Thursday, February 25, 2010

জাতির বাংলা মেরুদণ্ড

১.
আজকালকার মায়েরা ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য ভীষন উদ্বিগ্ন থাকেন। কেবল মায়েদের কথা বলছি কারন উদ্বিগ্ন বাবা তেমন একটা দেখিনি। বাচ্চা যত ছোট উদ্বেগের মাত্রাও যেন তত ব্যাপক।

তিন বছর বয়সী বাচ্চার মা আফসোস করে বলে, “আমার ছেলেটা কিছুই পারে না, অথচ মেজো আপার ছোট মেয়েটা পাঁচটা মহাদেশের নাম মুখস্থ বলতে পারে। কি যে করবো এই ছেলেকে নিয়ে?”

শুনে প্রতিবেশী ভাবীও কম যান না, “আপনার ছেলে তো তবু সার্কের দেশগুলোর নাম জানে, আমারটা তো বাংলাদেশে কয়টা জেলা আছে তাও জানে না। কি করে মানুষ করি এটাকে?”

বাচ্চাকাচ্চার ভবিষ্যত নিয়ে এইসব উদ্বিগ্ন কথোপকথন কিছুক্ষন শুনলে আপনার মনে হবে দেশে আর যত সমস্যা আছে সব নস্যি। শিশুদের বিদ্যাসাগর বানাবার উপর কোন কথা নাই। এইসব মায়েরা সাধারনতঃ বাচ্চাদের ইংরেজী স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও পড়ানোর কথা ভাবতে পারেন না। অন্য জ্ঞান যাই হোক, বাচ্চার কচি মুখ দিয়ে যদি ফট ফট করে ইংরেজী কথা না বেরোয়, চলবে না। ফলে এরা ছোটেন শহরের নামকরা ইংরেজী স্কুলে। (ইদানীং খালি ইংরেজী স্কুলে পোষায় না, গ্রামার স্কুল লাগে)

আমার এক অর্ধশিক্ষিতা আত্মীয়া তাঁর বাচ্চাকে স্কুলে দেবার আগে থেকেই ইংরেজী জ্ঞানে পরিপক্ক করে তোলার চেষ্টা করছিলেন। যাবতীয় ফল-মুল-পশু-পাখী সমস্ত কিছুর নাম বাংলার আগে ইংরেজীতেই শিখিয়ে দিতে পণ করেছেন তিনি। একদিন সাহেব বাজার থেকে মাছ এনেছেন। ভাবী তিন বছরের মেয়েকে ডেকে বলছে, “দেখো দেখো, এটা হলো পিশ…. পিশ”। অথবা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় গরু দেখা গেল, “দেখো বাবু কাউ, কত সুন্দর কাউ।” আরেকদিন গাড়ীর সামনে ছাগল পড়লো, বলে, “দেখো ওগুলো গট গট”। যদিও নিজের বাংলা উচ্চারনই শুদ্ধ নয়, কিন্তু বাচ্চাকে ইংরেজীতে পারদর্শী করতে চিন্তার শেষ নেই। একদিন দুঃখ করে বলছে, এত কিছুর ইংরেজী নাম আছে আপেলের ইংরেজী নামটা পেলাম না কোথাও। আপেলের ইংরেজী না পেয়েও আমি অবাক হই না। কিন্তু অবাক হই এই প্রবনতাটা দেখে। এত ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে কেন অত ইংরেজী শিখবে। কি এমন জরুরী দরকার?

বাজারে যে জিনিসের চাহিদা বেশী সেই জিনিসের দাম বাড়ে তরতর করে। মায়েদের চাহিদার ফলে ইংরেজী স্কুলের দামও বেড়ে গেল হুড়োহুড়ি করে। স্কুল একটা ভালো ব্যবসা এখন। বিশেষতঃ ইংরেজী স্কুল।

২.
স্বল্পপুঁজিতে মজার ব্যবসাটা আমিও করবো কিনা ভাবছি।

আগে একটু হিসেব করে দেখি কতটা লাভজনক। ধরা যাক আমি একটা মোটামুটি মানের স্কুল খুলবো। স্কুলে প্লে, নার্সারি, ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর, ফাইভ মোট সাতটা ক্লাস থাকবে। সুতরাং সাতটা ক্লাসরুম, এটা টিচার্চ রুম, একটা প্রিন্সিপাল রুম, একটা টাকা কড়ি গোনার রুম। মোটামুটি দশটা খুপড়ি ঘর হলেও চলে যায়। প্রতি ক্লাসে যদি গড়ে বিশজন করে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করানো হয় তাহলে মোট ছাত্রের সংখ্যা দাড়ায় ১৪০ জন। মাসিক বেতন ৫০০ টাকা করে ধরলে ৭০,০০০ টাকা আয়। সাত ক্লাসের জন্য পাঁচজন টিচার। মাসিক বেতন ১৫০০ করে ধরলে ৭৫০০ টাকা। ১৫০০টাকা বেতনটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য কম মনে হতে পারে, কিন্তু আমার পাড়ায় একটা স্কুলে শিক্ষকদের ৪০০ টাকা বেতন দিতেও দেখেছি। স্কুল চালানোর অন্যান্য খরচ বাবদ আরো ৫,০০০ টাকা। স্কুল ঘর ভাড়া মাসিক ১০,০০০ টাকা। মোট খরচ ২২৫০০ টাকা। দেখা যাচ্ছে ছোট একটা স্কুল দিয়ে মাসে মোটামুটি ৫০,০০০ টাকার কাছাকাছি আয় করা সম্ভব বড় কোন বিনিয়োগ ছাড়াই। একমাত্র বিনিয়োগ হলো স্কুলঘর ভাড়া। যদি স্কুলঘরটা নিজের হয়, কিংবা বাড়ীওয়ালাকে ফুসলিয়ে পার্টনার করে নেয়া যায় তাহলে তো লাভের অংকটা আরো পুষ্ট হয়। এই আয় নিশ্চিত আয়। কোন ধুনফুন নাই।

বাংলাদেশের বেশীরভাগ জায়গায় গড়ে ওঠা তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো এরকমই। অপ্রয়োজনীয় বইয়ে ভর্তি থাকে শিশুদের পড়ার টেবিল। ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটায় পাঁচ-সাত-দশ বছরের বাচ্চারা। আনন্দময় শৈশব জিনিসটা এদের কাছে অধরা।


এবার জাতির মেরুদণ্ড বিষয়ক কয়েকটা কথা বলি।

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই জাতীয় ইংরেজী স্কুল দিয়ে যেভাবে মেরুদণ্ড গড়ে তোলা হচ্ছে সেটা বইয়ের বোঝা বহন করতে গিয়েই কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, জাতির ভার বহন করার মতো শক্তি অবশিষ্ট কিছু থাকবে কি? এরকম ব্যাঙের ছাতার স্কুলের পাশাপাশি দেশে বেশ কিছু ভালো ইংরেজী স্কুলও আছে। তবে সারা দেশে যদ্দুর খবর নিয়েছি ইংরেজী স্কুলগুলোর সমতূল্য একটা বাংলা স্কুলের খবর পাইনি কোথাও। কেন ভালো বাংলা স্কুল নেই? যত মনোযোগ দিয়ে ভালো ইংরেজী বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেরকম যত্ন করে বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় না।

চট্টগ্রামের একটা উদাহরন দেই। চিটাগাং গ্রামার স্কুল(সিজিএস) এখানকার সবচেয়ে খান্দানী স্কুল বলে পরিচিত। এই ইংরেজী স্কুলটির পড়াশোনার মান যথেষ্ট ভালো। ক্যাম্পাসের পরিবেশ যে কোন উন্নত দেশের সমতূল্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ওখানে মূলতঃ বাংলাদেশী উচ্চবিত্ত পরিবারে সন্তান এবং বিদেশীদের সন্তানরা পড়ে। আমার এক সামর্থ্যবান প্রতিবেশী বাংলায় পড়াতে চান তার সন্তানকে, তবে স্কুলের পরিবেশ চান সিজিএস-এর মতো। অনেক খুঁজেও সিজিএস এর মতো একটা বাংলা স্কুল খুঁজে পেলেন না। বাধ্য হয়ে তাকে ইংরেজী স্কুলকেই বেছে নিতে হলো। আমি বিশ্বাস করি আরো অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে ইংরেজী স্কুল বেছে নেয়।

কিছু কিছু গ্রামার স্কুলে করুণা করে একটা বাংলা বই রাখা হয়। দশটা ইংরেজী বইয়ের মাঝে একটা বাংলা যেন হংস মাঝে বক। বাস্তবতা হলো ইংরেজী বা গ্রামার স্কুলে সন্তানদের পড়ায় তারা সমাজের কর্তাশ্রেনীর সন্তান। তাদের লক্ষ্য থাকে সন্তান যেন বড় হয়ে পাশ্চাত্যের কোন দেশে গিয়ে মজবুত অবস্থান গড়ে নিতে পারে। সুতরাং ইংরেজী স্কুল চলুক। বাংলা স্কুলের যা ইচ্ছা হোক। বাংলা স্কুলের মধ্যে যে কয়টা ভালো স্কুল আছে সেগুলো নিজের গুনেই ভালো। স্কুল পরিচালনা কমিটি, শিক্ষকশ্রেনীর গুনেই ভালো। সরকারের কোন নীতির কারনে একটা স্কুলও ভাল হয়েছে তেমন নজীর পাওয়া কঠিন হবে।

৪.
আমাদের শিক্ষার হার মান সব বাড়াতে হলে স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে হবে, শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বিদ্যমান বাংলা স্কুলগুলোর মান উন্নত করতে হবে। যত্রতত্র ইংরেজী স্কুল প্রতিষ্ঠা সীমাবদ্ধ করে দিতে হবে। পাড়ায় মহল্লায় গজানো তথাকথিত ইংরেজী স্কুলগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা কারিকুলাম রাখতে হবে। শিশুদের পাঠ্য তালিকা থেকে অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান বাদ দিতে হবে। যে জ্ঞানটা ১০ বছর বয়সে পেলেও চলে সেটা পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাকে ঠেসে কেন গেলাতে হবে। সবগুলো স্কুলের কারিকুলাম এক হতে হবে। এক দেশে নানা জাতের বিদ্যাসাগর বানাবার তামাশা বন্ধ করতে হবে। অন্ততঃ ৯৯% মানুষের বাংলায় সুশিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। তাই জাতির মেরুদন্ডটা বাংলায় তৈরী করা হলে খুব অসুবিধা হবার কথা নয়।

[বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এর আগেও একটা অসম্পূর্ন লেখা লিখেছিলাম। চিন্তাটা মাথার ভেতর খচ খচ করে কিছুদিন পরপরই, তাই আরেকটি লেখা দিতে হলো ওই একই বিষয়ে]

একজন সামান্য মানুষের অসামান্য তৃপ্তি

অর্থে দরিদ্র মানুষদের ভুলে থাকার মতো সাধারন স্বার্থপর মানুষ হয়েও পাশের গ্রামের অষ্টম শ্রেনী পাশ সামান্য একজন আবসার হোসেনকে আমি ভুলতে পারিনা যে কারনে সেটাই বলবো এখন।

আবসার হোসেনকে খুবই সামান্য একটা চাকরী পেতে সাহায্য করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। বেতন ছিল মাত্র ১২০০ টাকার মতো। চাকরীটা পেয়ে শহরের কোথাও মেস নিয়ে বসবাস শুরু করে সে। আর আমি নিশ্চিন্ত হই একটা মানুষের উপকার হলো ভেবে। কিন্তু দুমাস যেতেই আবসার একদিন আমার কাছে এসে হাজির। আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই ঝামেলা পাকিয়েছে কোন, এখন প্রতিকার চাইতে এসেছে। মনে মনে আগেভাগেই বিরক্ত হওয়া শুরু করলাম। ব্যাটাকে চাকরী পাইয়ে দিয়ে ঝামেলার রাস্তা বের করলাম নাকি?

