Tuesday, March 29, 2016

A-B-C ....... টিকে থাকার তিনটে সুত্র

Assume nothing

(কেবল অনুমানের উপর ভিত্তি করে কোন সিদ্ধান্ত নিও না হে মানব!)

Believe no-one

(বিশ্বাস করে ঠোক্কর খাবার চাইতে অবিশ্বাসের ঠোঙা নিয়ে চানাচুর খাও!)

Check everything

(ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নিয়েই সতর্ক থাকো, যে পকেটে প্রতিদিন হাত ঢুকাও সেখানেও ফুটো থাকতে পারে!)

---------------------------------------------------------------------------------------------

দুনিয়াতে টিকে থাকার পরীক্ষিত এবং সহজ তিনটা সুত্র!

অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি

পড়ার এতকিছু বাকী রয়ে গেছে যে লেখালেখি করতে গেলে মনে হয় সময় নষ্ট। লেখার চেয়ে পড়া জরুরী। তখনই লিখবো যখন পড়ায় মন বসে না।


আট বছর ধরে শুধু হাবিজাবিই লেখা হলো। সেই আবর্জনা স্তুপে গল্পের সংখ্যা যখন শতাধিক দেখলাম সত্যি অবাক হলাম কেননা তার মধ্যে দশখানাও ছাপার অক্ষরে যাবার যোগ্য মনে হয় না।


ছাপার অক্ষরে যাবার যোগ্য গল্প কোনগুলো? যে গল্প লোকে পয়সা দিয়ে কিনবে। লোকে পয়সা খরচ করে কিসের জন্য? আনন্দ আর তৃপ্তির জন্য। কিরকম গল্প পড়ে পাঠকের আনন্দ হয় সেটা কি লেখক জানে? কোন একজন লেখক বলেছিলেন, তিনি লিখেন নিজের আনন্দের জন্য। পরে পাঠক তাতে যোগ দেয়। আমার নিজের গল্পের ব্যাপারে পাঠকের যোগদান বিষয়ে আস্থাহীন হলেও বাংলা ব্লগের বেশ কিছু তরুণ লেখক আছেন যাদের লেখা ছাপার অক্ষরে আসেনি কখনো, তাদের গল্পগুলো ছাপার অক্ষরে দেখতে ইচ্ছে করে। মূলধারার পাঠকের কাছে পৌঁছানো দরকার গল্পগুলো। কিন্তু কে নেবে প্রকাশের দায়?


আমি কিছু প্রতিভাবান তরুণ লেখকের গল্পের তালিকা করেছিলাম, পাণ্ডুলিপিও তৈরী করেছিলাম যদি কোন প্রকাশক খুঁজে পাই, দিয়ে দেবো। এখনো দেয়া হলো না।



Monday, March 28, 2016

মানুষের কাছ থেকে অমনুষ্যত্ব শিক্ষা

হে মানুষ আমি তোমাদের দেখে দেখে পাশবিক সততা হারিয়ে মনুষ্যত্ব লাভ করতে শুরু করেছি বলে অামাকে পশু সমাজ ত্যাগ করেছে৷

আমাকে এবার এক টুকরো মানবাধিকার দাও যাতে আমি কিছু মানুষসুলভ নির্লজ্জ কুৎসিত অপকর্ম সাধন করতে পারি৷

"জনৈক সমাজচ্যুত কুকুর"

আগাছার ফুল

বাজারের চোখে এই তুচ্ছ আগাছাগুলো মূল্যহীন৷ কিন্তু প্রখর রোদ ছেঁকে নিজের খাদ্য নিজে সংগ্রহ করে, সকল অবহেলা উপেক্ষা করে এরা কি করে যেন বাঁচার আনন্দটুকু আদায় করে নেয়৷ এটাকেই কী যোগ্যতা বলে?

Sunday, March 27, 2016

আঁধার ঘনিয়ে আসে যদি ...........

