যোগ্যতা সম্পন্ন জাতির সংখ্যা নেহাত কম নয়। দেশে দেশে তাদের অস্তিত্ব ছড়িয়ে আছে। সবগুলো জাতি যদি যদি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতো পৃথিবীতে স্বাধীন দেশের সংখ্যা পাঁচশো ছাড়িয়ে যেতো।


জগতের শক্তিমানেরা পৃথিবীর একশোভাগ ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে। এক ইঞ্চি মুক্ত জায়গা নেই কোথাও। সব মানুষকে কোন না কোন রাষ্ট্রে অধীনস্থ করা হয়েছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। পৃথিবীতে এমন অনেক আদিবাসী আছে তারা জানেও না কে তাদেরকে শাসন করছে। হয়তো শাসন করছে এমন কেউ যাদের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। হয়তো সেই জাতি উপজাতিগুলোর রাষ্ট্র, স্বাধীনতা, পতাকা, মানচিত্র এসবের কোন প্রয়োজন নেই। তবু সভ্যতার দোহাই দিয়ে তাদেরকে কোন না কোন রাষ্ট্র খোপে প্রবেশ করানো হয়েছে। মানুষ আধুনিক বলে বিবেচিত হবার পর থেকে এসব রাষ্ট্র সীমানার জন্ম। অথচ এসব সীমানার প্রশ্ন যখন ছিল না তখনও তাদের অস্তিত্ব ছিল। সীমান্ত থাকা না থাকায় তাদের কিছু এসে যায় না। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর সীমান্ত নেই। আদিযুগে হাজার হাজার বছর ধরে মানবজাতি এসব ছাড়াই পৃথিবীতে বেঁচে ছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এখন চাইলেই রাষ্ট্রবিহীন থাকতে পারবে না কোন জাতি। তাদেরকে কোন না কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকতেই হবে।


কিন্তু সব মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে কোন না কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকতে হবে কেন? আরো আশ্চর্য হলো এই প্রশ্নটা সাধারণভাবে আমাদের মনে জাগে না। আমরা মেনেই নিয়েছি মানুষের জীবনে এমন হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী এই আইনের আওতায় নেই। একটা পিঁপড়া কিংবা কাক কিংবা কুকুর বেড়ালকে নাগরিকত্ব নিয়ে কোন বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। অথচ মানুষকে নিরন্তর এই যন্ত্রনা পোহাতে হয়।


পৃথিবীতে কিছু মুক্ত দেশ মুক্ত অঞ্চল থাকা দরকার ছিল। যেখানে কোন রাজা থাকবে না, রাজনীতি থাকবে না, পাসপোর্ট থাকবে না, মানচিত্র থাকবে না, পতাকা থাকবে না। শুধু মানুষ থাকবে। স্বাধীন মানুষ। যে মানুষেরা স্বাধীনভাবে তাদের আদিম জীবনযাত্রা বজায় রাখতে পারবে। যে মানুষকে জোর করে আধুনিক সভ্যতার দীক্ষা গ্রহন করতে হবে না। যে মানুষকে অন্যের বানানো স্বর্গে সুখী হবার ভাণ করতে হবে না। যে মানুষ নিজস্ব আলয়ে একটি স্বাধীন বন্য প্রাণীর জীবন যাপন করবে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোন দেশ কোথাও নেই। পৃথিবীতে আর কোন জঙ্গল, পর্বতমালা কিংবা দ্বীপ নেই যেখানে সভ্যতার কদর্য পদক্ষেপ পড়েনি।


আমার চোখে আধুনিক মানুষের বানানো সভ্যতার সংজ্ঞায় মানুষদের জন্য প্রকৃতির দেয়া স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করার স্বাধীন কোন অঞ্চল না থাকা বড় রকমের মানবাধিকার লংঘন। এই মানবাধিকার লংঘনের কথা কেউ বলে না। অথচ প্রকৃত স্বাধীনতা হলো প্রকৃতির সন্তান হিসেবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকার অধিকার। পৃথিবীতে অন্য প্রাণীদের জন্য ছোটখাট অভয়ারণ্য থাকলেও মানুষের জন্য কোন অভয়ারণ্য নেই।


