ব্যাপারটা গোলমেলে। শিখার সাথে প্রায় দশ বছর পর দেখা হতে যাচ্ছে ফাহাদের। ফাহাদ দক্ষিন আফ্রিকা চলে গিয়েছিল শিখার বিয়ের আগের সপ্তাহে। শিখার বিয়ে হয় সোহেলের সাথে। বিয়েটা অনিবার্য ছিল কিন্তু ফাহাদের পক্ষে মেনে নেয়া অসম্ভব ছিল কারণ সে শিখাকে ভালোবাসতো। তাই শিখার বিয়ের আগেই দেশত্যাগ করে।
শিখা ফাহাদকে ভালোবাসলেও শেষ বিচারে বিয়ে করার জন্য বেছে নিয়েছিল সোহেলকে। কারণটা শিখাই জানে। ফাহাদ জানে না। সোহেল এসবের কিছু জানে না। আর কেউ জানে না। জানার কথাও না। তেমন কিছুই হয়নি ওদের মধ্যে। যা ছিল সবই অজান্তে। সোহেল শুধু জানতো শিখার সাথে ফাহাদের বন্ধুতা ছিল সহপাঠি হিসেবে।
দশ বছর পর দেশে ফেরা উপলক্ষে পুরোনো বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে গেট টুগেদারের আয়োজন করে ফাহাদ। সেখানে পুরোনো বন্ধু হিসেবে শিখাও সপরিবারে যোগ দেয়। ফাহাদ ছাড়া সবাই বিয়ে করেছে। ফাহাদ কেন বিয়ে করেনি সেটা নিয়ে কোন কৌতুহল নেই কারো। কারণ সে দশ বছর দেশে ফেরেনি। আফ্রিকায় কোন মেয়েকে তার পছন্দ হয়নি হয়তো। হয়তো বলার উদ্দেশ্য হলো আসল কারণটা কেউ জানে না।
শিখার সাথে ফাহাদের কিছু ছিল কিনা সেটা আর কেউ জানে না। শুধু শিখা জানে। ফাহাদ জানে শিখা তাকে ভালোবাসতো। মুখে কখনো বলেনি তবু সে জানতো। এখনো জানে। জানে বলেই শিখাকে আবার এত বছর পর কাছ থেকে দেখার জন্য এই আয়োজন।
বন্ধুরা ভাবলো এই অনুষ্ঠান তার নতুন জীবনে প্রবেশের কোন ইঙ্গিত। ফাহাদ নিজের পায়ে দাড়াবার জন্য এতদিন অপেক্ষা করছিল। আজ দাড়িয়ে গেছে। এখন নিশ্চয়ই তার ভবিষ্যত সঙ্গিনী সম্পর্কে কোন একটা ঘোষণা দেবে। কিন্তু ফাহাদের পরিবারও তেমন ইঙ্গিত পায়নি এখনো। এটা শুধু বন্ধুদের নিজস্ব বানোয়াট ধারণা।
নিমন্ত্রিত সব বন্ধু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। অস্বচ্ছল অসফল কোন বন্ধুকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। শুধু একজন বাদে। নাফিস কিভাবে সেই আসরে অতিথি হয়ে এলো সেটা ফাহাদ বুঝতে পারলো না। সে নিজে নাফিসকে নিমন্ত্রণ করেনি, কিংবা অন্য কাউকে বলতেও বলেনি। তবু নাফিস উপস্থিত হয়ে গেল সময়মত।
নাফিসও তাদের ক্লাসে পড়তো। কিন্তু অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে একটা ছোট চাকরীতে ঢুকে পড়েছিল জীবিকার তাগিদে। ছোট চাকরী থেকে সে আর বড় হতে পারেনি। পড়াশোনায় উজ্জ্বল থাকলেও আর্থিক উজ্জ্বল বন্ধুদের ভিড়ে নাফিস পরাজিত সৈনিকমাত্র। পরাজিত সৈনিকেরা উজ্জ্বল বন্ধুদের আড্ডায় খুব বেশী ঠাঁই পায় না। আর্থিক অবস্থার তারতম্য এইসব অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের তালিকা নিয়ন্ত্রণ করে। এই আসরেও তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। ফাহাদ তাকে বলেনি তবু আর কেউ হয়তো সাথে করে নিয়ে এসেছে।
নাফিসকে ফাহাদ অপছন্দ করে না কিন্তু তার উপস্থিতিটা ক্রমশঃ একটা অস্বস্তির জন্ম দিল ফাহাদের মধ্যে। অস্বস্তিটা নাফিসের আগমনের সময় ছিল না। বরং নাফিসকে প্রথম দেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সুন্দর মিথ্যে সাজিয়ে বলেছিল- দোস্তো, ভালো করেছিস এসে। তোর ঠিকানা জানা ছিল না বলে তোকে আগে বলা হয়নি।