যাদের চোখে অঢেল আলো আছে তারা আলোহীনতার অসহায়ত্ব উপলব্ধি করে না। আলো আছে বলেই জগতের সুন্দর অসুন্দর সবকিছু দেখে। উপভোগ করে জীবনকে। যাদের চোখে আলো নেই তাদের জীবন কিভাবে কাটে সেটা আলোর মানুষেরা বোঝে না।


আজ আমার একটি চোখের ওপর হঠাৎ করে যখন কালো বৃত্তটি এসে যখন আড়াল করে দাঁড়ালো, তখন ছোট্ট একটা আশংকা দীর্ঘ ভাবনার পথ দিয়ে ঘুরে এলো।


সমস্যাটি গুরুতর কিনা সেটা বোঝার জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তার আগে একটি সত্য উপলব্ধির উদয় ঘটলো সেটা লিখে রাখি। এখন যে বৃত্তটি ডান চোখের কেন্দ্রে আড়াল তৈরী করেছে, বামদিকে যদি সে আরেকটি বন্ধুকে পাঠিয়ে দেয় তাহলে সমস্ত জগত কালো সানগ্লাসের আড়ালে চলে যাবে। আর সাথে সাথে রাশি রাশি না পড়া বই, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, আমার সমস্ত জগত অর্থহীন হয়ে যাবে। নিমেষে পুরোটাই অন্ধকার।


তাই অনাগত ভবিষ্যতকে বলে রাখি - যা কিছু ঘটার ঘটুক, দূরের দৃষ্টি ঝাপসা হয় হোক, কিন্তু কাছের চোখ জুড়ে একটুখানি আলো থাকুক। এক ফুট বাই দেড়ফুট পর্দাটুকু অটুট থাকুক।

Wednesday, March 23, 2016

বন্ধু সেইজন, যে ধারণ করবে তোমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর


খলিল জিবরানের এই কবিতাটি আমার খুব প্রিয়। অনুবাদটা পড়ে একটা জিনিস বুঝলাম, অনুবাদকের শুধু ভাষাজ্ঞান থাকলেই হয় না। তার ভেতর কবিতার শেকড়ও থাকতে হয়। আমি জিবরানের এই কবিতার আরেকটা অনুবাদ পড়েছিলাম যেটা পড়ে ধর্মগ্রন্থ পাঠের অনুভূতি হয়েছিল এবং তাতে কোন বক্তব্য খুঁজে পাইনি যেটা এই অনুবাদে খুবই চমৎকার ভাবে এসেছে। Hasan Murshed এর ভেতর নিঃসন্দেহে নীরব একজন কবি বাস করে তা এই অনুবাদেই পরিষ্কার।


"বন্ধু তো সেইজন, যে ধারণ করবে তোমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর।
তাকে দেখেই তোমার চোখে মুখে জাগবে ধ্বনিত ধৈবত।
তুমি বুঝতে পারবে আলো, আলো আসছে...।
সে হবে তোমার ঐশ্বর্য যা তোমাকে দান করবে জীবনের উষ্ণতা।
তুমি তোমার দু'চোখ তৃষ্ণার মতো তুলে ধরবে তার দিকে আর সেই হবে তোমার তৃষ্ণা নিবারণী।
যখন সে তার হৃদয় উন্মুক্ত করবে, তোমার কাছে যত অন্ধকারই হোক তা -
তুমি ভয় পেয়ো না। আর বন্ধুকে কখনো "না" বলো না...।
যখন সে মৌন তখন কিছুটা সময় তাকে একা থাকতে দাও। তার নিজস্বতাকে তুমি তছনছ করো না।
শরতের স্নিগ্ধ আলো হও, বৈশাখের খরতাপ হয়ো না।
বন্ধুতা তো সেই সর্গীয় অমরাবতী যেখানে অপার্থিব আনন্দের মধ্যে পাখিডাকা নিস্তব্ধতায় জন্ম নেয় স্বপ্ন, ইচ্ছে, আকাঙ্খা।
বন্ধুতায় কখনো দূরত্ব সৃষ্টি হলে ভেঙে পড়ো না।
সাময়িক দূরত্বে বরং অনুভূতি আরো স্পষ্ট হয়, যেমন সমতল থেকেই সবচে ভালো দেখা যায় পাহাড়চূড়ো।
বন্ধুতায় কখনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা রেখো না। ওটা তবে বন্ধুতা নয়। বন্ধুতা তো এক সংজ্ঞাহীন বেহিসেবি অনুভূতির আশ্চর্য অনুবাদ।
তুমি তোমার সবচেয়ে ভালো যা কিছু তা উৎসর্গ কর বন্ধুর জন্য।
সে যদি তোমার আবেগে ভাটা দেখে- তাকে জানিয়ে দাও এরপরই জোয়ার আসবে। তাকে কখনো মৃত্যু, হাহাকার, ধ্বংস দেখিও না।
বন্ধুর ভেজা হাতের আঙুল ছুঁয়ে তুমি বেঁচে ওঠো, তোমার হাত বাড়িয়ে তাকে বাঁচিয়ে তোলো।
তোমার দুঃসময়ে তাকে সহযোগিতার সুযোগ দাও, কিন্তু নিজেকে কখনো মূল্যহীন করো না।
আর দুজন পরস্পরকে আলোকিত কর, যে আলোর ভেতরে সব রঙের উৎসার ঘটে। সে আলো অনিঃশেষ ও শান্তিকামী।
এসব কিছুই জীবনকে দেয় কোমল সকাল, স্নিগ্ধ সজীবতা-
এসব নিয়েই বন্ধু...

