Wednesday, January 29, 2014

অবিশ্বাসের বীজতলা

ফরহাদ ভাইকে প্রত্যাখ্যান করা আমার জন্য বেদনাদায়ক। কিন্তু না করে উপায় ছিল না। বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। তাছাড়া ফরহাদ ভাই আমার খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন।

আমাদের কোম্পানীতে চাকরী করতেন অনেক বছর আগে। এখান থেকে যাবার পর ভালো ভালো জায়গায় চাকরী বাকরী করে বেড়িয়েছেন, প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। ভালো আছেন বলে শুনেছি। গত পনের বছর কোন যোগাযোগই ছিল না।


পনের বছর পর হঠাৎ মাস দুয়েক আগে তিনি উদয় হলেন অফিসে। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। আমিও আপ্লুত হলাম। কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি এখন একটা নামকরা কোম্পানীর ডিরেক্টর। কার্ড দিলেন আমাকে। বললাম যোগাযোগ রাখতে। ফোন নাম্বার দিলাম। রাতে ডিনার করতে বললাম কোথাও বসে। কিন্তু তিনি খুব ব্যস্ত তাই পারবেন না। পরে কথা বলবেন এবং যাবার সময় জানাবেন বললেন। বললেন ঠিক, কিন্তু  চলে গেছেন কিছু না বলে। অবাক হলাম। আগে কখনো এমন করতেন না। এরপর আর কোন যোগাযোগই করলেন না। ভাবলাম ব্যস্ত মানুষ হয়তো। ওনার সম্পর্কে পনের বছর আগের বিশেষ একটা কথা মনে পড়তে গিয়েও পড়লো না।

দুমাস পর আজ দুপুরে কোনরকম হঠাৎ করে এসে হাজির আবারো। এসেই আমাদের পাঁচজনকে ডাকলেন। আমরা যারা তাঁর পুরোনো সহকর্মী। তিনি খুব বিপদে পড়েছেন। একটা কাজে পাঁচ লাখ টাকা লাগছে। সাড়ে চার লাখ যোগাড় হয়েছে। বাকী মাত্র পঞ্চাশ হাজার। একজনের পক্ষে হয়তো সম্ভব না তাই তিনি আমাদের পাঁচ জনের কাছে চাইতে এসেছেন। টাকাটা আজকেই লাগবে। নইলে তার খুব অসম্মান হয়ে যাবে।


আমরা ভাবনায় পড়লাম। এত টাকা হাতে নেই। মাসের শেষদিক এখন। ওনাকে বললাম একটু সময় দেন দুয়েকদিন। কিন্তু ওনার হাতে সময় নেই। এখুনি দিতে হবে। কালকে দিলেও হবে না। কিন্তু কেউ পকেটে করে অত টাকা নিয়ে ঘোরে না। মাসের বিশ তারিখ পার হবার পর হাত এমনিতে টানাটানিতে থাকে। তবু কোথাও থেকে ধার করে দেয়া যায় কি?


ভাবছিলাম আমি। ভাবছিল অন্যরাও। আমরা সবাই ফরহাদ ভাইকে পছন্দ করি। ওনার ব্যক্তিত্বই সেরকম আকর্ষণীয়। দশ মিনিটের কথা দিয়ে তিনি দশ বছরের মতো ঘনিষ্টতা তৈরী করে ফেলতে পারেন। কিন্তু সেই ফরহাদ ভাইকে সাহায্য করতে আমাদের সবার কেমন একটু দ্বিধা যেন। পকেট সামর্থ্য না থাকলেও ধার করে কি দিতে পারি না? তিনিও তার ইঙ্গিত দিলেন। কারো কাছ থেকে ধার করে দাও। 

এবার মনে হয় সবারই মনে পড়ে গেল ফরহাদ ভাই সম্পর্কে পনের বছর আগের ধারণাটা। 


প্রথম ঘটনাটা আমাদের সাথে তার প্রথম পরিচয়ের দু'বছরের মধ্যে।  আমাদের অফিসে যোগ দেবার পরপর জানতে পারি তাঁর স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তাঁর পাঁচ বছর বয়সী কন্যাটি ঢাকায় নানাবাড়িতে থাকে। তিনি স্ত্রীর শোকে ঢাকা শহর ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে এসেছেন। বউয়ের স্মৃতিগুলো তাঁকে খুব বেদনার্ত করে বলে ঢাকা তাঁর সহ্য হয় না।

শুনে আমরাও খুব ব্যথিত হয়েছিলাম। সহমর্মী হয়ে তাকে নিয়মিত সঙ্গ দিতাম। তিনি মৃত স্ত্রীর স্মৃতিচারণ করতে পছন্দ করতেন। তাদের মধ্যে কতটা প্রেম ছিল, কতটা ভালোবাসা ছিল, কতটা কেয়ার নিত তাঁকে সেসব বলতেন আমাদের। ওরকম একটা কেয়ারিং সংসারের জন্য আমাদের খুব লোভ হতো। আমরা কেউ তখন বিয়ে করিনি। 


কিছুদিন পর তিনি চাকরী ছেড়ে চলে গেলেন। নতুন জায়গায় বাসা নিলেন। তবু আমাদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল ওনার আন্তরিকতার কারণে। একদিন আমরা ফরহাদ ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গেলাম। গিয়ে দেখি ব্যাপক খানাপিনার আয়োজন। বললেন, ওনার কন্যা ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে, সেই উপলক্ষে খাওয়াদাওয়া।

আমরা তাঁর ফুটফুটে কন্যা সঞ্চিতাকে দেখে মুগ্ধ। কী সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটা!  

কিন্তু আমাদের মুগ্ধতাকে ছাড়িয়ে ভেতরের ঘর থেকে নিঃশব্দে যে মুর্তিমান বিস্ময়টি উপস্থিত হলেন, তিনি সঞ্চিতার মা, ফরহাদ ভাইয়ের স্ত্রী।  

ফরহাদ ভাই আজব মানুষ। একটুও বিব্রতবোধ না করে বললেন, এই হলো আমার স্ত্রী অপলা, সঞ্চিতার মা, যার কথা শুনেছো তোমরা। ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে আজ।


আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে না পড়লেও বিস্ময়ে থ হয়ে গিয়েছিলাম কয়েক মিনিট।  যথাসম্ভব বিস্ময় চেপে রেখে পরিচিত হলাম ভাবীর সাথে। মৃত মানুষ কিভাবে জীবিত হলো সেই প্রশ্নটা মাথায় ঠোক্কর খেতে খেতেই সৌজন্য বিনিময় শেষ হলো।  ভাবী ভেতরে চলে গেলে ফরহাদ ভাই বললেন, অপলা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ছিল দীর্ঘকাল। পঙ্গুত্বের হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে। এখনো ধকল কাটিয়ে ওঠেনি।

আমরা কিছুতে কোন হিসেব মেলাতে পারলাম না। এসবের মানে কি? নিজের স্ত্রীকে নিয়ে কেন এই মিথ্যে। আমাদেরকে আসল কথাটা আগে বললে কি সমস্যা ছিল? কিন্তু কোন ব্যাখ্যা নেই। আমরাও ওনাকে বিব্রত করি না।


কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় তিনি হঠাৎ বিপদে পড়ে আমার কাছে এলেন। বললেন কিছু টাকা লাগবে। আমার কাছে বেশী টাকা ছিল না। দেড় হাজার টাকা দিলাম। কিন্তু এরকম 'হঠাৎ বিপদ' ওনার প্রায়ই হতে থাকলো। অন্যন্য কলিগের কাছ থেকেও তিনি টাকাকড়ি ধার করতে থাকলেন।  যেহেতু উনি নিজেও মানুষের আপদ বিপদে সাহায্য করেন, তাই ওনার এসব হঠাৎ বিপদে আমরা টাকা পয়সা দিতে দ্বিধা করতাম না।  কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।

আরেকবার বিপদের স্কেল বাড়িয়ে এক সিনিয়র কলিগের বিশ হাজার টাকা নিলেন দুদিনে ফেরত দেবেন বলে। দুদিনের কথা বলে নিলেও দুমাসেও দেবার নাম নেই। ছমাসে অনেক ঝামেলা করে অর্ধেক উদ্ধার করতে পেরেছিল সেই কলিগ। কিছুদিন পর ফরহাদ ভাই চট্টগ্রাম থেকে পাট চুকিয়ে ঢাকায় চলে যান। কেউ ঠিকানা জানতো না।


আজ এত বছর পর আবারো ওনার 'হঠাৎ বিপদ। এই বিপদ আসল কি নকল জানার কি উপায় আছে কারো? ওনার ঠিকানাও কেউ জানি না।

আগেই বলেছি ফরহাদ ভাইয়ের এমন একটা ব্যক্তিত্ব আছে, যার ফলে ওনার দোষ ত্রুটি জানা সত্ত্বেও ওনাকে খুব বেশী অপছন্দ করতে পারেনা কেউ। দেখা যায় অনেক দোষই আমরা লঘু চোখে দেখি। ফলে জিতে যায় পছন্দ। পছন্দ করি ঠিক কিন্তু বিশ্বাসটা করতেই দ্বিধা। 

সবশেষে পছন্দ আর অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে ফরহাদ ভাইকে আমরা বিনয়ের সাথে অক্ষমতা জানিয়ে দিলাম। বিমর্ষমুখে ফরহাদ ভাই চলে গেলেন। 

ফরহাদ ভাই চলে যাবার পর আমরা পাঁচজন বসলাম।

যুক্তিগুলো আমরা এভাবেই সাজালাম। এখানে আসার আগে উনি আগে একটা ফোনও করলেন না। সরাসরি এসে টাকা চেয়ে বসলেন। এ কেমন কথা?  তাছাড়া আমাদের মতো চাকরীজীবিদের হাতে এত টাকা নগদে থাকে না এটা উনি জানেন না বলেও অবাক লাগলো। এমনকি ঢাকা থেকে ছুটে আসার আগে একটা টেলিফোনও করেননি উনি এরকম একটা বিপদে পড়েছেন। ঢাকা থেকে আমাদের কাছে ছুটে এসেছেন শুধু এই টাকার জন্য? কেমন যেন হিসেব মিলছে না।

আসলে পনের বছর আগের অবিশ্বাসের বীজটা এতদিন সুপ্ত ছিল। আজ তার এই নতুন বিপদ যেন সেই অবিশ্বাসের বীজের অংকুরোদগোম ঘটাতে শুরু করলো। 

ফিরিয়ে দেবার পর আমার একটু কষ্টবোধ হতে থাকে, ঘটনা যদি সত্যি হয়? যদি সত্যিই বিপদে পড়ে থাকেন?
আমি ফরহাদ ভাইয়ের কার্ড খুজে বের করি, মোবাইল নম্বরটা দেখে দেখে ডায়াল করি। যান্ত্রিক একটা কন্ঠ তখন ওই প্রান্ত থেকে জানান দিল - 'এই নম্বরটি বর্তমানে আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। অনুগ্রহপূর্বক.....।'
ফোন নম্বরটিও কি ভুল দিলেন?