আসরে মোট আঠারো জন। এ ওর সাথে, ও তার সাথে, সে ওর সাথে, এভাবে আঠারো জন মিলে আটত্রিশজনের কোলাহল জাগিয়ে আসর জমজমাট রসঘন আড্ডামূখর করে তুললো। প্রত্যেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাই গল্পগুজবের অধিকাংশই হলো রাজনীতি, সমাজের অবক্ষয় ইত্যাদি ঘুরে ক্যারিয়ার এবং রিয়েল এস্টেটে গিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটতে লাগলো। সাথে চলছে পাণীয়।
ফাহাদ খুব উপভোগ করছিল আসরটা। ভেতরের ঘরে হালকা পাণীয়ের ব্যবস্থা ছিল। বউদের সামনে খেতে যারা সংকোচ করে তারা ভেতরে গিয়ে খেয়ে আসছিল। আসর যখন সরগরমের চুড়ান্তে তখন ফাহাদ ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখার ফাঁকে ফাঁকে শিখার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল এই দশ বছরে সে কতটা বদলেছে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো শিখা সেই তরুনীই রয়ে গেছে, এখনো সবার চেয়ে উজ্জ্বল এবং শুভ্র। একটু মুটিয়ে গেছে যদিও, তবু একফোটা কমেনি সৌন্দর্য। সাজতে জানে শিখা। ওর মতো এত সুন্দর করে আর কাউকে সাজতে দেখেনি। সব মেয়েকে সাজার পর সুন্দর লাগে না।
ফাহাদের এখন কোন মোহ নেই তার প্রতি। কেবল বন্ধু হিসেবেই দেখছে। তবু সে নিজে জানে শিখাকে একটু কাছ থেকে দেখার জন্যই এই আয়োজন। শিখা এই ভীড় কোলাহল ছাড়িয়েও মাঝে মাঝে তার দিকে যে বিশেষ চাহনি দিচ্ছিল এটা খুব উপভোগ করছিল ফাহাদ। এই দৃষ্টিই বলে দেয় এখনো সে শিখার ভেতরে কোথাও রয়ে গেছে। এই ভালোলাগাটুকুর কোন তুলনা হয় না।
আড্ডার পর খাওয়াদাওয়া, খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই যখন ঘরের এদিক সেদিক ছড়িয়ে টুকরো টুকরো আলাপে সময় কাটাচ্ছে ফাহাদ তখন ঘুরে ঘুরে দেখছে সবার সবকিছু পাওয়া হলো কিনা, খাওয়া হলো কিনা, বিসদৃশ একটা দৃশ্যে তখনই তার দৃষ্টি আটকে যায়। দৃশ্যটা বিসদৃশ কেন লাগলো সেটা ফাহাদ নিজেও বুঝতে পারলো না। এত মানুষের মধ্যেও দুজন মানুষ খুব কাছাকাছি কথা আর দৃষ্টি বিনিময় করছে। কথাগুলো বিশেষ কোন কথা নয়। সাধারণ সাদামাটা কথা। সবাই শুনতে পারে তেমন কথা।
কিন্তু যে দুজন মানুষ কথা বলছে তাদের অত কাছাকাছি থেকে কথা বলার কথা না। তারা কখনো অত কাছে আসার মতো ঘনিষ্ট ছিল না। মেয়েটা ছেলেটার একদম কাছ ঘেষে দাড়িয়ে এবং এক হাতে ছেলেটার শার্টের বোতাম ঠিক করে দিচ্ছে। এত কাছাকাছি দুজন! ফাহাদের ভেতর সুক্ষ্ণ একটা ঈর্ষাবোধ ছড়িয়ে পড়লো। ছেলেটার সাদামাটা কথায় মেয়েটার চোখ থেকে যে মুগ্ধতা ছিটকে বেরুচ্ছে সে মুগ্ধতা দশ বছর আগে আরেকজনের জন্য ছড়াতো। মেয়েটা যে ভঙ্গিতে ছেলেটার কাছে দাঁড়িয়েছে সে ভঙ্গিতে আরেকজনের কাছে দাঁড়াতো। এই ভঙ্গীটা ফাহাদের খুব চেনা। ফাহাদ ওই মুগ্ধতায় বাগড়া দেবার জন্য কাছে এগিয়ে গেল।
কিন্তু মেয়েটার চোখ ছেলেটার মধ্যে এত গভীরতায় ডুবে আছে যে ফাহাদ কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও তাকে কেমন একটা অবহেলা করলো অথবা তাকে খেয়ালই করলো না। অস্বস্তি নিয়ে ফাহাদ ভেতরে চলে গেল। আরেক পেগ তরল গলায় ঢেলে একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে গেল।
এটা কোন বিশেষ ঘটনা নয়। এমনকি মেয়েটার স্বামীর চোখেও হয়তো তেমন লাগেনি। কিন্তু ওই দৃশ্যটা দেখার পর থেকে ফাহাদ কেমন অদ্ভুত একটা ব্যথা অনুভব করছে বুকের ভেতর। ভাবছে দশ বছরের ব্যবধান অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। তার অজান্তেই আরেকটি অধ্যায় কি ঘটে গিয়েছিল?