এই তবে বন্ধুতা।"

(The Prophet by Kahlil Gibran. Translated by Hasan Murshed.)

Sunday, March 20, 2016

আনন্দপাঠ

আনন্দের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য খুব বেশী মানুষের হয় না। কাজের সাথে আনন্দের একটা বিপরীত সম্পর্ক বেশীরভাগ মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। জীবিকার জন্য যে কাজ করতে হয় তার মধ্যে পছন্দের ভাগ খুব কম। অনেকটা বাধ্য হয়ে আমরা সেই কাজটা করি। পেটের দায়ে এছাড়া আর কোন উপায় থাকে না আমাদের। আমি এই দিকে অন্য অনেকের চেয়ে বেশী বিরূপ সময় কাটিয়েছি। কেননা আমার অপছন্দ কাজের যাত্রা শুরু ছাত্রজীবন থেকেই। আমি যে বিষয় নিয়ে পড়তে চেয়েছি সেই বিষয়ে পড়তে পারিনি।


যে বিষয় নিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছি সেটা ক্যারিয়ারের জন্য লোভনীয় হলেও আমার কোনকালেই ওই দিকে ক্যারিয়ার গড়তে ইচ্ছে করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ বছর তাই আমি প্রায় ফাঁকি দিয়ে পার করেছি। একাডেমিক বইয়ের চেয়ে আউট বইয়ে বেশী সময় দিয়েছি। রেজাল্টের চড়ও খেয়েছি খুবই সঙ্গত কারণেই। তবু পাশ করে বেরুবার পর জীবিকার জন্য ভিন্ন একটা বিষয়কে বেছে নিয়ে শুরু করলেও অগ্রগতিটা খারাপ হয়নি। অন্ততঃ আমি তাতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। প্রথম পাঁচ বছরের অমানুষিক পরিশ্রমটা বৃথা যায়নি। পুরস্কারে পুরস্কারে জর্জরিত হয়েছিলাম সেটাও সত্য। পেশা বদল না করেও তাই আর দশজন সফল মানুষের কাতারে কাটিয়ে দিয়েছি ২০ বছর।


তবে শেষ পাঁচ বছর একদম ক্যারিয়ার উদাস জীবন কাটিয়েছি। ওই সময় থেকে আমার নতুন জগতে বিচরণ শুরু। যেখানে প্রাধান্য ছিল বইপত্র পড়াশোনা জগতের। বয়স ৪০ পেরোবার পর আবারো সেই জগতে ফিরবো সেটা পরিকল্পিত কোন ব্যাপার ছিল না। সময়ের নির্দেশে যেন আমি নতুন পথে যাত্রা শুরু করি। বৈষয়িক বিষয়সমূহ আমাকে বিপুলভাবে বিব্রত করেছে, যন্ত্রণা দিয়েছে বলে তার কাছ থেকে মুক্তির জন্য আমি নতুন পথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ি। যারা আমাকে ক্যারিয়ারিষ্ট ভেবে ভুল বুঝতো, তাদেরকে বিস্মিত করে একদিন আমি জীবিকার প্রচলিত পথে ইতি টেনে দিলাম একদিন।


