Monday, October 12, 2015

চট্টগ্রাম থেকে কোলকাতার পথে: বেনাপোল সীমান্ত

বাসটি যখন বাংলাদেশ সীমান্তের শেষ সড়কটি অতিক্রম করছিল তখন পুবাকাশে সূর্যটা উঠি উঠি। পথ কতটা বাকী দেখার জন্য জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়েই আটকে গেলো চোখ। ভোরের মৃদু আলোয় আশ্বিনের নবীন কুয়াশা কচি সবুজ ধানখেতের উপর তুষার শুভ্র রং ছড়িয়ে স্থির ভেসে আছে দূর দিগন্ত ব্যাপী। এত মসৃন সৌন্দর্য আমার চেনাজানা গ্রামের কোথাও দেখিনি এর আগে। বাংলার মুখ আমি যতখানি দেখিয়াছি যশোহরের সেই ভোরের সৌন্দর্য অতুলনীয়। শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষের ঘরবাড়ি, দোকানপাট সবকিছুতে একটা শৃংখলা, সুনিপুন রুচির ছাপ এখানে। আমার চেনাজানা বাংলাদেশের সাথে মেলাতে পারি না। প্রায় প্রতিটা বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি ফুলের বাগান। বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি- এটাই জীবনানন্দের সেই বাংলা। রবিঠাকুর বলে গেছেন শতবর্ষ আগে- দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া...। এই বাংলাতেই কত না দেখা অজানা সৌন্দর্য রয়ে গেছে।

অতঃপর যাত্রা সমাপন। বেনাপোল বর্ডার। এপারের দালাল ফন্দিবাজের চিপা এড়িয়ে কাস্টম ইমিগ্রেশান করিয়ে সীমান্ত পার হয়ে যখন জিরো পয়েন্টে তখন পৌনে নটা। রোদের তীব্রতা বাড়ছে। জিরো পয়েন্ট জায়গাটা একটা খোলা ময়দান। দুপাশে দুই দেশের সীমান্ত প্রহরী। মধ্যিখানে হাশরের ময়দানে অপেক্ষমান বিচারাধীন বান্দাগণ। ভারতগামী হাজারখানেক মানুষ জিলিপির প্যাচের মতো অসীম দীর্ঘ বাঁকাচোরা ঘুর্নিপাকের লাইনে দণ্ডায়মান। সীমাহীন সেই প্যাচের একটা লেজে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। লাইনের আগামাথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একই লাইন একই জায়গা দিয়ে পাঁচ ছয়বার ঘুরে গেছে। মাথার উপরে ঠা ঠা রোদ। যারা ভাগ্যবান তারা কিছুটা গাছের ছায়া পেয়েছে। পাঁচ-দশ-পনেরো মিনিট গিয়ে এক ঘন্টা পার হয়ে গেলো। তখনো লাইনে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি মনে হয়, যতটা এগোচ্ছি তাতে অগ্রগতি বোঝা যায় না। লাইন নড়ে কি নড়ে না। রোদের তাপে চাঁদি পুড়ে যাচ্ছে। সামনে কিসের ঝামেলা, কেন এত দেরী, কেউ জানে না। দূর থেকে দেখলাম ভারতীয় সীমান্তে ঢুকার যে পথ সেখানে অনেক সময় নিয়ে একেকজনকে ঢুকতে দিচ্ছে। ওটা ইমিগ্রেশানও না, কাস্টমও না। শুধু ঢুকার প্রবেশ পথ। সেই পথ পেরিয়ে কাস্টম আর ইমিগ্রেশানের অফিস। ওই গেটে ঢুকতে কেন এত সময় লাগবে বুঝতে পারছি না। যেন জেলখানার দাগী আসামীদের সাবধানে ঢোকানো হচ্ছে। কড়া ধমক চলছে খানিক পর পর। গরম বিরক্তি রাগ সবকিছুর মাত্রা চড়তে থাকে বেলা বাড়ার সাথে। সেই পৌনে নটায় লাইনে দাঁড়িয়েছি, এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। লাইন শেষ হয় না তবু। ঘেমে কয়েকবার গোসল হয়ে গেছে। চরম বিশৃংখল অবস্থা। এর মধ্যে আবার সুযোগ পেয়ে কিছু দালাল লাইনের জায়গা বেচাকেনা করছে, লাইন(কার)চুপি চলছে হরদম। যারা পরিবার নিয়ে, বয়স্ক মানুষ নিয়ে, নারী ও শিশুদের নিয়ে যাচ্ছে তাদের দুর্ভোগ বর্ননাতীত। চরম জঘন্য এক পরিস্থিতি। এরকম অবস্থাতেই মানুষের মাথায় খুন চেপে যায়।