একটা সন্দেহ তাকে আহত করলো। সে জানে না ঘটনাটা সেরকম কিনা। তার ভাবনা মিথ্যা কিনা। এটা যাচাই করার কোন উপায় নেই। এটা কাউকে জিজ্ঞেসও করা যাবে না। তবু সে বুঝে ফেলেছে ওখানে কিছু একটা আছে। সামথিং ইজ দেয়ার। কী সেটা? এটা সোহেলের চোখে ধরা না পড়তে পারে, কিন্তু তার চোখ শিখাকে চেনে। শিখার দৃষ্টির সব ভাষা তার মুখস্থ।
শিখা আর নাফিসের মধ্যে কিভাবে এই ঘনিষ্ট যোগাযোগ তৈরী হলো সে জানে না। কিন্তু শিখার মতো উচ্চাভিলাসী নারী কখনো নাফিসের মতো পরাজিত সৈনিকের প্রতি এতটা মুগ্ধ হয়ে পড়বে এটা সে কিছুতেই মানতে পারলো না।
সবাই চলে যাবার পর একলা বিকেলে বারন্দায় বসে বসে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওড়াতে ওড়াতে ফাহাদ খুব গভীরে অনুভব করলো শিখার জন্য আর কোন গভীর অনুভুতি অবশিষ্ট নেই। গত রাতেও যে স্মৃতির আবেগে উদ্বেলিত হয়েছিল, আজ তার কোন অস্তিত্বই নেই। স্মৃতিগুলো যেন শিফট ডিলিট হয়ে গেছে হঠাৎ। এমন হয় কেন? একটা ব্যাপারে সত্য মিথ্যা যাচাই না করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলাটা কি ঠিক হবে? শিখার প্রতি এতকালের জমিয়ে রাখা স্মৃতিময় প্রেম মুহুর্তের মধ্যে মূল্যহীন হয়ে গেলো? ফাহাদ ভাবলো, আসলে কি সে শিখাকে ভালোবাসতো? ভালোবাসলে চট করে এতবছরের প্রেম ধপাস করে গর্তে পড়ে যেতে পারে ? আবার ভালো না বাসলে সামান্য একটা সন্দেহ এতটা আঘাত করতে পারে?
তাহলে কোনটা সত্যি? ফাহাদ চেষ্টা করে সন্দেহকে যুক্তি দিয়ে কাবু করতে পারে। কিন্তু সন্দেহ বড্ড ত্যাঁদর। একবার মগজে ঢুকলে আর রক্ষা নাই। ভাইরাসের মতো একের পর এক বংশবৃদ্ধি করতে করতে সুস্থ অনুভুতিগুলোকেও গ্রাস করে। তখন মানুষটা দাঁড়াবার জায়গাটার উপরও আস্থা রাখতে পারে না।
তাহলে কোনটা সত্যি? ফাহাদ চেষ্টা করে সন্দেহকে যুক্তি দিয়ে কাবু করতে পারে। কিন্তু সন্দেহ বড্ড ত্যাঁদর। একবার মগজে ঢুকলে আর রক্ষা নাই। ভাইরাসের মতো একের পর এক বংশবৃদ্ধি করতে করতে সুস্থ অনুভুতিগুলোকেও গ্রাস করে। তখন মানুষটা দাঁড়াবার জায়গাটার উপরও আস্থা রাখতে পারে না।
No comments:
Post a Comment