তারপর থেকে আমি স্বাধীন। তবে পছন্দের কাজের সন্ধানে ছিলাম। একসময় একটা পছন্দের কাজ করতেও শুরু করলাম এক বন্ধুর সাথে। আমার এক শুভাকাংখীর বদান্যতায় কাজটি পেয়ে যাই। প্রযুক্তির আশীর্বাদে শুধু একটি ল্যাপটপ সম্বল করে নতুন জীবিকায় কাজ শুরু। সীমিত আয় হলেও এই কাজটিতে আমি সন্তুষ্ট কেননা আমাকে দৈনিক ১৪ ঘন্টা কাজ না করে ৪ ঘন্টা কাজ করলেও হয়। বাকী সময় আমি নিয়োজিত করতে পারি নিজের পড়াশোনার জগতে। বইপত্রের জগতের জন্য এতটা সময় রাখাটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে কারো কারো কাছে। বিশেষ করে যারা জীবনটাকে শুধু আর্থিক প্রয়োজনে ব্যয় করাকেই একমাত্র সাফল্য বলে মনে করেন।


এটা অনস্বীকার্য যে অর্থ জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান এবং আমার এই নতুন পথের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে উত্তরাধিকারসুত্রে অর্জিত কিছু বৈষয়িক ভিত্তির কারণে। নইলে এতটা সীমিত আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে পড়াশোনার জন্য সময় ব্যয় করাটা বিলাসীতার নামান্তর হতো। তাই আমি যে পথে হেঁটেছি সেই পথে আর কাউকে আসতে বলি না। প্রতিটা জীবনের ছক আলাদা, প্রয়োজন আলাদা। যে যার জীবনের অবস্থান অনুসারে সাজাবে। আমি আমার জীবনের বাকী সময়টার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে পারলে খুশী হতাম। সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু আমি জানি না আয়ুষ্কালের কতখানি আমার হাতে আছে। দীর্ঘমেয়াদী কোন স্বপ্ন নেই আমার। কখনোই ছিল না। আমি ভবিষ্যতকে সবসময় ধূসর দেখি। আজকের দিনটাকেই হিসেব করি সফল কিংবা ব্যর্থতার। জীবনযাপন কিংবা সম্পর্কযাপন সবকিছুর ভূমিকা আছে এই সাফল্য কিংবা ব্যর্থতায়। সম্পর্কজগতের কোথাও যদি ভারসাম্যহীনতার ঘটনা ঘটে, তখন আমার দৈনন্দিন রুটিনে ব্যাঘাত ঘটে, আমি পিছিয়ে পড়ি। যদিও এইসব ঘটনা কেবলি মনোজগতের সাথে সংশ্লিষ্ট, তবু বাস্তব জগতে তার প্রতিক্রিয়াকে তুচ্ছ করার কোন উপায় নেই।


ইতিহাস একটি নীরস বিষয় হলেও উপস্থাপনার গুনে সেটি কী চমৎকার একটি বিষয় হয়ে উঠতে পারে সেটা জেনেছি সচলায়তনে 'সত্যপীরে'র ঐতিহাসিক বিষয়ে লেখা অসাধারণ গল্পগুলো পড়ে। সেদিন হাতে পেলাম শাহীন আখতারের 'ময়ূর সিংহাসন'। নতুন কোন বই হাতে পাবার পর স্বভাবত সেটি রেখে দেই পরে পড়বো বলে। আগে হাতের কাছে জমে থাকা আগের বইগুলো শেষ করি। কিন্তু ময়ূর সিংহাসন ই-বইটি পাবার পর খুলে একটা পাতা দেখে রেখে দেবো ভাবছিলাম। কিন্তু সেই এক পাতা কখন যে ৩০ পাতা হয়ে গেছে টেরই পাইনি। যখন এরকম গড়গড় করে পড়ার মতো বই পাওয়া হয় তখন আর কিছু লাগে না। বাকী বইগুলো জমা রেখে ওটাতেই মন পড়ে থাকে।