ইচ্ছে করছিল পিছিয়ে গিয়ে ফিরতি পথ ধরি। নিখাদ বেড়াতে যাবার জন্য এতখানি ধকল সহ্য করার কোন মানে হয় না।  এতগুলো মানুষকে বৈধ ভিসা পাসপোর্ট কাগজ নিয়েও ঢুকতে ঝামেলা করছে ভারতীয় পক্ষ। যদিও ওই গেট দিয়ে ঢোকার পরেই ইমিগ্রেশান, কাস্টম, সিকিউরিটি চেক হবে। তারপর ভারতে প্রবেশ। জিরো পয়েন্টে দাড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি জীবনে আর কখনো ভারতে যাবো না, গেলেও এই অসভ্য প্রবেশ পথে আর না। যে দেশ ইমিগ্রেশানে ঢোকার আগেই এত বিশ্রী বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে ওই দেশে ঢোকার ইচ্ছে উবে যায়। জানি না ভারতীয়রা এরকম অসভ্যতা শুধু বাংলাদেশীদের সাথে করে নাকি বাকী সবদেশের সাথে করে। অথবা বেনাপোল(পেত্রাপোল) সীমান্তের চরিত্রই অমন।

অনেক ভোগান্তি পরিশ্রমের পর সাড়ে বারোটার দিকে সেই মহা কাংখিত গেট পার হয়ে ভারতীয় কাস্টমসে ঢুকার সুযোগ পেলাম। ধন্য করে দিল ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী, তাদের স্বর্গতূল্য দেশে প্রবেশ করতে দিয়ে। এরপর কাস্টমসে ঢোকার পথে শুরু কুলী বাহিনীর প্রতিপত্তি। কুলী বাহিনীর এই প্রতিপত্তি বাংলাদেশ অংশেও দেখেছিলাম। তবে এই অংশে পার্থক্য হলো কুলিহীন যাত্রীদের সাথে কাস্টম অফিসারের হৈ হুংকার এবং আর কুলিসহ যাত্রীদের সাথে কাস্টম অফিসারের এক্সট্রা খাতির, তারা লাইনে ওভারটেক করার অনুমতিপ্রাপ্ত। কুলিরা কাস্টম করিয়ে দেয়। কুলি-কাস্টমসের যৌথ বাণিজ্য সহজে বোধগম্য।

লোকজনের লাইনের ভিড় দেখে এক কাস্টম অফিসার পৈশাচিক উল্লাস, 'বাংলাদেশ থেকে তো সব লোক ভেগে চলে এলো!' অফিসার হারামজাদাকে একটা চটকানা দেবার ইচ্ছেটা দমন করলাম নিরুপায় হয়ে। আগেও নানান দেশের ইমিগ্রেশান কাস্টমসের বেড়া ডিঙিয়েছি, কিন্তু পেত্রাপোল বর্ডারের সেই কাস্টমস অফিসারের মতো অশ্লীল অভব্য আচরণ আর কোথাও দেখিনি।

অবশেষে বেলা দুটোর সময় ইমিগ্রেশান কাস্টম পেরিয়ে  ভারতে প্রবেশ। যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য আমার পূর্ব জন্মের এক নস্টালজিয়া কাজ করতো সবসময়, যেখানে প্রথম প্রবেশের আনন্দ রোমাঞ্চ এতদিন ধরে জমিয়ে রেখেছিলাম, ভারতীয় কতৃপক্ষের নির্দয় আতিথ্য সেটা বিলুপ্ত করে দিয়েছে। একটা নতুন দেশে প্রবেশের কোন অনুভুতিই হলো না।

দুটো সভ্য দেশের কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা করাতে এতটা সময়/শ্রম/বিরক্তি যুক্ত হবার কারণ হচ্ছে দেশ দুটি যথেষ্ট সভ্য হতে পারেনি এখনো। তাই খুব বিরক্তির সাথে  দুটো দেশকে উদ্দেশ্য করেই বলছি- 'বিশ্ব দরবারে তোমাদের রাষ্ট্রনায়করা যতই সভ্যতা বা উন্নয়ন নিয়ে বাকোয়াজি করুক, তোমরা এখনো যথেষ্ট বর্বর। তোমরা তোমাদের অর্ধশতক পুরোনো সামান্য দুটো সীমান্ত পোস্টকে ন্যূনতম সভ্যতার আলো দিতে পারোনি।'

তবু একটা কথা বলতে হয় যে ভারতের কাস্টমস/ইমিগ্রেশান অংশের তুলনায় বাংলাদেশ কাস্টমস ইমিগ্রেশান অংশ অনেকটা আলোকিত, সভ্য, আধুনিক। মানুষ এবং দালানকোটা উভয় ক্ষেত্রেই। দালানকোটার বিচারেও ভারতীয় কাস্টমস এলাকা আক্ষরিক অর্থেই গরুর খোয়াড়ের চেহারায়। স্থানে স্থানে বাঁশের কঞ্চির বেড়া দেখে গরু ছাগলের হাটের কথাই মনে করায় এবং ভেতরের অফিসারের পশুসুলভ আচরণ তার যথার্থতা প্রমাণ করে দেয়।




[পরবর্তী অংশ : কলকাতা, প্রথম মুগ্ধতা]

No comments: