Tuesday, January 28, 2014

পোশাকী আলাপ

আমার একটা ফ্যাশন ভাবনা আছে। না, আমি ফ্যাশন বিষয়ে বোদ্ধা কেউ নই। ফ্যাশন আমার কাছে অতি দূরবর্তী বিষয়। আমি এমনকি এখনো ঠিকভাবে জানি না শব্দটা 'ফ্যাশান' নাকি 'ফ্যাশন'। আমি ফ্যাশনই লিখছি। আমার ফ্যাশন ভাবনা হলো মানুষের পোষাক আশাকের ধরণ। কেন মানুষ একেকসময় একেক রকম ফ্যাশন পাল্টায়। আমি নিজেও মাঝে মাঝে বদলাই। আমার বদলানো হলো কদিন টিশার্টে আসক্তি আবার কদিন ফতুয়ায় আসক্ত থাকা। কদিন কটন প্যান্ট পরতে থাকি, কিছুদিন ফরমাল প্যান্ট। কিছুদিন স্যু কিছুদিন কেডস দাবড়াই। এটাকে তেমন উল্লেখযোগ্য বলা যায় না।

আসলে আমি ঠিক চলতি হাওয়ার পন্থী নই। বরং উল্টো। বাজারে চলতি ডিজাইনের কোন পোষাক আমি পরি না। দুনিয়াতে যে রীতিই আসুক, আমি আমার ডিজাইনে থেকে যাই। আমার ডিজাইন হলো খুবই সরল। যদি শার্ট হয় তবে হাফ ফুল যেটাই হোক, বামপাশে একটা সাধারন পকেট, দুপাশে দু ইঞ্চি সাইজের দুখানা কলার, মাঝখানে পাঁচখানা সাদামাটা বোতাম। ব্যস। আমার এই শার্টের ডিজাইন চলছে গত ৩২ বছর ধরে। এর আগের কথা খুব বেশী মনে নেই, তাই বলতে পারছি না।

প্যান্টের ক্ষেত্রে দুপাশে দুটো পকেট, পেছনে দুটো ব্যাক পকেট, নীচের ঘের ১৭-১৮ ইঞ্চি। ব্যস। আর কোন ডিজাইন নাই। চলতি হাওয়া ঢোলা চিপা টাইট ফুলা ফোল্ডিং, কত জাতের ফ্যাশন আমদানী করেছে তার ইয়ত্তা নেই, কিন্তু আমি দিব্যি চোখ বন্ধ করে আমার নিজের ডিজাইনেই থেকে গেছি। ফলে একটা লাভ হয়েছে। চলতি ফ্যাশন ঘুরে ফিরে আমার লাইনেই চলে আসে। বুঝে গেলাম আমি ইউনিভার্সাল ডিজাইনই বেছে নিয়েছি। এই ডিজাইনে আমার দাদাকে দেখেছি, বাবাকেও, এখন আমি নিজেও। সুতরাং এখান থেকে নড়াচড়া করার কোন দরকার নেই।


আর্থিক অবস্থার সাথে পোষাক আশাকের পরিবর্তন ঘটবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। গরীব মানুষ ছেড়া লুঙ্গি আর ফুটো গেঞ্জি গায়ে ঘুরবে, আর বড়লোক স্যুটেড বুটেড হয়ে গাড়ি হাঁকাবে এটাই জগতের নিয়ম।

আমি গরীবও নই আবার বড়লোকও নই। মাঝামাঝিতে থাকলে সুবিধাও আছে মুশকিলও আছে। মুশকিল হলো বড়লোকদের সাথে তাল মেলানো। সুবিধা হলো গরীবি হালে থাকা। আমি তাই মুশকিলের চেয়ে সুবিধাটাই উপভোগ করি। বড়লোকী দোকান এড়িয়ে চলি। গরীবের মার্কেটে গিয়ে রুচিশীল জিনিস পছন্দ করি। পরিবারের সকলে চায় আমি আরেকটু দামী জিনিসপত্র কিনি। ব্র্যাণ্ডের জিনিস পরি। আমি নিজে সেটা করি না বলে সুযোগ পেলেই ওরা আমার জন্য দামী পোষাক আশাক কিনে উপহার দেয়। আমি তার শোধ নেবার জন্য মাঝে মধ্যে ওদের একটা শার্টের দাম দিয়ে সস্তা মার্কেট থেকে তিনটা শার্ট কিনে আনি। এরকম করতে গিয়ে দেখা যায় আমার পোষাক আশাকের পরিমাণ এত বেড়ে গেছে রাখার জায়গা নেই। ফলে প্রতি বছর আমাকে ডজখানেক ভালো জামাকাপড় বাতিল করতে হচ্ছে।