বইটি পড়ার পেছনে আগ্রহের অন্যতম কারণও হলো ইতিহাস। এই বইটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস যেখানে মোগল সাম্রাজ্যের এক দুর্ভাগা শাহজাদা সুজার পলাতক জীবনের উপর রচিত। এই শাহসুজা আওরঙ্গজেবের ধাওয়া খেয়ে সপরিবারে সসৈন্যে সেই ভারতের রাজমহল থেকে পালিয়ে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পেরিয়ে আরাকানে উপস্থিত হয়। বইটি শাহসুজা পরিবারের সদস্যদের এক একটি জীবন্ত চরিত্রের বয়ানে রচিত বলে পড়তে পড়তে প্রামাণ্যচিত্রের রূপ উদঘাটন করা যায়। শাহসুজা আরাকান পালিয়ে যাবার পর তাঁর ও পরিবারের দুর্দশা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত। যে গল্পগুলো নানান বয়ানে নানারকম মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠেনি, আগাগোড়া ধোঁয়াশা।


এই বইটি সেই ধোঁয়াশা দূর করে দিচ্ছে বলে পড়ার আনন্দ বেশ কয়েকগুন বেড়ে গেছে। এই বইটি পাবার পর হাতে আসলো ফরাসী পর্যটক বার্নিয়েরের ভ্রমণকাহিনীর অনুবাদ 'বাদশাহী আমল'। সেই একই সময়কালে, সেই একই ঘটনার বর্ননা বইটিতে আছে বলে, ময়ূর সিংহাসন শেষ করে বাদশাহী আমল পড়া শুরু করার ইচ্ছে। চট্টগ্রামে মগ ফিরিঙ্গী শাসন অত্যাচার ইত্যাদি নিয়ে রিজিয়া রহমানের 'উত্তর পুরুষ' পড়া হয়েছে মাত্র গত সপ্তাহেই। এই সপ্তাহটা মোগল ভারতের ইতিহাস বিষয়ক এই অংশেই কেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে। পড়তে গেলে লেখা হয় না, লিখতে গেলে পড়া আগায় না। আবার না পড়লে লেখা যায় না। দুই দিকেই মুশকিল জিইয়ে রেখে শুধু পড়াটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নিয়েছি আপাতত।



মানবিক দুষ্টচক্র

প্রতিটি মানুষ একেকটি চক্রে আবদ্ধ। যে যার চক্রে জনমভর ঘুরে মরতে থাকে। একেকটা মানুষের চক্র একেক রকম। প্রতিটি চক্রই যেন একেকটি পূর্বনির্ধারিত নিয়তির সৌরজগত। নিয়তি মানে কী? যা থেকে সে বের হতে পারে না? যেখানে তাকে অনিবার্যভাবেই ঘুরতেই হবে চিরকাল?

কারো কারো এই চক্র ভাঙ্গার ক্ষমতা থাকে, নিজের ভেতরেই সুপ্ত থাকে চক্র ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার শক্তি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ হয়তো সেই শক্তিকে দেখতে পায় না। কেউ ধন সম্পদের চক্রে ঘোরে, কেউ ক্ষমতার চক্রে ঘোরে, কেউ বা নিরাশার।

মানুষ খুব অসহায় একটা প্রাণী। শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান নিয়েও মানুষ কোথাও কোথাও খুবই হীন। নিজের হীনতাকে না দেখার একটা প্রবণতা সব মানুষের থাকে, কিছু মানুষ থাকে একদমই অন্ধ। চোখ আছে ঠিকই, সেই চোখে নিয়মিত তাকানোর কাজটা করেও, কিছু কিছু ব্যাপার দেখে না। তারা চোখ মেলে তৃতীয় অবস্থানে দাঁড়িয়ে চাইলে নিজের ভুলগুলি সনাক্ত করতে পারে। কিন্তু এক দুর্বিনীত অহংবোধ সেই ভুলগুলোকে সনাক্ত করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে বিনয় থাকতে পারতো, সেখানে থাকে বিনয়ী অহংকার। সুস্থ আত্মাকে ধ্বংস করার পথে বিনয়ী অহংকারের জুড়ি নেই। শ্রেষ্ঠ প্রাণীত্বের অস্তিত্ব নিয়ে আত্মশ্লাঘায় ভোগা মানুষ এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মুক্তি পায় না। চক্র ভাঙ্গার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে তখন হাতপায়ে বেড়ি নিয়ে নিজের সৃষ্ট যন্ত্রণার জালে আটকে থাকে। মানুষের এই পরিণতিটা মর্মান্তিক।

অন্যন্য প্রাণীর মতো মানুষের আয়ুও খুব সীমিত। সেই সীমিত আয়ুতেও মানুষের চরিত্রের ক্রমাগত বিবর্তন ঘটতে থাকে। দশক দশক ধরে মানুষ এক রকম থাকে না। বয়স, পরিবেশ, সামাজিক অবস্থান ভেদে মানুষের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কিছু কিছু পরিবর্তন শুভশক্তির  উত্থান ঘটায়, কিছু কিছু পরিবর্তন অশুভ পথে চালিত করে। এই পরিবর্তনগুলোর যে সমস্ত অনুঘটক সক্রিয় তা সবসময় মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আবার কিছু কিছু অনুঘটক মানুষ নিজের কর্মফলেই তৈরী করে। উন্নতি বা অবনতি দুই ক্ষেত্রেই এই অনুঘটকের ভূমিকা থাকতে পারে।

নিয়তি বিতর্কে দুটো উপাদানকে জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। একটি হলো জন্মগত অবস্থান আরেকটি হলো কর্মযোগ। জন্মগত অবস্থানে মানুষের কোন হাত থাকে না, কিন্তু কর্মযোগ সম্পূর্ণই নিজস্ব সৃষ্টি। মানুষ যে পথ দিয়ে অগ্রসর হয় সেটাকে কর্মযোগের ফলাফল বলা যায়।

ভবিষ্যত একটি রাস্তার নাম, যে রাস্তায় কতগুলো বাঁক আছে, কতগুলো খানাখন্দ আছে আমরা জানি না। কিন্তু আমরা এটা জানি যে বাঁকটা বেশী ঘোরালো হলে সেখানে গতি কমাতে হয়, যদি খানাখন্দ দেখি সেটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। এখন আমি সামনে বাঁক দেখেই যদি গতি না কমাই তাহলে আমার দুর্ঘটনায় পড়ার যে সম্ভাবনা তাকে আমি জন্মদোষে দুষ্ট করতে পারি না। খানাখন্দ দেখেও যদি আমরা তাতে পা বাড়াই তাহলে হোঁচট খাবার জন্য নিয়তিকে দোষী করতে পারি না।

তবে ভিন্ন ঘটনাও ঘটতে পারে। আমি কোন বাঁকে পৌঁছে নিয়ন্ত্রিত গতিতে অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও উল্টোদিকের অনিয়ন্ত্রিত গতির বাহন দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি। সেটাকে বলা যায় দুর্ভাগ্য অথবা অনির্ধারিত দুর্ঘটনা।

ভুল থেকে কোন মানুষই মুক্ত নয়। কিন্তু পুনরাবৃত্ত ভুলকে কী বলা যায় যদি তা নিউটনের প্রথম সুত্রের মতো ঘটতেই থাকে। পদার্থের ব্যাপারে নিউটনের প্রথম সুত্রটিকে মেনে নেয়া গেলেও মানুষের ক্ষেত্রে সেটা মেনে নেয়া কঠিনই। মানুষের শ্রেষ্ঠতা এখানে কিছুটা কম্প্রোমাইজড হয়ে পড়ে। যেসব ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা ঘটে সেটাকে দুষ্টচক্র হিসেবে অভিহিত করা যায় ঠিক, কিন্তু মানুষই সেই দুষ্টের বীজ।

শেষ করছি ধার করা দুটো লাইন দিয়ে।
মধ্যযুগের সন্ত কবীরের দুটো লাইন পড়লাম জ্যোতির্ময় নন্দীর বাংলা অনুবাদে-

"খারাপ খুঁজতে গিয়ে দেখি, খারাপ মিললো না কেউ,

যেই নিজ মন খুঁজে দেখি, আমার চেয়ে খারাপ না কেউ।"


আমরা বিশাল সংখ্যক মানুষ এরকম খারাপে পরিপূর্ণ। তবু সাহস করে সত্যটা বলতে পারি না, চেপে রাখি সাধু সাজার বাসনায়। যারা চেপে রাখে না, যারা সত্যটা বলতে পারে তারা কর্মযোগে খারাপ হলেও নিশ্চয়ই সকল ভণ্ডামি থেকে মুক্ত। কিন্তু তাদের সংখ্যা মানব সমাজে এতই ক্ষীণ যে আমাদের দৃষ্টিসীমায় তারা সহজে আসে না।