কিন্তু আমার স্বার্থপর চিন্তাটাকে লজ্জায় ফেলে আবসার একগাল সরল হাসি হেসে বললো, "স্যার বেতন পাইছি। গতমাসেও পাইছি। চাকরীটা খুব ভালো, আমি ভালো আছি।" আমার বুক থেকে ভার নেমে যায়। যাক কোন ঝামেলা পাকায়নি।

আরো দুতিন মাস পর আবারো এলো আবসার। ভাবলাম, এবার নির্ঘাত ঝামেলা হবে। কিন্তু এবারও সে আমাকে দুর্ভাবনামুক্ত করে। বোকার মতো হাসি হাসি মুখে বলে, "স্যার চাকরী ভালো চলছে, খুব আরামে আছি।" আমি হাঁপ ছাড়ি।

ছমাস কোন খবর নাই। তারপর একদিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখলাম ওকে। এবার বুঝি রক্ষা নাই, নিশ্চয়ই বিরাট কোন ঘটনা হবে। চেহারায় মলিনতা দেখা যাচ্ছে ওর। কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, "কি রে, কোন সমস্যা হইছে?"

"একটু সমস্যা হইছিল স্যার। বাড়ী গেছিলাম বিষুদবার, শনিবার আসতে পারি নাই, রোববার আসার পর বসের বকা খাইছি, একদিনের বেতন কাটা গেছে" কিছুটা বিমর্ষ সুরে বললো।

এইবার আমি সত্যি চিন্তায় পড়লাম। ব্যাটা কাজে ফাঁকি দিয়ে বাড়ী যাবে, আর আমাকে আমাকে বেতন না কাটার সুপারিশ করতে হবে। নতুন ঝামেলা দেখি! কিভাবে পাশ কাটানো যায় দ্রুততম বেগে ভাবতে লাগলাম।

কিন্তু এইটা আবসার। আবারো আমাকে বিপদমুক্ত করে তার শেষ কথাটি দিয়ে।

'কোন সমস্যা নাই স্যার, বেতন কাটা গেছে আমার দোষে, চাকরী তো কাটা যায় নাই। আমি ভালো আছি। যাই কাজে যাই......'। এবারও সেই দিলখোলা হাসি দিয়ে চলে যায় আবসার।

আমি তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে সুক্ষ্ণ একটা ঈর্ষা আর ভালো লাগায় ভুগি। তার চেয়েও বেশী বিস্ময়। এত অল্পে এতটা তুষ্ট হবার যাদুটা কি? আবসারের টাকা নাই কিন্তু তুষ্ট হবার সেই দুর্লভ ক্ষমতাটা আছে। আমার টাকা আছে কিন্তু অল্প নিয়ে সুখী হবার সেই ক্ষমতাটা নাই। তাহলে মানুষ হিসেবে আবসার বড় নাকি আমি? আমার চিন্তার কোন সমীকরন মেলাতে পারি না। কেবল দুরে হেঁটে যাওয়া ছোটখাটা কিন্তু তৃপ্ত মানুষ আবসারকে আমার চেয়ে অনেক বড় মনে হতে থাকে।

চিঠিগদ্যঃ তুই কি কোথাও আছিস 'অন্তহীন'?

তোকে যেন কতযুগ লিখিনি!! কত বছর হলো আজ? ডাক পিয়নের যুগ শেষ হবার পর আমাদের চিঠি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

আজকাল চিঠি পাঠাতে ডাকপিয়নের সাহায্য লাগে না, পোষ্ট অফিসে যেতে হয় না, ষ্ট্যাম্প কিনে লালা ভিজিয়ে টিপে লাগিয়ে দিতে হয় না। কিবোর্ডে আবজাব টাইপ করে ঠিকানা লিখে ক্লিক করলেই হয়ে যায়। আমি তো তোর ইমেইল ঠিকানা জানি না। ডাকপিয়নের যুগ শেষ হবার পর তুইও কোথায় হারিয়ে গেলি। আমি তোকে আর খুঁজি না, তুইও খুঁজিস না।

সময় মানুষকে কত বদলে দেয়! একটা দিন গেছে মনে হতো তোর চিঠি না পেলে আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে, ভেতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে যাবে। আমি আর কাউকে চিঠি লিখতাম না তোকে ছাড়া। আমার এত বন্ধু ছিল, কিন্তু চিঠি বন্ধু ছিলি একমাত্র তুই। আমাদের কতশত চিঠি যে বানের জলে গেছে ভেসে!! বানের জল না এলেও সময়ের বন্যায় হারিয়ে যেত অবশ্যই। কে কাকে মনে রাখে অতযুগ। আমি তবু ভুলি না তোর আবেগ ছোঁয়া চিঠিগুলোর কথা। সুযোগ থাকলে বাঁধিয়ে রাখতাম জীবনের পড়ন্ত বেলায় পড়ার জন্য। আজ হঠাৎ কেন যেন আমি তোর চিঠির জন্য তৃষ্ণার্ত হলাম। তোর কি কোন বিষন্ন বিকেলে মনে পড়ে সেই চিঠিযুগের কথা?

চিঠিটা তুই পাবিনা। তবু কোন একটা দৈবযোগ যদি তোকে হাজির করে ব্লগের ভেতর? হাজার মানুষের মধ্যে তো কেউ একজন তুই হতেও পারিস। সেই সম্ভাবনায় এলোমেলো কথা দিয়ে চিঠি সাজালাম। কি লিখবো সাজাতে পারছি না বলে এলেবেলে করে দিলাম ইচ্ছে মতো। তুই আমার তুচ্ছ চিঠিকে উচ্চ করে পড়তে পারতিস, এখনো কি পারবি? তুই ছিলি আমার জীবন্ত ডায়েরী কিংবা রেকর্ডার। পুরোনো অভ্যেসমতো তাই আমার ডায়েরীর লেখাই তোকে কপি করে দিলাম-

১. তথাকথিত সমসাময়িক কালকে বাদ নিয়ে ভিন্ন একটা কালে অবস্থা করতে পারলে মনের অনেক যন্ত্রনা লাঘব হয়। কখনো সুদুর অতীত, অথবা অনাগত শতাব্দীতে উড়ে গিয়ে চুপ করে সময়, কাল, মানুষের পরিবর্তন দেখা যেত যদি! আমাদের বর্তমান আমাদের অহেতুক ভোগায় নানান যন্ত্রনায়। বর্তমান থেকে পালিয়ে থাকার জন্য কেউ নেশাহত হয় পানীয় কিংবা ইনজেকশানে। বর্তমান থেকে পালানোর কাপুরুষ প্রবনতা সামাজিক অনাচার বৃদ্ধি করে, কথাটা কতটা সত্য কে জানে?

২. রাজনীতি দুষ্টচক্রে আবদ্ধ বলে রাজনীতির দিকে ফিরে তাকাতেও ইচ্ছে করে না। পালিয়ে থাকা কোন সমাধান নয় তবু স্বার্থপরতা ভর করে প্রচন্ডভাবে। সহপাঠি কিংবা সহযোদ্ধার অধঃপতন যতটা কষ্টের প্রতিপক্ষের অধঃপতন ততটাই যেন আনন্দের। প্রতিপক্ষের যন্ত্রনা আরো কতটুকু বৃদ্ধি করা যায় সেই প্রচেষ্টার গোড়ায় জল ঢালতে ঢালতে নিজের ঘরকেও প্লাবিত করে যাই বেখেয়ালে। সুযোগসন্ধানী অপশক্তির হাত তাই শক্তিমান হতেই থাকে। যার দুষ্টচক্রে আটকে থাকে সমাজ, রাজনীতি, মায় অর্থনীতি পর্যন্ত। মুক্তি পাওয়া আদৌ সম্ভব? প্রপিতামহ পায়নি, পিতামহ পায়নি, পিতাও না, আর নিজেও পাবো না নিশ্চিত। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এক জীবন অন্ধকার রেখে যাবো?

৩. উপমহাদেশে ইংরেজের দুশ বছরের শাসন আমাদের কিছু শিক্ষা দিয়েছে? আমরা ইংরেজ বিতাড়িত করেছি বলে গর্ব করি। আসলেই কি ইংরেজ বিতাড়িত করেছি নাকি দুদুটো বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা বৈশ্বিক রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বলে ইংরেজ হাত গুটিয়ে চলে গেছে। নইলে বিতাড়িত ইংরেজের দমবন্ধ কালো কোট আমাদের হাকিমের ঘাড়ের উপর কি করে চেপে বসে থাকে ষাট বছর পরেও?

৪. সভ্যসমাজে মানুষের ভরসার/শৃংখলার তিনটি স্থান - হাসপাতাল, থানা, বিচারালয়। তিনটি জায়গায়ই মানুষ সংকুচিত/ভীত/অপদস্থ এই দেশে। আমরা কি সভ্য দেশের নাগরিক?

৫. প্রযুক্তি প্রকৃতিকে নিধন করছে। চাল-ডাল-ফল-মূল বৃক্ষলতা থেকে পশুপাখি পর্যন্ত এর শিকার। হাইব্রীড আর জেনেটিক প্রযুক্তির প্রাদুর্ভাব চারদিকে। টমেটোর ঘ্রান থেকে পদ্মার ইলিশের ঘ্রান পর্যন্ত বদলে গেছে। আমার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে ওশিন টিভি রিমোট থেকে ল্যাপটপের বাটন পর্যন্ত শিখে ফেলেছে, কিন্তু তাকে কখনোই দিতে পারবো না দেশীয় টমেটোর মৌ মৌ সেই ঘ্রান যা লুপ্ত হয়ে গেছে প্রযুক্তির হাইব্রীড অত্যাচারে। প্রকৃতির যা হারিয়ে যায় তা কি ফিরে আসে আবার?