আধুনিক মানুষের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক এই সভ্যতার যাত্রা শুরু মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে। এটা হয়তো আর এক হাজার বছরও টিকবে না। টিকলে কী হবে কল্পনায় আসে না। তিনশো বছর আগে মানুষ প্রযুক্তির যে পর্যায়ে ছিল তাতে করে মানবজাতি আরো দশ হাজার বছর টিকতে পারতো। কিন্তু গত একশো বছরে মানুষ যেসব প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে তাতে স্বজাতিকে ধ্বংস করার মতো যথেষ্ট অস্ত্র মজুদ হয়ে গেছে, স্বজাতিকে চরম ঘেন্না করার নানান বিভক্তিও তৈরী হয়ে গেছে। এই মানসিকতার বহুধাবিভক্ত মানব জাতি আর এক হাজার বছর দূরে থাক দুশো বছর টিকবে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।


মাঝে মাঝে তাই মানুষের জন্য একটা অভয়ারণ্যের খুব প্রয়োজন অনুভব করি।

Tuesday, February 20, 2024

ধারাবাহিক গল্পচেষ্টাঃ হদিশ

১.

হাটের প্রবেশ পথেই মুড়িমুড়কিওয়ালারা সারি বেঁধে বসে থাকে। বাঁশের কঞ্চি বাঁধা ঝাঁকার ওপর রাশি রাশি গুড়ের মোয়া। জিবে জল আসার কথা থাকলেও পকেটের ১ পয়সার সীমিত বাজেটের কথা ভেবে সামলে নিল মিরাজ। এক হালি মোয়া ২ পয়সা। তার কমে বেচে না। অগত্যা ১ পয়সার মুড়ি শার্টের কোঁচড়ে নিয়ে কচমচ করে চিবোতে চিবোতে হাটের ভেতর ঢুকে গেল ভিড় ঠেলে। প্রথমে গেল বড় বটগাছটার নীচে। ওখানে বানরের খেলা চলছে। ডুগাডুগ ডুগাডুগ বাজনার তালে তালে বানর খেলা দেখাচ্ছে। চারপাশে লোকজন ভিড় করে মজা দেখছে।

প্রতি হাটবারে একটা না একটা মজার খেলা সাজিয়ে বসে এই বটগাছের তলায়। বিকেলের সোনা রোদ বট গাছের মাথায় উঠে গেছে। হেমন্তের বিকেলে সূর্যের তাপ মরে যায় আছরের পর পর। হাটে তখন বেসুমার ভিড়। মিরাজ মুড়ি চিবাতে চিবাতে বানরের নাচ দেখতে দেখতে প্রায় ভুলেই যাচ্ছিল তাকে এক সের গরু গোশত আর দুই সের আলু কিনে নিয়ে যেতে বলেছে মা।

ঘরে মা আর ৫ বছর বয়সী ছোট ভাই আফসার বাদে আর কেউ নাই। বাপ চাচা সবাই রেঙ্গুন ব্যবসা চাকরী কাজকারবার করে। সবাই স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছিল পরিবারে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর অভাবও শুরু। এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে খোদা মালুম। মিরাজদের কয়েক ঘর বাদে সমস্ত গ্রামে অভাবের হাহাকার। কিন্তু এই হাটবাজারে এলে অভাবের চেহারা বোঝা যায় না। হৈ হৈ রৈ রৈ করে সবাই কেনাকাটা করছে, গুলতানি আড্ডাবাজি করছে চা খানায়।

হঠাৎ সামনের এক দোকানে শফি চাচাকে দেখে সে একটু আড়ালে সরে দাড়ালো। লোকটার টেরা চোখে কেমন একটা বদ মতলব। 'ভাইফুত হণ্ডে যদ্দে' বলে যখন তার হাত চেপে ধরে, তখন ন বছর বয়সী বুকটা তার ভয়ে কেঁপে ওঠে। ভয় কিসের সে বোঝে না, কিন্তু অস্বস্তিটা টের পায়। কিছু মানুষের কথার মধ্যেই কিরকম বিশ্রী একটা সুর থাকে, চাহনীর মধ্যে শকুনের ছায়া। ভয়টা হয়তো অমূলক, হয়তো অন্য কিছু, হয়তো দেশে ভরসা দেবার মতো বাপ চাচা কেউ নেই বলে কিনা।

তাদের গাঁয়ে মাত্র আট ঘর। এর মধ্যে পাঁচ ঘরের পুরুষই রেঙ্গুন। অল্প কজন বৌ-ঝি ছাড়া বয়স্ক লোক বলতে আছে, ছেনুর বাপ, আধুইল্যার বাপ আর এই শফি চাচা।