Saturday, March 12, 2016

সন্ধি বিচ্ছেদ

"সন্ধির সাথে যেদিন আমার বিচ্ছেদ ঘটলো সেদিন আমি ব্যাকরন বইয়ের বদলে অংক খাতা খুলে বসলাম। আমি অংকে খারাপ কিন্তু হিসেবটা ঠিক করা দরকার। কিন্তু হিসেব কি অত সহজে মেলে? সন্ধিকে আমি কত টাকা দিয়েছি, সন্ধি আমাকে কত টাকা দিয়েছে তার হিসেব মেলাতে বসে অংকের সাথে আমার ঝগড়া বেঁধে গেল। সেই ঝগড়া থামাতে কবিতার আশ্রয় নিতে হলো। কবিতা তার ছাতাটা খুলতে না খুলতেই দমকা বাতাস এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল সন্ধ্যারাগিনীর কাছে। সন্ধ্যারাগিনী তখন সূর্যাস্তের শেষ আঁচলে বসে অনুপম বেহালায় সুর মেলাতে বসেছিল। ঘনিয়ে এসেছিল ফাল্গুন ধুলোর অন্ধকার। তারপর রাত আরো গভীর হতে থাকলো। মধ্যপথ পেরিয়ে গেল ছায়াপথ। সহস্র মুহুর্তের রাগ অনুরাগ পেরিয়ে নিকষ অন্ধকার যখন সুদূর নীহারিকার ছিটকে আসা আলোক কণা বিতরণে ব্যস্ত তখন কোথাও থেকে চৌরাসিয়া এসে আমাকে বাঁশীর সুরে তুলে নিল। আমি ভাসতে ভাসতে ভাসতে.......উধাও হয়ে গেলাম সময়ান্তরালে।"

বাতিল কাগজের নীচ থেকে উঁকি দেয়া অক্ষরগুলো অমিতকে বিদ্রুপ করতে থাকলে অমিত পুরোনো একটি বই খুলে নিরীক্ষা করতে বসলো। প্রচ্ছদ ছেঁড়া বইটি সযত্নে রক্ষা করার সকল প্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়েছিল জলীয় বাতাস। পোকার হাত থেকে রক্ষা পেলেও সময় তাকে ক্ষয়িষ্ণুতার পথে এগিয়ে নিয়েছে বহুদূর। এখন আর ফেরার কোন পথ নেই।

ফেলে আসা শহরের সব স্মৃতিই ধোঁয়াশা হয়ে গেছে। ঘাসের গালিচার বদলে কংক্রিটের ফ্লাইওভারে ছেয়ে গেছে রাজপথ। কোথায় খুঁজবে সে মলিন হয়ে যাওয়া শার্টের পকেটে ভিজে যাওয়া চিরকুটে লেখা দোকানের মেমোটা। সংখ্যাগুলোর উল্টো পিঠেই ছিল একাগ্রতার ছয়টি শব্দ। পেন্সিলের লেখা কখনোই অক্ষয় থাকে না, ভিজে বাতাসই তা মুছে দেবার জন্য যথেষ্ট।

চৈত্রের আগমনী ধুলো মার্চপাস্ট করে সার্কিট হাউস পেরিয়ে থমকে দাঁড়ায় রক্তিম সড়ক বাতির বিচ্ছুরিত আলোয়। এই শহরে এখন সন্ধ্যে নেমে এসেছে। চৌরাস্তা পেরোবার হুকুম নেই তোমার। ধুলোর ঝড় স্তিমিত হয়ে নেমে যায় দেয়াল ঘেরা খোলা ময়দানের আশ্রয়ে।

Wednesday, March 9, 2016

গান কবিতা গজল নিয়ে খুচরো আলাপ

প্রযুক্তির কাছে আমাদের অশেষ ঋণ কেননা তার হাত ধরেই আমরা প্রতিদিন নতুন পুরোনো কত আনন্দ আবিষ্কার করি। মাঝে মাঝে গান কবিতার নেশায় ধরে। সেই নেশা নিয়ে দুই কলম লেখা যাক।

জগজিত সিং এর গানের সাথে আমার পরিচয় এবং প্রেম দুটোই ঘটেছিল এই গানটি  গানটি দিয়ে। তখন সম্ভবত আমি কলেজের শেষ দিকে, ইন্টার পরীক্ষা দেবো। ওই গানটি যখন শুনি তখন আমি জানতাম না যে তিনি বাঙালী নন। অথচ কী অদ্ভুত সুন্দর করে বাংলা গান গাইলেন। প্রথমবার শোনার পর আরো কত শতবার শুনেছি পরবর্তী বছরগুলোতে দুই যুগ পার হবার পরও গানের সূচনার সুরটা যদি দূর কোথাও থেকে ভেসে আসে, বুকের ভেতর স্মৃতিগুলো কেমন তোলপাড় শুরু করে। ইতিমধ্যে হিন্দি গজল পেয়ে যাই, তখন আরো বুঁদ হয়ে পড়ি জগজিতে।

একই সাথে আরো অনেকের গজল মুগ্ধতার সাথে শুনেও জগজিতকে আলাদা ভাবে পাই। কেন জানি না। তারপর আরো কিছুকাল পর বিটিভির কল্যাণে মির্জা গালিবের সিরিজটি দেখা হয় তখন আবিষ্কার করি অন্য এক জগজিতকে। যে জগজিত হয়ে পড়েন মির্জা গালিবের গজলের অনন্য রূপকার। আমরা জগজিতের কন্ঠের সৌন্দর্যে আবিষ্কার করি মির্জা গালিবকে। আমি জানি না জগজিত না গাইলে আমি মির্জা গালিবকে এভাবে ভালোবাসতাম কিনা। মির্জা গালিবের এই গজলটা এখনো বেদনা হয়ে বাজে।

কবিতার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে ব্রততী বন্দোপাধ্যায়ের সাথে। এক বন্ধুর কল্যানে তাঁর সাথে পরিচয়। সেই পরিচয়ে বুঝলাম এরকম আবৃত্তি এর আগে শুনিনি। বাংলাদেশে রবিশংকর মৈত্রীর কবিতা শুনে সেই যে ভীষণ মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়েছিলাম, তার অনেক বছর পর ব্রততীকে খুঁজে পেয়ে যেন তা পূর্ণতা পেলো। ব্রততীর না পাঠানো চিঠি  কবিতাটি আর কেউ এভাবে আবৃত্তি করতে পারতো কিনা জানি না। তাঁর কাছাকাছি একজনকে পেয়েছিলাম যার কন্ঠ এই আবৃত্তির মতো। কিন্তু তিনি আর আবৃত্তি করেন না আজকাল।

সেদিন ঘুরতে ঘুরতে আরো একটি কবিতার সন্ধান পেলাম যে কবির নামও আগে শুনিনি। আবৃত্তি শুনে কবি আবুল হোসেন খোকন সম্পর্কে আগ্রহী হলাম। প্রায় অচেনা এই কবির মেহেদী পাতা  কবিতাটিও অপূর্ব। একটি কবিতা লিখেও অনেকে বিখ্যাত হয়ে যান। একটি কবিতা আবৃত্তি করেও অনেকে বুকের খুব গভীরে স্থান করে নেন। রবিশংকর মৈত্রীকে ফেসবুকের কল্যাণে খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু তাঁর সেই আবৃত্তিটা আর কোথাও পাইনি।

প্রিয় কবি কে- জিজ্ঞেস করলে চোখ বন্ধ করে বলে দেই, জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু তার বাইরেও তো রয়ে গেছে অসংখ্য প্রিয় কবি। আবুল হাসান, জয় গোস্বামী, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুন সহ নাম ভুলে যাওয়া অনেক কবি। তবু জীবনানন্দের নামটা প্রথমেই আসবে কেননা জীবনানন্দ এমন একজন কবি যাকে বুঝতে বুঝতে কেটে যেতে পারে আস্ত একটা জীবন। মানুষ চিরকালই রহস্যের পুজারী।

****** ******* ********
লিখতে লিখতে বিকেলের চায়ের সময় হয়ে গেল। এক কাপ গরম লাল চা, যার উপর ভেসে থাকবে একটুকরো লেবু, একটুখানি আদাকুচি, তিনটে পুদিনা পাতা। ভরপুর একটা সুগন্ধী চা!