৬. সীমিত জ্ঞানে একটা মাত্র গ্রহকে জীবজগতের বাসযোগ্য বলে জানি। সেই নীল আকাশ সমৃদ্ধ সবচেয়ে সুন্দর পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে না পারলে মানুষ কোথায় যাবে? শিল্পের অসুস্থ প্রবৃদ্ধি প্রকৃতিকে করছে ভারসাম্যহীন। প্রকৃতি ভারসাম্য হারালে প্রতিশোধের ছোবলের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতেই হবে। প্রযুক্তি দিয়ে কি এই প্রতিশোধ শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যাবে? নাকি 'যোগ্যতমের জয়' সমীকরনে মানুষ নামের প্রজাতির বিলুপ্ত ঘটবে এক সহস্রাব্দের ব্যবধানে?

কোন প্রশ্নেরই কোন উত্তর হয় না। অনির্দিষ্ট আকাশের দিকে ছুড়ে দেই প্রশ্নমালা!! তোর ডায়েরীতেই থাকলো না হয় আজ!

বন্ধু, তুই কি বুঝিস আজ কেন আমার খুব মন খারাপ? আজ কি সেই বিশেষ দিন? তুই পাশে থাকলে ঠিক বুঝে নিতি কেন আমার মন খারাপ। তাই তোকেই লিখছি। চিঠিটার উত্তর আশা করি না, তবু যদি চোখে পড়ে উত্তর দিস, যদি উত্তর থাকে।

যেখানেই থাকিস নিরন্তর ভালো থাকিস। আমার ছদ্মনাম দেখে আমি কে নাম দেখে না চিনলেও প্রশ্নগুলোই আমাকে চিনিয়ে দেবে তোকে। নাম বলে তাই তোকে, আমাকে বিব্রত করলাম না এই অসময়ে।

কালো আমার কালো

একদিন সবকিছুই ধূসর হয়ে যায়। মানুষ, গাড়ী, বাড়ী, উদ্ভিদ, প্রানী, সম্পর্ক, অনুভুতি সবকিছুই। ধূসরতার গভীরতা বাড়তে বাড়তে কৃষ্ণগহবরে হারায় সকল বর্নচ্ছটা। কৃষ্ণগহ্ব থেকে কখনো কি আলোর উত্থান ঘটে? যে আঁধার আলোর অভাবে ঘটে, সেখানে আবারো বর্ন দেখার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যে আঁধার কেবলই আঁধার, সেখানে নিকষ কালো বাদে অন্য কোন বর্ন নেই।

অন্ধকারের রং কি? কালো কি একটা রং নাকি আলোর অভাব? কালোতে আলো ছিটোলেই কি রংধনু হেসে ওঠে? রংধনুতে সব রঙের সমাহার থাকলেও কালোর স্থান নেই কেন? কালো কি অচ্ছ্যুত? আলোর অভাবই কালো যদি মেনে নেই তাহলে প্রশ্ন জাগে আলোর অভাব কেবল কালো হয় কেন? নীল বা সবুজ নয় কেন? জগতের আদি রং কি তাহলে কালো?

মহাশূন্যের বর্ন কি? মহাশূন্য বা মহাবিশ্বের কোন বর্ন নেই। বর্নহীন নিঃসীম অন্ধকার এক জগত। বিশাল অন্ধকারের মাঝে মাঝে ছিটেফোটা নীহারিকা-নক্ষত্র জগত আলোর ফুটকি হয়ে মাঝে মাঝে বর্ন ছড়ায়। সেই আলোর সীমানার বাইরে পুরো বিশ্বব্যপী নিকষ কালো অন্ধকার। ফলে যখন আলো সত্যি না অন্ধকার সত্যি - সেই বিতর্কটা আসে, তখন অন্ধকারেরই জয়জয়কার হয়।

যেহেতু অন্ধকারের রং কালো, জগতে কালোই সত্য, অন্ধকারই স্থায়ী। স্থান কাল ভেদে এর কোন ব্যতিক্রম নেই। কালো সত্য, কালো অবিনশ্বর, কালো ছড়িয়ে আছে জগতময়। সেই কালোতেই হারিয়ে যায় সকল অনাদিকাল।

কালো আমার কালো ওগো কালো ভূবন ভরা... কালো নয়ন ধোয়া আমার কালো হৃদয় হরা।

জলদোদয়

যবনিকা

ধুপ করে ছোট্ট একটা আওয়াজ করেই গুলিটা আশ্রয় নিল আবু রেজার বাম বুকে। রক্তের একটা কালচে ধারা নামছে শার্টের পকেট বেয়ে। বৃষ্টির জলে সয়লাব পুরো শরীর। চাদরে ঢাকা মাথাটা একপাশে এলিয়ে পড়লেও রেজার চোখে মুখে যন্ত্রনার কোন ছাপ বোঝা গেল না পার্কের অন্ধকারে। গুলিটা কতখানি উপভোগ্য ছিল তাও জানার উপায় নেই। ঘড়িতে দশটা বাজার সংকেত দিল কোথাও। ঘাতক আদু শেখ জীবনে কয়েক ডজন খুন করলেও এই প্রথম একটা খুনের পর চোখ জ্বালা করলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা পকেটে ভরে একবারও পেছনে না ফিরে হেঁটে বেরিয়ে গেল সে পার্ক থেকে। বৃষ্টি তখন আরো জোরে নেমেছে।

আরো জীবন, আরো আগের জীবন

দ্বিতীয় জীবনের শুরুটা ভালো না হলেও ওটাই ছিল ভালোর সূচনা। প্রথম জীবনের শেষ ধাওয়াটা খেয়েছিল রেজার আগের কর্মক্ষেত্র থেকে বহিষ্কারের সন্ধ্যাবেলায়। তিনমাসের বেতন বাকী রেখে কারখানা লে অফ ঘোষনা করার পর আন্দোলনে নেমে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে প্রানটাই খোয়াতে বসেছিল দেয়াল টপকাতে গিয়ে। শার্টের কলারে লোহার রড আটকে ঝুলেছিল দেয়ালের অন্যপাশে। কোনমতে ছাড়িয়ে নর্দমার আবর্জনার বুকে আশ্রয় নিয়েছিল সেই বেলা।

ধকল সামলে রেজা বহু পথ ঘুরে এই পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল আধঘন্টার মতো। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে গেছে তখন। সেই অন্ধকার পার্কে এক চিলতে আলোর মতো যে শ্যামলা মেয়েটির আগমন ঘটেছিল তার সাথে চাওয়াপাওয়ার কোন যোগ ছিল না। তবে ওরকম বিবশ সন্ধ্যায় তার মতো জ্যান্ত পুরুষের পাশে এসে নিঃসংকোচে বসতে পারে তেমন নারী চেনার বয়স রেজার বহু আগেই হয়েছিল। সেপথে কখনো গমন না করেও জানা আছে কিভাবে ওসব উৎপাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হয়। মেজাজ এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে, দুপুর থেকে না খাওয়া। পকেটে বিশটাকার আস্ত একটা নোটও নেই। প্রথম মন্তব্যটা খুব রুক্ষই ছিল বলা চলে, “যা ভাগ মাগী, অন্যদিকে যা, চোদার টাইম নাই”।

তিথি জীবনে যা কখনো করেনি, যা তার পেশার সাথে, স্বভাবের সাথে সম্পূর্ন বেমানান, তাই করে বসলো। রেজার কাছে এসে তার গালের মধ্যে কষে একটা থাপ্পড় মারলো।

রেজা পুরোপুরি হতবাক। ভাবতেই পারেনি একটা রাস্তার মেয়ে তাকে এভাবে চড় মারতে পারে। জীবনে সে যে কটি চড় চাপড় খেয়েছে তা মায়ের কাছ থেকেই। এমনকি বাবাও কখনো হাত তোলেনি গায়ে। এই মেয়ের এমন দুঃসাহস!! তেড়ে উঠতে গিয়ে দেখে মেয়েটা আবারো চড় তুলেছে, এবার আরো রুদ্রমুর্তি। রেজা চুপসে যায় একটা কথা ভেবে। এসব মেয়ের দলবল থাকে আশেপাশে। ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হবে না। চড় খাওয়াটা পরিচিত কেউ তো দেখেনি। অপমানটা গায়ে না মেখে পিঠটান দেবার প্রস্তুতি নেয় বরং।

মেয়েটা ততক্ষনে একটু হুঁশে এসেছে। শান্ত কন্ঠে বললো,
-একা মেয়ে দেখলে মাগী মনে হয় কেন, আপনাকে এভাবে ভদ্রতা শেখাতে হবে ভাবিনি।
-কি চাও তুমি.........আপনি? তুই থেকে এক চড়ে তুমি, তুমি বলেও মুশকিল লাগলো তাই আপনিতে ফিরে গেল। এবার কিন্তু কন্ঠটা শুনে মেয়েটাকে মনে হচ্ছেনা রাস্তার মেয়ে।
-কিছু চেয়েছিলাম? মুখটা খারাপ না করে বলা যেত না? মেয়েটা যথেষ্ট মার্জিত স্বরে বললো।
-সরি, আমি ভেবেছিলাম ওরকম কেউ..........এই পার্কে কোন ভদ্রমেয়ে আসে না সন্ধ্যাবেলায়। রেজা আমতা আমতা করে বলে।
-ওরকম কাউকে না চাইলে এখানে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছেন কেন?
-এখানে বসে থাকার উপর নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?
-নিষেধাজ্ঞা নাই, তবে সন্ধ্যেবেলায় মতলববাজ লোক ছাড়া কেউ ঢোকে না এই পার্কে। কি করেন আপনি, পেশা কি?
-আপনি কে, পুলিশের লোক? রেজার মনে ভয় ধরলো এবার।
-হ আমি পুলিশ.......আমি হলাম পুলিশের পোষ্য
-মানে?
-মানে পুলিশের খাই, পড়ি, আর পুলিশের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করি
-অদ্ভুত ব্যাপার!
-অদ্ভুত কোনটা, পুলিশের খাওয়াটা নাকি পুলিশকে গাল পাড়াটা
-না, কোনটাই না। আপনিই অদ্ভুত
-আমি অদ্ভুত, কারন আমি পুলিশের বউ। আমার স্বামী এই থানার ওসি।

এটুকু শুনে রেজার বুকে মারাত্মক উটুরপুটুর শুরু হলো। এবার রক্ষা নাই।

-মুখে জবাব নাই কেন সাহেব। ভয় পেলেন নাকি? কি করেন ঠিক ঠিক বলেন। রাতের আঁধারে পার্কে কোন ভদ্রলোক তো বসে থাকে না। আপনার নিশিকন্যাতেও রুচি নেই। কিসে আপনার রুচি। চুরি ছিনতাই?
-কি যে বলেন? রেজা হাসলো তবে অপমানটা গায়ে মাখলো না। পুলিশের বউয়ের চড়টা এখনো জ্বলছে। পুলিশ বেচারা না জানি দৈনিক কটা চড় হজম করে।
-আপনি কি করেন তাতে আমার কৌতুহল নেই। কিন্তু চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্রলোক। কিছু কথা বলি। এই পার্কে বেশীক্ষন বসে থাকবেন না। আমি একটা বাজি নিয়ে এই পার্কে একঘন্টা বসবো বলে এসেছি। আধঘন্টা পেরিয়ে গেছে। আধঘন্টা পর ও আমাকে নিতে আসবে। ওর ধারনা এই পার্কে রাতে কোন ভদ্রমহিলা ঢুকলে ইজ্জত নিয়ে বেরুতে পারে না। আমি ওকে বলেছিলাম পার্ক কেবল দুষ্ট লোকের আস্তানা নয়। খানিক কাপুরুষও মেলে এখানে। ভদ্রলোক একজন পাওয়া গেল চড় খেয়েও চুপ থাকে যে মানুষ। আমি বোধহয় বাজিটা জিতে গেলাম।

রেজার ভাল্লাগছিল না পুলিশের বউয়ের তামাশা। সে যথাসম্ভব ভদ্রভাবে বললো-

-দেখুন, আপনার অনেক দয়া যে আমাকে কেবল চড় দিয়েছেন, পুলিশের হাতে তুলে দেননি। কিন্তু আমি এখন যেতে চাই। অসুবিধে আছে?
-অসুবিধে নেই, যেতে পারেন, যাবার আগে নামটা শুনতে চাই আপনার
-আবু রেজা
-আমি দুঃখিত রেজা। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ। ওভাবে চড় মারা উচিত হয়নি আপনার। কি করেন আপনি?
-জানা কি জরুরী?
-আপত্তিকর কিছু থাকলে দরকার নাই। কিন্তু সাধারন কৌতুহল।
-আপত্তিকর কিছু নেই। আমি এক জায়গায় কাজ করতাম। আজ দুপুরে কোম্পানী লে অফ করে দিয়েছে তিন মাসের বেতন বাকী রেখে। আমরা আন্দোলন করতে শুরু করলে, পুলিশ ডেকে আমাদের দাবড়ানি দেয়। হয়তো আপনার স্বামীই ছিল দাবড়ানির দায়িত্বে। দাবড়ানি খেয়ে মরতে গিয়েও বেচে আছি। খিদা নিয়ে পার্কে শুয়েছিলাম, আপনার চড় খেয়ে তাও গেছে। এখন কোথাও যাবার নেই আমার। বাড়ী ফিরতে পারবো না কারন বাড়ীওয়ালা জিনিসপত্র জব্দ করবে বলেছে আজকের মধ্যে ভাড়া দিতে না পারলে। পকেটে দশ পনেরো টাকার মতো আছে। যা দিয়ে বাকী জীবন কাটাতে হবে........

রেজা বলতে থাকে তিথি চুপ করে শুনে যায়। সবটুকু শুনে তিথির ফ্যান্টাসী বুদবুদের মতো উবে গেল। রেজার পরবর্তী বাক্যটা আরো তলিয়ে দিল তিথিকে-
-আপনার স্বামীকে বলে আমাকে জেলে পাঠাতে পারবেন কোন মামুলি কেস দিয়ে? ওখানে থাকা খাওয়ার একটা বন্দোবস্ত অন্ততঃ হবে।

স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল রেজার দিকে। কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কি বলবে। সত্য বলা উচিত? নাকি লুকোবে। না সত্য কথাই বলি, ভাবলো সে।

-রেজা......আমার নাম তিথি, আমি......আপনাকে আমি সবটা সত্য বলিনি। কিন্তু আপনার কাহিনী শুনে আমার নিজের আসল কথাগুলো শেয়ার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আপনার বর্তমান অবস্থা আমার চেয়েও করুণ, তাই আমি সত্য বলতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি.........

তিথি এবার তার গল্প বলে আর রেজা শুনে যায়। তিথি যখন থামে রেজা অপলক তাকিয়ে থাকে তিথির দিকে। ভেতরে কিসের যেন একটা আলোড়ন। তিথির চোখে নতুন দৃষ্টি এখন, রেজাও বিচিত্র অনুভুতির রাজ্যে বিচরন করছে। চুপ করে বসে আছে ওরা।
অনেকটা সময় কাটার পর তিথি বলে
-এভাবে বসে থাকলে চলবে? কিছু খেতে হবে না? খিদে পেয়েছে খুব।

সেদিনের ওই ঘটনার পরবর্তী দৃশ্যগুলো বাংলা সিনেমাকেও হার মানিয়েছিল। দুজন দুরকম অসহায় মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব, সহমর্মীতার অপূর্ব এক সম্পর্ক। বাংলা সিনেমার কায়দায় খুব দ্রুত সেটা প্রেমে গড়ায় এবং বিয়েতেও। সুখে সংসার করতে থাকে রেজা-তিথি। নিহা, কেকা নামের দুটি ফুটফুটে মেয়ের বাবা-মা হয় ওরা। নার্সারীতে পড়ে পাঁচ বছরের কেকা, আর তিন বছরের নিহা ঘরে বসে অ আ করে গলা ফাটায়।

জীবনের সব লেনদেন কত ভারসাম্যহীন

সুখের গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো যদি একদিন বাজার করে ফেরার পথে রেজার রিকশাটা সামান্য দুর্ঘটনায় উল্টে গিয়ে মাথায় মারাত্মক আঘাত না পেত সে। হাসপাতালে চেক আপের সময় একটা টেষ্টের রিপোর্ট আসে সন্দেহজনক। তিথি দুশ্চিন্তায় পড়ে। আবারো টেষ্ট করিয়ে নিশ্চিত করার কথা বললেও এড়িয়ে যায় রেজা। পরে রেজা নিজে নিজে গিয়ে টেষ্ট করায় এবং নিশ্চিত হয়। দেখা যায় মেয়াদ খুব অল্প না হলেও দুবছর খুব বেশী সময় না। কাউকে কিছু বলে না এই ব্যাপারে।

দুই মাস আগে ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবু রেজা এই বেঞ্চিতে এসেই বসে ছিল রাত দশটা পর্যন্ত। মাথার উপরে ঝিম ধরা অন্ধকার। বুকের ভেতর খাঁ খাঁ শূন্যতা। দশ বছরের চাকরী জীবনের সঞ্চিত পাঁচ লাখ টাকার সাথে আরো পঞ্চাশ লাখ টাকা যোগ করেও দুই বছরের বেশী বাঁচতে পারবে না সে। কোন হিসেবই মেলানো যাচ্ছে না। দুই সন্তানের বয়স দশের নীচে। তাঁর অবর্তমানে তিথিকে বাচ্চাদের নিয়ে আশ্রয় দেবার মতো কেউ নেই। নিজে ভালো চাকরী করতো বলে তিথিকে চাকরী করতে দেয়নি। এখন কি হবে? ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে পথে বসবে? চিকিৎসা করালে জমানো টাকা পয়সা সব তো যাবেই, বাঁচারও কোন সম্ভাবনা নেই। শেষমেষ তিথিকে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। প্রতিদিন অফিস শেষে এই বেঞ্চিতে এসে বসে থাকে রেজা। আকাশপাতাল ভাবে। দশটার পরে বাসায় ফিরে। তিথি খুব বিরক্ত রেজার প্রতিদিন দেরী দেখে। বকাবকি করে, কখনো বা ঝগড়া। রেজা চুপ করে শুনে যায় কিছু বলে না। তিথি পরে অনুতপ্ত হয় ভেবে যে বেচারা অফিসে খুব ঝামেলায় আছে বোধহয়।

এরকম অনেক রাত পেরোয়। দিন আসে দিন যায়। প্রতিদিন নিজের সাথে যুদ্ধ করে। তবু নিজের সাথে বোঝাপড়া শেষ হয় না। দেড় মাসের মাথায় একদিন পথ খুঁজে পায় পরিচিত একটা লাইফ ইন্সুরেন্সের এজেন্টের সাথে কথা বলে। অসুখের কথা বেমালুম চেপে মোটা প্রিমিয়ামের একটা ইন্সুরেন্স করে ফেলে চোখ বন্ধ করে। গ্রাহকের মৃত্যূর পর নগদ পঞ্চাশ লাখ টাকা পাবে গ্রাহকের স্ত্রী। দুর্ঘটনায় মারা গেলে দ্বিগুন। তাছাড়া আগামী বিশ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়ের শিক্ষা ও ভরনপোষন বাবদ মাসিক পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। অনেক বিলাসী ইন্সুরেন্স প্রিমিয়ামও খুব বেশী। ছমাসে তিন লাখ টাকা মাত্র! তবে রেজা মোটেও চিন্তিত নয় ওটা নিয়ে। কারন মাত্র একবারই দিতে হবে। এরপরও হাতে থেকে যাবে দুই লাখ। সেই দুই লাখ অন্য কাজে। সেই কাজটার খোঁজ করতে শুরু করলো রেজা।

একদিন পার্কেই খোঁজ পেয়ে গেলো সৌভাগ্যের। বসে বসে সিগারেটে আনমনা টান দিচ্ছিল। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। চারদিক নিকষ কালো অন্ধকার। গলার কাছে ঠান্ডা স্পর্শ পেল রেজা হঠাৎ। ‘মিয়া কি আছে দিয়া ফালান, চিল্লাচিল্লি করলে ফাসায়া দিমু’। লোকটার নাম আদু শেখ। এই আদু শেখই তার দ্বিতীয় কাজটা করে দেবার জন্য রাজী হয়েছিল।

অবশিষ্ট বলে কোন বস্তু নেই এক জীবনের

প্রচন্ড যন্ত্রনা আর রক্তপাতপর্ব শেষ হবার পর শরীরটা যখন অবশ হয়ে আসছিল তখন নিথর চোখে বৃষ্টির ছাঁট পড়তেই নিহার কন্ঠটা ভেসে এলো কোথা থেকে যেন। ছোট্ট নিহা বৃষ্টি দেখলেই আবদার করতো- "বাবা, আমি বৃষ্টি যাবো, আমি বৃষ্টি যাবো। আমি তোমাকে ছাতা খুলে দেবো। তুমি আমাকে ছাতা কিনে দিও, আমি স্কুলে যাবো"..........চোখ বুজে আসার পরও যেন শব্দগুলো পাক খেতে থাকে রেজার সিক্ত জুলফির আশেপাশে।

এ ভ্রমণ, কোথাও যাওয়া নয়

এ ভ্রমন, কেবলই একটা ভ্রমন-
এ ভ্রমনের কোন গন্তব্য নেই
এ ভ্রমন মানে কোথাও যাওয়া নয়।
....................................

একদিন অবেলায় চেনা রাস্তার অচেনা মোড়ে
ঠিক দেখা হয়ে যায় পথের সাথে।
বিস্ময় ভুলে আমি পথের হাত ধরি,
পথ আমাকে আকাশ চেনায়।
আকাশ চেনার আজন্ম সাধ ছিল যার।
....................................
আমি চোখ বন্ধ করে ভাবি
আলোর পথে এ এক অনন্ত ভ্রমন।
এ ভ্রমন যেন কখনোই শেষ না হয়।
আমাকে পথ দেখাও হে আলো,
অনিঃশেষ অবিনশ্বর আলো।

তুমি জানো, কেবল তুমিই
আমার সম্মুখে আদিগন্ত বিস্তৃত পথ
অথচ দিন শেষে কোথাও যাবার নেই।

এ ভ্রমন তাই, কেবলই একটা ভ্রমন-
এ ভ্রমনের কোন গন্তব্য নেই
এ ভ্রমন মানে কোথাও যাওয়া নয়।

এ ভ্রমনে তুমি ছাড়া আর কোন সঙ্গী নেই।
****************************************
২৯.১২.২০০৯

'ঘুম যা' ক্লাস

মহিউদ্দিন স্যার বাংলা পড়াতেন ক্লাস সেভেনে। খানিকটা পাগল কিসিমের মানুষ। মুখ ভেংচিয়ে ধমক দিতেন বলে কেউ কেউ আড়ালে ডাকতো 'মুখবেকু'। পুর্নিমার চাঁদের মতো গোল স্কুলের পিতলের ঘন্টাটা ঝুলানো থাকতো দোতলায় ক্লাস সেভেনের জানালার সামনে। আর ক্লাসরুমের জানালায় ঘন্টা পেটানোর হাতুড়িটা রাখা থাকতো। বেতের বদলে ওই কাঠের হাতুড়িটা মাঝে মধ্যে আছড়ে পড়তো ক্লাস সেভেনের দুষ্ট বালকদের পিঠে।

ক্লাস সেভেনে আমি সেই মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানদের একজন যাদের ঘাড়ে তখনো হাতুড়িটা আছড়ে পড়ে নাই। ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে আবজাব গল্পে মহিউদ্দিন স্যারের আগ্রহ বেশী দেখা যেত। আমরাও তাতে উৎসাহী। কান ধরে দাড়িয়ে থাকা বা পেটানোর চেয়ে এইটা ঢের ভালো।

মাঝে মধ্যে স্যারের পড়ানোর মুড না থাকলে বলতো, 'ওই ঘুম যা সবাই'। এই 'ঘুম যা' মানে বেঞ্চে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ মটকা মেরে থাকা যতক্ষন পর্যন্ত স্যার উঠতে না বলেন। এইটা একটা মজার খেলার মতো ছিল। খুব উপভোগ্য। স্যার হেঁটে হেঁটে টহল দিতেন ঘন্টার হাতুড়ি হাতে।

একদিন 'ঘুম যা' ক্লাস চলছিল। আমাদের সবার মাথা বেঞ্চে নতমুখী। আমি ভ্যাবলা কিসিমের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কি ভুত চাপলো আমি স্যারের পায়ের শব্দ না পেয়ে ভাবলাম স্যার কোনদিকে গেছে একটু উঁকি দিয়ে দেখি। কিন্তু মাথাটা আলগা করতে না করতেই জীবনে প্রথমবারের মতো 'ধুম' করে হাতুড়িটা নেমে আসলো আমার পিঠে। কারন উনি তখন ঠিক আমার পেছনেই দাড়িয়ে। পরবর্তী সংলাপগুলো ছিল এরকম-

-কী রঙ্গ দেখতে উঠছস?
-কিছু না স্যার...
-স্কুলে আসার আগে কি খাইছস?
-ভাত খাইছি স্যার.... (আসলে কি খাইছি ভয়ে ভুলে গেছি)
-কি দিয়া খাইছস?
-কাতাল মাছ দিয়া খাইছি... (আসলে আমি তখন কাতাল ছাড়া আর কোন মাছ চিনতাম না)
-তোর বাপ কোথায়?
-কাতারে থাকে (বাবা তখন কাতারে একটা কোম্পানীতে চাকরী করতেন)
-তোর বাপে থাকে কাতার, তুই ভাত খাস কাতাল মাছ দিয়া, তোর মা কি কাতান শাড়ী পড়ে?

স্যারের কথা শুনে পুরা ক্লাস ঘুম ভেঙ্গে হো হো করে হেসে উঠে। আমি মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে থাকি। অপরাধটা গুরুতর বুঝতে পারছি। সব যে এভাবে মিলে যাবে বুঝি নাই। ভাবছিলাম হাতুড়ির বাড়ি আরো আসছে। কিন্তু পুরো ক্লাস এমন ভাবে হাসছে, স্যার বুঝলেন নিয়ন্ত্রন চলে গেছে হাতুড়ির বাইরে। পোলাপান আর ঘুমাবে না। তাই দেখে ক্লাস শেষ করে চলে যাবার যোগাড় করলেন। খাতাপত্র নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে শেষবারের মতো হুংকার দিলেন:

-ওই চুপ যা সব, যত্তসব ফাজিল। এই তু্ই বস্ (শেষ বাক্যটা আমাকে উদ্দেশ্যে বললেন)।

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঞ্চে বসতে বসতে মনে মনে বললাম- থ্যাংক্যু কাতাল মাছ। 'ঘুম যা' ক্লাসের মার থেকে তোমার জন্য বাঁচলাম।

বারো ঘন্টা বাসভ্রমনের বিনিময়ে তিন ঘন্টার বইমেলা দর্শন

শনিবার সকালে ঘুম ভাঙলো অনির্ধারিত বিলম্বে। বেশী রাত করে না ঘুমানোর ফসল। ‘দেরীতে ঘুমোলে আগে ওঠা হয় আর আগে ঘুমোলে দেরীতে ওঠা হয়’, তেমন একটা বিদঘুটে ব্যাপার হয় আমার। অফিসের গাড়ীটা মিস করে আর কতটা দেরীতে গেলে চাকরী টিকে থাকবে হিসেব করতে করতে একটা ফাঁকিবাজি ভাবনা মাথায় খেললো। আজ অফিসে না গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়? গত তিনমাস ছুটিছাটা বাদে একনাগাড়ে চলছে। আজকে যাবোই না। তারচে অন্য কোথাও যাওয়া যাক। গতপরশু থেকে ঢাকার বইমেলায় যাবার প্ল্যানটা বারবার বাতিল হচ্ছিল সুপরিকল্পনার অভাবে। নাহ, জীবনে সুপরিকল্পিত কাজ কয়টা করা যায়। তারচে বরং একটা অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তই নেই। হলে হবে নাহলে নাই। ঢাকাগামী যে কোন একটা বাসে একটামাত্র সীটও যদি খালি থাকে এই মুহুর্তে, তাহলে আমি ঢাকা যাবো। এক্ষুনি।

গোসল সেরে রেডী হয়ে সোহাগ পরিবহনে ফোন দিলাম পৌনে দশটায়। বললাম, “ভাই এখুনি ছাড়বে ঢাকার তেমন কোন গাড়ীতে একটা আসন হবে কিনা?”

বলা হলো -“হবে, দশটায় একটা গাড়ী যাচ্ছে, পনের মিনিট পর ছাড়বে”। শোনামাত্র একছুটে বেরিয়ে রিকশায় উঠলাম। তারপর বাস। বাসা থেকে বেরুবার আগমূহুর্তে ফেসবুকে ‘বইমেলা যাচ্ছি’ জাতীয় একটা ষ্ট্যাটাস লিখে এসেছি, ঢাকার কারো চোখে পড়লে যোগাযোগ করা যাবে। বাসে বসে মেলায় গিয়ে কাকে পাবো কাকে পাবো না হঠাৎ গিয়ে, ভাবতে ভাবতে ফোন দিলাম রুবেলকে। ও ছাড়া আর কারো ফোন নম্বর নেই। রুবেলকে জানাতে বেশ কাজ হলো। ওর কাছ থেকে দাদুভাই, সুবর্না, সুমনার নাম্বার পাওয়া গেল। ঢাকা পৌঁছার আগেই ফোনে যোগাযোগ হয়ে গেল বিহঙ্গ, সুমনা আর সুবর্নার সাথে। যাক একদম একা থাকতে হবে না গিয়ে। কেউ না কেউ আসবে।

মেলায় পৌঁছে আমারব্লগের ষ্টল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চরকির মতো কয়েকপাক ঘুরে অনুসন্ধান কেন্দ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম- ‘আমি হারিয়ে গেছি,আমাকে খুঁজে নাও’ ষ্টাইলে। তারপর রুবেল এসে উদ্ধার করলো অনুসন্ধান কেন্দ্র থেকে। গিয়ে পরিচিত হলাম ‘নিক চেনা, মুখ অচেনা’ ব্লগারদের সাথে। অমি পিয়ালরে ভাবতাম পোলাটা বয়সে আমার ছোটই হবে, কথা বলে জানলাম আমার এক বছর আগে ইন্টার পাশ দিছে। এবং দেশী লোক। আমার মামাবাড়ীর প্রতিবেশী। ডটু রাসেলকে ভাবতাম কঠিন এক পোলা, কথা বলে দেখি ভীষন অমায়িক এক ভদ্রলোক।

সুমনাকে ভাবতাম আপু আপু লাগবে, দেখি নিতান্ত বালিকা এখনো। বিহঙ্গরে ভাবতাম বড়সড় ঢ্যাঙা সাইজ কেউ হবে, ওমা এতো পিচ্চি পোলা। কেবল আমার সাথে দেখা করার জন্য সুমনা আর বিহঙ্গ মেলায় এসেছে, এই কথা শুনে কী অসাধারন অনুভুতি হলো! হালিমভাইকে যা ভেবেছি, বরাবরই পেয়েছি অবশ্য। আরো কয়েকজনের সাথে আলাপ হলো নাম ভুলে গেছি বলে ক্ষমাপ্রার্থী। তারপর পরিচিত হলাম এবারে মেলার দুজন সেলেব্রিটি সাবরিনা আর সালমা মাহবুব। সালমা মাহবুব যিনি আমাকে একবার ফোনে একটা ব্যাপারে খুব সাহায্যে করেছেন নিজে সমস্যাক্রান্ত হবার পরও। সাবরিনাকে অন্যসুত্রে পূর্ব চেনাজানা থাকলেও মুখোমুখি হলাম, এই প্রথম। কথা বলে ওনার স্নিগ্ধ আন্তরিকতায় সিক্ত হলাম আবারো। সম্পর্কে আমার ভাবী হলেও, তিনি ভাবীর চেয়ে বোন হতে আগ্রহী। আমি চট্টগ্রামে ওনার বাসায় সবপরিবারে দাওয়াত কবুল করে নিস্তার পেলাম।

এরপর মোড়ক উন্মোচন নজরুল মঞ্চে। দলবেধে উঠলাম সবাই। মোড়ক উন্মোচন হলো ছয়টা বইয়ের। পাপড়ি আপার সাথেও এই প্রথম মুখোমুখি। আমার ছোটবোন সুমীমা ইয়াসমিনের সাথে ওনার দীর্ঘদিনের সখ্যতা। যদিও আমার সাথে কালই প্রথম মুখোমুখি দেখা। কিন্তু দেখামাত্র গ্রেফতার করে নিলেন আন্তরিকতায়। হাত ধরে টেনে নিয়ে বড়বোন সুলভ চোখ রাঙানিতে বললেন, ‘এই তোমার আসল নাম বলো, আসল নামে চিনতে চাই তোমাকে’। আমি কাঁচুমাচু। তারপর চড় চাপড়ের ভয়ে বলে দিলাম আসল নাম। উনি হাফিজ ভাইকে(ওনার বর হাফিজুর রহমান) ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে। ভাইয়াকে বললেন ছবি তুলে দিতে। তারপর লুৎফর রহমান রিটনকে এমন জোরে ডেকে আমার সাথে পরিচয় করালেন দেখে যে কেউ ভুল বুঝবে আমি পাপড়ি আপার আপন মায়ের পেটের ভাই। রিটন ভাইও সেই ভয়ে মুখস্ত বলে বসলেন, আরে ব্লগার ‘নীড় সন্ধানী’ তো মারাত্মক লেখে (তবে আমি জানি আর উপরঅলা জানে রিটন ভাই জীবনেও আমার কোন লেখা পড়ে নাই)

এইসব করতে করতে আড্ডা শেষের দিকে গেল। সুমনা বিহঙ্গ বিদায় নিল। আমি ষ্টলে গিয়ে কয়েকটা বই নিলাম। ব্লগারদের বই এখনো আসেনি, ওটার জন্য অগ্রিম পেমেন্ট দিয়ে আসলাম। রাতের বাসেই ফিরতে হবে, সাথে আমার দুই বন্ধু ছিল ওদের নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে কিছুক্ষন স্মৃতিচারন করলাম। পনের বিশ বছর আগে কোন কোন জায়গায় আমাদের আড্ডা হতো সেগুলো নিয়ে হা হুতাশ করলাম। হা হুতাশ করে লাভ নাই। পুরোনো দিন ফিরবে না, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই বর্তমানকে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার কথা বলে সোহাগের মালিবাগ অফিসের দিকে রওনা দিলাম। প্রিয় বন্ধু আমাকে যত্ন করে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল বাসের গোড়ায়।

বাস যখন মাঝ রাতে চৌদ্দগ্রামের হাইওয়ে ইনে এসে পৌঁছাতে ফোন পেলাম প্রিয় বন্ধুর। সে জানালো মেলার আড্ডার ছবি নাকি ব্লগে চলে এসেছে ইতিমধ্যে। বন্ধু বললো, আনস্মার্ট আমাকে নাকি রীতিমত হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে নীল টিশার্টে। ওর বাকবাকুম খুশী আমাকে সেই মাঘ নিশীথের প্রচন্ড শীতকাঁপুনিতেও উষ্ণতার স্পর্শ দিল যেন।

টেরা শফি

ভিসা টিকেট কনফার্ম হবার পর আলকরনের টেরা শফি গেল এলাকার বড় জ্যোতিষী মফিজ কাওলাদারের চেম্বারে। প্রথম বিদেশ যাত্রা তার। দেশে প্রচুর আকাম করে পবিত্র দেশ সৌদি আরবে পাড়ি জমাচ্ছে ফ্রী ভিসাতে, জায়গামত থাকতে পারলে নাকি বহুত ধান্ধা ওখানে। ইহকাল পরকাল দুইটাই কাছাকাছি। তবু জ্যোতিষীর কাছ থেকে একটা ভবিষ্যতবানী নেবার ইচ্ছে।

টেরা শফিকে বস্তির লোক যেরকম চেনে, শিক্ষিত সমাজ চেনে না। মফিজ কাওলাদারও চিনলো না। গত একসপ্তাহ ঢাকা চিটাগাং দৌড়াদৌড়িতে দাড়িগোফ কামানোর সুযোগ পায়নি। সকাল নটায় পায়ে হেঁটে ঘুমের পোষাক লুঙ্গি-শার্ট পরেই জ্যোতিষীর চেম্বারে চলে এল। নিউমার্কেটের উল্টা দিকে বসে কাফিনা হোটেলে বসে মফিজ কাওলাদার।

পেশাদার ধূর্ত লোক মফিজ কাওলাদার । চেহারা দেখেই বলে দিতে পারে কাকে টিপলে কতটা বেরুবে। টেরা শফিকে না চিনলেও তার মলিন পোষাক আর খোঁচা দাড়ি বলে দিচ্ছে এটা দুশো টাকার মাল, দুহাজার টাকার উপদেশ দিয়ে লাভ নেই। বড়জোর একটা পাঁচশো টাকার অকেজো চুনি পাথর গছানো যাবে। শফির হাতটা ধরে খানিক কচলে গ্লাস দিয়ে সুক্ষ্ণচোখে দেখার ভান করে গড়গড় করে জ্যোতিষ টেম্পলেট রেকর্ডটা চালিয়ে দিল। সুখ-দুঃখ-প্রেম-শত্রু-মিত্র-টাকা-কড়ি কিছুই বাদ গেল না ওখানে। যতটুকু সুখবর দেয়া যায় দুশ টাকা ভিজিটে তার সবটুকু দিল।

কথা শেষ হবার পর কাওলাদার একটু চুপ থেকে বললো - 'তবে...'
এটুকু বলে আবারো চুপ মফিজ কাওলাদার। যেন ভাবছে।

টেরা শফি বললে, 'তবে কি?'

মফিজ কাওলাদার বললো, 'একটা সুসংবাদ আছে। আগামী বছরের শেষভাগে বিদেশ যাত্রার ঘোর লক্ষন আপনার বৃহস্পতি রেখায়। কিন্তু তার জন্য একটা চুনি পাথরের আংটি পরতে হবে যার মূল্য একহাজার টাকা কিন্তু আপনার জন্য বিশেষ ডিসকাউন্টে পাঁচশো টাকা মাত্র।'

এটুকু শোনার পর টেরা শফি ততোধিক টেরা চোখে চেয়ে থাকলো জ্যোতিষীর দিকে। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না এই সুসংবাদ!! তারপর বললো " মাত্র পাঁচশো টাকা? ঠিকাছে পাথরটা নেবো আমি, টাকাটা যোগাড় করে এখুনি আসতেছি।"

ঘন্টাখানেক পর মফিজ কাওলাদারকে সদর রাস্তায় ধাওয়া খাওয়ারত অবস্থায় পাওয়া গেল। পেছনে লাঠি হাতে একদল উস্কোখুস্কো এলোমেলো যুবক। ঘটনা থামলে জানা গেল ভাংচুর বাদেও নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা ছিনতাই হয়ে গেছে কাওলাদারের চেম্বার থেকে।

বিদেশ যাবার আগে বউয়ের হাতে কিছু নগদ দিতে পেরেও টেরা শফি ঠিক খুশী নয়।
কাওলাদার ব্যাটা শেষ আকামটা একরকম হাতে ধরে করালো।

একজন দীপা এবং ভুলে যাওয়া একটা প্রেম

১.
জাকের মাষ্টারের অর্ধপ্রকাশিত ইতিহাসটা অনেক রহস্য অমীমাংসিত রেখে চাপা পড়ে গিয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরেই। ঘটনাটা তার মৃত্যুর কয়েক বছর পর আমার কানে আসার পর উত্তরপুরুষ হিসেবে কৌতুহল দমিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। কারন জাকের মাষ্টার যে সময়ের মানুষ সেই সময়ে ওরকম একটা ঘটনা উপমহাদেশে বিরল। তবে জাকের মাষ্টারের চেয়েও যাঁর কারনে কৌতুহলটা চিড়বিড় জেগে উঠলো তিনি হলেন দীপালী চক্রবর্তী বা দীপা আহমেদ।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সুপুরুষ তরুন বোয়ালখালীস্থ সৈয়দবাড়ীর মওলানা সৈয়দ জাকের আহমেদ মাদ্রাসায় উচ্চতর ডিগ্রী নেবার জন্য কোলকাতা গমন করেন। তখনকার দিনে মাদ্রাসার ডিগ্রীর সাথে পাগড়ী বাঁধার একটা সম্মানজনক ব্যাপার ছিল। উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে মাথায় মওলানা পাগড়ী বেধে জাকের আহমেদ যখন গ্রামে ফিরে আসেন তখন মাথায় টাইটেল পাগড়ী দেখে যতটা বিস্মিত হয় তার তিনগুন বেশী বিস্মিত হয় সঙ্গের ছিপছিপে তরুনীকে দেখে। এ কাকে নিয়ে এসেছে জাকের মওলানা?

প্রাথমিক আলাপ সম্ভাষন শেষে জানা যায় এর নাম দীপালী চক্রবর্তী, কোলকাতা শহরে তার বসবাস। বিবাহিতা এবং দুসন্তানের জননী। কিন্তু কোন ভরা পূর্নিমায় জাকের মাষ্টারের সাথে তার দেখা হয়ে যায় সে কথা জানা যায় না। তবে সেই দেখাতে এমন গভীর প্রেমের জন্ম হয় দুজনের মধ্যে যে স্বামী-সন্তান-বিত্ত-বৈভব-পরিবার-ধর্ম-সংস্কৃতি সবকিছু ছেড়ে জাকের মওলানার হাত ধরে কোলকাতা শহর ছেড়ে পালিয়ে চট্টগ্রামের এই অজপাড়া গাঁয়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে একজন মাদ্রাসা পাশ মওলানা হয়েও জাকের মাষ্টার কিভাবে হিন্দু ব্রাম্মন রমনীকে ধর্মান্তরিত করিয়ে নিজের ঘরনী করার জন্য কোলকাতা থেকে মেইল ট্রেনে চট্টগ্রাম নিয়ে আসে সেটাও বোধগম্য হয় না কারো। এমনকি এই একুশ শতকেও ওরকম ঘটনা কতটুকু সহনীয়?

ছি ছি পড়ে যায় সমস্ত গ্রামে। এ কি অনাচার! সৈয়দবাড়ীর মান ইজ্জত সব গেল। এত দুঃসাহস কি করে হয় তার? জাকের মাষ্টারকে বংশমর্যাদার কারনে একঘরে করা সম্ভব না হলেও তার নবপরিনীতা বধুকে পাড়ায় অবাঞ্চিত ঘোষনা করা হয়। জাকের মাষ্টার কোন মতে তাকে ঘরে তুলতে পারলো না। শেষে পাড়ার বাইরে একটা ঘর বেঁধে আলাদা সংসার পাতে দুজনে। প্রেমের সংসারে বাজার হয়, রান্না হয়, খুনসুটি হয়। হয় প্রতিদিনের নিত্যনতুন রোমাঞ্চ।

২.
কিন্তু শীঘ্রই রোমাঞ্চে বাগড়া দেয় দীপার প্রাক্তন স্বামী।

এক বিকেলে বৃটিশরাজের পুলিশ এসে সমস্ত পাড়া ঘিরে ফেলে। দারোগাবাবুকে নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে কোলকাতা থেকে আগত দীপালীর স্বামী। পুলিশ দেখে দীপালীকে পেছনের জঙ্গলে লুকিয়ে রাখে দীপালীর বড় জা হালিমা খাতুন। গোপনে একমাত্র এই একটা মানুষেরই স্নেহ পেত দীপা। পুলিশ তন্ন তন্ন করে পাড়া তল্লাশি করে। দীপালীর স্বামী চিৎকার করে ডাকতে থাকে "দীপা দীপা" বলে। না পেলে বাড়ী জ্বালিয়ে দেবে বলে হুমকি দেয় পুলিশ।

রাজকীয় পুলিশবাহিনীকে যমের চেয়ে বেশী ভয় পায় মানুষ। কিন্তু সেই ভীতির মুখে ঝামা দিয়ে একটা সাহসী নারী কন্ঠ ভেসে আসে পাশের জঙ্গল থেকে। গ্রামের সমস্ত মানুষ হতবাক হয়ে শোনে মিতবাক তরুনী দীপা উচ্চকন্ঠে ঘোষনা করছে, "আমি স্বেচ্ছায় স্বামী সন্তান পরিবার সব ত্যাগ করে এসেছি। আমি আর কখনো ফিরবো না ওই ঘরে। আমাকে কেউ জীবিত নিতে পারবে না ওই সংসারে।"

উপস্থিত গ্রামবাসী নারী পুরুষ ছেলে বুড়ো পুলিশ দারোগাবাবু সবাই ওই দুঃসাহসী ঘোষনায় স্তব্ধ হয়ে যায়। দীপালীর ওই দৃঢ়তার কাছে হার মেনে ফিরে যায় পুলিশ, পেছন পেছন দীপালীর স্বামীও।

ওই ঘটনার পর দীপাকে ঘরে তোলার অনুমতি পায় জাকের মাষ্টার। দীপা প্রথমবারের মতো মূল বাড়ীতে প্রবেশাধিকার পায়। শুরু হয় নতুন জীবন।

কিন্তু বছর পেরোতেই জাকের এবং দীপার মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে অজ্ঞাত কারনে। কেন যেন জাকের মাষ্টার দীপাকে অবহেলা শুরু করে। প্রাথমিক রোমাঞ্চ কেটে গিয়েছিল বলেই কী? দুরত্ব বাড়তে বাড়তে দৈনিক খিটিমিটি ও চুড়ান্ত বিরক্তিতে পৌঁছে যায় সেটা। তাদের প্রায় ছাড়াছাড়ি হয় হয় অবস্থা। জাকের কেন যেন সহ্য করতে পারছে না আর দীপাকে। অস্বস্তিকর পরিস্তিতি। তখনো দীপা চাইলে ফিরে যেতে পারতো কোলকাতা। বড় জা হালিমা সেরকম প্রস্তাবও করেছিল স্নেহের বশে। কিন্তু দীপা অনড়। সে ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে। এই দেশেই থাকবে সে। যদি জাকের তাকে রাখতে না চায়, তাহলে বিদেয় করে এখান থেকে চট্টগ্রাম শহরে রেখে আসুক। একলাই থাকবে দীপা। কিন্তু কোলকাতা যাবে না কিছুতেই।

একদিন তাই হলো। জাকের মাষ্টার দীপাকে তালাক দিল এবং শহরে রেখে আসলো। রেখে আসা বলা ঠিক না। বলা ভালো শহরের রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসলো চরম অনিশ্চিয়তার মধ্যে। আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসা। এখানে জাকের মাষ্টারকে একটা অমানুষ বলে মনে হয়। কিন্তু সমাজে জাকের মাষ্টার খুবই ভদ্রলোক ছিলেন, আমি নিজের চোখে দেখেছি ওনার অনেক ভালোমানুষিকতা। কিন্তু ওই মানুষটা দীপার সাথে তখন কেন যে ওরকম করলো সেটা এই যুগে বসে বোঝা মুশকিল। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ননা বাদে বোঝা অসম্ভবও। সমস্যা হলো অত আগের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কেউ বেঁচে নেই। প্রায় একশো বছর আগের কথা।

দীপার কথা ভুলে যায় সবাই।

৩.
আরো পঞ্চাশ বছর পর শহরে দীপার সন্ধান পায় তার জা হালিমার এক সন্তান তালেব। খুঁজে বের করে তার হারিয়ে যাওয়া প্রাক্তন চাচী দীপাকে। খুঁজে পেয়ে মাকে আর বোনকে নিয়ে দীপার ঘরে যায়। চটগ্রামের আসকার দীঘির পাড়ে ছোট এক কক্ষের ঘরে নিঃসঙ্গ জীবন পার করছে দীপা। ঘরের একপাশে জায়নামাজ বিছানো, তসবি ঝোলানো দেয়ালে। অন্যপাশে তক্তোপশে পাটির বিছানা। মাথার উপর বেড়ার ছাউনি। তার উপরে টিন। অন্ধকার চার দেয়ালের ভেতর স্বেচ্ছাবন্দী জীবন। বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুজ। সুতার কারখানায় কাজ করেছে বহুবছর। এখন ঘরে বসে নামাজ পড়ে আর সেলাইকর্ম করে দিনযাপন করে। হালিমাকে এত বছর পরে দেখতে পেয়ে চিনতে ভুল করে না একমুহুর্তও। ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে দীপা। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বর্ষা নামে দুজনের। হালিমার মুখ দিয়ে কথা সরে না। কোন মতে বলে-

-আমি তো ভেবেছি তুমি চলে গেছ। কেন তুমি কোলকাতা গেলে না?
-কেন যাবো দিদি, আমি তো যাবার জন্য আসিনি
-জাকের তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে, তুমি কেন রয়ে যাবে?
-জাকের ছেড়েছে আমাকে। কিন্তু আমি তো ছাড়িনি তাকে, তার দেশকে, তার ধর্মকে। আমি সবকিছু ছেড়ে এসেছি তাকে আজীবন জড়িয়ে রাখবো বলে। আমার তো আর কিছু নাই।

এটুকু শুনেই হালিমা বাকরূদ্ধ। তার চোখ ফেটে আবারো জল আসে। সে অশ্রু লুকিয়ে সাথে আনা পিঠে, মিঠাই, নারিকেল, চালভাজা ইত্যাদি দীপার হাতে দেয়। আর বিস্ময়ে চেয়ে থাকে অই মুখটার দিকে। বয়সের বলিরেখা মুখে। কিন্তু কী নিদারুন বিশ্বাস এই নারীর ভেতর। বিশ্বাসের কি শক্তি!! তুলনা করার মতো কোন বস্তু বা মানুষ এই পৃথিবীতে খুঁজে পায় না হালিমা।

৪.
মায়ের মুখে শোনা ঘটনা। হালিমা খাতুন আমার নানী। দীপাও আমার নানী ছিল। নানার ভাইয়ের স্ত্রী। সেদিন হালিমার বাসায় আমার মাও গিয়েছিল। পাকিস্তান আমলের কথা।

নিঃসঙ্গ দীপাকে দেখতে জাকের মাষ্টার কখনো গিয়েছিল কি না কেউ জানে না। তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের আসল কারনও কেউ জানে না। দীপাও কাউকে বলেনি। জীবনের অনেক অমীমাংসীত রহস্যের মতো এটিও চির অমীমাংসিত থেকে যাবে।

দীপা আহমদেরও মৃত্যু হয়েছে বেশ কবছর আগে। জাকের মাষ্টারের আগে আগে। তারা দুজনেই চলে গেছে এক মহান প্রেমের ও বিচ্ছেদের রহস্য অমীমাংসিত রেখে।

ঘটনার এটুকু জেনে মনে হয় জাকের মাষ্টার খুব স্বার্থপরতার পরিচয় দিয়েছিল। কারন সে নিজে আবার বিয়ে করে সংসার নিয়ে সুখে দিন পার করেছে। সমাজে জাকের মাষ্টার ঘৃনিত মানুষ না হলেও পাঠক তাকে নিশ্চিত ঘৃনা করবে এই ঘটনা জেনে। আমিও করেছি যখন দীপার ঘটনাটা জেনেছি।

তবু ঘেন্নাকে ছাপিয়ে বিস্ময়টাই জেগে থাকে বেশী। রহস্যটা জানার অদম্য ইচ্ছেটা জেগেই থাকে। কি এমন প্রেম ছিল তাদের? একটা মানুষ প্রেমের জন্য কতটা ত্যাগ করতে পারে? দেশকালসময়ভেদে প্রেমের প্রকৃতি কি বদলায়? ভিন্নধর্মের দুটি মানুষের সাহসী প্রেম এই শতকেও পরম বিস্ময় জাগিয়ে রাখে আমার চোখে।

পহেলা ফাল্গুনে জ্যৈষ্ঠের স্মৃতিচর্বন

ভয়ানক গরম পড়ছে আজ। জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা দুপুর। ক্লাস শেষে কোনমতে ষ্টেশানগামী শেষ বাসটা ধরে ঝুলে পড়লাম। ষ্টেশানে এসে দেখি ট্রেনে ঠাসাঠাসি ভীড়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুপুর দেড়টার ফিরতি ট্রেনের যাত্রাটা মোটেও সুখকর নয়, বিশেষ করে এই দাবদাহে। কোন বগিতেই সুঁচ ঢোকার জায়গা নেই। বগির পাদানি গুলো পর্যন্ত দুজন করে বসে দখল করে রেখেছে। হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে যাবার আশাও মাঠে মারা গেল।

বিকল্প পথে নাজিরহাটের বাসে যাওয়া যায়। কিন্তু পকেটে আছে সাড়ে সাতটাকার মতো। আড়াই টাকা বাসভাড়া তিনটাকা রিকশা ভাড়া চলে গেলে দুই টাকা দিয়ে বিকেলটা পার করা যাবে না। একটা গোল্ডলীফেই দুইটাকা চলে যাবে। নাহ এই মাগনা ট্রেনই ভালো। আবার ট্রাই দেই।

পেছনের দিকে একটা মালগাড়ীর বগি দেখা গেল, ঢোকা যাবে ওখানে। বাছাবাছি না করে ওখানেই উঠে গেলাম। ওটাও ভরে গেল পাঁচমিনিটে। মালগাড়ীর বগিতে কোন আসন থাকে না। পুরোটা একটা লোহার বদ্ধ খাঁচা বিশেষ। দুপাশে পাঁচফুটের মতো খোলা মালামাল ওঠানামা করার জন্য।(ওরকম মালবাহী বগি ভার্সিটির ট্রেনে যুক্ত করার কোন যুক্তি আমি আজো পাইনি)

