Tuesday, February 20, 2024

ধারাবাহিক গল্পচেষ্টাঃ হদিশ

১.

হাটের প্রবেশ পথেই মুড়িমুড়কিওয়ালারা সারি বেঁধে বসে থাকে। বাঁশের কঞ্চি বাঁধা ঝাঁকার ওপর রাশি রাশি গুড়ের মোয়া। জিবে জল আসার কথা থাকলেও পকেটের ১ পয়সার সীমিত বাজেটের কথা ভেবে সামলে নিল মিরাজ। এক হালি মোয়া ২ পয়সা। তার কমে বেচে না। অগত্যা ১ পয়সার মুড়ি শার্টের কোঁচড়ে নিয়ে কচমচ করে চিবোতে চিবোতে হাটের ভেতর ঢুকে গেল ভিড় ঠেলে। প্রথমে গেল বড় বটগাছটার নীচে। ওখানে বানরের খেলা চলছে। ডুগাডুগ ডুগাডুগ বাজনার তালে তালে বানর খেলা দেখাচ্ছে। চারপাশে লোকজন ভিড় করে মজা দেখছে।

প্রতি হাটবারে একটা না একটা মজার খেলা সাজিয়ে বসে এই বটগাছের তলায়। বিকেলের সোনা রোদ বট গাছের মাথায় উঠে গেছে। হেমন্তের বিকেলে সূর্যের তাপ মরে যায় আছরের পর পর। হাটে তখন বেসুমার ভিড়। মিরাজ মুড়ি চিবাতে চিবাতে বানরের নাচ দেখতে দেখতে প্রায় ভুলেই যাচ্ছিল তাকে এক সের গরু গোশত আর দুই সের আলু কিনে নিয়ে যেতে বলেছে মা।

ঘরে মা আর ৫ বছর বয়সী ছোট ভাই আফসার বাদে আর কেউ নাই। বাপ চাচা সবাই রেঙ্গুন ব্যবসা চাকরী কাজকারবার করে। সবাই স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছিল পরিবারে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর অভাবও শুরু। এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে খোদা মালুম। মিরাজদের কয়েক ঘর বাদে সমস্ত গ্রামে অভাবের হাহাকার। কিন্তু এই হাটবাজারে এলে অভাবের চেহারা বোঝা যায় না। হৈ হৈ রৈ রৈ করে সবাই কেনাকাটা করছে, গুলতানি আড্ডাবাজি করছে চা খানায়।

হঠাৎ সামনের এক দোকানে শফি চাচাকে দেখে সে একটু আড়ালে সরে দাড়ালো। লোকটার টেরা চোখে কেমন একটা বদ মতলব। 'ভাইফুত হণ্ডে যদ্দে' বলে যখন তার হাত চেপে ধরে, তখন ন বছর বয়সী বুকটা তার ভয়ে কেঁপে ওঠে। ভয় কিসের সে বোঝে না, কিন্তু অস্বস্তিটা টের পায়। কিছু মানুষের কথার মধ্যেই কিরকম বিশ্রী একটা সুর থাকে, চাহনীর মধ্যে শকুনের ছায়া। ভয়টা হয়তো অমূলক, হয়তো অন্য কিছু, হয়তো দেশে ভরসা দেবার মতো বাপ চাচা কেউ নেই বলে কিনা।

তাদের গাঁয়ে মাত্র আট ঘর। এর মধ্যে পাঁচ ঘরের পুরুষই রেঙ্গুন। অল্প কজন বৌ-ঝি ছাড়া বয়স্ক লোক বলতে আছে, ছেনুর বাপ, আধুইল্যার বাপ আর এই শফি চাচা।

শফি চাচার ভয়ে একটা বেড়ার আড়ালে লুকোতে গিয়ে পকেটে হাত ঢুকলে টের পেল জিনিসটা নেই। আবার খুঁজলো, নেই। কোথাও নেই। হাফপ্যান্টের দুই পকেটে নেই। শার্টের বুক পকেটে নেই। সামনের পথের ধুলোয় নেই, গাছতলায় নেই, মুড়িওয়ালা, চিড়াওয়ালা, তেলেভাজার দোকান, কোথাও নেই।

একটা রূপার আধুলি। চকচকে সুন্দর আধুলি। এই বয়সে অনেকে আধুলি হাতেও ধরেনি। সেই আধুলি নেই তো মাংস আলু কিছুই নেই। আধুলি নেই তো.......মায়ের কঠিন রাগী চেহারাটা মনে পড়লো। আজকে মা তাকে মেরেই ফেলবে।

বাবা টাকা পাঠায় না অনেকদিন। বার্মায় জোরেসোরে যুদ্ধ লাগার পর থেকে বাবার কোন খোঁজ খবরই নেই। বেঁচে আছে না মরে গেছে কেউ জানে না। শফি চাচা প্রায় প্রতিদিন উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে আফসোস করবে বুক চাপড়ে 'মরি গেইয়ুগুই, অ-বাজি রেঙ্গুনত বেয়াগগুন মরি গেইয়ুগুই'।

লোকটার আহাজারিতে শোকের চেয়ে উল্লাসের ভাগ যেন বেশী। সেই উল্লাসে কেমন একটা ভয় ডাক দেয়। এমনকি ছোট্ট আফসার পর্যন্ত ভাইয়ের পেছনে লুকিয়ে যায় আতংকে। মিরাজের মা গায়ের কাপড় ঠিক করে চট করে ভেতরের ঘরে চলে যায়। শফি চাচার তখন গ্লাস পানির তেষ্টা পায়।

'অ ভউজ, এক গলস ফানি হাবাইবা না?' মিরাজের মা একটা টিনের গ্লাসে পানি ঢেলে মিরাজের হাত দিয়ে পাঠায়।
===============

২.
আধুলি হারিয়ে মিরাজ দিশেহারা। এই অভাবের সংসারে একটা আধুলি হারানো প্রায় আত্মহত্যার শামিল। মিরাজের তা বোঝার মতো বয়স হয়েছে। বাজার না নিয়ে খালি হাতে ফিরবে কি করে। এখানে চেনাজানা অনেকে আছে, কিন্তু একটা আধুলি দেবার মতো ক্ষমতাবান কেউ নেই। শফি চাচার হয়তো আছে, কিন্তু ওই লোকটা কি যেন মতলবে ঘোরে। তার কাছে গেলে সে হাত চেপে ধরবে আবারো। অসহ্য!

কান্না পেয়ে গেল তার। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, সে কি করবে এখন? ঘরে ফেরা যাবে না। চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে কোথাও। কোথায় যাবে সে। হঠাৎ করে হাট থেকে বেরিয়ে ছুটতে শুরু করলো সে। ছুটতে ছুটতে মাইলখানেক ছোটার পর মহাসড়কের কাছে এল। নীরব সুনসান। একটা কিছু গাড়ি নেই সমস্ত রাস্তায়। মাঝে মাঝে মিলিটারি ট্রাকগুলো ধুলো উড়িয়ে ছুটে যায়। শুনেছে ওরা দোহাজারী যায়। বিলাতী সৈন্য বোঝাই ট্রাক। ওরকম একটা ট্রাকে চড়ে কোথাও হারিয়ে যেতে পারতো যদি? সে বসে পড়লো রাস্তার পাশের জমির আলে। ছুটতে ছুটতে গায়ে ঘাম দিয়েছে। শার্ট ভিজে গেছে বুকের কাছে।

মোতালেব জ্যাঠার গলা শুনে নড়ে বসলো মিরাজ। আবছা আঁধারে প্রথমে চিনতে পারেনি তাকে। চিনতে পারার পর আধুলি হারানোর ঘটনা খুলে বলে কেঁদে ফেললো সে। কাঁদতে কাঁদতে একটু মিথ্যেও যুক্ত করে দিল আলগোছে। তার মা আধুলি হারানোর পর মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এখন সে দুচোখ যেদিকে যায় চলে যাবে। মোতালেব জ্যাঠা পশ্চিম পাড়ার। লোকটা দয়ালু, কিন্তু একটু হুজুগে। তাকে পাড়ার লোক সমীহ করে কেননা দোহাজারীতে বড় সড় মুদী দোকান আছে। মিলিটারীদের চালডালও সাপ্লাই দেয় শোনা যায়। মিরাজের কাহিনী তাঁকে আপ্লুত করলো। তিনি বললেন, 'কাঁদিস না বেটা। আমি দোহাজারী যাবো, তুইও চল। ঘরবাড়ির গুল্লি মার। বেডা মানুষের এত নরম দিল হলে চলে না।'

যেই বলা সেই কাজ। কিছুক্ষণ পর একটা মিলিটারী জিপ এলো শহরের দিক থেকে। মোতালেব জ্যাঠা হাত দেখাতেই থামলো। মোতালেব জ্যাঠা খটমট ভাষায় কি যেন বলতে ওরা গাড়িতে তুলে নিল দুজনকেই। অন্ধকার চিরে জীপ ছুটে চললো দোহাজারীর দিকে। আগে কখনো এত দূর যায়নি মিরাজ। বড়জোর নানাবাড়ি কাঞ্চননগর পর্যন্ত। কাঞ্চন নগর মাত্র এক ঘন্টার হাঁটাপথ। দোহাজারী গাড়িতে এক ঘন্টার পথ। অনেক দূর। গাড়িতে অন্ধকার। যাত্রী সবাই সৈন্য। শুধু ওরা দুজন সাধারণ। সৈন্যদের দেখে গোরা সৈন্য মনে হচ্ছে না। আবার এদেশীও মনে হয় না। কি ভাষায় কথা বলছে বোঝা যাচ্ছে না।

[চলবে.....]

No comments: