Friday, October 30, 2015

মনে রাখতে যেন না ভুলি .......(জীবনানন্দ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু)

জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুবার্ষিকী চলে গেল মাত্র কয়েকদিন আগে। ইচ্ছে ছিল একটা লেখা তৈরী করবো তাঁকে নিয়ে। তাঁর জীবন ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আমার ভালো রকমের আগ্রহ আছে। কিন্তু ব্যক্তিগত কিছু ঝামেলার কারণে লেখা গোছাতে পারিনি। তাছাড়া এখনো পড়ার অনেক বাকী, তাই তাঁকে নিয়ে পড়াশোনা এখনো চলছে ফাঁকে ফাঁকে। পড়ছি প্রণব চৌধুরী সম্পাদিত 'জীবাননন্দ: জীবন ও সৃষ্টি'। ১৯৫৯ সালে কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে বুদ্ধদেব বসু থেকে শামসুর রাহমান পর্যন্ত অনেক কবি সাহিত্যিক তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করেছেন। ৮৮৬ পাতার বেশ স্বাস্থ্যবান বই, এক নাগাড়ে পড়ে শেষ করা কঠিন। তবে বইটিতে এমন দুর্লভ কিছু লেখা পেয়েছি জীবনানন্দ পরিবারের সদস্যদের, যা এতদিন ধরে খুঁজছিলাম। বইটার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় বইয়ের হাটকে, যাদের কাছ থেকে আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই সংগ্রহ করতে পেরেছি। জীবনানন্দ সংক্রান্ত তাবৎ বই আমি গোগ্রাসে গিলি। তাঁর কবিতা দুর্বোধ্য বলেই বোধহয় বারবার টানতে থাকে। তাঁর গল্প উপন্যাসগুলোর বেশ কিছুটা পড়া হয়ে গেছে যেখানে অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলে আবার অনেক প্রশ্ন আরো জটিল হয়ে জড়িয়ে যায়। জীবনানন্দের উপন্যাস যতটা না সাহিত্য তার চেয়ে বেশী তাঁর জীবনযাপনের একাংশের প্রতিফলন। তাঁর জীবনটাও দুর্বোধ্য, ফলে তাঁর জীবনের অমীমাংসিত ব্যাপারগুলোও খুব টানে। অনেকগুলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন পেছনে ফেলে জীবনানন্দ চলে গিয়েছিলেন। আরো অনেক যুগ সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবে তাঁর পাঠকেরা।

এই লেখার বিষয় কিন্তু বই আলোচনা নয়, ভিন্ন একটি বিষয়। বইটিতে বুদ্ধদেব বসুর লেখা পড়তে গিয়ে একটা অংশে চোখ আটকে গেল।

"....জীবনে যেখানে যেখানে সুন্দরের স্পর্শ পেয়েছি সেটা যেমন স্মরণযোগ্য, তেমনি যেখানে কুৎসিতের পরাকাষ্ঠা দেখেছি তা যেন দুর্বলের মতো মার্জনীয় মনে না করি। যেন মনে রাখি, মনে রাখতে যেন ভুলে না যাই....." [বুদ্ধদেব বসু, ১৯৫৫]

কথাটা খুবই সত্যি। আমি যাদের প্রতি কুৎসিত আচরণ করেছি তারা যেমন ভুলবে না, আমার প্রতি যারা কুৎসিত আচরণ করেছে আমিও তাদের কথা ভুলবো না। কিন্তু খুব আপন যাদের প্রতি অসদাচরণ করেছি, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেমন হবে। তাদের প্রতিও অনেক সময় কুৎসিত রাগ দেখিয়েছি। আসলে রাগ বা মেজাজ দেখানোর জন্য আমার বরাবর পছন্দের মানুষ হলো খুব কাছের বন্ধু বা পরিবারের সদস্য, তারাও নিশ্চয়ই মনে রাখবে। মনে মনে ঘৃণা করবে আজীবন। এটা একটা কনফেশন, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া শাস্তি সবকিছু অনিবার্য ছিল। মজার ব্যাপার হলো আমি রাগী মানুষ বলে সমাজে পরিচিত নই। কেননা আমার যা রাগ তাপ কোপ সব নিতান্তই আপনজনের সাথে সীমাবদ্ধ এবং আমার কন্যাটিই সবচেয়ে বেশী শিকার। তবু কী আশ্চর্য সে পরদিনই ভুলে যায় আগের দিন তাকে কিভাবে বকেছি। কন্যাটি ভুললেও বন্ধুটি ভুলে কিনা জানা হয় না, হবে না।

Thursday, October 29, 2015

অন্ধকারেরও আছে ঠিকানা......

সন্ধ্যে নেমে এসেছিল শহরে। আমরা কজন হাঁটছিলাম শহরের প্রান্তদেশে। সড়ক পথ শেষ হবার পর হাঁটাপথ। প্রথমে সারিবদ্ধ দোকানপাট। দোকানপাট ফেলে একটু পশ্চিমে যাবার পর একটা বেড়িবাঁধ উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছুঁয়ে। সেই বেড়িবাধের উপর একটা এক্সপ্রেসওয়ে। দ্রুতগামী যানবাহন ছুটে চলছে ব্যস্তসমস্ত হয়ে।

আমাদের তাড়া ছিল না। চলছিলাম হেলেদুলে। কোথায় যাবো জানতাম না। এই পথটা যেখানে শেষ সেখানে গিয়ে বসবো কোথাও। এক্সপ্রেসওয়ের  নীচ দিয়ে একটি সুরঙ্গপথ। সেই সুড়ঙ্গে পা দিতেই শব্দের আকার আকৃতি বদলে গেল। ধ্বনিপ্রতিধ্বনিতে মুখরিত। একটা শব্দ হলে তার তিনটে উত্তর আসে। গা ছমছমে ব্যাপার।

একজন বললো, সিগ্রেট দে। আরেকজন এগিয়ে দিল। সাথে ম্যাচিস। আগুন জ্বলে উঠলে দেখা গেল গুহার ভেতর জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। শুধু আমরা কজন।

পা চালিয়ে গুহা পেরিয়ে নুতন একটা জায়গায় গিয়ে পড়ি। অতি প্রাচীন একটা বাজার। অন্ধকারে থমথম করছে। মৃদু আলো জ্বলছে কুপির ভেতর। এই ভুতুড়ে বাজারে কারা আসে? বাজারে তো কোন পন্য নেই। মাছের আঁশটে গন্ধ বাজারজুড়ে। এবড়ো থেবড়ো পথ, যে কোন অসতর্ক মুহুর্তে পা পিছলে আলুর দম হয়ে যেতে পারে কেউ।

চারপাশ তাকিয়ে মনে হলো এটা কোন মৃত নগরী। কত বছর আগে মরে গেছে কেউ জানে না। নাহ, আরেকটু এগোতেই লোকজন দেখা গেল। মাছের ঝাঁকা নিয়ে বসে গেছে বেপারী। ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশী। কাছে গিয়ে দেখা গেল সব ইলিশ মাছ। সামনেই সমুদ্র, জেলেরা মাছ ধরে এখানে রেখে যায়। আবারো এবড়ো থেবড়ো পথে এগিয়ে চলা।

এই পথে মানুষ নেই। সূর্য ডুবে গেছে কবেই। তবু পশ্চিমাকাশে খানিক রং এখনো টিকে আছে। সমুদ্রের কাছে চলে যাই আমরা। কিন্তু সমুদ্র অনেক দূরে সরে গেছে। এখন ভাটার সময়। আমরা চাইলেও সমুদ্রকে পেতে পারি না। তবু সমু্দ্রের রেখে যাওয়া কাদামাটি আর বালিয়াড়িতে নেমে যাই আমরা। অদৃশ্য কাঁকড়া শামুক ঝিনুকের দলকে খুঁজি উদ্দেশ্যহীন।

সামনে তাকিয়ে আমাদের গল্প থেমে যায়। চারজনই চুপ করে গেলাম। কী অসাধারণ এক দৃশ্য, সমুদ্রের সৈকত জুড়ে মৌনতা মেশানো অপার্থিব এক সৌন্দর্য। অন্ধকারেরও আছে হৃদয়স্পর্শী আলোর ছটা। সমুদ্রের কাছে আসলেই আমার একজনের কথা মনে পড়ে যায়। এখানে আসলে আমি তাকেই খুঁজি। একদিন ছিল, এখন নেই। সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। পর্যাপ্ত জ্বালানীর অভাবে প্রদীপটা নিভে গেছে কেবল। জীবনটাও তো তাই। যখন প্রাচুর্য থাকে তখন মানুষটা জীবন্ত থাকে। যখন থাকে না তখন জীবন থেকেও নেই। আমরাও সেরকম। একসময় জীবনপ্রদীপের তেলও তো ফুরিয়ে যাবে। তাই বলে তো জীবনটা বিফলে গেলো না। সুদূর অতীতে যে জীবন ছিল তাও তো সত্যি। অন্ধকার হয়ে গেলেও দিনের আলোটা সত্যি। তাই অন্ধকারের প্রতি আমার একরকমের পক্ষপাতিত্ব আছে। আমি পশ্চিমাকাশের শেষ আভাটুকু দেখতে দেখতে ধোঁয়া ওড়াতে থাকি আপনমনে।

Life was a song
You came along
I lay awake the whole night through.........

Wednesday, October 28, 2015

আধঘন্টার গদ্য

পরের দিনগুলো আর আগের দিনের মতো হবে না। পরের দিনের সাথে আগের দিনের তুলনা হয় না। বহুবছর পেরিয়ে যাবার পর এই সত্যটা জেনেছি। আগের দিনের সাথে পরের দিন মেলাতে গেলেই কষ্ট। পৃথিবীতে শীত হেমন্ত বসন্ত বারবার ঘুরে ফিরে এলেও মানুষের জীবনের ঋতুগুলো কখনো ফেরে না। মানুষের জীবনে প্রতিটা ঋতুই ভিন্ন।  পাহাড়ের কিনারায় ঝর্ণা ঝরানো রেস্তোঁরাটি যেদিন মিশে গেল উন্নয়ন বুলডোজারে, সেদিন আবারো বুঝেছি এবার নতুন জীবন তার। পুরোনোকে সেখানে খুঁজতে যাওয়া বৃথা।

সময় ফুরিয়ে আসছে, আগে পরে একজনকে চলে যেতে হবে। যে লেখাটা অপ্রকাশিত থেকেছে, সেটা পাণ্ডুলিপিতেই থেকে যাবে। চলে যাবার পর কেউ যদি পুড়িয়ে ছাই করে দিতো! সৃষ্টিকে নিজের হাতে ধ্বংস করার বেদনা অসহ্য।

নতুন কিছু লিখতে গেলেও পুরোনো এসে আঁকড়ে ধরে, অপরাধী করে। পুরোনো খাতা ফেলে নতুন কোন খাতা খোলার সময় নেই আর।

মনস্তাত্ত্বিক বিচারে মানুষ এক অসাধারণ রকমের স্বার্থপর প্রাণী। আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিই মানুষকে স্বার্থপর করে তুলেছিল আদিম যুগে। সেই প্রবৃত্তির বীজ আধুনিক মানুষের রক্তে মিশে বিনা ওজরেও স্বার্থপরতার উদাহরণ সৃষ্টি করে।

এটুকু লিখতেই পেরিয়ে গেল দীর্ঘ আধঘন্টা। পৃথিবীর অনেক আধঘন্টা অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে। কোন কোন আধঘন্টায় ফলেছে সোনালী ফসল। এমন কতো আধঘন্টা কেটে যাবে কারো.......88

Thursday, October 22, 2015

পোড়াবাস্তব স্বপ্ন-১

যদি অনেক অনেক বেশী স্বপ্ন দেখা মানুষের তালিকা হয়, আমি সেই তালিকার উপরের দিকে থাকবো। তার মানে আমি খুব স্বপ্নবাজ মানুষ তা নয়। যে স্বপ্নের কথা বলছি সেটাও ইচ্ছেপুরণ স্বপ্ন নয়। এই স্বপ্ন নিতান্তই ঘুম ঘোরে দেখা অর্থহীন সব স্নায়বিক স্বপ্ন। ছেলেবেলা থেকেই প্রতিরাতে হাবিজাবি স্বপ্নে কেটে যেতো ঘুমের সময়। অধিকাংশ স্বপ্নই ছিল প্রচণ্ড রকমের ভীতিকর। কোন কোন স্বপ্নে দমবন্ধ হয়ে যেতো আমার, নিঃশ্বাস নেবার জন্য এক ফোঁটা বাতাস পেতাম না, মরে যাবার যে অভিজ্ঞতা আমাদের সুদূরলব্ধ, সেই অভিজ্ঞতা হয়তো আমি কোন কোন রাতে ঘুম ঘোরেই স্বপ্নবেশে পেয়ে গেছি। যৌবনের শেষ অবধি আমার স্বপ্নগুলো সব সেই রকমই। বাস্তবে সেই স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়ন ঘটেনি বলে এখনো টিকে আছি।

আজকাল দেখতে শুরু করেছি নতুন জাতের স্বপ্ন। আমি কোন নতুন শহরে গিয়েছি এবং পথ খুঁজে পাচ্ছি না। একের পর এক গাড়ি বদল করছি, নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছি, কিন্তু আমার ঠিক ঠিকানায় পৌঁছাতে পারছি না। আজ দুপুরেও সেরকম একটা স্বপ্নে অন্ধকার নেমে এসেছিল। সকাল থেকেই মাথাব্যথা পিনপিন করে জানান দিচ্ছিল, দুপুরের পর সেটা জ্বর জ্বর শীত শীত আবেশ নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। কেমন একটা ক্লান্তিতে ঘুম নেমে এলো, তারপরই শুরু হলো স্বপ্ন যাত্রা, বলা উচিত দুঃস্বপ্নের যাত্রা। আমি পথ হারিয়ে অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে অন্ধকার কোন দালানের প্রবেশপথে গিয়ে বসে আছি। সেই প্রাচীন দালান কিসের মনেও করতে পারছি না। কিন্তু সেখান থেকে বের হয়ে অদ্ভুত কিছু মানুষ অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখতে দেখতে পার হয়ে যাচ্ছে। আমি তাদের কাছে পথের হদিস জিজ্ঞেস করলে তারা জবাব না দিয়ে চলে গেল। এরপর আরো অনিশ্চয়তা নিয়ে আমি একটা গাড়ির অপেক্ষা করছি। বড় একটা সহৃদয় যাত্রীপূর্ণ বাস, যেখানে উঠে আমি পৌঁছে যাবো আমার চেনা কোন ঠিকানায়। আমি জানি আমি ঢাকা শহরের কাছে কোথাও আছি, কিন্তু কিছুতেই আমার ঢাকার চেনা এলাকায় পৌঁছাতে পারছি না। অবাক ব্যাপার আমি ঢাকার কোন জায়গার নামও মনে করতে পারছি না। সব নাম আমার স্মৃতিপ্রকোষ্ঠ থেকে হারিয়ে গেছে। কেমন অসহায়ের মতো আমি রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছি একা। কোথাও আলো নেই। অন্ধকার পরিত্যক্ত একটা শহর বা মফস্বল।  এখানে কোন মানুষ নেই কেন?

ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি সন্ধ্যে নেমে এসেছে আমার শহরে। আমি রীতিমত নিজের বাড়িতে, নিজের বিছানায়। মাথাটা তখনো ঝিমঝিম করছে, বাস্তবে ফিরে আসতে আসতে বুঝতে পারলাম, জ্বরের প্রেমময় স্পর্শ মস্তিষ্কের বাম কোনায় খোঁচা দিয়ে জানান দিচ্ছে।


Monday, October 19, 2015

কফি হাউসের সন্ধানে.........

নতুন জায়গায় গেলে বাঙালরে নাকি হাইকোর্ট দেখায়, কোলকাতার রিকশাওয়ালা দেখালো 'কফিহাউস'। নিউমার্কেটের সামনে এক রিকশাওয়ালার সাথে  কলেজ স্ট্রিট- কফি হাউসে যাবার ব্যাপারে আলাপ করছিলাম। অমনি পাশ থেকে আরেক রিকশাওয়ালা এসে আমাদের ছো মেরে টেনে নিয়ে বললো, আমি চিনি, কিন্তু আশি টাকা ভাড়া লাগবে। বললাম, ঠিকাছে চলো।
.
সে মাইল দেড়েক গিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে একটা দালানের সামনে নামিয়ে দিয়ে বললো, এটাই কফি হাউস। ভেতরে কফি বিক্রি হয়। আমার হাতের গুগল ম্যাপ বলছে জায়গাটা আরো বহুদূর। বললাম, এই জায়গা না, কফি হাউস তো আরো দূরে, কলেজ স্ট্রিটে, তুমি কলেজ স্ট্রিটে চলো। সে চোখ উল্টে বললো, আমি ওখানে যেতে পারবো না। আমার ভাড়া দিয়ে এখানেই নেমে যাও তোমরা। যদিও এক চতুর্থাংশ পথও যায়নি তবু আমি তাকে ৬০ টাকা দিলাম। কিন্তু সে ভাড়া প্রত্যাখান করে হুমকির সুরে বললো, পুরো আশি টাকাই দিতে হবে।
.
কথার ধরণে মেজাজ টং হয়ে গেল। বললাম, আয় বেটা এদিকে আয়। বলে একটা দোকানের কাছে গিয়ে দোকানীকে বললাম, দাদা নিউমার্কেট থেকে এই জায়গার ভাড়া কত? দোকানী বললো, বড়জোর ৫০ টাকা। আমি বললাম, এরে ৬০ টাকা দিছি তবু ব্যাটা বলে কম হয়েছে। তখন দোকানী রিকশাওয়ালাকে কঠিন ধাতানি দিয়ে বিদায় করলো।
.
আমরা হাঁটাপথ ধরলাম এবার। কিছুদূর গিয়ে সামনে একটা ছাত্রমতন তরুণকে পেয়ে জানতে চাইলাম, কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস কিভাবে যাবো। ছেলেটা বললো, সামনে গিয়ে বাসস্টপে দাঁড়ান, ট্রাম বাস যাই আসে উঠে যাবেন, সোজা কলেজ স্ট্রিট নামবেন, ওখানেই কফি হাউস। কী সহজ সমাধান!
.
ট্রামে চড়লাম, প্রথমবারের মতো। এই প্রাচীন বাহনটিতে চড়ার একটা সুযোগ খুঁজছিলাম, পেয়ে গেলাম। ভিড় নেই, সিট পেয়ে গেলাম। ট্রামে চড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে আলাদা পোস্ট দেয়া যাবে, এখন কফি হাউস যাই। ধীর লয়ে চলতে চলতে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে গেল ট্রাম। পাঁচ টাকা ভাড়া মিটিয়ে নেমেই দেখি প্রেসিডেন্সি কলেজ! আহ যেন এই কলেজে আমি কোন এক কালে পড়েছি, তেমন নস্টালজিক হয়ে গেলাম। কফি হাউজ খোঁজার আগে ঢুকে পড়লাম প্রেসিডেন্সিতে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তরুণ তরুণীরা তখনো আড্ডারত। এক কোনায় বসে পড়তে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সময় কম। কিছু সময় ঘুরাঘুরি করে, মোবাইল ক্যামেরার দুয়েকটা ক্লিক সেরে রাস্তা পার হয়ে আবারো কফি হাউজের খোঁজে।
.
যে দালানে কফি হাউস সেটি দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে ওটার ভেতর একটা রেস্তোঁরা থাকতে পারে। কফি হাউসের সামনে দাঁড়িয়েও সন্দেহমুক্ত হতে পারি না। চারপাশে শুধু বই আর বইয়ের দোকান। মাঝখানে একটা আধো অন্ধকার প্রবেশপথ। সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে যেতেই বুঝলাম ঠিক পথে আছি। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছেই দেখা গেল কাংখিত সাইনবোর্ড INDIAN COFFEE HOUSE।
.
অবশেষে চপ-কাটলেট খেয়ে, ধুমায়িত কফিতে চুমুক দিতে দিতে হারিয়ে ফেলা এক আড্ডার কথা ভাবতে ভাবতে এক ঘন্টা কাটিয়ে দিলাম। তারপর কফি হাউস থেকে বেরিয়ে ফিরতি ট্রামের অপেক্ষায় রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নীচে এসে দাঁড়ালাম। উল্টোদিকে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিশাল প্রবেশপথ। তার আলো আঁধারিতে তাকিয়ে মনে হলো সাদা পাঞ্জাবি ধুতি পরা জীবনানন্দের ছায়া যেন হেঁটে চলে গেল ভেতরে বাগানের সীমানা পেরিয়ে....