মালগাড়ীতে ধরার মতো কিছুই নেই। দুই পায়ের ব্যালেন্সই একমাত্র ভরসা। সেই ভরসায় মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। পুরোনো লোহার জং ধরা বগি। বয়স একশো বছরের কম না। আগাগোড়া মরচে দিয়ে ঢাকা। মাথার উপরে.... পায়ের নীচে... ডানে..... বামে... শুধুই লোহা আর লোহার মরচে। এই গরমে লোহাগুলো যেন ফুটছে, আর আমাদের ফোটাচ্ছে। শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কাবাব হয়ে যাই কিনা।

ট্রেন ছাড়তেই একটু হাওয়ার পরশ মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু ওই হাওয়াটাও বাইরের উত্তাপে তেতে আছে। মালগাড়ীতেও প্রচন্ড ভীড়। একজন আরেকজনের গায়ে ঠেকা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এইছোট্ট জায়গায় ছাত্রছাত্রী পঞ্চাশজনের কম হবে না। সবাই ঘামছে আর হাঁসফাস করছে। আমার অবস্থা একটু বেশীই কাহিল সেদিন। কারন আমি এমনিতেই বাকীদের তুলনায় ছোটখাট আর দাঁড়িয়েছি মাঝখানে। ওখানে বাতাস প্রবেশ করছে না। পুরো শরীর ভিজে চুপচুপে। ঘামে মাথার চুল ভিজে পানি ঝরছে।

তখনো ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ট্রেনের সেই গরমে পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে পারিনি। মালগাড়ীতে আগেও দুয়েকবার উঠেছি। কিন্তু আজকের মতো জঘন্য অবস্থা আর হয়নি। জান বেরিয়ে যায় অবস্থা। ইচ্ছে হচ্ছে ভীড় ঠেলে লাফ দিয়ে নেমে জীবন জ্বালা জুড়াই এই লোহার নরক থেকে। ট্রেন কতক্ষন চলেছে জানি না। হঠাৎ ঘাড়ে একটা বাতাসের পরশ লাগলো। মোলায়েম এবং অপেক্ষাকৃত শীতল। ভাবলাম বাহ্ দারুন তো। এত মানুষের ভীড় সরিয়ে কোন ফাঁকে এই সুমতির বাতাস আমার কাছে পৌঁছে গেছে।

একটু পর পেছনে তাকাতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম, ওটা মোটেও প্রকৃতির হাওয়া নয়। আমার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো পেছনের একটা মেয়ের হাত পাখার বাতাস। মেয়েটার অজান্তেই তার বাতাসের কিছুটা আমার ভাগে চলে আসছে তার কাঁধ পার হয়ে। আমি চুপচাপ ওই অপ্রত্যাশিত বাতাস উপভোগ করে যেতে লাগলাম। সেই দোজখে ওই অচেনা মেয়েটার হাতপাখাটা আমাকে এয়ারকন্ডিশনের মতো স্বস্তি দিল।

ধড়ে যেন প্রান ফিরে এল। ভীষন ভীষন কৃতজ্ঞ বোধ করলাম মেয়েটার প্রতি। পেছনে না তাকানোর ভান করলাম। যেন অনিচ্ছায় বাতাস খাচ্ছি। কিন্তু আরো কিছু সময় পর খেয়াল করলাম বাতাসটা আগের চেয়ে একটু যেন বেশীই লাগছে। পেছন ফিরে আমি তো তাজ্জব!! মেয়েটার হাতপাখা আরো পেছনে এসে আমার ঘাড় বরাবর বাতাস দেয়া শুরু করেছে। সচেতন ভাবে সীমানা লংঘন করেছে হাতপাখাটা। শুধু তাই নয় এবারের বাতাসের প্রায় পুরোটা আমাকেই দিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমি বাতাসের জন্য কিরকম কাঙ্গাল হয়ে আছি। আহ কি মায়া রে। আমি চুপচাপ ওই জায়গায় দাড়িয়ে বাতাসটা দিয়ে প্রান জুড়াচ্ছি আর ভাবছি নামার আগে মেয়েটাকে অবশ্যই একটা বিশেষ ধন্যবাদ দেবো। এরকম একজন মায়াবতীর সাথে পরিচয়ের লোভও হলো।

কিন্তু না। বিধাতার ইচ্ছা ছিল না।

ট্রেনটা ষোলশহর আসতেই মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল বগি থেকে। আমার কিছু বলা হলো না, ধন্যবাদ রয়ে গেল পকেটে। "চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে............." কি এক আক্ষেপ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর চলে যাওয়ার দিকে। এই চল্লিশ মিনিটের যাত্রাপথে এমন মায়াবী হাওয়া দিয়ে যে আমার প্রানটা তাজা রাখলো, তাকে কিছুই বলা হলো না, এমনকি তার চেহারাও দেখলাম না আমি।

হে অচেনা মায়াবতী, আপনার সেই হাত পাখার বাতাসকে আমি এখনো কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরন করি আজ একুশ বছর পরেও।

একটি ভেলা, একটি ঝরনা এবং একটি ভ্রমনের সারসংক্ষেপ

লোকটা কাঠুরে। পাহাড়ী বৃক্ষ থেকে জ্বালানী সংগ্রহ করার জন্য ভেলা বানিয়ে উজানে গিয়েছিল। হিমালয়ের বরফ গলা খরস্রোতা নদী। নদীতীরে বসে ভেলাটা দড়ি দিয়ে ধরে রেখে কাঠুরে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল খানিক। দিবানিদ্রার ঝিমানিতে দড়িটা কখন ফসকে গেল হাত থেকে কাঠুরে টেরই পেল না।

সেইক্ষন থেকে ভেলাটার অনিশ্চিত ভাসন্ত জীবন শুরু। দিন যায়, মাস যায়। ভেলাটি নানান আঁক বাঁক ঘুরতে ঘুরতে কোথাও স্থির হতে পারে না নির্জন পর্বত সংকুল অরন্যে। ভাসতে ভাসতে ছোট্ট একটা উচ্ছল ঝর্নাধারার সাথে মিলিত হলো একদিন। যেখান থেকে হিমালয় প্রবাহের নদীগুলোর জন্ম হয় ঠিক সেইখানে ভেলাটি আটকে ছিল একটা ঝোপের লতায়। ঝরনার আনন্দধারা স্পর্শ করলো ভেলাটিকে। তাই প্রথম সুযোগেই ভেলাটি নিজেকে নিশ্চিন্তে ভাসিয়ে দিল পাহাড়ী ঝরনার একাকীত্বে।

ভাসতে ভাসতে ঝর্নাকে সঙ্গী করে প্রকৃতির বিপুল সাম্রাজ্যকে নতুন চোখে দেখতে পেল সে। ঝর্নাধারা তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল বুনো অর্কিডের সাথে, পাথরে লেগে থাকা প্রায় অদৃশ্য সবুজ শেওলার সাথে, অচেনা ডাকের পাখীদের সাথে, ঘাসের কার্পেট বিছানো উপত্যকার সাথে।

দক্ষিন সাগর থেকে উড়ে আসা মেঘেরা যেখানে বাধা পেয়ে বৃষ্টি ঝরায় একদিন ওরা থামলো সেই খানে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছিল উপত্যকা জুড়ে। ধোঁয়াশা সেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঝর্নাধারা একটা অচেনা অথচ খুব পরিচিত সুরের গান গেয়ে শোনালো তাকে। বৃষ্টি বিষন্ন ভেলাটিকে সেই গান যেন স্পর্শ করলো কোথাও। সেই সাথে বুঝতে পারলো এই আপাতঃ উচ্ছল ঝরনাটির কোথাও লুকোনো ক্ষত আছে একটা।

বৃষ্টি থামার পর আবারো পথ চলা শুরু হলে দেখলো ঝরনার বিষন্ন সুর কেটে গিয়ে তখন উজ্জল রোদ্দুর চিকমিক করছে। দেখে বোঝার উপায় নেই একটু আগে এই ঝরনাটিই করুন সুরে কি গান গেয়েছিল। দিনের পর দিন কলকল করে ঝরনা বয়ে চলে, ঝরনার গান শুনতে শুনতে বয়ে যায় ভেলাও।

পর্বতের উদ্দাম পথ চলা যখন সমতল সন্নিকটে একটু স্থিরতায় এসেছে তখন ভেলাটি ঝরনার কাছে মুখ খুললো, নিজের বহু পুরোনো লুকোনো এক ক্ষতকে উন্মুক্ত করলো ঝরনার কাছে। বেড়ে ওঠার কালে কোন এক আঘাতে তার প্রান বিলুপ্ত হবার পূর্বে সেও ছিল একটা পত্র পল্লবিত সবুজ বৃক্ষ। সেটাই তার আসল পরিচয়। ভেলাটির বর্তমানের পরিচয়হীনতার বেদনা, স্থানচ্যুত হবার বেদনা ঝরনাকে প্রবলভাবে স্পর্শ করলো।

ঝরনা পরম আদরে আশ্রয় দিল ভেলা এবং তার সকল বেদনাকে। একদিন ঝরনারও মুখ খুললো, জানা গেল তারও আছে অজানা বেদনার ইতিহাস। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ভেলাটি আবিষ্কার করলো ঝরনার বেদনা যেন তার চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশী। ঝরনাটি যেই ফল্গু ধারার সাথে বয়ে যাচ্ছিল, এক আকস্মিক ভুমি ধ্বস এসে রূদ্ধ করে দিয়েছিল তার অগ্রযাত্রা। প্রানবন্ত ধারাটিকে মাঝ পথে হারিয়ে ফেলে দিশেহারা মুমূর্ষু হয়ে পড়ে ছিল ঝরনাটি। ঠিক সেই সময়ে ভেলাটিও এসে আটকে গিয়েছিল ঝরনার কাছাকাছি লতাঝোপে।

নতুন মেঘের বৃষ্টিতে যখন ঝরনার বুকে স্রোতের জন্ম হলো, তখন ঝরনাটি প্রান পেল, প্রান পেয়ে প্রথম চোখ মেলে দেখলো ভেলাটিকে। নিঃসঙ্গতা কাটাতে ভেলাকেই তার সব গান শুনিয়ে যায় ঝরনা। ভেলাটিও এতদিন পর পথ চলার আনন্দ পেল। দুজনের একসাথে পথ চলা সেই থেকে শুরু। গন্তব্য অনিশ্চিত জেনেও পথ চলা থামে না। কারন এ ভ্রমন কেবলই ভ্রমন। এ ভ্রমনের কোন গন্তব্য নেই, আছে কেবল আনন্দ।