Thursday, June 22, 2023

০০- দক্ষিণের বারান্দা, একটি বিকেল, পুরোনো দিনের ফিরে আসা গান

I've seen you, beauty, and you belong to me now, whoever you are waiting for and if I never see you again, I thought. You belong to me and all Paris belongs to me and I belong to this notebook and this pencil. (Ernest Hemingway, A Moveable Feast)

১.
অদ্ভুত সুন্দর বিকেলটা ভরিয়ে দিতে গানটা বেজে উঠলো রেকর্ড প্লেয়ারে। ঠিক এই মুহূর্তে যেন গানটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। চোখ বন্ধ করে গানটা একবার দুবার তিনবার শোনা হলো। মহাকাল যেন এর মাঝে তিনবার প্রদক্ষিণ করে এলো। হাওয়ার মেঘ এসে বিকেলটা ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এই বিকেলের সাথে অন্য কোন বিকেলের তুলনা হয় না। বর্ষার হাওয়া মাতিয়ে রেখেছিল দক্ষিণের বারান্দা। তখনি গানের প্রজাপতিটা উড়তে উড়তে ভেসে এলো দূরালাপনীর নৈকট্য নিয়ে। অতঃপর অবশিষ্ট একটি বিকেল সুন্দর বিস্ময় জাগিয়ে চলে গেল আলগোছে। 


* * *
.....................
....................
....
...............................
...................
.......................
.................
.......................

অন্য বাগানের রঙধনু




অক্ষাংশ: ১৩.৫১সেকেন্ড, দ্রাঘিমাংশ ১৬-৩৭মিনিট
(২২ জুন ২০২৩)


২.

সাজানো বাগান আমার কখনোই ভালো লাগে না। আমি বরাবরই আগাছা প্রেমিক। অযত্নে বেড়ে ওঠা যেসব গাছ লতাপাতা এখানে সেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ আলো ছড়ায়, আমি সবসময় সেই আগাছাগুলো খুঁজে বেড়াই। এইসব ছোট ছোট ঘাসপাতার মধ্যে যে শৈল্পিক সৌন্দর্য আছে, সাজানো বাগান তার ধারে কাছেও নয়। চট্টগ্রাম শহর আদিকাল থেকে সেই বুনো জঙ্গলের আখড়া ছিল। এত বিপুল উদ্ভিদ বৈচিত্র্য পৃথিবীর কম শহরেই আছে। আমি যে কটি ভিনদেশি শহরে গিয়েছি তারা আধুনিকতায় আমাদের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে আমাদের ধারে কাছেও নেই। এত বিচিত্র ঘাসলতার জঙ্গল পৃথিবীর খুব বেশি অঞ্চলে নেই। চট্টগ্রামের সেই আদিম বৈচিত্রময় প্রকৃতি মানুষের সভ্যতার হাতে ধ্বংস হতে হতে ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। শহরের সৌন্দর্য রক্ষার দায়িত্ব যে কর্পোরেশন, তারাও এর মুল্য বোঝেনি কোনদিন। শহরের আদিম জঙ্গল কেটেছেটে ভিনদেশি একঘেয়ে ফুল পাতায় সজ্জিত করে সড়কদ্বীপ বাগান পার্ক। আদিম বন বনানীকে ধ্বংস করে কৃত্রিম বাগানের ওপর পাথরের প্লেটে শ্লোগান লেখা হয় - সবুজে সাজবে নগরী। সেইসব আরোপিত সৌন্দর্যের চেয়ে আমার কাছে একটি ঘাসফুল অনেক বেশি প্রিয়।

৩.