আমার মতে একটা মানুষের তিনটা শার্ট তিনটা প্যান্ট থাকলেই যথেষ্ট। ছাত্রজীবনে আমি ওই সংখ্যাটা খুব মেনে চলতাম। আমার কখনোই এর চেয়ে বেশী জামাকাপড় থাকতো না। এর বাইরে সবসময় পরার জন্য দুয়েকটা টিশার্ট বা কটন প্যান্ট থাকতো। ও হ্যাঁ এক খানা লুঙ্গিও থাকতো বটে।

আমি তেমন লুঙ্গি পরিনা কখনোই। ওটা কেবল পোষাক পাল্টানোর কাজেই ব্যবহার করি। লুঙ্গি পরে আমি কোনদিন ঘরের বের হয়েছি মনে পড়ে না। অথচ দেদারসে পরছে লোকজন, হাটে বাজারে ঘুরছে। আমি জানি লুঙ্গি খুব আরামদায়ক জিনিস। বিশেষ করে গরমকালে। কিন্তু ওই জিনিস আমার কাছে রিস্কি মনে হয়। আমি তাই প্যান্ট/ট্রাউজার পরেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি। ঘুমোবার জন্য ট্রাউজারই পছন্দ আমার।

বলছিলাম তিনটা শার্ট প্যান্ট থাকলেই যথেষ্ট। যখন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন আমি ছাত্র এবং বেকার। টিউশানিও করিনি কোনদিন। সুতরাং টাকাপয়সার জন্য ১০০% নির্ভরশীলতা বাবার উপরেই।

বাবা আবার ফ্যাশনবাজ লোক ছিলেন। আদিকাল থেকেই স্যুটেট বুটেড লোক হিসেবে দেখে এসেছি। পটিয়ার এক  প্রাচীন লোক একবার আমার সাথে পরিচিত হয়ে বলেছিল, পাকিস্তান আমলে পটিয়ার প্রথম টাই পরা লোক তোমার বাবা।  কথাটা আমার কাছে অতিরঞ্জিত মনে হলেও অবিশ্বাস করার কিছু নেই। কারণ একদম ছেলেবেলাতেই দেখেছি বাবার অগণিত টাই সম্রাজ্য।


সেই বাবা সাম্রাজ্য হারাবার পর কোন এক বছর ঈদে আমাদের জামাকাপড়ের টাকা দিতে পারছিলেন না। আমার বন্ধুরা তখন আড়ং থেকে পাঞ্জাবী কিনে পরছে। আমি তাদের কেনাকাটার সঙ্গি হয়ে নামী দামী দোকানে যাই কিন্তু কিছু কেনার কথা ভাবি না।  আমি জানি ওটা আমার কাপ অব টি নয়।

ভার্সিটি পড়ি তখন, বাবার দুঃখ দুর্দশা বুঝি। তবু একবার ঈদের সময় আড়ং এ গিয়ে বন্ধুর জন্য পাঞ্জাবি দেখতে গিয়ে খুব সাধারণ সুতীর একটা পাঞ্জাবীর উপর চোখ আটকে যায়। ঘিয়ে রঙের পাতলা সুতীর পাঞ্জাবীটায় কোন কারুকাজ ছিল না। একদম সাদামাটা। দামটাও যেন আমার সাথে মানানসই। ১৯৫ টাকা মাত্র। কিন্তু তখন ওই টাকাও আমার সামর্থ্যের বাইরে।

আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে বেরিয়ে আসি। এ বছর ঈদে বাবা কোন টাকা দিতে পারবেন না আমাদের জামাকাপড় বাবদ। আগামীকালই ঈদ। জামাকাপড় দূরে থাক, এমনকি খাবারদাবার কি রান্না হবে তাও জানি না। অবশ্য ওটা জানারও দরকার হয় না। মা ঠিক কিছু একটা বের করে ফেলে উপায়। তিনদিন বাজার না হলে রান্নার চুলা খালি যায় না মায়ের।

মায়ের যাদুর কাঠিতে আমরা তীব্র অভাবের দিনেও কখনো খাদ্য সংকটে ভুগিনি। আমাদের কয়েকটা কলাগাছ ছিল বাসার লাগোয়া। তার মধ্যে একটা আনাজি কলা বা কাঁচ কলা। ওই একটা গাছ থেকে মা যে কত রকমের খাবার বের করেছেন এখন অবাক হয়ে যাই। কলা তো আছেই তার উপর কলার থোড়, কলাগাছের ভেতরের নরোম শাঁস ইত্যাদি আইটেমের নানা উপাদেয় খাবার রান্না হতো।

বাসার সামনে একটা বাগান ছিল। ওখানে নানান জাতের কচু ঘেচু শাকের জঙ্গল ছিল। শহরে ওসব খাবার বিরল। মা ওখান থেকেই কত রকমের মজাদার খাবার আবিষ্কার করতেন। আমাদের সেই বাড়িটা ছিল শহরের মধ্যে ছোট্ট একটা গ্রাম।


বলছিলাম পাঞ্জাবির কথা। সেই পাঞ্জাবির জন্য মন খারাপ করে বাসায় ফিরে  ভাত খেয়ে ঘুম দেই সব ভুলে। বিকেলে ঘুম ভাঙতে দেখি মা রুমে এসে দুটো একশো টাকার নোট দিয়ে বললো, তোর ঈদের পাঞ্জাবি কিনে আন গিয়ে। সময় তো বেশী নেই।


আমি অবাক হয়ে যাই। মাকে বলিনি সেই পাঞ্জাবির কথা। কিন্তু কিভাবে যেন যাদু বলে জেনে গেছে মা।

সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে আড়ং এর শো রুমে চলে গেলাম। আড়ং তখন চৌমুহনী ফারুক চেম্বারের এক তলায়। ওখানে দুরু দুরু বুকে ঢুকে সেই পাঞ্জাবীর কাছে যাই। লোকজনের খুব ভিড়। ঈদের আগে শেষ কেনাকাটা। যে যা পারছে কিনে নিচ্ছে। পাঞ্জাবিটা আছে কিনা সন্দেহ।

কিন্তু ওই র‍্যাকের কাছে গিয়ে দেখি, আছে। কেউ নেয়নি। আসলে এটা বড়লোকদের জায়গা। কিন্তু ওই পাঞ্জাবি সবচেয়ে সস্তা, ঈদের সময় ওরকম পাঞ্জাবি কেনার কথা কেউ ভাবে না। আমার পকেটে দুশো টাকার দুটো কড়কড়ে নোট। আমি এখুনি চাইলে পাঞ্জাবীটার মালিক হয়ে যেতে পারি।


হঠাৎ করে মনটা ঘুরিয়ে ফেললাম। কেন যেন। নাহ, কিনবো না। কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম খালি হাতে। বন্ধুরাও পিছু পিছু আসলো। সবাই মিলে বাসে উঠে সোজা কোতোয়ালী মোড়। ওখানে কুমিল্লার খাদি দোকান আছে দুটো।

খাদি দোকানে ঢুকে একশো টাকায় একটা পাঞ্জাবি কিনে যখন রাস্তায় নেমে এলাম তখন আড়ং পাঞ্জাবির আক্ষেপ আমার সম্পূর্নই মুছে গেছে। আমি বুঝে গেছি পকেটে দুশো টাকার সাময়িক যোগান থাকলেও আড়ং যোগ্য হয়ে উঠতে ঢের দেরী। আরো অনেক বছর পর যখন আড়ং-যোগ্য হয়েছি তখনো আমি আড়ং পাঞ্জাবি কিনিনি। কেন যেন ইচ্ছে করে না। কোথাও একটা চেপে রাখা কষ্ট রয়ে গেছিল বলে?


এটা সেই তিনটে শার্ট তিনটে প্যান্ট যুগের কথা। সেই যুগে আমরা কয়েক বছরের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছিলাম। ওই সময়েই আমার চেনা হয় জহুর হকার মার্কেট। ওই মার্কেটটা ছিল বলে আমাদের মতো পরিবারগুলো ভদ্র সমাজে টিকতে পারতো। ওখানে প্রধানতঃ প্যান্ট সেলাই করাতে যেতাম। তখন ওখানে বিদেশী পুরোনো প্যান্টগুলো সেলাই খুলে সাইজমতো বানিয়ে দেয়া হতো। হানিমুন টেইলার্স নামে একটা দোকানে আমাদের কয়েক বন্ধুর যাতায়াত শুরু। ফিক্সড রেট। ১০০ টাকা। এত সস্তায় আর কোথাও প্যান্ট কেনার কথা ভাবতে পারতো না কেউ। ওই দোকান থেকে কয়েকটা প্যান্ট সেলাই করেছিলাম।

দোকানের নাম মনে থাকলেও সেলসম্যানটার নাম মনে নেই। চেহারা মনে আছে। তিনিও আমাদের নাম জানেন না। মুখ চেনা মানুষ। উনি আমাদের দেখলেই প্যান্ট নামিয়ে দেখাতেন যত্ন করে। আমরা দেখে পছন্দ করে কিনতাম। তার কারণেই আমরা আর কোন দোকানে যেতাম না।

কয়েক বছর আগে একবার ওই এলাকা দিয়ে যাবার সময় ইচ্ছে হলো দোকানটা দেখে যাই। আর্থিক স্বচ্ছলতা আসার পর গত দুই দশক এখান থেকে প্যান্ট বানাতে আসিনি। এই মার্কেট থেকে মাঝে মাঝে শার্ট কেনা হয় গার্মেন্টসের একটা দোকান থেকে। ১০০ নম্বর দোকান। তো ওই এলাকা দিয়ে যাবার সময় কয়েক বছর আগে হুট করে প্যান্টের গলিতে ঢুকলাম। সেই হানিমুন টেইলার্স আর সেই লোকটাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।

হানিমুন এখন চট্টগ্রামের খুব নামকরা দোকান। এখান থেকে বড় মার্কেটে চলে গেছে। তবু দেখলাম আদি দোকানটা এখনো আছে, আছে সেই লোকটাও। ভীষণ ভালো লাগলো। কত বছর পর। দেড় যুগের বেশী। আমি তাকে দেখে হাসিমুখে হাত বাড়ালাম। কিন্তু সে হাত বাড়ালো নিরাসক্ত ভাবে।


দোকানটা অনেক বদলে গেছে। পুরোনো প্যান্টের যুগ কবেই শেষ। এখন ঝকঝকে সব স্যুটের সারি, প্যান্টের সারি। এই মার্কেটের সবচেয়ে অভিজাত দোকান। ভালো লাগলো তাদের এই উন্নতিতে।


এটা সেটা কথার পর বললাম - একটা প্যান্ট দেখান তো। উপরের ওই প্যান্টটা। আগে এরকম দেখতে চাইলে চট করে নামিয়ে দেখাতেন। ওটার ডিজাইন দেখে পছন্দ হলে অর্ডার দিতাম। কিন্তু এবার উনি কেমন যেন রুক্ষ স্বরে বলে উঠলেন- প্যান্ট দেখানো যাবে না, অর্ডার দিলে কাপড় দেখে দেন। এত রূঢ় কথা শুনে আমি মানুষটার দিকে তাকালাম আবার। লোকটা এতটা বদলে গেছে? আমার আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না।কিছু না বলে ব্যথিত মনে বের হয়ে আসলাম।

কত মানুষই তো বদলে যায়, এ আর নতুন কি। কিন্তু ওই মানুষটার বদলে যাওয়াটা কেন যেন মেনে নিতে পারিনি।


এত বছর পর আমি আবারো সেই তিন প্যান্ট তিন শার্ট পলিসিতে ফিরতে চাই।  কেননা জামাকাপড়ের আধিক্যে আমি এখন রীতিমত হিমশিম খাই। আলমীরা ওয়ার্ডরোব সবখানেই ঠাসাঠাসি। এখন নিজে তেমন কিনি না, কিন্তু উপহারের বন্যায় ভেসে যাই। যেসব জিনিস আগে পরতাম না তাও উপহার পাই। আমি আগে জিন্স পরতাম না, মাত্র একখানা জিন্স কিনেছিলাম ভুটান যাবার সময়। এখন উপহারের ঠেলায় সেই জিন্সও হয়ে গেছে বেশ কয়েক খানা। হাল ফ্যাশনের জিন্স। পরলে বয়স বিশ বছর কমে যায়। জিনস, কর্ড, সিনথেটিক, কটন, গ্যাবার্ডিন নানান জাতের নানান ডিজাইনের প্যান্ট।

তিন-তিন ছয় খানা হলে যে আমার চলে যায় সেই আমার এখন জামাকাপড়ের সংখ্যা সেঞ্চুরী পার হয়ে গেছে। শার্ট টিশার্ট পোলো ফুল হাতা, আধাহাতা, শর্টস, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, কোট স্যুট জ্যাকেট সুয়েটার পুলওভার আরো কত কত হাবিজাবি। শীতকাল আসলে জামাকাপড়ের চাপে আমার আলমারীর দম আটকে যায়। সংখ্যায় বেড়েছে ঠিক, কিন্তু ডিজাইন সেই সেকেলেই রয়ে গেছে। সেকাল আমাকে ছাড়েনি, আমি সেকালকে ছাড়িনি। আমরা দুজন দুজনার হয়ে মহাকালে বিলীন হয়ে যাচ্ছি।

[একটি দড়ি ছেঁড়া লাইনচ্যুত ব্লগরব্লগর]

No comments: