ছুটতে ছুটতে চয়নের ছোট্ট বুকটায় হাঁপ ধরে যায়। পরনের শার্টের একটা বোতাম ছিঁড়ে কোথাও পড়ে গেছে। ছুটতে গেলে নদীর বাতাসে শার্টটা পিঠের দিকে ফুলে যায়। নিজেকে তখন সুপারম্যানের মতো লাগে।
সুপারম্যানের কথা ভাবলে মনটা উদাস হয়ে যায় তার। কতদিন টিভি দেখে না। মা এখন কেমন আছে? মা কি তাকে ভুলে গেছে? মায়ের কথা ভুলে থাকতে চায় অভিমানে। ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রাখে। কাউকে বুঝতে দেয় না তার কান্না। সে এখন বড় হয়েছে না? কদিন পরেই স্কুলে যাবে। অ আ ক খ লিখতে পড়তে শিখে গেছে ইতিমধ্যে।
মায়ের নাকি খুব অসুখ। অনেকদিন ধরে হাসপাতালে। সেই যে ভোরবেলা কাজে গেল, তারপর থেকে আর দেখেনি মাকে। বাবাও ঠিকমতো বাসায় আসেনি কয়েকদিন। সে পাশের বাসার খালার কাছে থাকতো। এরপর কয়েকটা দিন বাসায় হুলস্থুল চললো। গ্রাম থেকে নানা ভাই আসলো, নানু আসলো, আরো অনেকে। সবাই ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, কেউ কাঁদছে। সে কিছু চাইবার আগে হাজির করছে। কেন এত আদর সে বোঝেনি। সবাই এত আদর করে কিন্তু মার কাছে নিয়ে যায় না। মায়ের কি হয়েছে? মাকে দেখার জন্য সে অনেক কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু কারো মন গলাতে পারেনি।
সেদিন যখন মা কাজে যাচ্ছিল, চয়ন ঘুম থেকে জেগে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাকে বলেছিল আমার জন্য কি আনবা? মা বলেছিল, তোমার জন্য একটা রাজকন্যা পুতুল আনুম, সেই কন্যার হাতে থাকবে একটা সোনার বাক্স, সেই বাক্সে থাকবে চকলেট মিঠাই আচার চিপস আরো কত কিছু!
মা প্রায়ই এরকম সুন্দর সুন্দর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়। একেকদিন একেকটা। কিন্তু একদিনও মনে থাকে না তার। সন্ধ্যার সময় ঠিক খালি হাতে বাসায় ঢুকে। তবু চয়নের এসব বায়না করতে ভালো লাগে। মায়ের এই মিথ্যেটাকেও সে খুব ভালোবাসে। আসলে মা ঘরে ফিরলেই তার সব পাওয়া হয়ে যায়। দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে মায়ের গায়ের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়।
মা তার কপালে চুমু খেয়ে বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে রান্না বসায় চুলায়। কখনো তরকারি কুটে, পিয়াজ কুটে, মরিচ কুটে, কখনো বা গরম কড়াইতে স্যাঁয়াত করে ডিমভাজি করে। সে চুপচাপ মার পাশে ছোট্ট একটা পিড়ি নিয়ে বসে বসে এসব দেখে। খাবারদাবারের এই গন্ধটা তার খুব প্রিয়। খিদেটা কেমন চনমন করে ওঠে তখন। সে নিজের হাতে খেতে পারে এখন, তবু মা তাকে গরাস তুলে খাইয়ে দেয়।
মা অনেকদিন অসুস্থ থাকবে বাসায় ওকে কে দেখবে, তাই কিছুদিন পর নানাভাই তাকে নিয়ে আসলো তুলসীপুরে নানীর কাছে। সেই যে এসেছে আর ঢাকা ফিরতে পারেনি। নানীকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে দেখে মাঝে মাঝে। নানার সাথে ঝগড়া করে ঢাকা যাবার জন্য। কিন্তু নানাভাই রাজী হয় না। বলছে, চয়নকে দেখাশোনা করাই বেশী দরকার। তার মাকে দেখার জন্য হাসপাতাল আছে, সরকার আছে। আর আছে চয়নের বাবা।
বাবা কেন আসে না? বাবা তাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতো না। এখন কিভাবে ঘুমায়?
নদীর পাড়ে ছুটতে ছুটতে সে কান্না ভুলে থাকে, মাকে ভুলে থাকে।
নদীটা খুব মজার। পানি নেই বেশী। গ্রামের ছেলেদের সাথে সে নদীতে পা ডুবিয়ে খেলা করে। নদীতে জলধারা খুব ক্ষীণ, এখানে ওখানে সব বালির চড়া। মাঝে মাঝে হাঁটুজল। সেখানে নাম না জানা ছোট ছোট পোকা কিলবিল করে। ছোট্ট চয়ন গ্রামের দামাল ছেলেদের পিছু পিছু প্রতিদিন সকালের খেলাপর্ব সেরে দুপুরে বাড়ি ফিরে যায় শৈশবের ধুলোবালি মেখে।
উৎস
গত কমাসে এই গ্রামটা খুব চেনা হয়ে গেছে। এখানেই যেন জন্ম ওর। রাতে নানাভাইয়ের সাথে ঘুমায় সে। কালরাতে নানাভাইকে একটা মজার গল্প শুনিয়েছে। নানাভাই চোখ বড় বড় করে জানিয়েছে এত সুন্দর গল্প আগে কখনো শোনেনি। আসলে এই গল্পটা সে মায়ের কাছে শুনেছে। নানাভাইকে সে কথা বলেনি অবশ্য। সুন্দর গল্পের পুরস্কার হিসেবে নানাভাই তাকে বলেছে ঢাকা নিয়ে যাবে আগামী সপ্তায়। নানাভাই যখন বলেছে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে। নানাভাই কখনো মিথ্যে বলে না। কিন্তু আগামী সপ্তাহটা কতদূর?
পরদিন সকালে নানীর কাছে গিয়ে শার্টের বোতাম ছেঁড়া অংশটা দেখায়। এটা পরে ঢাকা যেতে পারব না। বোতাম লাগিয়ে দাও।
নানী পড়লো বিপদে। এই রঙের বোতাম পাবে কই? বললো, তোর নানা আসুক বাজার থেকে। বোতাম আনতে বলবো। কিন্তু তুই ঢাকা যাবি একথা কে বললো?
চয়ন জানালো, নানাভাই নেবে বলেছে। আগামী সপ্তায়।
নানী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দূরে তাকিয়ে কি যেন ভাবে। চয়ন বুঝতে পারে নানীরও মন খারাপ। তার ছোট্ট বুকের ভেতর মায়ের জন্য কেমন করছে। আগামী সপ্তাহ কতদূর আর? কালকেই আগামী সপ্তাহ? যদি তাই হতো? সপ্তাহ জিনিসটা সে এখনো বোঝে না। নানাভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আসুক আজ।
সেদিনই দুপুরের ভাতঘুম থেকে তাকে টেনে তুললো নানাভাই। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মাথার উপর একটা সুয়েটার গলিয়ে বললো, চল ঢাকা যাবো। সে অবাক। এত তাড়াতাড়ি সপ্তাহ চলে আসলো? মাথা আঁচড়ানোর সুযোগ না দিয়ে নানাভাই কেমন করে তাকে টেনে নিয়ে চললো। সাথে নানীও চললো। দৌড়ে দৌড়ে চলছে ওরা। সে ছুটতে থাকে পাশে পাশে। নানাকে কোন প্রশ্ন করে সঠিক উত্তর পাচ্ছে না নানী। বিরক্ত হয়ে চুপ করে গেল।
দুবার বাস বদলে যখন ঢাকা এসে পৌঁছালো তখন গভীর রাত। চয়ন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। ঘুমন্ত চয়নকে নিয়ে টেক্সিতে উঠলো নানা। টেক্সিটা যেখানে থামলো সেখানে অনেক মানুষের ভিড়, হৈ চৈ। তুমুল হৈ চৈ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল চয়নের। তাকে কোলে করে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে মাটিতে বিছানা পেতে আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে শুয়ে আছে কে যেন।
নানাভাই তাকে নিয়ে সেই বিছানার পাশে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে পেছন থেকে নানী এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ঘুমন্ত মানুষটার উপর। 'আমার নাসুরে নাসু! কেমনে তুই এই কাজ করলি? এখন আমি কি জবাব দেই তোর পোলারে???
চয়নের নানীর সেই কান্না ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত ঘরে, পাড়ায়, গুঞ্জন হয়ে ছড়িয়ে পড়লো ঢাকা শহরের ইথারেও। পরদিন সকালে দৈনিক পত্রিকাগুলোয় ঠাঁই পেল ছোট্ট একটা সংবাদ -যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় আহত নাসিমার আত্মহত্যা।
No comments:
Post a Comment