অক্ষাংশ: ১৪.৪২ সেকেন্ড, দ্রাঘিমাংশ ৮: ৩২ -১০:১৪ মিনিট
(২০ মার্চ ২০২৪)

বিকেল থেকে রোদ নরম হয়ে আসছিল। সন্ধ্যার আহবানে রাতের শীতল হাওয়া বসন্তকে রাঙিয়ে তুলেছিল। সফল রাত্রির মুখরতা।

Thursday, June 1, 2023

আমার বাবার মতো....ক্রমশঃ



(ষাটের দশকে বাবা)

প্রায় প্রত্যেক সন্তানের কাছে তার বাবা একজন মহানায়ক। কিন্তু আমার বাবা আমার কাছে কী ছিলেন সেটা আমি জীবদ্দশায় বুঝিনি। বাবা যখন কাছে ছিল তখন আমি বাবার দিকে ভাল করে তাকাইনি। সেজন্য আমার মধ্যে সামান্য একটু আক্ষেপ আছে। আমি বাবার খুব নেওটা ছিলাম একটা বয়স পর্যন্ত। বিদেশ যাবার আগ পর্যন্ত সেটা ছিল। বাবা যখন বিদেশ যায় তখন আমার ৯ বছর। ক্লাস ফোরে পড়ি। বাবা বছরে একবার আসতেন বিদেশ থেকে। এক মাস ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে যেতেন। আট বছর পর বাবা পাকাপাকিভাবে দেশে চলে আসেন। তখন আমি কলেজে উঠে গেছি। বাবার সাথে একটা দূরত্ব চলে এসেছে। স্বাভাবিক বয়সের দূরত্ব। আট বছরে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। আগের মতো বাবার কাঁধে উঠে যেতে পারি না যখন তখন। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। স্কুলের বন্ধু কলেজের বন্ধু পাড়ার বন্ধু। তাদের সাথেই আমার সময় কাটে। বাবার সাথে শুধু দরকারী কথা। আবদার আহলাদ ওসব আর কখনো করা হয়নি। কলেজ পেরিয়ে, ভার্সিটি শেষ করে চাকরিতে ঢুকে পড়েছি। খুব কঠিন প্রথম চাকরি। সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা। মাসে একদিনও ছুটি নেই। বাবার সাথে আর দেখাই হয় না ঠিকমত। দেখা হলেও কথা হয় না। আমি খুব ব্যস্ত। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। বাবা কিছু বলতে এলেও ভালমতন শুনতাম না। পরে শুনবো বলে এড়িয়ে যেতাম। আসলে আমার তখন প্রচণ্ড বিরক্তিকর একটা সময়। জীবনটা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এত কঠিন চাকরি, অথচ এত কম বেতন, যে কোন সময় চাকরি ছেড়ে দেবো। প্রতি মাসেই ভাবি এই মাসেই শেষ।

ওই সময়টা আমি বাবার কাছ থেকে একদম বিচ্ছিন্ন। আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধব সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। কারো জন্যই আমার সময় ছিল না। দাঁতে দাঁত চেপে কোনমতে টিকে থাকাই একমাত্র লক্ষ্য। বাবা তখন আমাকে নিয়ে কী ভাবতেন জানি না। কিন্তু আমার সামান্য চাকরি দিয়ে সংসারের তেমন কোন উপকারে আসতে পারছি না সেটা জানতাম। তবু আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম চাকরি পেতে কারো সাহায্য নেবো না। নিজের যোগ্যতায় যা পাবো সেটাই নেবো। এটা ছিল সেই চ্যালেঞ্জ। বাবা আমার প্রতি হতাশ হয়েছিলেন কিনা আমার কখনো জানা হবে না। কিন্তু আশাবাদী যে ছিলেন না সেটা টের পেতাম। আমার আর কিছু মনে পড়ে না। আমার চাকরি পাবার দেড় বছরের মাথায় বাবা হঠাৎ একদিন আমাদের ছেড়ে গেলেন। সেই ভোরবেলার কথা আমি জীবনে কোনদিন ভুলবো না। পহেলা বৈশাখের সেই ভোরবেলার কথা ভাবলে এখনো আমার চোখ ভিজে যায়। আমার সুস্থ সুন্দর সুপুরুষ বাবা সেদিন চিরতরে চোখের আড়ালে চলে গেল।

এখন মাঝে মাঝে পুরোনো দিনের ছবির অ্যালবাম খুলে বসি। দেখতে দেখতে ভাবি, আমার বাবার মতো সুপুরুষ আমাদের পরিবারের আর একটিও ছিল না। এখনো নেই। বাবা বেঁচে থাকতে এই কথাটা আমার কোনদিন মনে আসেনি কেন সেটা ভেবে খুব অবাক হয়ে যাই।