শফি চাচার ভয়ে একটা বেড়ার আড়ালে লুকোতে গিয়ে পকেটে হাত ঢুকলে টের পেল জিনিসটা নেই। আবার খুঁজলো, নেই। কোথাও নেই। হাফপ্যান্টের দুই পকেটে নেই। শার্টের বুক পকেটে নেই। সামনের পথের ধুলোয় নেই, গাছতলায় নেই, মুড়িওয়ালা, চিড়াওয়ালা, তেলেভাজার দোকান, কোথাও নেই।

একটা রূপার আধুলি। চকচকে সুন্দর আধুলি। এই বয়সে অনেকে আধুলি হাতেও ধরেনি। সেই আধুলি নেই তো মাংস আলু কিছুই নেই। আধুলি নেই তো.......মায়ের কঠিন রাগী চেহারাটা মনে পড়লো। আজকে মা তাকে মেরেই ফেলবে।

বাবা টাকা পাঠায় না অনেকদিন। বার্মায় জোরেসোরে যুদ্ধ লাগার পর থেকে বাবার কোন খোঁজ খবরই নেই। বেঁচে আছে না মরে গেছে কেউ জানে না। শফি চাচা প্রায় প্রতিদিন উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে আফসোস করবে বুক চাপড়ে 'মরি গেইয়ুগুই, অ-বাজি রেঙ্গুনত বেয়াগগুন মরি গেইয়ুগুই'।

লোকটার আহাজারিতে শোকের চেয়ে উল্লাসের ভাগ যেন বেশী। সেই উল্লাসে কেমন একটা ভয় ডাক দেয়। এমনকি ছোট্ট আফসার পর্যন্ত ভাইয়ের পেছনে লুকিয়ে যায় আতংকে। মিরাজের মা গায়ের কাপড় ঠিক করে চট করে ভেতরের ঘরে চলে যায়। শফি চাচার তখন গ্লাস পানির তেষ্টা পায়।

'অ ভউজ, এক গলস ফানি হাবাইবা না?' মিরাজের মা একটা টিনের গ্লাসে পানি ঢেলে মিরাজের হাত দিয়ে পাঠায়।
===============

২.
আধুলি হারিয়ে মিরাজ দিশেহারা। এই অভাবের সংসারে একটা আধুলি হারানো প্রায় আত্মহত্যার শামিল। মিরাজের তা বোঝার মতো বয়স হয়েছে। বাজার না নিয়ে খালি হাতে ফিরবে কি করে। এখানে চেনাজানা অনেকে আছে, কিন্তু একটা আধুলি দেবার মতো ক্ষমতাবান কেউ নেই। শফি চাচার হয়তো আছে, কিন্তু ওই লোকটা কি যেন মতলবে ঘোরে। তার কাছে গেলে সে হাত চেপে ধরবে আবারো। অসহ্য!

কান্না পেয়ে গেল তার। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, সে কি করবে এখন? ঘরে ফেরা যাবে না। চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে কোথাও। কোথায় যাবে সে। হঠাৎ করে হাট থেকে বেরিয়ে ছুটতে শুরু করলো সে। ছুটতে ছুটতে মাইলখানেক ছোটার পর মহাসড়কের কাছে এল। নীরব সুনসান। একটা কিছু গাড়ি নেই সমস্ত রাস্তায়। মাঝে মাঝে মিলিটারি ট্রাকগুলো ধুলো উড়িয়ে ছুটে যায়। শুনেছে ওরা দোহাজারী যায়। বিলাতী সৈন্য বোঝাই ট্রাক। ওরকম একটা ট্রাকে চড়ে কোথাও হারিয়ে যেতে পারতো যদি? সে বসে পড়লো রাস্তার পাশের জমির আলে। ছুটতে ছুটতে গায়ে ঘাম দিয়েছে। শার্ট ভিজে গেছে বুকের কাছে।