Tuesday, January 28, 2014

পোশাকী আলাপ

আমার একটা ফ্যাশন ভাবনা আছে। না, আমি ফ্যাশন বিষয়ে বোদ্ধা কেউ নই। ফ্যাশন আমার কাছে অতি দূরবর্তী বিষয়। আমি এমনকি এখনো ঠিকভাবে জানি না শব্দটা 'ফ্যাশান' নাকি 'ফ্যাশন'। আমি ফ্যাশনই লিখছি। আমার ফ্যাশন ভাবনা হলো মানুষের পোষাক আশাকের ধরণ। কেন মানুষ একেকসময় একেক রকম ফ্যাশন পাল্টায়। আমি নিজেও মাঝে মাঝে বদলাই। আমার বদলানো হলো কদিন টিশার্টে আসক্তি আবার কদিন ফতুয়ায় আসক্ত থাকা। কদিন কটন প্যান্ট পরতে থাকি, কিছুদিন ফরমাল প্যান্ট। কিছুদিন স্যু কিছুদিন কেডস দাবড়াই। এটাকে তেমন উল্লেখযোগ্য বলা যায় না।

আসলে আমি ঠিক চলতি হাওয়ার পন্থী নই। বরং উল্টো। বাজারে চলতি ডিজাইনের কোন পোষাক আমি পরি না। দুনিয়াতে যে রীতিই আসুক, আমি আমার ডিজাইনে থেকে যাই। আমার ডিজাইন হলো খুবই সরল। যদি শার্ট হয় তবে হাফ ফুল যেটাই হোক, বামপাশে একটা সাধারন পকেট, দুপাশে দু ইঞ্চি সাইজের দুখানা কলার, মাঝখানে পাঁচখানা সাদামাটা বোতাম। ব্যস। আমার এই শার্টের ডিজাইন চলছে গত ৩২ বছর ধরে। এর আগের কথা খুব বেশী মনে নেই, তাই বলতে পারছি না।

প্যান্টের ক্ষেত্রে দুপাশে দুটো পকেট, পেছনে দুটো ব্যাক পকেট, নীচের ঘের ১৭-১৮ ইঞ্চি। ব্যস। আর কোন ডিজাইন নাই। চলতি হাওয়া ঢোলা চিপা টাইট ফুলা ফোল্ডিং, কত জাতের ফ্যাশন আমদানী করেছে তার ইয়ত্তা নেই, কিন্তু আমি দিব্যি চোখ বন্ধ করে আমার নিজের ডিজাইনেই থেকে গেছি। ফলে একটা লাভ হয়েছে। চলতি ফ্যাশন ঘুরে ফিরে আমার লাইনেই চলে আসে। বুঝে গেলাম আমি ইউনিভার্সাল ডিজাইনই বেছে নিয়েছি। এই ডিজাইনে আমার দাদাকে দেখেছি, বাবাকেও, এখন আমি নিজেও। সুতরাং এখান থেকে নড়াচড়া করার কোন দরকার নেই।


আর্থিক অবস্থার সাথে পোষাক আশাকের পরিবর্তন ঘটবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। গরীব মানুষ ছেড়া লুঙ্গি আর ফুটো গেঞ্জি গায়ে ঘুরবে, আর বড়লোক স্যুটেড বুটেড হয়ে গাড়ি হাঁকাবে এটাই জগতের নিয়ম।

আমি গরীবও নই আবার বড়লোকও নই। মাঝামাঝিতে থাকলে সুবিধাও আছে মুশকিলও আছে। মুশকিল হলো বড়লোকদের সাথে তাল মেলানো। সুবিধা হলো গরীবি হালে থাকা। আমি তাই মুশকিলের চেয়ে সুবিধাটাই উপভোগ করি। বড়লোকী দোকান এড়িয়ে চলি। গরীবের মার্কেটে গিয়ে রুচিশীল জিনিস পছন্দ করি। পরিবারের সকলে চায় আমি আরেকটু দামী জিনিসপত্র কিনি। ব্র্যাণ্ডের জিনিস পরি। আমি নিজে সেটা করি না বলে সুযোগ পেলেই ওরা আমার জন্য দামী পোষাক আশাক কিনে উপহার দেয়। আমি তার শোধ নেবার জন্য মাঝে মধ্যে ওদের একটা শার্টের দাম দিয়ে সস্তা মার্কেট থেকে তিনটা শার্ট কিনে আনি। এরকম করতে গিয়ে দেখা যায় আমার পোষাক আশাকের পরিমাণ এত বেড়ে গেছে রাখার জায়গা নেই। ফলে প্রতি বছর আমাকে ডজখানেক ভালো জামাকাপড় বাতিল করতে হচ্ছে।


আমার মতে একটা মানুষের তিনটা শার্ট তিনটা প্যান্ট থাকলেই যথেষ্ট। ছাত্রজীবনে আমি ওই সংখ্যাটা খুব মেনে চলতাম। আমার কখনোই এর চেয়ে বেশী জামাকাপড় থাকতো না। এর বাইরে সবসময় পরার জন্য দুয়েকটা টিশার্ট বা কটন প্যান্ট থাকতো। ও হ্যাঁ এক খানা লুঙ্গিও থাকতো বটে।

আমি তেমন লুঙ্গি পরিনা কখনোই। ওটা কেবল পোষাক পাল্টানোর কাজেই ব্যবহার করি। লুঙ্গি পরে আমি কোনদিন ঘরের বের হয়েছি মনে পড়ে না। অথচ দেদারসে পরছে লোকজন, হাটে বাজারে ঘুরছে। আমি জানি লুঙ্গি খুব আরামদায়ক জিনিস। বিশেষ করে গরমকালে। কিন্তু ওই জিনিস আমার কাছে রিস্কি মনে হয়। আমি তাই প্যান্ট/ট্রাউজার পরেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি। ঘুমোবার জন্য ট্রাউজারই পছন্দ আমার।

বলছিলাম তিনটা শার্ট প্যান্ট থাকলেই যথেষ্ট। যখন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন আমি ছাত্র এবং বেকার। টিউশানিও করিনি কোনদিন। সুতরাং টাকাপয়সার জন্য ১০০% নির্ভরশীলতা বাবার উপরেই।

বাবা আবার ফ্যাশনবাজ লোক ছিলেন। আদিকাল থেকেই স্যুটেট বুটেড লোক হিসেবে দেখে এসেছি। পটিয়ার এক  প্রাচীন লোক একবার আমার সাথে পরিচিত হয়ে বলেছিল, পাকিস্তান আমলে পটিয়ার প্রথম টাই পরা লোক তোমার বাবা।  কথাটা আমার কাছে অতিরঞ্জিত মনে হলেও অবিশ্বাস করার কিছু নেই। কারণ একদম ছেলেবেলাতেই দেখেছি বাবার অগণিত টাই সম্রাজ্য।


সেই বাবা সাম্রাজ্য হারাবার পর কোন এক বছর ঈদে আমাদের জামাকাপড়ের টাকা দিতে পারছিলেন না। আমার বন্ধুরা তখন আড়ং থেকে পাঞ্জাবী কিনে পরছে। আমি তাদের কেনাকাটার সঙ্গি হয়ে নামী দামী দোকানে যাই কিন্তু কিছু কেনার কথা ভাবি না।  আমি জানি ওটা আমার কাপ অব টি নয়।

ভার্সিটি পড়ি তখন, বাবার দুঃখ দুর্দশা বুঝি। তবু একবার ঈদের সময় আড়ং এ গিয়ে বন্ধুর জন্য পাঞ্জাবি দেখতে গিয়ে খুব সাধারণ সুতীর একটা পাঞ্জাবীর উপর চোখ আটকে যায়। ঘিয়ে রঙের পাতলা সুতীর পাঞ্জাবীটায় কোন কারুকাজ ছিল না। একদম সাদামাটা। দামটাও যেন আমার সাথে মানানসই। ১৯৫ টাকা মাত্র। কিন্তু তখন ওই টাকাও আমার সামর্থ্যের বাইরে।

আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে বেরিয়ে আসি। এ বছর ঈদে বাবা কোন টাকা দিতে পারবেন না আমাদের জামাকাপড় বাবদ। আগামীকালই ঈদ। জামাকাপড় দূরে থাক, এমনকি খাবারদাবার কি রান্না হবে তাও জানি না। অবশ্য ওটা জানারও দরকার হয় না। মা ঠিক কিছু একটা বের করে ফেলে উপায়। তিনদিন বাজার না হলে রান্নার চুলা খালি যায় না মায়ের।

মায়ের যাদুর কাঠিতে আমরা তীব্র অভাবের দিনেও কখনো খাদ্য সংকটে ভুগিনি। আমাদের কয়েকটা কলাগাছ ছিল বাসার লাগোয়া। তার মধ্যে একটা আনাজি কলা বা কাঁচ কলা। ওই একটা গাছ থেকে মা যে কত রকমের খাবার বের করেছেন এখন অবাক হয়ে যাই। কলা তো আছেই তার উপর কলার থোড়, কলাগাছের ভেতরের নরোম শাঁস ইত্যাদি আইটেমের নানা উপাদেয় খাবার রান্না হতো।

বাসার সামনে একটা বাগান ছিল। ওখানে নানান জাতের কচু ঘেচু শাকের জঙ্গল ছিল। শহরে ওসব খাবার বিরল। মা ওখান থেকেই কত রকমের মজাদার খাবার আবিষ্কার করতেন। আমাদের সেই বাড়িটা ছিল শহরের মধ্যে ছোট্ট একটা গ্রাম।


বলছিলাম পাঞ্জাবির কথা। সেই পাঞ্জাবির জন্য মন খারাপ করে বাসায় ফিরে  ভাত খেয়ে ঘুম দেই সব ভুলে। বিকেলে ঘুম ভাঙতে দেখি মা রুমে এসে দুটো একশো টাকার নোট দিয়ে বললো, তোর ঈদের পাঞ্জাবি কিনে আন গিয়ে। সময় তো বেশী নেই।


আমি অবাক হয়ে যাই। মাকে বলিনি সেই পাঞ্জাবির কথা। কিন্তু কিভাবে যেন যাদু বলে জেনে গেছে মা।

সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে আড়ং এর শো রুমে চলে গেলাম। আড়ং তখন চৌমুহনী ফারুক চেম্বারের এক তলায়। ওখানে দুরু দুরু বুকে ঢুকে সেই পাঞ্জাবীর কাছে যাই। লোকজনের খুব ভিড়। ঈদের আগে শেষ কেনাকাটা। যে যা পারছে কিনে নিচ্ছে। পাঞ্জাবিটা আছে কিনা সন্দেহ।

কিন্তু ওই র‍্যাকের কাছে গিয়ে দেখি, আছে। কেউ নেয়নি। আসলে এটা বড়লোকদের জায়গা। কিন্তু ওই পাঞ্জাবি সবচেয়ে সস্তা, ঈদের সময় ওরকম পাঞ্জাবি কেনার কথা কেউ ভাবে না। আমার পকেটে দুশো টাকার দুটো কড়কড়ে নোট। আমি এখুনি চাইলে পাঞ্জাবীটার মালিক হয়ে যেতে পারি।


হঠাৎ করে মনটা ঘুরিয়ে ফেললাম। কেন যেন। নাহ, কিনবো না। কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম খালি হাতে। বন্ধুরাও পিছু পিছু আসলো। সবাই মিলে বাসে উঠে সোজা কোতোয়ালী মোড়। ওখানে কুমিল্লার খাদি দোকান আছে দুটো।

খাদি দোকানে ঢুকে একশো টাকায় একটা পাঞ্জাবি কিনে যখন রাস্তায় নেমে এলাম তখন আড়ং পাঞ্জাবির আক্ষেপ আমার সম্পূর্নই মুছে গেছে। আমি বুঝে গেছি পকেটে দুশো টাকার সাময়িক যোগান থাকলেও আড়ং যোগ্য হয়ে উঠতে ঢের দেরী। আরো অনেক বছর পর যখন আড়ং-যোগ্য হয়েছি তখনো আমি আড়ং পাঞ্জাবি কিনিনি। কেন যেন ইচ্ছে করে না। কোথাও একটা চেপে রাখা কষ্ট রয়ে গেছিল বলে?


এটা সেই তিনটে শার্ট তিনটে প্যান্ট যুগের কথা। সেই যুগে আমরা কয়েক বছরের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছিলাম। ওই সময়েই আমার চেনা হয় জহুর হকার মার্কেট। ওই মার্কেটটা ছিল বলে আমাদের মতো পরিবারগুলো ভদ্র সমাজে টিকতে পারতো। ওখানে প্রধানতঃ প্যান্ট সেলাই করাতে যেতাম। তখন ওখানে বিদেশী পুরোনো প্যান্টগুলো সেলাই খুলে সাইজমতো বানিয়ে দেয়া হতো। হানিমুন টেইলার্স নামে একটা দোকানে আমাদের কয়েক বন্ধুর যাতায়াত শুরু। ফিক্সড রেট। ১০০ টাকা। এত সস্তায় আর কোথাও প্যান্ট কেনার কথা ভাবতে পারতো না কেউ। ওই দোকান থেকে কয়েকটা প্যান্ট সেলাই করেছিলাম।

দোকানের নাম মনে থাকলেও সেলসম্যানটার নাম মনে নেই। চেহারা মনে আছে। তিনিও আমাদের নাম জানেন না। মুখ চেনা মানুষ। উনি আমাদের দেখলেই প্যান্ট নামিয়ে দেখাতেন যত্ন করে। আমরা দেখে পছন্দ করে কিনতাম। তার কারণেই আমরা আর কোন দোকানে যেতাম না।

কয়েক বছর আগে একবার ওই এলাকা দিয়ে যাবার সময় ইচ্ছে হলো দোকানটা দেখে যাই। আর্থিক স্বচ্ছলতা আসার পর গত দুই দশক এখান থেকে প্যান্ট বানাতে আসিনি। এই মার্কেট থেকে মাঝে মাঝে শার্ট কেনা হয় গার্মেন্টসের একটা দোকান থেকে। ১০০ নম্বর দোকান। তো ওই এলাকা দিয়ে যাবার সময় কয়েক বছর আগে হুট করে প্যান্টের গলিতে ঢুকলাম। সেই হানিমুন টেইলার্স আর সেই লোকটাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।

হানিমুন এখন চট্টগ্রামের খুব নামকরা দোকান। এখান থেকে বড় মার্কেটে চলে গেছে। তবু দেখলাম আদি দোকানটা এখনো আছে, আছে সেই লোকটাও। ভীষণ ভালো লাগলো। কত বছর পর। দেড় যুগের বেশী। আমি তাকে দেখে হাসিমুখে হাত বাড়ালাম। কিন্তু সে হাত বাড়ালো নিরাসক্ত ভাবে।


দোকানটা অনেক বদলে গেছে। পুরোনো প্যান্টের যুগ কবেই শেষ। এখন ঝকঝকে সব স্যুটের সারি, প্যান্টের সারি। এই মার্কেটের সবচেয়ে অভিজাত দোকান। ভালো লাগলো তাদের এই উন্নতিতে।


এটা সেটা কথার পর বললাম - একটা প্যান্ট দেখান তো। উপরের ওই প্যান্টটা। আগে এরকম দেখতে চাইলে চট করে নামিয়ে দেখাতেন। ওটার ডিজাইন দেখে পছন্দ হলে অর্ডার দিতাম। কিন্তু এবার উনি কেমন যেন রুক্ষ স্বরে বলে উঠলেন- প্যান্ট দেখানো যাবে না, অর্ডার দিলে কাপড় দেখে দেন। এত রূঢ় কথা শুনে আমি মানুষটার দিকে তাকালাম আবার। লোকটা এতটা বদলে গেছে? আমার আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না।কিছু না বলে ব্যথিত মনে বের হয়ে আসলাম।

কত মানুষই তো বদলে যায়, এ আর নতুন কি। কিন্তু ওই মানুষটার বদলে যাওয়াটা কেন যেন মেনে নিতে পারিনি।


এত বছর পর আমি আবারো সেই তিন প্যান্ট তিন শার্ট পলিসিতে ফিরতে চাই।  কেননা জামাকাপড়ের আধিক্যে আমি এখন রীতিমত হিমশিম খাই। আলমীরা ওয়ার্ডরোব সবখানেই ঠাসাঠাসি। এখন নিজে তেমন কিনি না, কিন্তু উপহারের বন্যায় ভেসে যাই। যেসব জিনিস আগে পরতাম না তাও উপহার পাই। আমি আগে জিন্স পরতাম না, মাত্র একখানা জিন্স কিনেছিলাম ভুটান যাবার সময়। এখন উপহারের ঠেলায় সেই জিন্সও হয়ে গেছে বেশ কয়েক খানা। হাল ফ্যাশনের জিন্স। পরলে বয়স বিশ বছর কমে যায়। জিনস, কর্ড, সিনথেটিক, কটন, গ্যাবার্ডিন নানান জাতের নানান ডিজাইনের প্যান্ট।

তিন-তিন ছয় খানা হলে যে আমার চলে যায় সেই আমার এখন জামাকাপড়ের সংখ্যা সেঞ্চুরী পার হয়ে গেছে। শার্ট টিশার্ট পোলো ফুল হাতা, আধাহাতা, শর্টস, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, কোট স্যুট জ্যাকেট সুয়েটার পুলওভার আরো কত কত হাবিজাবি। শীতকাল আসলে জামাকাপড়ের চাপে আমার আলমারীর দম আটকে যায়। সংখ্যায় বেড়েছে ঠিক, কিন্তু ডিজাইন সেই সেকেলেই রয়ে গেছে। সেকাল আমাকে ছাড়েনি, আমি সেকালকে ছাড়িনি। আমরা দুজন দুজনার হয়ে মহাকালে বিলীন হয়ে যাচ্ছি।

[একটি দড়ি ছেঁড়া লাইনচ্যুত ব্লগরব্লগর]

Monday, January 27, 2014

হেরে গেল আরো একজন

ছুটতে ছুটতে চয়নের ছোট্ট বুকটায় হাঁপ ধরে যায়। পরনের শার্টের একটা বোতাম ছিঁড়ে কোথাও পড়ে গেছে। ছুটতে গেলে নদীর বাতাসে শার্টটা পিঠের দিকে ফুলে যায়।  নিজেকে তখন সুপারম্যানের মতো লাগে।


সুপারম্যানের কথা ভাবলে মনটা উদাস হয়ে যায় তার। কতদিন টিভি দেখে না। মা এখন কেমন আছে? মা কি তাকে ভুলে গেছে? মায়ের কথা ভুলে থাকতে চায় অভিমানে। ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রাখে। কাউকে বুঝতে দেয় না তার কান্না। সে এখন বড় হয়েছে না? কদিন পরেই স্কুলে যাবে। অ আ ক খ লিখতে পড়তে শিখে গেছে ইতিমধ্যে।


মায়ের নাকি খুব অসুখ। অনেকদিন ধরে হাসপাতালে। সেই যে ভোরবেলা কাজে গেল, তারপর থেকে আর দেখেনি মাকে। বাবাও ঠিকমতো বাসায় আসেনি কয়েকদিন। সে পাশের বাসার খালার কাছে থাকতো। এরপর কয়েকটা দিন বাসায় হুলস্থুল চললো। গ্রাম থেকে নানা ভাই আসলো, নানু আসলো, আরো অনেকে। সবাই ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, কেউ কাঁদছে। সে কিছু চাইবার আগে হাজির করছে। কেন এত আদর সে বোঝেনি। সবাই এত আদর করে কিন্তু মার কাছে নিয়ে যায় না। মায়ের কি হয়েছে? মাকে দেখার জন্য সে অনেক কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু কারো মন গলাতে পারেনি।


সেদিন যখন মা কাজে যাচ্ছিল, চয়ন ঘুম থেকে জেগে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাকে বলেছিল আমার জন্য কি আনবা? মা বলেছিল, তোমার জন্য একটা রাজকন্যা পুতুল আনুম, সেই কন্যার হাতে থাকবে একটা সোনার বাক্স, সেই বাক্সে থাকবে চকলেট মিঠাই আচার চিপস আরো কত কিছু!


মা প্রায়ই এরকম সুন্দর সুন্দর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়। একেকদিন একেকটা। কিন্তু একদিনও মনে থাকে না তার। সন্ধ্যার সময় ঠিক খালি হাতে বাসায় ঢুকে। তবু চয়নের এসব বায়না করতে ভালো লাগে। মায়ের এই মিথ্যেটাকেও সে খুব ভালোবাসে। আসলে মা ঘরে ফিরলেই তার সব পাওয়া হয়ে যায়। দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে মায়ের গায়ের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়।


মা তার কপালে চুমু খেয়ে বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে রান্না বসায় চুলায়। কখনো তরকারি কুটে, পিয়াজ কুটে, মরিচ কুটে, কখনো বা গরম কড়াইতে স্যাঁয়াত করে ডিমভাজি করে। সে চুপচাপ মার পাশে ছোট্ট একটা পিড়ি নিয়ে বসে বসে এসব দেখে। খাবারদাবারের এই গন্ধটা তার খুব প্রিয়। খিদেটা কেমন চনমন করে ওঠে তখন। সে নিজের হাতে খেতে পারে এখন, তবু মা তাকে গরাস তুলে খাইয়ে দেয়।


মা অনেকদিন অসুস্থ থাকবে বাসায় ওকে কে দেখবে, তাই কিছুদিন পর নানাভাই তাকে নিয়ে আসলো তুলসীপুরে নানীর কাছে। সেই যে এসেছে আর ঢাকা ফিরতে পারেনি। নানীকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে দেখে মাঝে মাঝে। নানার সাথে ঝগড়া করে ঢাকা যাবার জন্য। কিন্তু নানাভাই রাজী হয় না। বলছে, চয়নকে দেখাশোনা করাই বেশী দরকার। তার মাকে দেখার জন্য হাসপাতাল আছে, সরকার আছে। আর আছে চয়নের বাবা।


বাবা কেন আসে না? বাবা তাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতো না। এখন কিভাবে ঘুমায়?

নদীর পাড়ে ছুটতে ছুটতে সে কান্না ভুলে থাকে, মাকে ভুলে থাকে।
নদীটা খুব মজার। পানি নেই বেশী। গ্রামের ছেলেদের সাথে সে নদীতে পা ডুবিয়ে খেলা করে। নদীতে জলধারা খুব ক্ষীণ, এখানে ওখানে সব বালির চড়া। মাঝে মাঝে হাঁটুজল। সেখানে নাম না জানা ছোট ছোট পোকা কিলবিল করে। ছোট্ট চয়ন গ্রামের দামাল ছেলেদের পিছু পিছু প্রতিদিন সকালের খেলাপর্ব সেরে  দুপুরে বাড়ি ফিরে যায় শৈশবের ধুলোবালি মেখে।

গত কমাসে এই গ্রামটা খুব চেনা হয়ে গেছে। এখানেই যেন জন্ম ওর।  রাতে নানাভাইয়ের সাথে ঘুমায় সে। কালরাতে নানাভাইকে একটা মজার গল্প শুনিয়েছে। নানাভাই চোখ বড় বড় করে জানিয়েছে এত সুন্দর গল্প আগে কখনো শোনেনি। আসলে এই গল্পটা সে মায়ের কাছে শুনেছে। নানাভাইকে সে কথা বলেনি অবশ্য। সুন্দর গল্পের পুরস্কার হিসেবে নানাভাই তাকে বলেছে ঢাকা নিয়ে যাবে আগামী সপ্তায়। নানাভাই যখন বলেছে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে। নানাভাই কখনো মিথ্যে বলে না। কিন্তু আগামী সপ্তাহটা কতদূর?


পরদিন সকালে নানীর কাছে গিয়ে শার্টের বোতাম ছেঁড়া অংশটা দেখায়। এটা পরে ঢাকা যেতে পারব না। বোতাম লাগিয়ে দাও। 

নানী পড়লো বিপদে। এই রঙের বোতাম পাবে কই? বললো, তোর নানা আসুক বাজার থেকে। বোতাম আনতে বলবো। কিন্তু তুই ঢাকা যাবি একথা কে বললো?


চয়ন জানালো, নানাভাই নেবে বলেছে। আগামী সপ্তায়।


নানী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দূরে তাকিয়ে কি যেন ভাবে। চয়ন বুঝতে পারে নানীরও মন খারাপ। তার ছোট্ট বুকের ভেতর মায়ের জন্য কেমন করছে। আগামী সপ্তাহ কতদূর আর? কালকেই আগামী সপ্তাহ? যদি তাই হতো? সপ্তাহ জিনিসটা সে এখনো বোঝে না। নানাভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আসুক আজ।


সেদিনই দুপুরের ভাতঘুম থেকে তাকে টেনে তুললো নানাভাই। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মাথার উপর একটা সুয়েটার গলিয়ে বললো, চল  ঢাকা যাবো। সে অবাক। এত তাড়াতাড়ি সপ্তাহ চলে আসলো? মাথা আঁচড়ানোর সুযোগ না দিয়ে নানাভাই কেমন করে তাকে টেনে নিয়ে চললো। সাথে নানীও চললো। দৌড়ে দৌড়ে চলছে ওরা। সে ছুটতে থাকে পাশে পাশে। নানাকে কোন প্রশ্ন করে সঠিক উত্তর পাচ্ছে না নানী। বিরক্ত হয়ে চুপ করে গেল।


দুবার বাস বদলে যখন ঢাকা এসে পৌঁছালো তখন গভীর রাত। চয়ন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। ঘুমন্ত চয়নকে নিয়ে টেক্সিতে উঠলো নানা। টেক্সিটা যেখানে থামলো সেখানে অনেক মানুষের ভিড়, হৈ চৈ। তুমুল হৈ চৈ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল চয়নের। তাকে কোলে করে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে মাটিতে বিছানা পেতে আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে শুয়ে আছে কে যেন।


নানাভাই তাকে নিয়ে সেই বিছানার পাশে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে পেছন থেকে নানী এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ঘুমন্ত মানুষটার উপর। 'আমার নাসুরে নাসু! কেমনে তুই এই কাজ করলি? এখন আমি কি জবাব দেই তোর পোলারে???


চয়নের নানীর সেই কান্না ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত ঘরে, পাড়ায়, গুঞ্জন হয়ে ছড়িয়ে পড়লো ঢাকা শহরের ইথারেও। পরদিন সকালে দৈনিক পত্রিকাগুলোয় ঠাঁই পেল ছোট্ট একটা সংবাদ -যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় আহত নাসিমার আত্মহত্যা।

উৎস


Thursday, January 23, 2014

বন্ধুদর্শন এবং.....

১.
অনন্তকাল সুখী জীবন কাটায় না কোন মানুষ। স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের আয়ু খুব সীমিত। বাজেট ফুরোলেই সব শেষ। অর্থ আয়ু সবকিছুর বাজেটই সীমিত। বিশ বছর আগে একবার চেয়েছিলাম আয়ু হোক ৩০ বছর। তারও পনের বছর পার হয়ে গেছে। এখনো আছি। দীর্ঘকাল বেঁচে থাকাটা অভিশাপ। কিন্তু এই বর্তমান আমার সুখের সময়। মাঝে মাঝে মনে হয় এটাই আমার জীবনের শীর্ষসুখ। এতটুকুতে যা পেয়েছি সেই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পাওয়া। এরপর পাওয়ার স্কেল শুধু কমতেই থাকবে। কমতে কমতে একসময় শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। তখন দেখবো জীবনে কিছুই অর্জন করিনি। বঞ্চনার কষ্টে আজকের এই অর্জনের স্মৃতিগুলোকে অলীক মনে হবে। ৬০ বছর আয়ুপ্রাপ্ত মানুষদের কি তেমনি মনে হয়? আমি ষাটের আয়ু পেলে কী করবো? অভিশাপ হয়ে বেঁচে থাকবো? সৃষ্টিশীল কোন কাজ করিনি জীবনে। যে সামান্য লেখালেখি করি সেটা শুধু নিজের জন্যই। নিজেকে ইতিহাসের খোরাক বানাবার তাগিদে। এখনো সুখীজীবন যাপন করছি বলেই লেখালেখি করতে পারছি। এমনকি দুঃখবিলাসী গানও গাইতে পারি। যখন সত্যি সত্যি দুঃখের জীবন শুরু হবে, তখন লিখে জানান দেবার অবকাশ থাকবে কি? নাহ এসব লেখা ঠিক হচ্ছে না। আমি কি নৈরাশ্যবাদী হয়ে পড়ছি?

২.
খানিক আগে পুরোনো এক বন্ধুর ফোন পেলাম। স্কুলে একসাথে পড়েছি। ঢাকায় চাকরী করে। স্বচ্ছল ঘরের সন্তান। প্রচুর জমিজমার মালিক উত্তরাধিকার সুত্রে। স্ত্রী পুত্রকন্যা নিয়ে সুখেই ছিল। সে জানালো নদীর ভাঙ্গনে তাদের সমস্ত ঘরবাড়ি জমিজমা চলে গেছে। তার গ্রামের বাড়ি বলতে আর কিছুর অস্তিত্ব থাকলো না। ঢাকার চাকরীটা আছে বলে চলছিল। এখন শোনা যাচ্ছে তার অফিসও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগামী মাসের পর চাকরীও থাকবে না। বউ একটা স্কুলে চাকরী করে, সেটাই ভরসা এখন। খুব টেনে হিচড়ে চলতে হবে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল শুনে। আমার যে হতাশা তার চেয়ে বহুগুন বেশী ওর সমস্যা। বন্ধুর এই সমস্যার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে আর ব্যক্তিগত নৈরাশ্যবাদ গ্রাস করতে পারে না।
মনে মনে বলি আমি আছি বন্ধু, তুই ভাবিস না।

৩.
আমার বন্ধুভাগ্য খুব ভালো। সেই স্কুলজীবন থেকে এখনো পর্যন্ত আমি বন্ধুদের অগাধ ভালোবাসা পেয়ে এসেছি। এত ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা আমার নেই। তবু সবচেয়ে কাছের বন্ধুর কাছে মনে মনে অভিমান করি কোন কোন সময়, আমাকে তুই কম ভালোবাসিস! কী অন্যায্য ব্যাপার না? তবু এরকম অন্যায্য দাবী তো সত্যিকারের বন্ধুর কাছেই করা যায়।

৪.
রুনা লায়লার একটা গান আছে দি রেইন ছবিতে। 'পরদেশী মেঘ রে, আর কোথা যাস নে। বন্ধু ঘুমায় দে ছায়া দে রে। বন্ধু ঘুমায় রে'। ছেলেবেলা থেকে রেডিওতে শুনে শুনে গানটা মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। তখনো বোঝার বয়স হয়নি পরদেশী মেঘকে উদ্দেশ্য করে বন্ধুকে কেন ছায়া দিতে বলছিল সে। তার বহুবছর পর বন্ধুর কল্যাণে গানটি খুঁজে পাই ইউটিউব থেকে। ছেলেবেলায় শোনা গানটি দেখার সুযোগ পেলাম এই বুড়ো বয়সে। বন্ধুর কাছে তখন খুব কৃতজ্ঞ হয়েছি। হারানো সময় খুঁজে দিতে বন্ধুর কোন বিকল্প হয় না।

৫.
পরিবারের বাইরে আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয় বন্ধু। বন্ধুর এই ঋন আমার কোনদিন শোধ করা হবে না। এই বিষয়ে ঋনী থাকাই আমার অগ্রাধিকার।

Tuesday, January 21, 2014

প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও তো জানা

১.
মানব পাঠের চেয়ে প্রকৃতি পাঠ অনেক সহজ। প্রকৃতি মানুষের চেয়ে অনেক বড় হলেও প্রকৃতি পাঠে কোন যন্ত্রণা নেই। মানুষ খুব সামান্য প্রাণী হলেও খুব দুর্বোধ্য, মানুষ পাঠ করার যন্ত্রণাদায়ক। একটা মানুষের যত ভেতরে প্রবেশ করা যায় ততই যন্ত্রণার ইতিহাস। মানুষ মানুষ খেলায় তাই আনন্দ নেই কোন। মানুষকে যত কম জানা যায় ততই সুখ।

২.
আরো অনেক দীর্ঘশ্বাস এখানে ওখানে হাহাকার করে হারিয়ে যায়, আমাদের কোনদিনই জানা হয় না। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ থাকলে পৃথিবী অনেক কোলাহলময় হতো।

৩.
মানুষের স্ববিরোধীতা আমাকে পীড়িত করে কেন? আমি নিজেও তো প্রচণ্ড স্ববিরোধী। আমার সকল কাজ, সকল সম্পর্ক, সকল নৈকট্য কোন না কোনভাবে পরস্পর বৈপরীত্যে ভরপুর। আমি যাকে শাসন করছি ভুল করো না বলে, সে জানে না আমি ওই একই ভুল অনেকবার করেছি। সে আমার ভুল জানে না বলে আমি তাকে শাসন করে শুদ্ধ করার সুযোগ নিচ্ছি। এটা কি অন্যায়?

৪.
আমি খুব স্বার্থপর। যারা আমাকে চেনে তারা এর বিপরীত কথা বিশ্বাস করে বলে তাদের আমি বোঝাতে পারি না আমি কতটা স্বার্থপর। সব স্বার্থপরতা কি খালি চোখে দেখা যায়? আসলে আমি খুব গোপনে শঠতা পোষণ করি, স্বার্থপরতা লালন করি, আমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করি। তুমি কি জানো আমি আমার স্বার্থপরতা আর শঠতা প্রমাণ করার জন্য একটি সুযোগের অপেক্ষা করি? আমাকে ঘেন্নার একটা সুবর্ন সুযোগ তুমি পাবে। তখন আর কোন অজুহাত লাগবে না।

৫.
বাড়ি ফেরার পথে যখন উল্টোদিকের বাসগুলো যাত্রী বোঝাই করে ১৮ নম্বরের দিকে ছুটে যায়, তখন আমার মনটা বাসের ছাদে চড়ে বসে। আমি হাওয়ায় দুলতে দুলতে বিনে পয়সায় পৌঁছে যাই ১৮ নম্বরে। ১৮ নম্বরে জেলেনৌকা, নদীর বাতাস, সমুদ্রের মোহনা। কাদাপানি মাড়িয়ে অপেক্ষমান নৌকায় উঠে পড়ি। এই নৌকা দেবে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি। বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে ভারত মহাসাগরে। আমাকে মহাসমুদ্র ডাকছে অনেক বছর ধরে। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?

৬.
উল্টোদিকের বাসে উঠে ভুল টিকেটে ধুঁকতে ধুঁকতে আমি সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যাই।

৭.
আমাদের জীবনে সবারই ওয়ান ওয়ে টিকেট। জীবন কোথাও ফিরতি টিকেটের ব্যবস্থা রাখেনি। যারা ফেরার কথা বলে, তারা বিভ্রান্তিতে ভুগছে। আমরা শুধু বর্তমান স্টেশান থেকে সামনের স্টেশানে যেতে পারি। চুড়ান্ত গন্তব্য আসার আগ পর্যন্ত এটাই আমাদের নিয়তি।


Monday, January 20, 2014

দশ টাকার জীবন

মাত্র এক টাকায় বিক্রি হয়ে যাবো একদিন- 
তখন তুমি বোলো না যেন এত সস্তা হলে কেন?

মানুষের দাম নিউজপ্রিন্ট কাগজের মতো।
কাগজ যখন পত্রিকা তখন তার দাম দশ টাকা।
যখন তারিখ বদলে যায় তখন সে ফেরিওয়ালার কেজি মাপা নিউজপ্রিণ্ট।
দশ টাকা নেমে আসে এক টাকায়।

আমাকে পড়া হয়ে গেলে আমিও দশ টাকা থেকে এক টাকায় নেমে যাবো।
তখনো তুমি বোলো না যেন এত সস্তা হলে কেন?

আমাকে তুমি কিনেই খালাস, পড়তে চাওনি।
তারিখ বদলে গেলে আমি এক টাকায় নেমে গেলাম।

তুমি বলো - 'তুমি সস্তা কিন্তু আমি তো শূন্যই',

আমি বলি-
'তোমার শূন্যতা নিয়ে আমার পাশে বসো,
দেখবে দশ টাকার অমরত্ব পেয়ে গেছি দুজনেই।'

আর কিছু না হোক, এসো দশ টাকার একটা জীবন গড়ি।

Sunday, January 19, 2014

সেই সন্দেহাচ্ছন্ন বিকেলটি

ব্যাপারটা গোলমেলে। শিখার সাথে প্রায় দশ বছর পর দেখা হতে যাচ্ছে ফাহাদের। ফাহাদ দক্ষিন আফ্রিকা চলে গিয়েছিল শিখার বিয়ের আগের সপ্তাহে। শিখার বিয়ে হয় সোহেলের সাথে। বিয়েটা অনিবার্য ছিল কিন্তু ফাহাদের পক্ষে মেনে নেয়া অসম্ভব ছিল কারণ সে শিখাকে ভালোবাসতো। তাই শিখার বিয়ের আগেই দেশত্যাগ করে।

শিখা ফাহাদকে ভালোবাসলেও শেষ বিচারে বিয়ে করার জন্য বেছে নিয়েছিল সোহেলকে। কারণটা শিখাই জানে। ফাহাদ জানে না। সোহেল এসবের কিছু জানে না। আর কেউ জানে না। জানার কথাও না। তেমন কিছুই হয়নি ওদের মধ্যে। যা ছিল সবই অজান্তে। সোহেল শুধু জানতো শিখার সাথে ফাহাদের বন্ধুতা ছিল সহপাঠি হিসেবে।

দশ বছর পর দেশে ফেরা উপলক্ষে পুরোনো বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে গেট টুগেদারের আয়োজন করে ফাহাদ। সেখানে পুরোনো বন্ধু হিসেবে শিখাও  সপরিবারে যোগ দেয়। ফাহাদ ছাড়া সবাই বিয়ে করেছে। ফাহাদ কেন বিয়ে করেনি সেটা নিয়ে কোন কৌতুহল নেই কারো। কারণ সে দশ বছর দেশে ফেরেনি। আফ্রিকায় কোন মেয়েকে তার পছন্দ হয়নি হয়তো। হয়তো বলার উদ্দেশ্য হলো আসল কারণটা কেউ জানে না।

শিখার সাথে ফাহাদের কিছু ছিল কিনা সেটা আর কেউ জানে না। শুধু শিখা জানে। ফাহাদ জানে শিখা তাকে ভালোবাসতো। মুখে কখনো বলেনি তবু সে জানতো। এখনো জানে। জানে বলেই শিখাকে আবার এত বছর পর কাছ থেকে দেখার জন্য এই আয়োজন।

বন্ধুরা ভাবলো এই অনুষ্ঠান তার নতুন জীবনে প্রবেশের কোন ইঙ্গিত। ফাহাদ নিজের পায়ে দাড়াবার জন্য এতদিন অপেক্ষা করছিল। আজ দাড়িয়ে গেছে। এখন নিশ্চয়ই তার ভবিষ্যত সঙ্গিনী সম্পর্কে কোন একটা ঘোষণা দেবে। কিন্তু ফাহাদের পরিবারও তেমন ইঙ্গিত পায়নি এখনো। এটা শুধু বন্ধুদের নিজস্ব বানোয়াট ধারণা।

নিমন্ত্রিত সব বন্ধু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। অস্বচ্ছল অসফল কোন বন্ধুকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। শুধু একজন বাদে। নাফিস কিভাবে সেই আসরে অতিথি হয়ে এলো সেটা ফাহাদ বুঝতে পারলো না। সে নিজে নাফিসকে নিমন্ত্রণ করেনি, কিংবা অন্য কাউকে বলতেও বলেনি। তবু নাফিস উপস্থিত হয়ে গেল সময়মত।

নাফিসও তাদের ক্লাসে পড়তো। কিন্তু অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে একটা ছোট চাকরীতে ঢুকে পড়েছিল জীবিকার তাগিদে। ছোট চাকরী থেকে সে আর বড় হতে পারেনি। পড়াশোনায় উজ্জ্বল থাকলেও আর্থিক উজ্জ্বল বন্ধুদের ভিড়ে নাফিস পরাজিত সৈনিকমাত্র। পরাজিত সৈনিকেরা উজ্জ্বল বন্ধুদের আড্ডায় খুব বেশী ঠাঁই পায় না। আর্থিক অবস্থার তারতম্য এইসব অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের তালিকা নিয়ন্ত্রণ করে। এই আসরেও তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। ফাহাদ তাকে বলেনি তবু আর কেউ হয়তো সাথে করে নিয়ে এসেছে। 

নাফিসকে ফাহাদ অপছন্দ করে না কিন্তু তার উপস্থিতিটা ক্রমশঃ একটা অস্বস্তির জন্ম দিল ফাহাদের মধ্যে। অস্বস্তিটা নাফিসের আগমনের সময় ছিল না। বরং নাফিসকে প্রথম দেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সুন্দর মিথ্যে সাজিয়ে বলেছিল- দোস্তো, ভালো করেছিস এসে। তোর ঠিকানা জানা ছিল না বলে তোকে আগে বলা হয়নি।

আসরে মোট আঠারো জন। এ ওর সাথে, ও তার সাথে, সে ওর সাথে, এভাবে আঠারো জন মিলে আটত্রিশজনের কোলাহল জাগিয়ে আসর জমজমাট রসঘন আড্ডামূখর করে তুললো। প্রত্যেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাই গল্পগুজবের অধিকাংশই হলো রাজনীতি, সমাজের অবক্ষয় ইত্যাদি ঘুরে ক্যারিয়ার এবং রিয়েল এস্টেটে গিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটতে লাগলো। সাথে চলছে পাণীয়।

ফাহাদ খুব উপভোগ করছিল আসরটা। ভেতরের ঘরে হালকা পাণীয়ের ব্যবস্থা ছিল। বউদের সামনে খেতে যারা সংকোচ করে তারা ভেতরে গিয়ে খেয়ে আসছিল। আসর যখন সরগরমের চুড়ান্তে তখন ফাহাদ ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখার ফাঁকে ফাঁকে শিখার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল এই দশ বছরে সে কতটা বদলেছে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো শিখা সেই তরুনীই রয়ে গেছে, এখনো সবার চেয়ে উজ্জ্বল এবং শুভ্র। একটু মুটিয়ে গেছে যদিও, তবু একফোটা কমেনি সৌন্দর্য। সাজতে জানে শিখা। ওর মতো এত সুন্দর করে আর কাউকে সাজতে দেখেনি। সব মেয়েকে সাজার পর সুন্দর লাগে না।

ফাহাদের এখন কোন মোহ নেই তার প্রতি। কেবল বন্ধু হিসেবেই দেখছে। তবু সে নিজে জানে শিখাকে একটু কাছ থেকে দেখার জন্যই এই আয়োজন। শিখা এই ভীড় কোলাহল ছাড়িয়েও মাঝে মাঝে তার দিকে যে বিশেষ চাহনি দিচ্ছিল এটা খুব উপভোগ করছিল ফাহাদ। এই দৃষ্টিই বলে দেয় এখনো সে শিখার ভেতরে কোথাও রয়ে গেছে। এই ভালোলাগাটুকুর কোন তুলনা হয় না।

আড্ডার পর খাওয়াদাওয়া, খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই যখন ঘরের এদিক সেদিক ছড়িয়ে টুকরো টুকরো আলাপে সময় কাটাচ্ছে ফাহাদ তখন ঘুরে ঘুরে দেখছে সবার সবকিছু পাওয়া হলো কিনা, খাওয়া হলো কিনা, বিসদৃশ একটা দৃশ্যে তখনই তার দৃষ্টি আটকে যায়। দৃশ্যটা বিসদৃশ কেন লাগলো সেটা ফাহাদ নিজেও বুঝতে পারলো না। এত মানুষের মধ্যেও দুজন মানুষ খুব কাছাকাছি কথা আর দৃষ্টি বিনিময় করছে। কথাগুলো বিশেষ কোন কথা নয়। সাধারণ সাদামাটা কথা। সবাই শুনতে পারে তেমন কথা। 

কিন্তু যে দুজন মানুষ কথা বলছে তাদের অত কাছাকাছি থেকে কথা বলার কথা না। তারা কখনো অত কাছে আসার মতো ঘনিষ্ট ছিল না। মেয়েটা ছেলেটার একদম কাছ ঘেষে দাড়িয়ে এবং এক হাতে ছেলেটার শার্টের বোতাম ঠিক করে দিচ্ছে। এত কাছাকাছি দুজন! ফাহাদের ভেতর সুক্ষ্ণ একটা ঈর্ষাবোধ ছড়িয়ে পড়লো। ছেলেটার সাদামাটা কথায় মেয়েটার চোখ থেকে যে মুগ্ধতা ছিটকে বেরুচ্ছে সে মুগ্ধতা দশ বছর আগে আরেকজনের জন্য ছড়াতো। মেয়েটা যে ভঙ্গিতে ছেলেটার কাছে দাঁড়িয়েছে সে ভঙ্গিতে আরেকজনের কাছে দাঁড়াতো। এই ভঙ্গীটা ফাহাদের খুব চেনা। ফাহাদ ওই মুগ্ধতায় বাগড়া দেবার জন্য কাছে এগিয়ে গেল।

কিন্তু মেয়েটার চোখ ছেলেটার মধ্যে এত গভীরতায় ডুবে আছে যে ফাহাদ কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও তাকে কেমন একটা অবহেলা করলো অথবা তাকে খেয়ালই করলো না। অস্বস্তি নিয়ে ফাহাদ ভেতরে চলে গেল। আরেক পেগ তরল গলায় ঢেলে একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে গেল।

এটা কোন বিশেষ ঘটনা নয়। এমনকি মেয়েটার স্বামীর চোখেও হয়তো তেমন লাগেনি। কিন্তু ওই দৃশ্যটা দেখার পর থেকে ফাহাদ কেমন অদ্ভুত একটা ব্যথা অনুভব করছে বুকের ভেতর। ভাবছে দশ বছরের ব্যবধান অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। তার অজান্তেই আরেকটি অধ্যায় কি ঘটে গিয়েছিল?

একটা সন্দেহ তাকে আহত করলো। সে জানে না ঘটনাটা সেরকম কিনা। তার ভাবনা মিথ্যা কিনা। এটা যাচাই করার কোন উপায় নেই। এটা কাউকে জিজ্ঞেসও করা যাবে না। তবু সে বুঝে ফেলেছে ওখানে কিছু একটা আছে। সামথিং ইজ দেয়ার। কী সেটা? এটা সোহেলের চোখে ধরা না পড়তে পারে, কিন্তু তার চোখ শিখাকে চেনে। শিখার দৃষ্টির সব ভাষা তার মুখস্থ।


শিখা আর নাফিসের মধ্যে কিভাবে এই ঘনিষ্ট যোগাযোগ তৈরী হলো সে জানে না। কিন্তু শিখার মতো উচ্চাভিলাসী নারী কখনো নাফিসের মতো পরাজিত সৈনিকের প্রতি এতটা মুগ্ধ হয়ে পড়বে এটা সে কিছুতেই মানতে পারলো না। 


সবাই চলে যাবার পর একলা বিকেলে বারন্দায় বসে বসে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওড়াতে ওড়াতে ফাহাদ  খুব গভীরে অনুভব করলো শিখার জন্য আর কোন গভীর অনুভুতি অবশিষ্ট নেই। গত রাতেও যে স্মৃতির আবেগে উদ্বেলিত হয়েছিল, আজ তার কোন অস্তিত্বই নেই। স্মৃতিগুলো যেন শিফট ডিলিট হয়ে গেছে হঠাৎ। এমন হয় কেন? একটা ব্যাপারে সত্য মিথ্যা যাচাই না করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলাটা কি ঠিক হবে? শিখার প্রতি এতকালের জমিয়ে রাখা স্মৃতিময় প্রেম মুহুর্তের মধ্যে মূল্যহীন হয়ে গেলো? ফাহাদ ভাবলো, আসলে কি সে শিখাকে ভালোবাসতো? ভালোবাসলে চট করে এতবছরের প্রেম ধপাস করে গর্তে পড়ে যেতে পারে ? আবার ভালো না বাসলে সামান্য একটা সন্দেহ এতটা আঘাত করতে পারে? 

তাহলে কোনটা সত্যি? ফাহাদ চেষ্টা করে সন্দেহকে যুক্তি দিয়ে কাবু করতে পারে। কিন্তু সন্দেহ বড্ড ত্যাঁদর। একবার মগজে ঢুকলে আর রক্ষা নাই। ভাইরাসের মতো একের পর এক বংশবৃদ্ধি করতে করতে সুস্থ অনুভুতিগুলোকেও গ্রাস করে। তখন মানুষটা দাঁড়াবার জায়গাটার উপরও আস্থা রাখতে পারে না।  

আজকের এই বন্ধু পুনর্মিলনীর সিদ্ধান্তটা ভুল বলে মনে হলো। শিখাকে আজ ওভাবে না দেখলে প্রেমময় পূর্ব স্মৃতিগুলো অটুট থাকতো। দশ মিনিটের একটা দৃশ্য দশ বছরের আনন্দের মধ্যে ঝপাত করে কালিমা ঢেলে দিল।

Saturday, January 18, 2014

পশ্চিমা বাতাসের কবলে বাংলাদেশ

-শুনেছো কথাটা?

-কোন কথা?

-ঐ যে কালকে আমেরিকা যা বললো

-হ্যাঁ শুনেছি

-শিরোনামটা খুব অস্বস্তিকর। আমেরিকা জুনের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন চায়। পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে চিন্তিত। বাংলাদেশে যখন বছরের পর বছর অনির্বাচিত সরকার ছিল তখন কোন মাথাব্যথা ছিল না।

-মাথা ব্যথা তো থাকবেই। এটা কোন ইলেকশান হলো? এমনকি আমি যাকে ভোট দিতে চেয়েছিলাম সেও ভোটে দাঁড়ালোই না।

-তাহলে তোমার আফসোসের কি আছে।

-আফসোস হলো যে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে তাদের চেয়ে আমার প্রার্থী অনেক বেশী যোগ্য ছিল

-যোগ্য হলে দাঁড়ালো না কেন।

-দাঁড়ায়নি নেত্রী অনুমতি দেয়নি বলে। এখন বলো আমেরিকার কথা নিয়ে তোমার আপত্তি কেন?

-বর্তমানে যে সরকার ক্ষমতায় আছে সেটি যেমন নির্বাচন করেই আসুক না কেন, এটি একটি বৈধ সরকার। এই সরকারে আপত্তি থাকলে সেটা জনগণ জানাবে। আরেকটা নির্বাচন চাইলে জনগণ চাইবে। আমেরিকা নির্বাচন চাইবার অর্থটা কি এখানে? আমেরিকা আমাদের কী?

-আমেরিকা আমাদের বড় ভাই কাম বন্ধু

-বড় ভাই কি অন্যায় আবদার করতে পারে?

-অন্যায় কোথায় দেখলা?

-অন্যায় না? আমার বউয়ের জন্য আমি কি শাড়ি কিনবো সেটা কি বড়ভাই বলে দেবে?

-তোমার বউ যদি ভাসুরের কাছে নালিশ করে শাড়ি পছন্দ হয় নাই বলে, তাহলে বড় ভাইয়ের উপায় কি?

-বউয়ের না হয় আক্কেল নাই। তাই বলে বড় ভাইও বেয়াক্কেলের মতো কথা বলবে?

-বেয়াক্কেল কেন হবে? বড় ভাই একটা নালিশ শুনে মন্তব্য করেছে মাত্র।

-মন্তব্য বলে মনে হয়নি আমার। দাবী বলেই মনে হয়েছে।

-বড় ভাই কি কোন দাবী করতে পারে না?

-আমি কোন তাত্ত্বিক আলোচনায় যাবো না। কিন্তু বড় ভাইয়ের আবদারের সীমানা তিনি লংঘন করেছেন এটা মানতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের মতামত নিয়েই তো এই দেশের চলার কথা, এটাই তো গণতন্ত্রের নিয়ম, নাকি? বাংলাদেশের মানুষ যদি এই যেনতেন নির্বাচন মেনে নিয়ে চুপ করে থাকে আগামী পাঁচ বছর, তাহলে আমেরিকার সমস্যা কি?

-আমেরিকার সমস্যা হলো এই নির্বাচন বিরোধী দল মেনে নেয়নি। যাদের উপর আমেরিকার স্বার্থের বিনিয়োগ ছিল। সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন দলের সাথে আমেরিকার কিছু বোঝাপড়া থাকে। সেই বোঝাপড়ায় ভেজাল লেগে গেছে এই ফলাফলে।  তাছাড়া সাধারণ মানুষও তো সর্বাত্মকভাবে নির্বাচন মেনে নেয়নি। আমেরিকা সেই সুযোগও নিয়েছে।

-এই নির্বাচন অনেক মানুষ মেনে নেয়নি, কথা সত্য। কিন্তু মেনে না নিলেও বিক্ষোভে তো ফেটে পড়েনি। সেরকম হলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসতো না? আর্মি পুলিশ এসব দিয়ে কি জনতার আন্দোলন থামানো যায়? আর্মি পুলিশ তো এরশাদেরও ছিল, আইয়ুবেরও ছিল, খালেদারও ছিল। কিন্তু মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ফেটে পড়েছে তেমন ঘটনা কই? সেরকম একটাও দেখি না। কিন্তু ভেবে দেখেছো কেন ফেটে পড়েনি? ফেটে পড়েনি কারণ যেসব মানুষ আওয়ামীলীগ পছন্দ করে না, তারাও বিএনপি জামাতের কাজকর্ম সহ্য করতে পারেনি। বিএনপি জামাত যে আন্দোলন করেছে সেই ইস্যুর যতটা জনপ্রিয়তা ছিল তাও নষ্ট হয়ে গেছে আন্দোলনের সহিংস ধরণে। আন্দোলনের নামে যা করেছে তার প্রায় সবটাই নাশকতা। ওটা ছিল দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বিএনপি এমন একটা দলের কাছে আন্দোলন বিক্রি করেছে যে দলটা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। যে দলটি বাংলাদেশের মানুষকে শত্রুদেশের মানুষ মনে করে। সেরকম একটা নৈরাজ্যবাদী দলটাকে আন্দোলন চালাবার দায়িত্ব দিয়ে চুড়ি পড়ে ঘরে বসে ছিল ওরা। এই বিএনপি মানুষের কাছ থেকে দূরে তো গেছেই, এমন কি জিয়ার বিএনপির কাছ থেকেও দূরে চলে গেছে।

-তোমার আসল কথাটা খুলে বলো তো? কি বলতে চাও তুমি?

-আমি বলতে চাই বিএনপি তার আশির দশকের চেহারায় ফিরে আসুক। ওই বিএনপিকে বিরাট অংশের মানুষ সমর্থন করেছিল। বর্তমান বিএনপিকে মানুষ কাছে টানতে পারছে না জামাতপ্রীতির কারণে। আদর্শিকভাবে বিএনপির যেটুকু স্বতন্ত্র চেহারা ছিল গত কয় বছরে তা প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। লক্ষ্য করে দেখবে বিএনপির সমর্থক বলে আলাদা কোন লোক নেই। আজকাল বিএনপি সমর্থক বলতেই তারা জামাতেরও সমর্থক। এই বিএনপি বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসা মানে জামাত ক্ষমতায় আসা।

-ইউরোপ আমেরিকা তাই তো বলেছে জামাতকে বাদ দিয়ে আসতে হবে। ঠিক তোমার কথারই প্রতিধ্বনি যেন।

-কিন্তু আমার স্বার্থ আর ইউরোপ আমেরিকার স্বার্থ এক না। পশ্চিমারা তৃতীয় বিশ্বে নানান জাতের প্রাণী পোষে। টিয়া ময়না হরিন বাঘ ভালুক সাপ থেকে সবকিছু, যখন যেটা কাজে লাগে। যখন যাকে দরকার তাকেই সুশীল তাকেই মডারেট উপাধিতে ভুষিত করে। এমনকি সেটা কাল কেউটে সাপ হলেও।

-তুমি খুব জটিল চিন্তা করো। আমি অত জটিল চিন্তা পারি না। আমি সিনেমা দেখি, বই পড়ি, সংসার করি আর মাঝে মাঝে তোমার সাথে ঝগড়া করি। পৃথিবীটা অত জটিল কিছু না। ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে থাকা ভালো। আমি তাই থাকি।

-তোমার মতো সুখী এদেশে আর কে আছে। স্বামীর অগাধ সম্পদের পাহাড়ের উপর বসে বাতাস খাওয়া। প্রাডো গাড়ির তেল পুড়িয়ে সমাজ সেবার সেমিনার করা আর  মাঝে মাঝে বিনামূল্যে হিতোপদেশ বিতরণ করা।

-জায়গামতো খোঁচাটা তুমি ভালোই পারো। থাক আজ আর ঝগড়া করতে পারছি না। বাচ্চাকে আনতে যেতে হবে স্কুলে। পরে কথা হবে। তুমি ভালো থেকো।

-তুমিও ভালো থেকো।

Thursday, January 16, 2014

১৬ জানুয়ারী ২০১৪: স্কুল বালকের প্রথম দিন

আজ আমাদের পুচকা শিহানের শিক্ষাজীবনের অভিষেক হলো। প্রথম স্কুল দিবস নিয়ে যে টেনশান ছিল সেটা কেটেছে ওর নিরুপদ্রপ ক্লাস প্রবেশে। ভয় ছিল সে ঢুকবে কিনা। ব্যাটা কারো সাথেই কথা বলে না। বাসায় অতিথি এলে মুখে তালা মেরে চুপপপপ হয়ে যায়। যে কেউ ভাবে কী সুশীল একটা ছেলে। কিন্তু ভদ্রলোক যে কি পরিমান সাইলেন্ট বিটলা সেটা পরিবারের লোকজনই জানে। প্রথমদিন সে কোনমতে ক্লাসে ঢুকলেও ভয়ে নাকি তার কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল। কান্না আসছিল খুব, কিন্তু সামলে রেখেছে। এটুকুতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি তার জায়গায় হলে পালিয়ে চলে আসতাম। ওশিনও প্রথম কদিন ঢুকেনি।

ওশিনও এই স্কুলে পড়ে। স্বীকার করতেই হয় বাপের চেয়ে তাদের দুজনের পারফরমেন্স অনেক ভালো। তাদের বাপ ক্লাস ওয়ানে একদিনও ক্লাস করে নাই। ক্লাস টুতেও কদিন করেছে হাতে গোনা যাবে। ক্লাস থ্রিতে তো চরম ফাঁকিবাজি করে ধরা পড়ছিল। রীতিমত স্কুল চুরি করেছিল। আগ্রাবাদ স্কুলের বদলে এক বন্ধুর সাথে পাশের কলোনীতে টিএণ্ডটি স্কুলে গিয়েছিল ক্লাস করতে। অবশ্য বাপ এখন বুড়াকালে সেই দুষ্কর্মের স্মৃতিচারণ করে বিশেষ পরিতৃপ্তি পেয়ে থাকে।

ওদের স্কুলটি বাচ্চাদেরকে বিশেষ কায়দায় পড়ালেখা করায়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করা বাংলা মাধ্যমের স্কুল খুঁজতে গিয়ে এর সন্ধান পাই। আনন্দের সাথে পড়াশোনা এখানকার অন্যতম চরিত্র। 'ফুলকি' পরিচালিত স্কুলটার নাম 'সহজপাঠ'। 'ফুলকি' হলো চট্টগ্রামের চার দশক পুরোনো একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। নন্দনকাননে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ফুলকি স্কুল বলে বেশী পরিচিত। নিরিবিলি পাহাড়ঘেরা পরিবেশটা মুগ্ধ করে।

শিহানের ক্লাসের নাম 'খেলাপড়া'। এই ক্লাস আগে ছিল না। এ বছর থেকে শুরু করেছে। খেলাপড়া অন্যস্কুলের প্লে। এই স্কুলে নার্সারিকে বলে, কুঁড়ি। কেজিকে বলে, 'কলি'। চমকপ্রদ সব নাম। এখানকার পড়াশোনার ধরণটাও চমৎকার। যে কোন লেখা শেখানো হয়  ছবি আঁকার মতো। একটা সংখ্যা লিখে বলা হবে রং করো। বাচ্চারা রং নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। ফলে খেলতে খেলতে পড়া শেখা হয়। ওশিনও এই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠলো এবার। ওশিন শুরু করেছিল 'কুঁড়ি' ক্লাস থেকে।

পুচকার আজকের দিনতো কোনমতে কাটলো। সামনের দিনগুলোতে কি করে সেটার জন্য চিন্তায় আছি।


Monday, January 13, 2014

বই প্রতিরক্ষা

অভিজাত এলাকার এক ধনকুবের গেছেন নগরের সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকানে। দোকানটা বিশাল একটা হলরুম যেন। প্রথমে ঢুকতে মনে হয় না বইয়ের দোকান, মনে হয় কোন প্রাচীন মিউজিয়াম।

শহরে বইপত্র বেচার এমন একটা জায়গা আছে  তিনি কল্পনাই করেননি। নিউইয়র্কের বার্নস এণ্ড নোবলে একবার ঢুকেছিলেন। এক কাপ কফি খেয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন ইতালীর বন্ধুর সাথে।

এটার সাথে নিউইয়র্কের সেই দোকানের কেমন একটা মিল। ওটার একপাশেও বেশ বড় একটা কাফে ছিল, এটার এক কোনেও নেসলের একটা কফি মেশিন দেখা যাচ্ছে। পাশে কয়েকটা টুল পাতা। পড়ুয়ারা চুকচুক করে কফি খাচ্ছে বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে।

এই দোকানটার কেমন একটা জাহাজি আমেজ বা ঘ্রাণ আছে, জাহাজের মতো গোলাকার জানালা দেয়াল জুড়ে, সেই জানালা দিয়ে বাইরের সবুজ দেখা যাচ্ছে। এমনকি দোকানের মধ্যিখানে সটান দাঁড়ানো একটা আস্ত বাতিঘর। সেই বাতিঘরের ফাঁকফোকর জুড়েও বই আর বই।

মেঝেতে প্রাচীন কোন অচেনা কাঠের কারুকাজ। সমস্ত ঘর জুড়ে অপূর্ব সব শিল্পকর্মের মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনী। চমৎকৃত হলেন ভদ্রলোক, হতেই হবে। শুধু চমৎকৃত নন, গর্বিতও হলেন গরীব দেশের এই ছোট্ট শহরেও এমন একটা বইয়ের দোকানের জন্য।

দোকানে ঢোকার পর থেকে ভদ্রলোক কোন কথা বলেননি। শুধু বইয়ের তাকের দিকে নজর বুলিয়ে যাচ্ছেন। বোধহয় স্থির করতে পারছেন না কোন বই কিনবেন। কিংবা আজ কিনবেন নাকি কাল। অনেকে প্রথমে দেখতে আসে, পরে অর্ডার করে।

এই ভদ্রলোক এর আগে আসা সবার চেয়ে কেমন যেন আলাদা। কিন্তু কী আলাদা সেটা বোঝা যাচ্ছে না। দোকানের সেলস ম্যানেজার চশমার ফাঁক দিয়ে মেপে নিতে চাইছেন কতটাকার বই কিনবেন এই ভদ্রলোক।

এরকম প্রকৃতির লোকজন কমপক্ষে দু তিন হাজার বই কিনে নিয়ে যায় একসাথে। এরা পড়ে কম, কিনে বেশী। আবার অতি পড়ুয়াদের পকেট থাকে গড়ের মাঠ। কেউ কেউ দুঘন্টা ঘাটাঘাটি করে বড় জোর দেড়শো টাকার একটা পাতি উপন্যাস কিনে বিমর্ষমুখে বেরিয়ে যায়। এই ভদ্রলোক প্রথম দলের নিশ্চিত, তবু কি যেন একটা পরিষ্কার তফাত। এই চাহনি আগে দেখেনি সেলস ম্যানেজার।

ভদ্রলোক দোকানের এপাশ ওপাশ কয়েকবার চক্কর দিলেন। সমস্ত ঘর হেঁটে হেঁটে কি যেন একটা  অনুমান করার চেষ্টা করছেন।

সেলস ম্যানেজার খেয়াল করলেন তাঁর চোখ কি যেন খুঁজছে।
দুর্লভ কোন বই? মুভি? গান? অ্যালবাম? সব আছে সব।
কাউন্টারে একবার জিজ্ঞেস করলেই কম্পিউটারে দুটো বাটন চেপে বলে দিতে পারেন তিনি।

হ্যাঁ, এবার আসছেন তার কৌতুহল নিবৃত করতে। কাউন্টারে এসে জিজ্ঞেস করলেন-
-সাইজ কত?
-মানে?
-এই দোকানের সাইজ। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা।

সেলস ম্যানেজার হতবাক। এই প্রশ্ন মোটেও আশা করেননি তিনি। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন পেয়ে উত্তর দিতে দেরী হচ্ছিল।

-কী হলো? জানা নেই?
-জী স্যার, আছে। এটা হলো এটা.......মানে দৈর্ঘে দেড়শো ফুট, আর প্রস্থে ......এই ধরেন আশি ফুট।
-হুম। তার মানে বারো হাজার
-বারো হাজার মানে?
-বর্গফুট
-জী, তাই হবে।
-আমারটা একটু ছোট হবে। চলবে তবু।
-আপনারও দোকান আছে বুঝি?
-না, আমার দোকান নাই। আচ্ছা, এটার দাম কত?
-কিসের
-এই দোকানের ?
-এটার তো দাম নেই
-মানে?
-এটা সরকারী দালান। আমরা ভাড়া নিয়েছি।
-ও আই সি। দালান বাদ দিলে দোকানের সবকিছুর দাম কত?
-সবকিছু মানে?
-মানে দেয়ালগুলো বাদ দিয়ে যা আছে। বইপত্র, র‍্যাকট্যাক, বাতিটাতি যা আছে সব।
-সেটা.....সেটা তো কখনো হিসেব করিনি.......

প্রশ্ন শুনে ভিরমি খেলেন সেলস ম্যানেজার। আমতা আমতা করে জবাব দিলেন। লোকটা উন্মাদ নাকি? দেখেশুনে তো সুস্থ মনে হচ্ছে। কথাবার্তার এই ছিরি কেন? দোকানের দাম দিয়ে কী করবেন তিনি?

ভদ্রলোক মনে হয় বুঝতে পারলেন সেল ম্যানেজারের কথা।

-ভাবছেন দোকানের দাম জেনে কি করবো?
-জী, আসলে ঠিক তা না......
-আসলে ভাবার কথাই। কিন্তু দোকানটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। যেটা খুব পছন্দ হয় আমি তার দাম জানতে ইচ্ছে করে। আপনি তো বলতে পারলেন না, পারার কথাও না। যাই হোক। এ তো হবারও কথা নয়। তবু স্রেফ কৌতুহল।
-জী স্যার
-আপনাদের ইনটেরিয়র আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার ড্রইংরুমের সাইজটা এরকমই হবে প্রায়। আমি আমার বাড়ির ড্রইংরুমের ডিজাইনটা এরকমই করতে চাই। তাই দামটা জানতে চেয়েছিলাম। সে যাকগে। আসল কথায় আসি। কিছু বই লাগবে আমার।
-কি বই?
-সে আপনারা ঠিক করবেন।
-আমরা? কি বলছেন স্যার! আমরা কি করে জানবো কি বই কিনবেন আপনি?
-জী। আপনাদেরই করতে হবে। এই মাপের একটা ড্রইংরুমের সবগুলো দেয়াল বই দিয়ে সাজাতে কত টাকা লাগবে সেটা আপনারা ঠিক করে আমাকে একটা হিসেব দেবেন। আমি খুবই ব্যস্ত। আমার হাতে সময় নেই। আমি শুধু চেকটা লিখে দিয়ে যাই আজ। আপনারা বই পরে পাঠিয়ে দেবেন।

সেলস ম্যানেজারের মাথা ঘুরাতে শুরু করে। এসব কি বলছে লোকটা। জন্মেও শোনেনি কেউ এভাবে বই কিনতে পারে। নির্বাক চাউনিতে তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেণ্ড। তারপর কোনমতে একটা জবাব তৈরী করে বলে-

-স্যার আপনি ভাববেন না। আপনার বাসার ঠিকানাটা দেন। আমরা লোক পাঠিয়ে মাপ নিয়ে আসবো। তারপর বইগুলো পাঠিয়ে দেবো।
-ঠিক আছে। আপাততঃ দশ লাখ টাকার চেক রাখেন। বেশী কম যা হয় পরে এডজাস্ট করে নেবেন।

ভদ্রলোক চেক আর ঠিকানা লেখা কার্ড দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন।

গাড়ি চলতে চলতে ভাবছেন, শেষবার বই কিনেছিলেন পয়ত্রিশ বছর আগে মেট্রিক পরীক্ষার টেষ্ট পেপার। পয়ত্রিশ বছর পর আবারো বইয়ের খোঁজে নেমেছেন ইন্টেরিয়র ডেকোরেটরের অনুরোধে।  অনেক বছর পর বইয়ের জন্য আবারো নৈকট্য বোধ করছেন তিনি। বইয়ের ঘ্রাণসমেত একটা ড্রইংরুমের স্বপ্নে তার ঘুম চলে আসছিল।

জরুরী কথাটা তখনই মনে পড়লো।

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দোকানের নাম্বার টিপতে শুরু করলেন। দোকানে ফোন করে বলে দিতে হবে অর্ধেকের বেশী যেন ইংরেজী বা দুর্বোধ্য ভাষার বই হয়। যাতে হাবিজাবি লোক এসে বইপত্র হাপিস করে দিতে না পারে।

বই পড়তে কাউকে বারণ করা চরম অভদ্রতা। কিন্তু এটাও তো মানতে হবে- বইপত্র শুধু কিনলেই হয় না, বইপত্র রক্ষা করতেও জানতে হয়। স্কুলে পড়া স্বাধীনতার ভাবসম্প্রসারণটির কথা মনে পড়লো তাঁর।

Tuesday, January 7, 2014

ডিমবল

এক টাকায় একটা ডিমবল। ছেলেবেলায় টেবিল টেনিস বলকে আমরা 'ডিমবল' ডাকতাম। বড় হবার পরও ডিমবল নামটা রয়ে গেছে। মেঝেতে ছুড়ে দিলে ডিমবলের ঠাশ ঠাশ করে লাফিয়ে ওঠার দৃশ্যটা আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি টেবিল টেনিস তেমন খেলিনি। লন টেনিসও না।

ছেলেবেলায় আমরা লন টেনিসকে বলতাম 'লং টেনিস'। গুগল করে দেখেন শুধু আমি না, অনেক পত্রিকাতেও লং টেনিস লেখা। আমি কোন টেনিস তেমন খেলিনি কিন্তু টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলেছি বিস্তর। প্রায় সবার ক্রিকেটে হাতে খড়ি হয় টেনিস বল দিয়ে। সাদা রঙের টেনিস বলগুলো ছিল সস্তা। পাঁচ টাকা দামের সবুজ রঙের টেনিস বলগুলো দামী। এই বলগুলো মসৃন পশমে ঢাকা। 

আমাদের ব্যাট ছিল তক্তার তৈরী। পাতলা তক্তার এক পাশে সরু করে হাতে ধরার ব্যবস্থা করা হতো। উইকেট হিসেবে ব্যবহার করতাম থান ইট কিংবা বাঁশের কঞ্চি।  ক্লাস সেভেন পর্যন্ত তক্তার ব্যাটে খেলেছি। ক্রিকেটের পাশাপাশি চলতো ফুটবলও। বর্ষাকালে মাঠের কাদার মধ্যেও থপথপ করে টুর্নামেন্ট চলতো আমাদের। ফুটবলে আমি স্ট্রাইকার হতে চাইলেও ভাগ্য আমাকে গোল কিপারে নির্ধারন করে। কারণ একবার ক্লাবের দুঃসময়ে পেনাল্টি কিক ধরে ফেলেছিলাম। সেই থেকে আমার জায়গা গোলপোষ্ট।

ফুটবল ছেড়ে দিলাম ক্লাস নাইনে ওঠার পর, তখন ব্যাডমিন্টনের নেশা। ব্যাডমিন্টন ছিল সবচেয়ে প্রিয় খেলা। ফুটবল ক্রিকেট সব ছেড়ে ব্যাডমিন্টনে লেগে ছিলাম অনেক বছর। কিন্তু সব খেলার পাশাপাশি অবসর বিনোদন ছিল ডিমবল। সাদা গোল ডিমের উপরদিকে মেরুন রঙের চাইনীজ ছাপা ছিল আসল  ডিমবলে।

একটা ডিম বলের দাম ছিল এক টাকা। হ্যাঁ এইটা কিভাবে যেন মনে আছে। পাখির ডিম নামে এক ধরনের গুলগুল রঙিলা ক্যাণ্ডি পাওয়া যেতো। এক প্যাকেটে অনেকগুলো। সেগুলোর দামও ছিল এক টাকা।  ডিমবলের সুবিধা ছিল পকেটে নিয়ে ঘুরা যেত। এমনকি বেড়াতে গেলেও হাফপ্যান্টের পকেটে ফুলে থাকতো একটা ডিমবল। হাতের তালু দিয়ে মেঝের সাথে বাড়ি মেরে মেরে খেলতে খেলতে হাটতাম। শহরের যে কোন জায়গায় এটা চমৎকার নিজস্ব বিনোদন। তবে গ্রামে গেলে এটার কেরামতী শেষ। গ্রামে ছিল কাঁচামাটির মেঝে। সেখানে এই বল লাফাবে না। তাই গ্রামে গেলে ডিমবল বাদ। গ্রামের জন্য নেয়া হতো লাটিম। ডিমবলের জায়গাটায় ফুলে থাকতো লাল সবুজ লাটিম। ভাবতে কেউ অবাক হতে পারে, এই বয়সে এসে আমি আবারো সেই ১ টাকা দামের ডিমবল আর আট আনা দামের লাটিমকে মিস করতে শুরু করেছি।

মিস করতে শুরু করেছি যখন শিহানের জন্য আমার হারানো খেলনাগুলো খুঁজতে গেছি দোকানে। সাদা বল না পেয়ে কমলা রঙের টেবিল টেনিস বল কিনে এনে নিজেই খেলতে শুরু করি হাত দিয়ে। শিহান দেখে মজা পায়। সে এখনো খেলতে পারে না। কিন্তু আমাকে খেলতে বলে। আমি খেললেও আনন্দ তার। আমি শিহানকে পাশে বসিয়ে বড়দের ভঙ্গীতে আমার ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করে যাই। আমার বকরবকর শুনে সে আমোদিত। আরো বলো, আরো বলো করে অতিষ্ট করে দেয়। তখন আমি মনে না পড়া স্মৃতিগুলোকেও হাতড়ে কিছু বের করি। যেটুকু মনে আছে তার উপর রঙ চড়িয়ে গল্প করি ওর সাথে। ছেলেবেলাটা একটা স্মৃতির সমুদ্র। সেই সমুদ্রে হারানো মুক্তোগুলো খুঁজে বেড়ানো আমার প্রিয় অভ্যেস। বিক্ষিপ্ত হলেও তাকে অক্ষরাবদ্ধ করতে দেরী করি না তাই।

Monday, January 6, 2014

৬ জানুয়ারী ২০১৪ গুমোট নগর, একটু সবুজ সময়

১.
এখন যা ঘটছে, তা কাংখিত না হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। যা ঘটছে তা মানতে না পারা আমার ব্যক্তি অবস্থানকে ক্ষুন্ন করছে না, কিন্তু অসন্তুষ্টিকে বাড়িয়ে চলছে। আমি কার উপর অসন্তুষ্ট?

২.
দেশকে আমি কি দিচ্ছি সেটার চেয়ে বাজারে আমি কত টাকা ব্যয় করছি সেটা যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় তখন আমার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলাই সঙ্গত।

৩.
মানুষগুলো বিভক্ত হয়েই চলেছে। বাঙালীমাত্রেই বিভক্তিবান্ধব, দ্বিধাবাজ প্রাণী।

৪.
গুমোট সময় আরো দীর্ঘায়িত হবে। আরো আরো দীর্ঘতর। একটা নতুন ঘটনা ঘটবে। আগে ঘটেনি তেমন। অপ্রস্তুত ঘটে যাবে। ইনট্যুশন কেমন তাড়া দিচ্ছে।

৫.
গতকাল ছিল সত্যিই চমৎকার একটা দিন। নির্জন জনবিরল শহর। অনেক বছর পর এমন নিঃশব্দ নগরী দেখলাম। রাস্তার একমাত্র বাহন রিকশা, সেই রিকশাও হাতে গোনা। থমথমে শহরে যেন কারফিউ চলছে। উর্দিপরা সৈনিক বন্দুক উঁচিয়ে জীপ গাড়িতে টহল দিচ্ছে। অনেক মানুষ যখন ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না, সেই নির্জন দুপুরে আমরা চার বন্ধু শহরের এক পাশ চষে বেড়ালাম। ধুলো উড়িয়ে হেঁটে বেড়ালাম। নগরজীবনে কাছের বন্ধুরা সবুজ বনানীর মতো উজ্জ্বল।