আমি বাবার মতো এত স্মার্ট কোনদিন হতে পারবো না। কখনো চেষ্টাও করিনি। আমার বাবা শুধু আমাদের পরিবার নয়। আমাদের পুরো গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে স্মার্ট মানুষ ছিলেন। মৃত্যুর পর বাবার এক বন্ধু আমাকে বলেছিলেন- 'তোমার বাবা পটিয়া থানার প্রথম টাই পরা মানুষ'। কথাটা শুনে আমি হেসে দিয়েছিলাম। এটা কেমনতরো যোগ্যতা আবার। কিন্তু বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে মনে হয় কথাটার মধ্যে সত্যতা থাকার সম্ভাবনা আছে। এত সুন্দর করে টাই বাঁধতে পারে তেমন লোক আমি খুব কম দেখেছি। স্যুট ছাড়া বাবার খুব কম ছবিই আছে। বাবার কতগুলো স্যুট ছিল, কতগুলো টাই ছিল আমি কখনো গুনেও দেখিনি। এখন ছবিটার দিকে তাকিয়ে আমার ভাবতে ভালো লাগছে, আমি খুব সাধারণ পুত্র। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন অসাধারণ। বাবা চলে যাবার পর সেই অসাধারণ রূপটি আমার চোখে পড়তে শুরু করেছে। বাবা কখনো জানবে না আমি এখন কতটা মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দেখি।

আরো পুরোনো কথা:

আমার বাবা আগাগোড়া স্বাবলম্বী মানুষ ছিলেন। তিনি যা কিছু করেছেন সব নিজের যোগ্যতায়, নিজের উপার্জিত আয় থেকে করেছেন। পৈত্রিক সম্পত্তির কানাকড়িও তিনি ভোগ করেননি। গ্রামের জমিজমা সম্পদ কিছুর লোভ করেননি কখনো। পঞ্চাশ দশক থেকে তিনি চট্টগ্রাম শহরে এসে দাদার সাথে থাকতে শুরু করেন। বাসা ছিল ফকিরহাট এলাকায়। দাদার টেইলারিং ব্যবসা ছিল সেখানে। দাদা বাবাকে গোসাইলডেঙ্গা জিআরকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই যে বাবা শহর চিনেছিল, তখন থেকে আগ্রাবাদ এলাকাতেই থিতু হতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে দাদা গ্রামে ফিরে গেলে বাবা শহরে চাকরি নিয়ে একাকী জীবনযাপন করতে শুরু করেন। বন্দরকেন্দ্রিক কাজ ছিল বাবার। একটা নামকরা শিপিং এণ্ড ফরোয়ার্ডিং কোম্পানিতে চাকরি করতেন। বিয়ে করেছিলেন ১৯৬৫ সালে। আমার জন্ম হয়েছিল সিজিএস কলোনীতে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বাবা আমাদের নিয়ে গ্রামে চলে যান। বাবা তখন অন্য জায়গায় বাসা নিয়েছিলেন। সম্ভবত ফকির হাটে কিংবা মোগলটুলীতে। ঠিক মনে পড়ছে না। বাবা যখন গ্রামে ছিল আমাদের নিয়ে শহরের বাসায় বোমা পড়েছিল একবার। বাবার বাসার আসবাবপত্র পুড়ে গিয়েছিল। স্প্রিং এর একটা বিদেশী খাট ছিল, সাথে স্প্রিং এর মেট্রেস। ওটার মাঝখানে বোমা পড়ে গর্ত হয়ে গিয়েছিল। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি ওটা। সত্তরের দশকে কলোনীতে বাসা নিয়ে আমাদের গ্রাম থেকে নিয়ে আসেন। ১৯৭৪ সাল থেকে আমরা পাকাপাকিভাবে শহরবাসী হই। তার আগের পাঁচ বছর বোয়ালখালী টু পটিয়া এভাবে ঘুরে ফিরে থাকতাম আমরা। গ্রাম থেকে চলে আসার পেছনে একটা পারিবারিক বিরোধ কাজ করেছিল। বাবা রাগ করে আমাদের নিয়ে চলে এসেছিল।

সেবার চলে আসাতে আমাদের জীবনটা নতুন মোড় নিয়েছিল। নইলে আমাদের গ্রামেই কাটাতে হতো সারাজীবন। ব্যাপারটা কেমন হতো জানি না। কিন্তু আমাদের পড়াশোনা স্কুল পার হতো না এটা নিশ্চিত। কারণ আমাদের সমতূল্য যারা গ্রামে আছে তাদের এইরকম অবস্থা সবার। বাবা শহরে ছোট একটা বাসা নিয়ে থাকতেন। সেই বাসাতেই আমাদের এনে তোলেন। তখন আমরা ভাইবোন তিনজন। এক রুমের একটা বাসা। কলোনীর সবচেয়ে ছোট বাসা ছিল। এইচ টাইপ। সেই বাসাতে আমাদের পাঁচ বছরের বেশি সময় কেটেছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০। ১৯৭৭ সালে বাবা হুট করে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। কিছুই বুঝতে পারিনি। কেন বাবাকে বিদেশ চলে যেতে হলো। আমাদেরকে গোমদণ্ডির নানাবাড়িতে রেখে চলে গিয়েছিলেন। কলোনীর বাসাটা তখনো ছিল। আমাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো। বাবা বিদেশ যাওয়ার পর কিছুদিন অনিশ্চিয়তা ছিল। কানাঘুষা শুনতাম বাবা কখনো ফিরবে না আর। আত্মীয়স্বজনদের কিছু ফিসফাস চলতো। আমার খারাপ লাগতো কিন্তু কিছু করার ছিল না। বোঝারও উপায় ছিল না। কিন্তু গ্রামে আমার ভালো লাগতো না। আমি শহরের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। গ্রামের স্কুলটা ভালো লাগেনি। সে কারণে বোধ করি বড় মামার ভরসায় আমরা কলোনীতে ফিরে আসি। আমাদের বাসায় মায়ের চাচাতো ভাই আলমগীর মামাকে থাকার জন্য বলা হয়। আমরা তাঁকে নিয়ে ওখানে থাকতাম। ওটা আমাদের খুব অনিশ্চিত একটা সময়। আমি ক্লাসফোর থেকে ফাইভে উঠলাম। বাবার চিঠি আসতো মাঝে মাঝে। টাকা পাঠাতো কিছু। বড়মামা আমাদের সেই টাকা দিয়ে যেতো। মাসে বোধহয় এক হাজার টাকা পাঠাতো। ওটাই অনেক টাকা আমাদের জন্য। বাসা ভাড়া ছিল দেড়শো টাকার মতো। দুবছর পর বাবা ছুটিতে আসেন। এক মাসের জন্য। আমাদের জন্য একটা বারো ইঞ্চি সাদাকালো টিভি এনেছিলেন। কী যে আনন্দ। এমন চমকপ্রদ জিনিস আমরা আগে কখনো দেখিনি। তবে মাসখানেক পর টিভিটা বিক্রি করে দেয়া হয়। টিভি দেখলে আমাদের পড়াশোনা নষ্ট হবে সে কারণে। তখনো ঘরে ঘরে টিভি চালু হয়নি। পুরো কলোনীতে দশটা টিভিও ছিল না। আমাদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে শুধু শাহীন আপার বাসায় টিভি ছিল। আর কারো টিভি নেই।

বাবা এক মাস ছুটির পর বিদেশে চলে যান আবারো। কিন্তু এবার আর অনিশ্চয়তা নেই। বাবা খুব ভালো একটা কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছেন। অনেক টাকা বেতন। সে আমলে অত টাকা বেতন পেতো না আমাদের আর কোন আত্মীয় স্বজন। মনে হয় ৫ হাজার রিয়াল। বাংলাদেশী টাকায় চল্লিশ হাজার টাকা হবে। হঠাৎ করে আমরা যেন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাই। আসলে আমাদের জীবনযাত্রার মান তেমন বাড়েনি। শুধু বাসাটা একটু বড় নিয়েছিল সেটাই। তবে আমাদের জীবনটা ঘুরতে শুরু করেছিল তখন থেকে। পরবর্তী অর্ধযুগ আমরা দারুণ আনন্দ এবং স্বচ্ছন্দ্যে কাটিয়েছিলাম। বাবা অনেক জমিজমা সম্পদ করেছিলেন। আট বছর বিদেশ থাকার পর ফিরে এসেছিলেন মোটা অংকের টাকা নিয়ে। ১৯৮৫ সালে। তখন আমি কলেজে উঠে গেছি।


আত্মতৃপ্তি সংলাপ
আমাদের খুব সামান্য মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল। সত্তর দশকে বাবা ছোট একটা বেসরকারি চাকরি করতেন। সংসার ভালোই চলতো। তবু আরেকটু উন্নত জীবনের লক্ষ্যে সত্তর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন বাবা। আট বছর পর বিদেশের পাট চুকিয়ে দেশে চলে আসেন। হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ফিরে আসার সময় মোটামুটি ভালো অংকের টাকাপয়সা এনেছিলেন। কিন্তু সেই টাকা দ্রুত শেষ হয়ে যায় মাত্র তিন বছরের মধ্যে। শেষ কয়েক বছর বাবা আর্থিক কষ্টে কাটিয়েছিলেন। আমার চাকরিজীবন শুরু হতে না হতেই বাবা মারা গেলেন ১৯৯৭ সালে। আমি ছাড়া বাকী সবাই তখন ছাত্রজীবনে। মা আর চার বোনকে নিয়ে আমার নতুন সংগ্রাম শুরু হলো। শহরে থাকার মতো একটা টিনশেড বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। আত্মীয়-স্বজন সবার মধ্যে আমাদের আর্থিক অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। তবু সেই জটিল অবস্থা কাটিয়ে উঠেছিলাম অল্পদিনের মধ্যে। যে পরিবার কিভাবে চলবে সে দুশ্চিন্তা নিয়ে বাবা খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল, সে পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। বাবা কিছুই দেখে যেতে পারেনি। বাবা কখনো জানতে পারবে না বাবার পাঁচ সন্তানের সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পাঠ শেষ করতে পেরেছে, যাদের সাথে তাদের সংসার হয়েছে তারাও সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে পাশ করেছে। সবাই সম্মানজনক চাকরি বাকরি করছে। বাবার সন্তানদের মধ্যে দুজন পিএইচডি করছে। একজন দেশে, আরেকজন ইউরোপের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে একজন। বাবা কখনো জানতে পারবে না বাবার রেখে যাওয়া অসহায় ছেলেমেয়েগুলো সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে উঠে দাঁড়িয়েছে। সফলতার মুখ দেখেছে। নিজ নিজ চেষ্টায় বাবার মুখ উজ্জ্বল করেছে সবকটি ছেলেমেয়ে। কারো কাছে হাত পাততে হয়নি, সবাই বড় হয়েছে নিজ নিজ যোগ্যতা দিয়ে। এটাই সবচেয়ে বড় আত্মতৃপ্তির বিষয়। টাইম মেশিন থাকলে বাবা এসে দেখে আনন্দিত হতো। এ সময়ে বাবাকে আমি খুব মিস করি। বাবা যে সময়ে সংকটে পড়ে গিয়েছিলেন, আমি সে বয়সে এসে পৌঁছেছি বলে আজকাল বাবার কথা বেশি মনে পড়ে। বাবার কষ্টগুলো আমি অনেক বেশি করে অনুভব করি। বাবা যে বয়সে চলে গিয়েছিলেন সে বয়স থেকে আমি মাত্র কয়েক বছর দূরে। এই বয়সে পৌঁছে আমি জীবনকে নিয়ে তৃপ্ত, কৃতজ্ঞ। জীবনের কাছে আমার আর কোন পাওনা নেই। বাবার রেখে যাওয়া শূন্য পরিবারটি এতদূর আসতে পেরেছে সেটা অনেক বড় সাফল্য।