পাঁচ লাইন

কোলাহলপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দুপুর।
পাহাড় চেরা পথে ঘাসজঙ্গল মাড়িয়ে হেঁটে যাওয়া।
লাইব্রেরী ছায়ার স্বস্তিতে ফিরে টং দোকানের চা।
শাটল ট্রেনের জানালার পাশে মুখোমুখি আসন।
আটকে থাকা ঘাসবিচালির সযত্ন উৎপাটন।

[চবিতে একটি দুপুর]

Thursday, October 15, 2015

মিলিয়ে যাওয়া সুখের বিন্দুগুলো

১.


ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই চোখটা কচকচ করছে পানি দিলাম অনেকখানি তবু কমেনি চোখটা ডলতে ডলতে লাল হয়ে গেছে আরো ঘন্টা দুই ঘুমোতে পারলে পূর্ণ হতো চোখের বিশ্রাম  গতরাতে ঘুম হয়নি তেমন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম অদ্ভুত কিছু কষ্ট আর ভালোলাগা ঘুমকে বিলম্বিত করেছে কালরাতে একটু পড়াশোনা করছিলাম বারোটার দিকে বই বন্ধ করে শোবার জন্য আসলাম দেখলাম ওরা তিনজন ঘুমোচ্ছে শিহান আমার পাশে ঘুমোয় ঘন্টা দেড়েক আগে ওদেরকে শুতে বলে আমি বাতি নিবিয়ে ড্রইং রুমে চলে গিয়েছিলাম শিহান ওর খেলনা ল্যাপটপটা নিয়ে দুষ্টুমি করছিল বলে হালকা বকা দিয়ে বলেছিলাম, 'ঘুমোবার সময় এটা দরকার নাই টেবিলে রাখো ওটা এখন' আমি একটু জোরে কথা বললেও পছন্দ হয় না ওর কিন্তু প্রতিবাদ করে না তাই বোঝা যায় না রাগ করছে কিনা আমার কথা শুনে সে চুপচাপ ল্যাপটপটা টেবিলে রেখে শুয়ে পড়েছিল

 

এখন ফিরে এসে দেখি সবাই ঘুম আজ একটু গরম লাগছে সাধারণত ওশিন শিহানের যে কোন একজন দাদী বা ফুফুর সাথে থাকার জন্য জেদ করে প্রতিদিন তিন জন এক বিছানায়  ঠাসাঠাসি করে শুতে ভাল্লাগে না আমার তাই আমি আস্তে করে শিহানের পাশ থেকে বালিশটা নিয়ে আলগোছে দরোজা বন্ধ করে ড্রইং রুমের ডিভানে গিয়ে শুয়ে পড়লাম বাতি নিবিয়ে এখানে ঘুমোতে ভালোই লাগে আমার মাঝে মাঝে

 

কিন্তু কয়েক মিনিট পর অন্ধকারে একটা ছোট্ট একটা ছায়ামুর্তি দেখা গেল গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে ডিভানের কাছে কে এসেছে বুঝতে পেরে ঘুমের ভাণ করে চুপ করে পড়ে থাকলাম চোখ বুজে সে এসে ডাকলো, "বাবা বাবা, ওঠো, রুমে চলো, তুমি না থাকলে আমার ঘুম আসে না" এটা সত্যি ওকে রেখে কখনোই আমি অন্য ঘরে ঘুমোতে পারিনি আজ ভেবেছিলাম সে ঘুমিয়ে গেছে তাই চুপিসারে চলে এসেছিলাম ওর ডাকাডাকিতেও আমি মটকা মেরে পড়ে থাকলাম দেখি কি করে সে আমার চোখের পাতা খুলে দিল ছোট ছোট আঙুল দিয়ে, মুখে হাত দিয়ে ঠোট দুটো ফাক করলো আমার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা তবু আমি হাসি চেপে পড়ে থাকলাম আমার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে চলে গেল

 

খানিক পর আবারো ফিরে এলো এবার সোজা ডিভানে উঠে আমার পেটের উপর বসলো তারপর দুহাতে আমার গাল ধরে বললো, "আমি কিন্তু এখানে বসে থাকবো চলো তুমি নইলে আমি নামবো না" আমার খুব হাসি পাচ্ছিল ওর কাণ্ড দেখে তবু হাসি চেপে চুপ করে থাকলাম এবারো ব্যর্থ হয়ে চলে গেল

 

পাঁচ মিনিট পর ওর ছোট বালিশটা নিয়ে আবারো এলো বললো, "তুমি যদি না যাও, আমি এখানেই ঘুমাবো" বলেই পাশের সোফায় বালিশ দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো আমার খুব মায়া হচ্ছে বুঝতে পারছি এখানে ঘুমানো অসম্ভব তবু দেখি কতক্ষণ থাকে খানিক পর সে আর কোন কথা না বলে ছোট বালিশটা নিয়ে গুটিগুটি পায়ে চলে যায় বেডরুমের দিকে

 

এবার আমাকে উঠতেই হয় আমি রুমে গিয়ে দেখি শুয়ে পড়েছে আমার দিকে পেছন ফিরে আমি পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম আস্তে করে শুয়ে এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি এসেছি এদিকে ফিরো কিন্তু সে শক্ত হয়ে আছে কিছুতে ফিরবে না অনেক ডাকলাম, কিছুতে কিছু হয় না শরীরটা শক্ত করে রেখেছে বুঝতে পারলাম অভিমান করেছে জোর করে যখন আমার দিকে ফিরিয়ে আদর করলাম তখন আমার মুখটা সরিয়ে দিয়ে গাল ফুলিয়ে বললো, "দেখছো না আমার রাগ হয়েছে? অনেক রাগ! তোমার সাথে কথা বলবো না"

 

কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতর এত ভালোলাগা আর কষ্ট একসাথে হানা দিয়ে চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ওর এত মায়াকাড়া ভালোবাসা! এটাই প্রথম না, আরো ছোটকাল থেকেই এমন বাবার বুকে মুখটা গুঁজে ঘুমোবে শক্ত করে আকড়ে ধরে রাখবে ওকে নিয়ে আমারো ভীষণ প্রিয় অভ্যেস এটা কিন্তু আজ ভালোলাগার সাথে কেমন একটা কষ্টবোধ মাথার ভেতরে কেমন সব চিন্তা ভর করতে শুরু করলো আমি যদি হুট করে যে কোনদিন হারিয়ে যাই, এই পুচকাটা কী কষ্টই না পাবে সবকিছু হারাতে পারলেও ওকে হারিয়ে আমি কোথাও যেতে চাই না কিন্তু একদিন তো যেতে হবেই যাওয়াটা অনিবার্য তখন সে কী করবে, কার সাথে ঘুমোবে, কাকে খুঁজে আনবে ড্রইং রুম থেকে ওর পাশের বালিশটা চিরকালের জন্য খালি হয়ে যাবে? আমার ইচ্ছে করছিল ওকে জড়িয়ে নেই বুকের সাথে কিন্তু ওরও মাত্র ঘুম এসেছে হয়তো জাগাতে ইচ্ছে হলো না তারপর, তারপর থেকে অনেক রাত অবধি শুধু ওই কষ্টটাই জেগে থাকলো ঘুম পালিয়ে গেল দুচোখ থেকে যখনই একটু ঘুম আসে, আবার কেমন চমকে উঠে ভেঙ্গে যায় ঘুম ভেঙ্গে মনে হয় চলে যাবার ডাক এসেছে আসছে

 

আসবেই তো আয়ু কমতে কমতে একদিন ছোট্ট একটা বিন্দুতে এসে থেমে যাবে আমি যতবারই চোখ বন্ধ করছিলাম, ততবারই সেই বিন্দুটা এসে হাজির হচ্ছিল চোখের উপর চমকে চমকে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল তাই বারবার শেষমেষ কটার দিকে ঘুম এলো টেরই পেলাম না সকালে উঠেও চোখের জ্বালাপোড়া থেকে গেছে বুকের ভেতর দলাপাকানো কষ্ট

 

কোন কোন সুখের সময়ে এরকম বেদনাদায়ক ভাবনা কেন ভর করে?

[২০১৪]


২.

সুখের আয়ু খুব সীমিত আমাদের। যে মানুষগুলোকে ঘিরে আমাদের সুখ, সেই মানুষগুলো একদিন কোন না কোন কারণে দূরে মিলিয়ে যায়। যে সম্পর্কগুলো নিয়ে আমাদের প্রতিদিনের তৃপ্তি, সেই সম্পর্কের আয়ুও একদিন ফুরিয়ে আসে। যে মানুষগুলো আমাদের দেখে একসময় সুখী হতো, একদিন সেই মানুষগুলোই আমাদের দেখে বিরক্ত হয়। যে বন্ধুগুলোর সাথে একসময় প্রতিদিন দেখা হতো এখন তাদেরকে আর কোথাও খুঁজে পাই না। বয়স যখন অর্ধশতকের কাছাকাছি পথে চলে আসে তখন অনেক কিছুই জীবনের কাছ থেকে নির্বাসিত হয়ে যায়। মাত্র কবছর আগেও মনে হতো আমি কখনো বুড়ো হবো না, শরীর বুড়ো হলেও মনে মনে চিরতরুণ থেকে যাবো। আশ্চর্যজনকভাবে চল্লিশ পার হবার পরও কী করে যেন টিকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু পঞ্চাশের দিকে যেতে যেতে সে ধারণা বদলে গেল। আজকাল মানুষের আচরণ দেখেই বুঝে ফেলি, সময় শেষ হয়ে আসছে। সুখের বিন্দুগুলো ঘুরতে ঘুরতে বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলিয়ে যাবে সহসা। অনেক মানুষ আমাকে মুছে ফেলবে, আমিও অনেককে মুছে ফেলবো। একসময় এটাকেই স্বাভাবিক মনে হবে। একসময় এটাই জীবনের ধর্ম হয়ে যাবে। আমরা সেই কালের দিকে এগিয়ে চলছি। [২০১৫]