মোতালেব জ্যাঠার গলা শুনে নড়ে বসলো মিরাজ। আবছা আঁধারে প্রথমে চিনতে পারেনি তাকে। চিনতে পারার পর আধুলি হারানোর ঘটনা খুলে বলে কেঁদে ফেললো সে। কাঁদতে কাঁদতে একটু মিথ্যেও যুক্ত করে দিল আলগোছে। তার মা আধুলি হারানোর পর মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এখন সে দুচোখ যেদিকে যায় চলে যাবে। মোতালেব জ্যাঠা পশ্চিম পাড়ার। লোকটা দয়ালু, কিন্তু একটু হুজুগে। তাকে পাড়ার লোক সমীহ করে কেননা দোহাজারীতে বড় সড় মুদী দোকান আছে। মিলিটারীদের চালডালও সাপ্লাই দেয় শোনা যায়। মিরাজের কাহিনী তাঁকে আপ্লুত করলো। তিনি বললেন, 'কাঁদিস না বেটা। আমি দোহাজারী যাবো, তুইও চল। ঘরবাড়ির গুল্লি মার। বেডা মানুষের এত নরম দিল হলে চলে না।'

যেই বলা সেই কাজ। কিছুক্ষণ পর একটা মিলিটারী জিপ এলো শহরের দিক থেকে। মোতালেব জ্যাঠা হাত দেখাতেই থামলো। মোতালেব জ্যাঠা খটমট ভাষায় কি যেন বলতে ওরা গাড়িতে তুলে নিল দুজনকেই। অন্ধকার চিরে জীপ ছুটে চললো দোহাজারীর দিকে। আগে কখনো এত দূর যায়নি মিরাজ। বড়জোর নানাবাড়ি কাঞ্চননগর পর্যন্ত। কাঞ্চন নগর মাত্র এক ঘন্টার হাঁটাপথ। দোহাজারী গাড়িতে এক ঘন্টার পথ। অনেক দূর। গাড়িতে অন্ধকার। যাত্রী সবাই সৈন্য। শুধু ওরা দুজন সাধারণ। সৈন্যদের দেখে গোরা সৈন্য মনে হচ্ছে না। আবার এদেশীও মনে হয় না। কি ভাষায় কথা বলছে বোঝা যাচ্ছে না।

[চলবে.....]

Monday, February 19, 2024

অনুবাদ বিষয়ক একটি জরুরী প্রশ্নের উত্তর

যারা আক্ষরিক অনুবাদ করতে গিয়ে সাহিত্যের বারোটা বাজিয়ে ফেলেন এবং অন্য ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় শব্দ সাজিয়ে অনুবাদ করেন তাদের জন্য নীচের প্রশ্নোত্তরটি খুব জরুরী এবং শিক্ষণীয়। আজকের পত্রিকায় ছাপানো খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের সাক্ষাতকার থেকে এই প্রশ্নোত্তরটি তুলে রাখলাম। 

আজকের পত্রিকা: ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে কোন সমস্যার মুখোমুখি হন? সমস্যাটা কী রকম?

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে যে সমস্যাগুলো হয় তা মূলত ভাষাগত। ইংরেজি সিনট্যাক্স যেহেতু বাংলার মতো নয়, সে জন্য ইংরেজির অনেক দীর্ঘ বাক্য বাংলায় আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। সর্বনাম বা ‘প্রোনাউন’ ব্যবহার করে ইংরেজিতে বড় বড় বাক্য রচনা করা যায়, কিন্তু বাংলায় তা অনুবাদ করতে গেলে দীর্ঘ বাক্য ভেঙে দুটো কি তিনটি বাক্যে লিখতে হয়। এ ছাড়া রয়েছে বাংলায় ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দের অভাব। বাংলার তুলনায় ইংরেজি সমৃদ্ধতর। ইংরেজিতে একটি শব্দে যা বোঝানো সম্ভব, বহু ক্ষেত্রে বাংলায় তা ব্যাখ্যা করে বলতে হয়।

এ ছাড়া একটি ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ, সংস্কার, বিশ্বাস-অবিশ্বাস ইত্যাদি বাংলা পাঠকের বোধগম্যতার কথা মাথায় রেখে অনুবাদ করতে হয়। লাখো ভাষার পাঠকের বোধগম্যতা নিশ্চিত করতে উৎস ভাষার সংস্কৃতির প্রতি সব সময় একনিষ্ঠ থাকা সম্ভব হয় না। যেকোনো ভাষার অনুবাদককে এই শ্যাম রাখি না কুল রাখির দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করেই কাজ করতে হয়।


https://www.ajkerpatrika.com/318978/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%87-%E0%A6%AE%E0%A7%8C%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B-%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AF?fbclid=IwAR0gxh3aI3t0x6kpEQVTg8p0Ez_Y1dB2jySzotz2pdpY7J3uXWswWuj2P88

Wednesday, February 14, 2024

'আছে' বনাম 'অধিকার'

১. আছে- অনুভব
‘আছে’- এই অনুভূতি খুব জরুরী। যাদের আছে তাদের জন্য যেমন, যাদের নেই তাদের জন্যও। যাদের যা আছে অনেক সময় তারা তা বুঝতে পারে না। অনুভব করে না। হারিয়ে যাবার পরেই মনে পড়ে, আমারও ছিল। যাদের এখন নেই, তাদেরও একসময় ছিল। যখন ছিল তখন অনুভব করেনি। চলে যাবার পর মনে পড়েছে, আমারও ছিল। কী ‘আছে’? তালিকার কোন সীমানা নেই। বস্তুগত এবং অবস্তুগত যে কোন ধরণের বিষয় হতে পারে। পরিবার, সম্পর্ক, জীবিকা, স্বচ্ছলতা, সম্পদ, সময়, সুবিধা, সুস্থতা, সৌন্দর্য যে কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আছে - এই অনুভূতির অভাবে প্রচুর মানুষ নিজেকে বঞ্চিত মনে করে। যা নেই, তা নিয়েই হাহাকার করতে থাকে। যা আছে, সেটার কাছ থেকে প্রাপ্য সুখের অংশ বুঝে নিতে পারে না। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ ‘আছে’ বিষয়ে সমান। ইলন মাস্ক থেকে কৃষক গণিমিয়া পর্যন্ত এই অনুভূতি নিয়ে একইরকম সুখ অনুভব করতে পারে। গনিমিয়া সাড়ে চার হাজার টাকায় একটা গরু বাছুর কিনে যতটা সুখী হয়েছে, ইলন মাস্ক বিলিয়ন ৪৪ বিলিয়ন ডলারে টুইটার কিনেও সেরকম সুখী হয়েছে। দুজনের অর্জনের অর্থমূল্য যোজন যোজন দূরত্ব থাকলেও অনুভূতির বিচারে দুজনের সুখ কারো চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আমাদের দেহে সুখের অনুভূতি বিলিয়ে দেয় যে পদার্থ, সেটা চার হাজার টাকার লেনদেনে যে পরিমাণ নির্গত হয়, চল্লিশ বিলিয়ন ডলার পেয়ে গেলে সেটা একশো গুন বেশি নির্গত হবার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং এখানে সম্পদের পার্থক্য যতই থাকুক, অনুভূতির পার্থক্য খুব বেশি হবে না। শুধু নিজেকে সেই অনুভূতির জন্য প্রস্তুত করতে জানতে হবে। অনেক কম থেকেও কখনো কখনো দেখা যাবে গনি মিয়া ইলন মাস্কের চেয়েও বেশি সুখী।

২. 'অধিকার' প্রয়োগের অধিকার
অধিকার থাকলেই সবসময় সেটা আদায় করতে হবে তেমন কোন কথা নেই। কড়ায় গণ্ডায় নিজের সব হিসেব বুঝে নেবার মধ্যে কোন মহত্ব নেই। অন্যের ক্ষতি করে নিজের ন্যায্য অধিকার বুঝে নেয়াটাও এক ধরণের অন্যায়। খুব প্রয়োজন না হলে নিজের সব অধিকার আদায় করা উচিত নয়। পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণী মূলত নিজের দেহটারই মালিক। নিজের দেহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর ওপর অধিকার হলো বাড়তি পাওনা। বাড়তি পাওনা আদায় করতে গিয়ে মানুষ সারা পৃথিবীতে অশান্তির সৃষ্টি করে।

৩. প্রয়োজন বনাম চাহিদা
প্রয়োজন এবং চাহিদা মানবজাতির সবচেয়ে ভারসাম্যহীন ব্যাপার। মানুষ বাদে অন্য সব প্রানী প্রয়োজন এবং চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্তু মানুষের চাহিদা সবসময় প্রয়োজনকে ছাড়িয়ে যায়। কতটুকু ছাড়াতে পারে তার কোন সীমা নেই। সেটা মহাবিশ্বের মতো অসীম। মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদার মধ্যে এই চরম ভারসাম্যহীনতা পৃথিবী জুড়ে কলহবিবাদের জন্ম দিয়েছে। মানুষ মনে করে প্রয়োজন শেষ হলে থেমে যাওয়া পরাজিত হবার লক্ষণ। অতএব বিজয়ী হবার মানসে চাহিদাকে এতটা প্রলম্বিত করে সেটা অন্যের প্রয়োজনকেও কেড়ে নিতে থাকে। এমনকি অন্যের প্রয়োজনকে নিজের চাহিদার পদতলে রাখাকে সাফল্য হিসেবে দেখা হয়। 

যার কাছে এক লাখ টাকা আছে তার প্রয়োজন এক কোটি হলে যৌক্তিক হতে পারে। কিন্তু যার একশো কোটি টাকা আছে, তার প্রয়োজন শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু সে তবু হাজার কোটি টাকার দিকে হাত বাড়ায়। হাজার কোটির চাহিদা বাড়তে বাড়তে লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও কেউ থামে না। অথচ মানুষ ভাল করেই জানে সে এক হাজার বছর বেঁচে থাকবে না। তার গড় আয়ু একশো বছরেরও কম। ৫০ বছরের পর থেকে তার ভোগের শক্তি কমতে শুরু করে। মানবজাতির এই নির্বুদ্ধিতা কেউ নিন্দার চোখে দেখে না। কারণ মানুষের দৃষ্টি এটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ প্রয়োজন আর চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য থাকলে পুরো পৃথিবী জুড়ে বিদ্যমান সমস্যার অধিকাংশই মিটে যেতো। আবুল হোসেনের জীবনের অন্যতম সাফল্য ছিল তিনি দীর্ঘ আড়াই দশক সর্বাঙ্গীনভাবে সুখী জীবন কাটাতে পেরেছিলেন। শুধু প্রয়োজনের ভেতর চাহিদাকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম বলেই এই সাফল্য এসেছিল।

Monday, February 5, 2024

বন্ধুতার সংকোচন

 বয়স হতে হতে মানুষের বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা কমতে থাকে। একসময় যারা ঘনিষ্ট ছিল তাদের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমার বন্ধুবান্ধবের পরিধি বেশ বড় হলেও নিয়মিত বন্ধুর সংখ্যা খুব সংকুচিত হয়ে গেছে। এই সংকোচনের প্রধান কারণ রুচির পার্থক্য। Common Interest বা সমান আগ্রহ বলতে যে জিনিসটা আছে সেটার খুব অভাব। অধিকাংশ বন্ধুবান্ধবের সাথে আমি আলাপ জমাতে পারি না এই পার্থক্যের কারণে। তাদের আগ্রহ টাকাপয়সা, ক্যারিয়ার, বৈষয়িক সম্পদ অথবা ধর্মকর্ম। অথচ আমার এই চারটি বিষয়ের একটিতেও আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ বইপত্র। বইপত্রে আগ্রহ আছে তেমন বন্ধু আমার খুব কম। লেখালেখিতেও আমার কোন বন্ধুবান্ধব নেই। যখন আড্ডায় বসি তখন আমার আলাপের বিষয় থাকে না। আমি চুপচাপ বসে থাকি বোরিং শ্রোতা হিসেবে। অতি ধার্মিক কিছু বন্ধুবান্ধব তো রীতিমত উৎপাতের মতো। তাদের্ উপস্থিতিই আমি সহ্য করতে পারি না। অথচ এরা একসময় কত আধুনিক প্রগতিশীল ছিল। কিন্তু এরা কেউ কেউ এমনসব অশিক্ষিত অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে মনে হয় এরা মাত্র গ্রামের মক্তব থেকে উঠে এসেছে। উচ্চশিক্ষিত বন্ধুবান্ধবের এই অধঃপতন দেখে খারাপ লাগে। কিন্তু যে যার রুচি নিয়ে জীবন কাটাবে তাতে আমার আপত্তি করার কিছু নেই। আমি শুধু এড়িয়ে থাকি। ফলে আমার আড্ডা দেবার মতো লোকের মধ্যে বাস্তবের বন্ধু খুব কম। তবু এর মধ্যে একটা সৌভাগ্য যে দুজন ঘনিষ্ট বন্ধু এখনো মোল্লাগিরির পথে হাঁটেনি। তাদের সাথে এখনো আগের মতো সময় কাটাতে পারি। ওই দুজনের কারণে আমি এখনো নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা পাই। তাদের একজন ভার্সিটির বন্ধু, আরেকজন স্কুল বন্ধু। এই আকালে সেই দুই বন্ধুর কাছে অনেক কৃতজ্ঞতা।